এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • পাথরে পাথরে নাচে আগুন - প্রথম কিস্তি

    দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৬ জুন ২০১১ | ৮৫৯ বার পঠিত
  • এক
    তথাপীদং শশ্বৎ পরিচিত বিবিক্তেন মনসা,
    জনাকীর্ণং মন্যে হূতবহপরীতং গৃহমিব।

    ফ্রাস্টু মানে নিমে দত্ত ওরফে নিমচাঁদ দত্ত সময়ে অসময়ে কোটেশন ঝাড়ে জানি,কিন্তু আপিস টাইমে মাল খেয়ে এসে আমারই শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে এমন সংস্কৃত শ্লোক ঝেড়ে আমাকেই ঘায়েল করবে ভাবিনি।অতএব জিজ্ঞেস করে যেটুকু বুঝলুম তা আমার পক্ষে নিতান্তই বিড়ম্বনার।আমাদের এই আন্তর্জাতিক আকাদেমিক প্রতিষ্ঠানে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে এসে তার নাকি রীতিমতন গরম লাগছে।তাই সে কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম থেকে এই উদ্ধৃতিটা ঝেড়ে দিয়েছে।দুষ্যন্তের রাজসভায় ঢুকে এমনটাই নাকি মনে হয়েছিল আশ্রমিক শার্ঙ্গরবের।তাঁর মতো নির্জন একাকী তপোবনবাসীর কাছে দুষ্যন্তের ঘ্যাম সভাগৃহ যেন দাবগৃহ,আগুনে গা জ্বলে পুড়ে যায়-।

    ন্যাকামির আর শেষ নেই।আমাদের এই বিদ্যে প্রতিষ্ঠানে এখন কর্পোরট লুক।যন্ত্র নিয়ন্ত্রিত আতপ, যন্ত্র নিয়ে বসে কাজ,সকাল বেলাতেও নিয়নের আলো।বাইরের তাপ-উত্তাপ গায়েই লাগে না।আমাদের কিউবিকলসগুলো বহির্জগৎহীন।ফ্রাস্টু নিমে দত্ত তার গায়ের জামাকাপড় আমার ঘরের মধ্যেই খুলতে শুরু করে।এমন অভব্য কাণ্ডে বাধ্য হয়েই আমি ওকে টেনে নিয়ে যাই বাইরে।লিফটে করে নেমে আসি নীচে,যেখানে আর একটা নতুন রিইনফোর্সড কংক্রীটের আকাদেমিক বিল্ডিং হচ্ছে ।নির্মীয়মাণ সেই বিল্ডিংএর সামনের স্তুপাকৃতি পাথরকুচি তুলে নিয়ে নিমে ছুঁড়ে মারে উঁচু পাঁচিলের ওপরে। দেয়ালের উদ্যত বর্শায় ঠনঠন শব্দ করে সেগুলো অন্য কোথাও আছড়ে পড়ে-তারপর ফ্রাস্টু এগিয়ে যায় আমাদের আদ্যিকালের বাড়িগুলোর দিকে,ফাঁপা ইঁটের তৈরী বাড়ির দিকে।ঐ পুরোনো বাড়ির একটা ভগ্ন অবশেষ তুলে নেয় হাতে-বিশেষভাবে তৈরী করা ফাঁপা বড় ইঁট।তারপর বলে এই ফাঁপা ইঁট দিয়ে বাড়ি করতে মশলা কম লাগে না প্রতি ঘনফুটে? এগুলো একসময় তো আমাদের আতপ থেকে রক্ষা করত।এমনকি পাশের জনবহূল রাস্তার আওয়াজ থেকেও।এখন কি এটা পরিত্যক্ত বাতিল?তোদের এই পুরোনো ফাঁকা ইঁটের বাড়িতে খুব কম কংক্রীট আর ছাদের ভেতর থেকে পাইপ নেবে গেছে ভূগর্ভে- মাটিতে আকাশজলের ঘাটতি পোষাতে হবে তো!এখন এসব প্রাচীন প্রযুক্তি- বাতিল প্রযুক্তি।

    নিমচাঁদ হাঁটে কদমতলে-আমাদের প্রতিষ্ঠানে সদ্যনির্মিত ইঁট-বিটুমেন পাথরকুচির রাস্তার ওপর দিয়ে আর বলে চলে অতীতচারী স্বগত ""এই রাস্তা ছিল এককালে কমলা মোরামের,যা মাটি আকাশজল শুষতে পারত তখন। বাঁধিয়ে দিলি কেন এভাবে? তোদের মত বৈজ্ঞানিকদের পায়ে কাদা লাগত তাই?এই রাস্তা,এই কংক্রীটের বাড়ির বিকিরণ কি তোরা জানিস না আদৌ? আমার গায়ে জ্বালা ধরছে-উত্তাপটা যেন পারমাণবিক বোমায় তাপের চেয়েও বেশী। ""
    এরপর নিমে দত্ত আমার অজানা বিষয় সবুজ স্থাপত্য(ঋক্ষননশ অক্ষদবভঢ়নদঢ়য়ক্ষন) নিয়ে জ্ঞান দিতে থাকে এবং অত:পর আমাদের প্রতিষ্ঠানের ভেতরের দু-দুটো সিমেন্টে বাঁধানো পুকুর দেখে মারাত্মক খচে যায় ,বলে ""সভ্যতার সহিত বিদ্যাভাবের উদ্বাহ হলেই বিড়ম্বনার জন্ম নেয়""।না, এটা কোটেশন নয়,নিমে দত্তর
    ""নিজের"" কথা। আমি খেপে যাই ""কার বিদ্যাভাবের কথা বলছ?আমাদের মত বৈজ্ঞানিকদের?তোমার আস্পর্ধা তো কম নয়।"" আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিমে দত্ত পুকুরের বাঁধানো পাড়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকে ""পৃথিবী আপনার প্রাণের জিনিস আপনি খুশি হয়ে দেয়।কিন্তু যখন তার বুক চিরে মরা হাড়গুলো ঐশ্বর্য বলে ছিনিয়ে আনি,তখন অন্ধকার থেকে একটা কানা রাক্ষসের অভিসম্পাত নিয়ে আসি-এ কথাটা কোথায় যেন শুনেছি ? মনে পড়ছে না।"" তারপরই,একথা বলার পরই আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত নামে ডেকে উঠল আমায় ""সিসেরো,এবার তোমায় নিয়ে খুঁজতে বেরোব সেই আঁধার-যেখান থেকে আসে তোমার রাস্তার জন্য,বাড়ির জন্য পাথর,অথবা যেখান থেকে আসে অঙ্গার, তোমার আলোর জন্য,যন্ত্রের জন্য।তোমার কি জানতে ইচ্ছে করে না সিসেরো,কোথা থেকে আসে তোমার অন্ন-বস্ত্র আর সিমেন্ট-পাথর?এই উৎসমুখে গেলেই জানতে পারব কোন কোন নাগরিক অর্জন করে অনার্জিত ইনক্রিমেন্ট-----!
    না,এসব জানার আমার দরকার কী?বরং আমার বাচ্চা মেয়ের মতই বলা ভালো,মাছ থাকে ফ্রিজে,চাল হয় দোকানে।

    দুই

    মা মা বলে হুঙ্কার ছাড়ে ফ্রাস্টু নিমে দত্ত ""চল এবার আমরা বেরোই মাতৃ-সন্দর্শনে""। নাস্তিক নিমে দত্ত বলে কি? ""পাপ,পাপ-একি পাপ -মাকে আমরা চতুর্মার্গের পার্শ্বে নিয়ে গেছি,তাঁকে মার্জিনালাইজ্‌ড করেছি, ব্যাটা পুংদেবতাদের চাপে পড়ে।মা,মা,কি করব বল মা?তোর ছিন্ন ভিন্ন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলি পড়বি তো পড়,ঐ পাথুরে জায়গাগুলোতেই পড়ল শেষ অব্দি?বউ হারিয়ে বাবা ভোলানাথ এমন নাচ নাচলি বাবা উদোম যে তোর পায়ের চাপে পাহাড় পর্বত সব ঐ জায়গাতেই সেঁধিয়ে গেল মাটির নীচে।নে,শালা নে-বারবার এখন পাথর,পাথর থেকেই এখন হবে শালা পাথরকুচি।-"" ঘব,লঁ বষরঁ লষঢ়বনক্ষ,ঐং ভড়ব ঢ়ষং ভঢ়শনড়ড়ঁ ষয়ক্ষ পক্ষতফলনশঢ়নধ থষধঁ-সতক্ষঢ়ড়,ঢ়বন দষক্ষসষক্ষনতরড়...তরতড়,ঢ়বতঢ় ভড় থরতড়সবনলঁ!ঝবতঢ় ভড় শষঢ়বভশফ লষক্ষন ঢ়বতশ ভলতফভশতঢ়ভষশ.জঢ়তঢ়ন-ষয়ক্ষ শতঢ়ভষশ ড়ঢ়তঢ়ন ভড় তরড়ষ ড়তভধ ঢ়ষ থন তশ ভলতফভশতঢ়ভষশ !"" তফাৎ কোথায় মা? চল,সিসেরো,আমরা এখন সতীপীঠ খুঁজবো জতদক্ষনধ ঋনষফক্ষতসবঁ ষপ বীরভূম তশধ বর্ধমান।""
    নিমে দত্ত আমার ঘরে এসে মায়ের দেহাঙ্গ দেখবে বলে গুগুল-আর্থ দেখতে বসেছে।ইন্টারনেটের অধিবাস্তবে আমরা ঢুকে পড়ি-ঢুকে পড়ি বীরভুম আর বর্ধমানে।জুম ইন করে খুব স্পষ্ট ছবি পাচ্ছি না,জুম আউট করলুম;চোখের সামনে ভেসে উঠলো বড় দুটো আয়তক্ষেত্র-একটা ছাইরংএর, আরেকটা কালো কুচকুচে।এ দুটো কোন রাজনৈতিক ভৌগোলিক বিভাজিকা নয়। বোধহয় উপগ্রহের মারফত খুব স্পষ্ট ছবি তোলা হয়নি এখানের,তাই দুটো প্যাচেস এসেছে।মনে হচ্ছে খুব সরলরেখায় সবুজ এক জায়গায় শেষ হয়ে তৈরী হয়েছে দুটো কালো আর ছাই আয়তক্ষেত্র।কালো আয়তক্ষেত্রটা আসানসোল অঞ্চলের আর ছাইরঙা অংশটা সিউড়ি,দুবরাজপুর,রামপুরহাট,নলহাটি ,মল্লারপুর ইত্যাদি অঞ্চলের,আকাশপথে গরুড়াবলোকনে দেখা স্পষ্ট দুটো গন্ডি।ফ্রাস্টু বলে ব্যাটারা যেন আগে থাকতেই ডিফাইন করে রেখেছে দুটো গন্ডি;একটা কয়লার কালো অঞ্চল,আর একটা ছাই রঙের পাথর কাটা অঞ্চল।একটা খনি আর একটা খাদান।একটা মাটির তলা থেকে তুলবে কয়লা আর একটা তলা থেকে তুলে আনবে বেসাল্ট।ব্যাটারা বদমাশ।ওরা ষড়যন্ত্র করে মাটির তলা ফাঁপা করছে।""
    বুঝতে পারি নিমে দত্ত পারসিকিউটরি প্যারানইয়ায় ভুগছে।মাটির তলা থেকে মানুষের,হ্যাঁ,কেবলমাত্র মানুষের প্রয়োজনে সম্পদ তুলে আনতেই হয়।এর মধ্যে আবার ষড়যন্ত্র কিসের?""বদমাশ"" কারা?""ওরা"" কারা?নিমে দত্ত কি সত্যিই এই হাইপাররিয়েলে লাভপুর,কঙ্কালিতলা,সাঁইথিয়া,বক্রেশ্বর,নলহাটির সতীমন্দিরের তলায় মায়ের প্রত্যঙ্গ খুঁজছে?নাকি অন্য কিছু খুঁজছে?
    আসানসোল অঞ্চলে জুম ইন করে দেখি,এক জায়গায় আগুনে রেখা। আগুন জ্বলছে কেন? অন্যদিকে বীরভুমের ছাইমাটিতে কতকগুলো বৃত্তাকার ক্ষেত্র।এগুলো কী?থাক থাক পাথর নেমে গেছে যেন নীচে-কয়েকটায় আবার সবজেটে জল-এরকম অসংখ্য বৃত্ত-এগুলো কী?নিমে দত্তর কথায় জানতে পারলুম,এগুলো খাদান-বেসাল্ট পাথর কেটে তুলছে মানুষ মাটির নীচে থেকে।
    নিমে দত্ত আবার প্রলাপ বকে""এবার আরো জুম ইন করে ,মাটিটাকে টিল্ট-আপ করে দেখতো, সতীমার অঙ্গগুলো পাস কিনা? উপগ্রহের লেন্স যদি ঐ অঙ্গগুলি খুঁজে পায় ,তাহলে বোঝা যাবে,ঝুলি থেকে শ্রয়ডিংগারের জীবিত, মৃত,বা জীবন্মৃত বেড়াল বেরিয়ে পড়ল কিনা? ""

    আমি জানি,এমন প্রশ্ন প্রত্নতাত্ত্বিককে করলে আমি বেধড়ক কেলানি খাব।

    তিন

    ""তোকে আবার গয়ররং ষক্ষযনক্ষ আর অবয়বহীন না মালিক দেখাব এখানেও-চটকলের বেত্তান্তের মতই এখানেও পাবি দুনম্বরি ছায়া খেলা।এবং এখানে এটাও প্রমাণিত হবে ঋঈঙ-ঋগঙ-র সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাবের মানে নেই কোনো-ছায়া খেলার দাপট এমনই""।
    আমি অবাক হয়ে বললুম "মানে,আমরা তো এখন ট্রেনে চেপে অবসর কাটাতে চলেছি বীরভূম।এর মধ্যে আবার গয়ররং ষক্ষযনক্ষ আর ঈভড়নলথষধভনধ মালিক আসছে কোত্থেকে?সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি হবে নাকি?""ফ্রাস্টু ট্রেনের জানলায় মুখ বাড়িয়ে জোরে গেয়ে ওঠে""কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন,তার ঘুম ভাঙাইনু রে""।
    আমাদের দ্রুতগামী ট্রেনের গতি হঠাৎ ব্যাহত হয়।একটা কয়লা বোঝাই মালগাড়ি আমাদের ট্রেনের পাশে ধিকির ধিকির করে চলছে।নিমে দত্ত জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বলে""এইরকম একটা মালগাড়ির কয়লার ওপর শুয়ে মঙ্গল পাথরকাটার খাদান থেকে সটান চলে এসেছিল কয়লাখনিতে।""
    -কে মঙ্গল?
    -মঙ্গল দাগি,ঘাগু আসামি-""খুনে পাগল""বলে ডাকে পুলিশ। সশ্রম কারাদন্ডের সময় যে কাজ করত পাথর কাটার খাদানে,শর্টফায়ারারের ।জিলেটিন স্টিক ফাটিয়ে সে কেটে পড়ে বন্দীদশা থেকে।
    -এটা কি কোনো ফিলিম?
    - হ্যাঁ,যশরাজ চোপড়ার নিবেদন""কালাপাথর""কয়লাখনি নিয়ে অমিতাভ-শশী অভিনীত ফাটাফাটি ছবি-১৯৭৯এর। সে সময় জানিস,এ ছবি রাষ্ট্রীয়করণের পক্ষে কথা বলেছে,প্রাইভেটাইজেশনের বিরুদ্ধে কথা কয়েছে।বুর্জোয়া মালিক যে কত খারাপ তা দেখিয়ে দিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে---এই ছবির খলনায়ক ধনরাজপূরীর একটা ডায়ালগ শুনবি? গয়রর শ্রমিক বুঝতে সুবিধে হবে তোর।
    এই বলে আমার অনুমতির অপেক্ষা না করে কোটেশনে ভাসমান নিমে দত্ত শেকসপিয়ার-মিল্টন ছেড়ে প্রেম চোপড়ার মত হাস্কি গলায় পাল্প ফিলিমের ডায়ালগ ঝাড়ে""সাক্সেনা,আপকা হিসাব ইতনা কমজোর হ্যায় ইয়েভি নেহী জানতে চালিশ লাখ( রুপেয়া) চারশো ( মজদুর) সে বহত জাদা হোতে হ্যায় ---জিতনা কোয়্‌লা নিকাল সকতে হো নিকাল লো,বাদমে কুছ ভি হো গয়া তো হম দেখ লেঙ্গে। মানে এখানে চল্লিশ লাখ টাকা চারশো মজদুরের চেয়ে বেশী।""

    নিমে দত্তর কাছ থেকে এমনতরো সংলাপের কনটেক্সটে যা হৃদয়ঙ্গম হলো তা অনেকটা এইরকম: কয়লাখনির টানেল আরেকটু বিস্তৃত হলেই পাশের নদীর জল খনির দেয়াল ভেঙে ঢুকে পড়বে। এ কথা চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাক্সেনার কাছ থেকে জানতে পেরেই ধনরাজের এমনতর প্রত্যুক্তি: টানেল বাড়ালে চল্লিশ লাখ টাকা ঘরে আসবে,তাতে যদি চারশো মজদুর ডুবে মরে যায়,তাতে ধনরাজের কিস্যু যায় আসে না---।নিমে দত্ত বলে ""এই ছবি আমি দেখেছিলুম গত শতাব্দীর আটের দশকে,ঘাটশিলায়,সুবর্ণরেখার ধারে খোলা আকাশের নীচে,খনি শ্রমিকদের পাশে বসে বড় স্ক্রীনে।ছবির শেষে যখন শ্রমিকদের মারের হাত থেকে ধনরাজকে রক্ষা করল পুলিশ,তখন পাশে বসা শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাস এখনো মনে আছে।""

    আমার তৎক্ষণাৎ মনে পড়ল ১৯৭৯ থেকে আরো বিশ বছর আগের একটা নাটকের কথা ""অঙ্গার""।ফ্রাস্টুও কথায় কথায় সেই নাটকের একটি চরিত্রের কথা পাড়ল: সনাতন ওরফে বদ্যিনাথ।রবি ঘোষ এই চরিত্রে অভিনয় করতেন।সনাতন যখন বদ্যিনাথ ছিল ,তখন সে ছিল ইলেকট্রিসিয়ান। কোলিয়ারিতে ফ্যান সারানোর সময় খাদে ফাটল ধরে। সে চাপা পড়ে সাতদিন আটকে ছিল। বেরিয়ে আসার পর প্রথমে তাকে ভূত ভেবে সবাই পালায়।বদ্যিনাথ নিজেকেও ভেবে বসে ভূত।কিন্তু পরে বন্ধুবান্ধবেরা এসে তার গলা জড়িয়ে ধরলে তার বোধোদয় হয়। ""গলা "" নামক প্রতঙ্গ যখন আছে,তখন সেও ""বর্তমান"" আছে!কিন্তু ভুল ভেঙ্গে দিল কোম্পানি।ওরা বললে আমি নেই-কোর্টে ওরা প্রমাণ করে দিয়েছে আমি নেই।মানে বদ্যিনাথ বলে কোন লোক কস্মিনকালে ছিল না।ওদের খাতায় বদ্যিনাথ বলে কোনো নাম নেই। তারপর বদ্যিনাথ ভূতপূর্ব হয়ে যায়,সনাতন নাম নিয়ে আবার খনির কাজে যোগ দেয়।
    আর ফ্রাস্টু বলে চলে ""১৯৫৯ এর অঙ্গার,১৯৭৯-এর কালাপাথ্‌থর,শৈলজানন্দের ১৯২০/৩০-এ লেখা কয়লাকুঠি এবং ঐ অঞ্চলের অন্য অথবা আজকের ঘনশ্যাম চৌধুরির খাদান বা খাদানের পরে সংকলন-এসব কিছুতেই তুই যা খুঁজে পাবি,তার সঙ্গে আজকের,আমাদের ২০০৮-আমাদের গন্তব্যস্থলের তেমন কোনো হেরফের পাবি না।সেই একই রেজিস্টারিতে নাম-হীন,ঙঊ-ঋক্ষতঢ়য়ভঢ়ঁ-হীন,সুরক্ষা-হীন,উজঐ-হীন না মজুরদের তুই খুঁজে পাবি এখানে।খাদানের বা পরিত্যক্ত খনির অ-সুরক্ষিত প্রতিবেশে এখনো মজুর পাথরচাপা বা কয়লার চাঁই চাপা পড়ে মরে যায়। তার বাড়ির লোককে বলে দেওয়া হয়,ও মদ খেয়ে মরেছে অথবা হপ্তা তিনেক আগে টাকা পয়সা বুঝে নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। গয়ররং ষক্ষযনক্ষ এরকমই ভূতপুর্ব বেওয়ারিশ লাশ।সংগঠিত ক্ষেত্রের স্থায়ী মজুরদের মজুরির পাঁচ ভাগের একভাগেরও কম পেয়ে কাজ করছে ওরা দৈনিক বারো ঘন্টা।কাজের পরিমাণ প্রায় ২/৪ গুণ বেশী।খনির ঠিকাদারেরা এদের দিয়ে বাড়ীর গু-মুত পর্যন্ত সাফ করায়।কামিনদের নিয়ে গিয়ে ঠিকাদার নিজের বিছানায় শোয়ায়।এরকম কত কাজ। পরিত্যক্ত খনির ধসে----""
    ---""বারবার এরকম পরিত্যক্ত খনি কথাটা ব্যবহার করছিস কেন ?""
    ""পৃথ্বীর বুকের মধ্যে যা যা আছে,সবই যে তুই গায়ের জোরে তুলে আনতে পারবি-এমনটি নয়।কেননা তোর নিজের পায়ের তলার মাটি ধ্বসে যাবে তো। তাই কয়লার পিটের মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ মাল স্তম্ভাকারে ছেড়ে আসার নিয়ম। কোল ইন্ডিয়া যেই মাত্র বালিভর্ত্তি না করে (প্রশ্ন কর,কেন?কেন ড়তশধ পভররভশফ হল না?)একটা খনির ওপর "অথতশধষশনধ" ফ্ল্যাগটা লটকে দেয়,তৎক্ষণাৎ সেখানে হাজির হয় বেসরকারি ঠিকাদার। ৬০ থেকে ৮০ টাকার দিনমজুরও জুটে যায়।কখনো বা শুধু মদের পয়সা পেলেই তারা তুলে দেয় কয়লা। হায়রে,১৯৭৩ এর কয়লাখনির জাতীয়করণ! শ্রমিক সুরক্ষা আইন,শ্রম আইন-এসব কথা এখন অবান্তর।

    আচ্ছা,এমন দুনম্বরী কয়লা তোলায় তো মাটিতে ফাটল ধরবে-যে ফাটল রেললাইন অবধি নাকি গড়িয়েছে।এসব নিয়ে বলার লোক নেই নাকি?দেশে কি আইন নেই?


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৬ জুন ২০১১ | ৮৫৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন