এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সব চরিত্ররাই কাল্পনিক নয়...

    Chandan Sengupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ অক্টোবর ২০২০ | ১৪৮২ বার পঠিত | রেটিং ৪.৩ (৬ জন)
  • তথাগত রায়চৌধুরী……

    মাঝে মাঝে নিজেকে তার খুব একা মনেহয়, কেমন যেন হারিয়ে যায় সে বাস্তব জীবন থেকে , হঠাত্‍ করেই দূরে চলে যায় তার আদরের গড়ে তোলা সংসার থেকে, যাকে সে খুব যত্ন করে গড়ে তুলেছে এবং আগলে রেখেছে।

    এই সমস্যা কাউকে বলে বোঝানো যায়না..... বউ ছেলে মেয়ে। মা বাবার কাছ থেকে আশাও করেনা... তবু যাকে এতদিন বোঝালে না বুঝলেও বোঝার চেষ্টা করতো , সেই বিনতি পিসিও সেদিন কথা শোনালো...

    এদিকে এতদিনেও তথা বুঝেই উঠতে পারছেনা, যে সে কী করবে? মাঝে লুকিয়ে সাইক্রীয়াটিস্টের কাছেও গেছে...সে কিসব ভুলভাল উপদেশ দিচ্ছে। ঠিকঠাক মনে হয়নি তথার..... বৌকে সাথে নিয়ে যাবে ভাবছে অন্য কারোর কাছে , কিন্তু ঠিক ম্যানেজ করা যাচ্ছেনা। এই দীর্ঘ প্যানডেমিক পরিবেশে আরোও জাঁকিয়ে বসেছে রোগ।

    এমনিতে মোটামুটি মেধার ছাত্র ছিল তথা... খুব আহামরিও না আবার ফেলে দেওয়া গড়পরতাও নয়... বি’টেক করেছে সরকারী কলেজ থেকে, নয়তো অবশ্য হতও না....বাবা সৌগত রায়চৌধুরির অতো আর্থিক সঙ্গতি ছিলনা যে তাকে ভাল প্রাইভেট কলেজ থেকে পড়াবে, তো তারপরেই চাকরি আর সেখান থেকে এমবিএ টাও সেরে রেখেছে। সে যাহোক একদিকে ভালই হয়েছে... অন্তত পড়াশোনায় যে মোটামুটি ‘ভালো’ সেটা তো এখনও সে শুনতে পায়...আর প্রশংসা শুনতে তথার খুব ভাল লাগে।

    কিন্তু তথার আপত্তি টা তো বোধহয় এখানেই... সে যা হতে চেয়েছিল, তা’পারেনি... কিন্তু সেইগুলোতে যে সে ‘খুব ভালো’ ছিলো এবং সেইসব বিভাগে এগোলে যে সে খুব নাম করতো...বা আরও ভালোভাবে জীবন কাটাতে পারতো... ‘এইটুকুও’ কেউ বলেনা...কেউ প্রানখুলে তথার সেসব প্রতিভার কদরই করেনা... এদিকে সে আজকে যা, তা সে কোনদিন কল্পনাতেও হতে চায়নি, এই একঘেয়ে করপোরেট জীবন তথার কাছে কেমন যেন মনে হয় গ্রাম বাংলার যাত্রাপালার অভিনয়... সেই উগ্র সাজ আর অতি’অভিনয়...

    কিন্তু ....... ঐ কল্পনা। ঐ এক কল্পনা, স্বপ্ন, চিন্তা....কেমন যেন পদার্থের সান্দ্র অবস্থার মতো জীবন্ত আর ঘুমন্ত অবস্থার মাঝামাঝি জায়গায় নিয়ে চলে যায় তথাকে... দিন রাত এক করে সেই ইউটোপিয়ান জগতে বিচরণ করে তথা.... যা খুশী করে বেড়ায়... যেখানে খুশী ঘুরে বেড়ায়......

    সে দেখে সে মোহনবাগানের নামী স্ট্রাইকার... বিদেশী ক্লাব তাকে ফি-বছর ট্রায়ালে ডাকে... তাও মোহনবাগান ছেড়ে সে যাবেনা... পরপর ৩’বার দেশের সেরা ক্লাব, আর ও’সেরা প্লেয়ার.... বলা ভালো ও একাই ক্লাব কে চ্যাম্পিয়ন করেছে ও করছে.....

    সারা রাত বিছানায় ছটফট করে.... হয়তো ভোররাতে একটু ঘুমোয়...যদিও পরেরদিন অফিস থাকলে বা না থাকলেও তার সেই স্বপ্ন থেমে থাকেনা .....সে যতই তাকে করপোরেটের মেকি অভিনয় করতে হোক... স্বপ্ন কল্পনা সব কিছুতে জড়িয়ে থাকে...মাঝে মাঝে তথা ভাবে এটা কী করে সম্ভব হয়... লোকে তো ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে আর ঘুম ভাঙ্গলে সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ ভুলে যায়... যে অল্প ক’জনের মনে থাকে সেটাও বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না... কিন্তু তথার স্বপ্ন যেন বাংলার মেগা টিভি সিরিয়াল ..... চলতেই থাকে... রাতে যেটা দেখল... পজ করে তারপর থেকে আবার দিনে...

    কখনও ২-৩’দিন টানা এই প্রভাব থাকে, অফিসে–ওয়াশরুমে- এমন কী মিটিং এ ব’সের ঝাড়টাকেও ডিফেন্সের কড়া ট্যাকেল এর মতো মনেহয় ... “রায়চৌধুরী, তুমি কোথায় ”.... ব’সের ক্যাকোফোনিক উচ্চস্বরে ঘোরকাটে কয়েক সেকেণ্ডের জন্য ... তারপর আবার সেই... ক্লায়েন্ট প্রেজেন্টেশন এর দিনেও এই ফুটবল জ’র চলতে থাকলে ...ক্লায়েন্টকেউ লাস্ট ডিফেন্স মনেহয়। ভেতরে ভেতরে ভাবে, ১টা থ্রু পাক ……নেট সে করবেই.......

    বাস এরকম কদিন চলে মোহনবাগানি পর্ব... তারপর কিছুটা প্র্শমিত হলে বা বিশেষ কিছু অনুঘটকে আরেক পর্ব শুরু হয়... মাঝে মাঝে অবশ্য কদিন স্বভাবিক জীবনও যায়, যখন গুরুতর কিছু চাপ চলে -বাড়ির বা কাজের বা ছেলে মেয়ের শরীর খারাপ হয়...বা তিয়াসার সাথে ঝগড়া হলে....

    ও তিয়াসা,

    তিয়াসা ঘোষ, কলেজ ক্রাশ থেকে কিভাবে যে সকালের টুথ ব্রাস হয়ে গেল... সেটাও একটা জগত্‍ তথার কাছে... তবে সেটা এই গল্পের বিষয়ের বাইরে...অন্য কোনওদিন বোলবো....তথা আর তিয়াসার ঝাড়া দশ বছরের প্রেম... সেই প্রেম পরিণতি পায় আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে... অবশ্য এই শক্ত বাঁধনের বেশীরভাগটাই তিয়াসার জন্যে... তথা’তো ইহলোকে থাকেই খুব কম সময়...

    ছেলে- দু’বছরের , নাম আরুতোষ আর মেয়ের বয়স ছয়,আরাত্রিকা রায়চৌধুরী। ছোট করে আরু আর অত্রি । মেয়ে সল্টলেকের নামী কনভেন্ট স্কুলে এবার ক্লাস ওয়ানে পড়ছে।

    যাইহোক যেখানে ছিলাম সেখানে ফিরে আসি...তো এইভাবে কদিন মোহনবাগান বা ফুটবল জ’র এর পর আসে হয়তো ফটোগ্রাফি জ’র...আরেক ফেজ...এটা সত্যিই যে একটা সময় মেট্রোগলি ছিল তথার প্রিয় আস্তানা... ক্যামেরা ,লেন্স,পোলারয়েড,ফিল্টার,ফ্লাশ সহ যাবতীয় গিয়ার... স্টার্ট-আপ থেকে সেমি প্রফেশনাল, প্রায় সব খদ্দেরকে একটা বেসিক লেক্চার শোনানোর ডিউটি ছিল তথার... গ্রিড লাইন কী ,এসএলটি এসএলআর এর পার্থক্য কী? পোর্ট্রেট আর ল্যন্ডস্কেপ এর বেসিক ডিফরেন্সকে কী... এরপর খদ্দেরের বেসিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে ওর লেক্চারের গভীরতাও বাড়া কমা করতো...সববয়সী খদ্দেরের একটা খুব আবশ্যক অপ্শন ছিল তথা... মুমতাজ ফটোগ্রাফির বৃদ্ধ ইয়াসিন কতবার বলেছিল তথাকে তার দোকানে থাকতে, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র তথা খালি হাসতো... বলতো “চাচা এইতো ভালো , বিনা পয়সায় তোমার কাজ করে দিচ্ছি”...

    তো সেই ফটোগ্রাফি নিয়েও একটা জ’র চলে তথার.... মেরু জ্যোতি বা আকাশের তারা... বা ল্যান্ডস্কেপ থেকে ওয়াইল্ড ফটোগ্রাফি....উফ্ফ সারা রাত আবার ছটফট....

    তার শেষ ও সবথেকে জোরালো একটা ক্যারেক্টার হল কমরেড তথাগত রায়চৌধুরির... এই পর্যায় টা বহুদিন স্থায়ী হয়... এবং তথার স্বভাবিক জীবনে এই পর্যায় সব থেকে বেশি প্রভাব ফেলে... নাওয়া খাওয়া সব চুলোয় যায়... সারাদিন শুধু চিন্তা ভাবনা ...সে নেতা ,সেখান থেকে মন্ত্রী - সিএম থেকে পিএম.... ওফ মাথা ফেটে যায়... কী কী করবে আর কিভাবে দেশ সাজাবে … মার্ক্স ,এঙ্গেল্শ, লেনিন, ট্রটস্কি থেকে হালের শি জিংপিন, পুতিন বা য়েলেত্‍সিন…সেই নিয়ে....

    বাস।

    তথার দাবী তার সাথে তার এই তিন স্বপ্ন আর কল্পনা কেও মেনে নিতে হবে। যেন একই মানুষের ৩টে ছায়া। যদিও এতে কারোর বিশেষ আপত্তি ছিলোনা, তবে এইসব কাল্পনিক কারনে কারোর কোনওরকম অবহেলা হলে তারা কথা শোনাতে ছাড়েনা।

    তো এই নিয়েই চলছিল, সল্টলেক সেক্টর থ্রী আইবি ব্লকের একটা চার কামরার ফ্ল্যাটের সংসার, বাবা-মা-তথা-তিয়াসা আর দুটো পুচকে।

    এরই মধ্যে সেদিন বিনতি পিসিকে বাস স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে আসার কথা...পিসি লাখোবার এই ফ্ল্যাটে এসেছে,,কিন্তু এই দীর্ঘ লকডাউনে সব যেন নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে ...মাথার মধ্যে মেমোরি কার্ড টাও যেন কেউ রিসেট করে দিয়েছে,

    সেই বাস স্ট্যান্ডেই যাচ্ছিল তথা... হল কী যেতে যেতে আমফানের এই বিদ্ধংসী অবশেষ দেখতে দেখতে,, সে নিজে নেতা হলে কী করতে হতো সেটাই ভাবতে শুরু করল.... আর বাস... সেই কমরেড বেরিয়ে এল... দেশের ইকনমি বা মার্ক্স... লেনিন... ধাপে ধাপে এসব সরিয়ে রাজ্যের শিল্প ...সেলিম গোষ্ঠী জিন্দাল গোষ্ঠী টাটা সিংগুরের কারখানা... সব যেন চোখের সামনে দেখছে সে... কোথায় তখন বিনতি পিসি আর কোথায় বাস স্ট্যান্ড.... রাজ্যের শিল্পের হালে মানুষকে হতে হচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিক.....আর আজ পরিযায়ী শ্রমিকরাই দেশের বোঝা...তথা তখন এই কেরালা তো এই উত্তরপ্রদেশ।

    রেল লাইন কি ঘুমনোর জায়গা?

    ন’হাজার বছরের সভ্যতায় এখনও এলনা ইকুয়ালিটি... উল্টে দিনে দিনে টা বেড়েই চলেছে..... এখনও কী চরম আর্থসামাজিক বৈষম্য.... আম্বানির মুম্বাইয়ের ‘অ্যান্টিলিয়া’ সমুদ্রের ধারে ৪৯০০০ স্কয়ার ফিটের ২৭ তলা বাড়ি,১৬৮টি গাড়ি রাখার গ্যারেজ, ৩টে হেলিপ্যাড। ইনডোরের ঝুলন্ত উদ্যানের পাশে ৯টা লিফট সারাদিন ওঠা নামা করে। বডি-স্পা বা ইন হাউস সিনেমা হল কিছুর অভাব নেই।সেবার জন্য ৬০০ চাকর। আর সকালবেলায় নীতা আম্বানি জাপানের নরিটেক কোম্পানির ৩লক্ষ টাকার কাপে আমেজ করে চা খেয়ে প্রাতরাশ সারেন।

    আর অন্যদিকে....এই এক পরিযায়ী শ্রমিক... যাদের বিছানা রেললাইন!!!খাবার বলতে লাইনে ছড়ানো ছিল কিছু রুটি... ছিন্নভিন্ন দেহের মাঝেও রুটি গুলো গোটাই ছিলো। শেষ ৩’মাসে তাদের কোনও কাজনেই।বকেয়াপেমেণ্টের কোনও লক্ষণও নেই।সরকারের সেই নিয়ে কোনও নির্দেশিকাও নেই। গনতন্ত্রের সবচেয়ে বড় জোকার কোর্টরুমও এখন যেন কলোসিউয়ামে বসে পশু মানুষের যুদ্ধ দেখছে। মাঝে কিছু কর্পোরেট ফ্যাশন দুরস্ত ছেলে মেয়ে এসে ২-৪ দিন কয়েকটা প্যাকেট দিয়ে আর সেলফি নিয়ে সেই যে গেল.... তারপর থেকে শুধুই প্রতিশ্রুতির বন্যা শুনে আসছে.....

    বাবার কাঁধে বসে দিন রাত দিশা হীন ভাবে হাটতে হাটতে তেস্টার জলটুকুও চাইতে ভুলে গেছিল চার বছরের আরতি... বা হয়ত পিচ গলা রাস্তায় বাবার পায়ের ক্ষত দেখে আর ইচ্ছে হইনি চাইবার... সেখানেই এলিয়ে পড়েছে সে... সামনে পিছনে ধুধু হাইওয়েতে না আছে হাসপাতাল না ডাক্তার... আর থাকলেও এন্ট্রি রেসট্রিক্টেড। যেখানে ২২০০০ টাকায় সিসিইউ... আর তাদের তো....

    আরতি মারা গেছে বাবার কাঁধে

    বা, ছোট্ট বিট্টুর মা মাত্র তেরো’দিনের খিদের জ্বালাতে প্লাটফর্মেই পাড়ি দিয়েছে অন্য কোনও লোকে, ... সাম্যাবস্থার খোজে...

    গলা ভারী হয়ে আসে তথার....

    অথচ এই ১৩০ কোটির দেশে,এই ১২ কোটির পরিযায়ী শ্রমিকরাই হয়ে উঠতে পারতো দেশের সেরা সম্পদ। কম শ্রমমূল্যের টানে এই দেশী হয়ত হতে পারতো চীন বা ভিয়েতনাম। সেখানে এখনও প্রিভিলেজড মানুষ এদেশের এলিট সম্প্রদায়। যারা লাখোকোটি ব্যাঙ্কলোন পায়, লাভ হলে দেশে সমুদ্রের ধরে অ্যান্টিলিয়া বানায় আর লস হলে লোনের বোঝা দেশবাশীর ঘাড়ে চাপিয়ে লণ্ডন চলে যায়। যে ২৮ বছরে সেনসেক্স-নিফটি-জিডিপি’র ঊর্ধ্বগামী অর্থনীতিতে শ্রমিক’রা ২১০ % নিট মূল্য সংযোজন করেছে, সেই ২৮ বছরেই শ্রমিক’দের নিট পারিশ্রমিক নামমাত্র ১৪% বেড়েছে। যে ২৮ বছরে ভারতবর্ষে বিলিয়নারির সংখ্যা ১ থেকে ১৩২ হয়েছে, সেই ২৮ বছরেই ১০০ টাকা উৎপাদন মূল্যে শ্রমিক'দের প্রাপ্য মজুরি কমতে কমতে ৯.৯ টাকায় ঠেকেছে.....

    সব শোধ করবে তথাগত, পিনারাই বিজয়নের কেরালা মডেলে দেশকে করবে, ৯৯% নয় ১০০% শিক্ষিত।দেশের সব মন্দির মসজিদ ভেঙে হবে স্কুল, হাসপাতাল আর কারখানা।জাত আর ধর্ম হবে নিশিদ্ধ বস্তু।

    কৃষ্ণ’দার চায়ের দোকানে বসে বাড়তি আধা ঘণ্টা হাতে’ছিল .. কারণ বাস সেক্টর ১’এ আসতে তখনও কম করে আধঘন্টা লাগতোই... এই অব্দি তথা তথায় ছিলো...তারপরেই সেই যে পরিযায়ী শ্রমিক থেকে কেরালা হয়ে পিএম এ গেলো..... কোন কোন জিনিস নিয়ে ভাবাটা বাদ দেবে ?

    ওদিকে ঝাড়া ২ ঘণ্টা কেটে গেছে... বিকেল থেকে সন্ধ্যে হয়ে কৃষ্ণ’দার ঝড়েভাঙ্গা দোকান যখন বন্ধ হচ্ছে ,তখন ওর হোস ফেরে.... তখন ওর পিএম ফেজ চলছে.... সেখান থেকে নিজেকে আবার বাস্তবের নাটকের নট তথাতে আনতে কয়েক মিলি সেকন্ড যা লাগলো... নিয়ে এসেই তার প্রশ্ন...

    ‘এই কৃষ্ণ’দা কটা বাজে গো’...

    কেন সাতটা হল তো

    কী?? সাতটা...

    হ্যা গো তখন থেকে তো তুমি কিসব ভেবেই চলেছ, সাথে আবার বিড়বিড়ও করছিলে, সমীররা তো তোমায় দেখে দাত বার করছিল... খুব চাপ নাকি গো... অনেকের চাকরি গেছে না ?....

    “এই বলছি এখানে বয়স্কা কাউকে নামতে দেখেছ ঘণ্টা খানেক আগে ?”

    না গো দাদা! এক ঘণ্টা আগে? কী জানি গো ঠিক খেয়াল করতে পারছিনা। কারোর আসার কথা ছিল নাকি গো। যাও যাও বাড়ি যাও গিয়ে দেখ এসে গেছে। এদিকে মনে হচ্ছে আবার ঝড় হবে গো। কেমন কালো মেঘ দেখেছ?

    তথা প্রমাদ গুনল... আজ তিয়াসা থেকে শুরু করে মা বাবা বিনতি পিসি মায় বাবা অব্দি ঝাই মাই করবে, উফ্ফ তথা বুঝে উঠতে পারেনা কী করবে, সেতো ভালোই চায় সবার, সে সত্‍ , সে নির্ভিক, জীবনে একটাকাও অবৈধ ভাবে নেয়নি, কারোর কাছে কোনও বাড়তি সুযোগ চায়নি, একটা আদর্শ নিয়ে বড় হয়েছে, কিছুর সাথে আপোষ করেনি সে... তাইতো সে ভারতের মেসি হয়নি, বা দেশের ইতিহাসের সেরা পিএম হয়নি বা বিখ্যাত ফটো গ্রাফার হয়ে উঠতে পারেনি... সে’নিয়ে আফসোস তার প্রচুর। কিন্তু একটু ভেবে যদি সেই সুখ মেটানো যায় তাতেও সবার সমস্যা... সে জানে বিনতি পিসি ইচ্ছে করেই তথাকে ডেকেছিল... পিসি পরীক্ষা করছিল...যে তার দরকারেও তথা ওরকম ভুল করে কিনা....

    আজ তিয়াসা নেবে... পকেট থেকে লিস্ট বার করল তথা...পিসিকে বাড়িতে পৌছে তার কিছু জিনিস আনার কথা... এখন বাড়িমুখো না হয়ে এসব নিয়ে ঢোকাই ভাল... এসব দেখলে হয়তো ঝড় একটু কম হবে ।

    সবে আনলক প্রথম ফেজ চলছে... কিন্তু তাতেই মানুষ জন যেন দুর্গা নবমীর উত্‍সবে মেতেছে... সে যদি মন্ত্রী হতো!!!...... না ! তথা নিজেকে আটকালো... আর সে ওই পথে ঢুকবেনা । নিজেকেই বিরক্ত লাগছে তার ।

    বিগ বাজার গ্রসারি থেকে জিনিস গুলো মিলিয়ে মিলিয়ে নিলো তথা...যদিও তিয়াসা খুব এডজাস্টিভ, চালের জয়গায় ডাল নিয়ে গেলেও ও ঠিক ম্যানেজ করে দেয়.... কিন্তু আজকের আকাশ আংশিক মেঘলাই থাকবে এটা জানে তথা । পেমেণ্ট কাউন্টার এ প্রচুর ভিড় তার সাথে আবার একেকজনের প্রচুর জিনিস... এ যেন কাল থেকে আবার লকডাউন.... তথা ভাবলো এই সুযোগে কী একবার মোহনবাগনে ঢুকবে নাকি?? না থাক... বরং আরও কয়েকটা জিনিস কিনে নেওয়া যাক, প্রচুর ফুড আর গ্রসারি কুপন জমে আছে, দুর্দিনে পাড়ার দোকানের লোকাল মাল খেয়েই কাটিয়েছে, এখন বহুদিন পরে তাই এই সামান্য মলেই বাজার করতে বেশ ভালোলাগছে,,মাঝে মাঝে ভাবে তথা, কিভাবে এই মল কালচার তার আদর্শ থেকে তাকে নামাচ্ছে.... কিন্তু কী করবে সে? ডেলমন্টের মেয়নিজ বা ক্যালিফোর্নিয়ার ড্রাইফ্রূটস তো আর শংকর মুদির দোকানে পাবেনা...তার থেকে তার কল্পনার চরিত্রেই ওই কঠোর আদর্শ তোলা থাক। ওখানে কারোর কোনও দাবীই তথাকে তার নিজের বেড়া ভাঙতে দেবেনা।

    অথচ এই covid pandemic এর আগে কিন্তু পরিস্থিতি এরকম ছিলোনা। খুব কাছের কোনও পরিস্থিতির সাথে যদি এই পরিস্থিতির তুলনা হয়, সে তো সেটা সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ, যেখানে সারা বিশ্ব অনুসরণ করেছিলো জন মেনর্দ কেইনেস’এর তত্ত্ব। যার শীরদারা ছিল সেই মৌলিক পরিষেবার রাষ্ট্রীয়করণের মধ্যে। যখন এই উন্মুক্ত অর্থনীতির লোকেরা ছিলেন বিজেপির সেই 2-সাংসদের মতন।এখন যা মহীরুহ।

    সেই অর্থনৈতিক বিষবৃক্ষ তার বিষছায়া ধারণ করতে সময় নিলো মাত্র ২০-২৫ বছর।সেই বিখ্যাত ১৯৭০, রোনাল্ড রেগন , মারগারেট থ্যাচারের হাত ধরে যখন সেই মৌলিক অধিকার গুলি পরিণত হলো বাজারের পণ্যে। এর পরে পরেই সোভিয়েত পতনে যার গতি আরওত্বরান্বিত হলো। আটকে থাকলনা এই গরীবের দেশেও। আস্তে আস্তে বেসরকারিকরন হতে থাকলো ভারী শিল্প,স্বাস্থ্য, শিক্ষা। ‘রুগ্ন’ তকমা দিয়ে বিক্রি হতে শুরু হল তাবড় ব্যবসায়ীদের কাছে, যাদের টাকাই আবার খাটতে থাকলো রাজনীতিতে, দেশের নেতা বা রাষ্ট্রনেতা চয়নে। এ-যেন জলে কুমীর আর ডাঙ্গায় বাঘ.....

    উফ্ফ কোথায় হারিয়ে গেছি..... সল্টলেক সেক্টর থ্রি এর বিগবাজার থেকে নিও লিবেরাল ... সোভিয়েত...দৃষ্টি ঝাপসা.....

    একটা ট্রলিতে ধাক্কা খেয়ে জ্ঞান ফিরলো তথার, কিন্তু একি?? এ কী দেখছে সে!!!

    ড্রাই ফ্রূটসএর পাশেই সবজি কাউন্টার... একজন তাতে পুরোনো সবজি বদলাচ্ছে.... সে অবিকল তথার মতো, হুবহু যদিও আপাত দৃষ্টিতে অনেক বয়স্ক লাগছে, চোখে হাই পাওয়ার চশমা, ইউনিফর্ম দেখে বোঝাযায় এখনও ফিউচার গ্রুপ বা বিগবাজারের ডাইরেক্ট এম্প্লয়ী নন... থার্ড পার্টি তে আছেন...হয়তো চোখে দেখেন ও কম...

    হঠাত্‍ করেই একদম মুখোমুখি, কিন্তু সেই ব্যক্তির তথাকে দেখে অবাক হওয়ার সেরকম কোনওলক্ষণ নেই, যেন চোখ নামাতে পারলেই বাঁচেন, যেন এই পৃথিবীতে অবিকল দুজন খুব সহজলভ্য।

    তথাই কাঁপা গলায় বলল...

    ফ্ফুল...ফুল কপি কত করে ?...

    আমি জানিনা স্যার, আমার কাজ নোংরা সাফ করা, ফাঁকা ছিলাম তাই লাগতে বলল... আপনি ওই ওনাকে জিগেস করুন...

    চেক চেক ইউনিফর্মের এক মহিলা এদিকেই এগিয়ে আসছেন...

    কিন্তু তথার সেদিকে মন নেই। সে খুব অবাক... অবিকল তার মত একজন...যতদূর তথা জানে তার কোনও ভাই ফাই বা যমজ কেউ কখনও ছিলনা…. তাহলে এ কে ? এত মিল কিকরে সম্ভব, নিজেকে যেন আয়নায় দেখছে সে.....অথচ সেই প্রতিবিম্বের কোনও বিকার নেই

    মে আই হেল্প ইউ স্যার?? স্যার.....

    হুমমম না মানে এই দেখছি আর কি...

    এখানে সব অর্গনিক প্রোডাক্ট স্যার, নো হার্ম্ফুল পেশটিসাইড্স নো কেমিক্যাল ফারটিলাইজার... দিস আর অল ফ্রম ইস্টসাইড ফিউচার ফার্মহাউস...

    ও...

    তথা বুঝতে পারছে সেই নিওলিবারাল ওপেন মার্কেটের বিজ্ঞাপন কৌশলের বড়শী তার চোয়ালে ঘোরাঘুরি করছে....

    না ম্যাম থ্যাংক্স.....

    দুশো বছরের কলোনিয়াল দাসত্বে সবচেয়ে কাজের হল ইংগ্লিশ শব্দ গুঁজে দেওয়া... এটাই ধন্যবাদ বললে তথা জানত এত সহজে নিস্তার ছিলোনা... কিন্তু সেই প্রতিবিম্ব কোথায় গেলো ?...

    ওইতো এক পা টেনে টেনে আস্তে আস্তে যাচ্ছে, হাতে একটা ওয়াইপার... কি আশ্চর্য !তথা কোথায় করপোরেট অফিসের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ,মাস গেলে মোটা মাইনে আর তার মতোই কেও এখনও পাঁচ-হাজার বা ছ-হাজারের কনট্রাক্টচুয়াল জব করছে.... জোরে এগিয়ে যায় তথা ... অনেক দিন পর সে একটা রিয়েল ওয়ার্ল্ড ইন্টারেস্ট জিনিস পেয়েছে... ধ’রে ফেলে নিজের ইমেজ কে...

    বলছি আপনার কি নাম....

    থমকে দাড়ায় সে... কেন স্যার আমি কি কিছু ভুল করেছি স্যার ?

    আরে নানা আপনি কিচ্ছু করেন নি .....

    তাহলে কি স্যার....

    আপনার ছুটি কখন??

    ডিউটি শেষ স্যার, সকাল আটটা রাত আটটা শিফট

    ও তাহলে চলুন একটু বাইরে চা খাই.... আসলে অনেক দিন কথা বলার মতো কাউকে পাইনি তাই...

    শুকনো মুখ আরও কিছুটা শুকিয়ে গেলো প্রতিবিম্বের, হঠাত্‍ এরকম একটা অসম প্রস্তাবে তার মুখের এই পরিবর্তন তথার দৃষ্টি এড়ালোনা

    কিন্তু স্যার আমার তো’বেশি সময় নেই.... সাইকেল করে যেতে হবে অনেক দূর সেই মুচিবাজার...

    আরে ১০’মিনিট.... যাও তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি বাইরে আছি, আইনক্স গেট এর সামনে

    ঝটপট করে এল তথা,, মোক্ষম সময় এ এসেছে তার ট্রলি নিয়েই টানা পোড়েন চলছে... এগিয়ে এসে আনমনা শরীরে কার্ড পেমেণ্ট করল সে... ভুলেই গেল কুপন দিতে... দুটো বড় বড় ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আইনক্স এর সামনে আসতেই প্রতিবিম্বের সাথে দেখা... সাইকেল নিয়ে দাড়িয়ে আছে...

    এইতো চলো ...ওই দোকান টা ভালো?...

    না স্যার ওটায় না আগেরটায় চলুন

    ওকে তাই চলো....

    পাশে যেতে যেতে তথার কেমন যেন মনে হল সে নিজের সাথেই যাচ্ছে... কি অদ্ভুত লাগছে...রোমাঞ্চও হচ্ছে... ইস সত্যিই যদি উনি তথার ভাই হতো... আজ বাড়িতে গিয়ে মা’কে রসিয়ে রসিয়ে বলবে...

    প্রতিবিম্ব হয়ত ব্যাগগুলো সাইকেলে নিয়ে যেতেই পারতো কিন্তু এপ্রোচ করতে লজ্জা পাচ্ছে মনেহয়... তথা দু-একবার হাত বদল করল... একটু দাড়িয়ে আবার এগোলো... প্রতিবিম্ব কিন্তু এক গতিতে মাথা সামনে রেখে চলতেই থাকলো...ও কি চোখে দেখতে পায়না... যা হাইপাওয়ার স্পষ্ট দেখতে নাই পারে... তাই হয়ত ও অবাক নয়... বা এত বড়লোক মানুষের সাথে ও হয়ত ঠিক সেরকম করতে পারছেনা যেটা তথা পারছে.... সেই... এখন যদি তথাকে রতন টাটার মতো দেখতে হতো... অবাক হলেও তথা কি আগে থেকে কিছু জিগেস করতে পারতো... আরে এইযে ধোনী বা কোহলীর ক্লোন কপি যারা... তারাতো সেই গ্যালারিতেই থাকে... ক্লাব হাউসে তো আর ঢুকতে পারেনা...একান্তই ধোনী কোহলী হাত ধরে না ঢোকালে

    স্যার এইযে.....

    হ্যা দুটো চা বলো... বড়

    কি সহজেই আপনি থেকে তুমিতে এসে গেছে তথা... তুই হলেও চলত... কারণ দোকানদারও ওকে তুই আর তথাকে আপনি ,স্যার বলছে... আসলে ভারতের সিউডো সামন্ততন্ত্র প্রতিটা রক্ত বিন্দুতে এখনও বয়ে চলেছে...

    আপনার নাম টা বললেন নাতো

    গৌতম স্যার ...গৌতম সেনগুপ্ত

    এই বিস্কুট নাও না... এই দাদা ২’টো বড় বিস্কুট দাওনা

    স্যার এখন আবার...

    আরে খাও খাও.....

    তথা চাইছে সময় আর গৌতমের সেটাই নেই

    তোমার চোখে অনেক পাওয়ার না? কতো?

    হ্যা’স্যার , তবে কতটা জানিনা স্যার । মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ক্লিনিক করেছিলো; ওরাই চশমা দিয়েছে, পরিবার পিছু একজনের। এবার তো হলই না স্যার , আসছে বার হলে বলেছি বাচ্চা মেয়েটার করিয়ে দেব... ও নাকি ঠিক দেখছেনা ...

    হায়রে আমার ইনক্রেডিবল ভারত,, এক শ্রেণীর কাছে চোখের চশমাও যেন সোনার নেকলেস... .. ‘আসছে বার করিয়ে দেব’ ঠিক যেন ‘গড়িয়ে দেব’...

    ঢোক গিলল তথা, চা টা বেশ গরম তাই হয়ত একটু বাড়তি সময় পাবে সে...

    তুমি কোথায় থাকো বেশ ?

    মুচিবাজারে....

    তোমাদের ওখানে ঝড় কেমন হল গো ? আমাদের আবাসনেতো দুদিন কারেন্ট ছিলোনা, এখনও ইন্টারনেট নেই.....

    বলেই কেমন ইতস্তত বোধ হল তথার... চুপ করে গৌতম বাবুর কাছথেকে শুনতে চাইলো।

    ও আমাদের স্যার সব উড়ে গেছে... পার্টি অফিস থেকে কাল তিরপল দিল, কিছুটা বেঁধে এসেছি আজ বাকিটা বাপবেটা মিলে বাঁধবো....



    কয় ছেলে তোমার ?

    এক ছেলে এক মেয়ে, মেয়ে এবার ক্লাস নাইন হতো আর ছেলে সেভেন........ সবই তো বন্ধ,জানিনা কী হবে...

    পার্টি অফিস কেন? মানে কারা দিল? মিউনিসিপ্যালিটি...

    ধুর সেতো নাকি কবে বোর্ড ভেঙে গেছে।

    আমিতো স্যার আগে কমুনিষ্ট পার্টির হোলটাইমার ছিলাম , এখন আর কিছুতে নেই, তারপর এই তিন মাস পুরো বসে... ভাগ্যিস এক নেতা ওর লিঙ্ক লাগিয়ে এটা করে দিল... কেউ আসেনি স্যার দুখের দিনে, কেউ নয়, না সরকার না বিরোধীরা... না প্রশাসন না বুদ্ধিজীবীরা... ওই পার্টি থেকে চাঁদা ফাঁদা তুলে যতটুকু হয় আর কী... তবে সেটাই অনেক, মাথায় প্লাস্টিকের হলেও ছাদ তো হয়েছে স্যার... তবে কখনও কিছুর সাথে আপোষ করিনি স্যার... নিজের মনের শুনেছি...আজও তার জন্য গর্ব হয়।

    এক নিশ্বাসে অনেক বেশি বলে ফেলেছে ভেবে চুপ করল সে... ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তথার দিকে... যদিও হরলিকসের মোটা গ্লাসের মত চশমার কাছের পিছন দিয়ে কেমন মরা মাছের চোখের মত লাগছে তার চোখ...

    গলার কাছে কেমন কিছু আটকে থাকার অনুভুতি হল তথার

    পার্টি অফিস .... হোল টাইমার .... কেমন চেনা চেনা আর নিজস্ব লাগছে তথার...

    তুমি সিপিএম করতে?

    হ্যা স্যার ...এখনও ...কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে...

    তবে ভুল করেছিলাম স্যার

    মানে?

    স্যার কলেজ এ ফিজিক্স নিয়ে ঢুকেছিলাম... বামেদের শাসন ...সেই ২৩৫-৩০... কলেজেও এসএফআই তখন ক্ষমতায়... তো একদিন জোর করে সবাইকে বলল মিছিলে যেতে... আমি নিজে যাবোনা বলেছিলাম... হাটুর বয়সী এচড়ে পাকা ছেলে আমায় শাসাচ্ছিল... বাস আমিও গেলাম ক্ষেপে... বাবা ছিল আমার নকশাল করা সিপিএম, প্রচুর চেনা জানা, তার প্রভাব খাটিয়ে পরের বছর সিআর হলাম তারপরের বছরেই কিভাবে যেন জিএস হয়ে গেলাম... বাড়ি থেকে বার বার বারন করেছিলো... তখন ভেবেছিলাম মধ্যবিত্তিও সীমাবদ্ধতা... আর ওদিকে তখন বুদ্ধবাবুর ডু ইট নাউ এর হুংকার... সিংগুর সালেম জিন্দাল নন্দীগ্রামের মায়াবী স্বপ্ন.... জান লড়িয়ে দিয়েছিলাম স্যার... মাথায় কিচ্ছু রাখিনি... নিজের ভবিষ্যত্‍ একবারও ভাবিনি

    কিন্তু কি যে হয়ে গেল... সবাই ভুল বুঝল স্যার... পিছন থেকে সব কাছের নেতারাই ছুরি মারলো... আর সততার অহংকার নিয়ে বুদ্ধবাবু সেই ভুল স্বীকারকরে নিলেন... আমরা শেষ হয়ে গেলাম... পড়াশোনাটাও গেল আর ভবিষ্যত্‍ও...প্লেন বিএসসি পাস করলাম... কিন্তু আর কোথায় চাকরি , তারপর মার্কামারা হোলটাইমার মানে তখন হার্মাদ, পারলে পিটিয়ে মারে...কিছুদিন পালিয়ে থাকলাম মাসির বাড়ি... কাছের তিনবন্ধু গুম হয়ে গেল...জানিনা তারা আদৌ বেঁচে আছে কিনা... এরপর আর কী...তিন চারটে প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করেছি... পয়সাও এসেছে... বাবা মাকে নিয়ে ভালোই ছিলাম... মাঝে দুম করে পার্টির বহুদিনের সাথীকে বিয়ে... ২টো বাচ্চা। তারপর এই লকডাউন...বাস চাকরি বাকরী গেলো... তবে যতই খারাপ দিন আসুক কখনও নিজের পরিবার নিয়ে আমায় ভাবতে হয়নি, আমাদের পুরো মহল্লাই যেন আমার পরিবার... সবাই মিলে মিশে থাকি দাদা......

    বড় করে একটা শ্বাস চরলো গৌতম বাবু। দু’মিনিটেই নিজের জীবন বলে ফেলল গৌতম বাবু... ।

    তথার মুখ কিন্তু ফ্যাকাশে... নির্বাক সে, চা ভাড়েই থাকলো... কী সহজে সেই স্বপ্নের কমরেড তথাকে খুজে পেল বাস্তবের তথা... ফিজিক্স...৩’বন্ধু .... সিংগুর....বুদ্ধ.... কী দারুন কথা বলেন এই গৌতম বাবু। এত সাধারণ জীবনেও তার কত প্রাণশক্তি... কত আনন্দ... ঠিক যেন বিশ বছর আগের তথা।

    হঠাত্‍ করে ‘দাদা’ শব্দেই যবনিকা পতন....

    দাদা বললেন গৌতম দা, তাহলে তো আমি আপনাকে ছাড়বোনা । একদিন আমাদের বাড়ি আসুন জমিয়ে আপনার গল্প শুনবো... আমার খুব কাছের লাগছে...গৌতমদা প্লিজ

    এরকম অসম আর খেজুরে আলাপচারিতায় খুব স্বাভাবিক যে কেউ হতভম্ব হয়ে যাবে, কিন্তু হয়ত রূঢ় বাস্তব কে যুদ্ধে হারানো যোদ্ধার কাছে এসবই খুব স্বাভাবিক...প্রচুর চড়াই উতরাই দেখেছে কমরেড গৌতম সেনগুপ্ত, তাই এখন আর কিছুতেই কিছু হয়না, মানুষকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করার মত সুক্ষ চিন্তা ভাবনা আর’সে করেনা... তবে তথার ব্যাবহার তার খুব ভাল লেগেছে, একটা সময় এভাবেই সেও কিন্তু আর্থসামাজিক বেড়া টপকে সবার সাথে তুমি তুমি করেই মিশতো

    তোমার নম্বরটা দেবে গৌতমদা...

    হ্যা স্যার

    ৯৮.....

    ওকে , এই সেভ করে রাখলাম, ফোন করে একটা আড্ডা ম্যানেজ করব, আর আমি এখন থেকে স্যার নই, তথা দা বা শুধু তথা...

    ওকে দাদা এবার আসি... দাদা খুব ভাল লাগলো, আসলে সবার থেকে এত ভাল ব্যবহার তো পাইনা... সবাই তো তুই বলে ইংগ্লিশ ঝাড়ে... ভাবে আমরা কিছুই জানিনা বুঝিনা... যাক ভাল লাগলো আপনারাও আছেন এই সল্টলেকে....

    সাইকেলে মিলিয়ে যাওয়া অব্দি দেখল তথা... পয়সা মিটিয়ে ব্যাগ গুলো তুললো হাতে... তার হাতের বড়ো ব্যাগ দেখে আর মনেহয় জেশ্চার দেখে এক রিক্সাওলা অনেক্ষন ধরেই তাক করেছিলো.. তথা ব্যাগ হাতে নিতেই প্যাক প্যাক করে আওয়াজ করল, হাতের ইশারায় তাকে ডেকে উঠেই তথা বলল আইবি ব্লক...হাতের ঘড়িতে তখন পৌনে নয়... তথার বুকটা ছ্যাত্‍ করে উঠলো

    যাক সেদিন বাড়ি ফিরে চরম কিছু হয়নি... সবাই যেন মেনেই নিয়েছে এরকম আধপাগল মানুষ টাকে, খালি ঐ খুব কাছের বিন্তিপিসিই যাতা করে ছাড়লো। তথাকে নাকি নাখোদায় ঝাড়াতে নিয়ে যেতে হবে.........

    কাজের চাপ আর নানান ব্যস্ততায় তথাও ভুলেই গেছিল গৌতম দাকে কিন্তু রোব্বারের মাটন মাখা ঝিম দুপুরে ফোনটায় খোঁচাখুচি করতেই বেরিয়ে এল... গৌতম সেনগুপ্ত... একবার ফোন করবে নাকি? ...পাশে তিয়াসা এই এসে একটু শুয়েছে, ছেলে মেয়ে ঠাম্মির সাথে লুডো খেলছে আর দাদাই হয়েছে রেফারি....

    এই’তি তুমি সমান্তরাল পৃথিবীতে বিশ্বাস কর? মানে Parallel Universe বা Alternate Universe?

    কালকে ক পেগ মেরেছিলে ? আমাকেতো বললে চার , কিন্তু এতো চার’এর লক্ষণ নয়...

    আরে ধুর ইয়ারকি নয়...

    শোনো এসব Parallel, Alternate কী Universe না পৃথিবী এসব ঐ তোমাদের কী যেন বলে.... হ্যা... উইকেন্ড সিনড্রোম, আমাদের মতো ২৪X৭ এম্প্লয়ী হও তো বুঝবে এসব বিলাসিতা কোথায় হারিয়ে যাবে... সোম থেকে শুক্র মিটিং আর ক্লায়েন্ট কল্ ....শনি বার এলেই বার পুজো আর রবিবার তার হ্যাংওভার...

    তথা বুঝল তার প্রিয় তি এখন অন্য স্তরে রয়েছে...আর এমনিতেও তি এখনও ওর সেই নিম্নমধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি । তাই নিজের কলিগ দের সাথে ও বউকে নিয়ে খুব একটা যায়না, আবার তি’ ও কেমন আড়ষ্ট থাকে তাই ও নিজেথেকেই অ্যাভয়েড করে।

    পাস ফিরলো তথা...একটু পরেই তার নাক ডাকতে থাকলো....ওয়ার্নর ব্রাদার্স এর Inception নিয়ে স্বপ্ন দেখছিল তথা... স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন তার মধ্যে আবার প্রোগ্রামিং... উফ কি জটিল তত্ত্ব

    আজকে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল খেলা ... রবিবার বিকেল ৫টা , মোহনবাগানের হোমম্যাচ, দর্শক শূন্য মাঠে খেলা হবে।কলকাতা লীগের প্রথম ম্যাচ... লকডাউনের ফুটবলঘুম কাটাতে প্রথমেই এই ম্যাচ রাখা হয়েছে... লা লিগা , সেরিয়া , ইপিএল সবই এবার দর্শক শূন্য খেলা করাচ্ছে... এদিকে দু-তিন দিন থেকেই তথার নাওয়া খাওয়া সেই গোষ্ঠপাল সরণীতে... কখন ৫’টা বাজবে... রবিবারের বিকেলে পুচকে দুটোকে পড়াতে বসতে হয়... তিয়াসার ২৪X৭ এর এই একটু যা ব্রেক হয়... সেটাই তিয়াসা দারুন ভাবে এন্জয় করে,,, বসে শুয়ে ...মাকে বাবাকে আরও গুষ্ঠীকে ফোন করে... কিন্তু সেও জানে এই বিশেষ দিনে তথার কি অবস্থা হয়... চোখের পলক পড়েনা এই ৯০মিনিট... আর যদি হেরে যায়....তো একেক দিন ওকে বাড়িতে একা রাখতেও ভয় লাগে তিয়সার।

    এমনিতেই পনেরোয় অগাষ্ট, তাই আবার মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল।রোজকার ইস্টবেঙ্গল কে আজ যেন সেই লাল মুখো হনুমান গুলোর মত লাগছে।

    এই যেন সেই আইএফএ শিল্ড শুরু হল। সেন্ট জেভিয়ার্সের সাথে খেলা। এই টীমে শুধু শ্বেতকায় । খুব শক্তিশালী দল। কিন্তু দাড়াতেই পারলোনা মোহনবাগনের কাছে। উড়ে গেলো ৩-০ এ হেরে। আবার পরের রাউন্ড । এবার সামনে রেঞ্জর্সক্লাব। রেভারেণ্ড সুধীর চ্যাটার্জী ছাড়া বাকি সব মোহনবাগনি খালি পায়ে। একটু বৃষ্টি হলেই বুট পরা গোরাদের সাথে এঁটে ওঠা দায়।আর সেই বৃষ্টিই নামল রেঞ্জর্স এর সাথে খেলার সময়। ব্যাস জরিজুরি শেষ। যদিও তখন বাগান দু-গোলে এগিয়ে। এদিকে শ্বেতকায় রেফারি ৩টে পেনাল্টি দিল রেঞ্জর্সক্লাবকে। কিন্তু গোল কিপার হীরালাল মুখার্জী আজ যেন হিমালয়। পেনালটির মৌসুমীবায়ুতো কোন ছার আজ সাইক্লোনও গলতে দেবেনা সে। যদিও জল কাদায় ঘাটাঘাটি তে শেষে রেঞ্জর্স একটা গোল শোধ করেছিল, কিন্তু কাঁধ তখনই ঝুলে গিয়েছিল গোরাদের। হই হই করে বাগান উঠল কোয়ার্টার ফাইনালে। সেখানে রাইফেল ব্রিগেড। সামনে গোরা দেখলেই হীরালালের হাত পাহাড়-পর্বত হয়ে যাচ্ছে। এই ম্যাচটাও সেই টানলো। এই ফাকে শিবদাস ভাদুড়ী একটা গোল করে বসলেন। হাজার চেষ্টা করেও দুর্ভেদ্য মোহনবাগান গোল সেদিন খোলা গেলোনা। অসাধ্য সাধন করল মোহনবাগান। সেমিফাইনাল। না, মিডিলশেক্স এর পিগট সাহেব গোল মুখ খুলতেই দিলনা। প্রথম দিন অমীমাংসিত। দ্বিতীয়দিনের নায়ক সেই তথা উর্ফ অভিলাষ ঘোষ। তিন গোলে হারল মিডিলশেক্স । সারা বাংলা ,সারা দেশ তখন আনন্দে দিশাহারা। খেলাতো একটা ছুতো, আসল হল গোরাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলা। ১৮৮৯ সালের এই অগাষ্ট মাসেই ১৪ নম্বর বলরাম ঘোষ স্ট্রীটে ভূপেন্দ্রনাথ বাবুর বাড়িতে যে সভা বসেছিল এবং যে সভার যজ্ঞফল মোহনবাগান ভিলার সেই ছোট্ট ক্লাব ‘মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব’ আজ দেশের সেরা ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনালে। রেল কোম্পানীর বিশেষ ট্রেন, স্টিমার, গরুর গাড়ি থেকে পায়ে হেটে অজস্র মানুষের গন্তব্য সেদিন সেই এক স্থান, কলকাতা গড়ের মাঠ। কে’নেই সেখানে? কোচবিহারের রাজা থেকে শোভাবাজারের জমিদার, পাটিয়ালার মহারাজ থেকে বর্ধমানের রাজাধিরাজ। ওদিকে নেটিভ নিগারদের বাড়বাড়ন্ত ১৮৫৭ এর মত আরেকবার ধুলোয় পিষে দেওয়ার জন্য গাদাগাদা লাল মুখো হনুমান। উন্মাদনার স্তর এতটাই ছিলো’যে বিলেতের রয়টার্স অব্দি ম্যাচ কভার করতে এসেছিল। সকাল থেকে মাঠে তিল ধারনের স্থান ছিলনা। মিলিটারি দল ইস্ট-ইয়র্কশায়ার ঠিক কত গুলো গোল দেবে এই নিয়ে গোরাদের চলছিল পুরোদমে বাজি । তাদের অনুমান সঠিক প্রমাণ করেই খটখটে মাঠে ইস্ট-ইয়র্কশায়ারের প্রথম গোল। সেমসাইড। ওদের স্ট্রাইকার জ্যাকসনের এর গোলার মত শট লেফ্টব্যাক সুকুলের বডিতে ডিফ্লেক্ট হয়ে জাল কাপালো।পুরো দেড় মাইল দূর থেকে গোরাদের গর্জন শোনা গেল। পত্‍পত্‍ করে ঘুড়ি উড়ল, ইস্ট-ইয়র্কশায়ার ১ মোহনবাগান ০। কিন্তু খেলা খুললো এবার- শিবদাস থেকে রাজেন- হয়ে বিজয়দাস সেখান থেকে অভিলাষ উর্ফ তথা..... মুহুরমুহু আক্রমণ। কতবার আর ভাগ্য সাথ দেবে গোরাদের। ওয়ান ইজ-টু-ওয়ান এর একটা বিষাক্ত বল লাস্ট ডিফেন্সকে বোকা বানিয়ে শিবদাস রাখল সেকন্ড বারে। হয়তো বেরিয়ে যেতো বাইরে। এই তথা নিজেকে ছুড়ে বল সমেত গোলে ঢুকল। টানা ১০’মিনিট লাগলো দর্শকদের দের শান্ত করতে। আকাশের দিকে নিজের আত্মসম্মান খোজা চোখগুলো ,আবার ঘুড়ি উড়তে দেখল।১-১। এরপর সে এক খেলা। এই মোহনবাগান গোল দেয় দেয়... তো এই গোরারা... কিন্তু ফুটবলল বিধাতা হয়তো সেদিন একটু সাহসী হয়েছিলেন । তাই শেষ হবার ঠিক ২’মিনিট আগে তথার সেই ভলি। গোরাদের মুখ স্টিল ছবির মত করে ম্যাচের সেরা গোল। বিলেতের প্রতিটা নিউজ পেপারে ছিল যার বর্ণনা.....

    ডিংডং

    এই একটু দরজা টা খুলে দাওনা গো । মাসি এসেছে।বলো আগে বাসনটা মাজতে আমি আসছি তারপর। এখনও শুরু হয়নিতো তোমার ম্যাচ।......

    গোল দেওয়ার আনন্দ করার মত দুহাত তুলে তথা গেল দরজা খুলতে.... । আরু আর অত্রি বাবাকে দেখছে।

    নাঃ... জিতেছিল মোহনবাগান। আরু আশু তিয়াসার সবার সাথে হই হই করে ৩-১ এ জিতল। বাবাকে স্পেশাল মোগলাই আর মাকে ফিসফ্রাই, তি’র আয়ুধ বিরিয়ানি বা বাচ্চাদের বাসকিন রবিন্সের ডার্ক চকলেট ফ্লেভার, সবকিছুই খুব হালকা লাগছিল তথার।

    রাত বারোটা অব্দি ঘন ঘন ফোন আর তথার থ্যাংক্স জানানো চলল। নতুন জয়েন করা ছেলেগুলো অব্দি তাদের স্যারের এই পাগলামির হদিস জেনে গেছে। নয়ত আজকের দিনেও প্রায় অবসলিট হয়ে যাওয়া কলকাতা ফুটবল লীগের খেলার কেউ খবর রাখে?... এক তথা ছাড়া

    এদিকে রাতে স্থানীয় মেরিনার্স ক্লাবে গিয়ে খয়রাতি করে পরেরদিন মোহনবাগান ক্লাব অব্দি বাইক রালিতে অংশগ্রহণের ছক করে এসেছে তথা। সব কটা ফ্যান্স ক্লাব ও আসবে।সোমবার এমনিই তথা ওয়ার্ক ফ্রম হোম রেখেছিল এরকম একটা পরিস্থিতির সম্ভাবনা ভেবে। সেগুলো সব একে একে লেগে যাওয়ায় তথা একটু বাড়তিই খুশি। মেরিনার্স ক্লাবের আবদারে তথা ওর নতুন এয়ারবোন এনফিল্ডটা বার করেছে। ৩টে থেকে শুরু হল সেই রালি। সামনে মিনিট্রাকে বিশাল সাউন্ড সিস্টেমে সেই গান...

    ‘আমাদের সূর্য মেরুন... নাড়ির যোগ সবুজ ঘাসে...

    আমাদের খুজলে পাবে সোনায় লেখা ইতিহাসে...

    আমাদের রক্তে খেলা... খেলার ছলে বিপ্লবী দেশ

    আমরাই কখন’ও মুখ.....কখনও দল কখন’ও দেশ…..

    জন্মেছি মাথায় নিয়ে... খেলোয়াড়ী পরোয়ানা

    বুকের এই কল’জে বলে লড়াই কর হার না মানা

    দেখো ওই উর্নিশান... খেলার আকাশ ধোয়ার সোপান

    আমরাই মোহনবাগান... মো-হ-ন-বা-গা-ন’

    মিছিল করে ঢুকছে একেকটা ফ্যান ক্লাব। হাওড়া, বালি, হুগলী, মেদিনীপুর... এবার সল্টলেক... হঠাত্‍ করে নজর গেল তথার... বোধহয় হুগলীর ম্যাটাডোর ওটা... আবার সেই হামসকল... প্রথমে মনে হল গৌতম দাই.... কিন্তু ভাল করে দেখলে পার্থক্য বোঝা যাচ্ছে ....ইনি গৌতম বাবুর মত অতটা মলীন নন... তবে তার মত চকচকেও নয়।

    পাশের লেনেই আছে... সারা গায়ে সবুজ মেরুন আবির...একগাড়ি ছেলের মাঝে জোরে জোরে স্লোগান দিচ্ছে...কিন্তু কিছুতেই এগিয়ে ওই গাড়ির কাছে যেতে পারছেনা তথা। সামনে কমকরে গোটা বিশেক বাইক আছে।কিছুক্ষণের জন্য মাথা থেকে সব কো-অর্ডিনেট চলে গেছে তথার... এ কী হচ্ছে তার সাথে... সেদিন কমরেড প্রতিবিম্বের সাথে দেখা হোলো কিন্তু ইনি আবার কে?... এটাও কি তথার কোনও সত্ত্বা।তথা কী পাগল হচ্ছে??? খুব ঘাবড়ে গেল সে..... হঠাত্‍ করে নিজের কল্পনাগুলোকে চরিত্রের আকারে পাচ্ছে সে.... আবার এই রক্ত মাংসের চরিত্রেরা তার ধরেকাছেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

    অনেক কিছু মনে পড়ছে তথার। পাড়ার ক্লাব থেকে জেলা লীগ হয়ে মোহনবাগান ট্রায়ালে ডাক... কিন্তু একজোড়া বুট পায়নি সে ট্রায়াল দিতে যাওয়ার। সে যদি যেত সে নিশ্চিত সেই সিলেক্ট হতো।

    হঠাত্‍ একটা সুযোগ চলে এল... গাড়ি গুলোকে আটকে বাইক পাস করাতে শুরু করেছে পুলিশ। এই সুযোগ... একদম কাছাকাছি চলে এসেছে... তথা ইচ্ছে করেই স্টার্ট বন্ধ করে সিগনাল খেয়ে ম্যাটাডোর এর ঠিক পিছনে গিয়ে দাড়িয়েছে। কিছুক্ষন সব চুপচাপ। বাইক থেকেই ওর বুলেটের দিকে তাকিয়ে থাকা ছেলেদের নির্দেশ দিলো তথা’ওর প্রতিবিম্বকে ডাকতে। শুনতে পায় সে। এদিকে এগোতেই তথা বললো ‘দাদা নেমে আসুন আমার বাইকে’। একটু ফ্ল্যাগটা ধরতে হবে। আপনাদের তো অনেক ছেলে।

    কিরকম অদ্ভুত ভাবেই এক কথাতেই রাজি হয়ে নেমে আসে সে।

    দাদা কী নাম? কোথা থেকে?

    বাইকে উঠে ভাজ করা ফ্ল্যাগটা খুলতে খুলে বলে ওঠেন সিদ্ধার্থ রায়, শ্রীরামপুর।

    ও’ওখানে কোথায়?আরে আমিও ও তো ওখানেই বড় হয়েছি...

    সিগনাল অন হতেই সব ব্যস্ত হয়ে উঠল... মাস্ক টাস্ক সব চুলোয় গেছে... ক্লাবতাবুর কাছাকাছি এসে গেছে বিশাল এই রালি... তাই তার আওয়াজও বেড়েছে বহুগুন....পিছন থেকে সেই সিদ্ধার্থ বাবুও গলা মেলাচ্ছে.... ‘হাত কাটলে মোহনবাগান...বুক চিরলে মোহনবাগান’...

    অথচ প্রায় জড়বত্‍ হয়ে বসে রয়েছে তথা... ... শ্রীরামপুর... সেই বটতলাস্পোর্টিং ক্লাব... কুণাল দার কোচিং....

    তাহলে কী সত্যিই এই পৃথিবীতে সমান্তরাল জগতের অস্তিত্ব আছে ? তাহলে কী আমাদের সাথেই আমাদের মত অনেক মানুষের অস্তিত্ব আছে ? তাহলে কোনটা রিয়াল কোনটা ভার্চুয়াল... কোনটা সঠিক? নাকি সব গুলোই সঠিক... কিন্তু সবগুলো সঠিক হলে কিভাবে সম্ভব... আবার না হলেও তা কিভাবে হচ্ছে...কোনটা কল্পনা আর কোনটা বাস্তব... গৌতম বাবুর নিশ্বাসের আওয়াজ সে শুনেছে...তার সাথে চা খেয়েছে...এখন সীদ্ধার্থ বাবুর শরীরের স্পর্শ ... একি মিথ্যে? একি কল্পনা....?

    এরপরের একঘন্টা নানা ভাবে কাটিয়ে অবশেষে সিদ্ধার্থ বাবুকে নিয়ে একটু আলাদা হতে পেরেছিল তথা... সেই সেদিনের ক্যালকাটা গ্রাউন্ড বা আজকের গড়ের মাঠের এককোনায় বাইক থেকে নেমে সিদ্ধার্থ বাবুর মুখোমুখি দাড়িয়ে ছিলো তথা।

    দেখুন সিদ্ধার্থ বাবু আপনি তিয়াসা কে চেনেন?

    কে তিয়াসা?

    সেই শ্রীরামপুর কলেজ ফিজিক্স! আপনি ফিজিক্স নিয়ে পড়েছিলেন তো?

    হুর ... ভুল হচ্ছে আপনার ,সেবার কলকাতা মাঠে ট্রায়াল দিতে এসে ১২ ক্লাস টাই পাস করতে পরলামনা। তার আবার কলেজ... আরে দাদা আমি মাঠের লোক ,একটানা ১০’বছর কলকাতা খেললাম... ভবানীপুর-পীয়ারলেস-এরিয়ান্স হয়ে আবার ভবানীপুর এ এসে অবসর... এখন উয়ারী ক্লাবের কোচ.... বিয়েশাদি করিনি... ওসব মেয়েছেলে ফেলে আমার ভাল লাগেনা দাদা ....

    আর মোহনবাগান? সেখানে খেল্লেন না কখনো?

    আরে মোহনবাগান কী অতো সহজ দাদা... তবে ক্লাব অ্যাক্সেস আছে... বাবলুদা ,সত্যদা,, টুমপাই দা... সবাই চেনে। এবার তো ক্লাব মিটিংগেও ছিলাম... আর ভবানীপুর তো জানেনি সেকেন্ড বাগান... একই মাঠ একই স্টাফ... বাস ওই আর কী....দুধ আর ঘোল।

    আর চাকরি? সেসব কিছু করলেন না...?

    ধুস,ওসবে মন বসেনি। সত্যি বলতে কী পাইওনি... ভেবেছিলাম ঠিক বড় ক্লাবে ঢুকে যাব একদিন... বাঙালি স্ট্রাইকার সেই দীপেন্দু আর অসীমের পর তো কেউ এলনা... কিন্তু হোলো কই... জীবনের সময় বড় কম দাদা আর পরীক্ষা অনেক বেশী.....

    বর্ষায় ভেজা ময়দানের সবুজে কেমন হারিয়ে যাচ্ছে তথা... সেই তার স্বপ্নের অভিলাষ কেমন ক্লিশে হয়ে যন্ত্রনাবিদ্ধ একটা মুখ ভেসে উঠছে... সে যেন খাবি খাচ্ছে সময় আর পরিস্থিতির জাতাকলে... তাহলে কী তার ফুটবল প্রতিভা উয়ারী ক্লাবের কোচ হয়েই শেষ হতো... আজকের এই জীবনও কী সে পেতোনা।বাবা মা তিয়াসা আরু আশু নিয়ে স্বচ্ছল সুন্দর এরকম একটা জীবনও কী সে পেতোনা.... ভাগ্যিস সেদিন সে বুট যোগাড় করতে পারেনি....সিদ্ধার্থ বাবু হয়তো পেরেছিল জুতো যোগাড় করতে বা গৌতম বাবু পেরেছিল এসএফআই এর সেই ছেলে টাকে সবক শেখাতে.... তথা পারেনি... সেদিন হেরেছিল তথা, তাইকি আজ কিছুটা হলেও জীবন দৌড়ে এগিয়ে... কখনও তো এক পা এগোতে হলে দু’পা পিছিয়েও আসতে হয় ... ভাগ্যিস সে সেদিন যেতে পারেনি.....

    কিন্তু পয়সাটাই কি সব ?... নিজের ইচ্ছের কি কোনও মর্যাদা নেই ? ... আজ যে কাজ তথা করে তা কি একটু হলেও সে উপভোগ করে ?... বিনা কারনে বস যে তাকে ঝাড় দেয় এবং সেই ঝাড় যে সে তার নিচের স্টাফদের ট্রান্সফার করে দেয় তাতে কি কোনও আলাদাঅনুভুতি আছে ? কোনও রোমাঞ্চ আছে... এক্সেল শীট আর ওয়ার্ড এ কাজ করতে কি সে এতো ডিগ্রী করেছে.... নিজেকে খুব কনফিউজড লাগে তথার.....

    দাদা আমার ছেলেরা খুজছে হয়তো ... চলি আবার দেখা হবে... ভালো থাকবেন... আর কখনও ক্লাবে এলে বলবেন...

    জয় মোহনবাগান....

    নভেম্বরের মুক্তেশ্বর...দীর্ঘ লকডাউন কাটিয়ে বাড়ির খুটিনাটিতে জড়িয়ে... আজ অনেকদিন পর যেন মুক্তি পেয়েছে তথারায়চৌধুরি এবং অবশ্যই তার পরিবার... বিনতি পিসিরও আসার কথা ছিল... কিন্তু তার হাটুর ব্যাথা বেড়েছে।তাই পাহাড়ের ঝক্কি আর নিলেন না...

    এদিকে কি দারুণ পরিষ্কার আকাশ... মায়ের খুব পছন্দ হয়েছে কেএমভিএন এর এই হোটেলটা। এখানে নাকি এককালে জিম করবেট থাকতেন। ৭০০০ফিট ওপরে পাহাড়ের একটা খাড়াই খাজে আলমোড়া রেঞ্জের দিকে মুখ করে হোটেলটা। খুবই মনোরম। ৪ টে ঘর। ২‘টোতে তথারা আছে। একটা বন্ধ। আরেকটায় কেউ আছে। কিন্তু জানালা থেকে বেরিয়ে আসা একটা লম্বা লেন্স ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি তথা। এমনিতে বেড়াতে এসে অচেনা লোকেদের সাথে আলাপ করতে তথার বেশভালোই লাগে।

    আজকের দিনটা এক্সট্রা বুকিং করিয়েছে তথা। এত ভালো হোটেল দেখে মা বাবা আরও একটা দিন থাকতে চেয়েছে। একটু লেট করেই ডিনার রুমে গেল তথা।তিয়াসা বাচ্চাদের নিয়ে গেছে ঠাম্মি দাদাইয়ের ঘরে চালান করতে।ওদের খাওয়া হয়ে গেছে।

    তথার এখনও সেই গৌতম সেনগুপ্ত আর সিদ্ধার্থ রায় এর প্রহেলিকা মনে পড়ে।ফোনেও কথা হয়েছে বেশ কবার।

    আলো আধারি ডাইনিং হলে একটা টেবিল এ তথা একা। তার কিছু দূরে একটা টেবিল এ অরও ২ জন। একজন পুরুষ ও তার স্ত্রী হয়তো। কিন্তু স্ত্রী লোকটি বিদেশিনী।বেশ চাপা গলায় কথা বলছে । ওনারা বোধহয় ইংরেজিতে কথা বলছে। অনেক বিদেশী আসে এখানে। প্রকৃতির এত ভাল রূপ তার সাথে সস্তা থাকা খাওয়া। তাই সুযোগের সত্‍ব্যবহার করে।

    তাদের পাশের খালি চেয়ারে রাখা দুটো ক্যামেরা ব্যাগ। বেশ ভারী। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এনারা ফটোগ্রাফি করতে এসেছেন।

    ফটোগ্রাফি!!!

    উসখুস করছে তথা, হুম পিছন থেকে তার ই মত লাগছে... আর ওই অল্প আলোয় বিদেশিনী.... হ্যা..হ্যা মনে পড়েছে... সেই কলেজ লাইফে মেট্রোগলির আড্ডার সেই মেয়ে... কলকাতায় স্ট্রীট ফটোগ্রাফি করতে এসেছিল... তথার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছিল এস্প্লনেড-হাতিবাগান-টেরিটি বাজার... চাইনা টাউন আরও কত জয়গা...ঘামে ভেজা গ্রীষ্মের বিকেলের হঠাত্‍ কালবৈশাখীতে’ ভিজে চুপসো হয়ে প্যারামাউন্টের ডাবের শরবত খাইয়ে ছিল তথা... ভাগ্যিস তিয়াসা তখন বেশ শক্ত পোক্ত পজিশন এ ব্যাটিং করছিলো... নয়ত এই বিদেশিনীর ঘুর্ণীতে উইকেট পড়েই যেতে পারতো...

    সেদিনের কলেজের ঝিম ধরা ক্যান্টিনে পাকাপাকি ভাবে চে’গুয়েভারার একটা দেওয়াল ছবির নীচে বসে সস্তার সিগারেট জ্বালিয়ে তথা কত রঙ্গীন স্বপ্ন দেখতো... এই সে নিউজিল্যাণ্ডের ফিয়র্ডল্যাণ্ডের পাহাড় জঙ্গল আর অদ্ভুত শান্ত ও রহস্যময় জলের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে এই আবার স্কটল্যান্ডের ফিঙ্গাল্স গুহার প্রাকৃতিক রক স্ট্রাকচার এ ট্রেকিং করছে... কখনো চীনের হলেলুজা পর্বতের স্বর্গীয় সবুজ আবার কখনও বলিভিয়ার শালার-দে-উলুনির নুনের ধু ধু প্রান্তরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে...বেলজিয়ামের হলেরবস জঙ্গল... ফ্যারো আইল্যান্ড.. নর্দার্নআয়ারল্যান্ড..........ইস.... জীবনে কী মিস করেছে তথা...সে জানে তার এই অবতার নিশ্চই ওই সব জয়গা গুলো ঘুরে এসেছে... সে পারেনি... আর কখনও পারবেওনা.... কি সুন্দর ওদের ঐ বোহেমিয়ান জীবন আর কোথায় এই তথার শেকল বাধা সার্কাসের জোকারের জীবন। নিজের ফেলে আসা তিন সত্বাকেই সে’যেন মিস করছে আজ......

    স্যার ম্যাডাম’কা পার্সেল....

    কউন ম্যাডাম ?

    স্যার আপ রুম ২০২ মে হো না ? ম্যাডাম নে ফোন কিয়াথা। আলু পারাঠা অর্ডার কিয়া, হামারা স্টাফ সব নিকাল গয়া ... তো ঊনোনে আপ কোহি দেনে কে লিয়ে বোল দিয়ে...

    ও ওকে... লেকিন অপকো ক্যাইসে মালুম হুয়া কে ম্যায়হি উনকি হাজব্যান্ড...

    ম্যাডাম নে বাতায়া স্যার ফোনপে ... আপকা হুলিয়া...

    বা হাতে পার্সেল টা পাশের ফাকাচেয়ারে রেখেই মুখ ঘোরালো তথা... যা....ওরা চলে গেছে... ওদের টেবিল সাফ করছে একজন...তথা সেই খাবার দিতে আসা ছেলেটিকেই জিগেস করল ... উহাপে জো স্যার ওর ম্যাডাম ব্যাঠিথি ও ক্যায়া বাহার সে?

    হা স্যার ও লোগ তো ফরেনার হ্যায়...ফটোগ্রাফার হ্যায়... বহত দিন সে ঠেহেরে ... অপকাহী বগল বালে রুম পে... পাতা নাহি ক্যায়া ক্যায়া ফটো লেতে রেহতা হ্যায়...

    ছেলেটি আরও নানা ভাবে ওদের বর্ণনা দিতে থাকলো... কিছুক্ষন সেসব সহ্য করে একটু সুযোগ পেয়েই তথা জিগেস করল ‘ও ম্যাডাম কে নাম ক্যা হাই... কুছ ক্যামি... ক্যামিলা কারকে...’

    এরকম প্রশ্ন আস্তে পারে তা ভাবতে পারেনি পাহাড়ী ছেলেটি... কম বয়স্ক ছেলে কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরে বেস ম্যাচিউরিটি দেখালো...স্যার মেরে ইধার রুম নম্বর সে এন্ট্রি হোতা হ্যায়... নাম সব বিকাশ কে উধার এন্ট্রি হোতা। কিউ স্যার সেলিব্রিটি হ্যায় ক্যায়া...

    নাহি এয়সেহি.....

    স্যার জানে কে টাইম থোড়া সাবধানী সে জানা । অভি থোড়া বরিস হুয়া হ্যায়।তো রাস্তা স্লিপারি হোগায়া, ওর আপ তো চপ্পল প্যাহেনে হ্যায়। মোবাইল কা টর্চ অন কর কে জানা সাব

    হুম

    হাত ধুয়ে পার্সেল নিয়ে বেরোলো তথা...কি অদ্ভুত পাহাড়ী অন্ধকার, যেন গিলে খেয়ে নেবে, দূরে জোনাকীর মত কিছু আলো আর আকাশে তারা আর সাদা মেঘ... চাঁদের দেখা নেই... একহাতে পার্সেল অন্য হাতে মোবাইল জ্বেলে তথা চললো, তাকে অনেকটা নামতে হবে। ডাইনিং হল তাদের রুম থেকে বেশ দূরে,, অনেক পাথুরে সিড়ি... আস্তে আস্তে নামছে তথা, হঠাত্‍ একটা বাঁক ঘুরেই একহাত দুরেই মুখোমুখি সেই বিদেশীনি, কেমন টাল খেয়ে গেল তথা। ভিজে হাত থেকে মোবাইল টা পড়ে গেল...স্বপ্ন দেখছিল হয়তো.... ঝুপ করা অন্ধকার... তথা অনুভূতিতে বুঝল তার সামনে কেউ নেই। কি করবে সে? চিত্‍কার করে হেল্প চাইবে... কিন্তু তাতে তো লোক জড়ো হয়ে যাবে,বাড়ির সবাই হাসাহাসি করবে... তার থেকে আস্তে আস্তে নামবে নাকি... দেখা যাক চেষ্টা করে... কিছুখন চোখ বন্ধ করে অন্ধকারের সাথে এক্লাইমেট করল সে... এসব ই সে টিভিতে বিয়ার গ্রীলের কাছ থেকে শিখেছে... এরকম ছোট ছোট চ্যালেন্জ তথা খুব এনজয় করে... কিন্তু হঠাত্‍ কি হয়ে গেল... তথা বুঝল সে পিছলে গেছে , সে দ্রুত নীচে পড়ছে... না আর নয়... চিত্কার করতেই হবে। কিন্তু গলাদিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছেনা কেন... দম বন্ধ হয়ে আসছে কেন.......

    পি পি পি পি পি পি......আস্তে আস্তে এরকম একটা আওয়াজ আসছে তথার কানে... ঝাপসা দেখতে পাচ্ছে সে... অকাশী নীল কাপড়ে ঘেরা চারদিক... ধীরে ধীরে শুনতেও পাচ্ছে ... দৃষ্টিও আসতে আসতে পরিষ্কার হচ্ছে তথার... কিন্তু এটা কিরকম স্তরে রয়েছে ও... কেমন যেন সেই পদার্থের সান্দ্রতার স্তরে... এতদিন সে স্বপ্নকে কনট্রোল করেছে... তাকে শাসন করে মেসি থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছে... কিন্তু আজ যেন সেই আধা জাগ্রত আধা ঘুমন্ত এক অবস্থা তাকে শাসন করছে... কিছুতেই এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেনা ... সে বুঝতে পড়ছে...সে হস্পিটালের আইসিইউ তে আছে... হয়ত এটাকেই কোমা বলে। চারদিকে গাদা মেডিকেল যন্ত্র, যান্ত্রিক আলো ও শব্দ... দূরে একজন নার্স...দৃষ্টির ডিফোকাসে সব দেখছে তথা.....উফ্ফ তথা উঠে বসতে চাইছে... সমস্ত মন দিয়ে জাগতে চাইছে ... কিন্তু শরীর আজ তার আয়ত্বে নেই... সে কিছুতেই পারছেনা উঠতে... এ কি হোলো তার... সে তো নাস্তিক ছিলো, কিন্তু আজ কেন যেন ভগবানের কাছে আশ্রয় নিতে ইচ্ছে করছে... কেন মনে হচ্ছে সে সর্বশক্তিমান... সেই পারে... সেই পারে এই অবস্থা থেকে উঠে দাড় করাতে... খুব ভয় করছে তথার... এভাবে কতক্ষন লড়াই করবে সে... চোখের পলকও পড়ছেনা...

    পিপিপিপিপিপি

    অসহ্য লাগছে তথার... হে ঠাকুর প্লিজ... ক্ষমা কর... আমায় মুক্তি দাও... হয় আমায় আমার শরীরের কনট্রোল ফিরিয়ে দাও... নয়তো একসাথে সব শেষ কর... আমি পারছিনা..... খুব চাপ দেয় তথা.... একবার মনে হল যেন চোখের পলক ফেলতে পারলো.....

    হঠাত্‍ সামনের নীল পর্দাটা সরে গেল... তথা দেখছে তার দিকে ঝুকে অনেক গুলো মুখ...কেদে কেদে চোখ লাল করা তিয়াসা... আশু অত্রী...মা বাবা... গৌতম সেনগুপ্ত, তার স্ত্রী ... দুটো ছেলে মেয়ে...সিদ্ধার্থ রায়... বোহেমিয়ান তথা ও তার বান্ধবী আর... তার কিছুটা দূরে ক্লান্ত ও শ্রান্ত তথা........তথা বুঝে উঠতে পারছেন কোনটা সে ? তার শরীর কোনটা.... দিনের পর দিন বাস্তবের সাথে বিপ্লব করে চলা শক্ত মেরুদণ্ডের গৌতম... নাকি ভালোবাসার কোচ সিদ্ধার্থ... নাকি সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়ানো বোহেমিয়ান সেই ব্যাক্তি... নাকি এই সব কিছুর সাথে আপোষ করে সময়ের সাথে নিজের সব ইচ্ছে বাদ দিয়ে... সময় যেখানে নিয়ে গেছে সেখানেই বেঁচেথাকা করপোরেট একটা মানুষ... যার বুকে কমিউনিষ্ম অথচ নিজে লিবারাল অর্থনীতির আশ্রয়প্রার্থী একজন... সচ্ছল অবস্থাতেও যে পরিযায়ী শ্রমিকের সব কিছু হারানোর ব্যাথা অনুভব করতে পারে....রাস্তার দুধারের মানুষের কষ্টে যার প্রচুর ভাবনা আসে... আবার কিছুক্ষন পরেই সেই মেকি চকচকে বৈভবময় জীবনে খুব সহজেই মিশে যাওয়া একটা মানুষ....

    ঈশ্বর যেন তাকে একটা মাল্টিপল চয়েস প্রশ্নের সামনে রেখেছে... যাতে চারটে অপ্শন... যেকোনও একটাতেই একটা ছোট্ট টিক দিয়ে সে বেছে নিতে পারবে তার জীবন.....

    ঘামছে তথা....মাথা ছিড়ে যাচ্ছে... কিন্তু আজ শরীরের কেউ তার বাধ্য নয়....

    আরু আর অত্রি’র মুখ দুটো মনে পড়ছে খুব... হায়রে দুটো শিশু... প্লিজ প্লিজ আমাকে যেতে দাও.....

    ১’বছর পর

    আচ্ছা বাবা তুমি ছোট বেলায় বড় হয়ে কি হতে চাইতে??......

    এইযে যেরকম আছি... ঠিক সেরকম হতে চাইতাম সোনা.......
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Srilipi Maiti | ০১ নভেম্বর ২০২০ ০০:৪৫99473
  • বেশ অন্যরকম 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন