এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা

  • গুরু হবার সহজ গাইড- কী লিখবেন , কেন লিখবেন

    সৈকত বন্দোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৩ মে ২০১১ | ৮৬১ বার পঠিত

  • কঠিন বইপত্তর নিয়ে ফান্ডা লড়াতে চান? বই রিভিউ করে বাজারী গুরুদের মুখে ঝামা ঘষে দিতে চান? পড়ুন "গুরু হবার সহজ গাইড - কী লিখবেন কেন লিখবেন"

    পণ্ডিতরা এতদিন আমাদের বুঝিয়ে এসেছেন, বইপত্তর রিভিউ করা খুব কঠিন কাজ। এর জন্য উচ্চমানের ফান্ডা লাগে। লম্বা দাড়ি ও ঝোলা ব্যাগ দরকার হয়। এতদিন আমি-আপনি কঠিন বই নিয়ে লিখতে গেলে ওঁরা "তুই ব্যাটা কী জানিস' বলে সর্বসমক্ষে হ্যাটা করেছেন। বাজারের ব্যাগ থেকে টপাটপ ইংরিজি রেফারেন্স তুলে এনে নাকের ডগায় ছুঁড়ে মেরেছেন। ডানদিকে-বাঁদিকে দেরিদা ও নেরুদা, ফ্রয়েড ও ফুয়েন্তেস ঝেড়েছেন। দূর-দূর করে নিজেদের ঠেক থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বিদেয় করে দিয়েছেন। আমরা, অনধিকারী শুদ্দুরেরা, জুতোপেটা খেয়ে নীরবে ফিরে এসেছি ঘরে।

    এই রচনা সেই অপমানিত ও অসুখী আত্মাদের জন্য, যাঁরা আঁতেলদের কাছে এভাবেই আজীবন অপদস্থ হয়েছেন। লাথিঝাঁটা খেয়ে, মুখ চুন করে, দিনের শেষে, বিফলমনোরথ, ফিরে এসেছেন ম্লান কফিহৌস থেকে। সেই সকল বঙ্গভাষী, যাঁরা ব্যর্থ-লেখক, যাঁরা ল্যালা, মূর্খ, চণ্ডাল, অনাথ ও আতুর, তাঁদের এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি ও নতুন জীবনের এক রত্নগুহার গুপ্তধনের সন্ধান দেবার নিমিত্তই রচিত হল ঈশ্বরপ্রদত্ত এই সটীক দশটি বিধান (টীকা বর্তমান লেখকের)। পাতি-পাবলিকরা একে হতচ্ছেদ্দা করলে পাবেন অনন্তকাল নরককুণ্ডের পারপিচুয়াল গরম তেলের ছিটে। দিনে দশবার তেলেভাজা হবেন, ডেলি আপনার মুণ্ডু কেটে আপনারই হাতে ধরিয়ে দেবে বিশালবপু বরকন্দাজরা। আর শুদ্ধচিত্তে নিষ্ঠাভরে অনুসরণ করলেই তুড়ি মেরে প্রবন্ধ লিখবেন। এনি ডে পণ্ডিতদের নাক কেটে নেবেন। ম্যাগাজিনে ম্যাগাজিনে আপনার নাম দেখা যাবে। জীবদ্দশায় যশ ও ধন পাবেন, পরকালে মেনকা-রম্ভা (লেডিসদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা আছে)।

    --------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    দশটি বিধান (সটীক)

    প্রথম বিধান। কোথায় লিখবেন। যথাযথ স্থানে আত্মপ্রকাশ করুন।
    টীকা: আপনার আত্মপ্রকাশের জন্য চাই যথার্থ মঞ্চ। পৃথিবীর যাবতীয় লোককে আপনার রচনামাহাত্ম্য পড়ানো গেলে ভাল হত, কিন্তু তার জন্য বড় কাগজে লিখতে হয়। তারা আপনাকে চান্স দেবেনা (দিলে আপনি ফালতু এই লেখা পড়তেন না)। এমনকি তেমন-তেমন আঁতেল ছোটো ম্যাগাজিনও ইয়াব্বড় ডিগ্রি-পেডিগ্রি এবং/অথবা দশ বছরের লেখালিখির এক্সপিরিয়েন্স ছাড়া লিখতে দেয়না। অতএব, আপনাকে টার্গেট অডিয়েন্স ঠিক করে ফেলতে হবে। লেখার লক্ষ্যও স্থির করে ফেলতে হবে। ফুটবল মাঠে যেমন ছোট ক্লাব থেকে উপরে উঠতে হয়, তেমনই ছোট জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। গুরুচন্ডালির মতো পত্রিকাকে টার্গেট করবেন, যারা লেখা দিলে না ছেপে পারবেনা। কিন্তু সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে, যে, গুরুচন্ডালিতে দুটো লেখা ছাপানোই আপনার জীবনের ব্রত নয়। প্লেয়ারের দূর পাল্লার লক্ষ্য হল বড় দল। আর অন্তর্বর্তীকালীন লক্ষ্য হল বড় দলের সঙ্গে ম্যাচে তুখোড় খেলে বড় কোচের নজরে পড়া। অর্থাৎ ছোট-বড় মিলিয়ে আপনার এই মুহূর্তের আসল টার্গেট হল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাথা, চশমা আঁটা আঁতেলশিরোমণিদের নেকনজরে আসা। সেদিকে নজর রাখতে হবে। ঠিক সময়ে ঠিক, অর্থাৎ কনটেম্পোরারি মেটেরিয়াল সাপ্লাই দিতে হবে। কী করে লিখবেন, সে নিয়ে ঘাবড়াবেন না, ও আমরা সামলে নেব। কী নিয়ে লিখবেন, অর্থাৎ সাবজেক্টে মন দিন। সাবজেক্ট হিট হলেই আপনিও হিট।

    দ্বিতীয় বিধান। সাবজেক্ট। ঠিকঠাক বিষয় বাছুন। নইলে বাঁশ খাওয়া অনিবার্য।

    টীকা: এমন বই কখনও বাছবেন না, যা নিয়ে বাজারে বিতর্ক আছে। যেমন ইতিহাসের বই। বা পলিটিক্স। কি দর্শন। এসব বইয়ের ব্যাখ্যা নিয়ে পণ্ডিতরা হামেশাই বাজারের মোড়ে লাঠালাঠি করে থাকেন, আপনি শান্তশিষ্ট মানুষ, ঐসব বাজে বখেড়ায় গিয়ে লাভ নেই। বাড় খেয়ে খুব অল্পপড়া বই নিয়েও ফান্ডা লড়াতে যাবেন না। এমনিতে ওসবের রেফারেন্স জোগাড় করাও চাপ, প্লাস পণ্ডিতরা যে বই পড়েননি, তা নিয়ে আলোচনা করলে ওনারা রেগে যেতে পারেন। আবার বহুপঠিত বই, যেমন ধরুন হ্যারি পটার ফটার জাতীয় পপুলার মালপত্তর নিয়ে লিখেও লাভ নেই। ওসব নিয়ে খবরের কাগজে লেখা হয়, তারা আপনাকে চান্স দেবেনা। সেটা আপনার লক্ষ্যও নয়। আপনার লক্ষ্য আঁতেল ম্যাগ। আপনার লক্ষ্য চশমা পরা পণ্ডিতবর্গ। তাই মূলত সাহিত্যের এলাকাতেই খেলুন। এমন বই নিয়ে লিখুন, যা সাধারণ লোকে পড়েননি, কিন্তু পণ্ডিতরা অবশ্যপাঠ্য বলে পাঠ করেছেন। বাংলায় যা নিয়ে বিশেষ লেখালিখি হয়নি, কিন্তু ইংরিজিতে হয়েছে। ফলে রেফারেন্সও প্রচুর। টুকতে সুবিধে হবে। মনে রাখবেন পরীক্ষার খাতায় টোকা পাপ হলেও, রিভিউয়ে, বিশেষ করে বাংলা প্রবন্ধে না টুকলে লোকে প্যাঁক দেবে। এবং লাস্ট বাট নট দা লিস্ট, যা নিয়ে লিখছেন, দেখবেন, সেই বইটি নিয়ে যেন কোন বাওয়াল না থাকে। পৃথিবীর পণ্ডিতবর্গ যেন মোটামুটি এক স্বরে বইটির প্রশংসা করে থাকেন। যেমন ধরুন, কাফকার ট্রায়াল। কি মার্কেজের একশ বছরের নি:সঙ্গতা।

    এসব বইয়ের নাম জানবেন কোত্থেকে? যেভাবে আমরা জেনেছি। মাঝে-মাঝে পাতিরামে ঢুঁ মারবেন, চটি এবং মোটা বইয়ের পাতা ওল্টাবেন (কেনার দরকার নেই), তাহলেই জানা যাবে বিশ্বের আপামর কন্টেম্পোরারি বইয়ের নাম, যা এখন বাংলা বাজারে সাড়া ফেলেছে। বইপত্তর ঘাঁটতে হবে বলে ঘাবড়ে যাবেন না। খাটনি বলতে এইটুকুই। বাকিটা জিলেট স্মুদ। ও হল-ম্যানেজ হয়ে যাবে। প্রমিজ।

    তৃতীয় বিধান। কতটা লিখবেন। লেখার আকার ঠিক রাখুন।

    টীকা:লেখার আকার ঠিক-ঠাক না হলে বিষয় পছন্দ করেও কোন লাভ নেই। সাইজ ঠিক না হলে লোকে পড়বেনা। গাব্দা লেখার চেষ্টা করবেন না। এমনিতেই লোকের সময়ের অভাব, পণ্ডিতদেরও হরেক-রকম ধান্দায় ব্যস্ত থাকতে হয়, লোক চরিয়ে খেতে হয়, আপনার মত পঞ্চাশটা লোকের লেখা পড়তে হয়। বিরাট লেখা হলে ওনারা জাস্ট কাটিয়ে দেবেন। বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে দেখেছেন, ২০০০ শব্দের বেশি লেখা হলে এই জেটযুগে লোকে সেসব ধরতেই ভয় পায়, যেজন্য খবরের কাগজের নিবন্ধগুলির মাপ ২০০০ শব্দের মধ্যেই করা হয়। তা, আপনি তো খবরের কাগজে লিখছেন না, আপনার তেমন নাম-ধামও নেই। ফলে আপনাকে লেখার আকার ২০০০ শব্দের কম করতে হবে।

    তার মানে অবশ্য এই নয়, যে, পুচকে লেখা দেবেন। তাতে অন্য সমস্যা আছে। ৫০০ শব্দের নিচে লেখা হলে, সেটা দেখতে ভাল হয়না। মনে হয়, লেখার মতো বিদ্যে নেই, তাই সমালোচনা করেনি, বইয়ের বর্ণনা করে ছেড়ে দিয়েছে। সেটা লেখকের ইমেজের পক্ষে ভাল না। ফান্ডাবাজরাও ভাল চোখে দেখেন না। অতএব, সাইজের জন্য মোটামুটি ১০০০ শব্দের মতো একটা জায়গায় রফা করতে হবে। যাতে একটা চৌকো এ-ফোর সাইজের পত্রিকার মোটামুটি এক পাতা ভরে যায়। এর বেশি হলেও ঝামেলা, কম হলেও বিপদ।

    এক পাতা জুড়ে কী লিখবেন? আগেই বলা হয়েছে, ওসব নিয়ে ভাববেন না। কোথায় লিখবেন, কী নিয়ে লিখবেন, আর কতটা লিখবেন, এসব সিদ্ধান্তগুলিই আসলে কঠিন সিদ্ধান্ত। অধিকাংশ মানুষই এগুলি ভুলভাল নেন বলে ব্যর্থ লেখকে পরিণত হন। কাজেই ঐগুলি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করুন। "কী লিখবেন' টা এই তথ্যবিপ্লবের যুগে কোন ব্যাপারই নয়। লেখা ও টোকার জন্য আছে বিশ্বের আধুনিকতম প্রযুক্তি, ইন্টারনেট। এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যা এখন ঘরে-ঘরে। চ্যাট/ওর্কুট/ভাট করা ছেড়ে ইন্টারনেটে লেখালিখির জন্য সামান্য সময় দিন। মেথডিকালি ব্যবহার করুন। বাকি সব বিন্দাস।

    চতুর্থ বিধান। কী লিখবেন। শুভকাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করুন।

    টীকা: আগেই বলা হয়েছে, বই পছন্দটিই হল রিভিউএর প্রাণভোমরা। ঠিকঠাক বই পছন্দ করতে পারলেই অর্ধেক কাম খতম। যে বই নিয়ে লিখছেন, সেটা পড়তেও পারেন, নাও পারেন। ওটা অপশনাল। তাহলে লিখবেন কীকরে? খুব সোজা। লেখার জন্য বেশি চাপ নেবার দরকার নেই, মানুষের চাপ কমানোর জন্য এখন আছে ইন্টারনেটের সুবন্দোবস্ত। বই-ফই পড়ার চাপ নেবেন না। পৃথিবীতে গুচ্ছের সার্চ ইঞ্জিন আছে, তাদের ঘাড়ে পড়া এবং খোঁজার চাপটি চাপিয়ে দিন। বই আর লেখকের নামটা জানলেই কাফি। নেট খুলুন আর গুগলে নামধাম দিয়ে এন্টার মারুন। ব্যস। মনে রাখবেন, আপনি ইতিমধ্যেই এমন বই বেছেছেন, পণ্ডিতমহলে যার সুনামে পৃথিবী অন্ধকার। ফলে গুচ্ছের রেফারেন্স পাবেন। সবকটা পড়ারও দরকার নেই। সার্চ রেজাল্টের প্রথম পাতায় যে দশটা লিংক পেলেন, একটা ১০০০ শব্দের রিভিউ লেখার জন্য তাই যথেষ্ট।

    বিশ্বাস হচ্ছে না? আসুন, ব্যাপারটা একটু হাতে-কলমে করেই দেখা যাক। লেখার সাইজ আমরা জানি। কাদের জন্য লিখব জানি। এখন প্রথমে একটা বই বাছতে হবে। দুই নম্বর বিধানে আমরা রিভিউএর জন্য আদর্শ দুটো বইয়ের কথা লিখেছি। মার্কেজের একশ বছরের নি:সঙ্গতা আর কাফকার ট্রায়াল। এর মধ্যে থেকে আমরা প্রথমে একটা বেছে নিই। ধরুন আপনি কাফকার ট্রায়াল নিয়েই লিখছেন। এবার গুগলে "ট্রায়াল কাফকা' দিয়ে সার্চ দিলে যে প্রথম পাঁচটি বস্তু পাবেন, তারা নিম্নরূপ:
    ১। উইকিপিডিয়ায় ট্রায়াল বিষয়ক বক্তিমে। ২। ঐ একই জায়গায় কাফকা বিষয়ক বক্তিমে। ৩/৪। দুটি ভিন্ন পণ্ডিতি সাইটে ট্রায়াল নিয়ে চাট্টি হাইফান্ডা লেকচার। ৫। গুটেনবার্গ নামক একটি সাইটে কাফকার ট্রায়াল নামক বইটি। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।
    বিশ্বাস করুন বা না করুন, এই পাঁচটা স্টাডি মেটিরিয়াল দিয়েই আস্ত ট্রায়ালের রিভিউ লিখে ফেলা যায়। ইন ফ্যাক্ট পাঁচ নম্বর লিংকটাও লাগেনা। গোটা বইখানা পড়ে লাভ টা কী? ইচ্ছে হলে অবশ্য পড়তে পারেন। কিন্তু সেটা, আগেই বলা হয়েছে, অপশনাল। লেখার জন্য ওটা পড়ার দরকার নেই।

    তবুও সন্দেহ আছে? সাধে কী আর আপনার দ্বারা কিছু হয়না? বেশি বকে লাভ নেই, আপনার সন্দেহ ঘোচানোর জন্য, আসুন এখানে আমরা লিখে ফেলি আস্ত একটি রিভিউ। জেনে নিই প্রবন্ধ লেখার টেকনোলজির অন্ধিসন্ধি। পরবর্তী বিধানগুলিতে।

    পঞ্চম বিধান। কীভাবে লিখবেন। লেখার পদ্ধতি আয়ত্ত করুন।

    টীকা: ছোটোবেলায় যদি রচনা লিখে থাকেন তো আপনি নির্ঘাত জানেন, যে, যৌনতার শুরুতে যেমন ফোরপ্লে, লেখার গোড়ায়ও তেমনই ভূমিকা। ভূমিকা জম্পেশ হলে তবেই লোকে বাকিটা পড়বে। ভূমিকাতেই গেঁথে ফেলতে হবে আঁতেল-কুল-চূড়ামণি পণ্ডিতগণকে। স্রেফ ভূমিকা দিয়েই বুঝিয়ে দিতে হবে, আপনি ফান্ডাবাজ লোক। এলেবেলে না। প্লেনের টেক-অফের মত ভূমিকাই হল জার্নির শুরু। ঠিকঠাক না হলে প্লেন মুখ থুবড়ে পড়বে। জার্নি হবে বরবাদ। অতএব, লেখার প্রাথমিক শিক্ষা হল, ভূমিকা নিয়ে রিস্ক নিয়ে লাভ নেই। এবং এটাও মনে রাখতে হবে, যে, আপনি তো সত্যিই প্লেন চালাচ্ছেন না, যে, টেক-অফ নিজেকেই করতে হবে। এক্ষেত্রে ওটা এক্সপার্টের হাতে ছেড়ে দেওয়াই মঙ্গল। অর্থাৎ, জাস্ট টুকে দিন। পারলে ইংরিজিতে। ব্যাপারটা জম্পেশও হবে, আবার আপনার ফান্ডার যথাযথ পরিচয়ও দিয়ে দেওয়া হবে।

    কাফকার ট্রায়ালের জন্য একটা যুৎসই জম্পেশ ইংরিজি উদ্ধৃতি খুঁজে বার করতে পারলে ব্যাপারটা এমনিই বোঝা যাবে। বেশি খাটাখাটনি করতে হবেনা, ঝপ করে খুঁজে বার করার জন্য আমাদের হাতে আছে চারটি লিংক, যেগুলি আমরা ইন্টারনেটে সার্চ করে বার করেছিলাম। তার প্রথমটাতে অর্থাৎ উইকিপিডিয়ায় ট্রায়াল সংক্রান্ত বক্তিমেটিতে ক্লিক করলেই পাওয়া যাবে একটি জম্পেশ উদ্ধৃতি:

    The parable within Kafka's masterpiece highlights perfectly the essence of his philosophy. Assigned unique roles in life, individuals must search deep within the apparent absurdity of existence to achieve spiritual self-realisation. The old man, therefore, is the symbol of this universal search inherent to mankind. 'The Trial' is not simply a novel about the potential disaster of over-bureaucratisation in society; it is an exploration of the personal and, particularly, spiritual, needs of human beings.

    (Novels for Students: The Trial)

    আদতে উদ্ধৃতিটা দুটি প্যারাগ্রাফের। শেষ প্যারাগ্রাফটি নেওয়া হল। প্রথমটা পরে কোথাও লাগিয়ে দেওয়া যাবে। ব্যস, হয়ে গেল আমাদের ভূমিকা। এটা কেন নেওয়া হল? সিম্পল। হাতের কাছে এইটাই পাওয়া গেল বলে। ভূমিকা লেখার হ্যাপাও বাঁচল, আর কোটার ১০০০ টার মধ্যে ৭০-৭৫ টা শব্দও লিখে ফেলা গেল। বিনা খাটনিতে বধও হয়ে গেলেন আঁতেলরা। না হয়ে উপায় নেই, কারণ এতে অনেক কঠিন-কঠিন জিনিস আছে। ইংরিজিতেও লেখা বটে। আর কী চাই?

    হ্যাঁ, এই নভেলস ফর স্টুডেন্টস বস্তুটা ঠিক কী জিগাবেন না। জানা নেই। মাক্কালী।

    ষষ্ঠ বিধান। বিষয়বস্তু। শরীরে নজর দিন।

    টীকা: ভূমিকা তো গেল। কিন্তু লেখার শরীরে কী থাকবে? এ নিয়ে ঘাবড়াবেন না। শুধু একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, যে, ভূমিকা জাস্ট একটি ফালতু জিনিস নয়। ভূমিকার সঙ্গে তার পরবর্তী অংশের একটি কানেকশন থাকতেই হবে। অতএব আলতো ঠেলা দিলে ভূমিকা থেকেই লেখার প্রসব হবে। অটোমেটিকালি। তা, ঠেলা দেওয়া কঠিন কিছু না। ঝট করে উইকিপিডিয়ায় উদ্ধৃতিটা দেখে নিন একবার। দেখতে পাবেন, যে ইংরিজি টেক্সটটি আমরা ব্যবহার করেছি, তাতে "প্যারাবল' শব্দটির উপর একটি হাইপারলিংক আছে। মানে ওখানে ক্লিক করলে বেশ কিছু ফান্ডা পাওয়া যাবে। এই হাইপারলিংকই হবে আমাদের মিসিং লিংক। কী বলছেন? প্যারাবল বস্তুটা কী জানেন না? ধুর মশাই ঈশ্বর বলেছেন তিনিও জানেন না। হাতের কাছে উইকি আছে যখন আমাদের জানার দরকারটা কী? উইকি যা বলছে, আর নিজের যা কনফিউশন আছে, পাঞ্চ করে একটু নিজের ভাষায় লিখে দিন:

    "প্যারাবল শব্দটি কাফকার রচনার মতই রহস্যময়। তার সঠিক অর্থ কারও জানা নেই। প্যারাবল মানে উপকথা নয়। ম্যাজিকও নয়। প্যারাবল একাধারে একটি সরল ও সংযত ন্যারেটিভ, অন্যদিকে এক প্রলম্বিত মেটাফর, যা, সত্য ও ধোঁয়াশাকে একই সঙ্গে ধারণ করে এই পৃথিবীর বুকে। পৃথিবীর সঠিক আকার কারও জানা নেই। শৈশবের ভূগোল পাঠ জানিয়েছিল, পৃথিবীর আকার পৃথিবীর মত। প্যারাবল শব্দটিও প্রায় একই রকম। একটিমাত্র পার্থক্যকে অবশ্য যদি বাদ দেওয়া হয়। নিজের মত নয়, প্যারাবলের আকার হুবহু কাফকার রচনার মত'।

    ব্যস। ভূমিকার সঙ্গে শরীরী সংযোগস্থাপন শেষ। এবার লেখা হুহু এগোবে। কীকরে এগোবে? মনে করে দেখুন, উইকিতে ভূমিকায় দুটি প্যারাগ্রাফ ছিল। তার একটি আমরা ব্যবহার করেছি। অন্যটি এখনও কুমারী। অস্পর্শিত। সেটাকেই ঝপ করে অনুবাদ করে দেওয়া যাক:

    "কাফকা নভেল লেখেননি। লিখেছেন প্যারাবল। ট্রায়াল নিজেই একটি প্যারাবল, মজা হচ্ছে, মুর্গির মধ্যে যেমন ডিম, আবার ডিমের ভিতরেও মুর্গি, ট্রায়ালের ভিতর ঢুকে আছে আরও একটি প্যারাবল, যার নাম বিফোর দা ল। আইনের সামনে। এই অংশটি কাফকার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হলেও,কাফকা যতদিন বেঁচে ছিলেন, জোসেফ কের মত ট্রায়ালও আর দিনের আলো দেখেনি। আইন আর মৃত্যু, কাফকা আর জোসেফ কে আসলে একই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। যে দরজা শুধু একদিকেই ঘোরে। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে প্রবেশ করতে হয় এক অন্ধকার পার্কে। আর ফিরে আসা যায়না। '

    সপ্তম বিধান। জীবন চরিতে নজর দিন।

    টীকা: লক্ষ্য করে দেখবেন, ট্রায়াল থেকে আমরা সোজা কাফকায় চলে এসেছি। লেখা ছেড়ে লেখকের মাথার উপর ভোঁ ভোঁ করছি। শুধু ল্যান্ড করার অপেক্ষা। রিভিউ লেখার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হল লেখককে নিয়ে চাট্টি ভাট দেওয়া। ওতে দুটো সুবিধে হয়। এক, বেশি ফান্ডা করতে হয়না। দুই, মুফতে কোটার ১০০০ শব্দের মধ্যে শ আড়াই শব্দকে ম্যানেজ করে ফেলা যায়। শুধু একটা জিনিস মাথায় রাখা জরুরী, যে, ব্যাপারটা কায়দা করে করতে হবে। লেখাকে লেখকের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া এখন ঠিক ফ্যাশান নয়। কাজেই একটা জাম্পকাট টাইপের ব্যাপার আনতে হবে। মানে, রিভিউএর মধ্যে লেখা আর লেখকের একটা যোগাযোগ থাকবে, কিন্তু সেটা আলগোছে। মনে হবে যেন বইয়ের নায়ক লেখকই। কিন্তু সেটা ঘুণাক্ষরেও লোককে বুঝতে দেওয়া যাবেনা। দিলেই প্যাঁক দেবে।

    তা, এখানে আমরা খুব কেয়ারফুলি সেই জিনিসটাই করতে চলেছি। কাফকার জীবনী কোথা থেকে পেলাম? কোথা থেকে আবার, সার্চের দুই নম্বর লিংক থেকে।

    "এই অন্ধকার, এই অস্বচ্ছতা, ডিমের প্রশান্তির ভিতর ছটফটে মুর্গির আভাস, কাফকার সর্বত্র। প্যারাবল তাঁর আয়ুধ, দ্ব্যর্থবোধকতা তাঁর প্রতিরক্ষা। তাঁর প্রায় প্রতিটি লেখাই অসমাপ্ত। আলো-ছায়া ও দ্ব্যর্থবোধকতার জন্য কাফকাকে অনুবাদ করা অসম্ভব। একমাত্র সমাপ্ত উপন্যাস (অনেকে বলেন বড় গল্প) মেটামরফোসিসের প্রথম লাইনেই যে জার্মান শব্দটি লেখেন, তার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ""অপরিচ্ছন্ন জীব, বলিদানের অযোগ্য''। প্রচলিত অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয় ""পোকা'' অর্থে। ইংরিজি ঘুরে বাংলা অনুবাদে সেটা যখন ""পতঙ্গ'' হয়ে যায়, যখন আমরা জানতে পারি, গ্রেগর একদিন সকালে উঠে দেখে সে একটি পতঙ্গে পরিণত হয়েছে, তখন এই আলো-ছায়াটি হারিয়ে যায়, যা আসলে কাফকার প্রাণ। একই জিনিস দেখি, এমনকি চিঠিপত্রেও। মৃত্যুর আগে প্রাণের বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে কাফকা তাঁর যাবতীয় লেখাপত্র, ডায়রি পুড়িয়ে নষ্ট করে দিতে লেখেন। ম্যাক্স ব্রড সেই অনুরোধ পালন করেননি, কারণ, তিনি কাফকার বাক্যের দ্ব্যর্থবোধকতায় বিশ্বাস করেছিলেন। কাফকার ধ্বংসের অনুরোধের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে লেখাগুলিকে রক্ষা করার বাসনা। অনুরোধের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে তা অমান্য করার অনুষঙ্গ।

    এই ডাবল-মিনিং, আলোর নিচে ধোঁয়ার আভাস, কাফকার জীবনেরই অংশ। তিনি জন্মেছিলেন একটি ব্যবসায়ী ইহুদী পরিবারে, কিন্তু জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছেন প্রাহা সার্কলের সাংস্কৃতিক বৃত্তে। ব্যক্তিগত জীবনে ডিপ্রেশন, পেটের গোলমাল থেকে শুরু করে যক্ষ্মার অসুখে ভুগে গেছেন সারাজীবন, যদিও বহিরঙ্গে ছিলেন ফিটফাট, রসিক। লিখতে অসুবিধে হয় বলে চাকরি ছেড়েছিলেন, কিন্তু চাকরিজীবনে রীতিমত দক্ষ কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। লেখাকে এতই গুরুত্ব দিতেন, যে, তার জন্য চাকরি ছাড়তে পারেন, ওদিকে সে লেখালিখি ছিল আবার একান্ত গোপন, সমস্ত লেখা পুড়িয়ে দিতে নির্দেশ দিয়ে যান ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং প্রেমিকাকে। বলাবাহুল্য, কেউই সেই অনুরোধ রক্ষা করেননি। বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের উদ্যোগেই কাফকার অধিকাংশ রচনা দিনের আলো দেখে। বান্ধবী ডোরার কাছে ছিল কাফকার কুড়িটি নোটবই আর পঁয়ত্রিশটি চিঠি। ১৯৩৩ সালে সেসব গেস্টাপোর হাতে পড়ে, এবং হারিয়ে যায়। মুণ্ডহীন মানুষদের সেসব গোপন বৃত্তান্ত আজও অন্ধকারেই। '

    অষ্টম বিধান। জমিয়ে উদ্ধৃতি দিন।

    টীকা: খেয়াল করেছেন কিনা জানিনা, দেখতে দেখতে আমরা ৫০০ শব্দ পার করে দিয়েছি। একদিনের পক্ষে যথেষ্ট খাটাখাটনি হয়েছে। এবার একটু সোজা কাজ করব। এদিক সেদিক থেকে কিছু উদ্ধৃতি গুঁজে দেব। সেটা শুধু খাটনি বাঁচানোর জন্য দরকার তাই নয়, প্রবন্ধের আবশ্যিক অংশ। প্রাবন্ধিকদের সম্পর্কে একটা ধারণা আছে, যে, তাঁদের মাথার পিছনে দিব্যজ্যোতি আছে, নামের পিছনে ডিগ্রি। তাঁরা ইংরিজিতে মহাপণ্ডিত, সেকারণে হাত নয়, কাঁধ থেকে বেরিয়ে এসেছে খান দুই ডানা। তাঁরা দুই পকেটে বইয়ের বান্ডিল নিয়ে ঘুরে বেড়ান, আর যত্রতত্র ইংরিজি-ফরাসী-জাপানি ভাষায় কারণে-অকারণ রেফারেন্স ঝেড়ে দেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। বলাবাহুল্য এসবের মধ্যে সত্য বিশেষ নেই, কিন্তু পাবলিক পারসেপশনের উপর তো আর আমার-আপনার হাত নেই। অতএব পাবলিকের কাছে আপনাকেও প্রাবন্ধিক হবার প্রমাণ দিতে হবে। আজ তোমার পরীক্ষা, ভগবান।

    তা, পরীক্ষা কঠিন কিছু নয়। ওপেন বুক টেস্ট মাত্র। হাতের কাছেই ইন্টারনেটে খোলা আছে আমাদের উইকির পাতাখানি। তার উপরের দিকেই গুচ্ছের উদ্ধৃতি আছে। তার থেকে গোটা কতক ঝেড়ে দিন।

    ""কাফকার জীবন আর লেখা তাই আলাদা কিছু নয়। "স্যাডনেস ইন প্যালেস্টাইন?!' প্রবন্ধে ড্যান মিরন জানাচ্ছেন " It seems that those who claim that there was such a connection and that Zionism played a central role in his life and literary work, and those who deny the connection altogether or dismiss its importance, are both wrong. The truth lies in some very elusive place between these two simplistic poles'.

    কাফকার প্রথম যুগের অনুবাদক পাভেল এইসনার, ট্রায়াল সম্পর্কে জানাচ্ছেন, যে এই রচনাটি আদতে "triple dimension of Jewish existence in Prague is embodied in Kafka's The Trial: his protagonist Josef K. is (symbolically) arrested by a German (Rabensteiner), a Czech (Kullich), and a Jew (Kaminer). He stands for the guiltless guilt that imbues the Jew in the modern world, although there is no evidence that he himself is a Jew.'''

    এখানে দুটো উদ্ধৃতি দেওয়া হল। আকারে দেড়শো শব্দের মতো। আরো দুটো দিলেই আড়াইশো হয়ে যেত। কিন্তু অকারণে সাইজ বাড়িয়ে লাভ নেই। এখানে জাস্ট একটা টিউটোরিয়াল হচ্ছে, অতএব, ইশারাই কাফি হ্যায়।

    নবম বিধান। ভাষা ব্যবহারে যত্নবান হোন।

    টীকা: তো, এই ভাবে নয় নয় করে আমরা পেরিয়ে এলাম ৭৫০ টি শব্দ। এবার আমাদের অবতরণের সময়। অর্থাৎ উপসংহার। আমাদের শিক্ষাও প্রায় সমাপ্ত। শুধু একটা বিষয়ে ফাইন টিউনিং দরকার। সেটা হল ভাষা। ভাষার ব্যাপারটা গোটা লেখার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, কিন্তু বিশেষ করে উপসংহার লেখার আগে গোটা দুই পয়েন্ট মনে রাখতে হবে। এক, এটা এখন মোটামুটি সব্বাই জানেন, যে, লেখায় "উন্নততর', "অগ্রগতি', "প্রগতিশীল', এই জাতীয় লিনিয়ার শব্দবন্ধ ব্যবহার করবেন না। কেন করবেন না তার পিছনে অনেক দার্শনিক যুক্তি আছে, সেসবে এখানে ঢোকার দরকার নেই। শুধু এটুকু মনে রাখলেই হবে, যে, ওতে লেখা ফ্ল্যাট লাগে। আর দুই, শুধু এটুকুই নয়, এতক্ষণ ধরে প্রবন্ধ নামক যে বস্তুটি আমরা প্রসব করলাম, যদি ভালো করে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন, ভাষায় একটা ধোঁয়া-ধোঁয়া, ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি ধরণের ব্যাপার রাখা আছে। বলাবাহুল্য, সেটি ইচ্ছাকৃত। এই ধরণের প্রবন্ধে ভাষার এইরূপ ব্যবহার আবশ্যক। নইলে, পড়ে সবকিছুই জলের মতো বোঝা গেলে, যুক্তিপরম্পরা সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মতো সোজা হলে, লোকে দুয়ো দেবে। কলম্বাস আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পরে নিন্দুকে বলেছিল ওতে আর কী আছে, জাহাজ থাকলে ওরকম নাক বরাবর যেতে আমরাও পারতাম। কলম্বাস তবু কিছু একটা করে দেখিয়েছিলেন, আমরা তো বসে জাস্ট প্রবন্ধ লিখছি, অতএব আমাদের ক্ষেত্রে লোককে এসব বলতে দেবার চান্স নেওয়া যাবেনা। বললাম কিন্তু বললাম না, ছটা বাক্য লিখলাম, তার বাক্যছটায় চোখ ধাঁধিয়ে গেল, কিন্তু পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো খুলে দেখলে ভিতরে পড়ে রইল শুধু এক মহাশূন্য, এরকম একটা ব্যাপার রাখতেই হবে। নইলে লোকে প্রাবন্ধিক হিসেবে মানবেনা। সম্পাদকরা মুখের উপর পাণ্ডুলিপি ছুঁড়ে মারবেন। আপনার আর আলোচনা লেখা হবেনা।

    ভাষার ব্যাপারটা উপসংহারের সময়েই বলা হল, তার কারণ, উপসংহারে ভাষার বিরাট গুরুত্ব আছে। এতক্ষণ উদ্ধৃতি-টুদ্ধিতি দিয়ে ফাটিয়ে দিয়েছি, এবার একটু ধূম্রজাল সৃষ্টি করে শেষ করতে হবে। "নিজের ভাষায়'। নিজের ভাষা শুনে আবার ঘাবড়াবেন না। ভাষা নিজের হলেও শব্দ তো কারো বাপের না। তাই এদিক-সেদিক থেকে কিছু কঠিন লাইন আর শব্দ জোগাড় করুন। কবিতার লাইন চলবে। লিটল ম্যাগাজিনের যেকোন অনুরূপ প্রবন্ধ থেকে কিছু শব্দ টুকে দিলেও চলবে। ইন্টারনেট থেকেও নিতে পারেন। আরেকটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, যে, শুধু বাংলা শব্দ না, সঙ্গে কিছু কঠিন ইংরিজি শব্দও রাখবেন। বাংলা হরফে। তাতে ব্যাপারটা কেতাদুরস্ত লাগে।

    ভয় পাচ্ছেন? নানা কঠিন কিছুই না। একবার করলেই বুঝতে পারবেন। আর এক-দুবার লিখে ফেললে দেখতে পারবেন, একই উপসংহারকে একটু নেড়ে-চেড়ে সব লেখাতেই বসিয়ে দিতে পারছেন। আর গোটাকতক উপসংহারের একটা সেট বানিয়ে নিতে পারলে তো কথাই নেই। এখান থেকে চারটে ওখান থেকে দুটো শব্দ নিয়ে অনায়াসেই ম্যানেজ করতে পারবেন। একবার লিখে ফেললেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে:

    "" তাই ট্রায়াল শুধু একটি নভেল নয়, এক অসম্পূর্ণ নভেল, কাফকার নভেল। শুধু প্যারাবল নয়, রামধনুর দেশ। স্ট্র্যাপহীন খোলা পিঠের বাঁক। ছোটো নদী। ভাষার তলোয়ার। রমণের ইন্দ্রজাল। কেটেকুটে ফেলা নরম শরীর। কবরের উপর ছড়িয়ে থাকা কুয়াশার নরম আস্তরণ। রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার, গ্রিক মিথলজি। কী নেই এই অসমাপ্ত উপন্যাসে? একই সাথে জুয়িশ উত্তরাধিকার, পেটের অসুখ, প্যারাবল, ন্যারেটিভ, মনোলগ ও বিহঙ্গ বাসনা। ড্রামা ও ড্রামাহীনতা, প্যারডি ও মন্তাজ, লজিক ও প্রত্যাখ্যান। ফিউশন আর প্রহসনের প্রকৌশল। ইনভার্টেড লজিক, আইকনোক্ল্যাজম, ফর্মলেসনেস, জলের আকার। উৎকেন্দ্রিকতা, বিপ্রতীপতা, গদ্যের গতিজাড্য, কাব্যের ক্যাকোফনি। ন্যারেটিভের প্রত্যাখ্যান, সরলরেখার সাবভার্সান, যতির রিভার্সাল, অ্যান্টি-ফাউন্ডেশনালিজম, নাজি-জন্মবৃত্তান্ত, কামকাতরতার খিস্তি, রক্ত, বেদনা, হারানো হিয়ার টুকরো, পুরোনো লাইটহাউস। রক্ত, বেদনা, স্বপ্ন ও শরীর।

    এই রক্তমাংসের শরীরকে প্রতিদিন, স্বপ্ন ও অপরাধবোধে, দাঁড়াতে হয় কাঠগোড়ায়। হাড়হিম দু:স্বপ্নে দেখা যায় এক অন্ধকার পার্ক। লাইন দেওয়া মানুষ হাতল ঘুরিয়ে একা-একা ঢুকে যায় কুয়াশায়। ফিরে আসেনা। এই পার্কের দরজাটির নামই ট্রায়াল, যা শুধু একদিকেই খোলে।''

    ফিনিশ।

    দশম বিধান। নিজের উপর বিশ্বাস রাখুন।

    টীকা: আমাদের প্রবন্ধ/সমালোচনা কমপ্লিট। ভূষিমাল যাই হোক, পড়ে ভাল লাগল কিনা একবার বলুন। সেটাই আসল কথা। তবুও যাঁরা কিন্তু কিন্তু করছেন, বই না পড়ে কী করে রিভিউ লিখব, বলে আলগোছে লজ্জানত হচ্ছেন, দেখেও না শেখা সেইসব অপোগণ্ড জনতার জন্য একটিই বাণী, যে এই রাস্তায় আপনিই প্রথম নন। বাকি লোকে প্রচুর ক্লাস-টাস করে, প্রফেসারের নোট জাতীয় সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস দেখে টোকে, আর আপনি টুকলেন একদম অথেন্টিক সোর্স থেকে।

    কাজেই লজ্জা-টজ্জা পাবার কিছু নেই। শিক্ষা মানে মূলত টোকার শিক্ষা। প্রণম্য গুরুদেবের ভাষায় বলতে গেলে, বঙ্গভাষার বাকি প্রাবন্ধিকদের মতোই আপনারও শিক্ষা সম্পূর্ণ হইয়াছে। আপনি এখন গ্র্যাজুয়েট। সে জন্য গর্ববোধ করুন। পার্টি-ফার্টিও দিতে পারেন। আর, বিলম্ব না করে, লেগে পড়ুন কাজে। আপনার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আমাদের শুভকামনা রইল। আমেন।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ২৩ মে ২০১১ | ৮৬১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অযান্ত্রিক | 127.194.211.114 (*) | ০৩ ডিসেম্বর ২০১২ ০৪:৪৯89021
  • দুর্ধর্ষ গাইডলাইন! হতাশায় নিমজ্জিত উঠতি সাহিত্যসমালোচকদের জন্য আলোর দিশা।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন