এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  খবর  টাটকা খবর

  • করোনাভাইরাস – জীবনের ভিন্ন যাপনের এক আখ্যান? - ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য (চিকিৎসক, গবেষক ও জনস্বাস্থ্য কর্মী)

    Jayanta Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    খবর | টাটকা খবর | ২৪ মার্চ ২০২০ | ৮৮৪৮ বার পঠিত
  • ২২ মার্চ, ২০২০-র প্রতীকী জনতা কার্ফু (যা আসলে প্রয়োজনীয় লকডাউনের মহড়া ছিল) এবং ২৩ মার্চ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সহ ২২টি রাজ্যের ৭৫টি জেলায় পূর্ণ লকডাউন একান্ত প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ। এর জন্য কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাবো। সর্বেশেষ খবর অনুযায়ী, শেষ অবধি সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ লকডাউনের আওতায় চলে। ১৯ মার্চ গুরুচণ্ডালীর পাতায় আমি করোনাভাইরাস নিয়ে যে লেখাটি লিখেছিলাম সেখানে সামাজিকভাবে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার চেইনটি কেটে ফেলার জন্য (অর্থাৎ স্টেজ ২ থেকে স্টেজ ৩-এ যাওয়া) ব্যক্তিদের গৃহবন্দী করে রাখা এবং “সেলফ-আইসোলেশন”-এর কথা উল্লেখ করেছিলাম। সরকারের এই উদ্যোগ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক বিপর্যয়কে মোকাবিলা এবং এড়ানোর জন্য একটি কার্যকরী পদক্ষেপ হবে ভরসা রাখছি। গতকালের (২২ মার্চ, ২০২০, হু-র সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে – ২৯২,১৪২ জন সংক্রমিত (নতুন সংক্রমণ ২৬০৬৯), মৃত্যু ১২,৭৮৪ জনের। হু-র বয়ানে - Four new countries/territories/areas from the African Region have reported cases of COVID-19. একই সাথে হু-র বয়ানে - There has been a rise in criminals disguising themselves as WHO to steal money or sensitive information. একে আমরা কোল্যাটারাল ড্যামেজ বলেও ধরতে পারি।

    প্রসঙ্গত, আজ থেকে ১০০ বছর আগে ১৯১৮-১৯ সালে ২০২০-র করোনাভাইরাস অতিমারির মতোই উপনিবেশিক ভারতের শাসক সমাজ কেঁপে উঠেছিল। ভারতে ১৯১৮ সালে শুরু হল ইনফ্লুয়েঞ্জা। এর উৎস সেসময়ের অতিমারি “স্প্যানিশ ফ্লু”। তৎকালীন বোম্বেতে ১৮ জুন, ১৯১৮-তে ফ্লু আক্রান্ত নাবিকদের নিয়ে একটি জাহাজ এলো (এখন উড়োজাহাজ আসে) এবং মহামারি ছড়ালো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যত সৈনিক মারা গিয়েছিল তার চেয়ে বেশি, প্রায় দু কোটি, মানুষ মারা গেলো এখনকার পরিভাষায় এই অতিমারিতে। সেসময়ের উপনিবেশিক ভারতের জনসংখ্যার ৬% প্রাণ হারালো। জুনের পরে সেপ্টেম্বরে আবার এর সক্রিয় আক্রমণ শুরু হলো। ১৯১৯ অব্দি চললো ধ্বংস লীলা। উপনিবেশিক ভারতের ৯টি প্রদেশ এবং ২৩১টিরও বেশি জেলা আক্রান্ত হয়েছিল। সেসময় গাঁধি বলেছিলেন বেঁচে থাকার সমস্ত ইচ্ছে চলে যাচ্ছে। নামী হিন্দী লেখক সুর্যকান্ত ত্রিপাঠির স্ত্রী মারা গেলেন ইনফ্লুয়েঞ্জায়। টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে তখন বারংবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ভিড় এড়িয়ে চলতে, আক্রান্তের সংস্পর্শে না আসতে। আজকের করোনাভাইরাস অতিমারির সাথে কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে?

    কিন্তু আজকের করোনাভাইরাস বা সংক্ষেপে করোনা এক বাস্তব দুর্যোগ, মৃত্যুদূতও বলা যায়। কেন? এখনো অব্দি সমগ্র পৃথিবী জুড়ে শ্রেষ্ঠ মেধার বিজ্ঞানীদের এবং চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং গবেষণার পরেও আমরা অ-সামান্য এই ভাইরাসটি সম্পর্কে প্রায় কিছুই ভালো করে বুঝে উঠতে পারিনি। আমরা সাধারণভাবে বুঝি কোন একজন রোগির মধ্যে কোন উপসর্গ না থাকলে তার ভেতরে সে রোগটি নেই। করোনার ক্ষেত্রে চিত্র ভিন্ন। ১৯ মার্চ, ২০২০-তে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত হয়েছে একটি গবেষণাপত্র - SARS-CoV-2 Viral Load in Upper Respiratory Specimens of Infected Patients। সেখানে গবেষকেরা ৭২টি নাকের রসের এবং ৭২টি লালারসের স্যাম্পেল নিয়ে পরীক্ষা করেন। এ পরীক্ষায় দেখতে পান উপসর্গহীণ রোগীর নমুনায় যে পরিমাণ ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে উপসর্গযুক্ত রোগীর ক্ষেত্রেও সমপরিমাণ ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে। এর অর্থ উপসর্গহীন মানুষের থেকে সংক্রমণ ছড়াবে। গবেষকদের মন্তব্য - we need better data to determine transmission dynamics and inform our screening practices. অর্থাৎ, এখনো অব্দি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার একটি প্রাথমিক দিক সম্বন্ধেই ভালো করে বুঝে উঠতে পারি নি।

    ১৯ মার্চ, ২০২০-তে ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম - Prolonged presence of SARS-CoV-2 viral RNA in faecal samples। ১৬ জানুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ, ২০২০ পর্যন্ত গবেষকেরা মোট ৯৮ জন রোগীর স্যাম্পেল সংগ্রহ করে কাজ করেছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত – However, potential faecal–oral transmission might pose an increased risk in contained living premises such as hostels, dormitories, trains, buses, and cruise ships. এছাড়াও কোয়ারান্টাইনে বা সেলফ-আইসোলেশনে থাকা মানুষদের ক্ষেত্রেও এটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। শুধ কি তাই? গবেষকরা দেখছেন - Our data suggest the possibility of extended duration of viral shedding in faeces, for nearly 5 weeks after the patients’ respiratory samples tested negative for SARS-CoV-2 RNA। অর্থ হল, লালা রসে ভাইরাস না পাওয়া গেলেও ৫ সপ্তাহ পর্যন্ত গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মানুষের অন্ত্রে ৫ সপ্তাহ বেঁচে থাকতে এবং রেপ্লিকেট করতে পারে। এর ফলে আবার সংক্রমণ ঘুরে আসার সম্ভাবনা থেকে গেল। এর সাথে আরো দু-একটা তথ্য যোগ করা দরকার – প্রথম, সংক্রমণের প্রথম দিকে যেমন দেখা গিয়েছিল প্রধানত ষাটোর্ধ মানুষেরা (সাথে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি অতিরিক্ত অসুস্থতা আছে) প্রধানত আক্রান্ত হবে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে কমবয়সীরাও প্রায় সমপরিমাণে আক্রান্ত হচ্ছে। একমাত্র গর্ভাবস্থায় সংক্রমিত মা থেকে শিশুর সংক্রমণ বাহিত হয়না। যদিও চিনে এবং লন্ডনে দুটি কেসের রিপোর্ট পাওয়া গেছে যেখানে জন্মের ৩০ ঘন্টার মধ্যে শিশুটিও টেস্ট পজিটিভ হয়েছে। চিকিৎসকরা নিশ্চিত নন এটা গর্ভাবস্থায় সংক্রমণ না কি জন্মের পরে। দ্বিতীয়, আমেরিকান জার্নাল অব হেমাটোলজি-তে ৪ মার্চ, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের শিরোনাম – Hematologic parameters in patients with COVID-19 infection। সেখানে গবেষকরা দেখেছেন রক্তে শ্বেত কণিকা, লিম্ফোসাইট, এমনকি অণুচক্রিকার পরিমাণও কমে যাচ্ছে - On admission, leukopenia was observed in 19 patients (29.2%) with only one patient presenting with severe leukopenia (WBC < 2 × 109/L). Lymphopenia featured in 24 patients (36.9%) with 19 having moderate lymphopenia (absolute lymphocyte count [ALC] 0.5‐1 × 109/L), and five with severe lymphopenia (ALC < 0.5 × 109/L). Most patients had normal platelet counts, with 13 patients (20.0%) having mild thrombocytopenia (platelet count 100‐150 × 109/L). এর পরিণতিতে থ্রম্বোসিস, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে ডিসেমিনেটেড ইন্ট্রাভাস্ক্যুলার কোয়াগুলেশনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

    প্রসঙ্গত, এখনো অব্দি করোনাভাইরাসের কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। অ্যান্টিভাইরাল থেকে ক্লোরোকুইন এবং অ্যাজিথ্রোমাইসিন ইত্যাদি বিভিন্ন ওষুধ নিয়ে নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। কিন্তু কোনটাই আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত নয়। হু বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা জানানোর একটা সংস্থান রেখেছে। সেখানে বিভিন্ন ছোট ট্রায়ালের রিপোর্ট আপলোড করা হচ্ছে। শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি।

    ২০ মার্চ, ২০২০-র নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম – Covert coronavirus infections could be seeding new outbreaks। আমাদের বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়, একজন আপাত-উপসর্গহীন মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ এই বিপজ্জঙ্ক ভাইরাস তার শরীর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে। কি অসম্ভব এক পরিস্থিতি! নেচার-এর মন্তব্য - As coronavirus outbreaks surge worldwide, research teams are racing to understand a crucial epidemiological puzzle — what proportion of infected people have mild or no symptoms and might be passing the virus on to others. Some of the first detailed estimates of these covert cases suggest that they could represent some 60% of all infections. অর্থাৎ, প্রাথমিক যে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে তাতে অনুমান করা যায় জনসমাজের ৬০% সংক্রমণ এভাবে ঘটতে পারে। জাপানের এক জাহাজ থেকে উদ্ধার করা টেস্ট-পজিটিভ ১৩ জনের মধ্যে ৪ জনের অর্থাৎ ৩১%-এর কোন উপসর্গ ছিলনা।

    ভাইরাসের প্রজনন সংখ্যা (রিপ্রোডাকশণ নাম্বার) দিয়ে এর গতিপ্রকৃতি এবং সংক্রামিত করার ক্ষমতা মাপা হয়। একে বলা হয় R0 – যা দিয়ে বোঝা যায় একজন সংক্রমিত মানুষ ক’জনের মাঝে এই ভাইরাসকে পৌঁছে দিতে পারে। সাধারণভাবে এ সংখ্যা ২-২.৫। চিনের য়ুহানে একসময়ে এটা ৪ অব্দি পৌঁছেছিল। এখন এ সংখ্যা ০.৩২-এ এসে পৌঁছেছে। এপিডেমিওলোজির ভাষায় সংখ্যাটি ১-এর নীচে গেলে সংক্রমণমুক্ত বলা যেতে পারে। কিভাবে সম্ভব হল? আমরা দেখবো সে বৃত্তান্ত।

    আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট নিয়ে কথা বলবো – (১) COV-IND-19 Study Group-এর (আমেরিকার মিশিগান, জনস হপকিন্স, কানেক্টিকাট এবং দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিক্সের ১৪ জন গবেষকের একটি দল) ২১ মাড়ড়চ, ২০২০-র রিপোর্ট, এবং (২) Coronavirus: The Hammer and the Dance (করোনাভাইরাসঃ হাতুড়ি এবং নৃত্য) শিরোনামে একটি প্রতিবেদন।

    COV-IND-19-এর রিপোর্টে নজর আকর্ষণ করা হয়েছে প্রকৃত কত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত (the number of truly affected cases) এটাকে যদ্দূর সম্ভব নির্দিষ্টভাবে জানা। কারণ অজানা আক্রান্তরাই স্টেজ ২ থেকে স্টেজ ৩-তে (সামাজিক সংক্রমণ) যাবার “মিসিং লিংক”। ১৮ মার্চ, ২০২০ পর্যন্ত মাত্র ১১,৫০০ জনের টেস্ট করা হয়েছে। ২০ মার্চ বিবিসি নিউজ-এ প্রশ্ন তোলা হয়েছে - Coronavirus: Why is India testing so little? ভারতের অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থা মাথায় রেখেও বলা যায় টেস্টের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। হু-র ডিরেক্টর জেনারেল জোর দিয়েছেন – টেস্ট, টেস্ট, অ্যান্ড টেস্ট। এ রিপোর্টে গাণিতিক মডেলের সাহায্যে ভবিষ্যৎবাণী করছে যে যদি কোন হস্তক্ষেপ না করা হয় তাহলে সবচেয়ে কম করে হলেও ৩১ মার্চ সংক্রমিতের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৭৯, ১৫ এপ্রিল ৪৮৩৬ এবং ১৫ মে ৫৮৬৪৩। গতকাল এবং আজ থেকে (২২ ও ২৩ মার্চ) সরকারের তরফে সক্রিয় হস্তক্ষেপের পরে সংক্রমিতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৩৩( ৩৭৯-র চেয়ে অনেক বেশি)। এবার আরেকটা পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হয়েছে – প্রতি ১০০০ মানুষের জন্য ভারতে হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ০.৭; ইতালিতে ৩.৪; ফ্রান্সে ৬.৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১১.৫; চিনে ৪.২; ২.৯ ইংল্যান্ডে, ২.৮ আমেরিকায় এবং ১.৫ ইরানে। আমাদের ৫ গুণ রোগী ভর্তির ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ইতালির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পূর্ণত ভেঙ্গে পড়েছে। আমেরিকা এবং ইরানেরর খুব শোচনীয় অবস্থা। ইংল্যান্ডের ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়ার মুখে। এবার আরেকটা হিসেব দেওয়া হয়েছে। সরকারের তরফে হস্তক্ষেপ না হলে ১৫ মে নাগাদ সম্ভাব্য রোগীর সংখ্যা প্রতি ১০০,০০০-এ হবে ১৬১ জন (জাতীয় ক্ষেত্রে ২২ লক্ষ)। আবার কঠোর সরকারি হস্তক্ষেপ করা হলে এ সংখ্যা কমে সমগ্র দেশে হবে ১৩,৮০০ জন। এরা গুরুত্বপূর্ণ যে পরামর্শগুলো দিচ্ছে তা হল – (১) টেস্টের সংখ্যা সাংঘাতিকভাবে বাড়াতে হবে, (২) লকডাউনের প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে কঠোরভাবে, (৩) সবার জন্য বিনামূল্যে টেস্ট এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা রাকাহ দরকার, (৪) নন-এসেনশিয়াল বা কম প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল কেয়ার কমিয়ে দিতে হবে, বাড়াতে হবে হাসপাতালের এবং আইসিইউ-এর বেড সংখ্যা, (৪) লকডাউনের সময়, বিশেষ করে প্রান্তিক ও দরিদ্রশ্রেণীর মানুষের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতের সাধারণ মানুষের বিরাট দায়িত্ব হল সচেতনভাবে কোন ব্যতিক্রম ছাড়া “সামাজিক দূরত্ব” (৩ থেকে ৬ ফুট) রক্ষা করতেই হবে। কিছুদিনের জন্য একক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতেই হবে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা যেমন ২০ সেকেন্ড ধরে বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, জামাকাপড় গরম জলে বা সাবান জলে খুব ভালো করে ধোওয়া বা হাঁচি-কাশির সময়ে কনুই দিয়ে নাক মুখ আড়াল করা ইত্যাদি কঠোরভাবে মেনে চলতে। আমরা এক ভয়ঙ্কর অজানা শত্র্যর সাথে লড়াই করছি।

    এবার Coronavirus: The Hammer and the Dance প্রতিবেদনটিতে আসি। ট্রাম্পের করোনাভাইরাস নিয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল – This coronavirus thing is not a big deal (করোনাভাইরাস এমন কিছু বড়ো বিষয় নয়)। তারপরে এখন আমেরিকার? ২৩ মার্চ ইউএসএ টুডে-র শিরোনাম - 100M in lockdown; Trump wavers on social distancing; stimulus battle rages। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর খবর অনুযায়ী (২৩ মার্চ, ২০২০) - As of Monday morning, at least 33,018 people across every state, plus Washington, D.C., and three U.S. territories, have tested positive for the virus, according to a New York Times database, and at least 428 patients with the virus have died. নিউ ইয়র্কে রবিবার মোট ৪,৮০০ নতুন সংক্রমণ হয়েছে। আজ অর্থাৎ ২৩ মার্চ, ২০২০-তে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর হচ্ছে - The Toughest Triage — Allocating Ventilators in a Pandemic। প্রথম বাক্যটি হুবহু জার্নাল থেকে তুলে দিই - The Covid-19 pandemic has led to severe shortages of many essential goods and services, from hand sanitizers and N-95 masks to ICU beds and ventilators. Although rationing is not unprecedented, never before has the American public been faced with the prospect of having to ration medical goods and services on this scale. বিশ্বের বড় দাদা আমেরিকার অবস্থা এমন হয়েছে যে নিতান্ত আবশ্যিক আত্মসুরক্ষার জিনিসও সরবরাহ করতে পারছে না। আইসিইউ বেডে টান পড়েছে।

    Coronavirus: The Hammer and the Dance প্রতিবেদনটিতে সরাসরি প্রশ্ন রাখা হয়েছে – আমাদের কাছে কি কি অপশন বা রাস্তা খোলা আছে? (১) কিচ্ছুটি কোরো না – নিজের নিয়মেই ভাইরাসের সংক্রমণ কমে যাবে। কিছু মানুষের মৃত্যু হবে এই যা। প্রায় এমন একটা নীতি নিয়ে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা চলেছে একটা সময় পর্যন্ত। তারপরে নীতির পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু আজ আবার ট্রাম্প লকডাউন তুলে নেবার পক্ষে। ভয়ঙ্কর বিতর্ক শুরু হয়েছে। (২) মিটিগেশন বা প্রশমন স্ট্র্যাটেজি – যেহেতু এখন করোনাভাইরাসকে প্রতিহত করা সম্ভব নয় সেজন্য এ রোগকে এর মতোই চলতে দেওয়া উচিৎ। এর ভিত্তি হচ্ছে ইম্পেরিয়াল কলেজ অব লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি পেপার। সেখানে একটি গ্রাফ দেওয়া হয়েছিল। সেটি দেখলে গণিত এবং এপিডেমিওলজির ছাত্ররা সবাই বুঝতে পারবেন।



    ইম্পেরিয়াল কলেজের পেপারের শেষে মন্তব্য করা হয়েছিল – We are going to some mitigation (আমরা কিছু প্রশমন চাইছি)।এখানে আরেকটা প্রশ্নও চোলে আসবে। এই ভাইরাসের ক্ষেত্রে কি herd immunity বা গোষ্ঠি অনাক্রম্যতা কি সম্ভব? এই মুহূর্তে উত্তর হচ্ছে – না। ভবিষ্যতে হবে কিনা এখুনি বলা যাবেনা। কারণ আরএনএ ভাইরাস ডিএনএ ভাইরাসের চেয়ে ১০০ গুণ দ্রুত মিউটেশন করে। (৩) Suppression Strategy বা অবদমনের স্ট্র্যাটেজি – প্রশমনের স্ট্র্যাটেজি এই অতিমারিকে বেঁধে ফেলেনা, কেবলমাত্র কার্ভটিকে একটু ফ্ল্যাট বা নামিয়ে দেয়। অবদমনের স্ট্র্যাটেজি রোগাক্রান্তের যে জ্যামিতিক হারে উর্ধমুখী বৃদ্ধি ঘটে তাকে ছেদ করে বা কেটে দেয়। আরেকটি গ্রাফ এটা স্পষ্ট করবে।



    এবার যদি অবদমনের স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হয় তাহলে কেমন হবে সে গ্রাফ?



    অবদমনের স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হলে কি কি ঘটবে?

    ● করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা কমবে

    ● স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং এর সাথে যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপরে তৎক্ষণাৎ চাপ কমবে

    ● মৃত্যুর সংখ্যা কমবে

    ● কোল্যাটারাল ড্যামেজ কমবে

    ● সংক্রমিত, আলাদা হয়ে থাকা এবং কোয়ারানটাইনে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীরা দ্রুত সুস্থ হয়ে কাজে ফিরতে পারবে

    ● জনসমাজে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া কমাবে

    এভাবে চিন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ান এই মারাত্মক ভাইরাস সংক্রমণকে বাগে এনেছে। এরপরে শুরু ডান্স বা নৃত্যের অধ্যায়।

    মানুষকে বিপুল পরিমাণে টেস্ট করতে হবে। মানুষ নিজের উপসর্গ বুঝতে পারে হয় সেলফ-আইসোলেশনে যাবে কিংবা ডাক্তারের পরামর্শ চাইবে। ১৪ দিনের কোয়ারানটাইনে থাকাও তখন খুব সমস্যার মনে হবেনা। কারণ বেঁচে থাকাটা বেশি এবং একমাত্র জরুরি।



    সবশেষে, লকডাউন এবং অবদ্মনের ফলে কয়েক সপ্তাহ আমাদের জীবনের ছন্দ বদলে যাবে। কিন্তু বিনিময়ে পাওয়া যাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সারিয়ে ফেলার সময় আর বেঁচে থাকার নৃত্যশীল আনন্দ


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • খবর | ২৪ মার্চ ২০২০ | ৮৮৪৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শেখর রায়, বীরনগৃ | 188.114.111.124 | ২৪ মার্চ ২০২০ ১১:৩০91724
  • ব্যতিক্রমমী, দরকারী, তথ্য সমৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক প্রচার। যা বিরল। আ
    আমার মত- প্রথম কাজ পঃবঃ এ তিন জায়গায় এই পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। অতি শীঘ্র প্রমহকুমায় একটি করে এই সেন্টার করা। দ্বিতীয়, আন্ত রাজ্য আসা। যাওয়া অতি কঠোর ভাবে আটকানো ও অন্তরাজ্য জেলার ভেতর পরিবহন সেনসর করা। আর স্টডয়াম ও টাউনক্লাব মাঠকে প্রাথমিকভাবে রেডি রাখা যাতে প্রান্তিক মানুষ, খাদ্য, স্বাস্থ্য, ও আইসোলেশনের সুযোগ পায়।
  • শেখর রায়, বীরনগৃ | 188.114.111.124 | ২৪ মার্চ ২০২০ ১১:৩০91723
  • ব্যতিক্রমমী, দরকারী, তথ্য সমৃদ্ধ বৈজ্ঞানিক প্রচার। যা বিরল। আ
    আমার মত- প্রথম কাজ পঃবঃ এ তিন জায়গায় এই পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। অতি শীঘ্র প্রমহকুমায় একটি করে এই সেন্টার করা। দ্বিতীয়, আন্ত রাজ্য আসা। যাওয়া অতি কঠোর ভাবে আটকানো ও অন্তরাজ্য জেলার ভেতর পরিবহন সেনসর করা। আর স্টডয়াম ও টাউনক্লাব মাঠকে প্রাথমিকভাবে রেডি রাখা যাতে প্রান্তিক মানুষ, খাদ্য, স্বাস্থ্য, ও আইসোলেশনের সুযোগ পায়।
  • সায়ক দত্ত | 103.44.175.13 | ০৫ মে ২০২১ ১০:৫২105488
  • খুব ভালো লেখা। অনেকদিন আগের হলেও বেশ কিছু জিনিস অজানা ছিল। এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ।কবে মেটে সেটাই দেখার।

  • সায়ক দত্ত | 103.192.118.7 | ১১ মে ২০২১ ২২:২৮105873
  • ভালো লেখা।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন