এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Saikat das | 113.50.83.201 | ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ১১:৫৫686209
  • স্কুলের বারান্দায় পড়ুয়ারা ভিড় করে। ক্লাস সেভেনের জটলা যে দিকে, সেখানে সুখচাঁদ এসে দাঁড়ায়। ঢালাই লোহার বড় নৌকা থেকে হাতাভর্তি জমাটবাঁধা ভাত চালান হয়ে যায় এক একটি থালায়। পাতলা জলের মত ডাল ফ্যান বসে যাওয়া ভাতে একাকার। সয়াবিনের তরকারি তুলনায় ভালো খাবার ছেলেদের কাছে। সুখচাঁদ লাইনের তাঁর সহপাঠীদের একদম পিছনে জড়সড় হয়ে দাঁড়ায়, স্কুলবাড়ির পুরনো দেওয়াল, হিমেল হাওয়ায় মিঠে রোদ, কালোজাম গাছের মহীরুহ ছায়ার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে চুইয়ে পড়া আলো, কাঠবিড়ালির কুটুর কুটুর ভাতের গরম ভাপের গন্ধে মিশে কি এক আবেশে একরত্তি ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে। দুপুরের খাবারের লাইনে ছেলেটা বন্ধুদের ঠেলেঠুলে সামনে এগোতে পারে না, বরং নিজেকে অন্যদের চেয়ে একটু দূরে গুটিয়ে রাখে, তারও কারণ আছে, কিন্তু কারণটা ভুলতে ছেলেটা অন্য দিকে নজর ঘোরায়। আর ঠিক তখনই ঝোপ বুঝে কোপ মেরে সবুজ-সোনালি বসন্ত তার কিশোর মনকে কেড়ে নিয়ে যায়। জামগাছ থেকে স্যাকরার হাতুড়ির মত আওয়াজ তুলে তুলে কি এক পাখি ডেকে চলে, পরিমল স্যার জীবনবিজ্ঞান পড়ান, নাম বলেছিলেন বসন্তবৌরি। কখনও কখনও সুখচাঁদের মনে হয় পাখিটা ধুনুরির মতো তুলো ধুনছে। সাদা মেঘের মধ্যে দিয়ে সে ছিলা চালায় আর শিমূল তুল উড়ে উড়ে এসে জমে স্কুলের মাঠে। আর শিমূল ফুলের রঙ লাল, সেই ফুলের রঙে দোলের দিন কি ভাবে একে অপরকে রাঙানো যায়, সুখচাঁদের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। কিন্তু সুখচাঁদকে কেউ কখনও রাঙায় না। মাস্টারেরা স্কুলের ছাত্রদের সুনাগরিক বানাতে চান, তাই তাঁরা বলেছেন
    --- ওর সাথে কেউ মিশো না, ওর বাড়ির লোক ভালো না।
    ।।২।।
    সুখচাঁদ মানকিই। ক্লাস সেভেন, সেকশন বি, রোল-৪৫। ক্লাসের পিছনের সারির ছাত্র, পদবীটি সহপাঠীদের তামাশার খোরাক। মাস্টারেরা বলেন, মাথাটা একেবারে নিরেট। তাঁরা এমনই বলে থাকেন, সেটাই ট্র্যাডিশন, তাঁদের অবশ্যই জানার দরকার নেই, ছেলেটির বাবার ফুটপাথের ওপর দোকান পুলিশ ভেঙে দিয়েছে, তাঁদের অবশ্যই বোঝার প্রয়োজন নেই যে সুখচাঁদের রোজকার ম্যাটিনি শোয়ে তার বাবা মাকে মাটিতে ফেলে, চুলের মুঠি ধরে চোরের মতো... অবশ্যই ইগনোর করা যায় নিঃসঙ্গ পরিসরে ওর শরীরে আসছে যে বদল তাকে, অন্য শরীরের প্রতি আকণ্ঠ তৃষ্ণাকে, তাঁরা শুধু হতাশ হন এমন মেধাহীন নির্বোধ কেন তাঁদের ভাগ্যেই জোটে। কিন্তু সুছাত্র মাত্রেই জানে, শিক্ষকের শিক্ষা শিরোধার্য। ছেলেরা তাদের মাস্টারের সুশিক্ষায় তাদের এই সহপাঠীকে হেনস্থা করতে শেখে, দায়িত্ব নিয়ে তার মা-বাপ-পরিবারের পিণ্ডি উদ্ধার করে থাকে। তারা শিখতে থাকে,
    --- এই অপারেশন সানসাইন কি তোরা জানিস?
    --- এই চাঁদ, তোর বাপের সঙ্গেও পুলিশ ওসব করেছিল?
    --- তোদের ঘরটাও তো রেলের জমি দখল করে তৈরি, পুলিশ আসে না?
    --- তুই রিপু করা প্যান্ট পরে স্কুলে আসিস কেন? বাপকে বলবি ফুটপাতের দোকান থেকে সস্তার নতুন প্যান্ট কিনে দিতে।
    যারা এই সুশিক্ষা বহন করে তারা নিজেরা যে এর শিকার হয় না, এমন ভাবারও কোনও কারণ নেই। এই যেমন আফজল। স্কুলের টিচার্সরুমের ক্রিকেটীয় বিতর্ক হোক বা বাড়িতে গুরুজনের উপদেশ, কোথা থেকে যেন ক্লাসের ছেলেরা বুঝে যায়, তাদের অনেকদিনের বন্ধু আফজল আসলে পাকিস্তানের পতাকা হাতে খেলা দেখতে বসে। বোঝে না শুধু আফজল। প্রথমে মৃদু প্রতিবাদ করে, হেসে ব্যাপারটিকে অবজ্ঞা করতে চায়, কিন্তু বন্ধুরা আরও পেয়ে বসে, সামনে, পিছনে, ডায়ে, বাঁয়ে টিটকিরি শুনে থাকতে না পেরে ও নির্বোধের মতো চেঁচিয়ে বিচার চায়,
    --- আমি মুসলমান হতে পারি, কিন্তু আমি ভারতের সাপোর্টার, স্যার!
    ক্লাস মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে যায়। দুপুরের সেই নৈশব্দে দাঁড়িয়ে যেটা আফজল বলতে পারে না, তা হল, ধর্ম নয়, দেশ নয়, বসন্তে রাঙানো এক কিশোর আমি ।
    ।।৩।।
    সুখচাঁদের মাঝে মাঝে মনে হয় তার এই ইস্কুল, ক্লাসঘর, মাস্টারদের ব্যঙ্গ, বন্ধুদের বিদ্রূপ পিছনে ফেলে সে চলে যায় অনেক দূর দেশে। রোজ রাতে মেলট্রেনের বাঁশি তাদের ঘরটাকে থরথর করে কাঁপিয়ে যে দেশে চলে যায়। কোথায় সে দেশ? স্কুলের পাঁচিলের ওপাশে শ্যাওলা সবুজ পুকুর, সজনে ডাঁটা, কলাগাছের বন, দিগন্তে তালপাতার ছই, ওই ছইয়ের নীচে বোধহয় সেই দেশ! একছুটে সেখানে চলে যাওয়া যায় বুঝি? কিন্তু সে নতুন দেশেও যে থেকে যাবে তাদের টালিছাওয়া ঘর, সেই টালির চালে বসন্তবৌরি আসে না, ওখানে তাদের আসতে নেই। সেখানে ছোট ভাইটি বসে আছে আশায় আশায় কখন তার বড় ভালো দাদাটি মিড-ডে মিলের আধখানি ডিম নিয়ে আসবে ঘরে; সে যে ডিম খেতে কত ভালোবাসে, দাদা কি আর তা জানে না? সুখচাঁদ লজ্জা পায়, তারও কারণ আছে, কিন্তু লাজের মাথা খেয়ে পিঠের ব্যাগ থেকে বার করে আনে স্টেইনলেস স্টিলের দুটি বড় টিফিন বাক্স। একটি বাক্স ডালমাখা ভাত, অন্যটি তরকারিতে ভরতি করে আবার চালান করে দেয় ব্যাগের ভেতর। ঠিক এই সময়ে কত কত জোড়া দৃষ্টি ওর বুকে চেপে বসে, বলতে চায় - আগুনে প্রবেশ করো- কিন্তু মাটি তো ভাগ হয়ে যায় না! প্রিয় পাঠক, এই ভাবে ওদের ঘরে একবেলার রান্নার খরচ বাঁচে। কিন্তু, ওদের ঘর বলে কোনোকালে কিছু ছিল কি?
    ।।৪।।
    সুখচাঁদ যে স্কুলে আর আসে না, এটা খেয়াল করতে সবারই কিছুটা সময় লাগে। যখন শেষমেশ বোঝা যায়, সহপাঠীমহলে গুঞ্জন শুরু হয়। টিচার্সরুমে সবাই হঠাৎ করুণায় গলে গলে পড়েন, তাঁরা কথার শেষে জিব দিয়ে আপসোসমূলক শব্দ করতে থাকেন যা শুনে ছাত্ররাও ঘাবড়ে যায়,
    ---আহা রে বেচারা,
    --- ওর ভবিষ্যৎ কিছু রইল না,
    --- আমরা চেষ্টা কিন্তু কম করিনি ওকে অন্তত স্কুলফাইনালটা পাশ করাবার।
    কেউ খবর আনে রেললাইনের ধারে ওদের ঘর জি-আর-পি ভেঙে দিয়েছে, কেউ বলে ওকে চায়ের দোকানে কাজ করতে দেখেছে; কিন্তু এমন ভাবনাও কি অলীক যে ধরণী সীতার মত তাকে গ্রহন করেছে? আমি শুধু পেয়েছি কালোজাম গাছের ছায়ায় ঝিকিমিকি আলোয় লেখা ওর চিঠিখানি,
    --- বিদায় শিমূলের রাঙা ফুল, বিদায় তুলোর মেঘ, বিদায়। ভালো থেকো স্যাকরা পাখি, তালপাতার ছই আকাশে, তুমিও ভালো থেকো, বিদায়, বিদায়।
  • Suhasini | 213.99.205.106 | ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ১৩:১৫686210
  • খুবই মন ছুঁয়ে গেলো। আরও লিখুন।
  • aranya | 154.160.98.95 | ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ১৬:৩২686211
  • ভাল লেখা
  • পরিচয় | 128.138.24.195 | ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ২১:২৮686212
  • চিত্ররূপময়, যেমন আগেও বলেছি সৈকত।
  • hu | 140.126.225.237 | ৩১ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩২686213
  • পড়লাম। সাহিত্য হিসেবে এইসব লেখা আর বিচার করতে পারি না। তাই ভালো লাগল ইত্যাদি আর বললাম না।
  • Manish | 127.214.45.1 | ০৩ নভেম্বর ২০১৫ ১৭:৪১686214
  • ভালো লাগলো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন