এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • ফেকলু রাজাঃ একটি ছত্তিশগড়ি রূপকথা

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    বইপত্তর | ২০ জুলাই ২০১৪ | ৬৭৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Ranjan Roy | ২৮ আগস্ট ২০১৪ ১১:২১646979
  • পরের দিন সকাল বেলা। আজ রাজপুরীতে নহবৎখানায় সানাই বাজল না। মহারাজ সকাল থেকেই পূজোয় বসেছেন।জামাইরাজা কে নির্বাসনে পাঠিয়ে ওঁর মন অশান্ত। কিন্তু এ ছাড়া আর কি করার ছিল?
    এই বিয়েটা! নিজের বচনে বাঁধা পড়ে বাধ্য হয়েছিলেন। লীলাকুমারীও চেয়েছিল।
    এক অজ্ঞাতকুলশীল পাত্র! হয়তো ভেবেছিলেন কাঠুরের ছেলে রাজার জামাই হলে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। কোথায় কি! উল্টে এমন সব ঘটনা ! ওঁর রাজ্যে!
    খালি ভুলতে পারছেন না লীলাকুমারীর চোখের দৃষ্টি। কাল যখন দরবার থেকে উঠে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন ও কিন্তু কাঁদে নি। উনি যখন রাজধর্ম পালনের কথা বলছিলেন মেয়ে কোন প্রতিবাদ করে নি। শুধু এক অদ্ভূত চোখে তাকিয়ে ছিল বাবার দিকে।
  • সিকি | 131.241.127.1 | ২৮ আগস্ট ২০১৪ ১২:৩৯646980
  • তারপর? তারপর?
  • Ranjan Roy | ৩০ আগস্ট ২০১৪ ০০:০৭646981
  • ৭)
    ইতিমধ্যে নির্বাসিত জামাইরাজা কে সঙ্গে নিয়ে প্রধান সেনাপতি বিক্রমজিৎ সিং রাজাদেশ পালনে রওনা হয়ে গেছেন। সূর্যাস্তের আগেই অপরাধীকে রাজ্যের সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দিতে হবে। সঙ্গে কিছু রসদবাহী ঘোড়া ও দশজন অশ্বারোহী। তবে প্রধান সেনাপতি সতর্ক। তাই যাত্রাপথ একটু বদলে নিয়েছেন।পথটি দুর্গম, কিন্তু সীমান্তে পৌঁছতে সময় নেবে কম।
    এই যাত্রাপথের পরিবর্তনের গল্পটি কিন্তু কেউ জানে না। মহারাজও না। পরিকল্পনাটি ছকেছেন প্রধান সেনাপতি নিজে, সঙ্গে ওঁর মুখ্য সহকারী বীরভদ্র সিং। রাজ্যের এই এলাকা বীরভদ্র চেনেন ভাল, বিশেষ করে জঙ্গলের রাস্তা। উনিই বলেছেন মহারাজের থেকেও গোপন রাখতে। ওঁর মনের অবস্থা ভাল নয়, বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন। যদি কোন ভাবালুতার বশে মেয়েকে বলে ফেলেন! তারপর! বলা তো যায় না, যখন সুদিন গিয়ে কুদিন আসে, সব বাধাবিপত্তি একসাথে দল বেঁধে আসে।
    সূর্য প্রায় ডোবে ডোবে। জঙ্গলের রাস্তা যেন ফুরোয় না। বীরভদ্র বললেন-- চিন্তার কিছু নেই। সীমান্ত খুব কাছে, ব্যস্‌, এই জঙ্গলটা পেরোলেই।
    বিক্রমজিৎ নিশ্চিন্ত হলেন। বীরভদ্র যে এই জঙ্গলের গোলকধাঁধা হাতের তালুর মত চেনেন।
    এমন সময় ঘটল বিপত্তি।
    জামাইরাজা ওরফে ফেকলুরাম হটাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। খানিকক্ষণ আগে থেকেই ওঁর গা গুলোচ্ছিল। এখন শুরু হল প্রচন্ড বমি!
    পেট মুচড়ে মুচড়ে উঠছে জামাইরাজার।
    বিক্রমজিৎ সিংয়ের মুখ শুকিয়ে গেল। ওঁর প্রতি আদেশ রয়েছে যে সূর্য ডোবার আগে ফেকলুরামকে সীমান্ত পার করে প্রতিবেশি মিত্ররাজ্যে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে তবে ফিরতে হবে। সে বাবদ প্রতিবেশি রাজার কাছে লেখা মহারাজের পত্রটি প্রধান সেনাপতির কোমরবন্ধে একটি রে্শমী কাপড়ে মুড়ে বেঁধে রাখা আছে।
    কিন্তু যদি জামাইরাজা ভেদবমিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন? যদি মারা যান? সঙ্গে একজন বদ্যিও নেই! বিক্রমজিৎ আর ভাবতে পারছেন না।
    বীরভদ্র আশ্বাস দিলেন। খানিকক্ষণ বিশ্রাম করা যাক। জামাইরাজার চোখমুখ ভাল করে ধুইয়ে দিয়ে একটি বড় গাছের নীচে রেশমী চাদর বিছিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল। বমি বন্ধ হল। ফেকলুরাম বীরভদ্রের দিকে চেয়ে একটু বিষন্ন হাসলেন ।
    কিন্তু দ্রুত নামছে অন্ধকার। আবার অশ্বপৃষ্ঠে যাত্রা শুরু। সীমান্ত যত শীঘ্র সম্ভব পেরিয়ে যেতে হবে।
    হ্যাঁ, জঙ্গল শেষ হতে আর বেশি দেরি নেই।
    দূর থেকে দেখা যাচ্ছে আলোর ছটা। জনপদ এত কাছে এসে গেছে?
    একট
  • Ranjan Roy | ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৮:২০646982
  • আলো এগিয়ে আসছে।সবার চোখ সেদিকে।
    সম্ভবতঃ প্রতিবেশি রাজ্যের জনপদের লোকজন।
    এত রাত্রে?
    তাহলে ওদের কোন টহলদারী দল।

    আলোর বৃত্তটি বড় হচ্ছে, হতে হতে বিশ্রামরত ফেকলুরাজা ও তার সহচরটির কাছে এসে থামল। কয়েকজনের হাতে জ্বলছে মশাল। সেই আলোয় দেখা গেল আগন্তুক দলটিকে।
    জনাপঁচিশেক অশ্বারোহী, সশস্ত্র। এরা কারা?
    -- কহাঁ হোহি রাজা ফেকলওয়া? কহাঁ হমনকে যুবরাজ?
    এগিয়ে গেলেন বিক্রমজিৎ সিং, সতর্ক পদক্ষেপে।
    --- তোমরা কে? কহাঁ লে আওথো?
    -- আমরা? আমরা আমাদের রাজা ফেকলুরামের বিশ্বস্ত দেহরক্ষী! তুই কে?
    ---- মুখ সামলে! আমি এ রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। আর এই ফেকলুরাম কোন রাজা বা যূবরাজ নয়, এ হল বন্দী। মহারাজ এর 'দেশ-নিকালা' শাস্তি ঘোষণা করেছেন।

    আগন্তুক দলের দ্বিতীয় জন এগিয়ে আসে।
    -- বাজে কথা! আমাদের একজনই রাজা। তিনি রাজা ফেকলোয়া! আর তুই ছুছুন্দর! তুই এখন আমাদের হাতে বন্দী।

    বাকিটুকু আমরা পিপলগাছের ডালে বসে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর মুখ থেকে শুনব।
    ---- বিক্তমজিৎ এর মত তলোয়ারবাজ এ' রাজ্যে ক'জন আছে? তবু তিনি বন্দী হলেন? হ্যাঃ!
    --- শুধু বন্দী? প্রাণটাও খোয়ালেন।
    -- কা বর?
    -- কা কা বাতাবো? কা লা কা করবো?
    --ন্যাকামী ছাড় বেঙ্গি! এদের মশালের আলোয় ঘুম গেল চটে, তারপর তলোয়ারে তলোয়ারে ঠন্‌ ঠন্‌, মাঝে মাঝে শিক্‌ শিক্‌! এবার খুলে বল্‌, তারপর ঘুমোবো।
    -- বলার কি আছে? ও'রম গোটা দশেকের মহড়া উনি একাই অনায়াসে নিতে পারতেন, কিন্তু পেছন থেকে বীরভদ্রের বর্শা ওঁর পিঠ দিয়ে ঢুকে পেটফুঁড়ে নাড়িভঁড়ি শুদ্ধু বের করে দিল যে!
    --- বলিস কি রে! বীরভদ্র সিং? ঠিক দেখেছিস তো?
    --- তোমার বেঙ্গি কখনো ভুল দেখে না। হ্যাঁ, একবারই ভুল দেখেছিলাম, তোর সঙ্গে মালাবদলের সময়।
    ব্যঙ্গমা শুনেও শুনল না।
    --তারপর?
    -- মশালের আলোয় স্পষ্ট দেখনু-- বীরভদ্র আর আগন্তুক দলের নেতা-উপনেতা কোলাকুলি কচ্ছে। আর হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালো ফেকলুরাম। পেটব্যথা বমিটমি সব ঠিক হয়ে গেছে।
    -- হ্যাঁ, বিক্রমজিতের সঙ্গী বাকি ন'জন কিছু ঠিক করে বোঝার আগেই কচুকাটা হল। অপকম্মের সাক্ষী রাখতে নেই যে!
    --- আরে আসল ব্যাপারটাই দেখলি না?
    এই হানাদের দুই নেতা হল ফেকলুর সেই দুই চ্যালা যাদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন বিক্রমজিৎ।
    -- জানি! জানি। খুঁজে পাবেন কি করে! ওরা তো লুকিয়েছিল যুবরাণী লীলাকুমারীর প্রাসাদে।
    --- কিন্তু প্রধান সেনাপতির ডানহাত বীরভদ্র ! সে তলে তলে ফেকলুরামের সঙ্গে! ক্ষী কান্ড!
    --- ডানহাত না, বাঁ-হাত; যা দিয়ে মানুষজন নিত্যি অপকম্ম করে।
  • Ranjan Roy | ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ২৩:০৯646983
  • ৮) এ রাজ্যে অমঙ্গলের ছায়া। কার যে নজর লেগেছে বোঝা দায়! নইলে যা কখনো ঘটেনি তা সত্যি হয়?
    একটা বাচ্চা মেয়েকে কিছু নররাক্ষস খুবলে খায় আর তাদের দলের দুটো দামড়া গা ঢাকা দিয়ে থাকে?
    লোকে বলছে -- দিনের বেলা নাকি প্যাঁচা ডাকছে? হটাৎ করে শুকিয়ে যাচ্ছে কুয়োর জল আর মায়ের বুকের দুধ!
    ফেকলুরামকে নিয়ে সীমান্ত পার করতে গেল সেনাপতি আর ফিরল না। পরের দিন রাজদরবারে মহারাজ বৃথাই অপেক্ষা করলেন বিক্রমজিৎ সিংয়ের ফিরে আসার। লীলাকুমারী ঘরের মধ্যে পায়চারি করছেন। মুখ শুকনো, শক্ত চোয়াল। শুকনো চোখ যেন জ্বলছে!
    এই ধাক্কা সামলাতে পারলেন না রাজার বেয়ান-- ফেকলুরামের মা সেই ছোটকি ছুরি গাঁয়ের ছুতোরগিন্নি বুধবারিন বাঈ।
    শেষকালে বেয়াই আমার একমাত্র ছেলেকে নির্বাসনে পাঠালেন! আমার দিকটা দেখেও দেখলেন না!
    পুরুষেরা এমনিই হয়। ওদের তো আর পেটে ছেলে ধরতে হয় না, কি বুঝবে ছেলে কি জিনিস। সারারাত ধরে এইসব সাতপাঁচ ভেবে বেয়াইমশায়ের এমনতরো ব্যাভারের নিজের মত করে মানে খুঁজে পেয়ে
    ভোরের দিকে সে নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজল। আর খুলল না।
    দু'দিন পর নগরসীমান্তের কোতোয়াল দূত মুখে খবর পেয়ে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পৌঁছে গেল দরবারে ।
    জনাকয়েক সৈন্য নিয়ে রাজার সৈন্যের ছোট দলটি ফিরে আসছে, তাতে বীরভদ্র সিংকে দেখা যাচ্ছে কিন্তু প্রধান সেনাপতি নেই।
    -গজব রে গজব!
    -- কহাঁ গইস হমনকে সেনাপতি?
    --- পালকওলা পাগড়ি পহিনকে যো ঘোড়ে মা সওয়ার হাবে ওহি!
    --- রোঘা-বের্রা! অপন সেনাপতি লা চিনস্‌ নাহি? তোর আঁখি লা ফুটে!
    -- আরে ওকর বড়া গজব লা দেখতস্‌ কি নাহি?
    -- কা হে ও?
    -- আরে সবকে পিছে কালী ঘোড়ি পর সওয়ার লা দেখ, হমনকে জামাইরাজা নো হে?
    -- হাও জি! এইসন লাগথে কি মহারাজ আপন দামাদকে সাজা লা মাফ করদিস।

    হতভম্ব কিংকর্তব্যবিমুঢ় রাজদরবারে হাঁটু মুড়ে বসেছেন বীরভদ্র সিং। বলছেন--- আমাকে শাস্তি দিন মহারাজ~! আমাদের সেনাপতি বিক্রমজিৎ সিং কে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না। উনি বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন।
    সীমান্ত এলাকায় জঙ্গলী আদিবাসীদের একটি ডাকাতের দল সেদিন রাতে আমাদের আক্রমণ করে, লক্ষ্য জামাইরাজা ফেকলুরামকে তুলে নিয়ে যাওয়ার। আমরা প্রাণপণে লড়াই করেছি। অধিকাংশ সাথী মারা পড়ল, দস্যুদেরও। কিন্তু জামাইরাজাকে রক্ষা করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় উনি বিধর্মী দস্যুদের হাতিয়ারে আহত হয়ে জঙ্গলে অধিক রক্তক্ষরণের ফলে কাল রাতে মারা গেছেন। তাই আমাদ্বের দেরি।
  • ranjan roy | 24.98.58.239 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৮:১৯646984
  • ব্যাঙ্গমা-- শোন রে বেঙ্গি! সেনাপতি বিক্রমজিতের শেষের কাজকম্ম বেশ ধূমধাম করে হল।
    ব্যাঙ্গমী-- দূর বোকা! এ কি বিয়ে না অন্নপ্রাশন? ধূমধাম? বলতে হয় রাজকীয় সমারোহ--- একটু গলার আওয়াজ মোটা করে ,চোখ নামিয়ে।
    --- তুই কত কী যে জানিস বেঙ্গি! এই দেখ, আওয়াজ বদলে চোখ নামিয়ে বলছি-- এখন রাজ্যের নতুন সেনাপতি বীরভদ্র সিং।
    -- বীরভদ্র! ঠিক জানিস? কিন্তু আমরা যা দেখেছিলাম?
    -- চুপ! নইলে গাছের ওপরে আমাদের বাস ঊঠবে।
    --- কি করে চুপ করবো? ওই লোকটাই তো---
    -- এক্কেবারে চুপ! আমরা গরীব-গুব্বো লোক, আদার ব্যাপারী, ব্যস্‌।
    --- আর মহারাজা! উনি তো লোক ভাল। কিন্তু--
    --- কিন্তু ওনার সময় খারাপ যাচ্ছে। ওই যে বলে না 'আদমী নহী, ওয়ক্ত বলবান হোতে'।
    -- বুঝেছি , বেশি শোলোক ঝাড়িস নে। মানুষ নয়, সময় হল আসল শক্তিধর।
    -- ব্যস্‌ , সময় ভাল নয়। এখন মুখ খুলতে নেই। খুলবো, তবে ঠিক সময়ে।
    -- কিন্তু মহারাজ যে ধর্মসংকটে পড়েছেন!
    -- ফের বড় বড় কতা! ধর্মসংকট আবার কি?
    -- মানে ফিরে এসেছে জামাই। কিন্তু কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই? কারাগারে? না ঘরে? ও যে ঘরজামাই।
    -- সে কি শাস্তি তো একবার ঘোষণা হয়ে গেছে! বীরভদ্র যাক , ব্যাটা ফেকলুরামকে সীমান্তের ওপারে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসুক। কাঠুরের ব্যাটা কাঠ কেটে পেট ভরুক গে!
    -- না, না! সভাসদদের কেউ কেউ বলছেন যে যারা কিশোরী মেয়েটিকে অত্যাচার করে মেরেছে তাদের তো প্রাণদন্ড হয়েই গেছে। ফেকলুরাম তো শিকারে গেছল। ওকে কেন আর টানাহ্যাঁচড়া করা! ও তো কিছু করে নি!
    -- সে কি! অপরাধীরা যে নিজমুখে কবুল করল-- যা করেছে জামাইরাজার কথায়।
    -- দূর! ও তো নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে মিথ্যে কথা। খুনীদের কথার ওপর ভরসা করে কি রাজার জামাইকে অমন শাস্তি দেওয়া যায়!
    -- কিন্তু খুনীগুলোকে রাজবাড়ির আঙিনায় তো উনিই এনেছেন। ছোটলোকগুলোকে মাথায় তুললে যা হয়।
    -- তাই ফেকলুরাজাকে এখন কোন বড় দায়িত্ব দেওয়া হবে না। তবে উনি থাকবেন রাজপ্রাসাদেই।
    --- কিন্তু দু-দুটো খুনে যে এখনো ধরা পড়েনি, তার কী হবে?
    -- ওরা? ওরা ভিনরাজ্যে পালিয়ে গেছে। ব্যস্‌।
    --- কিন্তু আমি যে দেখলাম ওই দুটোকে জামাইরাজা ফিরে আসার সময় ওনার কালোঘোড়ার আগে আগে যেতে?
    -- অ্যাই! তুই ওদের চিনিস? তুই কিচ্ছু দেখিস নি। আমরা কিচ্ছু দেখিনি।
  • কা | 172.136.192.1 | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:১০646985
  • *
  • ranjan roy | 132.176.216.40 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৯:১৫646986
  • ৯)
    ধীরে ধীরে আবহাওয়া শান্ত হয়ে এল। বাতাসে শীতের আমেজ। টুপ টাপ করে খসে পড়ছে জীর্ণ পাতা। আস্তে আস্তে রাজ্যে জীবন পুরনো ছন্দে ফিরে এল।
    -মানে?
    --মানে আর কি? মানে হল --
    ফুলের গাছ ফুল দিচ্ছে,
    ফলের গাছ ফল দিচ্ছে।
    গাভীরা দুধ দিচ্ছে।
    খাতক মহাজনকে সুদ দিচ্ছে।
    চাষী ক্ষেতে হাল দিচ্ছে।
    কামার ঘোড়ার পায়ে নাল দিচ্ছে।
    বৌ দুধ জ্বাল দিচ্ছে।
    শ্বাশুড়ি বৌকে গাল দিচ্ছে।
    কুমোর বানায় মাটির হাঁড়ি।
    নাপিতভায়া কাটছে দাড়ি।
    --- অ্যাই, অ্যাই! এবার থাম। আমার জতধম্মো তুলে কথা বলতে হবে না। আমি রোজ বিনি পয়সায় ক্ষৌরি না করলে তোকে আর রাজসভায় ভাঁড়ামো করে খেতে হত না।
    -- মানে?
    -- ফের মানে? নাঃ, তোমার সিদ্ধির নেশা মাথায় চড়েছে । ঠাকুরপো বলছেন উনি বিনিপয়সায় তোমার চুলদাড়ি না কাটলে তোমার কপালে দুঃখু ছিল। মহারাজ হলেন কায়দাপসন্দ মানুষ। রাজসভায় গোঁফদাড়ি-চুলের জট নিয়ে ঢুকলে বিদুষকের পদটি কবেই ফুরুৎ হয়ে যেত।
    -- আর এক গেলাস দাও দিকি গিন্নি!
    -- আর না! তোমার জিভ জড়িয়ে আসছে।
    -- ধ্যাৎ! আমার নেশা-টেশা হয় নি। এই পৈতে ছুঁয়ে বলছি।
    --কিন্তু কিছু একটা হয়েছে। আজ একটু বেশি বকবক করছ।
    -- বলছি তো কিছু হয় নি। আসলে আমার মনমেজাজ ভাল নেই।
    -- বিটলে বামুন! বৌকে না বলিস্‌, আমাকে বল। নিঘ্ঘাৎ রাজসভায় কিছু হয়েছে। যাকগে, প্যাঁচে পড়লে আমি বুদ্ধি বাতলে দেব।
    --- হ্যাঁ, হ্যাঁ, কথায় বলে না-- কাক ধূর্ত, আর নাপিত ধূর্ত।
    --- আমায় রাগালে ভাল হবে না। আসল কথা বল দেখি? আজ কি আবার তোর জিভে দুষ্টু সরস্বতী ভর করেছিলেন?
    নরসুন্দর বন্ধুর কথায় বিদুষক মাথা হেলিয়ে সায় দেয়। তারপর গুম হয়ে বসে থাকে।
    ভর সন্ধ্যেয় বিদুষকের আঙিনায় নিত্যিকার সিদ্ধির আসর। প্রাণী মাত্র দু'জন। দুই বন্ধু। আর বিদুষকের ব্রাহ্মণী রান্নাঘর থেকে যোগান দিচ্ছেন-- বেগুনভাজা, পলতাপাতার বড়া আর ধনেপাতার চাটনি।

    বিদুষক আস্তে আস্তে মুখ খোলে।
    -- হয়েছে কি, আজ সবাই প্রশংসা করছিল। সুশাসনের, সুখশান্তির। এবার ফসল ভালো হয়েছে। গোলায় গোলায় ধান উপছে পড়ছে আর কোষাগারে খাজনা। এরমধ্যে একজন জামাইরাজার তারিফ করে বলল-- মহারাজ, নির্দোষ জামাইরাজাকে শাস্তি না দিয়ে আপনি বড়সড় পাপের হাত থেকে বেঁচে গেলেন। তাই কোসগাই পাহাড়ের দেবী প্রসন্ন হয়েছেন। ওনার আশীর্বাদে এবার রাজ্যে ফসলের বন্যা।
    এমন সময় মহারাজ আমার দিকে তাকালেন।
    আমি বললাম-- মহারাজ, রাজ্যের অবস্থা নিয়ে আমি একটি গান বেঁধেছি। অনুমতি হলে শোনাই।
    --- সে কি! তুই আবার গান বেঁধেছিস? বলিসনি তো!
    --আরে শোন না!
    " জঙ্গল জঙ্গল ঘুম কে দেখা,
    বসতি বসতি ঘুম কে দেখা,
    হর তরফ হরিয়ালি হ্যায়,
    সির্ফ আঁখে সবকী খালি হ্যায়,
    সির্ফ আঁখে সবকী খালি হ্যায়,।"

    ( দেখেছি দেখেছি বনপ্রান্তর,
    গেছি জনপদ, মানুষের ঘর।
    ক্ষেতভরা ধান, সবুজ শ্যামল,
    তবুও শূন্য অক্ষিকোটর।)
    -- তারপর?
    -- দরবার চুপ । খানিকক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না। হটাৎ, মহারাজ উঠে ভেতরে চলে গেলেন।
    -- বুঝলাম, এ রাজ্যে তোর বাস উঠল বলে।
  • ranjan roy | 132.176.222.90 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৬:৩৮646987
  • প্রকৃতির নিয়মে কিছুই স্থায়ী নয়।আজ গ্রীষ্মের দাবদাহ পোড়ায়, তো কাল বৃষ্টির তোড়ে বান ডাকে। শরতের কাশফুলের দিন ফুরোতে না ফুরোতে জেঁকে বসে শীত।
    তেমনি ক্ষেতের ধান ঘরে উঠে নবান্নের গন্ধ ছড়ানোর আগেই এল দুঃসংবাদ।
    রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে প্রজারা বিদ্রোহ করেছে। শুধু তাই নয়, ওদের দমন করতে পাঠানো একটি ছোটখাট অশ্বারোহী বাহিনীকে ওরা পরাজিত করে বন্দী করেছে।
    মহারাজের রক্তচাপ বেড়ে গেল।
    মন্ত্রী-পাত্র-মিত্র সবাই বললেন-- এখনই কিছু করতে হবে। এদের আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়।
    তাই প্রধান সেনাপতি বীরভদ্র সিং এবরের অভিযানে একশ' অশ্বারোহীর একটি বাহিনী পাঠাবেন।
    কিন্তু মহারাজ বললেন-- না, এবারের অভিযানের নেতৃত্ব করব আমি।
    ওঁর আদেশ-- বীরভদ্র সিং উনি ফিরে না আসা পর্য্যন্ত রাজধানী ছেড়ে নড়বেন না। রাজপ্রাসাদের এক কোনাতেই ওঁর থাকার ব্যবস্থা হল। মেয়ে-জামাইয়ের ভালোমন্দ ওঁর হাতেই থাকবে।
    মহারাজের মনটা আক কুডাক ডাকছিল। বয়েসও হয়েছে। মেয়ের থেকে বিদায় নেবার সময় বললেন -- শরীরটা ভাল নয়। বড় ক্লান্ত লাগছে। যদি আমার একটা পুত্রসন্তান থাকত, তবে হয়ত এই সময়ে সামলে নিত।
    লীলাকুমারী কেমন এক অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
    তিনদন পর। গোটা রাজ্য জুড়ে যেন ঝড় বয়ে গেল।
    বিদ্রোহ দমিত। রাজ্য শান্ত। কিন্তু রাজা ফেরেন নি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি ধকল শরীরে সয় নি।
    এসবই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজবৈদ্য সৎকারের আগে মৃতদেহের শরীরে কিছু অস্বাভাবিক চিহ্ন দেখে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিশেষ করে নীলচে ঠোঁট আর বিস্ফারিত চোখের মণি।কিন্তু রাজকন্যা বললেন-- রাজবৈদ্যের বয়স হয়েছে, এসব চোখের ভুল।
  • ranjan roy | 132.176.222.90 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৭:১১646989
  • -- দেখলি বেঙ্গি, দেখলি! এ রাজ্যের লোকের আক্কেলটা দেখলি!
    শেষকালে সিংহাসনে বসাল সেই কাঠুরের ব্যাটা ফেকলুরামকে!
    -- তো কি করবে, তোকে বসাবে?
    --- ইয়ার্কি নয়, আর কেউ ছিল না?
    -- আরে অপুত্রক রাজা।একটিমাত্র মেয়ে, বড় আদরের। তাইতো ফেকলুরাম হল ঘর-জামাই। আর মহারাজ নিজেইতো একমাত্র মেয়ে-জামাইয়ের হাতে রাজ্যভার সঁপে দিয়ে বানপ্রস্থে যেতে চেয়েছিলেন।
    -- তাহলে ভালই হল বলছিস?
    --দেখা যাক। বাকি সময় বলবে।
  • ranjan roy | 132.176.222.90 | ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ২৩:৪১646990
  • ১০)
    ফেকলুরাম। নামটা বড্ড হালকা। মানে যে কথায় কথায় রাজাউজির মারে। চালবাজ।
    তা চালবাজ তো সিংহাসনে বসা রাজার নাম হতে পারে না। তাই রাজপুরোহিত পুঁথিপত্তর ঘেঁটে নাম ঠিক করেছেন-- রাজা ফোকলওয়া!
    এখন এই রাজ্যের নতুন রাজা হলেন জামাইরাজা-- রাজা ফোকলওয়া!
    দরবারে উনি একা ন'ন, সঙ্গে বসেন রাণী লীলাকুমারী। ওদের যুগলমূর্তি দেখে প্রজারা বিগলিত।
    -- দেখ গা, বিলকুল রামজী অউর সীতামাঈয়া কস লাগথে, নেহি গা?
    -- হ্হউ জী, বরোবর!

    নতুন রাজা কিছু নতুন নিয়ম করেছেন। বিদুষকের ভাঁড়ামো ওনার পছন্দ নয়। এইসব হালকা ঠাট্টা তামাশায় মেতেই তো গোটা রাজ্য উচ্ছন্নে গেছে। ওসব চলবে না। তাই বিদুষককে বিদেয় করে দেওয়া হয়েছে।
    কোথায়?
    সে সব জিগ্যেস কর না।
    রাণীমার গান-টান পছন্দ নয়।
    -- আরে লোকজন গান বাঁধবে, গান গাইবে তো কাজ করবে কখন!
    কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিবর্তন?
    দাঁড়াও বাপু! এদিক-ওদিক দেখে নিই।
    -হ্যাঁ, সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হল দরবারে কোন নালিশ নিয়ে আসা চলবে না।
    মানে? তাহলে প্রজারা ওদের দুঃখের কথা বলতে যাবে কোথায়?
    কেন? ওরা যাবে গাঁয়ের মোড়ল-মোকর্দম-কোতোয়ার বা গুণাইতের কাছে।
    সেখানে সুরাহা না হলে?
    তখন জেলার যত রাজকর্মচারী তাদের কাছে।
    সেখানেও সমিস্যের নিদান না পেলে?
    তখন ভগবানের কাছে! আ মোলো যা! মোদ্দা ক্থাটা হল নতুন রাজ্যে এমন ভাল ব্যবস্থা যে আজ অবধি কেউ নালিশ জানাতে গিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে আসেনি।
    ফলে দরবারে রোজ রোজ বাজে লোকের ঘ্যানঘ্যানানি নেই। তাই রাজা-মন্ত্রী-পাত্র-মিত্র-অমাত্য সবার হাতে প্রচুর সময়। তাই তাঁরা রাজ্যের উন্নতির জন্যে ভালো ভালো নতুন নতুন চিন্তা করছেন।
    আর রাজার সেই সব ইয়ারদোস্ত?সেই ছোটকি-ছুরি গাঁয়ের ?
    ওরাই তো আজ জেলায় জেলায় রাজকর্মচারি। শান্তি রক্ষার দায়িত্বে আছে।
    রাজ্যে শান্তি ফিরেছে।
    তাই সকালে কাক-চিল ওড়ে, সন্ধ্যেয় শেয়াল ডাকে।
    কিন্তু একটা গান, মাত্তর কয়েক কলি,-- ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। লোকে চাপা গলায় গুনগুন করে গাইছেঃ

    " জঙ্গল জঙ্গল ঘুমকে দেখা,
    বস্তি বস্তি ঘুমকে দেখা,
    হর তরফ হরিয়ালি হ্যায়,
    সির্ফ আঁখে সবকী খালি হ্যায়"।
  • ranjan roy | 132.176.222.90 | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:১৪646991
  • রাজা মাঝে মাঝেই মৃগয়ায় বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু আগের মতন শুধু ইয়ারদোস্তদের নিয়ে নয়,-- সঙ্গে থাকেন রাণী লীলাকুমারী। কেন জানি এইসব জঙ্গলের ধারে শিবির করে থাকার কথা শুনলেই রাণী অস্থির হয়ে ওঠেন। রাজা ফোকলোয়াকে একা ছাড়তে চান না।
    এমনি এক বকুলফুলের গন্ধে ম'ম করা ফাগুনরাতে তাঁবু পড়েছে কোসগাঈ পাহাড়ের কাছে, ছোটকি-ছুরি গাঁয়ের পাশের জঙ্গলের ধারে।
    সন্ধ্যেয় হরিণের মাংস দিয়ে শ্রীকমল চালের ভাত খেয়ে সবাই শুয়ে পড়েছে। কাল সকালে রাণীমা পূজো দিতে যাবেন পাহাড়ের উপরে কোসগাঈ দেবীর থানে।
    রাত্তির দো-পহর। শেয়াল ডে্কে উঠল। কিন্তু রাজা ফোকলোয়ার চোখে ঘুম নেই। পা টিপে টিপে বেরিয়ে এসেছেন তাঁবুর বাইরে। প্রহরী ঘুমে ঢুলছে।
    বনের দিকে এগিয়ে চললেন রাজা।
    না, ভুল হবার কথা নয়। এই তো সেই রাস্তা যেখান দিয়ে গাঁয়ের কাঠুরেরা জঙ্গলে ঢোকে।
    এই তো সেদিন। মাত্তর দু'বছর আগের কথা। তখন উনি ছিলেন পাশের গাঁয়ের গোবিনরাম কাঠুরের ব্যাটা ফেকলুরাম। এত তাড়াতাড়ি তো ভুলে যাবার কথা নয়। এই পথ দিয়েই তো--।
    সেই নিকষকালো রাত; ঠিক আজকের মত। রাক্ষস-রাক্ষসী, এক পায়ের মল! সেই মল থেকেই দিন ফিরল। আজ উনি মহারাজ। উত্তেজনায় বুকের ভেতরে হাতুড়ির বাড়ি।
    ব্যস্‌, এই শিমূল গাছটা পেরোলেই আসল জঙ্গল শুরু।
    কিন্তু পেছনে পায়ের শব্দ।
    ক্ষিপ্রগতিতে ঘুরে দাঁড়ালেন রাজা, হাতে খোলা তলোয়ার।
    -- একি, মহারাণী ! তুমি? কী চাও? আমার পেছনে পেছনে কেন ?
    চাপা হাসির আওয়াজ।
    -- তুমি যে জন্যে মাঝরাত্তিরে গহন বনে ঢুকছ?
    -- তুমি জানো আমি কী চাই?
    -- আমি তোমাকে খোলা পুঁথির মত পড়তে পারি রাজন্‌! তুমি চাও ওই মলজোড়ার আরেকটি! নইলে তোমার ঘুম হচ্ছে না।
    -- ঠিক ধরেছ গো। দেখ, এই একটি মল আমাকে কাঠুরে থেকে রাজা করেছে। অন্য জোড়াটি পেলে কি যে হবে--!
    -- একটু ভুল হচ্ছে তোমার ফোকলোয়া! মল নয়, তোমায় রাজা করেছি আমি। তোমার কাঠুরে বুদ্ধিতে চললে--!
    ওই মল তো আমার পায়ে। এর জোড়াটি পেলে সেটি আমাকেই দেবে। অন্য পায়ে বেশ মানাবে। আজ অবধি আমার কথার অবাধ্য হও নি। আজকেও হয়ো না।
    রানী তাকালেন রাজার দিকে এক অদ্ভূত দৃষ্টিতে। এই দৃষ্টি বৃদ্ধ মহারাজ দেখেছিলেন রাজকন্যে লীলাকুমারীর চোখে, দেখে শিউরে উঠেছিলেন।
    ফোকলোয়া চোখ নামিয়ে নিলেন।
    -- বেশ, চল। কিন্তু এতে বিপদ আছে।
    -- তুমি জান, আমি বিপদ নিয়ে খেলতে ভালবাসি। নইলে তোমাকে বিয়ে করতাম না। আমিও তো তলোয়ার ধরতে জানি। আর ওরা দুজন। সেই ভেবেই বলা।
  • s | 182.0.249.87 | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৭:০৯646992
  • বাহ। দারুন। রাজনৈতিক রূপকথা।
  • ranjan roy | 132.176.168.162 | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৯:২৩646993
  • শিমূলগাছের বাঁক ওরা অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছেন। জঙ্গল এখন গভীর। হাওয়া নেই। সেই কৃষ্ণপক্ষের রাত। রাজা ফোকলোয়া ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনায় ভুগছেন। তলোয়ারের বাঁটে চেপে বসেছে হাতের আঙুল।
    অন্ধকার বটে! এবার নিজের মেখলার আড়াল থেকে লীলাকুমারী বের করে এনেছেন সেই মায়াবী মলের একটি। তার দীপ্তিতে পথ দেখে ওরা এগিয়ে চলেছেন। কোথায় সেই কোসম গাছ? আর সেই রাক্ষস দম্পতি! ওরা কি বেঁচে আছে? যদি মরে হেজে গিয়ে থাকে তবে জোড়ার আরেকটা মল? সেটা এখন কার কাছে?
    আচমকা একটা হাওয়ার বেগ, নড়ে উঠল গাছের পাতা। তারপর একটা বোঁটকা গন্ধ! কাছে, বেশ কাছে। আর শুকনো পাতা খড়মড়িয়ে উঠছে। আসছে, কেউ আসছে। এলোমেলো জোড়া পদক্ষেপ।
    ফোকলোয়া ফিস্‌ফিস্‌ করে বললেন-- হাঁটু গেড়ে বস। ওরা যেই ঝাঁপ দেবে আমরা কোমর লক্ষ্য করে চালিয়ে দেব। তাতেই কাজ হবে।
    পায়ের শব্দ থেমে গেল।
    খানিকক্ষণ চুপচাপ। ফোকলোয়ার হৃৎপিন্ড যেন ফেটে যাবে।
    আবার পায়ের শব্দ।
    কিন্তু একি! পিছিয়ে যাচ্ছে কেন? দূরে সরে যাচ্ছে। টের পেয়েছে? পালাচ্ছে।
    হতাশ লীলাকুমারী ধাওয়া করার উপক্রম করতেই রাজা ওর হাত চেপে ধরেছেন।
    না, দু-জোড়া পায়ের আলাদা আওয়াজ , কিন্তু আলাদা দুটো দিক থেকে।
    এবার রাণী বুঝতে পারলেন। ওরা গাছটাকে বেড় দিয়ে দু'দিক থেকে এগিয়ে আসছে। দু'পাশ দিয়ে আলাদা আলাদা হামলা করবে।
    কিন্তু এরাও প্রস্তুত। দুজনে মাটিতে একটি হাঁটু গেড়ে উবু হয়ে বসেছেন। পিঠে পিঠ,বিপরীতমুখী, ব্জ্রমুষ্টিতে তীক্ষ্ণধার তরবারি।
    হামলা এল আচমক। খিলখিল হাসির সঙ্গে দুদিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাক্ষস-রাক্ষসী। সঙ্গে সঙ্গে চলল দুজনের তলোয়ার। কিন্তু লাফিয়ে এড়িয়ে গেল ওরা। হাসির বেগ গেছে বেড়ে।
    ফাটা বাঁশের মত আওয়াজে রাক্ষাসী বলছে-- আয়, আয়! এবার খেলা দেখবি। মজা টের পাবি।
    নেংচে নেংচে এগিয়ে আসছে রাক্ষসী। ঝাঁপ দিল। এবার দুজনেই একটু দেরি করে হাত চালালেন।
    লেগেছে! লেগেছে! তলোয়ারের কোপ লেগেছে রাক্ষস-রাক্ষসীর পায়ে। আবার! আবার!
    কিন্তু রক্ত কই? ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোল কই?
    এই আঘাত কি যথেষ্ট নয়?
    শেষ চেষ্টা। এবার মরিয়া হয়ে দুজনে প্রচন্ড শক্তিতে তলোয়ার চালালেন।
    কিন্তু তলোয়ার হাওয়া কেটে বেরিয়ে গেল।
    কোথায় রাক্ষস রাক্ষসীর জোড়া?
    হাউইয়ের মত আলোর রেখা মিলিয়ে যাচ্ছে দূর আকাশে। সেখান থেকে শোনা গেল আকাশবাণীঃ
    ---অনেক অনেক ধন্যবাদ রে! তোদের জন্যে কতদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম! কতদিন ! কতবছর! আজ আমরা শাপমুক্ত হলাম।
    এবার তোদের পালা। অপেক্ষায় থাক , যতদিন না তোদের চেয়েও লোভী , নীচ , বেইমান, খুনে জোড়া এসে তোদের দায় নিয়ে নেয়।

    অবাক কান্ড! হতভম্ব লীলাকুমারী দেখলেন রাজা ফোকলোয়ার চামড়া কুঁকড়ে যাচ্ছে,গায়ের লোম পোশাক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে কাঁটার মত। কিন্তু রাজন্‌ তোমার চোখ? মাথায় শণের মত চুল! আর ছুঁচলো দাঁতের পাটি! তোমাকে চিনতে পারছি নে, তোমার দিকে তাকাতে পারছি নে। একি রূপ তোমার?
    লীলাকুমারীর গলা চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসে-- রাজা! রাজা ফোকলোয়া!
    কিন্তু এই ভাঙা ভাঙা খোনা স্বর? এই কি রূপকুমারী?
    রাজা ফোকলোয়া হেসে ওঠে, সব হারানোর হাসি।
    -- নিজেকে দেখ একবার। তুমি আমি যে রাজযোটক। সব খোয়ালাম, তবু যদি মলটা পেতাম!

    আবার আকাশবাণী!
    আর এই নে সেই মল।

    আকাশ থেকে উল্কার মত নেমে আসছে এক আলোর টুকরো-- তীব্রবেগে পাক খেতে খেতে। মাটি ছোঁয়ার আগে সেই আলোর বৃত্ত এক আশ্চর্য মল হয়ে জড়িয়ে যায় লীলাকুমারীর পায়ে।
    আনন্দে নেচে ওঠে লীলাকুমারী, রাজা ফোকলোয়ার হাত ধরে দুটো পাক খেয়ে নেয়।
    না, আফশোস করে লাভ নেই। এই অরণ্যে গড়ে তুলতে হবে নতুন রাজ্য। সে হবে এক শক্তিশালী রাক্ষসরাজ। রোজ সূয্যি ডুবলে শেয়াল ও হায়নার হাসিতে মুখরিত হবে রাজার দরবার।
    হুক্কা হুয়া! হুক্কা হুয়া!
    রাজা ফোকলোয়া! ফোকলোয়া!

    (সমাপ্ত)
  • সিকি | 135.19.34.86 | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৯:৪১646994
  • সুপ্পার্ব! অসাধারণ!! এত সুন্দর রাজনৈতিক রূপকথা আমি এর আগে কখনও পড়ি নি। জাস্ট অসাধারণ!
  • d | 144.159.168.72 | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১১:৩৬646995
  • অসম্ভব ভাল হয়েছে রেঅঞ্জনদা। একদম পুরোটাই ভাল।
  • de | 190.149.51.67 | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১২:৫২646996
  • ভীষণ সুন্দর! রঞ্জনদার সেরা লেখা!
  • সিকি | 135.19.34.86 | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৩:২০646997
  • অন্যতম সেরা লেখা। এটা একসঙ্গে করে পিডিএফ বানাচ্ছি আজই। সবাইকে পড়াতে হবে।
  • ranjan roy | 132.176.0.145 | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১৯:৩২646998
  • s, দময়ন্তী (দয়্মন্তী নয়ঃ)), কুমু, নীনা, দে, সিকি --- সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
    অনেকদিন ধরে কিছুই ঠিকমত লিখতে পারছিলাম না। সম্ভবতঃ মনোযোগের অভাব। এটা লিখে নিজেরই বেশ ভালো লাগছে।
  • aranya | 78.38.243.218 | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ১১:৫৩647000
  • অপূর্ব!
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন