এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • বাতাসের সাথে আমি

    মুরাদুল ইসলাম লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০৬ জুন ২০১৯ | ১২৫৪ বার পঠিত
  • এই এলাকায় নতুন বাসা ভাড়া নিয়ে উঠার পর থেকেই আব্বাস মিয়ার চায়ের দোকান আমার প্রিয় জায়গা। দিনে দুইবার এখানে এসে চা খাই। সকালে একবার, আর সন্ধ্যায় একবার।

    প্রতিদিন সন্ধ্যায় পাটের আঁশের মত চুলযুক্ত আধবুড়ো লোকটাকে আব্বাস মিয়ার দোকানে বসে থাকতে দেখতাম। সবার সাথে গল্প গুজব করছে, পান খাচ্ছে, চা খাচ্ছে, এবং মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। কখনো কখনো কোন একজন লোককে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে আস্তে আস্তে কী যেন কথা বলছে, এবং সেই লোককে নিয়ে চলে যাচ্ছে কোথাও।

    এই লোকটার আচার আচরণ দেখে আমার আগ্রহ জন্মাল। একদিন সামনের রাস্তা দিয়ে বিকট সবদ্যা মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল একটা ছেলে। তা দেখে লোকটি চিৎকার করে উঠল, মর! মর! মরেনা ক্যান এইগুলা! দেখবেন মরব একদিন, তেজ বাইর হইব তখন!

    লোকটার বলার ভঙ্গিতে ছিল তীব্র বিরক্তি। আমার মজা লাগল। সেদিন কথা বলার চেষ্টা করলাম তার সাথে।

    কেমন আছেন?

    এই তো, বালাই, আপনে?

    ভাল। আমি এই এলাকায় নতুন এসেছি।

    হ জানি তো। ৩১৩ নাম্বার বাসা, তিন নাম্বার, রোড বারো।

    আপনি জানলেন কীভাবে?

    এই এলাকার সব কিছু তালেবালি জানে।

    আপনার নাম কি তালেব আলি?

    হ।

    এই পর্যন্ত কথা বলে লোকটা একটু থামল। সে হয়ত সেদিন ব্যস্ত ছিল। আমাকে বলল, কুনু দরকারে আমারে বইলেন। আইজ কাজ আছে। আর কথা কমু না। যেকুনু দরকারে বইলেন কিন্তু।

    কথাটা বলে লোকটা এক অদ্ভুত হাসি হাসল। আমি তখন বুঝতে পারি নি 'যেকুনু দরকার' বলতে সে কী বুঝাচ্ছে।

    এরপরের দিন আবার তার সাথে দেখা। এই দিন সে নিজে এসে কথা বলল।

    ভাই, যাইবেন নাকি এক জায়গায়?

    কোথায়?

    ঐ পার্কের পিছে। ভালো মাল আছে।

    ভালো মাল মানে?

    লোকটা আমাকে ইশারা করল উঠে যেতে তার সাথে। আব্বাস মিয়ার চায়ের দোকান থেকে একটু দূরে। ইলেকট্রিক খাম্বার নিচে, যেখানে জড়াজড়ি করে রয়েছে অনেক অনেক তার।

    আমি গেলাম।

    তালেবালি বলল, একা মানুষ থাকেন। মাইয়া মানুষ লাগব নাকি? পুরা সেইফ… কাম করার পর টেকা দিবেন। যেমন মাল চাইবেন এমন আছে। ভাইয়ের কেমন মাল পছন্দ?

    আমার ইচ্ছা হলো একে বাজিয়ে দেখার। তবে মনের একটা অংশ প্রচণ্ডভাবে বাঁধা দিচ্ছিল। বলছিল আমাকে যে বিপদ হতে পারে। কারণ এমন কথা অপরিচিত একজন কেউ এসে বলল অবশ্যই এতে বিপদের আশংকা থাকে। কিন্তু মনের আরেক অংশ চাচ্ছিল অন্য কিছু।

    আমি বললাম, টাইট।

    তালেবালি সুপারি চিবুতে চিবুতে বলল, ভাই টাইট মাল আছে। টেনিস বল টেনিস বল। খেইলা মজা পাইবেন।

    তার বলার ভঙ্গিতে অদ্ভুত এক এরোটিক আহবান ছিল। আমি যেন বশ হয়ে গেলাম।

    বললাম, কত?

    তালেবালি বলল, এগারোশ মাত্র। করার পর মজা পাইলে টেকা দিবেন, নাইলে দিবেন না। এই তালেবালি এমনে টেকা নেয় না। অন্যদের জিগাইয়া দেখেন। আমার সাথে কাম কইরা কেউ বিপদে পড়ে নাই।

    আমি তালেবালির ভঙ্গিতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম , কই যাইতে হবে?

    তালেবালি হাত ধইরা আমারে বলল, আহেন আহেন, আহেন আমার লগে।

    সে পার্কের সামন দিয়ে দুইটা ল্যাম্পপপোস্ট পেরিয়ে ঠিক পার্কের পেছনে থাকা একটি বাড়িতে নিয়ে গেল। ভগ্নপ্রায় কুঁড়েঘরের মত।

    ঘরের অবস্থা দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখানে?

    তালেবালি হেসে বলল, আহেন ভিতরে, দেখেন কী জিনিস।

    ভিতরে আসলেই জিনিস। সব পরিষ্কার। বিছানা অত্যাধুনিক। পুরো তোশক বা ফোমের উপরে সুন্দর কারুকাজ করা বিছানার চাদর। কারুকাজে নানা ধরণের লতাপাতা আঁকা, একটার সাথে আরেকটা লাগানো কোন না কোন ভাবে।

    বিছানার উপরে আমি মেয়েটাকে দেখলাম। বিশ বাইশ হবে বয়স। শ্যামলা গাত্র বর্ণ। টাইট ফিগার। তালেবালি যেমন বলেছিল ঠিক তেমনি, তার স্তনদুটি টেনিস বলের মত। খাড়া হয়ে আছে।

    তালেবালি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, লাগাবেন নাকি ভাই?

    আমি আর না করতে পারলাম না। সম্মোহিতের মত এগিয়ে গেলাম। শুনলাম পিছনে দরজা বন্ধ হয়েছে। আমার মনোযোগের প্রায় সবটুকুই তখন সামনে, কেবলই সামনে।

    শুনলাম যাবার আগে লোকটা বলে যাচ্ছে, শেষ হইলে পার্কের তেরো নাম্বার বেঞ্চে চইলা আইসেন। জিনিস ভাল লাগলে পয়সা দিবেন। না লাগলে নিমু না।

    আরো কী কী জানি বলল, আমার সেদিকে খেয়াল ছিল না।

    মেয়েটির সাথে আমি সেক্স করলাম সেই লতাপাতা আঁকা বিছানায়।

    সেক্সের পরে যেন ফিরে এলাম সচেতন পৃথিবীতে। দ্রুত বের হয়ে এলাম ঘর থেকে। আসার আগে মেয়েটির উপর চোখ পড়েছিল। দেখলাম সে হাসছে। অদ্ভুত সে হাসি।

    আমি দরজা দিয়ে বের হয়ে একটু যাবার পড় মনে হলো আমার মোবাইল ফোন রেখে এসেছি। আবার দৌড়ে যাই ঘরে। লতাপাতা আঁকা বিছানার চাদরের উপরেই আমার মোবাইল ফোন পেলাম। কিন্তু মেয়েটিকে দেখলাম না। ঘরে দরজা একটাই, জানালাও নেই। দরজা দিয়ে আমিই একটু আগে বের হলাম, কয়েক পা গেলাম। সুতরাং এদিকে কেউ গেলে আমি দেখতে পেতাম। মেয়েটা গেল কোনদিকে? আর গেলোই বা কোথায়, এবং কেন? দ্রুত এইসব প্রশ্ন মাথায় আসছিল এবং আমাকে দিয়ে যাচ্ছিল বিপদের সংকেত।

    হঠাৎ একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। আমার মোবাইল থেকে ভেসে আসতে লাগল ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি কিছু কথাবার্তা। কণ্ঠস্বর শুনে আমি বুঝলাম এটি স্লোভানিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেকের কণ্ঠ। তিনি বলছেন, পিওর সেক্স ইজ মাস্টারবেশন উইথ রিয়াল পার্টনার…

    আমি দ্রুত মোবাইল হাতে নিলাম। কীভাবে যেন ইউটিউব ওপেন হয়ে ভিডিওটি চালু হয়েছে। ইউটিউব বন্ধ করে মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে আমি দরজার দিকে পা দিলাম।

    কোন রহস্যের সমাধান করতে সাহস হলো না। নিজেকে নিরাপদ রাখাই তখন প্রধান কাজ। দৌড়ে বের হলাম ঘর থেকে।

    একবার মনে হলো বাসায় চলে যাই। কিন্তু পরক্ষণে ভাবলাম এমন ভুল কখনো করা যাবে না। তালেবালির মতো লোকেরা দেখতে যতই সহজ মনে হোক না কেন, আসলে ঘাগু মাল। এই লাইনে যারা কাজ করে তাদের ঘাগু হতেই হয়। এরা করতে পারে না এমন খারাপ কাজ কমই আছে। বিশেষত টাকা না দিলে সে যে সুদে আসলে সব আদায় করে নিবে এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না।

    তাই আমি ঝামেলা থেকে বাঁচতে পার্কে চলে গেলাম। পার্কের ভেতরে তেরো নাম্বার বেঞ্চিটা খুঁজে পেলাম। কিন্তু সেখানে কেউ বসা নেই, খালি।

    আমি বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম ও তালেবালি নামক লোকটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

    আমার মাথা ঝিম ঝিম করছিল। শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ছে যেন। এমনিতেই সেক্স করার পর আমার ঘুম পায়, চোখ জ্বলে।

    আর আজ নানা দুশ্চিন্তা ভর করছে। এটা কি কোন সাজানো ফাঁদ? আমার কোন শত্রু কি এই কাজ করছে? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন আসতে লাগল মাথায়।

    দেখলাম বেঞ্চির দিকে চায়ের ফ্লাক্স হাতে এগিয়ে আসছে একজন মহিলা।

    আমাকে বলল, স্যার চা খাইবেন?

    এইসময়ে চা হলে ঘুম ঘুম ভাবটা দূর হবে। সাথে একটা সিগারেট হলেও ভালো হয়।

    আমি বললাম, হ্যা, এক কাপ চা দেও।

    মহিলা বলল, দুদ চা না রঙ চা?

    বলে সে একটা কেমন যেন অশ্লীল হাসি দিল।

    আর আমার চোখ গেল তার স্তনের দিকে। যে মেয়েটির সাথে সেক্স করে এসেছি তার স্তন ছিল টেনিস বলের মত। কিন্তু এই মহিলার স্তন মাঝারি আকৃতির। এমনভাবে কাপড় পরে আছে, ও ঝুঁকে এসেছে যে স্পষ্ট আমি অনুভব করতে পারছিলাম স্তনের আকার।

    আমি অনুভব করলাম যৌন উত্তেজনা আবার।

    এই অনুভবে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। এই একটু আগেই আমি সেক্স করে এসেছি। এখন আবার কেন, তাও এভাবে? নিজেকে খুবই খারাপ চরিত্রের ইডিয়ট মনে হলো আমার।

    চা খেলাম না আর। একটা সিগারেট ধরালাম। মনকে অন্যদিকে সরাতে ভাবতে লাগলাম তালেবালি লোকটার কথা। সে এই বেঞ্চিতে নাই কেন? বা আসছে না কেন? সে কি আমাকে কোন বিপদে ফেলবে? কোন ধরণের ব্ল্যাকমেইল?

    নানা ভয় কাজ করছিল।

    দেখলাম একজন পুলিশের লোক এদিকে আসছে। তাকে আসতে দেখে আমি মারাত্মক ভয় পেলাম, গলা শুকিয়ে গেল। আমার মনে হচ্ছিল সে যেন আমার দিকেই আসছে, এবং এর পেছনে তালেবালির কোন হাত আছে।

    পুলিশের লোক আমার দিকেই এলো। আমার দিকে সন্দেহপূর্ন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, এনি প্রবলেম?

    আমি স্বাভাবিক থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে বললাম, না, না। কোন প্রবলেম নয়।

    লোকটা চলে গেল।

    আমি আর বেঞ্চিতে থাকার সাহস পেলাম না। সোজা উঠে চলে আসলাম সেই চায়ের দোকানে, যেখানে তালেবালির সাথে আমার আলাপ হয়েছিল। লোকটাকে এখানেও দেখলাম না।

    এরপরদিন সন্ধ্যাতেও লোকটাকে দেখলাম না। এরপরদিনও না।

    কিন্তু আমার ভেতর খচখচানি শুধু বাড়ছিল।

    তৃতীয় দিনে চায়ের দোকানদার আব্বাস মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ভাই, আপনার দোকানে যে একটা লোক আসত প্রতিদিন, পান খেত, গল্প করত, সে কি আজ এসেছিল?

    দোকানদার আব্বাস মিয়া বলল, কুন লোক? সবেই তো পান খায়, গফ করে।

    আমি বললাম, তালেব আলি নামের লোক। চুল সাদা। আপনার সাথেই তো তিনদিন আগে হেসে হেসে গল্প করছিল অনেক।

    আব্বাস মিয়া বলল, এমন কাউরে তো দেখি নাই।

    আব্বাস মিয়ার কথায় আমি অবাক হয়ে গেলাম। বলে কী এই লোক! এমন কখনো হয়? তালেবালি লোকটার চুল এতোই সাদা যে, তাকে এমনিতেই সবার চাইতে আলাদা করা যায়। সে দুয়েকদিন আসলেও মনে থাকার কথা। আর আমি তাকে প্রায় প্রতিদিন আসতে দেখেছি। সবার সাথে গল্প করতে দেখেছি।

    ভাবলাম আব্বাস মিয়া হয়ত কোন কারণে বলতে চাচ্ছে না। তাই চায়ের দোকানে যারা নিয়মিত আসে আমি তাদের সবাইকে তালেবালি লোকটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু সবারই একই কথা। তারা নাকি এই লোককে চেনে না। এই নামের কোন লোক তাদের জানাশোনার মধ্যে নেই। সাদা লম্বা চুলের কোন লোক এই দোকানে নাকি কখনো আসেই নি।

    এমন কয়েকজন লোককেও আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যাদের তালেবালি ঐ ইলেকট্রিক খাম্বার নিচে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে কথা বলেছিল। তারপর তাদের নিয়ে কোথাও চলে গিয়েছিল, যেমন গিয়েছিল আমাকে নিয়ে। কিন্তু ঐসব লোকও আমাকে জানাল এইরকম কোন লোককে তারা চেনে না।

    আব্বাস মিয়ার দোকানে চা খাচ্ছিলাম। গরুর দুধ অনবরত জ্বাল হচ্ছে এক পাত্রে। ঘন হয়ে বাদামী বর্ণ ধারণ করেছে। গরুর দুধ বেশি জ্বাল হলে বাদামী রঙ ধারণ করে কি না আমি জানি না। সম্ভবত এই দুধে অন্য কিছুও মিশিয়েছে আব্বাস মিয়া। এক কাপ চায়ে বেশ অর্ধেক এই বাদামী বস্তু ঢেলে অল্প চায়ের লিকার দেয়া হয়, এরপর এক চামচ চিনি দিয়ে নেড়েচেড়ে চা তৈরি করে আব্বাস মিয়া।

    সবার অদ্ভুত আচরণের কারণেই কি না জানি না, আমি চায়ে কোন স্বাদ পাচ্ছিলাম না। তিনবার আব্বাস মিয়াকে বললাম, চায়ে চিনি দেন।

    সে তিনবারে ছয় চামচ চিনি দিল আমার কাপে। তাও আমি কোন স্বাদ পাচ্ছিলাম না। তিনবার চিনি দিতে বলার পরে আর বলতে সাহস হলো না।

    চায়ের কাপ রেখে হাঁটা ধরলাম রাস্তা দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম আমার সাথে এসব কী ঘটছে, এবং কেন ঘটছে। কে কারা আছে এর পেছনে? তারা কী চায়?

    আমার কি মাথায় অল্প সমস্যা দেখা দিচ্ছে রাতে ঘুম না হবার কারণে? আমার কি ডাক্তার দেখানো উচিত? ডাক্তারের কথা মনে আসতেই আমার সামনে পড়ল একটা সাইনবোর্ড, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শ্রীময়ী ব্রততী রায়।

    আমি এগিয়ে গেলাম। গেইট দিয়ে ঢুকে একটা দরজা পার হলাম। চেম্বারে বড় একটা টেবিলের অন্য পাশে বসে সাইকিয়াট্রিস্ট। তাকে দেখে মনে হলো তিনি মধ্যবয়স্ক।

    ঘরের মেঝেতে লাল কার্পেট বেছানো। সেই কার্পেটে নীল রঙের অনেক লতাপাতার ছবি, একটার সাথে আরেকটা যুক্ত।

    ভদমহিলা কিছু একটা পড়ছিলেন। আমি দরজায় হালকা আঘাত করে বললাম, আসতে পারি ম্যাডাম?

    মহিলা তার বড় চশমার ওপর দিয়ে তার গোল গোল দুই চোখ দিয়ে আমার কিছু সময় নিরীক্ষণ করলেন। বললেন, আসুন।

    আমি গিয়ে তার সামনে বসলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কী সমস্যা সবিস্তারে বলুন। কোন কিছু লুকাবেন না। রোগীরা এসে কথা লুকাতে চান। এটা আমার ভালো লাগে না।

    আমি বললাম, এই সমস্যা আমার কয়েকদিন ধরে হচ্ছে ম্যাডাম। কিছু জিনিস আমার সাথে ঘটেছে বলে আমার মনে হয়। কিন্তু পরে অন্যদের জিজ্ঞেস করলে এর সত্যতা আমি পাচ্ছি না। ব্যাপারটা খুবই অস্বস্থিকর। আমি মারাত্মক হতাশার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি।

    সাইকিয়াট্রিস্ট পুরো ঘটনা জানতে চাইলেন। আমি তাকে বললাম কী কী হয়েছে আমার সাথে। তালেবালির কথা, ঐ মেয়ের কথা, সেক্সের কথা, পার্কের কথা এবং সবার অস্বীকারের কথা।

    ভদ্রমহিলা খুব মনোযোগের সাথে আমার কথা শুনলেন। এরপর বললেন, আপনার যে সমস্যাটি হয়েছে তা আমি বুঝতে পারছি। খুব কমন একটি সমস্যা। এই মাসেই আপনার বয়েসেরই ঠিক আটজন রোগী এসেছেন আমার কাছে একই সমস্যা নিয়ে। দেশ ও সমাজের অবস্থা এই সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে কি না এ নিয়ে রিসার্চ হওয়া দরকার। তবে আপনি ঘাবড়ে যাবেন না। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আপনার আগে যারা এসেছিলেন তারা সবাই সুস্থ হয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। আপনিও যাবেন।

    আমি কিছুটা আশার আলো দেখলাম। যাক ভদ্রমহিলা আমার সমস্যাটা ধরতে পেরেছেন।

    আমি বললাম, থ্যাংক ইউ ম্যাডাম।

    ভদ্রমহিলা বললেন, আপনাকে কয়েকটা ব্যাপার বুঝতে হবে। সামান্য থিওরী। সহজ করেই বলছি আমি। আমাদের মাইন্ডের আনকনশাস বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে আমাদের সকল ডার্ক জিনিসপত্র বাস করে এমন মনে করতেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। কিন্তু গুস্তাব জাং মনে করতেন কেবল ডার্ক বিষয়াদিই না, সৃষ্টিশীলতাও এই অংশে অবস্থান করে। বুঝতে পেরেছেন?

    আমি মাথা নেড়ে বললাম, জি।

    কিন্তু আসলে তেমন কিছুই বুঝতে পারি নি।

    ভদ্রমহিলা বললেন, আপনার আনকনশাসে কিছু চিন্তা আছে। কিছু ফ্যান্টাসী। আপনি রিপ্রেস করে রেখেছেন। সেই রিপ্রেস করে রাখা ফ্যান্টাসিগুলি, আপনার ক্ষেত্রে তীব্র যৌন ফ্যান্টাসিগুলি কোন কারণে আপনার কনশাস মাইন্ডে চলে আসছে। এটা হতে পারে আপনি বাস্তব জীবনে আপনার স্বাভাবিক যৌন ইচ্ছাগুলিকে খুব বেশি দমিয়ে রাখেন এজন্য হচ্ছে। এজন্য আপনার এক ধরণের ধারণা হচ্ছে যে, আপনি ঐসব সেক্স করেছেন, তালেবালি নামক লোকটার সাথে দেখা, ওই মেয়ের সাথে সেক্স, সবই আপনার কল্পনা।

    কিন্তু ম্যাডাম আমি নিশ্চিত যে এগুলি সত্যি! এত স্পষ্ট কল্পনা হয় কী করে?

    হয়। আনকনশাস মাইন্ডের ক্ষমতা সম্পর্কে আপনি জানেন না তাই ভাবছেন হয় না। আনকনশাস মাইন্ড খুবই শক্তিশালী। আপনাকে এটি এমন অনেক চিত্রই দেখাতে পারে যা বাস্তবে নেই।

    আমি হতাশ অনুভব করলাম এই কথা শুনে। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে এর সমাধান কি ম্যাডাম?

    ভদ্রমহিলা অল্প একটি ভাবলেন। তারপর রহস্যময় এক হাসি দিয়ে বললেন, সমস্যা যেহেতু আছে, এর সমাধানও আছে। ফ্যান্টাসিকে এক্সপ্লোর করতে হবে। সেক্স থেরাপি।

    মানে?

    মানে হলো, আপনার রিপ্রেস করে রাখা যৌন ইচ্ছাগুলিকে বাস্তবে প্রকাশ ঘটাতে হবে। তাহলেই আনকনশাস মাইন্ডের চিন্তাগুলি শান্ত থাকবে।

    কিন্তু এই থেরাপি কীভাবে?

    ভদ্রমহিলা আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, এখানেই পারবেন। আমি এই থেরাপি দিয়ে থাকি। অন্য যে ক’জন এসেছিলেন তারা এই থেরাপি নিয়েই ভালো হয়েছেন। আমার সাথে সেক্স করতে আপনার আপত্তি নেই তো?

    ভদ্রমহিলা তার গাইয়ে পরা কোট খুললেন। আমি দেখলাম ছোট মতন একটা পোশাক তিনি পরে আছেন। এর আবরণ ভেদ করে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম তার সুবিশাল স্তন।

    আমি যৌনভাবে উত্তেজিত বোধ করলাম। ভদ্রমহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি আমাকে আহবান করছেন।

    আমি আগ্রহী বুঝতে পেরে তিনি উঠে আসলেন চেয়ার থেকে। আমাকে হাত ধরে চেয়ার থেকে তুলে মেঝের লাল কার্পেটে বসালেন। এবং আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি তার স্তন চেপে ধরেছিলেন আমার মুখের উপর। আমার মনে হচ্ছিল এভাবে কিছুক্ষণ রাখলে আমি মারা যাব দম বন্ধ হয়ে।

    মেঝেতে, সেই লতাপাতা আঁকা কার্পেটের উপর আমরা সেক্স করলাম। সেক্সের পর আমি শান্ত বোধ করতে লাগলাম। তখন আমার মনে হচ্ছিল, তালেবালি লোকটা এবং ঐ মেয়েটা আসলে বাস্তব ছিল না, আমার কল্পনাই ছিল।

    ভদ্রমহিলা শুয়ে ছিলেন কার্পেটে। তার স্তন নিঃশ্বাসের সাথে উঠছে আর নামছে। অল্প অল্প। আমার মনে হলো, এই ঘটনা কি সত্যি না আমার কল্পনা? আমি পরখ করে দেখতে ভদ্রমহিলার এক স্তনে হাত দিলাম এবং শক্তভাবেই চাপ দিলাম। স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলাম মাংস এবং উষ্ণতা। আমার হাতের চাপ পেয়ে ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন এবং বললেন, সত্যি কি না পরীক্ষা করলেন তো? অন্যরাও এমন করেছেন।

    বিব্রত হলাম কিছুটা। আশ্বস্তও হলাম এই ভেবে যে বাস্তবেই সব হচ্ছে।

    সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রমহিলার ওখান থেকে বের হয়ে আমি হাঁটতে লাগলাম। রাস্তায় তখন হালকা বাতাস বইছে। ফুরফুরে ও হালকা লাগছিল নিজেকে। কিছুদূর যাবার পরে একটা চায়ের দোকান পেলাম। সেখানে বসে এই মহিলার কথা আমি ভাবছিলাম। এ ধরণের চিকিৎসা পদ্বতি তো ভালোই। এখানে মাঝে মাঝে আসা যাবে।

    তখন আমার মনে হল মহিলার সাথে যোগাযোগের নাম্বার বা কোন কার্ড নিয়ে আসি নি। উনি প্রেসক্রিপশনও দেন নি। আবার আসতে হলে তার চেম্বারটা ভালো করে চিনে যাওয়া দরকার।

    আমি চায়ের দোকান থেকে পেছন ফিরতে লাগলাম চেম্বারের উদ্দেশ্যে। সেই বাসাটার সামনে গিয়ে দেখলাম গেইট খোলা আগের মতই। ভিতরে গিয়ে দরজার পাশের কলিংবেল চাপলাম। দুইবার চাপার পর নীল লুঙ্গি ও শাদা গেঞ্জি পরা একজন মধ্যবয়স্ক লোক দরজা খুললেন। জিজ্ঞেস করলেন, কারে চাই?

    আমি থতমত খেয়ে গেলাম। একবার মনে প্রশ্ন আসল, জায়গা ভুল হল কি না। কিন্তু ভুল হবার কোন কারণ নেই, এই অল্প সময় আগেও আমি এই বাসায় ছিলাম। একই গেইট, একই দরজা। তাই ভুল হবার কারণ নেই।

    আমি বললাম, আমি সাইকিয়াট্রিস্ট ব্রততী ম্যাডামের কাছে এসেছি।

    এই কথা শুনে ভদ্রলোক বিরক্ত মুখে আমার দিকে তাকালেন। আমাকে কিছু বললেন না। পেছনে তাকিয়ে বিরক্তির সুরে বললেন, মতির মা, আমারে শার্ট দেও।

    একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা এসে একটি শার্ট দিলেন ভদ্রলোককে। নীল শার্ট, কলারের দিকে রঙ উঠে গেছে। তিনি এটি পরতে পরতে ঘর থেকে বের হলেন, ও আমাকে বললেন, চলেন, আপনারে জায়গামত নিয়া যাই।

    আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি ব্রততী ম্যাডামের চেম্বার নয়? আমি এই বিশ মিনিট আগেও তো এখানে ছিলাম।

    ভদ্রলোক বললেন, ছিলেন তো ছিলেনই, এখন আসেন আমার সাথে। জিনিস কিলিয়ার কইরা দেই।

    ভদ্রলোকের কথা ছিল বিরক্তি ও অভদ্রতায় পূর্ন। তাই আমার কেমন জানি লাগল। এই লোক নিয়ে যাচ্ছে কোথায়, আর সেই বা কে।

    ভদ্রলোক আমাকে গেইটের বাইরে নিয়ে গেলেন। তারপর গেইটের পাশে লেগে থাকা বোর্ডের দিকে আমার মুখ ফেরালেন হাতে ধরে। বললেন, এইখানে কি লেখা আছে দেখেন? এই বোর্ডে?

    আমি দেখলাম লেখা আছে, আশুতোষ মজুমদার, এডভোকেট।

    কিন্তু একই বোর্ডে আমি অন্য নাম দেখেছিলাম আগেরবার।

    আমি অবাক হয়ে গেছি বুঝতে পেরে ভদ্রলোক বললেন, যান, এইবার শান্তি হইয়া বাসায় যান গা। গিয়া বড় একটা ঘুম দেন। মাঝে মাঝে আপনার মত দুয়েকটা লোক এইভাবে আসে আমাদের বাসায় সাইকিয়াট্রিস্ট এক ম্যাডামের খুঁজতে। তাদের বিশ্বাস করান যায় না। শেষে এই পদ্বতি বাইর করছি। তাও অনেকে বিশ্বাস করতে চায় না। তখন খারাপ আচরণ করতে অয়। আপনার জন্য সেইটা লাগব না নিশ্চয়?

    যেইভাবে ভদ্রলোক কথা বললেন, আমার আর কিছু বলতে সাহস হলো না। কিন্তু মাথার ভেতরে তোলপাড় চলছে। কী হলো এসব, কী হচ্ছে এসব।

    আমি জানতাম এই সময়ে মাথা স্থির রাখতে হবে। অবশ্যই কিছু একটা হয়েছে, কিছু একটা হচ্ছে। বাস্তবতার যুক্তি মিলছে না। এখানে সমস্যাটা বের করতে হলে আমার মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে এটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম।

    এই এলাকায় অনেক বিদেশী লোকজন থাকে। আমি যখন সি এস ডি শপিং কমপ্লেক্সের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, যথাসম্ভব আমার মাথাকে স্থির রাখার চেষ্টা করতে করতে তখন একজন বিদেশী লোকের মুখোমুখি হয়ে গেলাম।

    লোকটাকে দেখে মনে হলো ইউরোপীয়, মাথায় চুল খুব অল্প। সে আমার দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলল, আমার একটা সাহায্য করবেন?

    আমি বললাম, কী সাহায্য?

    লোকটি বলল, আমি একজনকে খুঁজছি। সে এখানে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। নাম অড্রি হর্ন, আপনি তাকে দেখেছেন?

    আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে?

    লোকটি হাসিমুখে বলল, অভাজনের নাম আর্ল, উইন্ডম আর্ল। চিনতে পেরেছেন নিশ্চয়ই? আচ্ছা, যাই হোক, অড্রি হর্নকে কি দেখেছেন? বেন হর্নের মেয়ে?

    আমি বললাম, না দেখি নি।

    লোকটি আমাকে থ্যাংক ইউ বলে পিছন ফিরে চলতে লাগল। আমি চিনতে পারলাম লোকটিকে। সে এজেন্ট কুপারের পার্টনার ছিল একসময়, এখন একজন ভয়ানক খুনি। অড্রি হর্নকে সে খুঁজছে খুন করার জন্য।

    কিন্তু টুইন পিকস থেকে সে কিভাবে এখানে চলে আসবে? আমি কি এখন বাস্তবে আছি না স্বপ্নে?

    আমার মনে আছে, আমি স্পষ্ট জানি উইন্ডম আর্লের পরিচয় কেউ জানে না। সে লুকিয়ে থেকে ছদ্মবেশে একের পর এক খুন করে যাচ্ছে আর কুপারকে ফেলছে ঝামেলায়। আমি যেহেতু জানি উইন্ডম আর্ল কী করবে তাই আমি চাইলে এটি থামাতে পারি। আবার আমার স্বপ্ন বাস্তবতার একটা পরীক্ষাও হওয়া দরকার।

    রাস্তার দিকে চোখ পড়তেই একটা ইট দেখতে পেলাম। নিজের কর্তব্য ঠিক করে ফেললাম। ভাবার সময় নেই। দ্রুত ইট হাতে নিয়ে, দৌড়ে গিয়ে উইন্ডম আর্লের মাথায় বসিয়ে দিলাম। তার মাথা থেঁতলে গেল। সে এক ভয়ানক চিৎকার করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

    আর আমি দৌড়ে পালাতে লাগলাম।

    রাস্তায় একসময় হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লাম হাঁপাতে হাঁপাতে। মনে হচ্ছিল আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, আমার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। কয়েক মিনিট মাথা নিচু করে রাস্তায় পড়েছিলাম। একটু ধাতস্থ হতেই আমার মনে হলো কেউ একজন খুব কাছ থেকে আমাকে দেখছে। আমি মুখ তুলতেই লোকটিকে দেখলাম। পুরনো একটি কোট পরা বুড়ো লোক। মাথায় লম্বা চুল, বহুদিন তেল পানি না পাওয়ায় রুক্ষ এবং ধূষর।

    লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, কী হে পথিকবর! কোত্থেকে আসা?

    আমি কিছু বললাম না, কারণ বলার শক্তি তখনো ছিল না।

    লোকটা বলল, ডোন্ট ওরি। লাইফ এমনই। লাইফে এমনই হয়। এই যে আমাকে দেখো, ওয়ান্স আপন এ টাইম, হোয়েন আই ওয়াজ এ কিড…যখন আমি বালক ছিলাম, তখন আমরা ফড়িং…ইউ নো ফড়িং? ডানাওয়ালা, সেই ফড়িং, যে জীবন দোয়েলের ফড়িং এর, সেই ফড়িং ধরতাম… খুব সাবধানে, আস্তে আস্তে পা ফেলে যেতে হয়, একটু অসতর্ক হলে, একটি অন্যমনস্ক হলে তারা টের পেয়ে যায়, তারা উড়ে যায়… তাই খুব আস্তে আস্তে… সেই সময়ের কথা আমার খুব মনে পড়ে… এখানে একটাও ফড়িং নাই… বুঝলে, লাইফ হলো হার্ড, হার্শ, সলিটারি, ন্যাসটি, ব্রুটিশ ও শর্ট … এই যে এতো কিছু হচ্ছে, এতো কিছু এতো কিছু, কিন্তু আমি ফড়িং পাচ্ছি না, এটা কোন ভালো জিনিস হলো? হে লেভিয়াথান! বলো তুমি, হে পথিক, জন্ম তব এই বঙ্গে?

    লোকটা একটানা আরো কী কী জানি একমনে বলে যাচ্ছিল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকলাম।

    অনেকক্ষণ একটানা হাঁটার পর আমি গিয়ে আবার সেই চায়ের দোকানে বসলাম যেখানে বসেছিলাম কিছু সময় আগে। সেখানে গান বাজছিল। রাজা কো রানী সে পেয়ার হ গ্যায়া, পেহলি নাজার মে পেহলা পেয়ার হ গ্যায়া…

    এই গানের দুই লাইন শোনার পরেই আমি বুঝতে পারলাম আমার পকেটের মোবাইল ফোনে একটা কল এসেছে। নাম দেখলাম কুইন রানিয়া।

    রিসিভ করার পরে ওপাশ থেকে একজন নারী কণ্ঠ বলল, সারাদিন তোমার কোন খবর নেই কেন?

    আমি বললাম, এই তো অফিস, কাজ…

    আমার কথা শেষ করতে পারলাম না। ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠ আমাকে বলতে লাগল, তোমার মত এত সেলফিশ আত্মকেন্দ্রিক লোক আমি দেখি নি। সারাদিনে একটা ফোন দেবার সময় তোমার হয় না। স্বাভাবিক কোন কিছুই তোমার মধ্যে নাই। স্বাভাবিক আবেগ, স্বাভাবিক মানুষের অনুভূতি। মিনিমাম দায়িত্বজ্ঞান বলতে যে জিনিস মানুষের থাকে, সেটাও তোমার নাই। আমি এতদিন, এতোটা দিন ধরে তোমাকে সহ্য করে গেছি। তোমার অন্যায়, তোমার এইসব পেইন দেয়া আমি সহ্য করে গেছি। কিন্তু আর নয়। এরকম কোন সম্পর্ক চলতে পারে না। এরকম কোন সম্পর্ক আসলে হয়ই না। তোমার সাথে হয়ত আমার কোন সম্পর্কই ছিল না। এবং থাকলে আজ থেকে, এই মুহুর্ত থেকে আর থাকবে না। একটা সেলফিশ, আত্মকেন্দ্রিক ইডিয়টের সাথে আমি কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না, আজ সারাদিন ভেবে এটাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সুতরাং, তোমার সাথে আমার সব কিছু আজ, এই মুহুর্তে, এখানেই শেষ।

    ওপাশ থেকে ফোন রেখে দিল নারী কণ্ঠ।

    আমি হতবাক হয়ে বসে রইলাম।

    চায়ের দোকানে তখন গান পরিবর্তন হয়েছে। নতুন গান বাজছে। লিওনার্দ কোহেনের ভারী কণ্ঠ ভেসে আসছে। এন্ড হোয়া.., হোয়া.., হোয়া.. ইজ মাই জিপসি ওয়াইফ টুনাইট… আই’ভ হার্ড অল দিজ ওয়াইল্ড রিপোর্টস, দে কান্ট বি রাইট…

    অনেক লোক আসছে, যাচ্ছে, চা সিগারেট খাচ্ছে। কিন্তু আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। আমি কিছুই মেলাতে পারছি না।

    আমার শরীর ঘামতে শুরু করেছিল। অস্বস্থি হচ্ছিল খুব। কার সাথে কথা বলব, কার সাহায্য নেব এটাও বুঝতে পারছিলাম না। সেই সময়ে একটা হাত আমার কাঁধে পড়ল। একজন লোক পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত রেখেছে।

    আমি তাকিয়ে দেখলাম পুরনো খাকি পোশাক পরা একজন লোক। কাঁধে ঝোলানো চোটের ব্যাগ। হাতে একটি ছোট বর্শার মত লাঠি। লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। হেসে বলল, এত চিন্তার কিছু নাই। রিল্যাক্স মারেন, রিল্যাক্স।

    আমি তাকিয়ে আছি কিছু বলছি না দেখে সে নিজে থেকেই বলল, আমারে চিনতে পারেন নাই? চিনছেন কি?

    না।

    আমি রানার। রানার ছুটেছে রানার। সেই রানার। এখন তো আধুনিক যোগাযোগের ব্যবস্থা, তাই আমার কাজকাম আর নাই। আগে ছিল, যখন আমি খবরের বস্তা নিয়া ছুইটা যাইতাম নানাদিকে, রাইতের আন্ধারে।

    আচ্ছা।

    আপনার মনে অবস্থা টের পাইয়া আইলাম আমি। চিন্তা নিয়েন না। এমন হয়। এইগুলাই হইয়া আসতেছে। নো চিন্তা। কেউ কেউ এইভাবে…বুঝেনই তো … হা হা।

    কী হচ্ছে এসব?

    কোন প্রশ্ন না। প্রশ্ন হইল ধাঁধা, গোলকধাঁধা, বুছচেন? সমস্যা বানায় এইগুলা। এর চাইতে আমি বলি সমাধান নেন, ঝামেলা মুক্ত থাকেন।

    কী সমাধান?

    সমাধান হইল, আগে আমার বিষয়ে কই আরেকটু। আমার তো কাজকাম নাই এখন আর। তাই কিছু মাজারে মাজারে ঘুরি। শুনেন, মাজার হইল আসল যাদুবিস্তারি বাস্তবতা। আপনারা যেমন কন সাইন্স দিয়া মাইনশের লাইফের সব সমাধান কইরা ফেলবেন, মাইনশের লাইফ অত সরল জিনিস না। অনেক জটিল, অনেক রহস্য, অনেক প্লাস মায়নাস। যেইগুলার কোন ব্যাখ্যা আপনার সাইন্সে নাই, যুক্তিতে নাই। কিন্তু অন্য অনেক জায়গায় আছে। মাজারে মাজারে আছে।

    আমার সমস্যার সমাধান কী? আমি ব্যগ্রকন্ঠে জিজ্ঞেস করি।

    রানার হাসে।

    বলে, চিন্তা নিয়েন না। সমাধান দিয়াই তো আমারে পাঠান হইল। আপনার সমস্যা নিয়া উনারা জ্ঞাত আছেন। সব সমাধান হইব।

    উনারা কারা?

    সব জানা ঠিক না। এইটা না জানলেন। আপনে নিশ্চয়ই জ্ঞানার্জনে নামেন নাই? সমাধান চান, ঠিক কি না?

    হ্যা ভাই, সমাধান চাই। আমার খারাপ লাগছে। আমি বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে আমার সাথে।

    রানার তার চটের ঝোলায় হাত দিয়ে এক পাতা ট্যাবলেট বের করল। শাদা শাদা বড় ট্যাবলেট। একটা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, চোখ বন্ধ কইরা খাইয়া ফেলেন। অল্প তিতা লাগব, খাইয়া ফেলেন।

    আমি ট্যাবলেট হাতে নিলাম। খাব কি না দ্বিধায় ভুগছিলাম।
    <
    br /> রানার বলল, দেরী কইরেন না। চিন্তার কিছু নাই। চিন্তায় টাইম যায়, আর সেই টাইম জিনিস জটিল কইরা ফেলে। খায়া লান। শাবানুর নাম নিয়া খায়া লান।

    আমি ট্যাবলেট মুখে দিলাম। খুব মিষ্টি একটা স্বাদ মুখে লাগল। মুখের ভিতরে অল্প অল্প করে গলে যেতে লাগল ট্যাবলেট। রানার বলেছিল তিতা লাগবে। কিন্তু আমি টের পেলাম অতুলনীয় এক স্বাদে মুখ ভরে যাচ্ছে। আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল আবেশে।

    যখন চোখ খুললাম দেখলাম চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। মানুষজন নেই। রাস্তাঘাট ফাঁকা, শুনশান নীরবতা। বড় রাস্তা দূরে চলে গেছে। এর দুপাশে গাছের সারি। কিছু দূরে দূরে ল্যাম্পোস্ট সামান্য সামান্য আলো দিচ্ছে।
    রানারকে আমি পেলাম না আঁশে পাশে। কেউই নেই। কোন জনপ্রাণী নেই।

    আমি রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। একসময় অনুভব করলাম আমি শূন্যে উঠে যাচ্ছি। প্রথম মনে হয়েছিল আমার ভুল হচ্ছে। কিন্তু যখন গাছের মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেলাম তখন আর অস্বীকারের উপায় থাকল না। আমি শূন্যে উঠে যাচ্ছি। উপরের আকাশে দেখলাম তারা জ্বলমল করছে। আমি বাতাসে ভাসতে ভাসতে সেদিকে উড়ে চলে যাচ্ছি। কী অদ্ভুত!


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ০৬ জুন ২০১৯ | ১২৫৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন