এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সিনেমা

  • দেবকী বসুর 'কবি', ১৯৪৯ - একটি অটেকনিকাল পাঠ (সপ্তম কিস্তি)

    ত্রিদিব সেনগুপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | সিনেমা | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১ | ১০৮২ বার পঠিত
  • 213
    00:21:14,000 --> 00:21:35,100
    _You smile, I weep,_
    _And let the flute play_
    _Below the 'Kadam' tree_[37]

    তুমি হাসো, আমি কাঁদি,
    বাঁশি বাজুক কদমতলে রে।
    গোটা ফিল্ম জুড়ে উচ্চারিত বা অনুচ্চারিত রকমে যে অগণ্য সংখ্যক রাধা-কৃষ্ণ আলোচনার উল্লেখ ছড়িয়ে আছে তারই একটা এটা। প্রেম তার চূড়ান্ততার তুলনা পায় তখনই যখন সেই প্রেমে কদমতলায় বাঁশি বেজে ওঠে। মানে যেখানে প্রেমিক প্রেমিকা রাধা আর কৃষ্ণর যুগলরূপ পেয়ে ওঠে। যখন এর আগের লাইনগুলো গাওয়া হচ্ছে, সেই সময় থেকে একটানা পর্দায় নিতাই কাছে আসতে থাকে, এবং তার সঙ্গে তার বাঁদিকে আসরে বসে থাকা ঠাকুরঝি, খুব সচেতন ভাবেই ধরে রাখা ওখানের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখটি। এই লাইনদুটি যখন গাওয়া শেষ হয় তখন ফ্রেমে পড়ে থাকে সত্য অর্থে শুধু এই দুজনই। রাধা-কৃষ্ণ প্রসঙ্গ আর আমরা চিহ্নিত করব না, কিন্তু গুণতে গুণতে যান, কতবার আসছে, এক সময় গোণা ছেড়ে দিতে হবে। এটাকে একটু আলোচনায় আনার হয়তো প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বৈষ্ণব সাহিত্য এলাকায় আমি একমাত্র পড়েছি কৃষ্ণদাস কবিরাজের "চৈতন্যচরিতামৃত', তাই এই এলাকায় আমার খড়্‌গ নিষ্কোষিত করা নিতান্তই বেমানান। এবং রাধা-কৃষ্‌ণের প্রেম থেকে বৃহত্তর বাঙলা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনূঢ়া কন্যার বিবাহ অব্দিও যে বিস্তৃত হয়ে গেছিল কদমের প্রেক্ষাপট, শুধু একটু হাতিঘোড়ার উপস্থিতিতে, তার প্রমাণ তো আছেই, ""চাঁদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে, কদমতলায় কে/ হাতি নাচছে ঘোড়া নাচছে, সোনামণির বে।''

    221
    00:23:42,100 --> 00:23:50,200
    Who threw my books?
    Ramayana, Mahabharat,
    Manasamangal?[38]
    এ কী? কে ফেলে দিল? আমার রামায়ণ, আমার মহাভারত, মনসামঙ্গল? আমার ঘর থেকে এগুলো এখানে কে ফেলে দিল?


    উপন্যাসে যা ছিল অনেক জায়গাতেই লেখকের বিবৃতিতে, বা স্থির বিবরণে, তাকে চলচ্চিত্রযোগ্য ঘটনায় পর্যবসিত করার এটা আর একটা উদাহরণ। কবিগানের আসরে এই বই এনে ফেলে দেওয়াটা চলচ্চিত্রের নিজস্ব সংযোজন। তবে নিতাইয়ের বইয়ের একটা তালিকা উপন্যাসেও আছে।

    যাহা ভাল লাগে তাহাই সে সযত্নে রাখিয়া দেয়। বইয়ের সংগ্রহ তাহার কম নয়-কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসের মহাভারত, কৃষ্‌ণের শতনাম, শনির পাঁচালী, মনসার ভাসান, গঙ্গামাহাত্ম্য, স্থানীয় থিয়েটার ক্লাবের ফেলিয়া-দেওয়া কয়েকখানি ছেঁড়া নাটক; ইহা ছাড়া তাহার পাঠশালার বইগুলি-সে প্রথম ভাগ হইতে আরম্ভ করিয়া প্রত্যেকখানি আছে।


    ছোটবেলার বই সংগ্রহের তালিকা আমরা আগেই পেয়েছি, পাঠশালার লেখাপড়ার বিবরণের সূত্রে। সেখানে মনসার ভাসান ছিল না। তার মানে নিতাইয়ের "যাহা ভাল লাগে' সূত্রে এটা যোগ হয়েছে। মনসার ভাসান সূত্রে আমার নিজের বেশ কিছু ছোটবেলার স্মৃতি আছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ আমি বেজায় ভাল পড়তাম, সেই ছয় বা সাত বছর বয়সেই, পাঁচালিও, শনির এবং মনসার। মধ্যমগ্রাম বঙ্কিমপল্লীর বাড়িটা ছিল বেড়ার, খড়ের ছাউনি, পরে টিন লাগানো হয়েছিল। তখনও বরিশাল থেকে আসা উদ্বাস্তু পরিবারের উদ্বাস্তু-পুনর্বাসন পর্চায় পাওয়া জমিতে সেই বাড়ির পুরো প্রেক্ষিতটাই ছিল গ্রামের, আজকের মধ্যমগ্রামের মাল্টিতলা বস্তিএলাকার অভিজ্ঞতার সঙ্গে যা আর মেলানোই যায় না। গোয়াল ছিল। গোয়ালের সামনে গোবর-নিকোনো উঠোনে, সন্ধে বেলায়, চান করে, কাচা ধুতি ভাঁজ করে পরা ছয় বা সাত বছরের আমি, লম্ফ ও প্রদীপের আলোয়, পাঁচালি পড়তাম। আর মনে আছে, গাল-তোবড়ানো ঠাকুমা খুব গর্বভরে অন্য গিন্নিদের দিকে তাকাতেন, বড় ছেলের বড় ছেলে এইটুকু বয়সেই কেমন পাঁচালি পড়ে দেখেছ? সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু এটা লিখতে পেরে আমার মধ্যে একটা আরাম হল, ঠাকুমার কথা মনে করে। "সে হাতে পূজিব আমি চ্যাংমুড়ি কানি?' বসে বসে পড়ছি আমি খালি গায়ে দুলে দুলে, আমার মনে আছে।

    যাই হোক, সেই পাঁচালি সূত্রে আমি যতদূর জানি, মনসার ভাসান হল মনসামঙ্গলেরই আর একটু প্রাকৃত, আরও একটু সৃষ্টিশীল এবং প্রক্ষিপ্ত কিছু যোগ হওয়া নানা সংস্করণ। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু মনসার ভাসান বা মনসামঙ্গল যাই হোক, তার কিন্তু একটা গুরুত্ব আছে এখানে নিতাইয়ের পড়ার উপাদান হিসাবে উল্লিখিত হওয়ার। আমার এই বিষয়ে সেই যোগ্যতাটাই নেই আর অগ্রসর হওয়ার, কিন্তু খুব স্পষ্ট একটা সংযোগ আছে মনসার সঙ্গে অনার্য ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক আচরণের ডিসকোর্সের। বৌদ্ধ একটা সংযোগও বোধহয় আছে। অন্তত অনার্য সংসর্গটা তো প্রশ্নাতীত। আমি সাবটাইটলেও তাই উপাদানটা উল্লেখ করে রেখেছিলাম। রামায়ণ এবং মহাভারত - আর্য ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির যদি প্রতিনিধিত্ব করে, নিতাইয়ের জীবন আচরণ সংস্কৃতির আলোচনায় অনার্য উপাদানটাও যে আছে, তার একটা জ্যান্ত ইতিহাস সহ, সেটা এখানে চিহ্নিত থাকছে। ঠিক শনির পাঁচালিতেও যেটা সত্যি, চলচ্চিত্রে যা আর উল্লিখিত হয়নি। অর্থাত্‌?, শম্বুকেরও একটা বংশধারা আছে, সেই বংশধারা অনুযায়ী উপাদান জমে জমে তারও একটা ইতিহাস তৈরি হয়ে আছে। নিতাই সেটাও পায়, শুধু রামায়ণ মহাভারতই পায় না।

    239
    00:26:10,450 --> 00:26:18,300
    Old Balia says it good:
    Train maybe late, the girl never.

    আমাদের বুড়ো বালিয়া বলে মন্দ নয়। টিরেন লেট হোতি, লেকিন ছোকরি না লেট হোতি।


    এর পরে ভাষাগত বর্গসঙ্করতার প্রশ্নে আমরা আবার আসব। এখানে লক্ষ্য করার জায়গা এটাই যে পরিবারের নারীরও একটা অভ্যস্ততা ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছে হিন্দির সঙ্গে। সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এটা আমরা বেশ কয়েকবার দেখতে পাব চলচ্চিত্র জুড়ে।

    247
    00:26:40,700 --> 00:26:50,200
    That I can't bear – Maharani!
    Living by rail-track,
    here and there! Maharani!
    248
    00:26:50,600 --> 00:26:54,800
    Say mathrani, chnachrani![42]

    অয়, অয় কথা আমি সইতে লারি। মহারাণী! না ঘর, না দুয়ার, অ্যালের ধারে বাস! আজ চণ্ডীতলা, কাল পিণ্ডিতলা। মহারাণী! মেথরানি! ছ্যঁ¡চরানি!


    ঠিক এর আগের আলোচনাতেই যে ভাষাগত বদলের উল্লেখ করলাম তার সঙ্গেই একটা সংযোজন হিসাবে আসছে এটা। গ্রামীন সমাজের কাঠামোর পুরনো স্থিতিটা এর মধ্যেই ভেঙেচুরে গেছে রেলতন্ত্রের হাতে। বদলির চাকরির সূত্রে নানা জায়গায় আবাস রচনা এই বদলাতে থাকা সময়েরই আর একটা চিহ্ন। আর একটা মজার উল্লেখও করে রাখি। এই ম্যাথরানি এসেছে মেথর শব্দের স্ত্রীলিঙ্গে। যে নারী নোংরা পরিস্কার করে, বা যে নর নোংরা পরিস্কার করে তার স্ত্রী, এই অর্থে। যতদূর সম্ভব দ্বিতীয়টা। যে মেথর-এর স্ত্রী এই মেথরানি সেই "মেথর' শব্দটা এসেছে বৌদ্ধ ধর্মকাঠামোয় একটা উঁচু পদের নাম "মহাথের' থেকে। এটা আমি পড়েছিলাম কোথাও একটা, বোধহয় দীনেশ সেনের "বৃহত্‌? বঙ্গ' বইয়ে। কিন্তু ওটা এই মুহূর্তে আমার হাতের কাছে নেই। তাই মেলাতে পারছি না। বৌদ্ধধর্মকে সমাজ জীবন থেকে মুছে দেওয়ার যে বিরাট কর্মকাণ্ড ঘটেছিল ব্রাহ্মণ্যের হাতে, রক্তপাত সহ, সেই কর্মকাণ্ডেরই একটা খুচরো সাংস্কৃতিক উপাদান এটা। যাই হোক, এটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, কিন্তু উল্লেখ করতে মজা লাগল।

    261
    00:27:41,900 --> 00:27:48,800
    Fill stomach by the porter's job.
    At night, fill heart with songs.
    262
    00:27:48,900 --> 00:27:51,800
    No Rajan, no porter job any more.
    263
    00:27:51,900 --> 00:27:53,000
    What?
    264
    00:27:53,300 --> 00:27:58,700
    Come, let me read Ramayana,
    And you smoke the cigarette.
    265
    00:27:58,900 --> 00:28:01,700
    Then tell me whatever you want.
    266
    00:28:01,900 --> 00:28:03,500
    Come, Rajan.

    তুম উস্তাদ, দিনমে কুলিগিরি করকে পেট ভরাও, আওর রাতমে গানা গাকে দিল ভরাও, হাঁ? চলো, চলো।না রাজন। কুলিগিরি আর আমি করব না।

    কেয়া?

    তুমি ঘরে এসো রাজন। আমি তোমায় রামায়ণের একটা পদ পড়ে শোনাই। তুমি ততক্ষণ সিগারেট খাও।

    তারপর তোমার প্রাণ যা চায় তাই আমাকে শুনিও।

    এসো রাজন।


    প্রথমে চলচ্চিত্রে প্রসঙ্গটা কিভাবে এল সেটা দেখে নেওয়া যাক। প্রথমে রাজনের মন্তব্যে ইঙ্গিত আছে সেই অতিনির্ণয়ের, আগেই যেটা আমরা দেখেছি, আধুনিকতার পেশা থেকে জীবিকা অর্জন আর ঐতিহ্যের সক্রিয়তা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেটা নয়, কৌতূহলটা অন্য জায়গায়। এই একমাত্র জায়গা "কবি' চলচ্চিত্রের যেখানে খুব স্পষ্ট একটা নির্মাণের গরমিল পেয়েছি আমি, এবং যা একটুও ছিল না "কবি' উপন্যাসে। এতটাই বেমানান লেগেছে এটা অবশিষ্ট চলচ্চিত্রটা তৈরির সুচারু সুপরিকল্পিত রকমের সঙ্গে যে, "কবি' চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজনও কেউ যদি আজও বেঁচে থাকেন, এবং তার স্মৃতিতে থেকে থাকে এই খুঁটিনাটি তো সেটা আমি জানতে আগ্রহী। গরমিলটা কোথায় সেটা আগে দেখে নেওয়া যাক উপন্যাস থেকে।

    নিতাই গম্ভীরভাবে বিষণ্ন মৃদু হাসিয়া বলিল-কুলিগিরি আর করব না রাজন।

    রাজা বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গেল। ... রাজা আসিয়া বসিয়াই তাহাকে প্রশ্ন করিল-কেয়া হুয়া ভাই তুমারা? কাম কেঁও নেহি করেগা? ...

    নিতাই হাসিয়া বলিল-শোন, আগে এই কাহিনীটা শোন।

    রাজা বলিল-দূ-রো, ওহি লিখাপড়ি তুমারা মাথা বিগড় দিয়া।

    নিতাই তখন পড়া শুরু করিয়া দিয়াছে। রাজা অগত্যা একটি বিড়ি ধরাইয়া শুনিতে বসিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তন্ময় হইয়া গেল।

    ""বর দিয়া ব্রহ্মা গেলা আপন ভবন।
    আদিকাণ্ড গান কৃত্তিবাস বিচক্ষণ।।''

    পড়া শেষ করিয়া নিতাই রাজার মুখের দিকে চাহিল। রাজা তখন গলিয়া গিয়াছে। সে হাত জোড় করিয়া কপালে ঠেকাইয়া প্রণাম করিয়া বলিল-সীয়ারাম! সীয়ারাম! তারপর নিতাইয়ের তারিফ আরম্ভ হইল-আচ্ছা পড়তা হ্যায় তুম ওস্তাদ! বহুত্‌? আচ্ছা!

    নিতাই এবার গম্ভীরভাবে বলিল-রাজন, এইবার তুমিই বিবেচনা ক'রে দেখ।

    রাজা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল-কী?

    জানালা দিয়া রেললাইনের রেখা ধরিয়া দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া নিতাই বলিল-রত্নাকর, ধর কবি হলেন, তারপর কি তোমার তিনি ডাকাতি করতেন, না, মানুষ মারতেন? ... তবে? আর কি আমার মস্তকে করে মোট বহন করা উচিত হবে? বাল্মীকি মনির কথা ছেড়ে দাও! কার সঙ্গে কার তুলনা! ভগবানের অংশ, দেবতা ওঁরা। কিন্তু আমিও তো কবি। না হয় ছোট।


    এবার দেখে নেওয়া যাক, এই গোটা প্রসঙ্গটা, যার শুরুটা আমরা আগেই দিলাম, কিভাবে সম্পূর্ণ হচ্ছে চলচ্চিত্রে, এর পরের দৃশ্যেই। ঠিক এর পরের দৃশ্যে নয়, মধ্যে একটা সম্পূর্ণ তাৎপর্যহীন দৃশ্যও চলে যাচ্ছে। চলচ্চিত্রের এই দৃশ্যটা মনে রাখুন, "কেয়া?' বলে রাজা বিস্ময় প্রকাশ করার পরেই নিতাই নিয়ে এল রামায়ণ পড়ার কথা, এমন একটা রকমে, যাতে মনে হতেই পারে, রামায়ণ থেকে কিছু একটা শোনাতে যাচ্ছে নিতাই, যা শুনে নিতাইয়ের কুলিগিরি না-করার সিদ্ধান্তের কারণটা যেন বুঝে যাবে রাজা, শোনার পরে রাজার যে আর কিছু বলার থাকবে না, এটা যেন আগে থেকেই জানে নিতাই। আর উপন্যাসটা পড়া ছিল অনেকদিন আগে, এত মনেও ছিল না। তাই ফিল্মটা দেখতে গিয়ে, এর পরের দৃশ্যতেই গরমিলটা চোখে পড়েছিল। চলচ্চিত্রে এর পরের সংলাপটা ফের রাজা আর নিতাইয়ের মধ্যেই।

    267
    00:28:07,900 --> 00:28:12,500
    No.
    No more petty jobs for you.[44]

    না:।

    আর তোমার ছোট কাম করা চলবে না ওস্তাদ। কভি নেহি।


    রাজার এই সংলাপটা শুরু হচ্ছে ৭.৯ সেকেন্ড থেকে। আর এর আগের নিতাইয়ের সংলাপটা শেষ হয়েছে ৩.৫ সেকেন্ডে। সাড়ে তিন থেকে সাড়ে সাত সেকেন্ড ছিল একটি খুচরো দৃশ্য - রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে আসছে ঠাকুরঝি। রাজার এই সংলাপের পরেই দেখব সেই কৃষ্ণচূড়ার তলায় নিতাইয়ের বাঁধা গান গাইছে ঠাকুরঝি, নিতাইয়ের অপেক্ষায়। তার মানে, তখন, মাঝের ওই জায়গাটায়, ওই দিকেই হেঁটে আসছিল ঠাকুরঝি। ফিল্মটা দেখাকালীন, আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম, আরও ততদিনে উপন্যাসের মূল প্রসঙ্গটা একদমই ভুলে গেছি। ভাবলাম, এটা কী হল? মধ্যে কী ঘটল, যাতে কুলিগিরি না করার সিদ্ধান্তের প্রতি বিস্মিত বৈপরীত্য থেকে সক্রিয় সমর্থনে পৌঁছে গেল রাজা? রামায়ণ পড়ার আর সিগারেট খাওয়ার প্রস্তাব দিল নিতাই, তার পরেই এটা ঘটল কী করে? ফিল্ম দেখার পরে ফের উপন্যাসটা পড়তে গিয়েই এখানে রামায়ণের ভূমিকাটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু সমস্যাটা এই যে, যদি "কবি' চলচ্চিত্রের এটা ইচ্ছিত আকারই হয়, তাহলে এটা অত্যন্ত খাজা হয়েছে, চলচ্চিত্রের অবশিষ্ট পরিকল্পিত সুচারু আকারের সঙ্গে এই গোটাটা অত্যন্ত বেমানান। ওখানে রেল আইন ধরে ঠাকুরঝি আসার বিশেষ কোনও তাত্‌পর্যই নেই। এরকম অর্থহীন দৃশ্য গোটা ফিল্মে আমি আর একটিও মনে করতে পারছি না।

    জানিনা, আমার এরকম ভাবতে ইচ্ছে করছে বলেই ভাবছি কিনা, কিন্তু আমার নিজের মনে হয়, এখানে অন্য কোনও একটা পরিকল্পনা ছিল দেবকী বসুর। রামায়ণ পাঠের একটা কোনও দৃশ্য বোধহয় তোলার পরিকল্পনা ছিল তার। ঠিক নিশ্চিত হতে পারছি না, আর এই মুহূর্তে কৃত্তিবাসের রামায়ণ ঘেঁটে দেখার উদ্যমটাও নিজের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছি না। আরও আজ আমার এক বন্ধুর বড় মেয়ে আত্মহত্যা করেছে, সেই সংবাদটা সকালে পাওয়ার পর থেকেই সবকিছু কেমন গরমিল হয়ে গেছে। সারাদিন পারিনি, সন্ধ্যার পর এই অংশটা জোর করে লিখতে বসলাম, যদি একটুও মন তুলে নিতে পারি, এই আশায়। তাই নিশ্চিত বলতে পারি না, কিন্তু আমার যেন মনে হচ্ছে প্রায় এরকমই আকারের পংক্তি কৃত্তিবাসে আছে। আমার যেন মনে হয়, তারাশঙ্কর বা দেবকী বসু ভেবে রেখেছিলেন ওই পংক্তিটা পাঠের দৃশ্য ওখানে গুঁজবেন, পরে আর হয়তো হয়ে ওঠেনি, নানা কারণে। নইলে রামায়ণের প্রসঙ্গ আনা, ওখানে দৃশ্য কেটে দৃশ্যান্তরে যাওয়া, আবার কেটে ওই দৃশ্যে ফেরত আসা, এর গোটাটাই বড্ড বাজে, এলোমেলো, সচেতন পরিকল্পনার অভাবের চিহ্ন, যা কিছুতেই গোটা ফিল্মের সঙ্গে যায় না। এবং যদি তা হত, তাহলে, দ্বিতীয় দফায়, যখন রাজা তার সমর্থন জানাচ্ছে কুলিগিরি না করার সিদ্ধান্তে, সেখানে আরামসে গুঁজে দেওয়া যেত, "রত্নাকর কেয়া বাল্মীকি বননে কা বাদ কভি খুন করতা' ইত্যাদি খারাপ হিন্দির কোনও সংলাপ। সেটাই বা করলেন না কেন, তাহলে তো অর্থহীনতা আর থাকত না, দর্শকও ধরতাইটা পেয়ে যেত, রামায়ণ কেন এল সেই প্রশ্নটাই আর থাকত না। গতকালই একজন বলল, রবীন মজুমদার এখনও বেঁচে আছেন, তাঁর কাছে জানা যেতে পারত কিনা জানিনা, এই জায়গাটায় কোনও নির্মাণগত কোনও গন্ডগোল ঘটেছিল কিনা।

    273
    00:29:07,200 --> 00:29:10,600
    Calm down, thakurjhi.
    Had my new quarters today.
    274
    00:29:10,750 --> 00:29:12,600
    So I had a lot of things to do.
    275
    00:29:12,750 --> 00:29:15,700
    Burner, utensil, pots for tea -
    Arranged everything.
    276
    00:29:16,750 --> 00:29:20,300
    You'll make tea, have it.
    Today not in Rajan's place.

    রাগ কোরো না ঠাকুরঝি। আজ আমার লতুন ঘর পাতানো হল।

    তাই গোছাতে দেরি হয়ে গেল।

    চায়ের উলুন, হাঁড়িতে জল - সব ঠিক করে এলাম।
    তুমি চা করবে, চা খাবে। আজ রাজনের বাড়িতে নয়।


    এই গোটা কথনটা লক্ষ্য করুন। চালু ও আবহমান পুরুষ অবস্থানের থেকে বেশ পৃথক একটা অবস্থান এটা। একটা অভ্যস্ত পারিবারিক ভূমিতে এটা ঘটা বেশ অসম্ভাব্য। একটি পুরুষ একটি নারীর জন্য ঘর-গেরস্থালি, বাসনকোসন সব গুছিয়ে রাখছে, একটি নারীর ভোগের জন্য, এটা বেশ পৃথক। এবং একটু বাদেই আমরা দেখতে পাব, অভ্যস্ত পারিবারিক ভূমিতে একটি নারী কোনও কিছু ভোগ করছে এটা কত বড় একটা অনভ্যস্ততা, এবং তাকে কী ভাবে স্বাভাবিক দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে যাওয়াটাই শিষ্টতা, এটা "কবি' চলচ্চিত্রে খুব স্পষ্টতা নিয়ে চিহ্নিত আছে একটি দৃশ্যে, সেটায় আমরা আসছি একটু বাদেই। কিন্তু খেয়াল করার এটাই যে, নারী গুছিয়ে রাখছে, নিমিত্তটা হল পুরুষের ভোগ - এই পারিবারিক অভ্যস্ততার গতিমুখটা এখানে উল্টে যাচ্ছে। শুধু এই একবারই নয়, "কবি' চলচ্চিত্র জুড়ে পুরুষ-নারী সম্পর্কের মানচিত্রে ঘটে উঠবে আরও অনেকগুলি বদল। এবং এই প্রথমটির চেয়ে আরও অনেক বেশি নাটকীয় এবং জটিল তাদের অনেকগুলিই। সেগুলোয় আমরা এক এক করে আসব। আরও দেখার এই যে, এই ঘটনাটার ভিত্তি একটা রেল কোয়ার্টার। অর্থাত্‌? ঔপনিবেশিক পুঁজির অভ্যন্তরে এই ক্রমজন্মমান আধুনিকতা, এক্ষেত্রে রেলকে ঘিরে, ঘটে উঠতে শুরু করেছে। নিতাইয়ের নিজের পারিবারিক ভূমির সাপেক্ষে এই গোটাটাই হত একটা অসম্ভাব্যতা। এই ঘটনাটা, বা, তার সূত্রে ব্যক্তি নারী ও ব্যক্তি পুরুষের এই ব্যক্তি সম্পর্কটা। এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অন্নপূর্ণা নারীর অবস্থান থেকে সরে গিয়ে নারী ভোক্তা হয়ে উঠছে, এবং ঘর-গেরস্থালির কাজ বেয়ে তাকে যত্ন করার, তার মনোরঞ্জন করার, চেষ্টা করছে একটি পুরুষ।

    হ্যারিয়েট ফ্রাড, স্টিফেন রেজনিক এবং রিচার্ড উলফের একটা বই ছিল, "ব্রিংইং ইট অল ব্যাক হোম' নামে। তাতে ফ্রাডের লেখা একটি অধ্যায় ছিল অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা এবং সেই সূত্রে নারীশরীরে আধারে ঘটতে থাকা রাজনীতি নিয়ে। বছর পনেরো আগে, রাক্ষস পত্রিকায় এই অধ্যায়টির একটা অনুবাদও করেছিলাম, আর একজন সহ-অনুবাদকের সঙ্গে। ফ্রাড নিজে একজন মনোবিশ্লেষক, তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন, কী ভাবে নারীশরীরের মধ্যে ঘটে চলতে থাকে অন্নপূর্ণা-রাজনীতি। সে জানে তাকে খাবার দিতে হয়, অন্যদের, হয় প্লেটে, নয় বুক থেকে, এটা তার কর্তব্য। এই কর্তব্যের নিরিখে সে নিজেকে সাজিয়ে নেয় এক ভাবে, নিজেকে অন্নপূর্ণা করে। আবার সে আসে বাজারের মুখোমুখি। সেখানে সে ছাত্র বা শ্রমিক বা যাই হোক, সেই ভূমিতে সে সেই একই ইঁদুরদৌড়ের অংশ যেখানে তাকে অন্যের মুখ থেকে ছিনিয়ে খেতে হয়, বাজারের বেদান্তে যার অন্য নাম প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক। এই দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপরীত গতিমুখকে একই সঙ্গে একই নারীশরীরে ধারণ করতে গিয়ে তার শরীরের রাজনীতির ঐক্যটা ভেঙে যায়, বিস্ফোরিত হয়ে যায়, সেখান থেকে কী ভাবে আসে অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা বা অ্যানোরেক্সিয়া বুলিমিয়া সেই আলোচনায় গেছিলেন ফ্রাড। খেয়াল করুন, ঠিক সেই গতিমুখটা নিয়েই আলোচনা করছেন ফ্রাড, যেটার উল্টে যাওয়াটা আমরা চিহ্নিত করছি চলচ্চিত্রের এই অংশে। এবং নারীপুরুষের সম্পর্কের এই নতুন চরিত্রের গতিটার ইঙ্গিত ছিল উপন্যাসেও। সেখানেও সেটা ঘটতে পেরেছিল সেই রেল-কোয়ার্টারের আশ্রয়েই। নিজে বানিয়ে চা খাচ্ছিল নিতাই, দুধ দিতে আসা ঠাকুরঝিকে নিতাই বলেছিল:

    -এস, এস, একটুকুন চা আছে-খাবে এস।

    -না না। ঠাকুরঝির চা খাইতে বেশ ভালই লাগে, কিন্তু মেয়েদের ভাল লাগার কথা নাকি বলিতে নাই। ছি!


    আমি জানি না, আজ এতদিন পরেও, বাংলা লেখায় বা চলচ্চিত্রে, নারীর ভোগের প্রতি পুরুষের যত্নের কতটুকু উদাহরণ আমরা পাই। বা, কতটুকু পাই বাংলা জীবনেও। এবং এই যে ঠাকুরঝির চিন্তার বকলমে তারাশঙ্করের মন্তব্য, ""মেয়েদের ভাল লাগার কথা নাকি বলিতে নাই'', এর একটা ভারি দক্ষ চলচ্চিত্রায়ন করেছিলেন দেবকী বসু, যেখানে লেখক কেন, চরিত্রটিরও কোনও মন্তব্য প্রয়োজন পড়েনি। সম্পূর্ণ নির্বাক সেই দৃশ্যটির কথায় আসছি একটু পরেই।

    (চলবে)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১ | ১০৮২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন