এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • চরণদাস চোর (বিখ্যাত ছত্তিশগড়ি লোকনাট্যের কাহিনীরূপ)

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ অক্টোবর ২০২০ | ৩১৩১ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)
  • চরণদাস চোর

    [ প্রখ্যাত হিন্দি সাহিত্যিক বিজয়দান দেথা’র কাহিনীর অবলম্বনে দিকপাল নাট্যব্যক্তিত্ব ছত্তিশগড় রায়পুরের হাবিব তনবীর গড়ে তুলেছিলেন এক নাট্য প্রযোজনা ‘চরণদাস চোর’। হাবিব স্বয়ং লন্ডন এবং ব্রিস্টলে ব্রিটিশ রয়াল আকাডেমি অফ ড্রামাটিক আর্টস ইত্যাদিতে আধুনিক নাট্যকলায় শিক্ষিত হলেও জর্মনীতে বার্টল্ট ব্রেখটের থিয়েটার ‘বার্লিনার এন্সেম্বল’ এর প্রযোজনা তাঁকে সবচেয়ে প্রভাবিত করেছিল বলে মনে হয়। ফিরে এলেন ছত্তিশগড়ে নিজের শেকড়ে, এবং গাঁয়ের লোকনাট্যের শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘নয়া থিয়েটার’। দলটির শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা ‘চরণদাস চোর’ --যা রবিন হুডের মত এক জনপ্রিয় চোরের গল্প--ওঁর হাতে হয়ে দাঁড়াল ছত্তিশগড়ি লোকনাট্য, এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে গেল গ্রামাঞ্চলে ।

    এই নাট্যপ্রযোজনাটি ১৯৮২ সালে এডিনবার্গ ইন্টারন্যাশনাল ড্রামা ফেস্টিভ্যালে ফ্রিঞ্জ ফার্স্ট অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত হয়েছিল।

    বর্তমান লেখাটি সেই নাট্যের মূল কাহিনীকে অবিকৃত লেখে বাঙালী পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সামান্য প্রচেষ্টা মাত্র ।]



    ব্যাটা, নামটা কী রে তোর ?

    আমি? চরণদাস চোর!

    সে বছর ভারি আকাল। সেটা কোন বছর? আরে যেবার ইন্দ্র ভগবান খুব রাগ করেছিল, জষ্টি-আষাঢ় মাসেও আকাশ থেকে আগুন ঝরছিল আর ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে গাঁয়ে পোখর মানে পুকুর আর কুয়ো শুকিয়ে যাচ্ছিল, লোকে খাবার জল পাচ্ছিল না তো চাষের জল!

    তাহলে তো আমার বাবার আমল। তখন কুমারী, হসদেও, আহিরণ, মনিয়ারী, জোঁক – এইসব নদিতে জায়গায় জায়গায় স্টপ ড্যাম হয় নি , বাঁধ তৈরি হয় নি এবং সেচের জন্যে খালকাটা হয় নি ।

    সেই কথাই তো বলছি ; তখন ছত্তিশগড়ে প্রতি তিনবছরে পালা করে ‘দুকাল’ হত , মানে আকাল পড়ত। গরীব মানুষ খেতখামারে কাজ পেত না । তাই মাটির দেওয়াল, খাপরার ছাদের ঘরে কাঠের দরজায় শেকল লাগিয়ে তালা ঝুলিয়ে কাঁথা -কাপড় পোঁটলা বেঁধে বউ -বাচ্চা-মাঈ-পিলা সমেত গাঁ ছেড়ে পালাত। কোথায় যেত ?

    আড়কাঠি যেখানে কাজের ভরসা দিয়ে নিয়ে যেত । সে দিল্লি-হরিয়ানা-রাজস্থান হতে পারে অথবা কলকাতা । তা কীরকম কাজ পেত? কতরকম কাজ! তবে বেশিরভাগ ইঁটভাটা নয়ত বাড়ি তৈরির কাজে রেজা-কুলি। থাক গে ওসব। এখন অমন দলে দলে গাঁ ছেড়ে ‘পলায়ন’ করে না । কথা না বলে গল্প শোন ।

    তা আকালের মার সেবার একটু বেশিই হয়ে গেছল। ঘরে ঘরে হাহাকার। বেড়ে গেল চুরি-চামারি। গরু-বাছুর, ধুতি-পাঁচহাত্তি-পটকু এমনকি মেয়েদের শাড়ি – সায়া- বেলাউজও বাদ যাচ্ছে না। টাকাপয়সা সোনাদানা তো গরীবের নেই , যাদের আছে তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে এক ব্যাটা! নাম তার চরণদাস চোর । তাকে কেউ আজ অব্দি ধরতে পারে নি । সে অতিচালাক, ছদ্মবেশ ধরায় নিপুণ। পুলিশের জালে চুনোপুঁটি ছিঁচকে চোর ধরা পড়ে , কিন্তু চরণদাস ঠিক পাঁকাল মাছের মত পিছলে বেরিয়ে যায় ।

    এমনসময় হল কি , এক বড়মানুষের বাড়ি থেকে চুরি গেল সোনার থালা । এবার রাজ্যের টনক নড়ল। রাজা নেই , ভরা যৌবনে বিধবা রাণী কড়া হাতে রাশ ধরেছেন। যে কোতোয়াল বা হাবিলদার চোর ধরে আনবে , সে পাবে পুরস্কার।

    চতুর সিং সারাজীবন চৌকিদারি করে শেষবয়সে হাবিলদার হয়েছে। সে আদাজল খেয়ে লেগে গেল চোরের খোঁজে। জষ্টিমাসের ভরদুপুরে মোতিপুর গাঁয়ের চৌপা্লের পাশ (চন্ডীমন্ডপ) দিয়ে যাবার সময় ওর চোখে পড়ল একটা লোক ইতিউতি চাইতে চাইতে চলেছে এবং তার পিঠে একটা বড় কাপড়ের বোঁচকা । ও একটা ঘরের আড়াল থেকে নজর রাখছিল। এ চোর না হয়ে যায় না । নইলে কার দায় পড়েছে এই গরমে পথে নামতে!

    তক্কে তক্কে থেকে বাঁকের মাথায় চতুর সিং জাপটে ধরল চোরকে । এক হ্যাঁচকায় বোঁচকার মুখ খুলে যেতেই বেরিয়ে পড়ল গাদা গাদা কাপড়।

    ব্যাটা চোর! আমার এলাকায় সমানে চুরি! তুই ভেবেছিস কি ! দেখ তোর কী করি !

    এবার আমি তোর মাথা কেটে তোরই হাতে ধরিয়ে দেব । কাটামাথা হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি যাবি।

    চোর হাপুস নয়নে মারে-বাবারে করে কাঁদে! আমার কি হবে গো! ঘাড়ে মাথা জোড়া না থাকলে খাব কি করে ? তারপর সে নিরীহ গলায় জিজ্ঞেস করে – অউ কা করবে দদা! আর কী করবে বাপ?

    --ব্যাটা চোরের গুষ্টি! তোর হাত কেটে উত্তর দিকে আর পা কেটে দক্ষিণে ছুঁড়ে ফেলে দেব !

    -- ও দাঈ ও! ও মোর দদা গ! ও মা! ও বাবা! আমাকে নুলো আর ল্যাঙড়া করে দিল গো; তোমরা একটু দেখ এসে! আর কী কী করবে গো সাহিব?

    -- তোর হাড়-মাস পিষে চাটনি বানিয়ে রাস্তার কুকুরকে খাইয়ে দেব ।

    -- কবে খাওয়াবে গ’?

    --ব্যাটা চোর , ন্যাকামি হচ্ছে!

    -- আমি চোর নই । চুরি করি নি । মিছিমিছি আমাকে--!

    -- আচ্ছা, তুই চোর নস , তবে এই এত কাপড় কার? তোর বাপের?

    -- ওঃ , এই ব্যাপার। এসব তো আমার গেরাহকের ।

    -- গ্রাহকের? গোটা গাঁ তোর গ্রাহক? তুই কি ধোপা নাকি?

    চোর বুকে চাপড় মেরে জানায় যে ও হল মোতিপুর গাঁয়ের খানদানি ধোপা চরণদাস। চতুর সিং খুশি হয়ে জানায় যে ও কিন্তু তিনপুরুষের খানদানি হাবিলদার। ওর ভয়ে যত দাগি অপরাধী এলাকা ছেড়ে অন্য তল্লাটে গা ঢাকা দেয় । চরণদাস এবার খৈনি ডলে চতুরকে একটিপ ধরিয়ে দেয় । খোশমেজাজে চতুর চরণদাসকে বলে যে ও আসলে সোনার থালা যে চুরি করেছে তাকে ধরার জন্যে খুঁজে বেড়াচ্ছে । ধরতে পারলে ইনাম আছে । চরণদাস যদি থালাচোরের খবর এনে দেয় তবে চতুর ওর সঙ্গে পুরস্কারের টাকা আধাআধি ভাগ করতে রাজি আছে । চরণদাস হাত বাড়ায়, বলে কে সোনার থালা নিয়েছে ও জানে। কিন্তু কিছু টাকা আগাম দিতে হবে নইলে ও বলবে না , কারণ পুলিশকে বিশ্বাস নেই ।

    হাবিলদার পকেট হাতড়ে অতিকষ্টে দুটো টাকা বের করে বলে,-- এখন এই রাখ, বাকিটা পরে পুরস্কার পেলে দেব’খন। নে, এবার বল । কে নিয়েছে সোনার থালা?

    -বলছি, আগে একটু কোণার দিকে চল, নইলে অন্যেরা শুনে ফেলবে। ইনামের টাকায় ভাগীদার বেড়ে যাবে ।

    --বেশ, এই বার বল! কে নিয়েছে?

    --চোরে নিয়েছে।

    -- ধ্যাৎ । সে তো আমিও জানি।

    -- জানিস? তাহলে ধরগে যা ! আমার কাছে ঘ্যান ঘ্যান কেন ?

    -কিন্তু তুই যে বললি চোরের নামটা বলবি? তবে তো ওকে ধরব, ইনাম পাব; তোকেও দেব ।

    --নামটা বলব? এক্কেবারে আসল নাম! আগে বলবে তো !

    -হ্যাঁরে ব্যাটা! আসল নাম, আর ভ্যান্তারা না করে বলেই ফ্যাল।

    --বললাম তো যে সোনার থালা নিয়েছে তার নাম চোর ; যে চুরি করে তার নাম চোরই হয় , অন্যনাম চাপা পড়ে যায় । এই যেমন আমি চরণদাস ধোবি, মানে ধোপা। কাল যদি চুরি করতে নেমে পড়ি তো লোকে আমাকে কী বলে ডাকবে? চরণদাস চোর ।

    হতাশ চতুর সিং ক্লান্ত হয়ে গাছের নীচে শানবাঁধানো জায়গাটায় বসে গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। আচ্ছা, বেওকুফের পাল্লায় পড়া গেছে। যে চুরি করে তার নাম তো চোরই হবে। মাঝখান থেকে দুটো টাকা গচ্চা গেল। কি যেন বলছিল? চরণদাস চোর ! হঠাৎ ওর দিমাগ -কী -বাত্তি জ্বলে ওঠে! পেছন ফিরে দেখে বোঁচকা তুলে চরণদাস কখন হাওয়া হয়ে গেছে।

    যাঃ হাতে পেয়েও ফস্কে গেল!

    গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে হাবিলদার চতুর সিং। দৌড়য় যে দিকে উধাও হয়েছে চরণদাস।

    “সাতশ’ ইঁদুর খেয়ে বেড়াল হজ করতে যায়,
    ওর ফাঁদে আজ পড়ব ধরা? কী পড়েছে দায়!
    আমার কী পড়েছে দায়”!



    “কেন হে মুরারি এ মায়া বিস্তারি
    জীবের সুখের তরী , কর নিমগন?”

    কয়েক কোশ দূরে লছনপুর গ্রাম। সেখানে গাঁয়ের বাইরে এক বটগাছের তলায় কয় মাস আগে এসেছেন এক সাধুবাবা। একটি পাথরের গায়ে সিঁদুর মাখিয়ে পাশে একটা ত্রিশূল পুঁতে উনি চোখ বুঁজে বসেছিলেন। পাঁড় মাতাল সদারাম সেখান দিয়ে টলতে টলতে যাচ্ছিল , ওর চোখ পড়ল ধ্যানস্থ বাবাজির দিকে। একটু অবাক হল । এই মহাত্মা কোত্থেকে উদয় হলেন ? আগের দিনও দেখেছিল কি ? বোধহয় । গতমাসে ? ঠিক মনে পড়ছে না ।

    যাহোক, ও সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ওঁর ডান হাত প্রথমে বরাভয় মুদ্রায় ওপরে উঠল , তারপর পাশে খালি জমির দিকে ইশারা করে ওকে বসতে বলল । সদারাম মন্ত্রমুগ্ধের মত আদেশ মেনে সেখানে বসল।

    একটু পরে বাবাজির চোখ খুলে গেল। উনি মধুমাখা গলায় বললেন—বেটা কাঁইচিরাম!

    সদারাম অবাক হয়ে সামনে পেছনে চারপাশে তাকাল। কেউ তো নেই ? মহাত্মা কি তবে ওকেই কিছু বলতে চাইছেন? কিন্তু ওর নাম তো সদারাম।

    বাবাজি যেন ওর মনের কথা পড়লেন।

    --ঘাবড়াস না বেটা! তোর আসল নাম হল কাঁইচিরাম। তুই লোকের পকেট কাটতে সিদ্ধহস্ত। ছ’মাস হল ছাড়া পেয়েছিস। তুই হলি কলাকার, শিল্পী। তোর কাঁইচির চালে লোকের পকেট,ধুতির খুঁট, কোমরে গেঁজে আলগা হয়ে যায় , লুকনো টাকাকড়ি টুপ করে রাস্তায় খসে পড়ে । মানুষ টেরটি পায় না । চালিয়ে যা । খালি গরীব মানুষকে কষ্ট দিস না । তুই হবি এ গাঁয়ে আমার প্রথম শিষ্য।

    সদারাম ওরফে কাঁইচিরাম বাবাজির পায়ে পড়ে মাটিতে মুখ ঘষে। বাবাজি, মোর কান ফুঁক দে । মোলা তোর চেলা বনা লে।

    আমার কানে কানে গুরু মন্ত্র দাও গো, আমাকে তোমার চ্যালা বানিয়ে নাও।

    --কিন্তু বেটা, শিষ্য হতে গেলে দুটি জিনিস লাগে । এক, তোকে আমার কাছে শপথ করে কোন একটা কু-অভ্যাস ছাড়তে হবে। আমি বলি কি মদের নেশা ছেড়ে দে! এই দেখ, ধেনো মদের গন্ধে আমার গা গুলিয়ে উঠছে।এটা খুব খারাপ, ক্ষতি করে । এটা তুই পণ করে ছেড়ে দে দিকি , আর আমার হাতে পাঁচসিকে দক্ষিণা গুণে দে , নইলে মন্তর কাজ করবে না ।

    এভাবেই কাঁইচিরাম বাবাজির প্রথম শিষ্য হল । শুধু তাই নয় , ওর মাধ্যমে গোটা লছনপুর জেনে গেল যে বাবাজি যেখানে যান সেখানেই গাঁয়ের দুঃখ দূর করেন । এই যে গতমাস থেকে খরা কেটে গিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তার পেছনে কে ? বাবাজি! দু’মাস আগে বটের তলায় বসে ধূনি জ্বালিয়ে গ্রামের মঙ্গলকামনায় তপ করেছিলেন, বললে হবে!

    একটু একটু করে ভক্তদের ভীড় বাড়তে লাগল। সবার মুষ্টি ভিক্ষা এবং মেহনতের ফলে গড়ে উঠল এক চালাঘর; তাতে ছাঁচের বেড়া, মাটির দেওয়াল আর খাপরার চাল । এতে দেবতা এবং তাঁর সেবায়েত বাবাজির একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা হল ।

    আজ শনিবার । সূর্য এখনও মাথার উপরে ওঠেনি । বাবাজি হাতে চিমটে নিয়ে নেচে নেচে ‘কেন হে মুরারি’ ইত্যাদি নামগান করে এখন বারান্দায় গুছিয়ে বসেছেন। একটু একটু করে একের পর এক ভক্তের দল আসছে, নারীপুরুষ সবাই। আসলে খেতের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। লোকের হাতে সময় আছে । সবাই হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে ‘ প্যার লাগুঁ’ বা ‘ প্যার পড়থ মহারাজ’ বলে যে যেমন পারে প্রণামী দিয়ে একটু দূরে গিয়ে মাটিতে আসনপিঁড়ি বসে পড়ছে।একদিকে মেয়েরা , অন্যদিকে পুরুষের দল। উনিও হাত তুলে সবাইকে ‘কল্যাণ হো’, ‘মঙ্গল হো’ বা ‘খুশ রহো’ বলে বরাভয় দিচ্ছেন।

    একটু দূরে ক’জন মিলে তাস খেলতে বসেছে। সেখানে কাঁইচিরাম গিয়ে একজনের কলার চেপে ধরে। সে নাকি কাল জুয়োয় জিতে কাঁইচির থেকে নেওয়া ধারের পয়সা না দিয়েই ঘরে চলে গেছল। কিন্তু আজ সে সমানে হারছে, ট্যাঁকে কিছু নেই । তাই উলটে কাঁইচিকে বলে আরও কিছু ধার দিতে যাতে জিতে দু’দিনের পয়সা একবারে ফেরত দিতে পারে । কাঁইচির বিশ্বাস হয় না । ও জুয়াড়ি ব্যাটাকে ঘেঁটি ধরে নিয়ে গুরুর পায়ের সামনে ফেলে যাতে ও সত্যি কথা বলার কসম খেতে পারে ।

    গুরু খুব খুশি। চ্যালা বটে কাঁইচিরাম। একের পর এক লোক ধরে এনে কানে মন্তর দেওয়াচ্ছে। গুরুর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু কাঁইচির মুখে মদের গন্ধ কেন ? ও তো মদ ছেড়েছিল। গুরুর সঙ্গে তঞ্চকতা? নরকেও ঠাঁই হবে না যে !

    কাঁইচি কান মূলে বলে – আপনাকে ঠকাই নি । ধেনোমদের গন্ধে আপনার গা গোলাতো, তাই ছেড়ে দিয়েছি । রাম ধরেছি। আপনিও তো সারাদিন রামনাম করেন । আমিও করি , নিজের মত করে।

    উনি কথা না বাড়িয়ে বললেন যে হবু শিষ্যকে জুয়োর নেশা ছাড়তে হবে। ও এককথায় রাজি। ব্যস, উনি ওকে কোলের কাছে টেনে কানে ফুঁকতে লাগলেন।

    --ওঁ , ভোলে শঙ্কর , কাঁটা লাগে ন কঙ্কর !

    কাশী বিদ্যাপীঠ, এই চ্যালাটি বড্ড ঢিট।

    জুয়োর নেশা যাকগে ছাড়ি, নইলে তোমার সঙ্গে আড়ি ! ফুঃ ফুঃ ফুঃ !

    এবার ব্যাটা দে দক্ষিণা , একটা টাকা আর চার আনা! ফুঃ ফুঃ ফুঃ !

    কি রে ? পাঁচসিকে বের করে আমাকে প্রণাম কর!

    কাঁইচিরাম বলে –এই ব্যাটা আজকে ট্যাঁকখালির জমিদার। কালকে দিয়ে দেবে। আমি জামিন রইলাম।

    বাবাজি স্পষ্টতঃ হতাশ। প্রথম দক্ষিণা! তাও বাকিতে? ঠিক আছে । কাঁইচি যখন বলছে।

    কিন্তু ইতিমধ্যে আরেকজন এসে গুরুর পাশে বসে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করেছে—বাবাজি, মোর কান ঘলাঊ ফুঁক দে। বাবাজি, আমার কানেও গুরু-মন্তর দিন ।

    এদিকে ধোঁয়ার চোটে গুরুর দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। এত ধোঁয়া হঠাৎ কোত্থেকে এল? হবু শিষ্যর দিকে কটমট করে তাকাতেই ও সাফাই গায় –কাছাকাছি একটা কারখানা খুলেছে যে ! তার চিমনির ধোঁয়াতেই --।

    গুরুর চিমটের এক ঘা ওর পিঠে পড়ে । উনি কাশতে কাশতে বললেন – বেটা, ভুকর ভুকর বিড়ি ফুকত লাগিস অউ দোষ দেথস কারখানে লা!

    ফুক ফুক করে সমানে বিড়ি টানছিস , দোষ হল কারখানার, অ্যাঁ? ফ্যাল বিড়ি , ফেলে দে বলছি! এক্ষুণি!

    ও ভ্যাবাচাকা খেয়ে বিড়ির বদলে দেশলাই ছুঁড়ে ফেলে। গুরু এবার ওকে শান্তভাবে বোঝাতে লাগলেন—বিড়ি কেবল নুকসান করে । নিজের, পরিবারের, চারপাশের সবার। এই সব্বনেশে কু-অভ্যাস ছেড়ে দে । পণ কর, অ্যার কখখনো এসব খাবি নে।

    লোকটা হতাশ হয়ে বিড়িটা নিভিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে। ছেড়ে দিলাম।

    এইবার দে দক্ষিণা , একটা টাকা আর চার আনা!

    লোকটা হাসিমুখে গামছা দিয়ে বাঁধা একটা ছোট পুঁটলি গুরুর পায়ের কাছে নামিয়ে রাখে। বাবাজির মুখ উজ্বল হয়ে ওঠে। কত দিলি রে ?

    -গুরু মহারাজ, এতে দশ বান্ডিল আছে ।

    --দশ বান্ডিল? অ্যাঁ, তুই তো সাধারণ লোক নোস।

    গুরু পোঁটলা খুলে হতবাক। এ কি? ভেবেছিলাম দশ বান্ডিল নোট, এ তো দশটা বিড়ির বান্ডিল!

    --হ্যাঁ , গুরুদেব; তুমিই তো বললে নেশা ছাড়তে হবে । সব গুরুকে অপ্পন করতে হবে । আমিও তাই ধোঁয়া গেলা ছাড়লাম, আমার যা বেঁচেছিল সব ছিচরণে অপ্পন করলাম।মন খারাপ করবেন না গুরুদেব; যা দিলাম আপনার এক হপ্তার খোরাক।

    গুরু ওকে চিমটের এক ঘা কষালেন। গুরুরা কক্ষণো বিড়ি খায়!

    এমন সময় চোখে পড়ল শিষ্যের কানের পেছনে গাঁজার কল্কে গোঁজা! এক থাবড়া মেরে সেটি ছিনিয়ে নিয়ে গুরু নিজের ঝোলায় পুরে বললেন –যা বেটা, তোর দক্ষিণা হয়ে গেল।

    শিষ্য পায়ে পড়ল।

    এমন কাজটি করবেন না গুরুদেব। আপনার কথায় বিড়ি ছাড়লাম , এখন কল্কে কেড়ে নিলে আমি কী নিয়ে থাকব? ও যে আমার জীবনভর সুখদুঃখের সঙ্গী ।

    --মন খারাপ করিস না বেটা! যখন পাঁচসিকে দক্ষিণা দেবার খ্যামতা নেই তখন গাঁজা খাওয়া তোকে মানায় না । আয় বেটা , কাছে আয় !

    তখন উনি খালি ওর ঘাড় ধরে নুইয়ে নিজের কোলের কাছে টেনে কানে কানে মন্তর দেওয়া শুরু করলেনঃ ওঁ , ভোলে শঙ্কর , কাঁটা লাগে ন কঙ্কর !

    কাশী বিদ্যাপীঠ, এই চ্যালাটি বড্ড ঢিট। -- ফুঃ ফুঃ ফুঃ !
    বিড়ির নেশা যাকগে ছাড়ি, নইলে তোমার সঙ্গে আড়ি ! ফুঃ ফুঃ ফুঃ !

    এমন সময় একজন হুড়মুড়িয়ে একটা বোঁচকা নিয়ে ওঁর পায়ের কাছে উবুড় হয়ে পড়ল। সমস্ত চ্যালা-চামুন্ডা হতবাক। এমন সময় চারদিকে চাইতে চাইতে আশ্রমের সামনে এল হাবিলদার চতুর সিং। ও হাঁফাচ্ছে। জানতে চাইল সাধুবাবার আশ্রমে কোন চোর এসে লুকিয়েছে কি না ।সাধুবাবা হাত উলটে বললেন – চোর এখানে কেন আসবে? বাবাজির আশ্রমে চুরি করার মত আছেটা কি? তুমি বাছা বরং যত বড়লোক গৌটিয়া মহাজন ওদের পাড়ায় যাও ।



    পণ করেছে চরণদাস

    শুনে সবার বন্ধ শ্বাস।

    হাবিলদার চলে যেতেই চরণদাস গুরুদেবের হাত ধরে অনুনয় বিনয় করতে লাগল—আমাকে বাঁচালি গুরুদেব! এবার আমার কানেও মন্তর দে ! কান ফুঁকে দে ।

    --বেটা আমি কে ! আমি নিমিত্ত মাত্র । তোকে বাঁচিয়েছে তোর ভাগ্য, তোর কিসমত। কিন্তু প্রত্যেকবার ভাগ্য সদয় নাও হতে পারে । এবার তোর নাম বল। তুই কী করিস তাও বলে ফ্যাল।

    -- নাম চরণদাস। কী করি নাই বা জানলেন; বলতে লজ্জা করে যে !

    -- আহাহা! লজ্জা শরম এখনও বেঁচে আছে ? আমার কি ভাগ্যি। থাক , তোকে মুখ ফুটে না বললেও চলবে। যার পেছনে হাবিলদার তাড়া করে বেড়ায় তাকে কিছু বলতে হয় না ।তুই হলি চোর । ঠিক ধরেছি কি না ?

    -- আজ্ঞে , আপনার অগোচর কিছু নেই । এবার কান ফুঁকে দিন তাহলে।

    -- বেটা, তার আগে একটা কাজ করতে হবে যে ! চুরি করা ছাড়তে হবে । কাজটা ভাল না ।

    চরণদাস প্রাণপণে মাথা নাড়ে। চুরি ছাড়লে খাবে কি ?

    বাবাজি বোঝান যে এত লোক কাজ করে খাচ্ছে, খেটে খাচ্ছে, সবাই কি চুরি করে পেট ভরা্য়, নাকি ঘর চালায়? দেখ গে’ কেউ গরুর গাড়ি চালাচ্ছে, কেউ মুটে-মজুরি করছে , ওরও অমনই কিছু করা উচিত। চরণদাসের কোন হেলদোল নেই ।

    হতাশ বাবাজি আকাশের দিকে চেয়ে হাত তুলে বলেন—হে প্রভো! এ কি তোমার লীলে! এমন সব চ্যালা জোটালে—একটা মাতাল , একটা জুয়াড়ি একটা বিড়িখোর তো একটা সিঁদেল চোর!

    চরণদাস আশ্রমের চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলে –তুমিই কি কম নাকি, গুরুদেব?

    --মানে?

    চরণদাস মুচকি হাসে। বলে চোর বেচারা রাত্তির জেগে পা টিপে টিপে গলিঘুঁজি ঘুরে একটু আধটু রোজগার করে, বাবাজি তো যা করে সেটা দিনদুপুরে, ঘরের আঙিনায় বসে, কান ফুঁকে । কিন্তু আমদানি তো চোরের কয়েকগুণ।

    বাবাজি চিমটে তুলেও নামিয়ে রেখে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; তারপর বলে মন্তর নেয়ার সময় গুরুর সামনে অন্ততঃ একটা পণ করতে হবে বেটা, এটাই দস্তুর।

    --বেশ; আমি তোমার কথা মেনে নিলাম । চুরি ছাড়ব না , কিন্তু একটার বদলে চার -চারটে ‘পরণ’ করব, এই বলে দিলাম।

    গুরুর চোখ কপালে ওঠে। চার -চারটে পণ! ব্যাটা বলে কি ! ঠিক আছে , তাই করুক । অব হো যা শুরু!

    -- পহেলা পরণঃ কখনও সোনার থালায় ভাত খাব না ।

    --আহাহা! ছোটবেলা থেকে সোনার থালায় খেয়ে খেয়ে বাছার আমার অরুচি ধরে গেছে। কত বড়ঘরের ছেলে রে তুই! আগে বঢ়ো!

    -- দুসরা পরণঃ লোকজনে কাকুতি মিনতি করলেও কখনও হাতির পিঠে চড়ে মিছিলে যাব না। --- মরে যাই , কী কঠিন পণ রে ! নগরবাসী তোকে হাওদায় চড়িয়ে শোভাযাত্রা বের করবে বলে হত্যে দিয়ে রয়েছে। পরেরটা শুনি!

    -- কোন দেশের রাণী যদি আমাকে বিয়ে করতে চায় –আমি না করে দেব; সে যতই রূপুসী হোক গে’।

    -- ওরে বাপ রে ! তোকে বিয়ে করবে বলে কত দেশের রাণী যে আজীবন কুমারী রয়ে গেল!

    এবার আমার পেট ফেটে যাবে। তবু চারনম্বরটাও শুনে ফেলি।

    -- এই শেষ; কোন দেশের প্রজারা যদি হাতজোড় করে মিনতি করে , “ চরণদাস, এ রাজ্যে রাজা নেই , গদি খালি,- তুমি এসে সিংহাসনে বস, রাজ্য চালাও“—আমি সোজা না করে দেব”।

    আর পারা গেল না ; গুরুদেব গড়াগড়ি খেয়ে খ্যা-খ্যা করে হাসতে লাগলেন।

    চরণদাস বিরক্ত হয়ে বলল—অনেক হেসে নিয়েছ। এবার কান ফুঁকে দাও দিকি। বলা তো যায় না, হাবিলদার ব্যাটা কখন এসে পড়ে !

    বাবাজি ওকে কোলে টেনে কানে কানে বলতে থাকেনঃ

    ওঁ , ভোলেশঙ্কর , কাঁটা লাগে ন কঙ্কর !

    কাশী বিদ্যাপীঠ, এই চ্যালাটি বড্ড ঢিট। ফুঃ ফুঃ ফুঃ !

    চুরির নেশা যাকগে ছাড়ি,

    নইলে তোমার সঙ্গে আড়ি ! ফুঃ ফুঃ ফুঃ !

    এবার ব্যাটা দে দক্ষিণা-- একটা টাকা, চারটে আনা।।

    চরণদাস গুরুর পা ছুঁয়ে হাসি হাসি মুখে উঠে দাঁড়ায়, তারপর দু’হাত উলটে বোঝায় পকেট খালি। ওতে ভবি ভোলে না । গুরু মনে করিয়ে দেন যে দক্ষিণা বিনা গুরুমন্ত্র বৃথা, কোন কাজে আসবে না । চরণদাস পুরো বোঁচকা গুরুর পায়ের সামনে নামিয়ে রেখে হাত জোড় করে । বাবাজি সন্দিগ্ধ মনে ওটা খুলতে থাকেন, বেরিয়ে আসে শাড়ি ব্লাউজ সায়া লুঙ্গি, একের পর এক। এগুলো ওঁর কোন কাজে লাগবে?

    চরণদাস ফের হাসিহাসি মুখে বোঁচকার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনে কাপড়ে মোড়া একটি সোনার থালা, গুরুর বাক্যি হরে যায় ।

    --নাও গুরুদেব, এই তোমার দক্ষিণা। এবার খুশি তো ? আরে অমন হাঁ করে বসে না থেকে তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে যাও।

    -- হ্যাঁ, এই চোরাই মাল ভেতরে নিয়ে যাই আর হাবিলদার এসে আমায় ভেতরে নিয়ে যাক , ইয়ার্কি পেয়েছিস?

    কথা মুখের থেকে খসল কি না ফের হাবিলদার হাজির।

    গুরু কাপড়ের বস্তার ওপরেই চড়ে বসলেন, ধ্যানস্থ। চরণদাস গুরুর সামনে মুখ গুঁজে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত।

    হাবিলদার চতুর সিং সন্দেহের চোখে সমস্ত ভক্তমন্ডলীর চেহারা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। আসলে সেই সোনার থালা এখনও উদ্ধার হয় নি । ইনামের রাশি দুগুণ হয়েছে। লোকজন ফিসফাস করছে এমন কাজ শুধু চরণদাসের পক্ষেই সম্ভব।

    চতুর এবার মেয়েদের বসার জায়গা ছাড়িয়ে দু’পা এগুতেই দেখল জুয়োর আড্ডা জমজমাট!

    সামনের লোকটার পিঠে লাঠির এক খোঁচা মেরে রাশভারি গলায় বলল—কি রে ব্যাটা! কাজকম্ম নেই ? ঘরের চিন্তা নেই ? এখানে ভরদুপুরে রাস্তার পাশে বসে জুয়ো খেলা হচ্ছে? বলি বৌ-বাচ্চা যে পথে বসবে সে আক্কেল আছে ? তোদের লজ্জাও করে না রে ! এই টাকা আমি সরকারের নামে বাজেয়াপ্ত করলাম।

    এই বলে সে বাজির পুরো টাকাটা পকেটে পুরল। সামনের লোকটাই দিনের গোড়ায় নতুন গুরুর কাছে জুয়ো খেলবে না বলে ‘পরণ’ (পণ) করেছিল। কিন্তু ওকে যে দিনের শেষে কাঁইচিরামের ধারের টাকা শোধ করতে হবে! ও করুণ মুখে চতুর সিং হাবিলদারের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই কি টাকা বাজেয়াপ্ত করার সময়? একটু পরে আসলে কি হত ? কী ভাল তাস পেয়েছিল ।ভগবান এমন একচোখো কেন ?

    চতুর সিংয়ের মেজাজ ফুরফুরে। পকেট গরম। সে বাবাজির দিকে হাতের ব্যাটনের ইশারা করে জিজ্ঞেস করে –ওটা কে রে ?

    --সাধুবাবা; আমাদের গুরুদেব।

    -- এ তল্লাটে কতদিন?

    -- তা’ মাস দুই হবে।

    -- এ সাধুবাবা? দেখলে তো চোর -গাঁটকাটার সর্দার মনে হচ্ছে।

    লাফিয়ে ওঠে মাতাল কাঁইচিরাম।

    --- আমার গুরুদেবকে চোর গাঁটকাটা বলা ! এমন আস্পদ্দা! শালা তোর হাবিলদারি পেছন দিয়ে বের করছি।

    ওরা দু’জন ঝাঁপিয়ে পড়ে হাবিলদারের উপর। বাকি তিনজন আটকাতে চেষ্টা করে । মেয়ের দল চিল-চিৎকার জোড়ে। সব মিলিয়ে একেবারে পুঁদিচ্চেরি কাণ্ড , কে কাকে মারছে, কে যে সামলাচ্ছে বোঝা দায়। ভীড়ের হাতচালাচালির মাঝে সেয়ানা চতুর মাথা বাঁচিয়ে সোজা রফুচক্কর ।

    বাবাজি প্রফুল্লচিত্তে সোনার থালা মন্দিরের ভেতরে রেখে এসে বললেন, ‘বেটা চরণদাস, তোর ভক্তিতে আমি প্রসন্ন হয়েছি। কিন্তু তোকে আর একটা কাজ করতে হবে। চারটে প্রণ নিজের হিসেবে করেছিস। একটা প্রণ আমার কথায় কর, মিথ্যে কথা বলা ছেড়ে দে’ ।

    --এ হয় না গুরুদেব; হতে পারে না ।

    -- কেন ? কেন হতে পারে না ?

    --দেখ, সূয্যি থেকে ওর কিরণকে আলাদা করতে পার? হাতের আঙুল থেকে তার নখুন আলাদা করতে পার ?

    গুরুদেব মাথা নাড়েন।

    --তেমনই চুরি আর মিথ্যে কথা আলাদা করা যায় না , একটা থাকলে আরেকটা থাকবেই।

    এমন দার্শনিক বিচারের সামনে গুরু অসহায় বোধ করেন। চরণদাসের মায়া হয় । ও বুক চিতিয়ে বলে – যাকগে,তোমার কথাই রইল; আজ থেকে নতুন পরণ করলাম—যাহা বলিব সত্য বলিব; সত্য বই মিথ্যা বলিব না ।

    বললে তোমরা পেত্যয় যাবে না । এমন সময় আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল । কে দেখেছে? কেউ না কেউ ঠিক দেখেছে। আমার ঠাকুদ্দা বলেছেন। তিনিও শুনেছেন তাঁর ঠাকুদ্দার কাছে। ব্যস।



    চরণদাসের বিষম দায়,
    (যেন) সবার পেটে অন্ন যায়

    দুটো বছর ভালয় ভালয় কেটে গিয়ে এবার আবার আকালের ছায়া। ঘরে ধান নেই , খেতখামারে কাজ নেই, গরীব-গুর্বো খাবে কি ? ছত্তিশগড়ে বেশির ভাগ জমিন হল একফসলী । এমনিতে গরীব চাষি আর খেতমজুরদের ঘরে চার থেকে ছ’মাসের বেশি ধান থাকে না । বাকি মাসগুলোয় ওরা বাইরে জন খাটতে যায় , কাজ না পেলে আধপেটা খায় অথবা পেটে কিল মেরে পড়ে থাকে। কিন্তু এবার তো সোজাসাপটা আকাল । পাড়া-পড়শি যে ধার দেবে সে গুড়ে বালি। সবার হাল উনিশ-বিশ।

    এমন দিনে চরণদাস চলেছে নওয়াপাড়া গাঁয়ের পাশ দিয়ে । চোখে পড়ল একটা কোসম গাছ, তার নীচে গ্রামদেবতার থান। মানে একটা গোবরলেপা জায়গার উপরে সিঁদূরলেপা তিনটে পাথরের টুকরো—বাড়রাজা, বাড়রাণী আর ঠাকুরদেব। তার সামনে বসে একজন মানুষ অঝোরে কাঁদছে।

    কেন কাঁদছে? কে জানে ? হবে কোন পেরাইভেট মামলা। সবব্যাপারে নাকগলানোর দরকার কি ? হক কথা ।

    কিন্তু চরণদাস হল চোর, আপনার আমার মত ছাপোষা ভদ্দরনোক নয় । ওর সব ব্যাপারেই কৌতূহল। কাজেই শ্রীমান চরণদাস দু’পা এগিয়ে আবার ফিরে এল।

    -কা হোইস গা? কাবর রোথস? কী হয়েছে ভাই , কাঁদছিস কেন ?

    লোকটা আরও জোরে ডুকরে কেঁদে ওঠে , তারপর চরণদাসকে হাত নেড়ে কেটে যেতে বলে । ও জানে যে ওর যা সমস্যা তাতে কারও কিছু করার নেই ।

    তিতিবিরক্ত হয়ে চরণদাস ওর দু’কাঁধ ধরে ঝাঁকায়, বলে চোখের জল মুছে সব খুলে বলতে। ফোঁপানো এবং হেঁচকি তোলার ফাঁকে ফাঁকে বোঝা গেল যে ক’দিন হল ঘরে চাল বাড়ন্ত। ঘটি-বাটি-লোটা- কাঁসার একটা থালা সব বন্ধক দেওয়া হয়ে গেছে। ওরা স্বামী-স্ত্রী না হয় পেটে কিল মেরে কচু-ঘেঁচু সেদ্ধ করে আরও কিছু দিন চালিয়ে নেবে। কিন্তু পেটে একটু ফ্যানভাত না পড়লে একবছুরে বাচ্চাটাকে বাঁচানো মুশকিল। মায়ের বুকের দুধও গেছে শুকিয়ে।

    তো এ গেছল গাঁয়ের সবচেয়ে বড় গৌটিয়া মহেশরামের কাছে একবস্তা ধান ধার চাইতে। আগামী বছর নতুন ফসল উঠলে অন্ততঃ ফাগুন-তেওহার, মানে হোলির উৎসবের আগে সব ফিরিয়ে দেবে। মহেশরাম দিয়েছে হাঁকিয়ে; বলেছে কিছু বন্ধক না রাখলে দেওয়া যাবে না । হাতে পায়ে ধরতে গেলে ওর লেঠেল চামার সিং এসে গলাধাক্কা দিয়ে আঙিনার বাইরে বের করে দিয়েছে । এখন ও কোন মুখে বাড়ি ফিরে যাবে!

    চরণদাস একটু ভাবে। তারপর বলে, ‘ঠিক আছে , আর একবার গিয়ে চেয়ে দেখ’। লোকটি মাথা নাড়ে, একবার যেরকম গলাধাক্কা খেয়েছে তারপর আর ওমুখো হয় !চরণদাস জিদ ধরে , ‘চল তো , ম্যায় তেরা সাথ হুঁ’।

    --সত্যি যাবি , নাকি মাঝপথে সটকান দিবি? ওই চামার সিং এর কাছে কিন্তু একটা দো-নলা আছে ।

    -- আরে সময় এলে ওর দো-নলা পেলাস্টিক হয়ে যাবে ; তখন খেলা দেখিস। এখন চল তো !

    -- এত বড়বড় ডিং হাঁকছিস, তুই কে রে ? কী নাম? কোথায় ধাম?

    -- নাম হবে মোর -- চরণদাস চোর!

    ধরে গুরুর চরণ, করেছি মহা-পরণ,
    যা বলি তা সত্যবচন, মিথ্যা কথা নয় কদাচন।।

    ওরে বাবা! চরণদাস চোরের নাম এ রাজ্যে কে না জানে ! সোনার থালা উদ্ধার হয় নি ।

    চারগুণ হোল ইনাম, মন্ত্রীর ছোটে কালঘাম।

    চোর-পুলিশ খেলাই সারা, আজও সে পড়েনি ধরা।

    গৌটিয়া মহেশরাম ওর কাছারিবাড়ির পেছনে ধানের মরাইয়ের সামনে একটা চৌকি বিছিয়ে বসে জাবদা খাতায় ধানের হিসেব, ধারের খতিয়ান, বকেয়া সুদ এইসব লিখছিল। লেঠেল চামার সিং ধানের বস্তা গুণছে আর হিসেব গুলিয়ে ফেলে বকুনি খেয়ে ফের গোড়া থেকে শুরু করছে । মহেশরাম লোকটিকে আবার ঢুকতে দেখে ভুরূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল। কী ব্যাপার?

    লোকটা হাত জোড় করে । মালিক, এক বস্তা ধান দিয়ে দাও। চাষের মরশুমে তোমার খেতে বেগারি করে শোধ দেব। কম বেশি যা হবে তা নতুন ফসল উঠলে দিয়ে দেব । ফাগুন তেওহারের আগে অবশ্যই। আমার বৌয়ের মাথার দিব্যি!

    --সে তো বুঝলাম ; বন্ধক কি দিবি? কিছু এনেছিস?

    -- না মালিক; সব তো আগেই গেছে। দে দে মালিক। তোর গু খাই মালিক।

    চিড়বিড়িয়ে ওঠে মহেশরাম। সেই এক ভ্যানর ভ্যানর! এক কথা কতবার বলব?

    এবার এগিয়ে আসে চরণদাস। দে দো মালিক, ভগবান তোর ভলা করে ! ওর টুরামনকে জান বচ জাহি , ওমন তোর গুণ গাহি। ওদের বাচ্চাটা প্রাণে বাঁচবে; ওরা দশ গাঁয়ে তোমার গুণ গাইবে ।

    --এ কাকে উকিল ধরে এনেছিস! দেখতে তো হাট্টাকাট্টা! খেয়েপরে আছে মনে হয় । তাই কথায় এত তেজ!

    -- আমি চরণদাস চোর।

    -- তো কা হোইস? আমার ধানের গোলা, কাছারি বাড়ি সব চুরি করবি নাকি? চতুর সিং? এগিয়ে আয়।

    ওরা দুজন চলে যায় । যাবার আগে চরণদাস বলে – কাজটা ভাল করলে না গৌটিয়াজি। তোমার এত আছে, অভাবী পেটে-কিল-মারা লোকটাকে এক বস্তা দিলে কী হয়ে যেত? আমি আবার আসব , তখন কিন্তু পস্তাবে।

    গৌটিয়া মহেশরাম হিসেব মেলাতে থাকে আর বিড়বিড় করে—দে দো ; দে দো। মগের মুলুক পেয়েছে ব্যাটারা। আস্পদ্দা দেখ, ধমকি দিয়ে গেছে! ব্যাটা দু’পয়সার চোর । বলে দে দো ; দে দো। হুঁঃ ; দেশে আইন কানুন উঠে গেছে নাকি? দে দো ; দে দো। যত্ত ভিখারির দল। একটাকে দিলে আরও একটা আসবে । তারপর পালে পালে আসবে । দে দো ; দে দো।

    হ্যাঁরে চামার সিং, একবার থানায় খবর দিলে হয় না ? ধমকি দিয়ে গেছে ব্যাটা চোর , ও নাকি মিথ্যে বলে না?

    --আরে না না মালিক, আমি আছি না ? আমার হাতে দোনলা কথা বলে । আপনি মিথ্যে ভয় পাচ্ছেন। একটা ছিঁচকে চোরকে এত পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই ।

    --ধুর ব্যাটা বলদা! ভয় পাচ্ছি তোকে কে বলল! তবু সাবধানের মার নেই । বলে কি না দে দো ; দে দো। হ্যাঁরে চামার সিং, তোর বস্তা গোণা শেষ হয় নি ? এবার পাক্কা হিসেব বল।

    -- মালিক, উনিশ কুড়ি , মানে হল গে’ আপনার তিনশো আশি বস্তা। আচ্ছা, আমি একটু ছোট-বাইরে সেরে আসি? এই গেলাম আর এলাম। কোন ভয় নেই মালিক। দো-নলাটা বস্তার আড়ালে রেখে গেলাম।

    মহেশরাম চিন্তিত মুখে জাবদা খাতায় মন দেবার চেষ্টা করে কিন্তু চোখ চলে যায় যেদিকে চামার সিং গেছে।

    এমন সময় ঢোলের বাদ্যি! চমকে উঠে মহেশরাম এদিক ওদিক তাকায়। কারা যেন ঢোল বাজাতে বাজাতে আর চিৎকার করে কিছু বলতে বলতে এদিকেই আসছে। অনেক লোকের আওয়াজ; অজানা আশংকায় মহেশরামের বুক কেঁপে ওঠে।

    দৌড়ে আঙিনার ভেতরে ঢোকে চামার সিং, মালিক ! রাউতনাচের দল আসছে। সত্যিই তো , ঢোলের বোল এবার স্পষ্ট , আঙিনার ঠিক বাইরে—রাউতনাচের বোলই বটে!

    ডিম-ডিম-ডিম, ডিডিম ডিডিম; ডিম-ডিম-ডিম, ডিডিম ডিডিম!

    মহেশরামের উৎকন্ঠ এক নিমেষে কেটে যায় । যা যা , ওদের ভেতরে ডেকে নিয়ে আয় , আমার ঢোলটা আনতে ভুলিস না যেন !

    রাউতনাচ হল ছত্তিশগড়ের রাউত বা গোয়ালা সমাজের( এদের পদবি যাদব) দলবদ্ধ নাচ । খেতের কাজ ফুরিয়ে গেলে এরা দলবেঁধে বেরিয়ে পড়ে , গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে সম্পন্ন পরিবারের ঘরের সামনে দুটো দোঁহা বলে এবং তারপর ঘুরে ঘুরে নাচে। পরণে বিচিত্র পোশাক। হলুদ রঙে ছোপানো হেঁটো ধুতি, রঙীন জামা, তার উপরে কুর্তি বা জ্যাকেট, পায়ে রঙীন মোজা এবং বুটজুতো। মাথায় পাগড়ি, মুখে লাল-হলুদ-সাদা রঙের ছোপ এবং গলায় কাগজের মালা। এদের হাতে থাকে গরুচরানোর খেঁটো লাঠি এবং কারও কারও বাঁহাতে ঢাল। নাচের সময় এরা যুদ্ধের অভিনয় করে। দোঁহার বিষয় কৃষ্ণ -রাধা বা সমসাময়িক কোন বিষয়ে ব্যঙ্গ ।

    ডিম-ডিম-ডিম, ডিডিম ডিডিম; ডিম-ডিম-ডিম, ডিডিম ডিডিম!

    আঙিনায় ঢুকে পড়েছে জনা তিরিশ রাউতের দল। তাদের একজন চিৎকার করে দোঁহা বলে –আরে রামরাজ মেঁ দহি মিলে অউ কৃষ্ণরাজ মেঁ ঘি। (কোরাস)—হউ!

    অউ কলযুগ মেঁ মিলে পেপসি, পাইপ লগাকে পী!” (কোরাস)—হউ!

    রামরাজ্যে এলো রে দই, কৃষ্ণরাজ্যে ঘি,

    এবার কলিযুগে পেপসি খাবি পাইপ লাগিয়ে –ছি !

    ডিম-ডিম-ডিম, ডিডিম ডিডিম!

    সবাই ঘুরে ঘুরে নাচে , তাদের সঙ্গে নাচে চামার সিং। মহেশরামও গলায় ঢোলক ঝুলিয়ে নেমে পড়েছে নাচের দলের মাঝে। এবার স্বরচিত দ্বিতীয় দোঁহাটি ও নিজে বলা শুরু করেঃ

    “হাট-বাজার ঘুম ঘুমকে লায়া একঠন লাড়ু,

    আধা খাইস মোর ঘরওয়ালি, আধা খাইস সাড়ু”।

    ‘হাটবাজার ঘুরে ঘুরে কিনলাম এক নাড়ু;

    আদ্দেক খেল আমার বৌ, বাকিটা আমার সাড়ু’, মানে ভায়রাভাই।

    রাউতনাচের দলটি খুশিতে উচ্ছল হয়ে বেদম নাচে। হাওয়ায় তুড়ি লাফ দেয় । ঢোল বাজে, থামতে চায় না ।

    ডিম-ডিম-ডিম, ডিডিম ডিডিম! ডিম-ডিম-ডিম, ডিডিম ডিডিম! ডিমিক ডিডিম, ডিমিক ডিডিম, ডিম-ডিম-ডিম, ডিডিম ডিডিম!

    এবার দোঁহা বলবে বলে এগিয়ে আসে একটা কালো চশমা পরা রাউত।

    ‘ঠাকুরসাহেব নেওতা দিহিস আগয়ে মনচোরা ,

    পান-সুপারি খাওত খাওত লে গয়ে ধান কে বোরা’।

    ‘সাহেবের নেমন্তন্ন পেয়ে এল রে মনচোরা,

    পান খেল, সুপুরি খেল, নিল ধানের বোরা’।

    মহেশ এবং চামার সিং পাগলের মত নাচে । কিন্তু দলটা হালকা হচ্ছে, চলে যাচ্ছে। অন্য পাড়ায় যাবে বোধহয় , এটাই রীতি।

    তবু মহেশের ঢোল বেজে চলে আর খানিকবাদে ওরা দু’জন ক্লান্ত হয়ে বসে কোমর থেকে গামছা খুলে কপালের ঘাম মোছে।

    - কতদিন বাদে এমন প্রাণ খুলে নাচলাম রে ! ‘অউ কলযুগ মেঁ মিলে পেপসি, পাইপ লগাকে পী’; হাঃ হাঃ হাঃ!

    - হ্যাঁ মালিক, আপনার দোঁহাটাও জব্বর হয়েছিল। ওই যে , ‘আধা খাইস মোর ঘরওয়ালি, আধা খাইস সাড়ু”; ও -হো- হো -হো!

    - বলছিস? যা কুয়োর থেকে লোটা ভরে জল নিয়ে আয়। গলা শুকিয়ে গেছে।

    চামার সিং জল আনতে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নিজে আগে তিন লোটা জল খায় । এবার গৌটিয়ার জন্যে দড়ি টেনে কুয়ো থেকে জল তুলবে কি কানে এল মহেশরামের আর্তনাদ।

    --ওরে সব্বোনাশ হয়ে গেল রে ! শীগগির আয়, দৌড়ে আয় হতভাগা!

    -- কা হোইস মালিক?

    --আর কা হইস , তুই তোর পাহারা ছেড়ে নাচতে লেগে গেলি, এদিকে তোর এক কুড়ি কম চারশ’ ধানের বোরা থেকে পাঁচ কুড়ি গায়েব! সাড়ে সত্যনাশ।

    -- সে তো আপনিও নাচছিলেন মালিক। দেখাদেখি মহুঁ চিটিকন নাচে রহিন।

    --ফের মুখে মুখে তক্কো! এখানে চৌকিদার কে! বড় মুখ করে কে বলেছিল দু’পয়সার ছিঁচকে চোরের কথায় ভয় পাওয়ার কিছু নেই ? আরে শেষ দোঁহাটা কী ছিল যেন ! কালো চশমা পরা রাউতের দোঁহাটা?

    -- ‘পান খেল, সুপুরি খেল, নিল ধানের বোরা’।

    ইস কি ভুল হয়ে গেছে! ওই কালা চশমা রাউতটাই চরণদাস! ব্যাটা চোর নয় ডাকাত। শোন , বেশিদূর যেতে পারে নি । আমি যাচ্ছি পাশের গাঁয়ে ; তুই গিয়ে থানা থেকে সেপাই নিয়ে আয় । আজ ওর একদিন কি আমার একদিন!



    চরণদাসের দেখ ফুর্তি
    বাগিয়ে নিল চাঁদির মূর্তি

    চরণদাস পাশের গাঁয়ে নেই । ও গেছে আহিরণ নদি্র শুকনো খাত পেরিয়ে বনের রাস্তা ধরে ধনরাস গাঁয়ে । সেখানে এখন অন্নকূট উৎসব। ধর্মগোলা খুলে গরীব চাষিবাসি লোকজনের মধ্যে লুটের চাল বিলিয়ে দেওয়া।

    একটা চবুতরার উপর চট বিছিয়ে বসেছে চরণদাস। ওকে সাহায্য করছে ওই গাঁয়েরই তিনজন । খোলা হচ্ছে একটা একটা করে চালের ‘বোরা’ বা বস্তার মুখ । সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন এক এক করে চরণদাসের সামনে এসে ধুতির খুঁট, গামছা বা আঁচল পেতে দাঁড়াচ্ছে। সহকারীরা চাল মেপে ওদের কাপড়ে ঢেলে দিচ্ছে। ওরা পোঁটলা বেঁধে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে । বাড়িতে ঢেঁকিতে পিষে চাল বের করে রান্না করবে ।

    সবার মুখে হাসি। মেয়েরা দল বেঁধে সুয়া নৃত্য (টিয়েপাখি নাচ) করছে, গাইছে “ শুনো সংগোয়ারি, মোর ভাই হো চরণদাস চোর ‘।

    শোন গো সাথি, চরণদাস চোর আমার ভাই !

    সূয্যি ডুবছে, অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে । আজকের মত চাল দেওয়া প্রায় শেষ। লাইনের শেষ লোকটিকে না দিয়ে চরণদাস যাবে না । কিন্তু শেষ লোকটি সামনে এসে কাপড় না পেতে চেঁচিয়ে উঠল –চোর !

    চমকে উঠে চরণদাস দেখল – গৌটিয়া মহেশরাম! গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিক পৌঁছে গেছে। মহেশ চেঁচাতে থাকে , হাবিলদার! চোর ধরেছি, শিগগির এস।

    একইভাবে চরণদাসও চেঁচায়—চোর ধরেছি, শিগগির এস।

    হাবিলদার চতুর সিং হাঁফাতে হাঁফাতে এসে দাঁড়াতেই চরণদাস গৌটিয়াকে ওর দিকে ঠেলে দিয়ে বলে – নিয়ে যাও ব্যাটাকে, ফাটকে পোর ।

    হাবিলদার প্রাণপণে জাপটে ধরে মহেশরামকে, অনেক কষ্টে তোকে হাতে নাতে ধরেছি। কিছুতেই ছাড়ব না ।

    মহেশরাম চেঁচায় , আরে আমি চোর নই ; ছাড় বলছি , করছিস কি?

    --জানা আছে ;ধরা পড়লে সব ব্যাটাই বলে আমি চোর নই ।

    --আরে আমি গৌটিয়া মহেশরাম আমিই তোকে খবর পাঠিয়েছিলাম। হ্যারিকেন এনে আমার চেহারা দেখ । তোর সঙ্গের চামার সিংকে জিজ্ঞেস কর।

    চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হলে হাবিলদার গৌটিয়ার পায়ে পড়ে । মাপ করে দাও গৌটিয়াজি, বড্ড ভুল হয়ে গেছে।

    --আরে সেসব পরে হবে । আগে চোরটাকে ধর; ওযে পালিয়ে গেল ।

    -- আপনি চিন্তা করবেন না গৌটিয়াজি; ব্যাটা যাবে কোথায় ? দেখব ঠিক গাঁয়ের বাইরে চায়ের দোকানে বসে ভাঁড়ে করে চা খাচ্ছে। এই ধরলাম বলে ।

    কিন্তু সপ্তাহ গেল , মাস গেল; চতুর সিং হাবিলদারের আর চোর ধরা হল না । যেখানেই যায় শোনে চরণদাস আগের দিন সেখান থেকে সরে গেছে । একবার তো প্রায় ধরেই ফেলেছিল। সঠিক খবর পেয়ে এক বাড়িতে হানা দিল। চরণ দাস বোধহয় সেখানে পাত পেড়ে খাচ্ছিল। আদ্দেক খাওয়া সেরে এঁটো হাতে পেছনের দোর দিয়ে সটকে গেল চরণদাস।

    শেষ দেখা হয়েছিল মনিয়ারি নদির পারে চারপারা গাঁয়ে , কিন্তু চতুর সিং চিনতে পারে নি । চরণদাসের ভোল বদলে গেছে। গায়ে উঠেছে হলদে রঙের ফুলহাতা কুর্তা, তার উপর কালো জ্যাকেট; মাথায় বাবরি চুল ছোট করে ছাঁটা , তায় নীলরঙা পাগড়ি। চরণদাস এখন বড়মানুষ , নাকি ভেক ধরেছে?

    সে যাকগে, নদির পাড়ের মন্দিরে সন্ধ্যারতির সময় শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে হাবিলদার পৌঁছে আরতি দেখে , প্রসাদ খায় । তারপর মন্দিরের বাইরে বাঁধানো চাতালে ঘুমিয়ে পড়ে । জানতেও পারেনি যে ওর সামনে্র সারিতে হাত জোড় করে চোখ বুঁজে বসে থাকা নীলপাগড়ি আসলে আর কেউ নয় , খোদ চরণদাস।

    চিনতে পূজারীজিও পারেন নি । বরং চরণদাসের কাছ থেকে চাঁদির হার প্রণামী পেয়ে গদ্গদ হয়ে ওর দেওয়া সত্যি পরিচয়টা-- ‘চরণদাস চোর ‘—উনি বিশ্বাস করেন নি। যার এত দেবদ্বিজে ভক্তি, মন্দিরে একটা গোটা রূপোর হার ‘চড়াওন’ দিয়েছে, ষে কেন চোর হবে ? নিঘঘাৎ দিল্লাগি করছে।

    পেট পুরে প্রসাদ খাইয়ে মন্দিরের মধ্যে বিষ্ণু ভগবানকে রাত্তিরে শয়ন করিয়ে তালা এঁটে

    ওকে পাশে শুইয়ে দিলেন। চরণ ওঁকে সতর্ক করেছিল , ঠাকুরমশাই এটা করলে পরে পস্তাবেন। আরও বলেছিল যে ওকে ভোর ভোর খেয়া পার করতে হবে । কাজেই খেয়াঘাটে চালাঘরে রাত কাটানোই ভাল । উনি হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন কোন চিন্তা নেই । রাতের শেষ প্রহরে পাখিদের ‘চহচহা’তেই ওঁর ঘুম ভেঙে যায় । উনি সময়মত চরণকে তুলে দেবেন।

    চরণ ওঁর পাশে শুয়ে পায়ে হাত বুলিয়ে দিল, গা টিপে দিল। উনি বড় আরামে ঘুমিয়ে পড়লেন।

    ভোরের দিকে যথারীতি ওনার ঘুম ভাঙল।চরণকে ডাকতে গিয়ে দেখেন জায়গাটা খালি। ভাবলেন বড়-বাইরে সারতে নদির পাড়ে গেছে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেও যখন চরণ ফিরল না তখন মনটা কুডাক ডাকতে লাগল। এবার মন্দিরের কাছে গিয়ে দেখলেন তালা ভাঙা; ভগবানের যত সোনারূপোর গয়না মায় খোদ রূপোর বিগ্রহটি গায়েব।

    বাইরের চাতালে ঘুমিয়ে থাকা হাবিলদারকে ঠেলে তুলে বললেন—কেমন পুলিশ তুমি? চোর মন্দির ফাঁক করে চাঁদির মূর্তি সমেত তোমার সামনে দিয়ে চলে গেল আর তুমি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছ? ভগবান তোমাকে মাপ করবেন ভেবেছ?

    বার বার হেরে যাওয়া চতুর সিং ভাবতে লাগল যে তাহলে কি ঠাকুরের ইচ্ছে নয় যে চরণদাস ধরা পড়ুক? অন্ততঃ আমার হাতে? ঈশ্বর কি চরণকে কোন বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে ধরতীতে পাঠিয়েছেন? ও কি প্রভূর বিশেষ কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে এই ধরায় জন্ম নিয়েছে?

    তাহলে কি এবার চরণদাসে সংগেই হাত মেলানো উচিত?

    হাবিলদারের সারারাত ঘুম এল না ।



    ছাড়ব চুরি; এই শেষবার,
    লুঠব রাণীর কোষাগার।

    কেটে গেছে আরও দুটো বছর । ইতিমধ্যে মহানদী,শিবনাথ,আহিরণ এবং মনিয়ারি নদি দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে । চরণদাসের এখন দেশজুড়ে খ্যাতি। তার দুটো কারণ ।

    এক, আজও ধরা পড়েনি । দুই, ও নাকি গুরুর কাছে পণ করার পর একবারও মিথ্যে কথা বলেনি।

    ধীরে ধীরে এইসব কথাবার্তা হাওয়ায় ভেসে ভেসে পৌঁছে গিয়েছিল রাণীর কানে । রাণী ফুলমতী অবাক। এমনও ঘটে! কোথাও বোধহয় অহংকারে ঘা’ লাগল। রাণী মন্ত্রী এবং নগর কোতোয়ালকে ডেকে বললেন—এসব কী শুনছি? একমাসের মধ্যে ওই চোর ব্যাটাকে বেঁধে এনে আমার দরবারে হাজির করুন। তারপর দেখব ও কোন ধাতুতে তৈরি!

    কয়েকমাস কেটে গেল । চরণদাসের কোন খবর নেই । ও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে । এবার মহামন্ত্রী রাণীকে বললেন—ব্যাটা ভয় পেয়েছে। আপনার ভয়ে হয়ত এ রাজ্য ছেড়ে ভিনরাজ্যে আস্তানা গেড়েছে । এই কয়মাসে কোন নতুন চুরির খবর নেই। যাকগে , আপদ গেছে। এবার আমরা ওর কথা ভুলে অন্য কাজে মন দিইগে’।

    রাণী বললেন, তথাস্তু!

    কিন্তু রাণী চরণদাসকে ভুলে গেলেও চরণদাস ভোলে নি । এবার ওর আঁতে ঘা লেগেছে।

    হয়েছে কি , ওই ভুঁড়ো ব্যাটা তিনপুরুষের খানদানি হাবিলদার চতুর সিং অনেকদিন হল চরণদাসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে । ভালই আছে ; কোন আফশোস নেই । ওই ব্যাটা ভেতরের সব খবর চরণদাসকে এনে দেয় । তাই ও আগেভাগেই জেনে গেছল যে এরাজ্যের রাণীমা ওকে বেঁধে নিয়ে যেতে হুকুম দিয়েছেন । ফলে ‘ তু ডাল ডাল, ম্যাঁয় পাত পাত’।

    পুলিশ ডালে ডালে, চরণদাস পাতায় পাতায়। ধরা পরার প্রশ্নই ওঠে না ।

    কিন্তু চরণদাসের মন উচাটন। সুন্দরী নারীর দর্প! চরণদাস ওঁর ভয়ে ইঁদুরের গর্তে সেঁদিয়ে গেছে! কভি নহীঁ ।

    হ্যাঁ, রাণী সুন্দরী বটেন । চরণদাস দেখে নি । ও রাজপ্রাসাদ থেকে দূরেই থাকে। কিন্তু হাবিলদার দেখেছে । একসময় রাজপ্রাসাদে পাহারাদারি করেছে যে ! ও বলে – অতকা সুঘঘর , অতকা সুন্দর নারী তঁয় কভো দেখেইচ নহীঁ চরণদাস!

    অমন অপরূপ সুন্দর নারী তুই কখনও দেখিস নি রে ! রাণীর ভরা যৌবন , কিন্তু বিয়ে করেন নি । আজ অবধি কাউকে মনে ধরেনি যে ! রাণীর সব ভাল, কিন্তু রাগলে উগ্রচন্ডী!

    পেছনে সবাই বলাবলি করে যে যদি সময়মত বিয়ে হয়ে যায় তবে বোধহয় মেজাজ একটু ঠান্ডা হবে । আশপাশের রাজকর্মচারির দল হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। কিন্তু সেই ‘আচ্ছে দিন ‘ আসবে কবে? যে বছরে রোববার নেই সেই বছরে হবে!

    তবে রাণীর মনের কথা জানে একজন, ওঁর সহচরী ইতোয়ারিন বাঈ , ও ইতোয়ার বা রবিবারে জন্মেছিল তাই এই নাম। আসলে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যারা আসে তারা এমন খোসামুদে , এমন ভ্যাদভ্যাদে যে রাণীর পিত্তি জ্বলে যায় ।

    চরণদাস মনে মনে মতলব আঁটতে থাকে-- কি করে রাণীর অহংকারের বেলুনে ফুটো করা যায়!

    আজকে নবরাত্রির প্রথম দিন । চরণদাস এবং হাবিলদার চতুর সিং গেছে গুরুজির আশ্রমে কিছু ফলমূল নিয়ে । গুরুজি আশীর্বাদ করে বললেন – একটা কথা বলি চরণদাস। সবই তো হল । রাজ্যজুড়ে নাম হল , খাওয়াদাওয়ার চিন্তা ঘুচল; এবার চুরিটা ছেড়ে দে । তোকে এখন এ’সব কাজ মানায় না । আমারও তো একটা মান-সম্মান আছে । সবাই জানে তুই আমার কাছে মন্তর নিয়েছিস। এবার আমার কথা মেনে চুরি করা ছেড়ে দে ; হ্যাঁ, পাকাপাকি ভাবে।

    চরণদাস বিষণ্ণ হাসলো। তারপর গুরুজির পা ছুঁয়ে বলল, ছেড়ে দেব; সত্যি ছেড়ে দেব। তঁয় জানথস গুরুদেব মহু ঝুঠ নহী গোঠিয়াথন, লাবারি ন মারথন ।

    তুমি তো জান গুরুদেব – আমি মিথ্যে কথা বলি নে ; বাকতাল্লা ঝাড়ি নে ।

    শেষ একটা বড় হাত মারব, পিলান করে ফেলেছি। তারপর ? আর একটাও না । ধীরে ধীরে লোকে আমার নামের শেষে ‘চোর ‘ বলা ভুলে যাবে। বড়জোর চরণদাস ধোবি বলবে—যা আমার বাপ-পিতামোর পেশা!

    আসলে কি জান গুরুদেব, লোকে আমায় ভালবেসে ‘চরণদাস চোর ‘ বোলে ডাকে । সরকারি খাতায় আমি দাগি । আগে মজা পেতাম, আজকাল কোথায় যেন খচ করে লাগে। কেন জান? আমার চেয়ে অনেক বড় চোর , ডাকাত, জালসাজ এ রাজ্যে আছে । কিন্তু তাদের কেউ অমন ভাবে নামের পেছনে লেজ লাগিয়ে ডাকে না । তাহলে আমি কি দোষ করলাম?

    সাধুবাবার গলা ভরে এল। বেটা, তোর যখন জ্ঞানচক্ষু খুলে গেছে তাহলে ছেড়েই দে না; শুভস্য শীঘ্রম!

    -না গুরুজি; ওই রাণীমাকে একবার দেখিয়ে দেব চরণদাস কি জিনিস!

    গুরুজির গলা শুকিয়ে যায় । উনি শুধোন- তা কী করবি রে বেটা?

    -রাজার ‘খাজানা’ মানে রাজকোষে হাত মারব।

    --ওরে বাপরে! এসব কথা শোনাও --, তুই এখান থেকে যা চরণদাস ! তোর কল্যাণ হোক, হরে মুরারে!

    চরণদাস তক্কে তক্কে থাকে।

    এখন বসন্ত ঋতু; কোকিল ডাকছে, শিমূল পলাশ ফুটছে। গাঁয়ে গাঁয়ে যুবক যুবতীরা খেলায় মাতছে , গাছে উঠছে, দোলনায় দুলছে , মগডালে চড়ে সেখান থেকে নদিতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটছে।

    একদিন চতুর সিং হাবিলদার খবর আনল যে মহামন্ত্রী প্রত্যেক ঋতুতে একবার কোষাগার পরিদর্শনে আসেন। এবার বসন্তকালের পরিদর্শনটি হবে ঠিক দশদিন পরে , এক বুধবারে।

    চরণদাস চতুর সিং এর সহায়তায় সাতদিন ধরে মহামন্ত্রীর মত বেশ ধরে ওঁর মত হাঁটাচলা কথা বলা অভ্যাস করতে লাগল। বাকি সব একেবারে ‘খাপে খাপ, পঞ্চার বাপ’ ; কিন্তু কথা বলাটা ? জিভে জড়িয়ে যাচ্ছে, পুরোপুরি হচ্ছে না । শেষে হাবিলদার বুদ্ধি দিল কম কথা বলতে ইশারায় হুকুম দিতে ; একটা দুটো দরকারি শব্দ এবং হাতের ইশারা ব্যস।

    কোষাগারটি রাজপ্রাসাদ এবং দরবার থেকে কোশ দুই দূরে। মন্ত্রীমশায় সকাল সকাল রওনা হয়েছেন। পরিদর্শন করে রাণীমাকে হিসেব পেশ করবেন। কিন্তু পথে গাঁয়ে গাঁয়ে সম্বর্ধনা, ফুলমালা , জলযোগ এবং বিশ্রাম এইসবে মন্ত্রীমশায়ের দু’ঘন্টা দেরি হল । কী করা যাবে? রাস্তায় গাঁয়ের লোকে হাতে মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে ! সেই সকাল থেকে রোদে গলদঘর্ম, না করা উচিত হবে না । প্রবীণ হাবিলদার তাই বোঝাল বটে !

    ওকে চরণদাস বলেছিল একঘন্টা যথেষ্ট, তবু বলা তো যায় না; সাবধানের মার নেই।

    যথাসময়ে মহামন্ত্রী হাজির কোষাগারের সামনে সামনে ভল্ল উঁচিয়ে পাইক বরকন্দাজ! এক ডজনের কম নয় ।

    --খাজাঞ্চিকে ডাক ।

    আগে থেকেই খবর দেওয়া ছিল। দরবিগলিত খাজাঞ্চি ইশারায় পাইকদের রাস্তা ছেড়ে দিতে বলল । ভেতরে গিয়ে মহামন্ত্রীজি বড় সিন্দুকের তালা খুলে দিয়ে বাইরে যেতে বললেন । আরও বললেন হিসেবের জাবদা খাতাটা ছেড়ে যেতে ।

    খাজাঞ্চি একটু অবাক হল । কিন্তু মহামন্ত্রীজির এক ধমকে তালা খুলে চাবি ওনার হাতে দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

    সিন্দুকের ডালা খুলে চরণদাসের চক্ষু চড়কগাছ! সাতনরী হার, মুক্তো হীরে-জহরত কি নেই ?

    সবগুলো হাতে তুলে নেড়ে চেড়ে দেখল। তারপর ভাবল –না , লোভ করব না । গুরুদেবকে কথা দিয়েছি যে ।

    জাবদা খাতায় দেখল সোনার মোহর আছে একশ’টি। ও দশটা তুলে কামিজের পকেটে পুরল। তারপর নিজের মনে বলল—নাঃ ; পাঁচটাই যথেষ্ট । আমি তো শুধু রাণীমাকে দেখাতে চাই ।

    তারপর ও পাঁচটা ফেরত রেখে তালা এঁটে বাইরে এসে খাজাঞ্চির হাতে চাবি দিয়ে মাথা নেড়ে বোঝাল সব ঠিক আছে। খাজাঞ্চি একটু নাস্তা করতে বলায় ও মাছি তাড়ানোর মত করে হাতে নেড়ে বেরিয়ে একটা ঘোড়ার পিঠে চড়ে পগার পার।

    এক ঘন্টা পরে আবার মহামন্ত্রী এলেন পরিদর্শনে। পাইক-বরকন্দাজ পথ আটকে দাঁড়াল। উনি বললেন—এ কি অসভ্যতা! সরে দাঁড়া বলছি ।

    খাজাঞ্চি বলল—তুমি কে বট হে !

    --- আজ কি ভাঙ চড়িয়ে কাজে এসেছিস? আমায় চিনিস না ? আমি মহামন্ত্রী, কোষাগারের হিসেব মিলিয়ে দেখব। আগে থেকেই খবর দেওয়া হয়েছিল; ভুলে গেছিস?

    --আচ্ছা, তুই মহামন্ত্রী? তাহলে ঘন্টখানেক আগে যিনি পরিদর্শন করে গেলেন, তিনি কে ?

    -- কে এসেছিল তুই বল। আমি তো এই এলাম।

    --সেপাই,ধর একে। এ ব্যাটা নিঘঘাৎ চুরির মতলবে এসেছে।

    সেপাইরা মহামন্ত্রীকে জাপটে ধরে। একটু পরে হাবিলদার চতুর সিং এসে ওনাকে উদ্ধার করে এবং খাজাঞ্চিকে এইরকম বোকামি ও বদতমিজি করার জন্যে কড়কে দেয় ।

    বুড়ো খাজাঞ্চির রক্তচাপ বেড়ে যায় । তাহলে যে এসে সিন্দুক খুলে হিসেব মিলিয়ে চলে গেল সে কে ? দিব্যি গেলে বলতে পারে সেও ঠিক এই আসল মহামন্ত্রীর মতই দেখতে।

    চতুর সিং হাবিলদার জেরা করে, ঠিক করে মনে কর বুড়ো! সব একইরকম ? জামাকাপড় চশমা সব? এনাকে ভাল করে দেখে মনে মনে মিলিয়ে নিয়ে বল। একইরকম ?

    খাজাঞ্চি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, বাকি সব একরকম; জামাকাপড় , পাগড়ি, কপালে চন্দনের ফোঁটা , চশমা, কিন্তু –

    --কিন্তু কী ?

    --হুজুর, ওর পা। আপনার পায়ে জরির কাজ করা ঝকঝকে নাগরা। কিন্তু ওর পায়ে একটা পুরনো সাধারণ নাগরা, আঙুলের কাছে ফাটা।

    সবাই স্তম্ভিত।

    চতুর সিং জিভ কাটে, সাজাতে গিয়ে একটা মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। তারপর সামলে নিয়ে বলে—এই দুঃসাহস গোটা রাজ্যে শুধু একজনেরই হতে পারে , চরণদাস চোর ।

    মহামন্ত্রী পারলে চোখের আগুনে খাজাঞ্চিকে ভস্ম করে ফেলেন । বলেন, আমি দেখব না । তুমি আগে সিন্দুক খুলে হিসেব মিলিয়ে দেখে বল – কী কী চুরি গেছে । সব তোমার মাসমাইনে থেকে কাটা যাবে।

    কাঁপতে কাঁপতে খাজাঞ্চি ভেতরে গিয়ে হিসেব মিলিয়ে বেরিয়ে আসে। আগের মত কাঁপছে না , কিন্তু একটু বেশি ঘামছে।

    --আমাদের কপাল ভাল মহামন্ত্রীজি, চোর বেশি কিছু নিতে পারে নি । হয়তো ভয় পেয়ে তাড়াহুড়ো করেছে , বাইরে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তো !

    -- বাজে বোকো না ; নিয়েছেটা কী ?

    -- কিছু না , শুধু দশটি সোনার মোহর।



    সত্যনাম সত্যনাম সত্যনাম সার,
    গুরু, মহিমা অপার,
    গুরু, অমৃতধার বহাই দে ,
    গুরু, বেড়াপার করাই দে!
    (ছত্তিশগড়ের দলিত ‘সতনামী’ সমাজের গান, পন্থীনাচের সঙ্গে গাওয়া হয় )

    রাণী ফুলমতী জরুরি বৈঠক করছেন। রাগের ঝাঁঝ চেপে রাখা গেল না । প্রথম চোট সোজা মহামন্ত্রীর উপর। আপনি না বলেছিলেন চরণদাস চোরকে ভুলে যাওয়াই ভালো। ও ভয়ের চোটে রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে ভিন রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। বড়ধরণের কোন চুরি অনেকদিন শোনা যাচ্ছে না । আপনিও বলেছিলেন , আমিও বিশ্বাস করেছিলাম। এবার কী বলবেন?

    মহামন্ত্রী নিরুত্তর; কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

    রাণী বড় করে শ্বাস নিলেন । একগ্লাস জল খেলেন। তারপর বললেন, চুপ করে বসে থাকলে চলবে না । রাজকোষ থেকে দিনেদুপুরে এমন চুরি! একে তো ডাকাতি বললেও কম বলা হয়, অপরাধী আমাদের ক্ষমতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। হাসির খোরাক করে ছেড়েছে। এখন পুরো ঘটনাটি যদি জানাজানি হয়ে যায় তো সাধারণ চাষিবাসি প্রজারা আমাদের আর মেনে চলবে? খাজনা দেবে? রাজকীয় উৎসবের দিনে বেগার খাটবে?

    সবাই ধীরে ধীরে দু’দিকে মাথা নাড়লেন।

    রাণী বললেন—আপনাদের মস্তিষ্কে পক্ষাঘাত হয়েছে। সবাই বোবাকালা হয়ে গেছেন । আমি বলছি কী করতে হবে। নগর কোতোয়াল! আপনি আপনার গোটা রাজ্যের বাছা বাছা গুপ্তচরদের ডাকুন। তিনদিনের মধ্যে চরণদাস আর তার গুরুমহারাজের হদিস চাই । তারপর আপনার বিশেষ একটি দল যাবে চরণদাস এবং তার গুরুকে বামাল সমেত বন্দী করে দরবারে আমার সামনে হাজির করতে । আমি দেখতে চাই ও কোন ধাতুতে তৈরি।

    মুখ খুললেন মহামন্ত্রী।

    অভয় দেন তো একটা কথা বলি । এভাবে চরণদাসকে ধরা যাবে না । এ’ধরণের চেষ্টা আগেও হয়েছে। লোকে ওকে ভালবাসে। ও জলের মধ্যে মাছের মতন ওদের সঙ্গে মিশে থাকে । চরণদাস আমাদের রাজ্যে খুব সাধারণ একটা নাম। গাঁয়ে গঞ্জে শ’য়ে শ’য়ে চরণদাস। লোকে আমাদের সেপাই-খবরি-খোচর সবাইকে বোকা বানাবে; ইচ্ছে করে অন্য অনেক চরণদাসের খবর এনে দিয়ে সব কাচ্চি করে দেবে। এভাবে হবে না ।

    রাণী রেগে লাল; থমথমে চেহারা। হিসহিস করে বললেন—আর কিছু বলার আছে ?

    --আছে রাণীমা। ও গুরুর কাছে প্রণ করেছে সত্যি বই মিথ্যে বলবে না ।

    সভাকবি বোলে উঠল—“রঘুকুল রীত সদা চলি আয়ে,
    প্রাণ জায়ে পর বচন ন জায়ে।“

    রাণী হাত তুলে থামালেন। ওসব গালগল্প অনেক শোনা আছে । অমন দিব্যি সবাই করে। ছোটবেলায় বাপ-মার কাছে। বড় হয়ে গুরুর কাছে। কিন্তু সত্যি সত্যি মানে ক’জন?

    --চরণদাস তো মানে । গত কয় বছর ধরে মেনে চলেছে।

    --আচ্ছা, তাতে আমাদের কী লাভ?

    --আছে , লাভ আছে রাণীমা। ওর গুরুদেবটিকে তুলে আনুন। ওর মুখ দিয়ে ঘোষণা করিয়ে দিন যে চরণদাস যদি সত্যবাদী হয় তবে তিনদিনের মাথায় দরবারে এসে অপরাধ কবুল করুক। ওকে ক্ষমা করা হবে।

    -- আর যদি না আসে ?

    -- তবে গুরুদেবটিকে চোরের কানে মন্ত্র দিয়ে চুরি করানোর অপরাধে গারদে পোরা হবে।

    -কিন্তু যদি ও এসে দোষ কবুল করে তাহলে?

    মহামন্ত্রী হেসে উঠলেন । শিকার একবার ফাঁদে পড়লে তাকে কি করা হবে সেটা কে ঠিক করে ? শিকারী না শিকার নিজে? তখন আপনি যা ভালো বুঝবেন।

    রাণী শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। তাই হোক। ও আসলে আমি ওকে ক্ষমা করে দেবা।আমার কথার খেলাপ হবে না। ও সত্যবাদী হলে আমি কেন মিথ্যেবাদী হব ? তাহলে জিত হবে ওর ; সেটা আমি হতে দেব না ।

    তাই হল।গুরুদেবকে ধরে আনা হল। তারপর ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করা হলঃ

    ডুম-ডুম-ডুম!

    শোন শোন শোন ! গ্রামবাসী নগরবাসী শোন! ডুম-ডুম-ডুম!
    আমাদের রাণীমা ঘোষণা করেছেন যে ডুম-ডুম-ডুম!
    চরণদাস যদি সত্যবাদী হয় তাহলে ডুম-ডুম-ডুম!
    যেন তিনদিনের মধ্যে দরবারে হাজির হয় ডুম-ডুম-ডুম!
    নিজের দোষ স্বীকার করে ডুম-ডুম-ডুম!
    তাহলে রাণীমা ওকে মাপ করে দেবেন! ডুম-ডুম-ডুম!
    আদেশ না মানলে ডুম-ডুম-ডুম!
    ওর গুরুদেব গারদে পচবে! ডুম-ডুম-ডুম!
    ডুম-ডুম-ডুম!

    তিনদিন লাগল না । দ্বিতীয়দিন ভর দুপুরে চরণদাস হাজির। গুরুদেবকে দেখতে পেয়ে ওর মুখে একগাল হাসি। সোজা গিয়ে পায়ের ধূলো নিল। বলল – তঁয় চিন্তা ঝন করবে গুরদেব। তোর কোনহ গলতি নাহী।

    আমি এসে গেছি। রাণীমা তোকে ছেড়ে দেবে। গুরুর থুতু শুকিয়ে গেছে । অতিকষ্টে বললেন—কল্যাণ হো!

    এবার মহামন্ত্রী গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন—চরণদাস, রাণীমার দিকে তাকাও। উনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন ।

    চরণদাস দেখল মাঝবয়েসি সুন্দরী নারী। কিন্তু অহংকারে ঠোঁট বাঁকা। ও মাটিতে গড় হয়ে প্রণাম করল। রাণী বরাভয় মুদ্রায় ডান হাত তুললেন।

    --চরণদাস !

    --জী রাণীদাঈ!

    -- তুই নাকি কখনও মিথ্যে বলিস না? সত্যি?

    -- যা বলি তা সত্যবচন , মিথ্যা কথা নয় কদাচন।

    হেসে ওঠেন রাণী । বাঃ বাঃ ; এ তো বেশ মজার মানুষ।

    --- বেশ, তাহলে বল কোষাগার থেকে স্বর্ণমুদ্রা কে নিয়েছে?

    --আমি রাণীদাঈ! পাঁচ সোনার মোহর । এই নিন সেই পাঁচ মোহর।

    -- পকড়ে গয়ে! কাবর ঝুটমুট গোঠিয়াথস ? ধরা পরে গেলি তো! কেন মিছেমিছি গপ্পো ফাঁদছিস? খাজাঞ্চি গুণে বলেছে চুরি হয়েছে দশটা সোনার মোহর।

    -- আমি সত্যি বলছি , শুধু পাঁচটাই নিয়েছি। সামনে গুরুদেব হাজির। চুরি করতে হলে তো সাতনরী হারটাই নিতাম। আমি শুধু আপনাকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে ভয় পেয়ে গা ঢাকা দিই নি।

    -- তাহলে তোষাখানার সিন্দুকে দশটা কেন কম হল ?

    --- খাজাঞ্চিকে জিজ্ঞেস করুন। ওই তো গুণেছে। ভেবেছে ডুবে ডুবে জল খেলে শিবের বাবাও টের পাবে না !

    রাণীমার চোখে আগুন জ্বলে। সে দৃষ্টির সামনে খাজাঞ্চি ভয়ে কুঁকড়ে যায় । কাঁপতে কাঁপতে জেব হাতড়ে বাকি পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা রাণীর পায়ের সামনে মাটিতে রাখে।

    --দূর হয়ে যা ! কাল থেকে যেন দরবারের আশেপাশে তোকে না দেখি।

    এবার রাণী তাকান চরণদাসের দিকে।

    --চরণদাস! তুই একটা আজব মানুষ। এমন আর যেমন বুদ্ধি, তেমনই সাহস। লুট ফেরৎ করে দিলি । কোষাগারের লোকসান হল না । তোকে আমি মাপ করে দিলাম।

    জয় হো! জয় হো রাণীদাঈকে!

    জয়ধ্বনিতে কাঁপে দরবার। চরণদাস মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে।

    --মহামন্ত্রী! আমি ওকে পুরস্কার দেব । বিশেষ সম্মান দেব । আজ এক বিশাল শোভাযাত্রা নগর পরিভ্রমণ করবে । তার সামনে হাতির পিঠে বসে থাকবে চরণদাস। সবাই দেখুক ও এমন মানুষ; শিখুক সত্যি কথার ফল। যাও চরণদাস ! মন্ত্রীজির সঙ্গে যাও।

    হাততালির ঝড়।

    চরণদাস বোকার মত একগাল হাসে। এদিক ওদিক তাকায় । এই সৌভাগ্য যেন বিশ্বাস হচ্ছে না । তারপর চমকে ওঠে। কিছু একটা মনে পড়েছে। তারপর হাতজোড় করে রাণীর দিকে তাকায়।

    --রাণীদাঈ! রাণীমা!

    --কি হল , কিছু বলতে চাও? নির্ভয়ে বল।

    -- রাণীমা, এটা হতে পারে না।

    --মানে? কী হতে পারে না ?

    -- আমি হাতির পিঠে চড়ে শোভাযাত্রায় যেতে পারব না । গুরুর কাছে পরণ করেছিলাম যে!

    -- আমি আদেশ করছি ।

    --রাণীমা, পরণ ভাঙতে পারব না ।

    রাণী অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিলেন।

    --ঠিক আছে , ঠিক আছে । শোভাযাত্রায় যেতে হবে না । এককাজ কর, বেলা হয়ে গিয়েছে তোমার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে। তুমি এবার আমার সঙ্গে বসে ভোজন কর। খেতে খেতে তোমার সব কথা শুনব ।

    চরণদাস লজ্জা লজ্জা মুখে হাসে, হাত কচলায়।

    রাণী নিজের সহচরী ইতওয়ারিনকে ডেকে বললেন – যা ; রূপোর – না না সোনার থালা সোনার বাটিতে পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে দে আমাদের দু’জনের জন্যে ।

    আবার চমকে ওঠে চরণদাস। এটা কি করে হয় ? ভাগ্য আজ তার সঙ্গে এ কি খেলায় মেতেছে? ওর মনে পড়েছে দুসরা পরণ—‘কখনও সোনার থালায় খাব না’।

    এবার রাণী বিরক্ত হন । মেজাজ চড়ছে। আবার সেই ‘পরণ’? ইয়ার্কির শেষ নেই ? আচ্ছা, গুরুর কাছে পরণ করেছিলি, এই তো তোর গুরুদেব, সাক্ষাৎ সামনে হাজির। গুরুদেব বলছেন প্রণ ফিরিয়ে নিতে , তাহলে আপত্তি নেই তো ? চল, এবার ভোজনশালায় যাই।

    চরণদাস নড়ে না ।

    কী হল ? এত আচ্ছা আপদ!

    মাফি দেও রাণীদাঈ, একবার পরণ করলে সেটা ফিরিয়ে নেয়া যায় না । গুরু বললেও না ।

    রাণী গর্জে উঠলেন, চরণদাস! তোর আস্পর্দা তো কম নয় ? সেদিনের ছিঁচকে চোর । আমার আদেশ অমান্য করিস? এই জন্যেই বলে কুকুরকে লাই দিতে নেই । আরেকবার বল, আদেশ মানবি কি না ?

    অসহায় চরণদাস গুরুর দিকে তাকায় তারপর মাথা নাড়ে, পারব না রাণীদাঈ।

    --বন্দী কর; নিয়ে যাও গারদে। সারাদিন খেতে দিও না । দেখি এর কত তেজ!

    চারজন প্রহরী ওকে টানতে টানতে নিয়ে যায় । চরণদাস চেঁচিয়ে ওঠে—গুরুদেব! মোলা বাঁচা লে গুরুদেব।

    গুরু ডানহাত তুলে বলেন -কল্যাণ হো! কল্যাণ হো!

    তারপর এক ছুটে হাওয়া।



    ‘নদিয়াকে পার মা, পরদেশি গাঁও মা,
    লাগে হ্যায় অব্বর এক মেলা;
    আজা টুরি ঝুলবে তঁয় ঝুলা’।

    ওই নদিটির পারেতে, অচেনা এক গাঁয়েতে ,
    বসেছে আজ জমকালো এক মেলা,
    আয় গো মেয়ে তোমায় দেব দোলা।

    প্রাসাদের এক কোণের দিকে রয়েছে হাজত ঘর, ঘোড়াশাল হাতিশালের পাশে। সেখানে মাটিতে শুয়ে এ’পাশ ও’পাশ করছে চরণদাস । ঘুম আসবে কি করে ? পেটে এক দানাও পড়ে নি , এক ফোঁটা জলও না । পাইকগুলো কেমন যেন লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে ও বলল কিছু একটা দাও, তোমাদের খাবার থেকেই দাও , আর দু’ঢোঁক জল খেতে দাও – কিন্তু উজবুকগুলো রাণীমার ভয়ে রা’টি কাড়ে না ।

    বহুবছর বাদে খিদের এমন জ্বালা টের পেল চরণদাস। বুঝতে পারল কাল সকালের আগে কোন ফয়সালা হবে না । কিন্তু এই কালী রাত যে কাটতেই চায় না ।

    ওদিকে আরেকজন ঘুমুতে পারছে না । রাণী ফুলমতী। সহচরী ইতওয়ারিন বাঈ অনেক’খন ময়ুরপঙ্খের পাখা দিয়ে বাতাস করল, মাথা টিপে দিল , পায়ে হাত বুলিয়ে দিল। এবার নিশ্চয় রাণীর ঘুম আসবে । কিন্তু একটু পরেই আবার ডাক – ইতোয়ারিন ! একবার আয় দেখি! ওই গানটা শোনাবি , অনেক দিন শুনিনি। আজ শুনতে বড্ড ইচ্ছে করছে ।

    ইতওয়ারিন অবাক হয় ; তারপর গুনগুনিয়ে শুরু করেঃ

    ‘নদিয়াকে পার মা, পরদেশি গাঁও মা,
    লাগে হ্যায় অব্বর এক মেলা;
    আজা টুরি ঝুলবে তঁয় ঝুলা’।

    কবে সেই বচপন কে দিনোঁ মেঁ এই গানটা শুনেছিলেন। গানটা গাইত যে কিশোর তার মুখও মনে পড়ে না । কিন্তু আজ এটা শুনতে এত ইচ্ছে করছে! কেন করছে?

    --তোমার কী হয়েছে বল দেখি! এমন ছটফট করছ কেন ? না নিজে ঘুমুবে , না আমাকে ঘুমুতে দেবে। কাল রাজবৈদ্যকে খবর দিই?

    কি যে হয়েছে তাকি রাণী নিজেই বুঝতে পারছেন ? শুধু টের পাচ্ছেন যে নিয়তি তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে এক অমোঘ পরিণতির দিকে ।

    -শোন, একটা কাজ করতে পারবি? একটা কাঁসার থালায় করে কিছু ভাত ডাল তরকারি, লোটায় করে খাবার জল ওকে চুপচাপ দিয়ে আসতে পারবি?

    -কাকে?

    -কাকে আবার ? ওই যে জোয়ান ছেলেটা সারাদিন না খেয়ে রয়েছে। আমার নাম করে প্রহরীকে বলবি হাজতের দরজা খুলে দিতে। তুই সামনে দাঁড়িয়ে থাকবি। খাওয়া হয়ে গেলে বাসনপত্তর গুছিয়ে নিয়ে চলে আসবি । কিন্তু সাবধান, যেন পাঁচকান না হয় ।

    -ঠিক আছে ; আমি দেখে নেব । তুমি এখন ঘুমোও দেখি।

    -আগে তুই আমাকে ওর থালাটা সাজিয়ে দেখিয়ে দিয়ে যা।

    ইতওয়ারিনের চোখ কপালে! রাণীমার হল কি ? কোন পেঁচোয় ভর করল? হে ঠাকুরদেব, হে বাররাজা, হে বাড়রাণী! তোমরা রক্ষে কর এই অবোধ রাণীকে।

    কিন্তু এত রাতে ওই দেবতারা বোধহয় ঘুমুচ্ছিলেন, তাই ইতওয়ারিন বাঈয়ের আকুল প্রার্থনা শুনতে পেলেন না । ফলটা হল ভয়ানক। একেবারে যা তা!

    থালি দেখে রাণী বললেন – শোন, তুই ওকে এখানে নিইয়ে আয় , এখানেই আমার সামনে তুই ওকে খেতে দিবি। ছেলেটা বড্ড একগুঁইয়ে আর অভিমানী । আমি বারণ করেছিলাম তো , তাই আমি বললে তবে খাবে ।

    --রাণীমা, তুমি এসব কি বলছ? মাথাটা কি একেবারে গেছে?

    -- কথা বাড়াস নে , তাড়াতাড়ি যা । এই আমার ছাপ লাগানো মুদ্রা নিয়ে যা । প্রহরীদের দেখা। ওরা চারজন চরণদাসকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে, কিন্তু হাত খোলা থাকে যেন । ও পালাবে না। ওরা আমার ঘরের বাইরে পাহারায় থাকবে। যা, থালাটালা এখানে রেখে যা ।

    ইতওয়ারিনের একেবারে সিট্টি-পিট্টি- গুম।

    তাহলে ব্যাপারটা এই? রাণী ফুলমতী মজেছে । মজেছে এবং ডুবেছে, ডুবেছে এবং মরেছে। সে না হয় হল , কিন্তু মজল কার সঙ্গে? একটা চোর । হে ঠাকুর, রাণী কী দেখল ওর মধ্যে? যাকগে, রাজা-রাণীদের ব্যাপার স্যাপার আলাদা । আমার আর বুঝে কাজ নেই ।

    রাণীর কক্ষে দীপের আলোয় মাটিতে কারুকাজ করা আসনে বসে খাচ্ছে চরণদাস। ময়ূরপংখের পাখা দুলিয়ে বাতাস করছে সহচরি। ঘর ম’ম’ করা অগুরুর গন্ধে চরণদাসের মাথা ধরেছে । কিন্তু ও খাচ্ছে গোগ্রাসে, রাণী বলছেন অনেককথা । চরণদাস হুঁ হাঁ করছে, ওর মন শুধু খাওয়ায়। এক খামখেয়ালি সুন্দরী দর্পিতা নারীর পাল্লায় পড়েছে ; তায় এ নারীর অগাধ ক্ষমতা। পরের খাওয়া কখন জুটবে , আদৌ জুটবে কি না – কে বলতে পারে।

    খাওয়া শেষ । হাত ধুয়ে চরণদাস উঠে দাঁড়ায়, রাণীকে প্রণাম করে। তৈরি হয় হাতকড়া পরে হাজতে ফিরে যেতে । এবার ঘুম আসবে ।

    কিন্তু রাণী ইশারায় ওকে থাকতে বলেন । সহচরিকে বলেন এঁটো বাসনকোসন নিয়ে যেতে আর বাইরে থেকে দরজা ভেজিয়ে দিতে ।

    --চরণদাস!

    -- কা রাণীদাঈ?

    -তোকে আর হাজতে যেতে হবে না, হাতকড়া পরতে হবে না ।

    --আপকী কিরপা রাণীদাঈ ।

    --ধ্যাৎ , কি তখন থেকে রাণীদাঈ রাণীদাঈ শুরু করেছিস! আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারিস, বল ফুলমতী ।

    --হউ রাণীদাঈ!

    --উঃ ,তোকে নিয়ে পারা গেল না । শোন , তুই এখন থেকে এই প্রাসাদেই থাকবি, আমার চোখের সামনে। এমন কড়া পাহারায় রাখব যে চুরি করার কথা ভুলে যাবি। কি , পছন্দ হল ?

    চরণদাসের মাথায় কিছুই ঢোকে না । ও জিজ্ঞেস করে ওর কাজটা কী হবে?

    --তোর মতন এমন লোক লাখে কেন, কোটিকে গোটিক। তাই ভাবছি তোকে রাজা করব। সিংহাসন আর খালি থাকবে না । এবার বল, কেমন লাগছে? ভয় পাস নে , তুই যেমন চালাক-চতুর অল্পদিনেই শিখে নিবি। আরে , আমি তোকে শিখিয়ে পড়িয়ে লায়েক বানিয়ে দেব।

    চরণদাসের সামনে লোভের কালীয়নাগ হাজার ফণা তুলে নাচছে।

    প্রভো, আমার ভাগ্য কি আমায় কালীদহে চোরাস্রোতে টেনে নেবে ? নইলে এক এক করে সবগুলো ‘পরণ’ ভাঙার প্রলোভন সমানে আমার সামনে মোহিনী রূপ ধরে আসছে কেন ?

    চরণদাস ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে , মেজেতে মাথা কোটে। এ কি চরনদাস!

    আমাকে মাপ কর রাণীমা, আমি এটাও পারব না । তিসরা পরণ তো ওহি থা , রাজ্যের জনতা আমাকে রাজা হতে বল্লেও রাজি হব না । রাণী অবাক , তারপর হেসে ফেলেন। এটাও পণ করেছিলে? কী করে ভেবেছিলে যে কেউ তোমাকে কখনও রাজা হতে বলবে?

    রাণী চরণদাসকে হাত ধরে মাটি থেকে তোলেন।

    তোমায় যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি। তুমি কারও মত না । আচ্ছা, তোমায় দেশের রাজা হতে হবে না । তুমি হবে আমার রাজা আর আমি হব তোমার একমাত্র প্রজা। আমায় বিয়ে কর চরণদাস। আমার থেকে কষে খাজনা আদায় কর। এবার আমি কোন না শুনব না , কোন পরণ-টরণ শুনব না । ওসব ঢের হয়েছে।

    চরণদাসের সামনে গভীর খাই , কৃষ্ণগহ্বর । তাতে নরকের আগুন, গন্ধক পুড়ছে। রাণী ফুলমতীর দুই হাত ওর কাঁধে , নাকের পাটা ফুলছে, নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে। চরণদাস রাণীর হাত ছাড়িয়ে দেয় , চোখ নামিয়ে নেয় ।

    --কী হল চরণদাস?

    -- এহি থা চৌথা পরণ; কোন দেশের রাণী আমায় বিয়ে করতে চাইলে রাজি হব না ।

    --চরণদাস, আমার দিকে তাকা। চোখ তোল, বল আমি কি সুন্দর নই ? আমাকে তোর পছন্দ হয় নি ?

    চরণদাস হাত জোড় করে । এইসন ঝন বোলিহ রাণীদাঈ । অতেক সুন্দর , অতেক সুঘঘর, কভো নহী দেখে হন।

    এমন কথা বোল না রাণীমা। তুমি এত সুন্দর ; এত রূপ কখনও দেখি নি ।

    - তাহলে ? আমার দিকে তাকা চরণদাস, চোখ তোল ।

    চরণদাস চোখ তোলে না । মাটির দিকে তাকিয়ে বলে – পরণ ভাঙতে পারব না ।

    রাণীর গলায় বাজ গরগর করে ।

    --চরণদাস, তোর মরার ভয় নেই?

    চরণদাস কাঁপতে থাকে , হাত জোড় করে –আছে রাণীমা, আছে । লেকিন পরণ তোড় নহীঁ সকুঁ।

    রাণী দু’বার হাততালির আওয়াজে দরজা খুলে ঘরে ঢোকে চারজন প্রহরী ।ওদের চেহারায় আশংকা ,চোখে মূক প্রশ্ন।

    --এই বর্বর অসভ্য বুনো আমার আদেশ মানে নি , আমাকে অপমান করেছে । আমার দয়ার সুযোগ নিয়েছে। গেঁথে ফেল।

    চারজোড়া ভল্ল ওর শরীর লক্ষ্য করে এগিয়ে আসে। চরণদাস কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে যায় , চিৎকার করতে চায় –গুরুদেব! রাণীদাঈ!

    কিন্তু দু’জোড়া ভল্ল এর মধ্যেই ওর গলার নলি আর বুকে বিঁধে গেছে। ওর শব বুনোশুয়োর শিকারের মত করে বর্শায় গেঁথে নিয়ে যাওয়া হয় ।

    বিছানায় লুটিয়ে পড়েছেন রাণী ফুলমতী। বুকের মাঝে এখন মহানদীর বান । থেকে থেকে ডুকরে উঠছেন – এ আমি কি করলাম!

    ইতিমধ্যে ভোর হয়েছে। কারা যেন নগর সংকীর্তনে বেরিয়েছে। মাদর ও খঞ্জনি বাজছে। ভৈরোঁ রাগে একটা গান ভোরের বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে, তাতে একটা লাইন শুধু স্পষ্ট হচ্ছেঃ

    “সত্য ঈশ্বর , ঈশ্বর সত্য “।

    চরণদাসের কি ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা হল ? আমরা জানি না ।

    ========================================

    (এই লেখাটি গত বইমেলায় ঋতবাক প্রকাশনের "তিনটি ছত্তিশগড়ি রূপকথা" সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রমিত | 202.8.114.234 | ২২ অক্টোবর ২০২০ ২১:৩১98779
  • আগে এই নাটকটির কথা অনেক শুনেছি, কোন দিন দেখার সুযোগ হয়নি। আপনার লেখায় পুরো জীবন্ত হয়ে উঠে এলো চোখের সামনে। সাথে ছত্তিশগড়ি ফ্লেভারটাও পুরোপুরি পেলাম, অথচ এটার দেশকালপাত্র যা খুশি হতে পারে। খুব ভালো লাগল। এরকম আরো বিখ্যাত নাটককে গল্পপের আকারে তুলে আনতে পারেন হয়বদন, তুঘলক, মারিচ সংবাদ, ঘাসিরাম কোতোয়াল 

  • সম্বিৎ | ২২ অক্টোবর ২০২০ ২১:৫৯98781
  • চরণদাস দেখেছি আটের দশকে রবীন্দ্রসদনে। হাবিব তনভিরের। তখন মুগ্ধ হয়েছিলাম। মুগ্ধ হবারই বয়েস তখন। নিরাভরণ মঞ্চ। সেট-টেটের বালাই নেই। বোঝা যায় প্রসেনিয়ামের জন্যে এ নাটক নয়। ভাষা ভাল বুঝিনি, কিন্তু কী অভিনয় আর কী মাউন্টিং। এবার রঞ্জনদার লেখাটা পড়ব। 

  • | 2607:fb90:e15a:5b58:38be:8730:5a5d:88ad | ২৩ অক্টোবর ২০২০ ০১:২৮98788
  • আমিও দেখেছি এ নাটক।একাডেমিতে। নব্বইয়ের শুরুতে। বুড়ো তনভির আর সুন্দরী রানীকে দিব্যি মনে পড়ে গেল।


    অনেক ধন্যবাদ রন্ঞ্জনদা।

  • অনিমেষ বিশ্বাস | 2401:4900:1228:b372:b50d:6bd6:20e0:a764 | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২১:২৮523144
  • কৌতুহলবশত প্রশ্নটি করছি। চরণদাস চোরের গল্পটি ছত্তিসগড়ী লোককথায় স্থান পেল কেন? এটা তো মূলত রাজস্থানী লোককথা যার প্রথম ' লিখিত রূপ দান করেন বিজ্জি' অর্থাৎ বিজয়দান দেথা । পরবর্তীতে হাবিব তনওয়ীর বিজয়দান দেথার লেখাটিকে নাট্যরূপ দান করেন। 
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন