এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ট্যালেন্ট হান্ট

    Parikshit Manna লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৯ নভেম্বর ২০২০ | ৮১৪ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • "কদ্দুর রে তোর বাড়ি? আধঘন্টা ধরে হেঁটেই চলেছি! বললি, সামনেই! এটা তোর সামনে? তেমন বুঝলে টোটো নিতাম!" - রুক্ষ গলায় বলল সোহম।


    "আলের ওপর দে টোটো!" -হাসল মিনু।


    সাতসকালে ট্রেনে চড়ে, শুধু কেক আর চা চলেছে। সাঁইথিয়া স্টেশনে নেমে থেকে হেঁটেই চলেছি!


    কেন? শুনুন তবে।


    আমরা প্রতিভা খুঁজে বেড়াই। গ্রামে, শহরে, পাড়ায় পাড়ায়। আমি আর আমার ফটোগ্রাফার বন্ধু সোহম। একটু পাগলাটে বিষয় বটে, কিন্তু পয়সা আছে! সাধারণ আইটেমকে আইডল বানিয়ে মার্কেটে ভাইরাল করতে পারলেই ভাল কমিশন! চ্যানেলগুলোতে তো "ট্যালেন্ট হান্ট" প্রোগ্রামটা এখন সুপারহিট!


    ভারী মিষ্টি গানের গলা বছর দশেকের মেয়েটার। ট্রেনে গান গেয়ে ভিক্ষে করছিল। কুড়িটা টাকার বিনিময়ে কতগুলো বাউল গান পরপর শোনালো! ঠিক করলাম ওকেই প্রোজেক্ট করব! তাই ওর বাড়ি যাচ্ছি ওর মা-বাবার সাথে কথা বলতে।


    পথে একটু জলযোগ করতেই হল। চা শেষ করে সিগারেট জ্বালিয়েছে সোহম। মিনু এখনো কচুরি খেয়ে যাচ্ছে। এই বসন্তেও কি ঝাঁঝ এখানকার রোদের! মাটিতে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে ইহকাল পরকাল সবটা শুষে নেবে! 


    মেটে রঙের খড়ছাওয়ানো ঘরটা আমার চেয়েও বেঁটে! আদুল গায়ে, তেলচিটে গামছা পরা, কালো, মাঝবয়সী লোকটা বেরিয়ে এসে আমাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে!


    "আমি মিনুর বাপ্। আপনেরা?"


    "আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। টিভি চ্যানেল!ট্রেনে আপনার মেয়ের গান শুনে ভাল লাগলো। তাই "ট্যালেন্ট হান্ট" অনুষ্ঠানের জন্য ওকে নিয়ে যেতে এসেছি। যদি আপনারা অনুমতি দ্যান, তাহলে ওকে আমরা কদিনের জন্য কলকাতায় নিয়ে যাবো। সাথে ওর মা-ও যাবেন।"


    কালো, তোবড়ানো গাল, গামছা পরিহিত মানুষটার দৃষ্টিতে এখনও ভ্রু-কুঞ্চন!


    "টিভি? তা আমাদের তো টিভি লাই বটেক্!"


    "ও! ঠিক আছে। টিভি পাবেন মিনু সিলেক্ট হলেই!" সোহম বলে উঠল।


    "মেয়ে, মা দুজনাকেই লিয়ে যাবেন? সে হবেক লাই! আমার চলবে কি করে? মেয়ের রোজগার। ওর মা না থাকলি রাঁধবে কে? বাচ্চাগুলোরে দেখবে কে? না বাবু। ওসব ট্যালেন হান আমার লাগবে নে। আমাদের তো ঐ মেয়ের ভিক্ষে আর ওর মা'র ঠিকে কাজ! একশো দিনের কাজটাও তো রোজ জোটে না! গরীবের ঘরে ওসব টিভি ফিভি লাগবে নে গো!"


    বললাম - "আরে অত ভাববেন না? আপনার মেয়ের গানের গলা খুব ভালো! একবার সিলেক্ট হলেই দেখবেন অনেক টাকা রোজগার হবে! তখন কোনো চিন্তাই থাকবে না!"


    কালো লোকটা কি একটা ভাবলো!


    "না বাবু। ওর গান রেলের বগিতেই চলুক্। রোজ পঞ্চাশ ষাট কামাই আছে বটেক্। ও আমি ছাড়তে পারবো না।"


    মিনুর বাপ ঘরে সেঁধিয়ে গেল নমস্কার জানিয়ে। পরিস্থিতি নেগেটিভ। ফিরে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। আলপথে ব্যালেন্স করছি, হঠাৎ....


    "বাবু! একটা কথা!"


    মিনুর বাপের গলা! মানলো তাহলে! যাক্ বাবা!


    "বলুন?"


    "আপনেরা মিনুকে এক্কেরে নিয়ে যান না কেনে! আমরা ফেরৎ চাইবো না! ভাববো মরে গেছে! বদলে বুঝে শুনে একটা টাকা দে যান! সত্যি বলছি! কক্ষনো চাইতে আসবো নে! আপনেরা যা খুশি করবেন ওকে নে! কিচ্ছু বলবো নে! শুধু কটা টাকা.... আমরা খুব গরীব বাবু! খুব!"


    আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে! রোদের হলকায় পাঁজর পুড়ছে! নাকি ট্যালেন্ট পোড়া গন্ধ?


    কোনো জবাব না দিয়ে ফিরে যাচ্ছি। পিচরাস্তায় মিনুর সাথে দেখা। একটা পাঁচশো টাকার নোট ওর হাতে দিয়ে সোহমকে বললাম চল্, "আগে টোটো পেয়ে যাবো।" 


    টোটোর লুকিং গ্লাসে মিনুর মুখটা ক্রমশ ছোট্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিভা মিলিয়ে যাচ্ছে সূর্যাস্তের মত। চোখের সামনে কালকূটের লেখাটা ভেসে উঠছে যেন -


    "অমৃতের সন্ধানে গিয়েছিলাম। কি নিয়ে ফিরছি, জানি না। চোখের জল যে এতো লবণাক্ত, তা আগে কখনো টের পাইনি।"


                       


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন