পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
আজ থেকে ২০০বছর আগের কলকাতা আর আজকের কলকাতার মধ্যে যে কয়েকটি মিল এখনও রয়েছে তারমধ্যে অন্যতম হলো কলেজ স্ট্রিট। বউবাজার অঞ্চলের গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ'র মোড় থেকে মহাত্মা গান্ধী রোডের মোড় পর্যন্ত প্রায় ১.৫ কি.মি. রাস্তাই হলো কলেজ স্ট্রিট । পুরানো কলকাতায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ব্রিটিশরা একসাথে চারটি পাকা সড়ক বানানোর কাজে হাত দিয়েছিলেন। কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, ওয়েলিংটন স্ট্রিট এবং ওয়েলেসলি স্ট্রিট।এগুলির মধ্যে কলেজ স্ট্রিটের নামটাই শুধু বদল হয় নি বাকি তিনটি নামই পাল্টে গেছে সময়ের দাবীতে। এই দেড় কিমি রাস্তার নাম কলেজ স্ট্রিট হওয়ার প্রধান কারণ অনেকগুলি বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়, হেয়ার স্কুল, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ইত্যাদির অবস্থান এখানে। এছাড়াও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম 'সেকেন্ড-হ্যান্ড' বইয়ের বাজার এবং ভারতের বৃহত্তম বইয়ের বাজার হ'ল এটি। এটি মানে কলেজ স্ট্রিটের দুপাশের দোকানগুলি। একের পর এক ছোটো বড় বইয়ের দোকান আর প্রকাশনী নিয়ে গড়ে ওঠা 'বই পাড়া' বঙ্গ তথা ভারতের শিক্ষা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান।
গত দুশো বছর লাখো লাখো পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়ে এখন যেন একটু ক্লান্ত কলেজস্ট্রিট। অন্তত তেমনটাই মনে হয় হাজারো দোকানের ভিড়ের একটি দোকান 'বাণী ভান্ডার'এর বর্তমান মালিক শুভজিৎ সাহার। এই বাণী ভান্ডারের সূচনা শুভজিৎ বাবুর ঠাকুরদা স্বর্গীয় মণীন্দ্র মোহন সাহার হাত ধরে। তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়শন পাশ করা মণীন্দ্র বাবু অন্যদের মতো সরকারি-বেসরকারী চাকরীর পথে হাঁটেননি। চিরকালীন বইপ্রেমী মণীন্দ্র সাহা প্রেসিডেন্সীতে পড়া এবং বইপ্রেমের সুবাদে কলেজস্ট্রিটের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন। সেই সান্নিধ্যের জন্যই কলেজস্ট্রিটে একটা ছোটো ৭ ফুট বাই ৫ফুট দোকানঘর কিনতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। সেটা ১৯৬২সাল, তখন চাকরীর থেকে স্বাধীন ব্যাবসার মান বেশী ছিলো আর খাস কলেজস্ট্রিটে বইয়ের দোকান হলে তো কথাই নেই। বইয়ের কদরও ছিলো তুঙ্গে । পড়ার বইয়ের চেয়েও চাহিদা বেশী থাকতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপহার দেওয়ার বই, বিখ্যাত সাহিত্যিকের রচনা সমগ্র, কিশোর উপন্যাস ইত্যাদির। মণীন্দ্র বাবুর ব্যবসা ভালোই চলত। তাই ৭এর দশকের প্রথম দিকেই তৎকালীন সোদপুরে ৫কাঠা জমি কিনে একটি বাড়ি তৈরী করতে সক্ষম হয় দেশ ভাগের সময় উদ্বাস্তু হয়ে আসা সম্বলহীন সাহা পরিবার। প্রথম কেনা পাঁচ ফুট বাই ৭ফুটের দোকানের থেকে দুটো দোকান পরে আরও একটা ওই একই মাপের গুমটি কেনেন তিনি, ওটা অতিরিক্ত বই রাখতে ব্যবহার করা হতো।
ধীরে ধীরে কালের নিয়মে মণীন্দ্র মোহন বাবুর ছেলে অর্থাৎ শুভজিৎ বাবুর বাবা পরিতোষ বাবু ব্যবসার মালিক হন। তখনও বই ব্যবসার সুদিন চলছে। এক তলা বাড়িকে দোতলা করেন তিনি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ফ্রিজ, রঙিন টিভি, ওয়াসিং মেশিন সবই কেনা হয় ওই দোকানের রোজগারেই। ২০০০ সালে যখন ছেলে শুভজিৎ ক্লাস ফাইভে পড়তো তখন পাড়ার মধ্যে প্রথম মোবাইল ফোন কেনেন পরিতোষ বাবু। নতুন সহস্রাব্দের প্রথম পয়লা জানুয়ারী এক বেলা দোকান খুলেছিলেন পরিতোষ বাবু। ছোট্ট শুভজিৎ শীতের বিকেলে মা আর দাদার সাথে সোদপুর থেকে শিয়ালদহ গেছিলো ট্রেনে। সেখানেই অপেক্ষা করছিলেন পরিতোষ বাবু । তারপর চারজন মিলে ঘুরতে গেছিলো মিলেনিয়াম পার্ক। এই পার্ক তখন এক্কেবারে নতুন, মাত্র পাঁচ দিন আগে উদ্বোধন করা হয়েছিলো। ঝাঁ চকচকে নতুন পার্কে শুভজিৎ আর তার দাদা ক্লাস এইটে পড়া দেবজিৎ একেবারে আত্মহারা হয়েগেছিলো। তবে আসল চমক তখনও বাকি ছিলো তাদের জন্য । পার্ক থেকে বেরিয়ে শিয়ালদহ যাওয়ার পথে এসপ্ল্যানেড আর ধর্মতলার মাঝে বাস থেকে নেমে সপরিবারে একটা ইলেক্ট্রনিক্স দোকানে ঢুকেছিলেন পরিতোষ বাবু। সেখানেই কেনা হয়েছিলো একটা মোবাইল ফোন। মোবাইল তখন অপার বিস্ময় শুভজিৎদের কাছে। বাড়িতে ল্যান্ড লাইন ফোন ছিলোই, পরিতোষ বাবু নিজের কাছে রাখতেন মোবাইলটা। কতদিন স্কুল থেকে ফিরে এমনি এমনি বাবাকে ফোন করতো শুভজিৎ আর তার দাদা। আর বাবা বাড়ি এলে মোবাইল নিয়ে 'স্নেক' গেমটা খেলতো তারা। একটু খেললে কিছুই বলতেন না পরিতোষ বাবু, কিন্তু বেশী খেললেই জুটতো বকুনি । তবুও কি এক অমোঘ টান ছিলো ওই বক্স বক্স সাপ আর তার খপ খপ করে পয়েন্টের টোপ খাওয়ার মধ্যে । তখন কি আর শুভজিৎরা ভেবেছিলো বা বুঝেছিলো যে ওই বক্স বক্স সাপটা একটা রূপক মাত্র! কিছু দিনের মধ্যেই ওই সাপের মতো টপাটপ ঘড়ি, ক্যালকুলেটার, FM রেডিও, ক্যালেন্ডার সহ একের এক জিনিস খেতে লাগলো মোবাইল আর পেঁচিয়ে ধরতে লাগলো দৈনিক অবসরের সময়গুলোকে। দিন কাটতে লাগলো নিজের খেয়ালে। ২০১২ সালে ইতিহাস নিয়ে M.A. করলো শুভজিৎ । আগের বছর দাদা সল্টলেক সেক্টর ফাইভে একটা বেসরকারি চাকরিতে জয়েন করেছে। তারও ইচ্ছা চাকরী করার। M.A. পাশ করেই সময় নষ্ট না করে B.Ed করতে ঢুকে গেল। সাথে সাথেই নানা সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে লাগলো। তবে মূল লক্ষ্য শিক্ষকতা। ২০১৪তে B.Ed শেষ করে নিজের হাত খরচ চালাতে দুটো মাধ্যমিকের ছেলেকে ইতিহাস পড়াতে শুরু করলো। এতে হাত খরচের সাথে সাথে পড়ার চর্চাটাও থাকে। বাবার মুখে শুনছে বই ব্যবসাতে নাকি মন্দা চলছে, লোকে আর বই পড়ে না। সেটা অবশ্য নিজেকে দিয়েও বোঝে শুভজিৎ । বছর কয়েক আগে গল্পের বইয়ের বিক্রি কমলেও ক্লাস ফাইভ থেকে M.A অবধি পাঠ্য বই ঢেলে বিক্রি হতো। কিন্তু এখন সরকার থেকে ক্লাস এইট অবধি বই ফ্রীতে দিচ্ছে, এতে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অনেক সুবিধা হলেও মার খেয়েছে বই দোকানদার আর পাবলিসাররা। ওদিকে কলেজের বই বিক্রিও কমে গেছে কারণ নোটস। নোটস নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার ফলে বই কেনাটাই প্রায় বন্ধের মুখে। মোবাইলে সহজলভ্য PDF আর জেরক্স শেষ ধাক্কাটা দিলো বই ব্যবসাকে। গুদাম ঘর হিসেবে ব্যবহৃত দোকানটা ১০লাখ টাকায় বিক্রি করে দিলেন পরিতোষ বাবু। তার ৮লাখ একটা MIS করে রাখলেন পোস্ট অফিসে।
সব মিলিয়ে এক সময়ের সম্মানজনক পেশা বই ব্যবসা আজ অতীতের ছায়ামাত্র।
ওদিকে ২০১৫ তে আপার প্রাইমারী পরীক্ষা বেশ ভালোই দেয় শুভজিৎ । টেট পরীক্ষায় পাশ করেও যায়! দাদা আগেই চাকরী পেয়ে গেছে, সেও পেয়ে যাবে এবার তাহলে ধুঁকতে থাকা বই ব্যবসা আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিলেই হবে।
মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। ২০১৬ পেরিয়ে ২০১৭শেষ হতে চললো পাশ করে থাকা পরীক্ষা থেকে রিক্রুটের কোনো খবর নেই। অন্য চাকরীর পরীক্ষাতেও সোজা পথে হওয়া মুস্কিল। কেমন যেন একটা হতাশা গ্রাস করতে থাকে তিন বছর বেকার থাকা শুভজিৎকে। দুটো থেকে বাড়িয়ে ছ'টা টিউশন ধরে, তার মধ্যে দুজন H.S.এর।
এরই মাঝে এক দুর্যোগ নেমে আসে তাদের সংসারে। হঠাৎই মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয় পরিতোষ বাবুর। সপ্তাহ খানেক হাসপাতালে থেকে ছাড়া পান, কিন্তু ডাক্তার বলেন মোটামুটি রেস্টে থাকতে, ডেলি প্যাসেঞ্জারী না করতে। কিন্তু তাহলে সংসার চলবে কি করে? বড় ছেলের সাধারণ ১১-১২ হাজার টাকা মাইনার বেসরকারি চাকরি আর ছোটো ছেলের টিউশনির হাজার চারেক টাকায় কিছুই হয় না। বই দোকান থেকে প্রায় কিছুই হয় না আয় এখন, তবুও কিছু তো হয় । অগত্যা ছোটো ছেলে শুভজিৎকেই বই ব্যবসায় নামতে হয় । ২০১৮র শুরু থেকেই নতুন জীবন সংগ্রাম শুরু হয় শুভজিতের। ছ'টা টিউশন কে দুজন করে তিনটে ব্যাচে ভাগ করে দেয় এবং প্রতিটি ব্যাচকে বর্তমান প্রথা অনুযায়ী সপ্তাহে দুদিন দেড় ঘন্টা করে পড়াতে (নোটস গেলাতে) শুরু করে পুরো প্রফেশনাল স্টাইলে। সোম, বুধ সকালে এবং মঙ্গল, বৃহস্পতি ও বৃহস্পতি, রবি রাতে। যে দু'দিন সকালে সে দু'দিন ভোর সাড়ে ছটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাতটা থেকে টিউশন শুরু করে এবং পৌনে নটার ট্রেন ধরে শিয়ালদহ গিয়ে দশটায় দোকান খোলে। বাকি দিনগুলো সাড়ে সাতটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ৭:৫৫এর ট্রেন ধরে সাড়ে ন'টায় দোকান খোলে। যে চারদিন রাতে পড়ানো সে দিন গুলো সাড়ে ছটা নাগাদ দোকান বন্ধ করে সোদপুর ফিরে আটটা থেকে সাড়ে নটা অবধি পড়ায়। বাকি দিনগুলো সাড়ে সাতটা অবধি দোকান করে নটার মধ্যে বাড়ি ঢোকে। মাঝে মাঝে ভাবে ভাগ্যিস তাদের বাড়ি বেলঘরিয়া বা দমদম নয়, হলে ট্রেনে চাপতে রোজ দম বেরিয়ে যেত আর সিটও পেতো না কোনওদিন । বৃহস্পতিবারটা বড্ড চাপ যায় । সেই জন্যই শুক্র, শনি এই দুটো দিন টিউশন রাখেনি সে। পরিতোষ বাবুর ঘরে চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগেনা। তাই বই ব্যবসার দুই চরম শত্রু মোবাইল আর জেরক্সকে আপন করে নিয়েছেন তিনি । তাদের বাড়ির মোট সাতটি ঘরের মধ্যে যেটা রাস্তার সবচেয়ে কাছে মানে বাইরের ঘর সেটাতে মোবাইল রিচার্জ আর জেরক্সের ব্যবসা শুরু করেছেন। আর একটি ঘরে দুটো ছেলে ভাড়া নিয়ে থাকে মেসের মতো। মাসে ৫হাজার টাকা দেয় । MIS এর সুদটাও দিনদিন কমে যাচ্ছে মারাত্মক ভাবে।
প্রথমদিকে রিচার্জটা ভালোই চলছিলো কিন্তু এখন বয়স্ক মানুষ ছাড়া রিচার্জ করতে তেমন কেউ আসেই না। কি সব অ্যাপস আছে মোবাইলে তার থেকে নিজেরাই রিচার্জ করে নেয়। জেরক্সটা চলে টুকটাক। পরিতোষ বাবু ভেবে পাননা মোবাইল আরও কত কিছুকে খাবে! একই জিনিস ভাবে শুভজিতও। দুবছরের বেশী হলো সে বই ব্যবসায় নেমেছে, বাজার খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে । এমনও দিন যায় যে সারাদিনে ৫০০টাকার বই বিক্রি হয় না, মানে লাভ থাকে ২৫-৩০টাকা! সারা দিন খেটে ৩০টাকা রোজগার বড্ড ধাক্কা দেয় তাকে। তাদের প্রায় ২লাখ টাকা দামের বই জমে আছে এদিকে বিক্রি প্রায় বন্ধ । প্রথমদিকে কোন বই ভালো বিক্রি হবে সেটা নিয়ে ভাবত সে। কম্পিউটার শিক্ষার কয়েকটি বই কিনেছিলো, কিন্তু দুটো বাদে সব পড়ে আছে। কম্পিটিটিভ পরীক্ষার বই আনালো একবার এগুলো কিছু বিক্রি হলো ঠিকই কিন্তু মার্জিন বড্ড কম। সারাদিনে পাঁচটা বিক্রি হলে পঁচিশ টাকা লাভ হয় । তাই গত মাস চারেক একটাও বই কেনেনি শুভজিৎ, কেউ কিনতে এলে সে বই না থাকলে চিরকূট লিখে নিয়ে আসে এখন। মাঝে মাঝে ভাবে এই লাখ দুয়েক টাকার বই আর এই দোকানটা বিক্রি করলে ১২-১৪ লাখ টাকা পাওয়া যাবেই। বিক্রি করে দিয়ে মোবাইল বা অন্য কোনো ব্যবসা শুরু করলে হয় সোদপুরেই। বাস্তবে সে কলেজস্ট্রিটে বই ব্যবসা করছে বটে কিন্তু টিউশনির টাকাটাই বড় ভরসা তার। এই দোকান থেকে তার ৫-৬ হাজার টাকার বেশী আয় হয় না কোনো মাসেই। ২০১৯এ দাদার বিয়ে হয়েছে, সংসারের খরচ বেড়েছে কিন্তু বাবা, দাদা আর সে তিনজন রোজগার করেও কুলোতে পারছে না। নতুন বৌদিও ব্যাপারটা বুঝেছে, তাই দু-তিনবার নিজের বুটিকের ব্যবসা শুরু করার কথা বলেছে এর মধ্যেই ।
এই ভাবেই কোনোমতে দিন কাটছিলো সোদপুরের সাহা পরিবারের । এরই মধ্যে হঠাৎ হানা দিলো বিশ্বব্যাপী অতিমারী করোনা। সব দেশের দেখাদেখি ভারতেও শুরু হলো লকডাউন । সোদপুর থেকে কলেজস্ট্রিট রোজ যাওয়াটাই অলীক কল্পনাতে পরিনত হলো কারণ ট্রেন বাস সব বন্ধ । আর গিয়েও বা কি হবে? কলেজস্ট্রিটের সব কলেজসহ বই দোকান সবই তো বন্ধ । লকডাউন হওয়ার পর টিউশনটাও খাপছাড়া হয়ে গেল। একজন ছাড়া বাকি অভিভাবকরা সোস্যাল ডিসটেন্স মেইনটেন করার জন্য পড়ানো বন্ধ রাখতে বললেন আর শুভজিতও সাবধানতা অবলম্বন করে চলাটাই সেফ মনে করলো। মাসের ৪ থেকে ১০তারিখের মধ্যেই সবার মাইনা দেবার সময় । ভাগ্যক্রমে সবাই ঠিকঠাক মাইনাই দিলো এপ্রিলের শুরুতে। কিন্তু ১৪ই এপ্রিল লকডাউন না উঠে আরো বেড়ে গেল। যে দোকান থেকে কিছুই রোজগার হয় না ফলে হা হুতাশ করে শুভজিৎ বাবু, সেই দোকান এতদিন বন্ধ থাকায় বুঝতে পারে যে ৫-৭ হাজার টাকার মূল্য কতটা তাদের টানাটানির সংসারে। গোটা এপ্রিলে অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হতে লাগলো। মে-এর শুরুতে সবকটা টিউশন থেকে টাকাও পেলো না ঠিক মতো। আসলে গত একমাস একদিনও পড়ানো হয়নি তাই তিনজন হাফ বেতন দিলেন, একজন ফুল দিলেন। আর বাকি দুজন একেবারেই দিলেন না। তার মধ্যে একজন না হয় ছোটো কাপড় ব্যবসা করেন দোকান বন্ধ তাই রোজগার নেই ফলে টাকা দিতে পারবেন না সেটা বললেন। কিন্তু অন্যজন তো সরকারি কর্মচারী, মাইনা পুরোই পাচ্ছেন তবুও এক পয়সা দিলো না! না পড়ালে পয়সা কিসের এই কথা বলে দিলেন অথচ নিজে ঘরে বসে মাইনা নিচ্ছেন। অদ্ভুত মানুষ সব। মাইনা না পাওয়ায় বেশ বেকায়দায় পড়লো সে। ফলে নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক পড়া এসব বজায় রাখলেও অবার টিউশন শুরুর চেষ্টা করতে লাগলো। তিনজনকে পড়ানো শুরুও হলো। এদিকে করোনা সংক্রমণে প্রতিদিন রেকর্ড করেই যাচ্ছে ভারত! কোথায় গিয়ে থামবে কে জানে? চতুর্থ দফার লকডাউন চলছে, কবে যে সব স্বাভাবিক হবে কে জানে, আদৌ হবে তো নাকি সব মরে ভূত হবে আতঙ্কে সেটাই ভাবে সে মাঝে মাঝে। তবে মরুক বা বাঁচুক লকডাউন দ্রুত ওঠাটা জরুরী না হলে ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকবে না। টিভিতে আর মোবাইলে শতকরা ৯০ভাগ খবর ডাইরেক্ট বা ইনডাইরেক্ট ভাবে করোনার সাথে জড়িত । কিন্তু মে মাসের ১৭-১৮ তারিখের দিকে করোনাকে একটু পাশে সরিয়ে হঠাৎই একটু নিজস্ব জায়গা করে নিলো 'আমফান' নামে এক ঘূর্ণিঝড় । কোথাও তার নাম উমপুন কোথাওবা আম্পান। যাইহোক নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী ২০মে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমফান। যতক্ষণ কারেন্ট ছিলো ততক্ষণ TVতে দেখেছে কিভাবে সব তছনছ করে ছুটে আসছে ঝড় । তারপর কারেন্ট চলে গেল, চলে গেলো মোবাইলের নেটওয়ার্ক । সেদিন সারাটা সন্ধ্যা আর রাত যে কিভাবে কাটলো জানেনা কেউ। প্রকৃতির তান্ডবলীলা কি জিনিস চাক্ষুষ হলো সেদিন। পরদিন সকালেও কারেন্ট নেই, ট্যাঙ্কে ওঠেনি জল। সারাটা দিন খবর পাওয়া গেলোনা কিছুর কারন মোবাইলে টাওয়ার নেই আর কারেন্ট নেই, বাস ট্রেনও চলছে না যে বাইরের খবর আসবে। ২২তারিখ সকালের পেপারে একটা ছবির দিকে চোখ যেতে আঁতকে উঠলো! কলেজস্ট্রিটের একটা ছবি, তাতে তাদের দোকানটাও দেখা যাচ্ছে একটু আর গোটা রাস্তায় কাগজের নৌকা নয় ভেসে বেড়াচ্ছে ছোটো বড় নানা বই । মোবাইলে টাওয়ার আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, কারন পাওয়ার ব্যাঙ্ক সহ মোবাইলে চার্জ শেষ।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্টেশন মোড়ে গেল শুভজিৎ । ওখানে এক বন্ধুর বাড়িতে ইনভার্টার আছে। ওর ফোনে নিশ্চিত চার্জ থাকবে। সেই ফোন হাতে নিয়ে 'বাণী ভান্ডার'এর পাশের এক দোকানদার করে ফোন করলো শুভজিৎ । ওনার বাড়ি লেবুতলা পার্ক। ফোন করে যা খবর পাওয়া গেলো তাতে শুভজিৎ সাহা স্পষ্ট বুঝলো যে ২০০বছর লোকের মুখে হাসি ফুটিয়ে ক্লান্ত কলেজ স্ট্রিটের বই বাজারের অবসর নেওয়ার সময় চলে এসেছে।
লেখা #সমীরণ_কুন্ডু_আদ্রা
(লেখাটি কয়েক মাস আগে লেখা, 'এখন শঙ্খ' পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম যদি ছাপে এই আশায়। এই গল্পটিসহ বইটি প্রকাশিত হয়েছে দুমাস আগে। তাই আজ পোস্ট করলাম। ধন্যবাদ এখন শঙ্খ পরিবারকে )
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |