এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কালকূটের শাম্ব 

    Lipikaa Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৯ আগস্ট ২০২০ | ২৬৯৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • শাম্ব
    কালকূট: 


    কালকূট ছদ্মনামে লেখক সমরেশ বসু শাম্ব উপন্যাসটি লিখেছিলেন। এটি ১৯৭৮ সালে দেশ পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। দু বছর পরে ১৯৮০ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পায়।

    পুরানের একটি গুরুত্বহীন কাহিনী ও চরিত্র এই উপন্যাসের মূল কাহিনী ও চরিত্র।

    দ্বারকাপতি শ্রীকৃষ্ণ ও তার পত্নী জাম্ববতীর প্রথম সন্তান ছিল শাম্ব। শ্রীকৃষ্ণ মহাদেবের সমস্ত গুণ সম্পন্ন একটি পুত্র সন্তান চেয়েছিল। সাড়া গায়ে ছাই মেখে একা নির্জন পার্বত্য স্থানে কঠোর তপস্যা করেছিল। তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে পার্বতীর অনুমতি নিয়ে মহাদেব বর দেন যে তার আর জাম্ববতীর প্রথম পুত্র মহাদেবের সমস্ত গুণের অধিকারী হবে। শ্রীকৃষ্ণের জগতমোহিনী রূপকেও ম্লান করে দিত তার চোখ ঝলসানো রূপ। গুনেও সে ছিল মহাদেবের সমান। যদুবংশের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম। তার ত্বক এত মসৃন ছিল যে তার সামনে ও আশেপাশে উপস্থিত যে কোনো বস্তুর ছবি প্রতিবিম্বিত হত তার শরীরে। অর্থাৎ আয়নার মত চকচকে ছিল তার চামড়ার মসৃনতা। তার আচার আচরণ ও ছিল বেশ নম্র ও ভদ্র। স্ত্রী, পুরুষ, ছোট বড় সকলকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে বাক্য ব্যবহার করত। এমন রাজপুত্রকে মহর্ষি নারদের চক্রান্তের শিকার হতে হয়েছিল। হঠাৎ একদিন দেবর্ষি নারদ শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকার রাজভবনে এসে উপস্থিত হল। শ্রীকৃষ্ণ সহ তার পরিবারের সকল সদস্যরা ছুটে এল দেবর্ষিকে আপ্যায়ন ও পূজা করতে। কিন্তু শাম্ব এলো না। দেবর্ষিকে দেখেও চোখ সরিয়ে নিয়েছিল সে। এই অপরাধে দেবর্ষি শাম্বকে উচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। তার চক্রান্তের শিকার হয়ে দোষ না করেও শ্রীকৃষ্ণের অভিশাপে দুরারোগ্য কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হল। লঘু পাপে গুরু দন্ড দেওয়া হল তাকে। শাম্বর জন্মকুন্ডলিতে ছিল, শাম্বর দুরারোগ্য ব্যাধি হবে - এ কথা শ্রীকৃষ্ণ জানত। কিন্তু তারই মুখ দিয়ে অভিশাপ হয়ে তা বেরিয়ে আসবে, সে কথা ভাবেনি সেও। এরপর শ্রীকৃষ্ণের অনুরোধে দেবর্ষি নারদ এই কুষ্ঠ রোগ থেকে মুক্তি পাবার উপায় বলে দিল ।

    ভাবছেন, এই গল্পের জন্য কেউ আকাডেমি পুরস্কার পায়? বইটির আসল সম্পদ তো অন্য জায়গায় ।

    শ্রীকৃষ্ণের অনুরোধে দেবর্ষি রোগ মুক্তির উপায় বলে দিল -- সূর্যালোকে চন্দ্রভাগা নদীর তীরে মিত্রবনে গ্রহরাজ (শনিদেব নয়, সূর্য দেব) সকল দেবতাদের নিয়ে মধ্যমণি হয়ে আছেন। সেখানে গিয়ে এই একমাত্র অনাবৃত দর্শিত ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে পারলে মুক্তি মিলবে। পথ বলে দিলেন, সমুদ্র তীর থেকে উত্তর দিকের গিয়ে আবার উত্তর পূর্বে যেতে হবে। রোগাক্রান্ত হয়ে কুত্সিত চেহারা আর অশক্ত শরীর নিয়ে প্রায় একবছরের বেশি সময় ধরে পায়ে হেঁটে অতি দূর্গম রাস্তা পেরিয়ে সকলের ঘৃণা, দয়া সহ্য করে শাম্ব পৌঁছল মিত্র বনে। কিন্তু সূর্যালোক খুঁজে পাবার আগেই দেখল ওর মত আরো সত্তর জন নারী পুরুষ শিশু রোগগ্রস্ত। কিন্তু এরা কেউ রোগমুক্ত হয় নি। এখানে এলেই রোগমুক্ত হওয়া যায় না, রোগমুক্তির উপায় জানা যায় মাত্র। তাই এখানে এসে মুক্তি নয়, মুক্তির উপায় জানতে পারল। শাম্ব একা যেতে পারত ,কিন্তু ওই সত্তর জনকেও রোগমুক্ত করতে চায় শাম্ব। কিন্তু তারা চায় না। শাম্ব সবাইকে সঙ্গে নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করল এবং নিলও। এখানেই প্রমাণ হল শাম্বর স্বতন্ত্রতা - একা নয় সকলকে নিয়ে এগোতে চায়। সকলের রোগমুক্তি তার কাম্য। আবারও এক বছরের বেশি সময় ধরে বারোটা ঋতুতে বারোটা নদীতে শুক্ল সপ্তমী তিথিতে স্নান করে মিত্রবনে ফিরল নদীর জলে পাওয়া কল্পতরু কাঠের একটি সূর্যদেবের মূর্তি কাঁধে করে, সঙ্গে সত্তর জনের মধ্যে টিকে যাওয়া মাত্র চোদ্দ জন সহযাত্রী।দুর্গম পথ অতিক্রম করে ফিরে এলো রোগমুক্ত হয়ে। এর পরও থামেনি শাম্ব। শরীর থেকে চিরদিনের মতো এই ব্যাধি দূর করতে সূর্য দেবের পূজারী খুঁজতে গেল। আবার একবছরের বেশি সময় ধরে পায়ে হেঁটে বরফের দেশ পেরিয়ে ভারতবর্ষের সীমানা পার হয়ে অতি দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে পূজারী নিয়ে এল। তাদের সপরিবার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করল। তারাই এই রোগকে চিরকালের মতো শরীর নির্মূল করতে পারে। তাদের ওষুধে শাম্ব সহ অন্য চোদ্দ জনের রোগ শরীর থেকে নির্মূল হল। তার মসৃন ত্বকে দ্বারকার রাজপ্রাসাদের জৌলুস নয় এবার মিত্রবনের নদী, বন, গাছপালা সহ প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রতিবিম্বিত হল। তবু শাম্ব থামল না। তার উপার্জিত অর্থ দিয়ে ভারতবর্ষে চন্দ্রভাগা নদীর তীরে বহুঅর্থ ব্যায় করে, বহুবছর ধরে, বহুশ্রম করে মোট তিনটি মন্দির স্থাপন করল (নদীর উত্স, মোহনা ও মিত্রবনে)। প্রত্যেক মন্দিরে ভারতবর্ষের বাইরে থেকে আনা পূজারীদের সপরিবার থাকার ব্যবস্থা করল। তারা সূর্য-পুজোর সঙ্গে সঙ্গে এই দুরারোগ্যের চিকিত্সা করতে লাগল। এরপরও শাম্ব দ্বারকায় গেল না। তার সুন্দরী স্ত্রী লক্ষ্মনাকে জানিয়ে এসেছে যে সে কোনো দিন আসবে না। কিন্তু লক্ষ্মনা চাইলে মিত্রবনে আসতে পারে। রাজ প্রাসাদের সুখ, ইন্দ্রিয় সুখ কোনো কিছুই তার কাছে আর কাঙ্খিত নয়। শাম্ব সমাজ সেবায় নিয়োজিত হল। বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করল শাম্ব। দূর দূরান্ত থেকে রোগগ্রস্ত মানুষ ছুটে আসতে লাগল আরোগ্যের আশায় এই মন্দির গুলোতে। তাদের চিকিত্সা শুরু হল শাম্বর তত্ত্বাবধানে। তিনটি মন্দিরে নিয়মিত যাতায়াত করতে লাগল শাম্ব। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা দায়িত্ব পালন করছে কি না তা নিজে গিয়ে দেখতে শুরু করল। এই হল তার জীবনের ব্রত। সবাই দুহাত তুলে ধন্য ধন্য করল। শাম্ব র নামে নগরের নামকরণ হল শাম্বর অজান্তেই। দ্বারকার রাজকুমার শাম্ব নিজের কঠোর পরিশ্রমে আর মনের জোরে হয়ে উঠল সে যুগের জন প্রতিনিধি। দেবর্ষি নারদ ও মুগ্ধ হয়ে মিত্রবনের শাম্ব প্রতিষ্ঠিত কল্পতরু কাঠের বিগ্রহের (যেটা কাঁধে করে বয়ে এনেছিল) নাম দিল শাম্বাদিত্য। শাম্ব হয়ে উঠল কালজয়ী যুগপুরুষ ।

    লেখকের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই উপন্যাস লেখার কারণ বলা যেতে পারে। তিনি একটি ছোট বাচ্চাকে কুষ্ঠ রোগে ভুগতে দেখেছিলেন। সেন্টু নামের একটি ফুটফুটে বাচ্চা তার বাসার সামনে দিয়ে রোজ স্কুলে যেত। পরে রোগাক্রান্ত হয়ে কুত্সিত হয়ে যায় এবং সকলের থেকে দূরে একটি ঘরে তাকে একা থাকতে হয়। পরে লেখক এই বাচ্চাটির সঙ্গে দেখা করেন। ওর ঐ কুত্সিত চেহারা ও শারীরিক কষ্ট দেখে খুব কষ্ট পান। পরে ওড়িশার চন্দ্রভাগা নদীর তীরে কোনারকের সূর্য মন্দিরে গিয়ে শাম্বর কাহিনি শোনেন। তখনই শাম্বর কাহিনী তাঁকে আকর্ষণ করে।এরপর পুরান বিশারদ শ্রীযুক্ত শ্রীজীব ন্যায় তীর্থ এর পরম সহযোগিতায় জন্ম হয় এই উপন্যাসের।

    এখানে মহাভারতে উল্লিখিত ভারতের বিভিন্ন স্থানের বর্তমান ভৌগলিক অবস্থান খুব স্পষ্ট করে লিখেছেন। এবং বেশ কিছু মহাভারতের ঘটনার বর্ণনা বিজ্ঞান সম্মত ভাবে বিশ্লষণ করে দেখিয়েছেন। এক কথায় উপন্যাসটি সমাজ এবং মানুষ কে কঠিন সংগামের দ্বারা সাফল্যে উত্তরনের পথ দেখিয়েছে।

    শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে প্রতিকূল পরিবেশ-এর সঙ্গে লড়াই করে জয়লাভ করার সাহস যুগিয়েছে। অবসাদগ্রস্ত মানুষের মানসিক জোর তৈরী করার পথ দেখিয়েছে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন