এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • achintyarup | 69.93.243.225 | ০৫ মার্চ ২০১৪ ০৪:৩৯630591
  • পিচ রাস্তার ধার ঘেঁষে মস্ত মস্ত টিনের গুমটি সার বেঁধে শুয়ে থাকে মরা কাছিমের মত। গুমটিগুলো শেষ হলেই একটা লোহার গেট। সে গেট থাকা না থাকায় তফাৎ নেই বিশেষ। সেখান দিয়ে ঢুকে পড়, ডানদিকে একটা ছোট্ট আপিসঘর, ডাক্তার বসে সেখানে সকালবেলা। গাদাগাদি করে বেঞ্চে বসে রোগীরা। আর আর বাঁ দিকে জংলা ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে সরু পায়ে চলা রাস্তা। ক্যাম্পের পেটের ভেতর ঢুকে গেছে। টিনের চালাগুলো সে রাস্তার বাঁ হাতে। গুমটির গা ঘেঁষে কাঁচা নর্দমা, কলতলা, শ্যাওলা। এই টিনের চালাগুলো থেকে ডানদিকে একটু সরে গেলে পুরোনো কালের পাকা আর্মি ব্যারাক। অর্ধেক ভেঙ্গে পড়েছে ঝুরঝুরে হয়ে। ছাদে গাছ গজিয়েছে। লম্বা লম্বা ঘাস বুড়ো মানুষের এলোমেলো চুলের মতো ঝুলে পড়েছে অন্ধকার জানালা-দরজার ওপর।

    এই বাড়িগুলোরও ডানদিকে, গঙ্গার একেবারে গা ঘেঁষে, ব্যারাকের কয়েকখানা ঘর একটু সাফ সুতরো করে রাখা। এক একটা ঘরে থাকে এক একটা পরিবার। সিঙ্গল ইউনিট ফ্যামিলি। মানে প্রত্যেক পরিবারের সদস্য সংখ্যা এক। রিফিউজি সব। সকলেই মহিলা। চলাফেরার ক্ষমতা বিশেষ নেই। সরকার থেকে দেওয়া ডোলের চাল-ডাল রান্না করে খাওয়ারই ক্ষমতা নেই, তো চলাফেরা! সেইজন্যই এখানে এনে রাখা।

    এই লাইনের শেষ বাড়িটা হেমলতার। মোটা কাচের চশমা পরে বারান্দায় বসে থাকে বুড়ি। একটা বই চোখের কাছে এনে পড়ার চেষ্টা করে। পাশে গিয়ে বসে গল্প শুনতে চাইলে পরণ কথার ঝুলি খুলে যায়। হেমলতার কথা বলি শোনো।তার মুখেই শোনো।

    হেমলতার কথাঃ

    কীরকম আছি দেখতে আইস? ভালো নাই। আমার বয়স একশোর কাছাকাছি হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে এইখানে গেসিলাম, তহন হইসে বিরানব্বই। প্রায় তিন চাইর বছর আগে। তা অহন একশো বছরের কাছে, অহন কি আর মনে আছে ওই সব?
    আমার দেশ বাংলাদেশে। ঢাকার জেলা। তবে আমরা থাকলেও, আমার বাবায় আর আমার শ্বশুর চইল্যা আইসে, মানে ময়মনসিং জেলায় আমরা ছিলাম, ছোট ছোট নিয়া আইসে আমাদের। আমাদের ওইখানেই বিয়া-সাদি হইসে, ওই ময়মনসিং-এই। কিশোরগঞ্জ আমার শ্বশুরবাড়ি, আর গৌরিপুর আছিল আমার বাপের বাড়ি।

    ময়মনসিং জেলায় তো কত জায়গা আছে, অহন তো সব ভুইলাও গেছি। জমিজমা ছিল, শ্বশুরবাড়ি ছিল ষোলঘর শুনছি, ওইখানে সব। আর এইখানে জমিজমা করে নাই, তারা কারবার-দারবার করসে। আমার শ্বশুরের বাবার তাগো মস্তবড় এইখানে ওই রুটির কারখানা-টারখানা, এইরকম ছিল। আর এইপারে তো সে আমরার অনেক কাহিনি। আমার ভাই তারা, তারা তো চাকরি বাকরি করে, মানিকতলাত ছিল। আর আমি দেশে। আমার বাবা মা অসিল, আমি কইসি আমি কোথায়ও যাব না। তারপরে শেষে, আমার বাবায় ছিল। বাড়িও করল, আমার দাদা, ভাই-টাই, সবই একখানে আছে, এখনে, আমারে কোনোখানে বেরোইতে দেয় না, আমার দুটো মেয়ে। কইসে, না, কোনোখানে যাবে না, এইখানেই থাকো। তারপরে আমার যে যা, সে ছিল চান্দমারি ক্যাম্পে। আমার কাছে গোপনে একটা চিঠি দিল। ওরাও দুই ভাই আছিল, আমাদের সব গেল। তহনে আমার যা-য় বলল কি, যে, খুশিরানি তোমাকে একটা কথা বলি। তোমার দুটো মেয়ে আছে। তুমি আমার কাছে চইলা আস। আমি তোমার ব্যবস্থা করব। চিরকাল তোমার বাপ-মা থাকবে না। তারপরে লুকাইয়া, চুরি কইরা সে অনেক কথা। ওই আমাদের দ্যাশে তো নিয়্ম আছে, আমাদের এইসব হইলে মাছও খাবে না, নিরামিষ খাবে, একাদশী করাবে, আম্বুবাচি করাবে। এখন তো চুলায় গেছে। তারপরে শেষে আমার বোনের বাড়ি গেসিলাম, ওইখান থেইকা আর বাপের বাড়ি যাই নাই। আমার বড় মাইয়াটা একটু বড় আছিল, জেঠিমার এইহানো যাবি? বলল, যাব। এই আমরা চুরি কইরা চইলা আইলাম।

    তারপরে আমার দিদি এই শিয়ালদায় আইনা আমারে ভর্তি করল এই ক্যাম্পে দিল। এইটা অনাথা ক্যাম্প তো, এই ক্যাম্পে দিল। তার পরের থেইকাই এইখানে আছি। তবে এখন আর ইচ্ছা করে না। এখন যেইখানে যাওয়ার, তার জন্যই বইসা আছি।

    এইখানে যে স্টাফ আছে, তারা খুব ভাল। দেখে শোনে আমাদের।

    কিন্তু পয়সা যা দেয়, তাতে কি চলে? না না, এইটা কোন ছাইয়ের পয়্সা? এতে তো বাইরে যারা খাইবে, জল গরমও হবে না। এখনে আমাদেরো সেই রকম, ওই যা আত্মীয়স্বজনে দুই-চাইর পয়্সা দেয়। চারশো টাকা আর রেশন। মিথ্যা কথা বইলে তো আর কিছু হইব না... এই গম, চাল, ডাইল, আর আইজকাইলকার এই বাজার। তবু তো এখন আলুটা একটু সস্তা হই্সে। আগে তো মাঝখানে দাম হইয়ে গেসিল। তবে, তোমাদের কাছে বাবু... তুমি তো আমার ছেলের থেকেও, মানে আমাগো নাতিপুতির থেকেও তোমাগো কি... আমরা কি আজকের মানুষ? যহন এইখানে আইসি এইখানে তো কিসু আছিল না, মিলেটারির সব এইখানে লাইন। এইসব পরণ কথা। এই পরণ কথা কি আর ফুরাবে? ফুরাবে না।

    তবে এখনে মোটামুটি বয়েস আন্দাজে যে খুব খারাপ আছি, তা না। এখনে যা দেয়, এখন রান্নাবান্না কইরা খাওয়া এইগুলি... রান্না কইরা বাইরের থেকে... সে অনেক কথা। আমার দিদি আছিল এইখানে মেডিক্যাল অফিসার...

    আমার নাম হইসে হেমলতা সরকার। এইখানে। সেও অনেক কথা। এইটা আমার ভাইয়ে... আমরা ওইখান থেইকা আসলাম, আমার যেই নাম আছিল... আমার শ্বশুরবাড়িতে আমারে খুশিরানি ডাকত। তারপরে আমার ভাইয়েরা আমার নাম দিয়া দিল। উল্টাপাল্টা হইয়া গেল। বাপের বাড়িতে খুশি খুশি কইরা ডাকত। আমি মেয়ে হইসি কইরা খুব খুশি হইসে আমার দাদায়, তারপরে আমার কাকায় নাম রাখল খুশি। আর শ্বশুরবাড়িতে আমারে খুশিরানি ডাকসে। আর এইসব পরণ কথা শুইনা কী করবি বাবা তরা বল। তরা আমার নাতির থেইকাও... তগো বয়স কি হইসে? কিছু না। দ্যাশ কোথায়? ময়মনসিং? আমার মামাশ্বশুর আছিল ওইখানে। ময়মনসিং-এ আমাদের খুব যাতায়াত... মানে, আমাদের কিছু একটা কিনতে হইলে, কাটতে হইলে ময়মনসিং যাইতে হইত। ময়মনসিংহ জেলার আঠারবাড়িতে আমার স্বামী রেলে কাজ করত। সেইখানে কোয়ার্টারে ছিলাম। সেও পরণ কথা, সেও বেশিদিন না। বছর-দুই বছর। আমার বিয়ে হল, তারপরে আমার একজন জ্যাঠা শ্বশুরের ঘরের সেই ননদের জামাই... তারপরে শেষে ওদের কতগুলো মালগাড়ি জমা পড়ছিল, চাকরি করত ওরা। তখনে কইল, যার যার আত্মীয় আচিল, যার যার শালা-সম্বন্ধী সব...

    কী দেখবে? দেখলে ভাল লাগব না, এইটা তো বালক ব্রহ্মচারীর। এইগুলো? এইগুলি একটা বই আছে, বইয়ের মধ্যে কয়টা গান আছে। আমি সেই বইটা পড়ি এইখানে বইসা। প্রথম অক্ষরটা দেখলে আমি বুঝি সব। লাগল হরির লুট রে এবার লুটে নে রে তোরা। আর এইসব দেখলে কী হবে? বালক ব্রহ্মচারীরে তো কেউ বিশ্বাস করে না। সুভাষ বোসেরেও না... সুভাষ বোসও মইরা গেছে... এইসব হবে না। যখনে হবে, তখনে বুঝতে পারবে। এখনও কিসু হয় নাই। এখনও অনেক দূরে। আমরা তো রাম নারায়ণও করি। তোমরা আর কয়দিনের মানুষ? ওই রাম নারায়ণও কেউ বিশ্বাস করে না এখনে।

    চলাফেরা? চলাফেরা এইখানটায় করতে পারি। আর যদি খুব ভোরের বেলা হয়, একটু হাঁটাহাঁটি করতে হয় তো। তখন এই অফিস পর্জন্ত যেইদিন ভাল লাগে, সেইদিন হাঁটি। আর তা না হলে সকালে এই জায়গায় হাঁটি। কারণ, পাও যায় আওলাইয়া বাওলাইয়া। পইড়া গেলে, মইরা গেলে তো ভাল। আর মইরা না গেলে যদি হাত-পাও ভাইঙ্গা-চুইরা থাকি তখনে কে দেখব? তবে, দেখবে না কেন? তুমি যদি কাছে থাক, তুমিও... দেখাটা তো বড় কথা না। আমি যদি আজকে বিছানায় পায়খানা করি বা কিছু করি, এইগুলি তো মানুষের শাস্তি। তবে আমারে ভাত-টাত দিয়া যায়, যাই হোক কোন রকম ভাবে জীবনটা... রান্না করে তো খাইতে পারি না। ভাতের সাথে তরকারি-টরকারি দেয়, আর এমনি মুড়ি-চিড়া সাতু-টাতু সব খাওয়া-টাওয়া, এই সমস্ত। নিরামিষ। না, মাছ-টাছ এইসব... এইসব আমরা যখন থেকে এই রকম হইছি, তখন থেকেই... আমরা দেশে ছিলাম তো, আমাদের একবার খাওয়া, সেই রকম নিয়ম মতো। আর এই দেশে থাকলে এইসব হত না। এইসব অনেক পরণ কথা, অনেক পরণ কথা।

    তবে এইখানকার স্টাফরা ভাল আছে। দেখাশোনা করে। এই তো আমি কানে শুনতে পাই না, ওই যে একটা ছেলে আছে, ওই যে... ও তো এই ঘরে থাকে, চোখ অপারেশ করছি, নিয়া গেসিল। আর কানেরও সব হয়ে গেছে, ওই অফিস থেকে। ডাক্তার লেইখা দিসে, সাড়ে তিন হাজার টাকার ওষুধ। সাড়ে তিন হাজার তো আমারে বেচলেও হবে না। তারপরে শেষে এখনে, এই যে বাপ্পা আছে, বাপ্পা বলছে, ঠিক আছে, ও চেষ্টা করতাসে। যা হয়... কানাটাই এখন বেশি হইসে, চোখটায়ও ভাল দেখি না। এইখানে তবে ঠাকুরের বই-টইগুলো একটু পড়তে চাই, কি খবরের কাগজটা... দেশের সঙ্গে তো একটা সম্পর্ক রাখতে হবে। খবরের কাগজ অফিসে গেলেই পাই। এখন তো আর পারি না। বড় বড় অক্ষর একটু দেখি, আর ছোটগুলো দেখতে পাই না।

    তারপরে এত পয়্সা কোথায়? চোখের ড্রপ আনতে হয়। প্রেশার আছে, হাই প্রেশার। প্রত্যেক দিন সে বড়িগুলো খাইতে হয়। তারপরে এখন আবার হার্টেরও দোষ হইয়ে গেসে। সেই বড়ি খাইতে হয়। এত এত পয়্সার দরকার। তবে যা আছে, গুছাইয়া... কারণ জীবনটা তো রাখতে হবে। এই আর কি। জীবনটা রাখতে হবে এই জন্য যেন হাইটা-চইলা খাইতে পারি। তুমি রৌদ্রটা লাগাইতাস কেন?

    আমি তো কিছু কইরা দিতে পারি না। যদি কেউ কইরা খায়, কিছু কইরা খাইলে খাইতে পারে। কিছু করতে পারি না। বস না। আবার কবে আসবা? এইখানে আর কোনদিন আসবা না?

    আর কি বলব? আমার দাদা বোধ হয় এখনো আছে কি নাকি তাও জানি না। আমার দাদারও অনেক বয়স হইসে। এই বিডন স্ট্রিটে পোস্টমাস্টার আছিল।

    আমার ছেলেমেয়ে? আর সেইসব... তুমি আমার পরণ কথা কি শুনবা? আমার আটজন ছেলেপিলে হইসে, সব গেছে। তারপরে আমার দুই জামাই, দুই জামাইও গেছে। ছোট মাইয়াটা আমার ছ মাসের পেটে আছিল, ওই মেয়েটা এখন খালি আছে। তারও সবই গেছে। এক বছর হইসে আমার বড় জামাই, তার সংসার এমনি সব ভাল... আমার জামাই নাই কেউ। তারপর এই আমার এই নাতি আইসিল, তখনে, তার আগে... আমার নাতি বিয়া করসে, ছেলে হইসে। তা আমি তো দেখি নাই। তার পরে, এক বছর পরে শুনতে পাইলাম যে... মানে জানে, সবাই জানে, এই জায়গার লোকেরাও জানে... আমারে জানায় নাই। তারপরে শুনলাম যে এই রকম। আর কী করব? আমার এমনে লোকজন ভাল। সবই ভাল ছিল। এখনে আমি চাই, সোনা বাবা তোমাদের বলছি, এখন যদি ওই জায়গাটায় মান কানে যাইতে পারতাম, বাচতাম। আর কিছুই চাই না। খুব ভাল জায়গা ওইটা। তা তো বুঝতেই পার। বুঝতেই পার। আজ যারে বেসেছ ভাল, কাল সে তোমার কোথায় গেল? ভবের মাঝে দিন দুই চারি অতিথ হয়ে থাক রে। এই তো। এই তো খেলা। তোমার সাথে আমার ঝগড়া মারামারি খটাখটি... কিন্তু আমরা তো তা না। আর ওই জায়গাটায় যাওয়া অত সোজা না। খুব কঠিন আছে। অন্তত আমাদের মত মানুষ। আর তোমার... ষাট, কইতে নাই, দেখ গিয়ে কত বয়সের বয়সের জোয়ান জোয়ান ছেলেরা যাচ্ছে, মেয়েরা যাচ্ছে। আর আমাদের মতন যে বুড়ামানুষ, তারা না মরে না। এই হইসে কথা। পরণ কথা।
  • Lama | 113.242.198.6 | ০৫ মার্চ ২০১৪ ০৪:৫৪630594
  • পড়ছি
  • sosen | 125.241.77.213 | ০৫ মার্চ ২০১৪ ০৮:২১630595
  • "এইখানে আর কোনদিন আসবা না? " :(
  • Lama | 213.132.214.156 | ১৪ মার্চ ২০১৪ ১৩:০৫630596
  • একটু তুলে রাখি। টইটা যাঁদের চোখে পড়েনি তাঁদের জন্য।
  • de | 69.185.236.52 | ১৪ মার্চ ২০১৪ ১৫:০৩630597
  • কোথায় এই ক্যাম্পটা?
  • sosen | 125.242.195.66 | ১৪ মার্চ ২০১৪ ১৯:২৯630598
  • তার পরের কিস্তি?
  • achintyarup | 69.93.193.212 | ১৫ মার্চ ২০১৪ ০২:০৩630599
  • হেমলতার সঙ্গে কথা হয়েছিল বাঁশবেড়িয়া ক্যাম্পে।
  • achintyarup | 69.93.193.212 | ১৫ মার্চ ২০১৪ ০৩:১৭630600
  • হেমলতা, ছবি, ইন্দুমতী, বাসনা, চিত্ত... মধ্যরাতের ভুলে যাওয়া পুত্রকন্যা এঁরা। এঁদের বাস পশ্চিমবাংলার নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা মোট আটটি রিফিউজি ক্যাম্প এবং হোমে। ২০০৭-০৮-এর সরকারি হিসেব অনুযায়ী এরকম রিফিউজিদের সংখ্যা ছিল ৬৮২। ২০১০-এ সেই সংখ্যা নেমে এসেছিল ৬৫০-র আশেপাশে। এখন নিশ্চয়ই কমেছে আরও। এঁদের বেশিরভাগই মহিলা। বেশিরভাগ পরিবারই সিঙ্গল-ইউনিট। অর্থাৎ পরিবারের সদস্য সংখ্যা এক।

    ২০০৭-০৮-এর হিসেবটাই আপাতত আছে আমার কাছে। সেই সময় নদীয়ার কুপার্স হোমের আবাসিক সংখ্যা ছিল ৪০, লাগোয়া রাণাঘাট উইমেন্স হোমে থাকতেন ২৪ জন, হাবড়া হোমে ৫৬ জন, চামটা উইমেন্স হোমে ১১৫ জন, বাঁশবেড়িয়া উইমেন্স হোমে ৩২ জন (তার কার্তিকপুর উইং-এর আবাসিক সংখ্যা ৮), ভদ্রকালী উইমেন্স হোমে ৪২ জন, ধুবুলিয়া হোমে ২০১ জন, এবং চাঁদমারি হোমে ১৬৪ জন।

    সরকারের দেওয়া সামান্য খুদকুঁড়োয় জীবন চলে এদের। প্রতি মাসে ৪০০ টাকা, প্রতি দু হপ্তায় ৮১৬ গ্রাম ডাল, ৩ কেজি চাল, ৪ কেজি গম, বছরে তিন সেট জামাকাপড়, দু বছরে একটা করে কম্বল, বিয়ের জন্য ১০০০ এবং শ্মশান খরচ হিসেবে ২৫০ টাকা করে বরাদ্দ করা আছে প্রত্যেকের জন্য। তা ছাড়াও, ঘরদোরের মেন্টেনেন্সের জন্য পাওয়ার কথা মাসে ৪৫ টাকা করে। পুনর্বাসন যাঁরা নিতে চান, তাঁরা রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিস্ট্যান্স পাবেন পরিবারপিছু ১০ হাজার টাকা এবং বাড়ি তৈরির জন্য ঋণ ৯০০০ টাকা। বেশিরভাগ ক্যাম্পেই বিজলি নেই, কেরোসিনের বাতি জ্বালতে হয়, তার জন্য কোনও খরচ যদিও সরকার দেয় না। রান্নার জ্বালানির খরচও না। কেমন এদের জীবন, তা দেখার জন্য কদিন ঘুরে বেড়িয়েছিলাম কয়েকটা হোম আর ক্যাম্পে। সেই গল্প লিখি। বেশিটাই তাদের নিজেদের কথায়।
  • achintyarup | 69.93.193.212 | ১৫ মার্চ ২০১৪ ০৩:২৭630601
  • রিফিউজিদের জন্য বামপন্থীদের তৈরি করা ইউনিয়নের নাম ইউসিআরসি-- ইউনাইটেড সেন্ট্রাল রিফিউজি কাউন্সিল। রাণাঘাটের কুপার্স হোমের আপিসঘরে বসে সেই ইউনিয়নের এক সদস্যের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আশপাশ থেকে কথার জোগান দিচ্ছিলেন অন্যরাও। সেই গল্প শোনো।

    মাহো রাজবংশীর কথাঃ
    আমার বিহারে বাড়ি ছিল। এদিকে জলপাইগুড়িতেও কিছু রাজবংশী আছে। (কোথায় গেছিলে? তোমায় খুঁজছে। রেশনও আনতে গেলে না!) বয়েস আমার চুহত্তর। (আমাদের স্টাফ ছিলেন।) আমি এখানে ওই আর আর ডিপার্টমেন্টের স্টাফ ছিলাম। ক্যাম্প গার্ড ছিলাম। ইউসিআরসি করি এখন। আমি রিফিউজি না হলেও, আমাদের যখন ইউসিআরসি-র সম্মেলন হল, তখন এরা আমাকে লিল। আমি যখন বললাম, আমি তো উদ্বাস্তু না, আমাকে এইখানে রাখছেন কেন? বলল, না... আমরা যে কমিটি করেছি, সেই কমিটিতে আপনাকে রাখছি। তাতে কি আর অসুবিধা? আরআর ডিপার্টমেন্টে তো চাকরি করেন। তো আপনিও তো উদ্বাস্তু হিসেবে... এইখানে তো আপনার বাড়িঘর নেই... তো সেই আর কি।

    এখানে সমস্যা হয়েছে, এদের দীর্ঘদিনের পুরোনো ঘর, যেটা হাটমেন্ট ছিল গভর্নমেন্টের। তো সে ঘর পঞ্চাশ বছর পঞ্চান্ন বছর আগে তৈরি হয়েছে। পঞ্চাশ-একান্ন সালে তৈরি হয়েছিল। এই ঘর সারাইতে সারাইতে জীর্ণ হয়ে গেছে। ওই ঘরে ওখানে ওরা আছে। এখন জল পড়লে, বৃষ্টি হলে একটু ভয় হয়। আগে সারানোর জন্য সরকার থেকে টাকা দিত, এখন কয়েক বছর হল প্রায় কোনও খরচা আর দেয় না। এখানে যে মহিলা হোম আছে, বছর দুয়েক আগে সেখানে কিছু টাকা আর মেটেরিয়াল দিল। এখান থেকে দিয়েছে, বাইরে থেকে দিয়েছে, বলে পাঁচশো টাকা দিয়ে দিচ্ছি প্রত্যেক ঘরে, তোমরা সারাইয়ে নাও। এই ভাবে ওই হোমে সারাইছে। কিন্তু এই হোমে সেটা হয় নাই। তা এখন এই হোমে দীর্ঘদিন ধরে ওইভাবে আছে। কারণ কি যেহেতু হাটমেন্ট ছিল, পুরোনো স্ট্রাকচার তো, ভাল ছিল, তাই চলছে আর কি। কিন্তু নড়বড়ে হয়ে গেছে, এখন তো ভরসা করা যায় না। ডোল যা দেওয়া হয়, তাতে কষ্ট করে চলে। মানে, একবেলা কম খেলাম, কি বাজার একটু কম করলাম। মানে, আমার তো চলতে হবে এর উপরেই। কারণ আর তো বাইরে কোনো ইনকাম নেই। তাই নিজেকে একটু কষ্ট করতে হয়। পুরো খাবার যেটা প্রয়োজন, সেটা হয় না। তাতে শরীর তো নিশ্চয়ই খারাপ হয় কিছু কিছু। এখানে আউটডোরে একজন ডাক্তার বসে। নাম তো আমি ঠিক বলতে পারছি না। ওই, রবিবার বাদ দিয়ে। (অনেকের মনে হল মাথা ঠিকমতো কাজ করে না আর।) হ্যাঁ। আমি তিনটে জানি। ঐ ক্যাম্পে আছে, আর এখানেও। একটা বেটাছেলে আছে, ও কথা বলতে আসলে, খুব কষ্ট হয়ে যাবে আপনার বুঝতে। মানে এমন ভাবে বলবে, যে ও-ই বুঝবে, আর আমরা বুঝতে পারি না ঠিকমতো।

    ক্যাশ ডোল, গভর্নমেন্টের যেটা স্যাংশন আছে, সেটা এনারা দেন। বাড়ানো কিছু তো উচিত। ধরে নেন, ড্রাই ডোলের ... টাকাটা কিছুটা বাড়াইলে হয়। পরিমাণ তো বলতে পারব না, তবে বাড়াইলে ভাল হয়। এই টাকা দিয়ে... যেমন নাকি আমরা ডিএ পাই, বা অন্য কিছু পাই, ওরা তো সেরম কিছু পায় না। তো ওদেরও তো মহার্ঘ পড়ে, ওদেরও তো বাজার বাড়ে... কিছুটা বাড়াইলে ভাল হয়। ড্রাই ডোলের একটা নিয়ম আছে, সেটা হল, রেশনিং এরিয়ায় যারা আছে, আমাদের তো রেশনিং এরিয়া নয়... এরা বাইরের রেশন পায় না। রেশনিং এরিয়ায় একটা রেট বান্ধা আছে। যে এত মাথাপিছু রেশন চাল গম দেওয়া হবে। সেই হিসাবে গভর্নমেন্ট বলছে, এদেরও তা দেওয়া হবে। তো ওদের যদি বাড়ে, এদেরও তা বাড়িয়ে দেবে আটোমেটিক। ওটা বলতে হবে না।

    (কিন্তু ধরুন, চারশো টাকা দিয়ে বাইরে থেকে খুব একটা কিছু কিনতে পারে না।) না। ছ কেজি চাল আর আট কেজি গম-- চোদ্দ কেজি। তাতে আঠাইস দিন... সেটা হয়। (কিন্তু অনেকে যে বলছে, একবেলা কম খেয়ে থাকি...) না, সেটা হয় না। কারণ কি, দুশো গ্রাম থেকে তো বেশি আমরাও খেতে পারি না। ঠিক না? (নিউট্রিশন ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা নাকি মাপ ঠিক হয়েছিল। দুশো চোদ্দ গ্রাম চাল, আর দুশো ছিয়াশি গ্রাম গম, পার ডে। আর আটান্ন গ্রাম ডাল। এইটা নাকি একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য যথেষ্ট।) তবে টাকা নিয়ে এটা বলা যায়, এটা একটু বাড়ানো উচিত। এই টাকা দিয়ে তো হয় না। মেক আপ করে আর কি। কিছু শাক পাতা জুটাইল, ডাল হয়ত খাইল না। কি তরকারি আনল না। এটা গ্রাম সাইডে এরিয়ায় একটু পড়ে তো... এই হল ব্যাপার। হ্যাঁ, কেরোসিন যদি ফ্রি করে তালে ভাল হয়। সেটা গভর্নমেন্ট যদি দেয়, তাতে ওরা একটু সুবিধা পায়। এই একটা পয়েন্ট ভালো তুলেছেন। ইলেকট্রিসিটি তো নাই। (এরা যে চাল গম যা পায়, সব তো মনে হয় না খায়। কিছু কি বাইরে বিক্রি করে অন্য জিনিস কেনে?) শোনেন, সেটা তো আমার বলাটা ঠিক হবে না, তবে এটা বলতে পারি, যে ওদের খাওয়াটা আঠাইস দিন হয়ে যায়। চাল গম হয়ে যায়। আর ডালটা। এটা বলতে পারি, এর বেশি আমাদেরও লাগে না। আমরাও তো খাই কিনে। তো ডাল চাল গম বিক্রি করে কিনা এটা তো আমি বলতে পারব না, আর আমার মুখে শোভা পাবে না। কেউ হয়তো ধরেন, কোনো তরকারি বা মাছ খাবার ইচ্ছে থাকল, পয়সা নাই, সেখানে পাঁচ কেজি গম যদি বিক্রি করে, সেটা আলাদা কথা। সেটা কষ্ট করে বিক্রি করছে। কিন্তু আইনে সেটা পড়ে না। দুবেলা পুরো খাবার হয় না বললে হয় না। এটা একটা নিয়ম। ধরুন কি, আমার এক কেজি রোজ লাগে, আর তিরিশ কেজি আপনি বেঁধে দিয়েছেন। আমি যদি বলি, না, আমার হয় না-- এটা তো হয় না। দুশো গ্রামের বেশি কেউ খেতে পারে না। (তাহলে এরা বলছে কেন?) বলছে, সেটা মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। কারণ কি এখানে যে কয়জন আছেন, আমার থেকে বেশি কেউ খেইতে পারবে না। কিন্তু আমার তো দুশো গ্রাম লাগে। আমি মিথ্যা বলব না। না কোনো আমার লাভ আছে। যে ওদের দিবেন না-- তা নয়। যেমন টাকা সম্বন্ধে জিগেস করলেন, তা আমি বলি টাকা দিলে ভাল। কারণ কি, টাকা বাড়াইলে, মাছ আছে, কি কিছু একটা তরকারি-- সবার তো একটু ইচ্ছা করে।

    (আপনারা ইউসিআরসি থেকে সরকারকে কিছু দাবি দিয়েছেন?) হ্যাঁ দিয়েছি। গত মাসেও তো এডিএম-এর ওখানে মিটিং হয়েছিল, ওইখানে আমাদের নেতারা বলেছিলেন। সেটাতে ঘাটতি হয় না। আমরা দাবি দিয়েছি। যেমন, পুনর্বাসনের টাকা বাড়াও। এইবার সিঙ্গল ইউনিটের জন্য চাওয়া হয়েছে চল্লিশ। অর্ডার হয়নি, ফাইল লেখালিখি হচ্ছে। চল্লিশ হাজার টাকা আর তিন কাঠা জায়গা।না, দুজন হলে তিন কাঠা, একজন হলে দু কাঠা। সিঙ্গল একজন যদি থাকে। (কিন্তু রিহ্যাবিলিটেশন নেওয়াটা এদের ক্ষতি হবে। ভীষণ ক্ষতি। কেউ না কেউ একজন অভিভাবক আসছেই। বুঝলেন তো? এসে ওই টাকাটা নিয়ে তারপর ওদের বার করে দেয়।) মানে ওদেরকে ডিপ্রাইভ করে দিচ্ছে, ওদের আর খাওয়া দিচ্ছে না, বা ব্যবহার ভাল করছে না-- এই রকম। (এর থেকে যদি কুকড ফুড দেওয়া যায়, তাহলে কি ভাল হয়?) কুকড ফুডে ওরা আবার রাজি না। আমাদের একটা ক্যাম্প আছে, বাঁশবেড়িয়ায়। যারা খুব থুত্থুড়ে হয়ে গেছে, তাদেরকে রান্না খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, বাঁশবেড়িয়াতে। (এখানে আমাদের সুপারিন্টেনডেন্টকে জিগ্যেস করুন, এখানে একজনের শরীর খারাপ হল, ওই মারা গেছেন যিনি। নাম গৌর দাসী। এই সিক্সটি-ফাইভ প্লাস বয়েস হবে। ওনাকে বলা হল, বাঁশবেড়িয়ায় যেতে, ওখানে গেলে রান্না করার হেডেক আর থাকছে না। কিন্তু উনি ওখানে যাবেন না। যার যে সেট-আপ, সেই সেট-আপ ছেড়ে কেউ যেতে চাইছে না। ওটাই ছেড়ে যেতে চায় না। সামনে একটা আতাগাছ আছে, ওইটা বিরাট ব্যাপার। সন্ধ্যার সময় একটু আতাগাছটার সামনে যায়। খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু নিজের যে অসুবিধে হচ্ছে, উনি যে রান্না করতে পারছেন না, শরীর খারাপ হয়ে গেছে, সেটা উনিও বুঝতে পারছেন, কিন্তু ওখানে যাবেন না।)

    আচ্ছা, আরেকটা কথা বলে নিই, রেশন সম্বন্ধে। আপনি যে বললেন যে এরা বলছে, যে হয় না। এরা বলতে পারে। কিন্তু ইউসিআরসি যারা করে, তারা তো গভর্নমেন্টের সঙ্গে রয়েছে, কিন্তু মিটিং মিছিল করে এদের জন্যেই। এদের জন্যেই করে। তখন এরা যে বলল, রেশনিং এরিয়ায় যে রেশন দেয় সেটা এদের দেওয়া হোক, সেইটা ইউসিআরসি মেনে নিয়েছে। তাহলে এখন এরা কি বলল না বলল, সেইটার তো দাম নেই, কেননা ওইখানে আগে তো মেনে নিয়েছে। ঠিক আছে না?

    তাহলে এই হল সমস্যা, আর এই দাবি। বিশেষ করে ঘরের দাবি, আর টাকার। আর পুনর্বাসন। এই তিনটা। পুনর্বাসনের টাকা একটু বাড়িয়ে দেওয়া। কারণ একটা বাথরুম-পায়খানা করতে গেলে তো আজকাল খুব গরীব হলেও কুড়ি হাজার টাকা লেগে যায়।

    (এখানে যাদের দেখলাম, তাদের কাউকেই তো পুনর্বাসন্যোগ্য বলে মনে হল না।) না। (তো, এরা সবাই পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি?) হ্যাঁ। এরাই এখন চাইছে পুনর্বাসন। শুনেন, এরা চাইছে একটাই কারণে। কিছু বাইরে ওদের আত্মীয়স্বজন আছে, তাদের একটু লোভ আছে। যে, চল্লিশ হাজার টাকা পাই যদি। (ওই... কয়েকদিন বাড়িতে গেছে, মাছ-ভাত খাইয়েছে, খাইয়ে বলছে, আমি তো আছি পিসি। তো, পিসি ভাবছে বোধহয় থাক, যদি ফেলে কুড়িয়েও আমাকে একটু খেতে দেয়, তাহলে আমিও ভাল করে থাকব। একটুখানি মাছের টুকরো তো পাওয়া যাবে।) কিন্তু, যা হয়, ওই ছ মাস দিল, তারপর সব গভর্নমেন্ট থেকে আদায় করে নিল, জমিটা নিল, তারপরে আটোমেটিক ব্যবহার খারাপ হয়ে গেল। এটাই হয়।
  • sosen | 125.244.225.202 | ১৫ মার্চ ২০১৪ ০৮:৪৯630592
  • ক্যাম্পগুলো সম্পর্কে আরেকটু জানতে চাই। আরো কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড। লেখক যে রকম দেখেছেন, ক্যাম্পগুলো ঠিক কি রকম, কোনদিন দেখিনি। এগুলো কি এখনো আছে?
  • achintyarup | 69.93.197.217 | ২৫ মার্চ ২০১৪ ০৪:৫৬630593
  • বিমল, প্রিয়বালা আর অঞ্জলির কথাঃ

    আমার নাম বিমল। এখানকার ইনমেট। আমি রিফুজি। তিন ভাই আছি আমরা, বিয়া-থাওয়া করসে সবাই, ছেলেপুলে আছে। তিন ভাইতেই আমরা এইখানে থাকি। আমি ওই তাঁতের কাজ করি। ওই যে এক মহিলা আছে, কথা কন। এই যে, উনি কি জিগাসা করবেন, সেইটা একটু বল।

    আমার নাম? নাম প্রিয়বালা বারুই। এইখানে তো প্রায় দশ-পনের বছর হইছে আছি। তার আগে ওই এক নম্বরের দিকে আছিলাম। এই কুপার্সেই। আর আমাগো অবস্থা? মরার মতো। দেশ আছিল ফরিদপুর। পাসপোর্ট হইছে না, তারও আগে আইসি। আমাগো অবস্থা একই রকম। একই রকম। ওই ডোল দেয়, ওই টুকটাক কইরা চলে। ডোলও ঠিকমতো পাই না। ক্যাশ ডোলটা মাসে চাইরশো টাকা। আর ড্রাই ডোলের কোনও ঠিক নাই। দুই মাস পরেও দেয়, তিনমাস পরেও দেয়, আবার আড়াই মাস পরেও দেয়, কোনও ঠিক নাই। আমি একাই। কেউ নাই। পেট চলে। চইলে যায়। কী করব? দেয়, কেউ কিনে দেয়।।। তাতেই চলছে। হ্যাঁ, না খাইয়া থাকে তাও আছে। আমাদের অনেকই অসুবিধা। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যদি না যাই আমরা, না যাইতে পারলে তো না খাইয়াই থাকতে হবে। বেশিরভাগেরই বয়স হইছে, আমাদের মতই সবাই। না খেয়েও মারা গেছে। অনেক আগে গেছিল একজন। সে অনেক আগে। এখন ওই।।। কেউ দেখাশোনা করে। দেখাশোনা মানে, ওই।।। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি হয়তো দুই চাইর দিন গেলাম, ওই রকম। এ ছাড়া কিছু নাই। আমাগো আয় করার কেউ নাই।

    আমার নাম অঞ্জুলি গাঙ্গুলি। আমার চোখ খারাপ, আমি কিছুই পারি না। আমার মা-বাবার সাথে আসছিলাম, ছোট। মা-বাবা ছিল। তারপর আমরা একটা ক্যাম্পে ছিলাম, সেইখানে মা-বাবা মারা গেছে, তারপর এই ক্যাম্পে। আমি আনম্যারেড। আমার মায়ের মাথা খারাপ ছিল তো, ওইজন্য, মা-কে দেখার জন্য।।। অখন আর বাড়িতে কেউ নাই। আত্মীয়স্বজন কেউ নাই, বইনের মাইয়া থাকে, ওই কোনও রকম।।। আমার বলতে কেউ নাই। দিদি যে মারা গেছে, ওই দিদির মেয়ে টেয়ে আছে, ওই বাড়ি দুই চাইরদিন গেলাম, ওই।।। কেউ নাই।

    শেষ ড্রাই ডোল পাইছি অনেক দিন, প্রায় দেড় মাসের উপরে হয়ে গেছে। ওই ক্যাম্পে, মহিলা হোমে, চৌদ্দ দিন অন্তর দেয়। আর আমাদের এই কুপার্স ক্যাম্পে করে কী জানেন, আমাদের ওই একবারেই দিয়ে দেয়, দুমাস তিন মাসেরটা একবারেই দিয়ে দেয়, তারপর ওই রকম, থাকে না, হাঁড়ি উপুড় করা থাকে, তখন আমাদের ওই রকম, দিন চলে কোনও রকমে। আমি আগে করতাম টিউশনি, কিন্তু এখন আমার চোখ খারাপ তো, আর পারি না। টেন পর্যন্ত পড়েছি। ওই রূপশ্রী ক্যাম্পে যে বিবেকানন্দ বালিকা বিদ্যালয়, ওইখানে পড়াশুনা করেছি। অখনে চোখ খারাপ। দুটো চোখেই অপারেশন হইছে। তারপরে এই কদিন ধইরা চোখ আরও খারাপ যাচ্ছে, ঝাপসা ঝাপসা দেখছি। এখন ওই কোন রকমে।।। ওই বইনঝির বাড়ি গেছিলাম, কদিন আগে আসলাম।।। বইনঝির বাড়ি খড়দা। না, ওরা ক্যাম্পে ছিল না। সোদপুর ছিল ওদের বাড়ি। সোদপুর থেইকা ওই খড়দাতে বিয়া হইছে। এই ডোলি ফ্যামিলি কয়েকটা আছি, এইখানে আমরা তিনজন।।। আরেকজন ছিল, সে মেয়ের বাড়িতে থাকে। সে পারে না, অচল। অচল হইয়ে গেছে, মেয়ের বাড়িতে থাকে। আরেকজন আছে, সুভাষিণী কর্মকার, বইনের বাড়িতে থাকে। উনি চলে ফেরে লড়তে চড়তে পারে না, কষ্ট হয়। ওই যা ডোল পায়, ওরা এসে নিয়ে যায়, নিয়ে।।। ওই থাকে ওদের কাছে। এই তো, আমাদের।।। আর কী আছে?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন