এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • যাহা নাই ভারতে

    Prakalpa Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৭ মে ২০১৪ | ১৮১২ বার পঠিত
  • পত্রিকার সম্পাদকেরা সচরাচর আধাপাগল হন। আমার সম্পাদক বদ্ধ পাগল। নাহলে আজ সকালবেলা ফোন করে আগামীকালের মধ্যে মহাভারত নিয়ে একটা লেখা লিখতে বলেন!আরে আমি কি নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি, নাকি অর্ণব গোস্বামী, যে সবকিছু নখের ডগায় থাকবে, কাগজ কলম নিয়ে বসলেই লেখা বেরোবে ফরফর, ফরফর!
    কে কাকে বোঝায়!
    ফোনটা আসবার পর থেকে সারাদিন অফিসে চিন্তা করেছি, কিস্যু আসেনি মাথায়। কয়েকজনকে জিগ্যেসও করলাম। পাশের টেবিলের বিকাশদা রেসের মাঠ থেকে সানি লিওন অনেককিছুর খবর রাখেন। আমার প্রশ্ন শুনে কাগজ পাকিয়ে কান চুলকোতে চুলকোতে চোখ বুজিয়ে বললেন, ‘মোয়াভারতটা আসলে একটা সমুদ্দুর, বুঝলি! তা নিয়ে বলার কিছু নেই, লেখারও না। শুধু উপভোগ করবার, ঢেউ আর ঢেউ। ওহ্যাঁ, সেবার পুরী গেসলুম যখন, বলেছি তোকে?’
    অগত্যা অফিসফেরত দুটো রুটি খেয়েই ঘরে বসে কাশীদাসী মহাভারতটা নিয়ে পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। পাণ্ডবদের, না, সঠিক বলতে গেলে, কৌন্তেয় আর মাদ্রেয়দের জন্ম হোল, তারা রাজপ্রাসাদে এল, বড় হচ্ছে, এই সব বেশ মন দিয়ে পড়ছি, হঠাত মনে হোল ঘরের মধ্যেই কে যেন কাশল।
    একা থাকি, রাতবিরেতে অনেক রকম শব্দসাড়া পাই। মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিই। এটাও তাই দিলাম। আবার পড়তে যাব, স্পষ্ট শুনলাম গম্ভীর আওয়াজ, ‘ওখানে কিছুটা অংশ বাদ পড়ে গেছে!’
    ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আমার খাটের ওপর আধো আঁধারিতে একটা বুড়ো জাঁকিয়ে বসে আছে। আমি টেবিলে বসে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ছি, বাকি ঘর অন্ধকার। দরজা ভালভাবে বন্ধ। এ আবার কোন জ্বালাতন রে বাবা!
    ভয় নয়, বেশ বিরক্তিই হোল। আমি মরছি নিজের জ্বালায়, আর উনি এলেন গপ্প মারতে! বললাম, ‘আচ্ছা, ধন্যবাদ। এবার আপনি আসুন, আমার কাজ আছে।’
    -‘আপনার কাজের সুবিধার জন্যেই আমার আসা।’
    -‘বুঝলাম। তা যেতে যদি না চান, মুখটি বন্ধ করে থাকুন দয়া করে।’
    -‘অর্বাচীন! আমি মুখ বন্ধ করলে তোরা ধ্বংস হয়ে যাবি রে!’
    মহা জ্বালা! এ যে দেখছি তুই তোকারি করছে! মরুকগে, আমি কথা না বাড়িয়ে আবার বইতে মন দিলাম। তাতেও নিস্তার নেই। আবার গর্জন, ‘কথাটা কানে গেল না, নাকি বিশ্বাস হলো না?’
    নাঃ, এভাবে হবে না। বই বন্ধ করে চেয়ারটা ঘুরিয়ে ছায়াবুড়োর মুখোমুখি বসলাম। ‘বলুন, কী বলবেন’।
    -‘পাণ্ডবরা ছোটবেলায় কী কী খেলাধুলো করতেন লেখা আছে ওখানে?’
    মজা লাগল। কোথাকার কে বুড়ো এসে পাণ্ডবদের খেলাধুলো নিয়ে প্রশ্ন করছে... আর বিষয়টা বেশ নতুন ও তো! বললাম, ‘সেভাবে তো কিছু দেখছিনা, এই গাছে উঠে ফল পাড়া, নদীতে সাঁতার কাটা...’
    -‘মুদ্গর-কন্দুক ক্রীড়া বাদ গেছে।’
    -‘বন্দুক? সেই যুগে?’
    -‘তুই কি সত্যিই এতটা আহাম্মক, নাকি আমার সঙ্গে মস্করা করছিস? বন্দুক নয়, কন্দুক। ভাঁটা। তোরা যেটাকে বল বলিস।’
    খামখা আহাম্মক বলাতে রেগেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু কৌতুহল বড় বালাই। ‘বল? ব্যাটবল? মানে ক্রিকেট?’
    -‘অবশ্যই।’
    -‘কিন্তু সেই যুগে ক্রিকেট? কে শেখালো ওদের?’
    মনে হোল খুশী হলেন ছায়াবুড়ো। তাঁর গালভর্তি সাদা গোঁফদাড়ির ভিতর থেকে একটু হাসির আভাসও যেন পাওয়া গেল।
    -‘শিখিয়েছিল একলব্য। তাদের উপজাতিরা এই খেলা খেলত আগেই। তবে রাজপ্রাসাদে এর প্রচলন ছিল না।’
    আমার গা শিরিশির করে উঠল! গল্প আসছে! জয় সম্পাদকের জয়! ‘আর একটু বিশদ বলুন না!’
    -‘একদিন পাণ্ডব এবং ধার্তরাষ্ট্র একশ-পাঁচ ভাই মাঠে এসে কোন খেলা খেলবে তা স্থির করতে না পেরে ঝগড়া করছিল। তখন একলব্য এসে ওদের মুদ্গর-কন্দুক খেলাটি শেখায়। দুইটি দল হবে, একদল মুদ্গর চালাবে, অন্যদল কন্দুক নিক্ষেপ করবে। নিক্ষিপ্ত কন্দুক যদি মুদ্গরের আঘাতে নির্দিষ্ট সীমার বাইরে পাঠানো যায়, তা হলে মান পাওয়া যাবে। আর যদি মুদ্গর দিয়ে কন্দুক কে স্পর্শ না করা যায়, তাহলে-’
    -‘হাউজদ্যাট!’ বলে ফেলেই জিভ কাটলাম আমি। ‘ক্ষমা করবেন, আপনি বলতে থাকুন!’
    -‘একদলের সকলের মুদ্গর চালনার পালা শেষ হলে, তারা কন্দুক নিক্ষেপ করত আসবে, আর অন্যদল মুদ্গর হাতে দাঁড়াবে। দুইদলের মুদ্গর চালনা শেষ হলে যে দলের মোট মান অধিকতর হবে, তারা হবে বিজয়ী। এই নিয়ম সকলের পছন্দ হোল। পাণ্ডবদের পক্ষে প্রথমে মুদ্গর হাতে দাঁড়ালেন যুধিষ্ঠির, অপরপ্রান্তে কন্দুক হাতে দুর্যোধন। কিন্তু যতোভাবেই কন্দুক নিক্ষিপ্ত হোক না কেন, যুধিষ্ঠির মুদ্গর দ্বারা তার গতিরোধ করছেন শুধু। মান ও বাড়ছে না, তিনি বাহির ও হচ্ছেন না! নির্ণায়ক ছিলেন দুর্যোধনের মাতুল শকুনি। তিনি একান্তে বললেন, ‘ভাগিনা, তুমি এভাবে ওকে বাহির করতে পারবে না। কন্দুক দাও দুসরা-র হাতে।’
    -‘দুসরা!’ অজান্তেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।
    -হ্যাঁ, দুসরা। দুর্যোধনের এই ভাইয়ের হাত ছিল বাঁকা, তাই কন্দুকের দিশা ঠাহর হতো না। সে এসে কন্দুক নিক্ষেপ করতেই যুধিষ্ঠির কন্দুকের নাগাল পেলেন না, বাহির হয়ে গেলেন। এবার এ হেন তষ্করতায় প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হলেন ভীমসেন। পরবর্তী মুদ্গর হাতে এসেই প্রথম কন্দুকটিকে সজোরে আঘাত করলেন। সীমা পেরিয়ে বহুদূরে গিয়ে সেটি পড়ল এক কূপের ভিতর। খেলা পণ্ড হোল, সকলে আলোচনা করতে লাগল কীভাবে কন্দুকটিকে উদ্ধার করা যায়।’
    -‘তখনই দ্রোণাচার্যের আবির্ভাব! সেই কুশের পিছনে কুশ ছুঁড়ে...!’
    ছায়াবুড়ো হাসলেন। ‘অল্পবিদ্যা, তবে মুর্খ তুই নোস দেখছি!’
    -‘আচ্ছা, এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা এতদিন আমরা জানতে পারিনি কেন?’
    আধো অন্ধকারেও মনে হোল জ্বলে উঠল তাঁর চোখদুটো। ‘সব গণপতির দোষ। আমার বিবৃতির গতির সাথে তাল মেলাতে না পেরে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। এইভাবে আরও কতো যে অংশ...’ বলেই থেমে গেলেন। জিভ কাটলেন কি?
    -‘আপনার বিবৃতি! গণপতি! মানে, আপনি কি... আপনিই কি...!!’
    মুহুর্তে অন্তর্হিত হলেন সেই ছায়ামুর্তি। চমকে উঠে দেখি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেবিলেই, কাশিদাসী মহাভারতের ওপর মাথা রেখে। ধাতস্থ হয়ে কাগজ কলম টেনে নিলাম। লেখাটা কালই জমা দিতে হবে যে!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৭ মে ২০১৪ | ১৮১২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বাঘ - Prakalpa Bhattacharya
    আরও পড়ুন
    বয়স - Prakalpa Bhattacharya
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন