এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • জনগণ জানেন, আমরা জানি

    ফারহা জিয়া : অনুবাদ - বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত
    আলোচনা | বিবিধ | ১৩ জানুয়ারি ২০০৮ | ১০৮৫ বার পঠিত
  • যথেষ্ট হয়েছে। কথা বলার, পরিষ্কার করে , জোর দিয়ে কথা বলার সময় হয়েছে। কারণ একটাই। আমরা, জনতা, জানি, ঠিক কোন পরিস্থিতিতে, ঠিক কোন ঘটনাক্রমের শেষ ধাপে গিয়ে, পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা করা হল।আমরা কিন্তু জানি এই দায়িত্ত্ব কাদের। বেনজির ভুট্টোর হত্যা ঠিক একক বা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। এই জাতীয় ঘটনার আদলের সঙ্গে আমাদের বিশেষ পরিচিতি তৈরী হয়েছে।

    সত্যি বলতে কি, আমরা কিন্তু সব সময়েই জানি যে, এই 'শক্তি' সবসময়েই পার পেয়ে যায়, যা খুশি তাই করতে পারে, করেই থাকে। বহুদিন ধরে আমরা তাঁদের নানা নামে ডেকে এসেছি,ভয় পেয়েছি, জোর দিয়ে বলতে পারিনি। ' ক্ষমতাসীন শক্তি', 'প্রতিষ্ঠান' নামক ন্যাকা ধোঁয়াটে শব্দটা দিয়ে পাকিস্তানে ঠিক কী বোঝানো হয় সেটা অপরিষ্কার থেকে গেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই, আমরা কিন্তু জানতাম এই 'তাঁহারা' বা 'ক্ষমতাসীন শক্তি' বা 'প্রতিষ্ঠান' বলতে কাদের বোঝাতে চাই, আমাদের পাঠক বা দর্শকেরাও জানতেন। কিন্তু আমরা চুপ থেকেছি। চমৎকার ব্যবস্থা আর কি। সবাই জানে বোঝে, কিন্তু সরাসরি কিছু বলে না। জীবনের মৃদুমন্দ ভাব দিব্য অব্যাহত থেকে এসেছে।

    স্বীকার করে নেওয়াই ভাল, আমরা কিন্তু একটা জিনিস ধরতে পারি নি। বেনজিরের জীবনের উপরে কত বড় বিপদ ঘনিয়ে আসছে সেটা আমরা আন্দাজ করতে পারিনি, এমনকি ১৮ অক্টোবরের ভয়াবহ ঘটনার পরেও পারিনি। বোধহয় খুব বেশি জানতেও চাই নি। আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানের দাবী, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে নিয়ে আসার দাবী, মনে করে দেখুন, বেনজির নিজেই এই সব দাবী জানিয়েছিলেন, নানা কথার ভিড়ে, নির্বাচনের উত্তেজনায় এই সব দাবী হারিয়ে গেছে।হারিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে, ক্ষমতাসীনেরা মনে করেছেন, 'আল কায়্‌দা' কে এই সব অনুসন্ধানের আওতায় এনে বিশেষ লাভ নাই, তারা যা করার করবে।আমরাও নির্বাচনের উত্তেজনায় সব ভুলে গেছিলাম। যতই হোক ড: কনডোলেজা রাইস আমাদের কিন্তু সবার আগে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, নির্বাচন হলেই এক নতুন দিন আসবে পাকিস্তানে। অপসৃত বিচারকদের বিষয়ে একটি প্রশ্নের উত্তরে সাংবাদিক সম্মেলনে এই কথা বলেছিলেন ড: রাইস । নির্বাচনী প্রচার যত এগোচ্ছিল একই সঙ্গে দুটি বিষয় কিন্তু বারবার উঠে আসছিল। বিচারকদের অপসারণ এবং সংবাদমাধ্যমের উপরে আরোপিত বিধিনিষেধ। ইতিমধ্যে আবার সংবাদমাধ্যমে বেনজির-মুশারফের মধ্যে 'চুক্তি' বা 'বোঝাপড়া' র বিষয়টিও বার বার উঠে আসছিল, অবশ্য আমরা পরে দেখলাম,দেখতে বাধ্য হলাম, যে বেনজিরের দিক থেকে সেই 'চুক্তি' আসলে ছিল মৃত্যুর সঙ্গে।

    ২৭ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচারের সময়ে, রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকতবাগে জনসভা শেষ করে যখন বেনজির বিদায় নিচ্ছেন, তখন তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়। এর অল্প পরেই, একটি আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ হয়।কিন্তু প্রশাসন বার বার বোঝাতে চাইছিলেন যে, বেনজিরের মৃত্যু হয়েছে সম্পূর্ণ একটি দুর্ঘটনায়, গাড়ির উপরের সানরুফের লিভারে মাথা ঠুকে গিয়ে। রাওয়ালপিন্ডি জেনেরাল হাসপাতালের ডাক্তারদের উপরে নিশ্চয় চাপ ছিল যাতে তাঁরা চুপ করে থাকেন, হাসপাতালের নথি গায়েব করা হয়, ঘটনাস্থল তড়িঘড়ি হোস পাইপ এনে ধুয়ে ফেলা হয়। সত্য চেপে দেওয়ার নিপুণ প্রচেষ্টা, কিন্তু দু:খের বিষয়, মানুষ কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁরা জানতেন কি চলছে। তাঁরা জানতেন, জানুয়ারীর ৮ তারিখে কিছুতেই নির্বাচন হবে না, নির্বাচনের দিন পিছিয়ে দেওয়া হবে, এমনকি যদি সমস্ত রাজনৈতিক দল ৮ তারিখের নির্বাচনে রাজি হয়ে যান, তাও নির্বাচন হবে না। তাঁরা জানতেন মুশারফ, তাঁর নিজের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার প্রচেষ্টাকে, এই পদে তাঁর প্রার্থী হওয়ার আইনি যোগ্যতাকে, সুপ্রিম কোর্টের কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে দেবেন না, প্রয়োজনে সামরিক শাসন জারি করবেন। মানুষ জানতেন, নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি চলবে এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) বা পাকিস্তান মুসলিম লিগ- এন (পিএমএল - এন) এই দুটি বড় দলকে কিছুতেই দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে দেওয়া হবে না। কিন্তু যেটা মানুষ হয়তো আন্দাজ করতে পারেন নি, যে পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রধান নেত্রী কে এই ভাবে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেওয়া হবে, স্রেফ একটাই উদ্দেশ্যে। গণতন্ত্র যেন এদেশে কিছুতেই শিকড় গাড়তে না পারে, মানুষের সামনে কিছুতেই যাতে নিজেদের ভবিষ্যত নিজেরা বেছে নেওয়ার কোন উপায় না থাকে।

    আমরা তাই বলছি, কথা বলার সময় হয়েছে। হারানোর বিশেষ কিছু নেই। সত্য কথা বলবার এইটাই সময়। দেশটার কাঠামোর মধ্যেই যে বিরাট একটা গোলমেলে দিক রয়েছে, সেনাবাহিনীর 'ক্ষমতার মাত্রাহীন ব্যাপকতা'র কথা, একটি 'প্রতিরক্ষাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থনীতি' সম্পর্কে কথা বলার সময় হয়েছে। পরিষ্কার করে বলা দরকার, এই দেশের বেশির ভাগ লোকের কাছে, 'ফেডারেশন' কথাটার কোন অর্থই নেই। 'প্রতিষ্ঠান' কথাটার অর্থ এবং তার ভূমিকার কথা পরিষ্কার করে আলোচনা করার সময় এসেছে। সংবাদমাধ্যমকেও নিজের ভূমিকার মূল্যায়ন করতে হবে। সাম্প্রতিক বছর দশেকের গণতন্ত্রের আমলটিকে তাঁরা নির্দ্বিধায় আর্থিক কারচুপি ও ভ্রষ্টাচারের দশক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। 'খবর' এর লোভে তাঁরা কখনো সূত্র গুলিকে পরীক্ষা করেন নি। কোথা থেকে কী খবর আসছে যাচাই করেন নি। ২৭ ডিসেম্বরের পরে এক সপ্তাহও হয় নি, ইতিমধ্যেই এস এম এস, ইমেল, সংবাদমাধ্যমের কলাম সব রকম পরিচিত মাধ্যমে ঐ একই ধরণের প্রচার শুরু হয়ে গেছে।
    একটা কথা স্বীকার করে নেওয়ার সময় এসে গেছে, মানুষের তোয়াক্কা না করে যে গত ৬০ বছর ধরে এই দেশটা চালানো হচ্ছে, তাতে এমন একটা অবস্থা এসে দাঁড়িয়েছে যে, রাজনীতিতে উদ্ভুত সমস্ত পরিস্থিতির সঙ্গেই , প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সহযোগিতার বিষয়টি এবং বৃহত্তর পাক-মার্কিন সম্পর্কের বিষয়টি বার বার যুক্ত হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর যত ন্যান্সি পেলোসি আর হিলারি ক্লিন্টনদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় আমাদের। খানিকটা অদ্ভুত শোনালেও এটা পরিষ্কার করেই এই আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ কে বোঝানো দরকার, যে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক এই বিশেষ ব্যাপক সহযোগিতার ঐতিহ্য কিন্তু মানুষের বিরুদ্ধেই কাজ করেছে এতদিন ধরে; প্রতিরক্ষা-নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে অত্যধিক গুরুত্ত্ব এবং বিশেষত আন্তর্জাতিক অস্ত্রসাহায্য এবং মানুষের আশা আকাঙ্খা স্বপ্ন কখনোই ঠিক নিশ্চিন্তে হাত ধরে হাঁটতে পারে না।

    -------------------------------------------------
    পাকিস্তানের নাগরিক ফারহা, সেদেশে গণমাধ্যমে কর্মরত।

    জানুয়ারী ১৩, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৩ জানুয়ারি ২০০৮ | ১০৮৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন