এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • হারানো হাঁস, ম্লান মুর্গী

    সামরান হুদা লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২০ ডিসেম্বর ২০০৯ | ১০৯৬ বার পঠিত
  • (দ্বিতীয় পর্বের পর)

                                     লোটা ভইরা শীতল জল দিল খরম পানি।
                                     পাঁচ ভাইয়ের বউয়ে রান্ধে পরম রান্ধুনি।।
                                     মানকচু ভাজা আর অম্বল চালিতার।
                                     মাছের সরুয়া রান্ধে জিরার সম্বার।।
                                     কাইট্টা লইছে কৈ মাছ চরচরি খারা।
                                     ভালা কইরে রান্ধে বেনুন দিয়া কাল্যাজিরা।।
                                     একে একে রান্ধে সব বেনুন ছত্রিশ জাতি।
                                     শুকনা মাছ পুইড়া রান্ধে আগল বেসাতি।।

                                                                                  - মলুয়া, মৈমনসিংহ গীতিকা

    আব্বার ভীষণ পছন্দ শুটকি মাছ। সে যে কোন মাছেরই শুটকি হোক না কেন। খাবারের টেবিলে একটা শুটকির পদ না থাকলে আব্বার খাওয়া হয় না। বাজারে যত রকমের শুটকি পাওয়া যায়, আমাদের বাড়িতে সব রকমের শুটকিই আসত। বঙ্গোপসাগরে যে সব সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়ে জেলেদের জালে, তার বেশির ভাগই শুকিয়ে শুটকি করা হয়। নদী নালা, পুকুর আর বিলের মাছ খেয়ে অভ্যস্ত আমরা বাঙালিরা, সচরাচর সমুদ্রের মাছ কিনি না। লাক্কা মাছ তেমনি একটি মাছ। আড়াই থেকে তিন ফুট লম্বা, দেখতে অনেকটা হাঙরের মত। জেলেরা সেই মাছ বাজারে এমনকী বিক্রির চেষ্টাটুকুও না করে ল্যাজার দিক থেকে মাছটাকে তিন ফালিতে ফাঁক করে কেটে দিত কুড়ুল দিয়ে। দুপাশে মাছের শরীর, মাঝখানে ইয়া মোটা কাঁটা। সেই চওড়া শরীরটা আবার সরু সরু করে চিরে দেওয়া, ভাল মতন শুকানোর জন্য। ঠিক যেমন মাংসের ফালি করা হয় কাবাবের জন্য। এই তিনফালি মাছ জোড়া লেগে থাকত মাথার সাথে। তিনফালি মাছকে জাষ্ট কাপড় মেলার দড়ি বা তারে মেলে দেয় জেলেরা, ঠিক যেমন জামা-কাপড় শুকোয় গৃহস্থ বাড়িতে।

    তো লাক্কা মাছের শুটকি প্রথম যেদিন এল, সে দেখে ভয়েই অস্থির আমরা। অত বড় একটা শুকনো মাছ, মরা শুকনো চোখ মেলে তাকিয়ে আছে আর শুকনো দাঁত সর্বক্ষণ খিঁচিয়েই আছে যেন! গোটা একটা লাক্কা মাছের শুটকি দেখে আম্মা প্রথমেই একপ্রস্থ চেঁচিয়ে নেয় আব্বার পরে, কেন অতবড় একটা গোটা শুটকি মাছ কেনা হল। আব্বা ততক্ষণে লেগে পড়েছে কুড়ুল দিয়ে সেই শুটকি মাছ কাটায়। কুপিয়ে কয়েক ভাগে ভাগ করে আব্বা বলে, একলা খামু নিহি, হগ্গলেরে দেওন লাগত না!

    ভীষন শক্ত সেই লাক্কা শুটকির টুকরোকে রাতভর ভিজিয়ে রাখে আম্মা। তারপর আবার খানিকটা সেদ্ধ মতনও করে নেয় নুন আর হলুদ দিয়ে, বোঁটকা গন্ধ ছাড়ানোর জন্য। টুকরো টুকরো শুটকিকে শিলে হালকা করে থেঁতো করে নিয়ে অনেকটা ঝুরো ঝুরো করে দেয়। সে কি বড় বড় রোয়া মাছের, যেন বুড়ো কোন ষাঁড়ের মাংসের রোয়া। খুব বেশি করে পেঁয়াজ, রশুন কেটে নিয়ে তেলে ভাজে আম্মা, আর তারপর ওতে মশলা দেয়, বাটা রশুন, ধনে আর বেশি করে লাল মরিচ। মশলা কষে এলে থেতো করা শুটকি দিয়ে দেয় আর তারপর খানিক বাদে বাদেই নাড়তে থাকে। খানিকটা জলও দেয় মশলা ভাল করে শুটকির ভেতরে ঢোকার জন্যে। ততক্ষণের আশে-পাশের বাড়িতেও ঢুকে পড়েছে লাক্কা শুটকির ভাজি'র গন্ধ! শুকনো ঝুরো মতন দেখতে, তেলে মশলায় প্রায় ডুবু ডুবু লাক্কা, অনেকটা যেন মাংসের ঝুরি কাবাব, ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় লালে হলুদে মেশানো এক অদ্ভুত রং ধরা রশুনের কোয়া। গরম ভাতের সাথে, পোলাওয়ের সাথে এমনকি গরম গরম সেঁকা রুটির সাথেও দুদ্দাড় চলে লাক্কা ভাজি।

    আব্বার শুটকি প্রীতি এমনই যে তিনি খুঁজে পেতে বের করেন নোনা ইলিশ। ইলিশের শুটকি। যদিও দুÖপ্রাপ্য আর দুর্লভ কিন্তু ইলিশপ্রেমীরা জানেন কোথায়, কোন জেলার কোন বাজারে পাওয়া যায় নোনা ইলিশ। ইলিশ যখন প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়ে আর সেই ইলিশ সব বিক্রি হয় না, উপযুক্ত স্থান-ব্যবস্থার অভাবে যখন ইলিশের পাহাড় জমে থাকে জেলেদের কাছে তখন তারা বড় বড় চাকা চাকা করে কেটে নিয়ে নুন মাখিয়ে দেয় ইলিশে। নুন মাখানো না বলে বলা ভাল নুনে ডুবিয়ে দেওয়া হয় ইলিশকে। কয়েকদিন ধরে চলে এই নুন মাখানো। যখনই গায়ের মাখানো নুনের উপরদিকটা ভিজে আসে তখনই আবার আরো নুন দেওয়া হয় ঐ ভেজা নুনের উপরে। তারপরে বিশালাকারের মাটির মটকায় থাকে থাকে সাজানো হয় নুনে চোবানো ইলিশকে। মাটির সরা মুখে দিয়ে মটকার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয় টাইট করে। তারপর মাটির মটকা কোন একটা ঘরে একপাশে রেখে দেওয়া হয়। কোন একটা ঘরে হয়ত এরকম সব সার সার মাটির মটকাই শুধু থাকে। তিন থেকে চার মাস পরে ব্যাপারীকে বিক্রি করে দেওয়া হয় মটকা সহ ইলিশ। ততদিনে তৈরি নোনা ইলিশ বা লোনা ইলিশ । সোজা কথায় ইলিশের শুটকি।

    খুব বেশি করে পেঁয়াজ রশুন কেটে নিতে হয় নোনা ইলিশ খেতে হলে। পেঁয়াজ রশুন নিয়ে কার্পণ্য করলে নোনা ইলিশের মন খারাপ হয়, সে তার স্বাদকে গুটিয়ে ফেলে। কাজেই ইচ্ছে মতন পেঁয়াজ রশুন কেটে নিতে হবে আগেই। খুব ভাল করে নুন মাখানো ইলিশ ধুয়ে নিতে হয়। খুব মানে খুব ভাল করে। তেল গরম করে চাকা ইলিশ বা টুকরো করে কেটে নেওয়া ইলিশ অল্প ভেজে নিতে হয় তেলে। বাজার থেকে আগে থেকেই কিনে আনতে হবে স্বাস্থ্যবান যুবক নরসিংদীর শিঙনাথ বেগুন। না পেলে অগত্যা লাফা বেগুন। বড় বড় মোটা মোটা যে বেগুনগুলো বাজারে পাওয়া যায় তাই আর কি। এতে করে যদিও নোনা ইলিশের মানহানি হয় কিন্তু কী আর করা যাবে! সেই বেগুন ডুমো ডুমো করে কাটা বেগুন তেলে হালকা সোনালি করে ভাজতে হবে। ভাজা বেগুন তেল থেকে তুলে থালায় সাজিয়ে রেখে এবার কড়ায় ঢালা হোক বেশুমার পেঁয়াজ অ¡র রশুন। পেঁয়াজ যখন সোনালি হয়ে এল তখন একটু মশলা দেওয়া যাক। মশলা বলতে লাল মরিচ বাটা আর ধনে বাটা। ঝাল খেতে আপত্তি না থাকলে মরিচবাটাও ইচ্ছে মতন কিন্তু ঝাল নিয়ে সমস্যা থাকলে একটু বুঝে শুনে। একটুশখানি জল দিয়ে মশলা কষে এলে ভেজে রাখা ইলিশেরা উঠবে কড়ায়। মশলা আর পেঁয়াজের সাথে ইলিশের সখ্যতা যখন মাখো মাখো তখন টুক করে ঢুকে পড়বে বেগুন। ইলিশের সাথে বেগুনের বন্ধুত্ব চিরকালীন কাজেই ওদের একটু নিরালায় ভাব করতে দেওয়া হোক কড়ায় ঢাকনা চাপা দিয়ে। খুব বেশিক্ষণ নয় যদিও। বেগুন আবার ভীষণ সংবেদনশীল কিনা, বড় অল্পেতেই রুষ্ঠ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় কাজেই খুব একটা নাড়া-ঘাঁটা একদমই নয়। শুধু আলতো করে একটু এদিক ওদিক করে দেওয়া। বেগুন আর ইলিশ এক হয়ে যখন তেলকে আলাদা করে দেবে তখন কুচানো ধনে পাতা আর চেরা লংকা দিয়ে নামিয়ে নেওয়া। আর হ্যাঁ। বলতে ভুলে গেছি, ভুল করেও নুন দেওয়া চলবে না নোনা ইলিশে। আগে থেকেই এত নুন খাওয়ানো হয় রাজকুমারীকে যে আর নুন তার সইবে না মোটেও। শালি ধানের লালচে সোঁদা সোঁদা গন্ধ ওঠা গরম ভাতের সাথে জমাটি প্রেম এই বেগুন আর ইলিশের।

                                     মাইনি্‌কয়া বলে "এমন কথা না কহিও তুমি।
                                     চাইড়া যাইতে মন না চলে সোনার বাড়ী জমি।।
                                     সানে বান্ধা পুষ্করিনী গলায় গলায় জল।
                                     পাইক্যা আইছে সাইলের ধান সোনার ফসল।।
                                     তা দিয়া কুটিয়া খাইয়াম সালি ধানের চিরা।
                                     এই দেশ না ছাইরো ভাইরে আমার মাথায় কিরা।।'

                                                                                  - মহুয়া, মৈমনসিংহ গীতিকা

    যা হয়, দেশ ছাড়ার সাথে আস্তে আস্তে খাওয়া দাওয়া পাল্টে যেতে থাকে। মাঝে সাঝে বাংলাদেশ গেলেও সিলেট আর যাওয়া হয়নি। কাজেই তামাবিলের পাখি যে বছর শেষে ঠিক সাইবেরিয়া ফিরে যায় এমন কথা বলতেও পারি না। আমি নাই বা থাকলাম দেশে, খাদ্যরসিকদের নিশ্চয় অভাব বাংলাদেশে পড়েনি। দেশে ফিরলে দাওয়াৎ অনেক পাই বটে কিন্তু সেই স্বাদ আর গন্ধ ফিরে পাই না। বছর দুই আগে দেশে গিয়ে দাওয়াৎ খেতে যাই ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে। ভাই বিয়ে করেছে এক বার্মিজ মেয়ে। বেশ কয়েক বছর আগে বার্মা থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত টেকনাফে এসে ঘর বাঁধে তাদের পরিবার। কেবল এক পুরুষেই বাংলাদেশে বাস। জীবিকা ও বসবাসের সুবিধার জন্য তারা চলে আসে চট্টগ্রাম শহরে। নিজেদের মধ্যে এখনও বার্মিজ ভাষায় কথা বলে। শাড়িকে দু'টুকরো করে একটা অংশকে, নিচের অংশ কোমরের নীচে সারং-এর মত করে পরে । উপরের অংশটা কোমর থেকে গুঁজে নিয়ে শরীরে জড়িয়ে রাখে ওড়নার মত। গায়ে পড়ে কোমর পর্যন্ত ঝুল সেমিজের মত জামা। বর্তমান প্রজন্ম বেশ আধুনিক। তাদের বাড়ি দাওয়াৎ খেতে গিয়ে বারোটি চেয়ারের ডাইনিং টেবিলে স্তূপীকৃত খাওয়ারের রাশি দেখে তো ভির্মি খাওয়ার যোগাড়। মিষ্টি দিয়ে খাওয়া শুরু হল। সেটাই তাদের রীতি। খাওয়ার পরিবেশন করতে এল ভায়ের শালিকা। যে ক'জন নিমন্ত্রিত ছিলাম, ছয়- সাতজন মত, তাদের প্রত্যেকের প্লেটে দেওয়া হল "দুরস্ত কুড়া', নাম শুনে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, ডিপফ্রাই করা এক গোটা মুর্গী, কড়া করে ভাজা। বিশাল বড় ট্রেতে করে নিয়ে এসেছিল, প্রত্যেকের পাতে একটি করে ধরিয়ে দিয়ে গেল। সেই মাংস এত কড়া করে ভাজা যে মাড়ি ছিঁড়ে পড়ার জোগাড়। শক্তপোক্ত দাঁত ছাড়া হাত না বাড়ানোই ভাল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি, গোটা কুড়াটাই খেতে হবে? তাহলে বাদ বাকি জিনিসেরই বা কী হবে? মিষ্টি হেসে সুন্দরী শ্যালিকা জবাব দেয়, "যেটুকু পারেন খান, খাইতে না পারলে পাশের প্লেটে তুলি রাখি দিবেন'। চেষ্টা চরিত্র করে মুরগীর দুটো ঠ্যাংই খাওয়া গেল কেবল। নুন, আদার রস, আর লেবুর রসে জারিয়ে রাখা "দুরুস্ত কুড়া' খেতে দিব্য। টেবিলে সাজিয়ে রাখা অন্যান্য খাদ্যের দিকে চোখ না গেলে "দুরুস্ত কুড়া' মন দিয়ে খাওয়া যেত। এরপরে যে বস্তুটি এল সেটিও ভেতর থেকে ট্রেতে চেপেই এল, এই ট্রে আকারে কিঞ্চিত ছোট। সেদিকে চোখ পড়তেই সবার চোখ গোলগোল। মাঝারি আকারের ট্রের মধ্যে একরাশ ইলিশ তাও সব গোটাগোটা। সেই ট্রে থেকে জাস্ট আস্তে করে খাওয়ার প্লেটে ঢেলে দিল গোটা একটা ইলিশ। আকারে বেশি বড় নয়, কিন্তু তাও তো গোটা! ধরার সময়ই তারা ছিল ছয়শ-সাতশ গ্রামের, তখনও মশলার কাপড়জামা সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা তাদেরও ছিলনা, আমাদেরও ছিলনা! হাসিমুখ শ্যালিকাটি বলল, "ছুরি দিয়ে কাটি কাটি খান।' অবাক দৃষ্টিতে তাকালাম, ছুরি দিয়ে কেটে! ইলিশ মাছ! পরিবেশনকারিনী তখন একটু বিবরণ দিলেন, ইলিশ রান্নার। "এটা আমাদের রেঙ্গুনের রান্না, এ মাছ খাইতে আপনাদেরকে কাঁটা বাছি খাইতে হবে না! চাবাই খায়্যি ফেলেন, কোনো কাঁটা লাগব না।' খানিকটা মাছ ভেঙে ভয়ে ভয়ে মুখে পুরতে জ্বীভে যেন আপনা থেকেই সব গলে গেল। হালকা টক স্বাদ পেলাম। শুনলাম রাতভোর সিরকায় ডুবিয়ে রাখার পর ঘন্টা দুই সময় লেগেছে একেকটি ইলিশ রান্না করতে! মশলা বলতে, আদা, রসুনের রস আর খানিকটা পিষে নেওয়া টমেটো। তরিবৎ আর এমনই মেহনৎ করে রান্না করা যে তাতে কোন কাঁটাই আর অবশিষ্ট নেই। তারও তিন ভাগের একভাগ মত খাওয়া হল। গ্রেভি আর খুশবু ওঠা পোলাও তখনও পড়ে, পড়েই রইল সেগুলো, পড়ে ভুনা মুর্গীর গোশত আর চট্টগ্রামের লংকা সহযোগে গরুর মাংস ইয়া বড় টেবিল জুড়ে। পোলাও বা অন্য কিছু নেওয়ার ইচ্ছে তখন নেই। তাদের ইস্পেশাল রান্না শুনে, মুর্গী কে সাইড করে অল্প একটু পোলাওএর সাথে লাল রঙের গোশত পাতে নিলাম। প্রচুর গ্রেভির মধ্যে লুকোচুরি খেলা মাংসের ছোট ছোট টুকরো, খুব ছোট ছোট সেই সব টুকরো দেখলে খেতে ভরসা হয়। ইয়া মস্ত মস্ত মুর্গীকে ঠিক চার টুকরো করে কেটে রান্না করা ভুনা দেখে যখন একেবারেই ভরসা হয়নি। গোশতের রঙ দেখে ভয়ের কিছু নেই। যাদের চাট্‌গাই লঙ্কা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে, তারা জানেন। যারা জানেন না, সেই লঙ্কার আকার সত্যি বড়, কাশ্মিরী লঙ্কার চাইতেও, ফুট খানিক লঙ্কা যখন গাছে ধরে তখন গাছের ওজনের থেকে প্রতিটা লঙ্কার ওজন অনেক বেশি হয়। সেই লঙ্কার রঙ ঘোরতর লাল, আর শুকিয়ে যাওয়ার পর দেখতে হয় কালচে লাল, সাইজে বড় আমপাতার মতন। কত কেজি মাংসে ঠিক কতটা লঙ্কা পড়েছে তা আল্লাহ জানেন! তবে ঐ যে গ্রেভির সাম্রাজ্য তার সিংহ ভাগই লঙ্কার দখলে। কালনেমির মত সেই লঙ্কায় ভাগ বসিয়েছে স্বল্প পেঁয়াজ, রসুন ও আদা। লঙ্কার বর্ণনা শুনে যাদের গলা শুকিয়ে এসেছে, তাদের এবার জানিয়ে দেওয়া ভালো, ঐ নাগরা জুতোর সাইজের লঙ্কায় ঝাল কিন্তু মোটেও নেই, বরঞ্চ মিষ্টি। ঝালের জন্য দেওয়া হয় অন্য লঙ্কা!

    সঙ্গতে যে পোলাও ছিল তার কথা বোধহয় এখানে লিখে রাখা ভাল। চিনিগুড়া চাল, যা আকারে খাসা বা গোবিন্দভোগ চালেরও অর্ধেক, তা ভিজিয়ে রেখে গাওয়া ঘিতে ভেজে নেওয়া হয় দারুচিনি এলাচ আর লবঙ্গ দিয়ে। চালের উপর তিন কড়া হিসাবে জল ঢেলে অপেক্ষা কখন জল টানে। তার মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রচুর পরিমাণে আদা ও পিঁয়াজ বাটা। জল টানার পরে সেটা বসাতে হয় দমে। গোটা হাড়িকে তুলে দেওয়া হয় মস্ত গরম তাওয়ার উপর। মাঝে মাঝে নেড়ে দেওয়া চলে। হয়ে গেলে উপরে আগে থেকে ভেজে রাখা লাল মিহি করে কাটা পেঁয়াজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে স্পেশাল ব্যাপার কিছু নেই, রোজকার খাওয়ার তো!

    কখনও অবশ্য মরশুমি মটরশুটি পড়ে রঙ বদলের জন্য। যা ছিল সত্যিই ইস্পেশাল তা আমাদের ছেলেবেলার পোলাও, আখনি। সিলেট ছড়ার পর আখনি না খাওয়ার আক্ষেপ ছাড়া কিছুই আর বেঁচে নেই। যে কালোজিরা চাল দিয়ে তৈরি হত আখনি তা সত্যিই রহিস ব্যপার। কুচকুচে কালো দেখতে সেই চাল তৈরি হত নিজেদের জমিতে। যেখানে উচ্চফলনশীল ধান বিঘেতে চল্লিশ মণ হয়, আমন আউশের মত সাধারন ধান হত কুড়ি মত, আর সেখানে রাজার বেটা কালোজিরা ফলত বিঘায় পাঁচ থেকে ছয় মণ। চকচকে কালো রঙের ধানের সাইজ ছিল কালোজিরের চেয়ে একটু বড়। তখনই বাজারে পাওয়া যেত না এ চাল। কাজেই ভরসা নিজেদের জমি। আমার দাদি কেবল আখনি খাওয়ার শখে করতেন এই চাষ। সেই চাল ভাঙানো হত নিজেদের বাড়িতেই। সেই ঘোলাটে সাদা চালে সত্যিই যাদু ছিল! জলের মাপে ভুলচুক হলেও সেই চালের গলার কোন ইচ্ছাই নেই! সব চাল থাকত আলাদা আলাদা পোলাও রান্নার পরেও। যাই হোক আখনি রান্নার পদ্ধতি পোলাও রান্নার মতই, কেবল তাতে যোগ হত মাংসের টুকরো। সেই মাংস একদম লঙ্কা ছাড়া আগেই রান্না করা থাকত, ছোট ছোট টুকরোর ভুনা। খাওয়া হয় খাসি বা গরুর মাংসের সঙ্গে। আগেই বলেছি, তখন আমাদের উনুনে রান্না হত, সে আবার কাঠের জ্বাল। আখনি পোলাওএর জল শুকানোর পরে যখন ভাপে বসান হত, তখন কিছু আধপোড়া কাঠ চাপিয়ে দেওয়া হত হাঁড়ির উপর। তার খুশবু ছড়িয়ে পড়ত ধীরে ধীরে।

    (সমাপ্ত)

    ২০শে ডিসেম্বর, ২০০৯
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২০ ডিসেম্বর ২০০৯ | ১০৯৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন