এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  কূটকচালি

  • বছরশেষের মস্তি

    দময়ন্তী লেখকের গ্রাহক হোন
    কূটকচালি | ২০ এপ্রিল ২০০৭ | ৭৮০ বার পঠিত
  • নতুন বছরের শুরুতেই এতো বলার কথা জমা হয়ে যাবে জানা ছিলনা। জানা ছিলনা, যে বুলবুলভাজা ভরে যাবার পরেও মনে হবে এই লেখাটিও প্রকাশ করা উচিত এখনি। এই সপ্তাহেই। অতএব একে জায়গা দেওয়া হল কূটকচা৯তেই। যদিও এটি কোনো অর্থেই কূটকচা৯ নয়। -- সম্পাদক।

    দেওয়ালীর হইহুল্লোড় শেষ হতে না হতেই, "মস্ত্‌' পাবলিক বছরশেষের মস্তির যোগাড়যন্তর শুরু করে দেয়। প্লেনের টিকিট, হোটেল বুকিং, পার্টির খবরাখবর; হ্যাপা কি কম নাকি! আর "আজকাল সস্তার টিকিট পেয়ে যত অ্যারাগ্যারা লোকও প্লেনে চাপে মশাই"। আগে থেকে ভাল ডীল দেখে বুক না না করলে, শেষে একগাদা গচ্চা যাবে। কটা ছুটি বাঁচল বছরশেষে নেবার জন্য, কটা সামনের বছরে ক্যারী ফরোয়ার্ড করানো যাবে, কটা সিকলীভ, কটা ক্যাজুয়াল, কার সাথে কাকে নেওয়া যাবে; এইসব হিসাবনিকাশও পাশাপাশি কষে ফেলতে হয়।

    ঠান্ডা, উত্তুরে হাওয়া এসবই আজকাল ক্ষণিকের অতিথি। ডিসেম্বরের শুরুতে যদি এলো তো, দিন সাতেকের মধ্যেই উধাও। বছরশেষের জন্যই যেন তারও অপেক্ষা। বছরশেষে এসে, বছর নতুন থাকতে থাকতেই চলে যায় শীত। তারমধ্যেই পরে ফেলতে হবে ব্লেজার, জ্যাকেট, পুলোভার, টার্ট্‌ল্‌নেক, ফিরহন, শাল, কোট-টাই, হাফ-স্লীভস চাই কি সম্ভব হলে ওভারকোট পর্যন্ত। ফ্রুটকেক, পেষ্ট্রী তো মেলে সারাবছরই, তবে এইসময় সেসব সম্ভার নেমে আসে দোকান উপছে সামনের রাস্তায়। সাথে আছে বাদামচাকতি, ছোলার চাকতি, গুড়-চানা। নানান সাজের নকল ক্রীসমাস ট্রী আর রংবেরঙের বল তো আজকাল পাড়ার মোড়ের দোকানেও পাওয়া যায় ডিসেম্বরের মাঝ থেকে। সবাই সাজছে ন্যু ইয়ার'স ঈভের মস্তির জন্য। দোকানপাট আর মার্কেটের আশপাশের সমস্ত গাছে আলোর মালা।

    পরিচিত লোকজন একে একে চলে যায় বোম্বে, গোয়া, পটায়া বীচ, লাক্ষাদ্বীপ, সিঙ্গাপুর, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ, ইউরোপের আনাচকানাচ, দার্জিলিং, কসৌলি, সিমলা .....। এফ এম রেডিওর কোন এক চ্যানেল আপনার বাড়ীতে এসে পার্টি অ্যারেঞ্জ করে দিয়ে যাবে, শুধু একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিন। অপর কোন চ্যানেল আপনাকে দেবে অমুক, অমুক হোটেলে ৩১শে রাতের পার্টিতে যাবার টিকিট, শুধু একটা এস এম এস করুন, যদি প্রথম ৫ জনের একজন হন তো একই রাতে ৪ টি পার্টিতে যাবার সুযোগ পাচ্ছেন, যার মোট প্রবেশমূল্য অন্তত ৬০০০ টাকা। রেডিও স্টেশানে ফোন করে জনৈক ব্যক্তি সরলভাবে জানতে চান পার্টিতে টিকিট কেন? পার্টি তো নিমন্ত্রনভিত্তিক হবার কথা। রেডিও জকি তাঁর সারল্যে মুগ্ধ হয়ে বলে "সো-ও স্যুইট"।

    এখানে সেখানে উড়ছে গোছাগোছা রঙীন বেলুন।
    প্লে-স্কুলের বাচ্চারা বেড়াতে বেরিয়েছে ঘোড়ার গাড়ী চেপে,
    আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে খুশীর ঝিলমিলে টুকরো।
    বাংলোবাড়ীর নর্দমা থেকে উঠে আসছে শিশুদের করোটি, হাত, পায়ের হাড়গোড়।
    সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসির লাইভ ভিডিও ছড়িয়ে যাচ্ছে দুনিয়ার কোনে কোনে।
    চেন্নইয়ে এক কিশোর খুনের অপরাধে ধরা পড়ছে আরো দুই কিশোর।
    কলকাতায় পুলিশ শান্তিরক্ষা ও মহিলাদের রক্ষা করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে বেধড়ক মার খাচ্ছে।
    শেষ হচ্ছে পুরানো বছর।
    আসছে নতুন বছর।

    ৩১শে সারা দুনিয়া উদ্বেল হয়ে ওঠে সাদ্দামের ফাঁসির বীভৎসতায়। দিল্লী থেকে মাত্র ২০ মিনিট দূরত্বে নিঠারি গ্রামের নিরুদ্দেশ বাচ্চাদের হাড়গোড়, করোটির মিছিল শেষ হয় না। বস্তাভর্তি করেও শেষ হয় না।এফ এম চ্যানেলে উদ্বিগ্ন, ক্রুদ্ধ দিল্লীবাসী। নিখোঁজ বাচ্চাদের কথা পুলিশকে বলতে গেলে তারা বলেছে জন্ম দিয়েছ, খেতে দিতে পার না? দেখেশুনে রাখতে পার না? তাই জন্যই বাচ্চারা পালিয়ে গেছে। এক শ্রোতা পরামর্শ দেন, এইসব পুলিশকে চাঁদে ডিউটি দেওয়া হোক, তাহলে আর ওদের কোন কাজ করতে হবে না। ঐ অঞ্চলটি গরীব কাজের লোকের বাসস্থান। এই ঘটনার প্রতিবাদে ৪-৫ দিনের মধ্যে কোথায়ও বেরোয় না কোন প্রতিবাদ মিছিল। কোন তাবড় নেতাও প্রথমদিকে যান নি সেখানে। বরং ছড়ানো হতে থাকে নানারকম গল্প। মানসিক বিকৃতির গল্প। শিশু মাংস খেয়ে পৌরুষ বাড়াবার গল্প। অসহায় বাবা মায়েরা ছবি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে বাংলোর বাইরে ... যদি পাওয়া যায় কোন চিহ্ন। ঘনঘোর কুয়াশায় ঢেকে যেতে থাকে চরাচর।

    "সালামি ইশ্‌ক ইশ্‌ক ইশ্‌ক...."
    "সিগনা-আ-ল পেয়ারকা সিগনাল"
    "মাঈ মাঈ মাইয়া এহে এহে এহে এহে...."
    সাইকাডেলিক আলোয়, ডিজিটাল ডলবি সাউন্ডে হোটেলে, রেজর্টে, ফার্মহাউসে এসে যায় নতুন বছর। আর তখনই কুয়াশায় ডুবে যায় নিরুলা'জ এর ছাদের ঘুরন্ত আলো। বন্ধ হয়ে যায় ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে সমস্ত প্লেনের ওঠানামা। হেডলাইট বা হর্নের ওপরে ভরসা রাখতে না পেরে বাইক থেকে যুবকবৃন্দ চীৎকার করে ওঠে "সামনেওয়ালে হঠ যা-আ-ও"। তবুও বাংলো থেকে করোটি আর হাড়গোড় ওঠার বিরাম হয় না।

    চেনাপরিচিত সকলকে "হ্যাপী ন্যু ইয়ার" বলা মোটামুটি শেষ। আবার টিপেটিপে হিসেব করে ছুটি নেবার পালা। তবু ভাল এই মাসে একটা ছুটি আছে। ২ দিনের কুয়াশা সরিয়ে ঝলমলে রোদ্দুর উঠে গেছে। তবুও সেই বাংলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে হাড়গোড়। কচি কচি হাত পায়ের হাড়, মাথার খুলি। শরীরের মাঝের অংশ পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে রক্তের কালচে ছোপ ধরা বিছানা, নানান ডিজাইনের ছুরি। আগামী নির্বাচনে খুব কাজে লাগবে বুঝে ফেলতেই, সমস্ত রাজনীতিজীবিরাও নেমে পড়েছে দরদ দেখাতে, বিচারের দাবী জানাতে, চাই কি এবারে হয়ত একটা প্রতিবাদমিছিলও হয়ে যাবে , অন্তত কলকাতায়। আরে বাবা নিঠারির অধিকাংশ অধিবাসী তো বাঙালী!

    বাড়ী থেকে বেরিয়েই দুটো বড় বড় গর্ত খোঁড়া হচ্ছে দেখে আঁতকে উঠি। এখানেও কি ....। "কি ব্যপার" জিজ্ঞাসা করায় অবাক জবাব আসে "জলের পাইপ ফেটে গেছে যে। কেন?" আরেকজায়গায় নর্দমার ঢাকনি খোলা। পাশে কিছু পাঁক আর মদের বোতল দেখে আবারও চমকে উঠি। জিজ্ঞাসা করতে আবারও অবাক জবাব আসে 'পৌরসভা থেকে পরিস্কার করা হচ্ছে। মাসে একবার করে হয় তো। কেন?" আচ্ছা ঐ বাংলোর আন্ডারগ্রাউন্ড জলের পাইপ কোনোদিন ফাটে নি? পৌরসভা ওখানে মাসে একবার পরিস্কার করতে যায় না? কচি কচি হাড়গুলো, খুলিগুলো কেবলই মাথার মধ্যে কামড়ায়। তখনই বান্ধবীর ফোন আসে। ওর স্বামী অবশেষে রাজী হয়েছেন দত্তক নিতে এবং ওরা একটি ৭ মাসের মেয়ে দত্তক নিয়েছে। নাম দিয়েছে "শ্রীবিদ্যা"।
    "... হামারি ঘরমে এক ছোটু আয়ী হ্যায়। তু আয়েগী না?"
    "হাঁ হাঁ বিলকুল আউঙ্গী।"

    শ্রীবিদ্যার জীবন নিরাপদ হোক। সুন্দর হোক। সার্থক হোক।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • কূটকচালি | ২০ এপ্রিল ২০০৭ | ৭৮০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন