এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৪:৫২582820
  • মতামতরাজনীতি
    মতামত সংবাদ
    অগ্নিঝরা মার্চ

    ‘ইয়াহিয়া বললেন, খেলা শেষ’
    সোহরাব হাসান
    ০৫ মার্চ ২০১৭, ০১:৪৭
    প্রিন্ট সংস্করণ


    একাত্তরের ঘটনাবলি পাকিস্তানের একেক কুশীলব একেকভাবে দেখেছেন। ব্যাখ্যা করেছেন। সিদ্দিক সালিক ও আরশাদ সামি খান দুজনই ছিলেন পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তা। কিন্তু তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়।
    মুক্তিযুদ্ধের সময় সিদ্দিক সালিক ছিলেন ঢাকায় আর সামি খান রাওয়ালপিন্ডিতে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকের বর্ণনা দিতে গিয়ে সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘জেনারেল নিয়াজি ১৪ ডিসেম্বর রাও ফরমান আলীকে সঙ্গে নিয়ে মার্কিন কনসাল জেনারেল স্পিভাকের কাছে যান এবং যুদ্ধবিরতির শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা করার অনুরোধ জানান। কিন্তু স্পিভাক জানিয়ে দেন যে তিনি তাঁদের পক্ষ নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন না, বার্তাটি পাঠিয়ে দিতে পারেন মাত্র।
    জেনারেল নিয়াজি চেয়েছিলেন, প্রস্তাবটি ভারতের সেনাপ্রধান স্যাম মানেকশর কাছে পাঠানো হোক। কিন্তু স্পিভাক পাঠিয়েছেন ওয়াশিংটনে। মার্কিন সরকার ভারতের কাছে পাঠানোর আগে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পরামর্শ করার চেষ্টা করে, কিন্তু ইয়াহিয়া খানকে পাওয়া যাচ্ছিল না। সিদ্দিক সালিক জানাচ্ছেন, ইয়াহিয়া ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং আর অফিসে আসেননি। তাঁর সামরিক সচিব মানচিত্রের মাধ্যমে তাঁকে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতেন। একবার সেই মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমি কী করতে পারি?’
    ১৬ ডিসেম্বর লাখ লাখ বাঙালির উপস্থিতিতে তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল নিয়াজি বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। নিয়াজি প্রথমে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানালে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা তাঁর অবস্থানে অনড় থেকে বলেন, ‘এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ তখন নিয়াজি যৌথ বাহিনীর কাছেই আত্মসমর্পণ করেন।
    যুদ্ধ আরও কয়েক দিন প্রলম্বিত করতে পারতেন কি না, পরে সিদ্দিক সালিক জিজ্ঞেস করলে নিয়াজি জবাব দেন, ‘তাতে আরও বেশি মানুষের মৃত্যু ও সম্পদ ধ্বংস হতো। নগরজীবন অচল হয়ে যেত। মহামারি ও অন্যান্য ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু পরিণতি একই হতো। এরপর তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, ‘আমি ৯০ হাজার বিধবা ও ৫০ লাখ এতিমের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে এখন ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দী পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছি।’
    এর আগের একটি ঘটনা। যুদ্ধে পরাজয় এড়ানোর জন্য পাকিস্তান তখন মরিয়া। ইয়াহিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে সহায়তা চেয়ে বার্তা পাঠালেন। পাকিস্তান সময় রাত দুইটায় নিক্সন যখন টেলিফোন করেন, ইয়াহিয়া তখন নিদ্রামগ্ন। তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলে দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে কথোপকথন হয়। নিক্সন পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান এবং বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর নির্দেশ দেন। দুই নেতার টেলিফোন সংলাপ শেষ হওয়ার পর উদ্দীপ্ত ইয়াহিয়া জেনারেল হামিদকে টেলিফোনে লাগিয়ে দিতে বলেন। ইয়াহিয়ার মতো সামিও তখন উদ্দীপ্ত।
    ইয়াহিয়া বললেন, ‘হামিদ, আমরা এটা করেছি। আমেরিকানরা পথে আছে।’ এরপর সামির মন্তব্য, ‘পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও জীবনহানি সত্ত্বেও সেই আমেরিকান নৌবহর আর আসেনি, এমনকি ঢাকা পতনের পরও নয়।’ তাঁর কাছে ঢাকার পতন এবং আত্মসমর্পণ ছিল একটি দুঃখজনক অভিজ্ঞতা। তিনি বলেছেন, ‘আমি কেঁদেছি এবং আমাদের টিমের আরও অনেকেই কেঁদেছে। পরাজিত ও অবমাননার বোধ তাড়িত করেছিল আমাদের। এসব যখন আমাদের সঙ্গে ঘটছে, আমরা তখন তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সামি ভেবেছেন, সেটি ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন এবং তা একসময় কেটে যাবে।
    কিছুক্ষণ পর তাঁর বোধোদয় হলো, এটি কোনো দুঃস্বপ্ন ছিল না। প্রতিদিনের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মতো ধ্রুব সত্য।
    ভুট্টো বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠন করেছিলেন, সেখানে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সামি খান তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। সেটি অবশ্য নিজের জন্য নয়। তিনি যার এডিসি ছিলেন, সেই পদচ্যুত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের জন্য। কমিশনের প্রধান তাঁকে বহু নারীর নাম উল্লেখ করে জানতে চান, ‘স্কোয়াড্রন লিডার, আপনি এঁদের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়েছেন, আপনি কি বলতে পারেন, তাঁরা ভেতরে যাওয়ার পর কী হয়েছে? মনে রাখবেন, আপনি শপথ নিয়েছেন।’
    এই প্রশ্নে সামি খান বিরক্ত হলেও মাথা ঠান্ডা করে বললেন, ‘এখানে দুটি বিষয় আছে, প্রটোকল ও নিরাপত্তা। এডিসি হিসেবে যাঁরা সাক্ষাতের সময় ঠিক না করে আসেন, তাঁদের বিষয়টি দেখা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আপনি স্মরণ করে দেখতে পারেন, অনুমতি নিয়ে অনেকবার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু ভেতরে প্রেসিডেন্ট ও আপনার মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছে, সেটি আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। প্রেসিডেন্ট ও আপনি যেসব নারীর কথা বললেন, তাঁদের মধ্যে কী হয়েছে, তা–ও আমার জানার কথা নয়।’
    দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, জেনারেল ইয়াহিয়া সব সময় মদ খেতেন। আপনি কী বলতে পারেন দিনে কী পরিমাণ মদ তিনি খেতেন?
    সামি উত্তর দিলেন, ‘স্যার, আপনি ভুল লোককে প্রশ্ন করেছেন। আমি তাঁর মদ পরিবেশনকারী ছিলাম না। আপনি যদি এই প্রশ্নের উত্তর চান তাহলে বার বয় বা হাউস কম্পট্রোলারের কাছে জিজ্ঞেস করুন।’
    নিয়াজির বার্তা পেয়ে ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং ঢাকার পরাজয়কে দুঃখজনক ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন,
    এই বিপর্যয় সাময়িক এবং পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের ভাষণের মূল রূপরেখা অনেক দিন আগেই তৈরি করে রাখা হয়েছিল।
    এরপর ইয়াহিয়া জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে এই বার্তা পাঠান যে, পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে এবং ভারতকেও এটি মানতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সহযোগিতা চান।
    তখনো পশ্চিম পাকিস্তানের ৫ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড এবং ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীর বিষয়টি জনগণকে জানানো হয়নি। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে জয়ী না হয়েও যেভাবে জনগণকে বোঝানো গিয়েছিল, এবার আর সেটি সম্ভব হচ্ছে না। এর অর্থ হলো, জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তাঁর সহযোগীদের বিদায়। জেনারেলদের সঙ্গে ইয়াহিয়ার বৈঠকের মাঝখানেই জানা গেল সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে।
    এই প্রেক্ষাপটে ইয়াহিয়া তাঁর এডিসি সামি খানকে লক্ষ করে বললেন, ‘শোনো, ব্রিগেড বিদ্রোহ করেছে, এ খবর সত্য হোক বা না হোক, খেলা শেষ।
    ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো দেশে ফিরে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে শপথ নেন।
    আগামীকাল: ঢাকায় ইয়াহিয়ার নৈশবিহার
    সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
    [email protected]

    http://www.prothom-alo.com/opinion/article/1097434/%E2%80%98%E0%A6%87%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%96%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%BE-%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B7%E2%80%99
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৪:৫৭582821
  • “চোরগুলোর কারণেই আজ এ অবস্থা”
    সালেক খোকন

    বীর এক মুক্তিযোদ্ধার জীবন কাটছে প্রায় নিভৃতে, ঢাকার মেরাদিয়ায়। শুধু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েই তিনি থেমে যাননি, স্বাধীন দেশে গণমানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যও কাজ করেছেন নিবিড়ভাবে। নিজের যতটুকু সম্পদ ছিল তা-ই দিয়েই মানুষের সেবা করার চেষ্টা করেছেন। বয়স তাঁর ৭২। বার্ধক্য ও নানা রোগে আক্রান্ত। তাঁর দুই কিডনিই হারিয়ে ফেলেছে কার্যক্ষমতা। তবু মৃত্যুর প্রহর গোনা নয়, এ যোদ্ধা মগ্ন থাকেন দেশ ও মানুষের উন্নয়ন চিন্তায়। এমন খবরটি পাই আরেক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে।

    মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে হলে শুনতে হবে ওইসব মানুষের জীবনের গদ্যও। এক একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের ইতিহাসই মুক্তিযুদ্ধের এক একটি ইতিহাস। সে ভাবনা থেকেই এক সকালে পা রাখি মুক্তিযোদ্ধা এ এস এম আকরাম হেলালের মেরাদিয়ার বাড়িতে। মুখোমুখি চলে নানা বিষয়ে আলাপচারিতা।

    কেমন আছেন?

    প্রশ্ন শুনেই মুচকি হাসেন। অতঃপর উত্তরে বলেন, “জীবনের স্পিরিটটাই এখন থেমে গেছে। অনেক স্বপ্নই স্বপ্ন হয়ে থাকল। মনে বড় দুঃখ। মানুষের কাজে ব্যস্ত ছিলাম সারা জীবন। এখন টেলিভিশনটাই আমার সঙ্গী। ছেলেমেয়েদের সময় দিতে পারি নাই। বাবার মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটটাও ওদের কখনও কাজে লাগেনি। ঘরে বসে এখন জীবনের হিসাব মিলাই। আগে গান লিখতাম। সুরও দিতাম। সে সুরও এখন মিলিয়ে যাচ্ছে।”

    ছামসুদ্দিন আহমেদ ও হালিমুন্নেসার পঞ্চম সন্তান এ এস এম আকরাম হেলাল। বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার উলুহাটি গ্রামে। বাবা ছিলেন স্যানেটারি ইন্সপেক্টর। ফলে তাঁর বদলির কারণে আকরামদেরও জীবন কাটে বিভিন্ন উপজেলায়। আকরামের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি তারাইল প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৬১ সালে তিনি চন্ডিপাশা হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে চলে আসেন ঢাকায়, বড় ভাইয়ের বাড়িতে। অতঃপর ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। এখান থেকেই ইন্টারমেডিয়েট এবং ১৯৬৬ সালে তিনি ডিগ্রি পাস করেন।

    akram-01
    বড় ছেলে রিদওয়ান আক্রামের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হেলাল

    শৈশব ও কৈশোরের নানা স্মৃতি আজও আবেগতাড়িত করে এই যোদ্ধাকে। তাঁর ভাষায়:

    “বন্ধু আব্দুস সালাম ভূঁইয়া, মকবুল হোসেন, শফিউল্লাহ, জগত মিয়া, রামকৃষ্ণ, আব্দুর রহমান, বাবুর কথা খুব মনে পড়ে। স্কুলের মাঠে আমরা ফুটবল খেলতাম। রাইট সাইডের প্লেয়ার ছিলাম। হায়ারেও খেলতে যেতাম। আচারগাঁয়ের সঙ্গে একবার খেলা হয়। দুইদিন চলছিল খেলাডা। হালুয়াঘাটের গারো প্লেয়ার আনে ওরা। শেষ পর্যন্ত আমরা হেরে যাই। খেলা শেষে ওইদিন খুব কেঁদেছিলাম।

    “আমার বয়স তখন আট বছর। ভাষা আন্দোলন চলছে। মিছিল আরম্ভ হইছে তারাইল বাজারে। মিছিল দেখলে তখন ঠিক থাকতে পারতাম না। যোগ দিয়াই স্লোগান দিছি,‘উর্দু ভাষার পতন চাই, নুরুল আমীনের কল্লা চাই’।

    “ঢাকায় এসে বন্ধুগো খুব মিস করতাম। বড় ভাই আবু নাসির ওয়াহিদের সাথে থাকতাম মালিবাগ রেলগেটের পাশে। শান্তিনগর এসে বাসে উঠতাম। ভাড়া ছিল দুই আনা। ঢাকায় তো লোক নাই তখন। ব্রেক ছাড়াই সাইকেল দৌড়াইছি নওয়াবপুরের মতো জায়গা দিয়া। এখন তো এটা চিন্তাও করা যায় না!”

    সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন দানা বাঁধছে তখন। কলেজে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন আকরাম হেলাল। জগন্নাথ কলেজের নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগের রেজা। তখন কলেজ থেকে মিছিল শুরু হয়ে নাজিমুদ্দিন রোড, সেন্ট্রাল রোড, চকবাজার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেত। সাধারণ মানুষও অংশ নিত ওই মিছিলে। কণ্ঠ আকাশে তুলে আকরামরা শ্লোগান তুলতেন, ‘আইয়ুব শাহী নিপাত যাক, গণতন্ত্র কায়েম কর’।

    ডিগ্রি পাসের পর আকরাম হেলাল ফিরে যান নিজ গ্রামে। শিক্ষকতা শুরু করেন মুসুল্লী হাই স্কুলে এবং পরে পুরোরা হাই স্কুলে। গণিত শিক্ষক হিসেবে খুব জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। হেলাল বিএসসি বললে দশগ্রামের মানুষ এখনও তাঁকে একনামে চেনে।

    সত্তরের নির্বাচনের পর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। দেশের নানা জায়গায় চলে গুলিবর্ষণের ঘটনা। আকরাম তখন ছিলেন ঢাকার কাফরুলে, এক ভাইয়ের বাড়িতে। বাকি ইতিহাস শুনি তাঁর জবানিতে:

    “কাফরুল এলাকাটা ছিল রানওয়ের সাথে লাগোয়া। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকের ঘটনা। পাকিস্তানিরা সারা রাত সেভেন জিরো সেভেন বোয়িং বিমানে আর্মি নামাত। রানওয়ে থেকে ওরা কচুক্ষেত ফিল্ডের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেত। খুব কাছ থেকে দেখেছি সেটা। তখনই টের পাচ্ছিলাম। ভবিষ্যত ভালো না। রক্তক্ষয়ী কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় ফায়ার হত। মানুষও অস্থিরতায় ভুগছে। সবার দৃষ্টি তখন শেখ সাহেবের দিকে।”

    মার্চের প্রথম দিকেই আকরাম ফিরে আসেন নান্দাইলে। সেখানেই রেডিওতে শোনেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ। তাঁর ভাষায়:

    “বাজারে বসে শুনেছি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ওই ভাষণ শিক্ষিত যুবকদের উদ্দীপ্ত করেছিল প্রবলভাবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এরপরও যে মুক্তি মিলবে, দেশ স্বাধীন হবে– তখনও বুঝতে পারিনি আমরা।”

    আপনারা তখন কী করলেন?

    ‘ইয়াং জেনারেশনকে একত্রিত করার চেষ্টা করলাম। নিজেও তখন বাজারে বাজারে গিয়ে ভাষণ দিতাম। ২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় আর্মি নামার খবর পাই রেডিওতে। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাটি শুনেই হিট খেলাম। যাক আমগো আর্মিও তো নামছে। আর্মি ও পুলিশ যদি ইনভলভ না হত তাহলে স্বাধীনতা সম্ভব হত না।”

    এপ্রিলের কথা জানালেন আকরাম। নিজ গ্রামের উলুহাটি স্কুলের মাঠে তাঁরা বাঁশের লাঠি দিয়ে যুবকদের প্রশিক্ষণ করাতে থাকে। একসময় ময়মনসিংহ শহরে ট্রেনিংয়ের খবর পান। কিছু চাল-ডাল-আটা সংগ্রহ করে তাঁরা চলে যান ময়মনসিংহের সিটি স্কুল ক্যাম্পে। সেখান থেকে তাদের পাঠানো হয় জিলা স্কুলের মাঠে। পুলিশ ও ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা ট্রেনিং করাচ্ছিলেন সেখানে। তিনদিন থাকার পর পাকিস্তানি সেনারা ফাইটারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে আকরামরা ফিরে আসেন নিজ গ্রামে।

    পরে কোথায় ট্রেনিং করলেন?

    “আগস্ট মাসের ঘটনা। উদ্যোগী মানুষ ছিলাম। ট্রেনিংয়ের চিন্তায় তাই ইতস্তত ঘুরতেছি। একদিন বন্ধু মজিবুর, আব্দুস সালাম ভূঁইয়া, মকবুল হোসেন, মাজহারুল, সিদ্দিকসহ ছয়জন একত্রিত হই। এক সকালে আমরা তাহেরপুর হয়ে চলে আসি ভারতে মহেশখোলা ইয়ুথ ক্যাম্পে। সেখান থেকে প্রথমে বাগমারা এবং পরে হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় তুরাতে। অস্ত্র ট্রেনিং হয় ১৫ দিন আর সাতদিন ছিল জঙ্গল প্যারেড। ফায়ারিং, এলএমজি, গ্রেনেড থ্রো, এসএলআর চালানো শেখায়। এক্সক্লোসিভে আমি ছিলাম পারদর্শী। এফএফ নং ছিল-৯৫৫৬।

    “ট্রেনিং শেষে আমাদের ৯০ জনের দলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মহেশখোলায়। কমান্ড করতেন কাজী আলম। ডিপুটি কমান্ডার ছিলেন আব্দুস সালাম। কিছুদিন কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্বে ছিলাম।”

    কোথায় কোথায় অপারেশন করেছেন?

    “আমরা ছিলাম গেরিলা। ‘হিট অ্যান্ড রান’ ছিল নিয়ম। ১১ নং সেক্টরে যুদ্ধ করি নেত্রকোণার মদন, কেন্দুয়া এবং কিশোরগঞ্জের আঠারবাড়ি, বলাইশিমুল, কাওরাট এবং তারাইলের দরিজাহাঙ্গীরপুর, শৈলাহাটি, ধলা প্রভৃতি এলাকায়। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে রণক্ষেত্র থেকেও যেমন পালাতে দেখেছি আবার অনেক সহযোদ্ধার মৃত্যুযন্ত্রণাও দেখেছি খুব কাছ থেকে। একাত্তরে রাজাকাররা কত অত্যাচার করেছে সেটা না দেখলে বুঝতে পারবেন না। এ দেশটা তো এমনি এমনি স্বাধীন হয়নি!

    এক অপারেশনের কথা শুনি মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হেলালের জবানিতে:

    “ডিসেম্বর ৩ তারিখের ঘটনা। কিশোরগঞ্জ থেকে পাকিস্তানি সেনারা আসছে। খবর পেয়ে ওদের ঠেকাতে তারাইল বাজারের পাশে আমরা ফলিং করলাম। ওরা চার কিলোমিটার দূরে। জ্বালিয়ে দেওয়া বাড়িঘরের ধোঁয়া উড়ছে। কাছাকাছি আসতেই ফায়ার ওপেন করি। আইয়ুব আলী এলএমজি-ম্যান আর আমি এসএলআর চালাই। সামনে পুতিগাঙ্গ। ওরা ৬০ থেকে ৭০ জন। লাইন ধরে এগোচ্ছে। ওদের চাইনিজ রাইফেল গর্জে উঠলে আমার টিকতে পারি না। তবু গুলি চালাই। একসময় পেছনে চাইয়া দেখি আমাদের একজনও নাই। সবাই যে সরে গেছে টেরও পাইনি। পরে আমিও ক্রলিং করে শৈলাহাটি চলে আসি। সেদিন মিনিট বিশেক এদিক-ওদিক হলেই মারা পড়তে হত। জীবনটা কবরে রেখেই একাত্তরে যুদ্ধ করতে হইছে।’

    দেশ স্বাধীনের পর কিশোরগঞ্জ এসডিওর অফিসে অস্ত্র জমা দেন মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হেলাল। অতঃপর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই তিনি আবার মাঠে নামেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শুরু করেন দেশ গড়ার আরেক যুদ্ধ। গ্রামের সাধারণ মানুষকে নিয়ে মাটি কেটে রাস্তা, খাল তৈরি করা, রাস্তার পাশে শাকসবজি লাগানো ও মাছ চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরিতে উৎসাহিত করা, দরিদ্র মানুষকে স্যালো-মেশিন কিনে দেওয়ার মতো সামাজিক কাজে যুক্ত থাকেন।

    তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু তখন চেষ্টা করেছেন দেশটাকে দাঁড় করাতে। কিন্তু বড় বড় নেতা ও অনেক মুক্তিযোদ্ধারাও কিন্তু তাঁর পাশে ছিলেন না। তাঁরা শুধু নিজের স্বার্থ আর তেল মারাতেই ব্যস্ত ছিলেন। সেলফহেলফটা পছন্দ করতাম। আমি মনে করি, দেশের জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধার লড়াইটাও সারা জীবনের।”

    যে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করলেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?

    খানিকটা নীরব থেকে এই যোদ্ধা বলেন, “দেশ পেয়েছি কিন্তু স্বপ্নটা তো বাস্তব হয়নি। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তো বেড়েই চলেছে। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা কই? এখন দেখেন নেতারা দামি দামি গাড়িতে চড়ে, আলিশান বাড়িতে থাকেন। একটু ব্যাথা পেলেই ট্রিটমেন্টের জন্য ছোটেন সিঙ্গাপুরের দিকে। এই নেতারা কেমনে দেশের সেবা করবে, বলেন?

    মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে এই যোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়:

    “আমার এলাকায় ১৯৭১ সালের পর ১১৭ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা ছিল। এখন ভাতা তোলে দুইশর ওপরে। থানায় থানায় কমান্ডাররা এই আকামডা করছে। মুক্তিযোদ্ধা হইতে হলে আরও দুইজন মুক্তিযোদ্ধার রিকমেন্ড লাগে। ওরা তো কিছু টাকা পাইছে আর নাম ঢুকাইছে। চোরগুলোর কারণেই আজ এ অবস্থা। যাচাই-বাছাই সঠিকভাবে হওয়া দরকার। কিন্তু আপনি নিজেই যদি অসৎ হন তাহলে সঠিক তালিকা কীভাবে হবে?”

    দেশ কেমন চলছে?

    “শেখের মেয়ে তো ‘আয়রনম্যান’। তাই দেশটাকে ভালোই এগিয়ে নিতে পারছেন। তবে নেতাদেরও তাঁর মতো হওয়া দরকার। শুধু বিদেশি রিজার্ভ আর গার্মেন্টসের উপর ভর করলেই হবে না। কৃষিতে নজর আরও বাড়াতে হবে। দেশীয় উৎপাদনের ওপর নির্ভরতা গড়তে হবে।”

    স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন:

    “বিভিন্ন দিবসে সারা বাংলায় যখন লাল-সবুজের পতাকা উড়ে, এ দেশের ছেলেমেয়েরা কাজের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে যখন দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তখন আনন্দে বুক ভরে যায়।”

    খারাপ লাগে কখন?

    “যখন শুনি এমপিরা যুবকদের চাকরি দিচ্ছেন টাকার বিনিময়ে, যখন দেখি আজ এমপি তো কাল সে কোটিপতি বনে গেছেন, ছাত্র রাজনীতিতে ক্ষমতাশীল দলের ছাত্রনেতাও লক্ষ টাকার মালিক হচ্ছেন, তখন সত্যি খুব কষ্ট লাগে। দেশ ও মানুষকে বেঁচে টাকা কামানোর জন্য তো দেশটা স্বাধীন হয়নি!”

    যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে দেশের ইতিহাস যেমন দায়মুক্ত হয়েছে ঠিক তেমনি সব সমস্যা পেছনে ফেলে একদিন নতুন প্রজন্মের হাত ধরেই দেশটা সত্যিকারের সোনার বাংলা হবে– এমন স্বপ্নে বিভোর হন মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হেলাল। জীবনের এই ক্লান্তিলগ্নে বুকভরা আশা আর চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি শুধু বললেন:

    “আমরা দেশটা স্বাধীন করেছি। তোমাদের দায়িত্ব সে স্বাধীনতাটা রক্ষা করা। না খেয়ে থাকলেও দেশের ক্ষতি করো না। কারণ দেশটা মায়ের মতন। মাকে কষ্ট দিয়ে তুমি কখনই বড় মানুষ হতে পারবে না।”

    সংক্ষিপ্ত তথ্য:

    নাম: মুক্তিযোদ্ধা এ এস এম আকরাম হেলাল
    ট্রেনিং: ২১ দিনের ট্রেনিং করেন ভারতের তুরাতে। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ৯৫৫৬

    যুদ্ধ করেন: ১১ নং সেক্টরের নেত্রকোণার মদন, কেন্দুয়া এবং কিশোরগঞ্জের আঠারবাড়ি, বলাইশিমুল, কাওরাট এবং তারাইলের দরিজাহাঙ্গীরপুর, শৈলাহাটি, ধলা প্রভৃতি এলাকায়।
    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/45575
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:০০582822
  • যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৬৩– “স্বাধীন দেশের উন্নতিটাই আমার মন ছুঁয়ে যায়”
    সালেক খোকন

    “আমগো বাড়িডা ছিল নদীর পাড়ে। এলাংজানি নদী। ধলেশ্বরীর শাখা। বর্ষায় কোশা দিয়া স্কুলে যাইতাম। নৌকা ডুইবা একবার তো মরার দশা! তবুও জীবনের লগে নদী থাকত। নদীর বুকে নৌকা ভাসাইয়া পিকনিক করতাম, স্কুল থাইকা ফিরাই নদীত ডুবাইতাম। শরীরডা পানিতে ঠাণ্ডা হইলে ভরসা ছিল পাড়ের গরম বালি। উপুর হইয়া শুইয়া ওম নিতাম বালিতে।

    “মা আমারে ভালবাসত বেশি। ঢাকায় বেড়াইতে যাইতাম আত্মীয়র বাড়িতে। তহন ঘরে মুরগি রান্না হইলে মা আমার জন্য রাইখা দিত। নষ্ট হইয়া গেলেও কাউরে দিত না। অসুস্থ হইলে চোখের পানি ফেলত। তিন বোনের ছোড আমি। আদরও পাইতাম বেশি। বোনেরাও মায়ের মতন আদর করেছে। বুড়া হইছি। এহনও তারা ছোটবেলার মতন আদর করেন।

    “আগে বছরে একবার নাটক হইত। ‘রূপবান’ ও ‘গুনাই বিবির পালা’ । পুরুষরাই সাইজা নায়িকা হইত। এহন তো নাটক হয় না। দেশ আপটুডেট হইয়া গেছে। যাত্রাও উইঠা গেছে। ধর্মের কথা কইয়া বাউলগো তো মানুষ মাইরা খেদাইছে। অথচ রাত যাইগা সানসা আর আব্দুর রহমানের কত পালা দেখছি!

    “আমি তহন ক্লাস নাইনে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তান সরকার স্কুল-কলেজে মোজাহিদ ট্রেনিং দেয়। আমরা কইতাম ‘অস্ত্র ট্রেনিং’। টাঙ্গাইলের করটিয়া কলেজ ছিল সেন্টার। তহন ফাল্গুন-চৈত্র মাস। আমগো এক মাসের ট্রেনিং করায় পাকিস্তানি আর্মিরা। ১০ রাউন্ড গুলি চালাইছিলাম ট্রেনিংয়ে। পাকিস্তানি সেনাগো ওই ট্রেনিং একাত্তরে কাজে লাগে ওগোই বিরুদ্ধে।”

    শৈশব ও কৈশোরের নানা ঘটনার কথা শুনছিলাম যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. ছানোয়ার হোসেন তালুকদারের মুখে। তাঁর বাড়ি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কামুটিয়া গ্রামে। এক সকালে তাঁর বাড়িতে চলে নানা বিষয়ে আলাপচারিতা।

    আব্দুল মজিদ তালুকদার ও ডালিমন খানমের ষষ্ঠ সন্তান ছানোয়ার। বাবা ছিলেন পাটের ব্যবসায়ী। পাট কিনে প্রক্রিয়া করে মাল্লার নৌকায় তা নিয়ে যেতেন নারায়ণগঞ্জে। ছানোয়ারের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি নথখোলা প্রাইমারি স্কুলে। হাতেয়া রাজাবাড়ি হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর তিনি আইএসসিতে ভর্তি হন টাঙ্গাইল কাকমারি কলেজে (বর্তমানে মোহাম্মদ আলী কলেজ)। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ওই কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।

    টাঙ্গাইলে তখন বড় নেতা ছিলেন শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, খন্দকার আব্দুল বাতেন প্রমুখ। নেতারা স্কুল-কলেজের ছাত্রদের নানা বৈষম্যের কথা শোনাতেন। কাগজ তৈরি হত পূর্ব পাকিস্তানেই। অথচ সেটার দাম পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল কম, পূর্ব পাকিস্তানে ডাবল। অফিস-আদালতে বাঙালিরা বড় কোনো জায়গায় যেতে পারত না। যোগ্যতা থাকলেও কেন তারা বড় চাকরি পাবে না? এমন নানা প্রশ্ন তখন ঘুরপাক খেত ছানোয়ারের মনে।

    পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে যায়

    সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করলেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করে পাকিস্তানি শাসক দল। শুরু হয় অসহোযোগ আন্দোলন। অতঃপর আসে ৭ মার্চ ১৯৭১। গোটা জাতি তাকিয়ে থাকে বঙ্গবন্ধুর দিকে। বাকি ইতিহাস জানালেন ছানোয়ার। তাঁর ভাষায়:

    “আগেই খবর পাই শেখ সাহেব ভাষণ দিব ঢাকায়, রেসকোর্স ময়দানে। চিন্তা করলাম ভাষণ শুইনাই লঞ্চে কইরা চইলা যামু মুন্সিগঞ্জ। পুলিশের ওখানকার সিআই ছিলেন আমার কাকা। ওইদিন টাঙ্গাইল থাইকা রওনা দিয়া শাহবাগের ঘোড়দৌড় মাঠে পৌঁছাই দুপুরে। দেহি সবার হাতে হাতে লাঠি। বঙ্গবন্ধু কইলেই সবাই ঝাঁপায়া পড়ব। স্টেইজের খুব কাছেই ছিলাম। দুপুরের পরে মঞ্চে উঠলেন শেখ সাহেব। কইলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি… তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রুর মোকাবেলা করতে হবে…।’ এইডা তো ভাষণ না, স্বাধীনতার ডায়রেক্ট ডিক্লেয়ার। এহনো শুনলে মনে এনার্জি আইসা যায়।”

    ২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি আর্মিরা। কলেজে এসে ছানোয়ার জানেন সে খবর। ২৭ মার্চ ১৯৭১। ঢাকা থেকে আর্মিদের একটি দল টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহের দিকে যাবে। খবর পেয়ে বাঙালি ইপিআর ও অন্যরা প্রতিরোধ গড়ে পাকুল্লা বাসস্ট্যান্ডের পাশে সাটিয়াচোরা গ্রামে এবং নাটিয়াপাড়ায়। কিন্তু সশস্ত্র আর্মিদের ঠেকাতে পারে না। করোটিয়া বাজার পুড়িয়ে দিয়ে তারা ময়মনসিংহের দিকে চলে যায়।

    ছানোয়ার জানান নিজের অভিজ্ঞতা:

    “ওইদিন সাইদুর রহমান বাদলসহ করোটিয়া বাজারে আসি। বাজারেই এক মারোয়ারি ছিল। ঢোল আর ঝাড়ু দিত ও। তারে পুড়ায়া মারছিল আর্মিরা। নিজ চোখে দেখছি তার পেটটা পুড়ে মাটিতে পড়ে আছে। ওর পোড়া দেইখাই সিদ্ধান্ত নিছি যুদ্ধে যামু।”

    এরপর কী করলেন?

    “মে মাসের প্রথম দিকে যুক্ত হই কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। আমি যখন ঢুকি তহন যোদ্ধা ছিল দশের মতো। আগেই ট্রেনিং ছিল, কিন্তু প্রথম দিকে অস্ত্র পাইতাম না। অপারেশনে শুধু সাহায্য করতাম। গ্রামে গ্রামে টেনিং হইত। আমরাও থাকতাম। কাদের সিদ্দিকী ভারতে চলে গেলে আমরাও আত্মগোপনে থাকি। তহন মুসা নামের এক কোম্পানি কমান্ডারের লগে পরিচয় হয়। তাঁর লগেই হায়ার ট্রেনিংয়ের জন্য নদী পথে চলে যাই ইন্ডিয়ায়।”

    কোন সীমান্ত দিয়ে ভারতে গেলেন?

    “বাহাদুরাবাদ ঘাট, ফুলছড়ির ঘাট হয়ে ভারতের মাইনকার চরে গিয়া উঠি। ওখান থেকে ট্রাকে কইরা চইলা যাই তুরা পাহাড়ে। আমগো দেড়শ জনরে ২৮ দিনের ট্রেনিং দেওয়া হয় ওখানে। শফিউল ইসলাম, রেজাউল করিম, বাবলু, নাজির আহম্মেদ চৌধুরিসহ অনেকেই ছিল সঙ্গী।”

    ট্রেনিং শেষে ছানোয়াররা একশ জনের দল নিয়ে ফিরে আসেন কাদেরীয়া বাহিনীতে। সন্মুখ ও সশস্ত্র গেরিলা অপারেশন করেন ১১ নং সেক্টরের নাগপুর, কামুটিয়া, কালিহাতিসহ টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায়।

    এক অপারেশনে পিঠে গুলিবিদ্ধ হন এই সূর্যসন্তান। কয়েক বছর আগেও ওই ক্ষত স্থান দিয়ে নিয়মিত পুঁজ পড়ত। মাঝেমধ্যেই ব্যাথায় কুকড়ে যান তিনি। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট আর একাত্তরের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন ৬৮ বছর বয়স্ক এই মুক্তিযোদ্ধা। স্মৃতি হাতড়ে তিনি জানালেন একাত্তরের রক্তাক্ত ওইদিনটির আদ্যপান্ত।

    “নভেম্বরের শেষ দিক হইব। নাগরপুর থানায় ছিল পাকিস্তানি সেনাগো ঘাঁটি। আমরা ওইটা দখল করব। আমাগো সাথে ১২-১৩ জন। অন্যপাশে সবুর খানের সঙ্গেও আছে ১৩ জনের মতো। তিনদিক থেকে আমরা আক্রমণ করি। থানার পুব দিকে নিচুতে ধানখেতের আইলে পজিশনে ছিলাম আমরা। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলল দুইদিন। কমান্ড করেন কাদের সিদ্দিকী নিজেই। পাকিস্তানি সেনারা চাপের মুখে থাকে। ওগো নাওয়া-খাওয়াও বন্ধ হয়। সার্পোটিংয়ের জন্য ওরা তহন ওয়ারলেস করে টাঙ্গাইলে।

    ২ ডিসেম্বর ১৯৭১। টাঙ্গাইল থেকে দুই ট্রাক আর্মি আসে। খাদ্য ও অস্ত্র নিয়া ওরা নামে এলাসিন নদীর ঘাটপাড়ে। ওইদিকে ছিল আমগো দুইটা কোম্পানি। কিন্তু তারা ঠেকাতে পারে না। খবর পেয়ে দুপুর ২টার দিকে কাদের সিদ্দিকীসহ যাই ঘাটপাড়ে।

    “আমরা রেঞ্জের বাইরে দিয়া আইসা একটা খালের কাছে পজিশন লই। গোলাগুলি চলল তুমুল। ওগো একটা দল ঘাট পাড় থেকে ফায়ার দিচ্ছে। আরেকটা দল নিচে নেমে পিছন দিক থেকে অ্যাটাকের জন্য এগিয়ে আসে। কাদের সিদ্দিকী কয়, ‘ছানোয়ার দেখ তো ওরা কতটুকু আইল?’ আমরা ছিলাম টান জায়গায়। মাথা তুলতেই দেহি নিচের দিকে খুব কাছাকাছি ওরা চইলা আসছে। চিৎকার দিয়া কইতেই কাদের সিদ্দিকী স্টেনগান দিয়া তিনটা ব্রাশ মারে। ওরা কয়েকজন পড়ে যায়। আমিও ব্রিটিশ এলএমজি দিয়া গুলি চালাচ্ছি। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামে। আমগো গুলিও শেষের পথে। কাদের সিদ্দিকী কয়,‘তোরা ব্যাক কর আমি ঠেকাই।’

    “আমার গায়ে কালো শার্ট। একটু শীতশীত লাগছিল। ক্রলিং করে পেছনে এগোতে যাব। অমনি একটা গুলি এসে পিঠের একপাশে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। পিঠটা কামড়ে ধরে। কিছু বুঝিনি তহনও। প্রথমে উপুর হয়ে শুয়ে থাকি। উঠতে পারছিলাম না। একটু পরে পিঠে হাত দিতেই অনুভব করলাম রক্তে ভেসে গেছে। ভাবলাম মরেই যামু। নিশ্চয়ই গুলি লাগছে বুকে! একটু পরেই দমটা যাইব। মা আর বোনগো কথা খুব মনে হচ্ছিল। বাঁচার তখন তীব্র বাসনা। সাহস করে বুকে হাত দিলাম। না, ক্ষত পেলাম না। মনে সাহস আসল। হয়তো বাইচা যামু।”

    চিকিৎসা হল কোথায়?

    “ভাতিজা বজলুর রহমান ছিল পাশে। অন্যদের সাথে সে আমারে কাঁধে করে এক গ্রামে নিয়ে যায়। দুইটা পেনিসিলিন ইনজেকশন দেয় কাদের সিদ্দিকী নিজ হাতেই। কাপড় দিয়া ব্যান্ডেজ করে সকালে নৌকায় নেওয়া হয় এক চরে, চেয়ারম্যান বাড়িতে। ওখানেই ছিলাম। কয়েকদিন পরেই টাঙ্গাইল স্বাধীন হলে কুমুদিনী হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিন মাস চিকিৎসা চলে। বেঁচে গেছি, কিন্তু একাত্তরের যন্ত্রণাটা থাকব মৃত্যুর আগ পর্যন্তই। কয়েকবছর আগেও ক্ষত দিয়ে পুঁজ পরত। এহনও ক্ষত জায়গা আঙুল দিয়ে স্পর্শ করলেই প্রচণ্ড ব্যাথা মাথায় গিয়া লাগে। শ্বাসকষ্ট হয় খুব। এই কষ্টটা বুঝাতে পারমু না ভাই। তবুও দেশ স্বাধীন হইসে। এটাই শান্তি।”

    ১৯৭১ সালে কাদেরিয়া বাহিনীতে যুদ্ধ করলেও মুক্তিযোদ্ধা ছানোয়ার বর্তমানে খুঁজে পান না একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীকে। অকপটে তিনি বললেন:

    “রাজাকারগো মন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতি বানাইছে বিএনপি। তহন তো মনে হইছে কিয়েরে দেশ স্বাধীন করলাম? নিজামি আর মুজাহিদের গাড়িতে উড়েছে আমার দেশের পতাকা। মনে হইছে আত্মহত্যা করি! অথচ একাত্তরের কাদের সিদ্দিকী এহন সেই বিএনপির সাথে মিটিং করে। বাঘা কাদের সিদ্দিকী জামায়াতের টিভি চ্যানেলেও কথা বলতে সংকোচ করেন না। এটা দেখলে খারাপ লাগে ভাই। ওনাদের তো রাগ একটু বেশি। কারও পরোয়া করেন না। ওই রাগটাই খাইছে। আওয়ামী লীগে না থাকাটাই কাদের সিদ্দিকীর সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।”

    যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। বেশ কয়েকজনের রাজাকারের ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে জমে থাকা কষ্টগুলোও আজ উবে যাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এই বীরযোদ্ধা বলেন:

    “আমার ভাই মোস্তাফিজও যুদ্ধে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরে আসেননি। টাঙ্গাইলের এক অপারেশনে শহীদ হন। স্বাধীন দেশে দেখলাম রাজাকারগো উত্থান। আর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ কইরা দুঃখ নিয়া টিকে ছিল কোনোরকম। সেই মুক্তিযোদ্ধাগো দুঃখের দিন কাটিয়ে দিয়েছে শেখের মাইয়া। একাত্তরে রাজাকাররা যে পাপ করছে সে পাপের শাস্তি ফাঁসি দিলেও কম হবে। জেলা পর্যায়ে সব রাজাকারগোও বিচার হওয়া উচিত। স্বাধীন দেশে চাই সব হত্যারও বিচার হোক।”

    কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে। টাঙ্গাইলে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে মুক্তিযোদ্ধা ছানোয়ার বলেন:

    “১৯৭৩ সাল থেকে ভাতা পাই। তখন তালিকাটা চূড়ান্ত করতে পারলে ভালো হত। এরপর তো টাকা দিলেই মুক্তিযোদ্ধার সনদ মিলত। গ্রামে গ্রামে গিয়ে কোন কোম্পানিতে কতজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল যাচাই করে তখন সনদ দিলে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে বির্তক থাকত না। এখনও মুক্তিযোদ্ধাগো যাচাই-বাছাই হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রিয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান টাঙ্গাইলে বসে কি যাচাই-বাছাই করছেন তা-ও মানুষ দেখছে! আমাদের জন্য এটা লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের নামে সারা দেশে টাকাপয়সার লেনদেন কঠোরভাবে ঠেকাইতে হবে। তা না হলে এ নিয়ে বির্তক থেকেই যাবে।”

    যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন, স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?

    খানিক নিরব থেকে মুক্তিযোদ্ধা ছানোয়ারের উত্তর, “দেশ পাইয়াও পাই নাই। আমরা মনে করেছিলাম, গরিব মানুষের উপকার হবে। ভেদাভেদ থাকবে না। কিন্তু তা তো রয়েই গেছে। বড়লোক বড়লোকই আর গরিব গরিবই রইছে।’

    কী করলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে?

    “সঠিক ও সৎ নেতৃত্ব থাকতে হবে। শেখ হাসিনা যথেষ্ট করতেছেন। তাঁর তো চাওয়া-পাওয়ার কিছু নাই। দেশে কত দুর্যোগ গেছে, কিন্তু তবুও তাঁর নেতৃত্বে দেশ সঠিক পথেই আছে। নেতাকর্মীদের দুর্নীতি আর অপকর্মের কঠিন শাস্তি দিতে পারলে দেশটা সত্যি পাল্টে যাবে।’

    স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাললাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন:

    “দেশ আগে কী ছিল? এখন দেখেন কেমন? ডিজিটাল হয়ে সবকিছু সহজ হয়ে গেছে। পৃথিবীটা হাতের মুঠোয়। স্বাধীন দেশের উন্নতিটাই আমার মন ছুঁয়ে যায়।”

    যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. ছানোয়ার হোসেন তালুকদার মনে করেন প্রজন্মকে সৎ ও সঠিকভাবে তৈরি করাটাই আমাদের দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশের নানা উৎপাদনমুখী কাজে প্রজন্মকে নিয়োজিত করতে পারলেই দেশ এগোবে। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি শুধু বললেন:

    “আমার মুক্তিযোদ্ধারা রক্ত দিয়ে দেশের স্বাধীনতা এনেছি। সেই স্বাধীন দেশটাকে সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বটা তোমাদেরই নিতে হবে।’

    সংক্ষিপ্ত তথ্য:

    নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. ছানোয়ার হোসেন তালুকদার

    ট্রেনিং: ২৮ দিনের ট্রেনিং করেন ভারতের তুরাতে

    যুদ্ধ করেন: ১১ নং সেক্টরের নাগপুর, কামুটিয়া, কালিহাতিসহ টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায়

    যুদ্ধাহত: ২ ডিসেম্বর ১৯৭১। টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানা অপারেশনের সময় এলাংজানি নদীর ঘাটপাড়ে এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি তাঁর পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে যায়।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/45106
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:০৩582823
  • যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৬২– “মুক্তিযুদ্ধে গুলি খাইছি, এইডা কতবার প্রমাণ করতে হইব?”
    সালেক খোকন

    “ট্রেনিং তখন শেষ। আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় মাগুরার শ্রীপুরে, আকবর চেয়ারম্যানের কাছে। তাঁর অধীনে ছিল মুক্তিবাহিনীর একটি দল। আমরা যোগ দিতে দলটি বড় হয়; সব মিলিয়ে ২০০ জন। ছোট ছোট গ্রুপ করে আমরা অপারেশন করি। নবুয়া, আহম্মদ, ভিকু, রাজ্জাক, সুধীর বিশ্বাসও ছিলেন আমাদের দলে।

    “রাজাকাররা অত্যাচার করত খুব। যুবতীদের ধরে নিয়ে ক্যাম্পে দেওয়া আর লুটপাট করা ছিল তাদের প্রধান কাজ। শ্রীপুর থানার ভেতরে কিছু রাজাকার তখন অবস্থান করছিল। থানার চারপাশ আমরা নিয়ন্ত্রণে নিই। ওরা ভেতরে। আকবর চেয়ারম্যান প্রথমে তাদের আত্মসমর্পণ করার কথা বললেন। প্রত্যুত্তরে তারা গুলি ছুড়ে। আমরাও পাল্টা জবাব দিই। অল্প সময়ের মধ্যেই গুলি করতে করতে থানা দখল করে নিই। ওই অপারেশনে মেলে অনেকগুলো অস্ত্র। এভাবেই চলছিল অপারেশনগুলো। নিরাপত্তা বলে কিছু ছিল না। যে কোনো সময় শক্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয় ছিল। একবার হলও তাই।

    “শ্রীপুর তামান্না স্কুলের ভেতর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা রেস্ট নিচ্ছিল। রাজাকাররা এ খবর পৌঁছে দেয় পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে। ওরা এসে ঘিরে ফেলে স্কুলটিকে। অতঃপর নির্মমভাবে হত্যা করে দশজন মুক্তিযোদ্ধাকে। তাদের লাশগুলোর দিকে তাকাতে পারিনি। কারও চোখ উড়ে গেছে, কারও বুক বেয়নেটের আঘাতে রক্তাক্ত। এখনও মনে হলে বুকটা ছেক করে ওঠে।”

    মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নানা ঘটনার কথা বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কুমার বিশ্বাস।

    তাঁর বাড়ি মাগুরা সদর উপজেলার পথের হাট গ্রামে। বাবার নাম বেনুয়ারি বিশ্বাস ও মা সরলা বিশ্বাস। চার ভাই ও দুবোনের সংসারে চৈতন্য সবার ছোট। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কোয়ারী হাই স্কুলে। পরে তিনি ভর্তি হন সত্যজিতপুর হাই স্কুলে। ওই স্কুলেই তিনি পড়েন ক্লাস নাইন পর্যন্ত।

    ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে চৈতন্যর বেশ খ্যাতি ছিল। হায়ারে খেলতে যেতেন বিভিন্ন উপজেলায়। একবার ভাইদের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য হয়। রাগ হয়ে চৈতন্যও তখন বাড়ি ছাড়েন। চলে যান যশোর শহরে। সেখানে কাজ নেন এক দোকানে। যা পেতেন তাই দিয়ে চলছিল তাঁর জীবন।

    কিন্তু সে জীবনেও ঝড় ওঠে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কারণে। চৈতন্য বলেন:

    “আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। দেশের খবর জানতাম মানুষের মুখে মুখে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিও শুনি রেডিওতে। তিনি বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি…. এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণই আমার কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা।”

    মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার ঘটনাটির কথা জানান এই মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ভাষায়:

    “২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় আর্মি নামে। তারা গণহত্যা চালাতে থাকে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। মার্চের শেষ দিকেই সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাওয়ার। সঙ্গে ছিলেন তিন বন্ধু। মান্দাতলা গ্রাম দিয়ে আমরা সীমান্তে যাচ্ছিলাম। ওই গ্রামের অনেক বাড়িঘরই জ্বলছিল তখন। এক লোক চিৎকার করে দৌড়ে কাছে এসেই বললেন, পাকিস্তানি আর্মিরা তাঁর ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে। তিনি পাগলের মতো কাঁদতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনারা সামনে থাকতে পারে, এমন চিন্তা করে ভয়ে তখন সঙ্গে আসা দুই বন্ধু সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেন। নিজের কথা ভেবে তাঁরা ফিরে যায় নিজ গ্রামে।

    “কিন্তু আমি সিদ্ধান্তে অটল থাকি। পাকিস্তানি সেনাদের চোখ এড়িয়ে কীভাবে বর্ডার পাড় হব? সে চিন্তা করছিলাম। ওই সময় মুচি সম্প্রদায়ের এক দল লোক যাচ্ছিল ভারতের দিকে। তাদের দলের সঙ্গে আমি মিশে যাই। পাকিস্তানিদের চোখ এড়িয়ে বাগদা সীমান্ত দিয়ে চলে আসি ভারতের গুগরা শরণার্থী ক্যাম্পে। সেখান থেকে আসি টালিখোলায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ওখানেই রিক্রুট করা হচ্ছিল। আমিও লাইনে দাঁড়ালাম। কিন্তু লম্বা না হওয়ায় আমাকে বারবার বাদ দিয়ে দেয়। অনুরোধ করেও ফল হয় না। শেষে যুদ্ধে যাওয়ার তীব্র আগ্রহ দেখে আমার নাম লিখে নিল ক্যাম্পের লোকেরা। সেখানে লেফট-রাইট চলল বিশ দিনের মতো। অতঃপর আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতে, বিহারের চাকুলিয়ায়। এসএলআর, এলএমজি, থ্রি নট থ্রি, গ্রেনেড, এক্সক্লুসিভসহ নানা বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয় ২৮ দিন। আমার এফএফ নং ছিল ৯৯৯।”

    ট্রেনিং শেষে মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কুমার বিশ্বাস অপারেশন করেন ৮ নং সেক্টরের শ্রীপুর, মোহাম্মদপুর, আরোয়াকান্দি প্রভৃতি এলাকায়। ওই সেক্টরের কমান্ডার তখন মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর। চৈতন্যরা ছিলেন গেরিলা। দিনের বেলায় আত্মগোপন করে থাকতেন। রাত হলেই চলত অপারেশন। পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়াই ছিল গেরিলাদের প্রধান কাজ।

    এক অপারেশনে এই সূর্যসন্তান বাঁ পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। গুলিটি বের করা গেলেও পয়জন ছড়িয়ে পরে গোটা পায়ে। তাই স্বাধীনতার পরেও চৈতন্যর যুদ্ধ থামে না। লড়াই চলে পাটিকে টিকিয়ে রাখার। অনেক কষ্ট আর চিকিৎসার পরও বাঁ পায়ে গুলিবিদ্ধ জায়গাটিতে ইনফেকশন হয়ে তা ছড়াতে থাকে। একসময় পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। ফলে ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ডাক্তাররা তাঁর বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলেন।

    কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন এই বীরযোদ্ধা? প্রশ্ন শুনে চৈতন্য প্রথমে আবেগ আপ্লুত হন। অতঃপর বলেন:

    “আমরা তখন রাজাপুর গ্রামের জয় গোপালের বাড়িতে। সেখানে ইয়াকুবের নিয়ন্ত্রণে ছিল মুক্তিবাহিনীর একটি দল। তাদের সঙ্গে যোগ দিই আমরাও। সব মিলিয়ে দেড়শ জন মুক্তিযোদ্ধা। থাকি মোহাম্মদপুরের পলাশ বাড়িতে।

    “নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের কথা। পরিকল্পনা হয় মোহাম্মদপুর থানা আক্রমণের। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। মধ্যরাতে রওনা দিয়ে আমরা থানার চারপাশে অবস্থান নিই। পাশেই সিও অফিস। তার ভেতরে ছিল একটি পুকুর। পুকুরের পাশেই ফাঁকা জায়গা। ভোরে পাকিস্তানি সৈন্যরা গোসল করতে আসবে ওই পুকুরে। ফাঁকা জায়গা থেকে আমরা তখনই আক্রমণ করব ওদের ওপর। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। একটা গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কমান্ডার আমাদের সংকেত দিবেন।

    “পরিকল্পনা মতো আমরা অ্যাডভান্স হই। গ্রেনেডের শব্দ পেয়েই সবাই ফায়ার ওপেন করি। গোলাগুলি শুরু হতেই ভেতর থেকে পাকিস্তানি সেনারাও আমাদের দিকে গুলি ছোড়ে। বৃষ্টির মতো গুলি চলছিল। চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় দুই যোদ্ধা। ছোট ভাই মোহাম্মদকে বাঁচাতে গিয়ে মারা পরেন আহাম্মদও। ভোর পর্যন্ত চলে গোলাগুলি।

    “আমি গাছের আড়াল থেকে গুলি চালাচ্ছি। পাশেই আতিয়ার। তাকে ডাকতাম ‘পাগলা আতিয়ার’ বলে। হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একটি গুলি এসে লাগে আমার পায়ে। প্রথমে টের পাই না। পাশ থেকে আতিয়ার বলে, ‘তুমি গুলি খাইছ।’ বাঁ পায়ের দিকে চোখ পড়তেই দেখি রক্তে ভেজা। হাঁটুর নিচের দিকটাতে ঢুকে গেছে গুলিটি। আমি পরোয়া করি না। তখনও শক্রুর দিকে গুলি চালাচ্ছি। এক ফাঁকে শরীরের চাদরে বেঁধে নিই পাটা। কিন্তু রক্ত তখনও ঝরছিল। এভাবে একসময় গোটা শরীরটাই শীতল হয়ে যায়। আমি লুটিয়ে পড়ি মাটিতে।

    “অন্যরা কাভারিং ফায়ার করলে পাগলা আতিয়ার তখন আমাকে কাঁধে তুলে নেয়। পেছনে সরে এসে আমাকে শুইয়ে রাখে গ্রামের ভেতরের এক বাঁশঝারে। পানির জন্য আমি ছটফট করছিলাম। এক সহযোদ্ধা বলল, ‘ওকে পানি দিস না। পানি খেলেই তো ও মারা যাবে।’”

    সহযোদ্ধারা বাঁশে বেঁধে চৈতন্যকে নিয়ে যান ডাংগাপাড়ায়। সেখানে ছিলেন এক গ্রাম্য ডাক্তার, নাম বজলু। তিনিই তাঁর পা থেকে গুলি বের করে আনেন। পর্যাপ্ত ওষুধ না থাকায় তখন গুলিটি বের হলেও ক্ষত স্থান থেকে পয়জন ছড়াতে থাকে। চৈতন্য ডাংগাপাড়া গ্রামে ছিলেন এক মাস। সেখানেই খবর পান দেশ স্বাধীনের।

    কেমন লেগেছিল ওইদিন?

    “কি যে আনন্দ লেগেছিল ভাই! গুলি খাওয়ার কষ্টের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ঘরের ভেতর ছিলাম শোয়া অবস্থায়। স্বাধীনতার খবর পেয়ে বাইরে বেরুতে চাইলাম। সহযোদ্ধারা আমাকে তুলে নিয়ে উঠোনে শোয়ায়। তৃপ্তি নিয়ে দেখলাম স্বাধীন দেশের মুক্ত আকাশটাকে। বিড়বিড় করে গাইলাম: ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি…।’”

    যুদ্ধাহত হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কুমরা বিশ্বাস ভাতা পাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই। মেডিকেল বোর্ড ফেস করেছেন কয়েকবার। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চুয়াল্লিশ বছর পর এই ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধাহত ভাতা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় গত জুলাই মাস থেকে।

    মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মাগুরা জেলা ইউনিট কমান্ডার মোল্লা নবুয়ত আলী স্বাক্ষরিত একটি পত্র পৌঁছে দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে। পত্রটিতে ১৫ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভুয়া যুদ্ধাহত হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ইন্ডিয়ান ট্রেনিং, ডিসচার্জ, মুক্তিবার্তার নম্বর ও বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে ভাতা পাওয়ার পরও অজ্ঞাত কারণে মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্যের নামটিও তুলে দেওয়া হয় সেখানে।

    কিন্তু কেন?

    মুঠোফোনে মাগুরা জেলা ইউনিট কমান্ডার মোল্লা নবুয়ত আলীর সঙ্গে কথা হয়। এ বিষয়ে কোনো যৌক্তিকতা তুলে ধরতে না পারলেও তিনি স্বীকার করেন, “এটা আমাদের ভুল হয়েছে। উনি প্রকৃত যুদ্ধাহত। তদন্তের সময় আমরা ঠিক করে নিব।”

    এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কষ্ট নিয়ে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে গুলি খাইছি, এইডা কতবার প্রমাণ করতে হইব বলেন? কত পরীক্ষা দিতে হইব? ভুলে ওরা আমায় ভুয়া বানালো, এর দায়টা কে নিবে? অনেক আগেই এ তালিকা চুড়ান্ত করা প্রয়োজন ছিল। দেশকে শক্রমুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি, কোনো সুবিধা পাওয়ার আশায় নয়। অথচ সুবিধালাভের আশায় আজ অমুক্তিযোদ্ধারাও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। আগে ‘কল্যাণ ট্রাস্ট’ ছিল। এখন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় হয়েছে। কিন্তু সঠিক তালিকা কই হচ্ছে? কমান্ডাররা তো বুঝে বা না বুঝে প্রকৃতদেরই আজ ভুয়া বানাচ্ছে। তাহলে সঠিক তালিকা হইব কীভাবে?”

    তিনি মনে করেন এদেশে মুক্তিযুদ্ধ একবারই হয়েছে। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সরকার পরিবর্তনের পর পরই হালনাগাদ করার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু যাচাইবাছাই করে তালিকাটি চূড়ান্ত করে ফেলা। তিনি বলেন, “এটা তো ভোটার তালিকা নয় যে, বারবার হালনাগাদ করতে হবে।”

    যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে চৈতন্য কুমার বিশ্বাস অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি।
    তাঁর ভাষায়:

    “তারা দেশের যে ক্ষতি করেছে বিচার তো আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে জিয়া ও তাঁর দল যুদ্ধাপরাধীদের স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী করেছে। এটা ছিল চরম অপমানের। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের গোপালগ্রাম ইউনিয়নের আফজাল হোসেন চেয়ারম্যান ছিল রাজাকার। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। কোনো বিচার হয়নি তার। বরং আওয়ামী লীগের পতাকা তলে রাজনীতি করছেন। এটা তো রাজনীতির জন্য খুবই ক্ষতিকর। বিচার দেরিতে হলেও একজন রাজাকার ও খুনি সাধু হয়ে যায় না। খুনিরা খুনিই থাকে।”

    বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

    “বঙ্গবন্ধু অবশ্যই উদার মনের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তবু ছোট ছোট অপরাধের মাফ না করে তাদেরও শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল।”

    আমাদের কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্যের বড় ছেলে চঞ্চল বিশ্বাসের সঙ্গে। বিএডিসিতে চাকুরি করছেন তিনি। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পিতার সন্তান হিসেবে গর্ব বোধ করেন। বললেন, “আমার বাবার মতো মুক্তিযোদ্ধারা রক্ত না দিলে এই দেশটা স্বাধীন হত না। পাকিস্তানের কাছে দেশ পরাধীন থাকত। তাদের আদর্শে সততার সঙ্গে আমরাও কাজ করতে চাই দেশের জন্য। প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের ঐক্যবদ্ধ থাকা। তাহলেই দেশ সঠিক পথে থাকবে।”

    দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে চলবে। মায়ের ভাষায় কথা বলবে। মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে বাস করবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন দেশেরই স্বপ্ন দেখতেন মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কুমার বিশ্বাস। কিন্তু স্বাধীনের পর এদেশে যখন নিজেদের মধ্যে হানাহানি দেখেন তখন কষ্টে নীরব হয়ে যান এ বীরযোদ্ধা। তিনি বলেন:

    “সরকার তো ভালোই থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক দলের চ্যালাফ্যালারা দলের ১২টা বাজিয়ে দেয়। সরকার যদি সাধারণ মানুষের কথা, দেশের কথা চিন্তা করে কাজ করে তবে দেশটা অবশ্যই অন্যরকম হবে।”

    স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালোলাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। মুচকি হেসে চৈতন্য বলেন:

    “সারা পৃথিবী এখন বাংলাদেশের প্রশংসা করে। আমরা এখন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নই। যুদ্ধাপরাধীর বিচার থামাতে মার্কিন মন্ত্রীর টেলিফোনকেও শেখের মাইয়া পরোয়া করে নাই। বাংলাদেশ এখন একটা সাহসি নাম। অর্থনীতিতেও উন্নত হচ্ছে। এটা ভাবলেই মন ভরে যায়।”

    খারাপ লাগে কখন?

    “যখন দেখি মানবতা নাই। মানুষ মানুষকে খুন করছে, মন্দিরে আগুন দিচ্ছে ধর্ম রক্ষার নামে। কই একাত্তরে তো সবাই কাধে কাধ মিলিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলাম। ধর্ম রক্ষা বলে তো তখন কিছু ছিল না। সেটাই যদি মানুষ মেনে নিত তাহলে তো বাংলাদেশের জন্মই হত না।”

    পরবর্তী প্রজম্মের হাত ধরেই এ দেশ হবে উন্নত বাংলাদেশ। এমনটাই বিশ্বাস যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কুমার বিশ্বাসের। তাদের উদ্দ্যেশে তিনি বলেন:

    “তোমরা নিজেদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত থাকবে। দেশপ্রেম আর আদর্শই তোমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। রক্তে পাওয়া এই স্বাধীন দেশে তোমরাই আলো জ্বালাবে।”

    সংক্ষিপ্ত তথ্য:

    নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা চৈতন্য কুমার বিশ্বাস

    ট্রেনিং: ২৮ দিনের ট্রেনিং করেন বিহারের চাকুলিয়ায়। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ৯৯৯

    যুদ্ধ করেন: ৮ নং সেক্টরের শ্রীপুর, মোহাম্মদপুর, আরোয়াকান্দি প্রভৃতি এলাকায়

    যুদ্ধাহত: নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ৮ নং সেক্টরের মোহাম্মদপুর থানা অপারেশনের সময় তিনি বাঁ পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। গুলিটি বের হলেও পয়জন ছড়িয়ে পরে গোটা পায়ে। একসময় পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/44649
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:০৯582824
  • যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের কথা জানলাম
    ০৫ মার্চ ২০১৭, ০০:৪০

    যাদের বয়স এখনো ১৮ হয়নি। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। কেমন করে জেনেছে তারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সে কথাই তুলে ধরা হলো।

    স্বাধীনতার ডাক
    অদিতি মজুমদার

    ছোটবেলায় কোনো এক মার্চ মাসে টেলিভিশনে দেখেছিলাম, একজন মানুষ আঙুল নেড়ে বলে যাচ্ছেন। প্রায় সময় তাঁকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যেত। তখনো বুঝিনি উনি কে এবং তাঁর কথা। শুধু দাদুকে বলতাম, ‘দাদু, আপনাকে টিভিতে দেখাচ্ছে!’ দাদু কথাটা শুনে হাসত আর বলত, ‘ওনার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন।’ তখনো ভালোমতো বুঝতে শিখিনি বলে বুঝতে পারিনি এ ডাক আবার কিসের ডাক!
    বয়স আরেকটু বাড়তেই যখন সবকিছু বুঝতে শুরু করলাম, তখনই বুঝতে পারলাম স্বাধীনতা ঘোষণার তাৎপর্য। সে সময় ঠাকুরমা ও ঠাকুরদার কণ্ঠে শুনেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে হায়েনাদের নৃশংসতার কথা। তারা বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে দাদু যে ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করত, সেখানে কিছু পাকিস্তানি দালাল দাদুকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। অগত্যা মে মাসে দেশ ছেড়ে বাবা আর বড় পিসিকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যায় দাদু। দাদু ঠাকুরমাকে রেখে যায় পটিয়ার একটি বড়ুয়া পাড়ায়। তখন আমার গর্ভবতী ঠাকুরমার সঙ্গে ছিল মেজো কাকা ও তিন পিসি। ঠাকুরদার মুখে শুনেছি কত কষ্ট করে নৌকায় চড়ে, হেঁটে তাঁকে ভারত পৌঁছাতে হয়েছিল। সেই সঙ্গে চলতি পথে দেখতে পাওয়া হায়েনাদের বর্বরতার কথাও শুনেছি ঠাকুরদার কাছে। আর ঠাকুরমা বলতেন রেডিওতে প্রতিদিন খবর শুনে কতটা ভয় আর আতঙ্কে তাঁদের দিন কাটত। এভাবেই ঠাকুরমা আর ঠাকুরদার কাছ থেকেই আমার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পাঠ নেওয়া।
    এরপর বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পাঠ্যবইয়ে পড়েছি মুক্তিযুদ্ধের কথা। শুধু পাঠ্যবইয়ের অল্প কিছু অংশ পড়ে যেন মন ভরছিল না। তাই ধীরে ধীরে হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমণি, দেয়াল, জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি, আনিসুল হকের মা, জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাশেদ, সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেডসহ আরও বেশ কিছু বই পড়ে অনুভব করলাম মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা।
    চট্টগ্রাম

    চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল
    আরাফাত চৌধুরী

    ছোটবেলায় একদিন বাবা আমাকে বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত শিল্পকলা একাডেমির অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমি দেশাত্মবোধক গান গেয়ে প্রথম পুরস্কার অর্জন করেছিলাম। সেদিন বাবা খুব খুশি হয়েছিল। অনুষ্ঠানের শেষে সবাইকে একটি ডকুমেন্টারি দেখানো হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের একটি বিখ্যাত ডকুমেন্টারি দেখে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়েছিল। কিন্তু আমি ভিডিওর কোনো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বাড়ি ফিরেই বাবার কাছে জানতে চাইছিলাম, বাবা আমাকে নিয়ে বসে বলতে লাগলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের ঘটনা, পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা ও বর্বরতার বীভত্স ইতিহাস। বাবার কাছ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। এরপর কেন যেন আমার মনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানার তৃষ্ণা আরও বেড়ে গেল। একদিন বাবা আমাকে আমার জন্মদিনে তিনটি বই উপহার দিয়েছিলেন। বই তিনটি ছিল আমার বন্ধু রাশেদ, জোছনা ও জননীর গল্প, একাত্তরের দিনগুলি। বই পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আমি সানন্দে বই তিনটি চার দিনে পড়ে শেষ করে ফেললাম। এরপর যখন সুযোগ পেয়েছি, তখনই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার চেষ্টা করেছি। ক্লাস এইটে পড়ার সময় স্কুলের বন্ধুরা মিলে একজন মুক্তিযোদ্ধার মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সত্য কাহিনি শুনব বলে িঠক করলাম। যেই ভাবা, সেই কাজ। অধ্যক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সবকিছু আয়োজন করে ফেললাম। আমাদের পার্শ্ববর্তী জেলায় থাকত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, আমরা তাঁকে আমাদের স্কুলে আমন্ত্রণ জানালাম। তিনিও বেশ খুশি মনে রাজি হয়ে গেলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বীরত্বপূর্ণ বিভিন্ন অভিযানের ঘটনা তিনি আমাদের জানালেন।
    কুমিল্লা

    থ্রি নট থ্রি
    তথাপি আজাদ

    ‘বড় ভাইয়ের লাশ বাড়িতে আসার পর শুনলাম “থ্রি নট থ্রি” রাইফেলের গুলি ডান চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমি তখন অত কিছু বোঝা শিখিনি। শুধু এইটুকু বুঝলাম, বড় ভাইকে পাকিস্তানিরা ভয়ংকরভাবে মেরেছে।’
    চোখ বড় বড় করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনছিলাম। তাঁর চোখে জল দেখেও কৌতূহল সামলাতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেলি, ‘তারপর?’
    মুক্তিযুদ্ধও নাকি এমনই ছিল। নেশার মতো। জয় ছিনিয়ে না আনা পর্যন্ত বাঙালি ক্ষান্ত হতে পারেনি। তাহলে সেই যুদ্ধের গল্পে তো আমার কৌতূহল হবেই। বাবা অবশ্য সে আশা অপূর্ণ রাখেননি। কিনে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ওপর অসংখ্য বই। কোনোটা পড়তে গিয়ে গা শিউরে উঠেছে আবার অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাস্ত হওয়ার কাহিনি পড়ে আনন্দে নেচে উঠেছি। মনে মনে ভেবেছি, ‘ইশ্! পাকিস্তানিরা কী বোকাটাই না ছিল! বোকা না হলে কি বীর বাঙালির সঙ্গে লড়তে আসে?’
    তবে আমার বন্ধু রাশেদ চলচ্চিত্র দেখে মনে হয়েছিল পাকিস্তানিরা বোধ হয় পিশাচ ছিল। তাই তো তাদের হত্যার তালিকা থেকে কেউই বাদ যায়নি। ছোটবেলা থেকেই বাবা বলে এসেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ দেখোনি তুমি। তাই বাঙালি হিসেবে তোমার প্রধান কর্তব্য হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকে অক্ষরে অক্ষরে জানা। অনুভব করা। তবেই দেশের প্রতি তোমার মমতা জন্মাবে। দেশকে ভালোবাসতে পারবে।’
    তাই যেখানেই কোনো মুক্তিযোদ্ধা দেখি, দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে তাঁর কথা শুনি। বই পড়ে যতটা অনুভব করি, তারচেয়ে নিজ চোখে মুক্তিযুদ্ধ দেখা এবং স্বজন হারানো মানুষের গলার স্বর, চোখের কোণে জমা জল দেখলে বেশি আক্ষেপ হয়। কেন একাত্তরে আমি ছিলাম না! মাঝে মাঝে ভাবি, পৃথিবীর বুকে তো মুক্তিযোদ্ধারা চিরদিন থাকবেন না। কেউ চাইলেও তাঁদের একবার ছুঁয়ে দেখতে পারবে না। কিন্তু আমি সৌভাগ্যবান। ছুঁয়ে দেখতে পেরেছি মুক্তিযোদ্ধাদের আর শুনতে পেরেছি মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস।
    রাজশাহী

    আমার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা
    মিনহাজ আহমদ

    ছোট থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও এর ইতিহাস সম্পর্কে আমি জেনেছি বেশ কিছু আলাদা মাধ্যম থেকে।
    বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বিভিন্ন শ্রেণিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং এর মূল্যবোধ, ইতিহাস সম্পর্কে বেশ কিছু গল্প, প্রবন্ধ, রচনা রয়েছে, যা পড়ে আমি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জেনেছি এবং সে বিষয়ে বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আলোচনা থেকেও অনেক ঘটনা ও পরিস্থিতি উঠে এসেছে, যা আমাকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে।
    আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি পারিবারিক আড্ডায় অথবা জিজ্ঞেস করা হলে নানা সময়েই তাঁর মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্মৃতিচারণা করতেন এবং তখনকার ঘটনা বলতেন। তাঁর গল্পাকারে বলা ঘটনাগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময়ের আক্ষরিক অবস্থা সম্পর্কে আমার ধারণাগুলো আরও স্পষ্ট করেছে।
    সারা বছর, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত দিবসগুলো পালনের সময় টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে অনুষ্ঠান, পত্রপত্রিকায় লেখা, দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়, যা শুনে এবং দেখে আমি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জেনেছি।
    মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও সে সময়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা নানান ইতিহাস, উপন্যাসের বই আমাকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বিভিন্ন বাস্তব ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা জানিয়েছে, যা আমার মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে।
    তবে জানার আছে এখনো অনেক কিছু।
    কিশোরগঞ্জ

    বাবা গল্প বলা শুরু করলেন
    সুনন্দিতা চৌধুরী

    মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমি প্রথম জেনেছিলাম তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়। তখন আমাদের পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি অধ্যায় ছিল। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের আগের ঘটনা ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালের বর্ণনা সংক্ষিপ্তভাবে লেখা ছিল।
    যদিও ওই অধ্যায় পড়েই আমি প্রথম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জেনেছিলাম, তবুও অত ছোট বয়সে ওই লেখা পড়ে আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারিনি। তাই বাবার কাছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলাম।
    বাবা মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা শুরু করলেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণ, ভোটে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করার পরেও তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণ, পঁচিশে মার্চ রাতে নিরীহ মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের ঝাঁপিয়ে পড়া, ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ভূমিকা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা, ভারতের সহযোগিতা, ষোলোই ডিসেম্বরে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের ঘটনাসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি ঘটনার বিশদ বিবরণ দেন বাবা। তাঁর কাছ থেকেই প্রথম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা পেয়েছিলাম।
    পরবর্তী সময়ে জাতীয় দিবসগুলোতে স্কুলের অনুষ্ঠান, পত্রিকার বিশেষসংখ্যা, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আয়োজন থেকেও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি।
    একটু বড় হয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা অনেক বই পড়েছি। জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি পড়ে মনে হয়েছে, আমিই এখন ১৯৭১ সালের অনিশ্চিত দিনগুলো পার করছি, একাত্তরের চিঠি পড়ে মনে হয়েছে, প্রতিটি শহীদই আমার পরম আপনজন, আনিসুল হকের মা পড়ে মুক্তিযুদ্ধকে অন্যভাবে অনুধাবন করেছি। তবে গল্পে গল্পে সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জেনেছি হুমায়ূন আহমেদের স্যারের জোছনা ও জননীর গল্প বইটি পড়ে।

    http://www.prothom-alo.com/pachmisheli/article/1097374/%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%A5%E0%A6%BE-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:১২582825
  • খেতাববঞ্চিত এক বীরের কথা
    পুষ্পেন চৌধুরী, লোহাগাড়া
    ০৫ মার্চ ২০১৭, ০১:২৯

    খেতাববঞ্চিত এক বীরের কথা
    একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশে যে অসংখ্য বীরের জন্ম দিয়েছে, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার আমিরাবাদের সন্তান মেজর নাজমুল হক ছিলেন তঁাদের একজন। রাষ্ট্রীয় বীর খেতাব না পেলেও জনতার কাছে তিনি একজন প্রকৃত বীর
    লোহাগাড়ার আমিরাবাদে ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় শহীদ মেজর নাজমুল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় l প্রথম আলো
    লোহাগাড়ার আমিরাবাদে ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় শহীদ মেজর নাজমুল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় l প্রথম আলো
    মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগের কথা। ১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ ৭ ইপিআর উইংয়ের অধিনায়ক করে মেজর নাজমুল হককে পাঠানো হয় নওগঁায়। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে সারা দেশ তখন ফুঁসছে ক্ষোভে। পাকিস্তানি শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছে জনতা।
    এমন পরিস্থিতিতে পাঞ্জাবি উইং কমান্ডার মেজর আকরাম কোনো বাঙালির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরে প্রথমে রাজি হননি। পরে বাধ্য হয়ে তিনি মেজর নাজমুল হককে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় গণহত্যার মাধ্যমে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। নওগঁায় সে খবর পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে নাজমুল হক স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ২৬ মার্চ নওগঁা মহকুমা মুক্তাঞ্চল ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় তঁার মুক্তিযুদ্ধ।
    একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশে যে অসংখ্য বীরের জন্ম দিয়েছে, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার আমিরাবাদের সন্তান মেজর নাজমুল হক ছিলেন তঁাদের একজন। রাষ্ট্রীয় বীর খেতাব না পেলেও জনতার কাছে তিনি একজন প্রকৃত বীর। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে তিনি সম্মুখযুদ্ধেই কেবল অংশ নেননি, একই সঙ্গে স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন লড়াই করার জন্য। ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল—দশম খণ্ড ও মেজর রফিকুল ইসলামে লেখা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বইতে শহীদ মেজর নাজমুলের বীরত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
    ১৯৩৮ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার আমিরাবাদ গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম তঁার। বাবা হাফেজ আহমেদ ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। তিন ভাইয়ের মধ্যে নাজমুল ছিলেন দ্বিতীয়। শিক্ষাজীবন শুরু করেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। কুমিল্লার ঈশ্বর পাঠশালা থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট) ভর্তি হন। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।
    মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর বেঁচে ছিলেন তিনি মাত্র ছয় মাস। এই ছয় মাসে সাত নম্বর সেক্টরের অধীনে সমগ্র রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা, দিনাজপুর ও রংপুরের কিছু এলাকায় অসংখ্য অভিযান পরিচালনা করেন। ইপিআর সদস্য ও স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে নিয়ে নওগঁা ও বগুড়ার সেনা ক্যাম্পে হামলা করেন তিনি। শত্রুমুক্ত করেন সমগ্র বগুড়া জেলা। এরপর গ্রহণ করেন রাজশাহী ও চঁাপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত করার পরিকল্পনা।
    বগুড়া ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯১ আইএপি (ইনডিপেনডেন্ট এমুনেশন প্লাটুন)। রংপুরে অবস্থিত ২৩ ব্রিগেডের যাবতীয় গোলাবারুদের সঞ্চিত রাখা হতো এখানেই। মেজর নাজমুল হক প্রথমে এই প্লাটুনের গোলাবারুদ যেন শত্রুর নিয়ন্ত্রণে না যায় তা নিশ্চিত করেন। এরপর বিস্তৃত অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ছাত্র ও যুবকদের সংগঠিত করতেন। কাছাকাছি কোনো স্কুলের মাঠে চলত প্রশিক্ষণ পর্ব। মুক্তিযুদ্ধকে একটি গণযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকেই তিনি প্রথম থেকে উদ্যোগী ছিলেন।
    মেজর নাজমুল হক যে ৭ নম্বর সেক্টরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সেই সেক্টরে প্রায় ১৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেন। নিয়মিত বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই হাজার এবং সাড়ে বারো হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন গণবাহিনীর সদস্য। এই সেক্টরের আটটি সাব–সেক্টর ছিল। প্রতিটি সাব-সেক্টরের অপারেশনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকতেন। অনেক সময় তিনি নিজেই অভিযানে নেতৃত্ব দিতেন।
    ১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনাসংক্রান্ত শিলিগুড়িতে একটি বৈঠক থেকে ফেরার পথে দুর্গম পাহাড়ি পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মেজর নাজমুল। পরবর্তী সময়ে মেজর কাজী নুরুজ্জামান সাত নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
    মেজর নাজমুল হক মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা না পাওয়ায় হতাশ তঁার পরিবারের সদস্যরা। এ ব্যাপারে মেজর নাজমুল হকের চাচাতো ভাই এস এম মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘আমরা শহীদ সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুলের স্মৃতি রক্ষায় তঁার নামে ১৯৮৮ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি। ভবিষ্যতে এই বিদ্যালয়কে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিণত করার ইচ্ছে রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের অর্থায়নে তঁার নামে একটি পাঠাগারও চালু হলেও এটি নিয়মিত খোলা থাকে না। এসব ছাড়া তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো সম্মাননা পাননি। ফলে মুক্তিযুদ্ধে তঁার অবদানও যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়নি বলে আমরা মনে করি।’
    মেজর নাজমুল হকের মেয়ে নওরীন সাবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবা যখন মারা যান তখন আমরা খুব ছোট। বাবা আমাদের দুই বোনকে খুব আদর করতেন। আমার বাবা একজন সেক্টর কমান্ডার হলেও তঁাকে সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। অথচ তিনিই একমাত্র সেক্টর কমান্ডার, যিনি যুদ্ধকালীন শহীদ হয়েছিলেন। তিনি এ দেশেরই গর্ব। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেলে আমরা বর্তমান সরকারের নিকট কৃতজ্ঞ থাকব।’
    মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক চৌধুরী শহীদ কাদের প্রথম আলোকে জানান, একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে নাজমুল হক ছিলেন দক্ষ সংগঠক। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে তঁার পরিবারের সদস্যদের কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ জানানো হতো না।
    লোহাগাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আখতার আহমদ সিকদার বলেন, ‘একজন সেক্টর কমান্ডার দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া সত্যিই দুঃখজনক। আমাদের দাবি, চট্টগ্রামের তৃতীয় কর্ণফুলী সেতুটি তঁার নামে হোক। আমরা চাই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্ম জানুক এবং এ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন হোক।’
    মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মাহফুজুর রহমানকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রথম আলোকে তিনি জানান, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মেজর নাজমুলের বীর উত্তম খেতাব পাওয়া উচিত ছিল। রাষ্ট্রের উচিত এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে যথাযথ সম্মান জানানো।
    http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1097707/%E0%A6%96%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%AC%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A4-%E0%A6%8F%E0%A6%95-%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%A5%E0%A6%BE
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:১৯582826
  • আমার একুশে চিত্রাবলি
    মুর্তজা বশীর
    ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৫:১২

    একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার আমি প্রত্যক্ষ সাক্ষী, সেজন্য আমি গৌরবান্বিত। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনের জন্য আমি পাঁচটি স্কেচ করেছিলাম ১৯৫৩ সালে। তখন একুশের ঘটনা যেভাবে আমার মনে রেখাপাত করেছিল, এসব তারই চিত্রাবলি। যদিও শিল্পগুণে এগুলোর শৈল্পিক মান নেই, তবু ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে অমূল্য বলে আমার ধারণা। তবে গুলিতে উড়ে যাওয়া রফিকের খুলি, মাথার মগজ সযত্নে স্টেশনের একপাশে রাখা ও সালামের গুলিতে ফাটা বাঁশের মতো হাঁ করা দৃশ্য ছিল এমনই হৃদয়বিদারক ও বিভীষিকাময়, যে সেটা আঁকিনি।

    সকাল ১০টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম, তখন ছাত্রজমায়েত তেমনভাবে হয়ে ওঠেনি। মাঝেমধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই—এ ব্যানার নিয়ে টুকরো টুকরো মিছিল ছাত্রদের বলিষ্ঠ পদধ্বনিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা মুখরিত করে তুলেছে। রাস্তায় পুলিশ ট্রাকভর্তি। রোদ তেতে উঠেছে মাথার ওপর। পুলিশের মাথায় গোল খাকিরঙা পশমি টুপি বেয়েই কাত করে পরা।
    আমতলায় মিটিং শুরু হয়েছে। সবার চোখেমুখে ঠিকরে পড়েছে একটি প্রশ্ন—কী হবে, কী করব এখন। গুঞ্জন ছিল ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে না। নেতারা বক্তৃতা দেন, এখন মিছিল করে অ্যাসেম্বলি হলের দিকে যাওয়া মানেই গন্ডগোলের সম্ভাবনা, তাতে আমাদের কোনো লাভ হবে না। ছাত্ররা ক্ষেপে উঠল শুনে, চিৎকার করে বলে, বিশ্বাসঘাতক। আমরা ফিরব না। মিষ্টি কথা শুনতে আসিনি। ক্রুদ্ধ চিৎকার ও টিটকারিতে থেমে যায় বক্তার আওয়াজ।

    এমন সময় জটলার ভেতর থেকে একজন সামনে রাখা টেবিলের ওপর উঠে বলেন, পাঁচ-দশজন করে বেরিয়ে অ্যাসেম্বলি হলের দিকে যাবে। হাত ধরাধরি করে ছাত্ররা বেরিয়ে এল। এমন সময় হলো লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার পালা।
    মেডিকেল হোস্টেলের ছাত্রাবাসের চারদিকে ছিল কাঁটাতারের বেড়া। এগুলো ছিল পাকিস্তান হওয়ার আগে গোড়া সৈনিকদের আবাসস্থল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এগুলো নির্মিত হয়েছিল। তার আগে সেখানে ছিল আমবাগান। এখানে অবাঙালি এক ফকির বাস করত। কালো কুচকুচে গায়ের বর্ণ, সারা গায়ে তেল চপচপে, তাই তার নাম ছিল তেলি শাহ। বর্তমানে মেডিকেল কলেজ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়, পরে যুদ্ধের সময় রূপান্তরিত হয় হাসপাতালে। ব্যারাকগুলো ছিল পুব-পশ্চিমে সিঁথির মতো সরু লাল ইটের রাস্তার দুই ধারে সারি সারি। কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় পুলিশের দিকে ছাত্ররা দিচ্ছে অনবরত স্লোগান, ‘এমএলরা বেরিয়ে আসো, সভ্যপদ থেকে পদত্যাগ করো।’

    লাঠিচার্জে আহতদের অনেকে ধরাধরি করে হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে নিয়ে চলল, কাউকে বা হাঁটু গেড়ে বসে ধরল। এগুলো ছিল গ্রন্থের জন্য স্কেচ। তবে সৃজনশীল হিসেবে প্রথমে আমি উল্লেখ করতে চাই ‘রক্তাক্ত একুশে’ চিত্রটি। লিনোকাটে উৎকীর্ণ এই চিত্রটির দুটি ভার্সন আমি করেছিলাম। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পর তিন-চার মাসের মধ্যেই এ দুটি রচনা করি। এখন যেটা বহুল প্রচারিত, সেটা ছিল প্রথম রূপ। এই লিনোকাটি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত গ্রন্থে ছাপা ছিল না। তবে দ্বিতীয় রূপটি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল।

    দুই লিনোকাটের প্রধান পার্থক্য হলো—গুলিবিদ্ধ ছাত্রকে যে ছাত্র ধরেছে, তার ডান হাতে প্ল্যাকার্ডটি থাকলেও দ্বিতীয় চিত্রটিতে তা নেই। তার জামার বুকপকেটে কলম, যা প্রথম চিত্রটিতে ছিল না। প্রথম ছবিটির ডান দিকের নিচে ‘এস’ ও ‘বি’ দুটি আদ্যক্ষর অর্থাৎ মুর্তজা বশীর একসঙ্গে খোদিত, কিন্তু অন্যটিতে নেই। তবে প্রথম ছবিটি আঁকতে গিয়ে যেভাবে লিনোকাটে আঁচড় ও অক্ষরের বিন্যাস করা হয়েছে, দ্বিতীয়টিতে তা অনুপস্থিত। মূলত আমার প্রকাশভঙ্গির সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরার জন্যই একই বিষয় ও ভঙ্গির দুইভাবে আঁকা হয়েছে। এই লিনোকাটের কম্পোজিশনকে সৈন্য ও ছাত্রজনতার মুখোমুখি লড়াইকে তুলে ধরা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। এখানে সৈনিকের রূপ ঘোষণার জন্য বেয়নেট লাগানো বন্দুক ও ব্রেনগানের নল এবং ছাত্র-জনতাকে বোঝানোর জন্য মাটিতে পড়ে থাকা খোলা বই ও একজোড়া নগ্ন পায়ের পাতা আঁকা হয়েছে। এই লিনোকাটই প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে দ্বিতীয় সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত বর্ধমান হাউসে অনুষ্ঠিত চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, এই চিত্রটি ছাড়া আর কোনো শিল্পকর্ম একুশের ওপর ছিল না।

    ‘রক্তাক্ত একুশে’ লিনোকাট ছাড়া আরও দুটি ড্রইংও উল্লেখ করার মতো। দুটিই ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আঁকা। এক কিষান-কিষানি দানবসুলভ এক জন্তুকে প্রতিহত করছে। চেক লুঙ্গি পরিহিত মানুষটির ডান হাতে উঁচিয়ে ধরা বল্লম, বাঁ হাতে তাকে প্রতিরোধ করে রয়েছে। কিষানির ডান হাতে কাস্তে এবং বাঁ হাতে উঁচু করে ধরা বাংলা বর্ণমালার প্ল্যাকার্ড। বাংলা কৃষিপ্রধান দেশ। তাই কিষান-কিষানিকে আমি বাংলার গণমানুষের প্রতিনিধি রূপে দেখানোর চেষ্টা করেছি। দ্বিতীয় ড্রইংটি বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক শহীদ মিনারের পাদদেশে এই বীভৎস জন্তু ভূলুণ্ঠিত। জন্তু হিসেবে আমি চিত্রায়িত করেছি ডাইনোসরকে। কিন্তু যে ডাইনোসরকে আমি চিত্রিত করেছি, তা মাংসাশী নয়, তৃণভোজী। তবু এর বিশাল ভয়ংকর রূপকে পাকিস্তানি আগ্রাসনের রূপক হিসেবে ব্যবহৃত করেছি। এর আগে বাঙালি জাতির ওপর একাত্তরে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটনা ঘটবে, তা হয়তো একজন শিল্পী হিসেবে দূরদর্শন করেছিলাম ‘জননী ভূলুণ্ঠিত’ নামে ১৯৬৯ সালে আঁকা এক স্কেচে।

    একাত্তরের প্রথম ড্রইংটি ছাপা হয়েছিল জহির রায়হান সম্পাদিত ইংরেজি সাপ্তাহিক দ্য এক্সপ্রেস পত্রিকায় এবং অন্যটি ছাপা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতি সংসদের চটি পুস্তিকা ‘সোনার হরিণ চাই’তে। শেষের ড্রইংটি ছাপা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের নিবেদিত ‘একুশে স্মরণে’ পুস্তিকায়। আরও কিছু বিক্ষিপ্ত ড্রইং করেছি, কিন্তু তার হদিস জানা নেই।

    আজ একুশে চেতনা কোথায়? যদিও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি, এটুকুই সান্ত্বনা পাওয়ার মতো অর্জন। কিন্তু সেই চেতনা যে অপস্রিয়মাণ তা একটি ড্রইংয়ে প্রকাশ করেছিলাম। শহীদ চত্বর থেকে শহীদ মিনার পাখি হয়ে দূর আকাশে হারিয়ে যাচ্ছে। বেদির মাঝখানে লাল সূর্য থেকে বাংলার চেতনা ঝরে পড়ছে। জননী বাংলাদেশ ফুলের অর্ঘ্য নিয়ে একপাজো বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে। ড্রইংটি ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর একুশের ক্রোড়পত্রের প্রারম্ভের অলংকরণ ২০০৭-এ।
    (লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর বিশেষ সংখ্যায়)

    http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1085221/%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A6%BF
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:৩২582827
  • কিছু তারবার্তা ও একজন ‘রহস্যময়’ নুরুজ্জামান…
    অমি রহমান পিয়াল

    এএনএম নুরুজ্জামান আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একজন। বীর উত্তম খেতাবধারী। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সফিউল্লাহ যখন ৩ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব ছেড়ে নবগঠিত সেনাব্রিগেড ‘এস’ ফোর্সের দায়িত্ব নেন, তখন তার জায়গায় সেক্টর কমান্ডার হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন নুরুজ্জামান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অত্যন্ত আস্থাভাজন নুরুজ্জামানকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত জাতীয় রক্ষী বাহিনীর। দুজনের জানাশোনাটা পুরানো। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী ছিলেন নুরুজ্জামান। তখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন।

    ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর রাতে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকারের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থানটি হয়, তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন নুরুজ্জামান। ৬ নভেম্বর তার বাসা থেকে সামরিক পোশাক বদলে, তারই জামা-কাপড় পরে বের হন খালেদ মোশাররফ এবং সাভার যাওয়ার পথে গ্রেফতার ও পরে নিহত হন।

    ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশে ছিলেন না। তিনি যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পথে লন্ডনে ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি দেশে থাকলে রক্ষী বাহিনী হয়তো এতটা হতোদ্যম অবস্থায় থাকত না। তার বন্ধু ও সাবেক সহচর কর্ণেল (অব.) আনওয়ার-উল-আলম এ বছরের ১৪ মার্চ ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত এক স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন, মোশতাক সরকার নুরুজ্জামানকে দেশে ফিরতে বাধা দিলেও তিনি কৌশলে ফিরে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি দিতে সেনাবাহিনীর ভেতরে জনমত গড়ে তোলেন।

    এ পর্যন্ত তথ্যগুলো ঠিকই আছে, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ১৯৭৫ এবং ১৯৭৬ সালের কিছু তারবার্তা পড়ার পর চাইলেই ব্যাপারটার দিকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যেকার এই অতিগোপন বার্তাগুলো আগস্ট এবং নভেম্বরে নুরুজ্জামানের সত্যিকার অবস্থান রহস্যময় করে তোলে। দেরি না করে সেদিকেই বরং যাওয়া যাক।

    প্রথম তারবার্তাটি ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ সালের। রাষ্ট্রদুত ইউজিন বোস্টারের পাঠানো এই বার্তায় বলা হয়েছে, রক্ষীবাহিনীর প্রধান (ডিরেক্টর জেনারেল) এএনএম নুরুজ্জামান ১১ আগস্ট, সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছেন। তার ভিসার জন্য আবেদনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়লের তরফে লেখা হয়েছে, নুরুজ্জামান অফিশিয়াল ডিউটিতে যুক্তরাষ্ট্র যাচ্ছেন। তার অফিশিয়াল ডিউটি কী ধরনের জানতে চাইলে আমাদের বলা হয়, তিনি সেখানে একমাসের শিক্ষা সফরে যাচ্ছেন। এরপর দশদিনের ছুটি কাটাবেন। যতদূর জানা গেছে. নুরুজ্জামান সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কারও সঙ্গে থাকবেন।

    আনওয়ারউল হক তার মেমোয়ারে লিখেছেন, ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানের পর নুরুজ্জামান সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান। ৭ নভেম্বর পরবর্তী সরকার তার দেশে আসায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ভারত থেকে পরে তার আত্মীয়-স্বজনের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন নুরুজ্জামান। এর আগ পর্যন্ত ভারতে তিনি বাংলাদেশে আক্রমণ করার জন্য একটি বাহিনী সংগঠিত করছিলেন বলে জানা যায়।

    এখানে একটু বলা দরকার, ৭ নভেম্বরের পর খালেদ মোশাররফ ও তাঁর অনুগতদের অবস্থা সম্পর্কে। শেরে বাংলা নগরে দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দপ্তরে গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁকে। সঙ্গী ছিলেন স্রেফ বেড়াতে এসে কমান্ডারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী কর্নেল হায়দার এবং কর্নেল নাজমুল হুদা। তাদের লাশ ফেলে রাখা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের সামনের মাঠে। লাশে থুতু দেয় বিপ্লবী সৈনিকরা।

    সশস্ত্র বাহিনীতে খালেদের অনুসারীদের ভাগ্য সম্পর্কে জানা যায় ১৯৭৫ সালের ১৯ ডিসেম্বরের একটি তারবার্তায়। সেখানে যা বলা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত রূপ:

    ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলীর পর সশস্ত্র বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফেরাতে তৎপর হয়েছেন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থরা। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফকে সহায়তা দেওয়ার জন্য বিমান বাহিনীর ৮ জনকে গ্রেফতার ও দণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেদিন সকালে মিগ ২১ নিয়ে আকাশে ওড়া স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও পরে তা মওকুফ করেছেন এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব। চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর কিছু অফিসার এবং বেস কমান্ডার রউফকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেনাবাহিনীতে খালেদ এবং জাসদ অনুগতদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এ পর্যন্ত ঠিক কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাদের ভাগ্য সম্পর্কে সঠিক জানা যায়নি।

    সে হিসেবে ভাগ্যবান বলতেই হবে শাফায়েত জামিল এবং নুরুজ্জামানকে। বঙ্গভবনের দেয়াল টপকে পালানোর সময় পা ভেঙে যায় জামিলের। এরপর তিনি মুন্সিগঞ্জে ধরা পড়েন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেই সিএমএইচেই তার চিকিৎসা চলে যার বাইরে বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের লাশ। শাফায়েত জামিলের ব্যাপারে এই সিদ্ধান্ত দেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। নুরুজ্জামানের ভাগ্যও একই রকম ভালো বলে আমরা জানতে পারি আমাদের আলোচ্য পরবর্তী তারবার্তায়। জানতে পারি কার উদ্যোগে তিনি গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে।

    ১৯৭৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ফরেন অফিসে হেনরি কিসিঞ্জার বরাবর পাঠানো তারবার্তায় বোস্টার যা লিখেছেন তার সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ এমন:

    ১৯ তারিখ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেন আমাকে ফোন করে একটি অতিগোপন অনুরোধ রাখার ইচ্ছে জানান। জাতীয় রক্ষী বাহিনীর সাবেক প্রধান এএনএম নুরুজ্জামান ভারতে আশ্রয় নেওয়াদের একজন। সেখানে বাংলাদেশে অভ্যুথানের জন্য একটি বাহিনী গঠন করছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অভিভূত হয়ে তিনি ভারত ত্যাগ করার ইচ্ছে জানিয়েছেন। সরকারও তাই চাইছে। যেহেতু তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, তাই যুক্তরাষ্ট্রে তাকে বছর খানেকের জন্য কোনো ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হোক যাতে পরে তাকে ফিরিয়ে এনে কোনো কূটনৈতিক পদে কাজে লাগানো যায়। তাকে ইংল্যান্ডে পাঠানোর কথাও ভাবা হয়েছিল। কিন্তু (সেখানে বাঙাালি অভিবাসীদের সংখ্যা বিশাল বলে) কর্তৃপক্ষ রাজি হয়নি। তবারক অনুরোধ করেন যাতে সিআইএ নুরুজ্জামানকে তাদের তত্ত্বাবধানে নেয় এবং কোনো মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর খানেকের জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেয়।

    বোস্টার জানান, তিনি অনুরোধটা জায়গামতো জানাবেন। তবে এর সমস্যাগুলোও তুলে ধরেন, বিশেষ করে নুরুজ্জামানকে ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মার্কিন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে যা বিব্রতকর। তবারক বলেন ব্যাপারটা বাংলাদেশ সরকারই সামাল দেবে। এটা এমনভাবে সারা হবে যাতে অস্বাভাবিক মনে না হয়। অন্য দশজন বিদেশি ছাত্রের মতোই নুরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাবেন। তার পড়াশোনার খরচের ব্যাপারে তবারক জানান যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমস্যা হলে বাংলাদেশ সরকার তা বহন করবে।

    এই প্রসঙ্গে দিল্লীর মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্নেইডার সরাসরি আপত্তি জানিয়ে যে বার্তাটি পাঠান তাতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে বিতর্কিত নুরুজ্জামানকে যুক্তরাষ্ট্র বাদে অন্য কোনো দেশে পাঠানো। অস্ট্রেলিয়া বা ফিলিপাইনের মতো নিরপেক্ষ দেশের নাম সুপারিশ করে স্নেইডার জানান, নুরুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে গেলে ভারত সন্দেহ করবে, ঠিক কতটা সন্দিগ্ধ তারা হবে সেটা মাপার জো নেই।

    ২৭ জানুয়ারি হেনরি কিসিঞ্জারের ফিরতি তারবার্তাটি থেকে আমরা জানতে পারি মার্কিনিদের এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই, তবে ভারত থেকে আমেরিকা যাওয়া এবং তার পড়াশোনার খরচ বাংলাদেশ সরকারকেই ব্যবস্থা করতে হবে। আমেরিকার বাংলাদেশ মিশন নুরুজ্জামানের পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করবে এবং প্রয়োজনে তাদের সাহায্য করা হবে। তবে কিসিঞ্জার দিল্লির সুপারিশমতো অস্ট্রেলিয়া ফিলিপাইন বা অন্য কোনো দেশের ব্যাপারটিও বিবেচনা করার জন্য ঢাকাকে অনুরোধ করেন।

    ২৮ জানুয়ারি বোস্টার এই বিষয়ে ফিরতি তার দেন। সেখানে লেখা হয়:

    তবারক হোসেন জানিয়েছেন পুরো ব্যাপারটা অতি-গোপনীয় বলেই এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ মিশনের কাউকে জড়িত করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি একই প্রেক্ষাপটে অন্য কোনো দেশেও তাকে পাঠানো যাচ্ছে না। কারণ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এই গোপন তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। পুরো ব্যাপারটা খুব কম মানুষই জানে। বাংলাদেশে জেনারেল জিয়া, মিসেস নুরুজ্জামান (দিল আফরোজ জামান) যিনি এ বিষয়ে স্বামীর হয়ে মধ্যস্থতা করছেন এবং তবারক হোসেনই জানেন বিষয়টা এবং তা আর কেউ জানুক তারা চান না। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধর্ণা দেওয়ার একটাই কারণ যে, গোপনীয় বিষয় এবং সম্পূরক ব্যাপারগুলো সম্পর্কে তাদের উপর আস্থা রাখা যায়।

    এরপর ৫ ফেব্রুয়ারির একটা বার্তায় জানা যায় যে, বোস্টার তবারককে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা দেন যা দেখে তবারক উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, মাঝ বছরে কোনো প্রতিষ্ঠান নুরুজ্জামানকে ভর্তি নেবে কিনা। সে ক্ষেত্রে তারা যাতে নেয় সে রকম কোনো ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান তিনি। ‘নুরুজ্জামান কেস’ শিরোনামে ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলের অনেকগুলো বার্তা কার্ড উইড্রন বা আবারও গোপনীয় হয়ে গেছে। কিছু তারবার্তা মুছে ফেলা হয়েছে এর স্পর্শকাতরতা বিচারে।

    ১২ আগস্ট লন্ডন থেকে জানানো হয় নুরুজ্জামান সম্ভবত ২১ জুলাই ইংল্যান্ড ত্যাগ করেছেন, তবে তা নিশ্চিত করা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রে নুরুজ্জামান পৌঁছেছেন কিনা এ নিয়ে বোস্টারের তদারকির উত্তরে ২০ আগস্ট জানা যায় যে বিষয়টির অতি-গোপনীয়তা (কনফিডেনশিয়াল হ্যান্ডেল) বাংলাদেশ দুতাবাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার জন্য একটি বাধা।

    এরপর আরও কিছু বার্তা বিনিময়ের পর ২৫ আগস্ট পাঠানো এক টেলিগ্রামে কিসিঞ্জারের তরফে নিশ্চিত হওয়া গেছে নুরুজ্জামান চার সপ্তাহ হল পৌঁছেছেন, থাকছেন ভগ্নিপতি হুমায়ুন কবিরের সঙ্গেই। তবে এই মুহূর্তে পূর্ব আমেরিকায় ঘুরতে গেছেন। সে দেশে পড়াশোনার ব্যাপারটি তিনি ভাবছেন। কিসিঞ্জার বলেন, ব্যাপারটিতে মার্কিন সরকারের আর জড়িত থাকার দরকার নেই, বাংলাদেশই এখান থেকে চালিয়ে নিতে পারবে।

    নুরুজ্জামান দেশে ফিরেননি আর। বিদেশেই কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন মিশনে। ১৯৯৩ সালের ১৫ মার্চ সুইডেনের স্টকহোমে মৃত্যু হয় তার। ফলে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে তার এই গোপন সমঝোতায় তার ভাষ্যটা আমাদের আর জানা হয় না। জানা হয় না কীসের পুরস্কার দিয়েছেন জিয়া তাকে বা কী হতে পারে সেটা। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে অন্তর্ঘাত? তাঁর গাড়ি এবং গন্তব্য জানিয়ে দেওয়া? কে জানে!

    অনুমান দিয়ে গল্প হয়, ইতিহাস হয় না। তবে নিশ্চিতভাবে পঁচাত্তরের আগস্ট ও নভেম্বরের প্রেক্ষাপটে নুরুজ্জামানকে বিতর্কিত আরোপ দেওয়ার মশলা আমরা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছি। বি জেড খসরু তার ‘বাংলাদেশ মিলিটারি ক্যু অ্যান্ড দ্য সিআইএ লিংক’ বইয়ে জিয়া-নুরুজ্জামানের গোপন সমঝোতার উল্লেখ করেছিলেন।

    আমি প্রমাণও দিয়ে দিলাম।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/21944
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:৩৭582828
  • জামায়াতে ইসলামী যে কারণে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন
    অমি রহমান পিয়াল

    রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ বড্ড জটিল জিনিস। সাধারণ নাগরিকদের তা বোধে আসে না। মুক্তিযুদ্ধে যে মানুষটি তার স্বজনদের হারিয়েছে, বোনকে ধর্ষিতা হতে দেখেছে, তাকে রাজনৈতিক মলম দিয়ে সব ভুলে যাওয়ার আশ্বাস দেওয়া এক রকম ধৃষ্টতা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠানে যে স্থবিরতা চলছে তাতে এবার নতুন ফতোয়া যোগ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে আদালত যখন (কাদের মোল্লার রায়ে) উল্লেখ করে দেন, তখন সংগঠনটির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের নাগরিক দাবি উপেক্ষা করে সম্প্রতি ভিন্ন সুর শোনানো হচ্ছে ক্ষমতাসীন মহলের তরফে।

    যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে থাকা একজন মাঠকর্মী হিসেবে আমার জন্য তা এক বিশাল হতাশা হয়ে এসেছে। কারণ আমি যেই যুক্তিতে আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দেখি, একই যুক্তিতে জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীনতাবিরোধী একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দেখি। মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে, একইভাবে জামায়াতে ইসলামী একাত্তরে এদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটে রাজনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি সশস্ত্র সহযোগিতা দিয়েছে।

    badr-ed
    মুখে বললেই তো হয় না। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই প্রমাণ লাগে। আমার দাবির স্বপক্ষে আমি তুলে ধরছি কিছু প্রমাণ। প্রথমেই বলা দরকার মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের ভিন্নতা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী যতই ঘোট পাকানোর চেষ্টা করুক, দুটো একই জিনিস। যুদ্ধাপরাধের মধ্যেই রয়েছে হত্যা, ধর্ষণ, উচ্ছেদ ইত্যাদি মানবতাবিরোধী অপরাধ। এখানে ভিকটিমরা সশস্ত্র বা সামরিক বাহিনীর সদস্য নয়, বেসামরিক লোকজন, যারা যুদ্ধের পক্ষ নয় কিন্তু যুদ্ধকালে হিংস্রতার শিকার।

    একইভাবে যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যেই রয়েছে ঘাতক ও দালালের সংজ্ঞাও । দালাল তারাই যারা মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সব ধরনের সহায়তা করেছে, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমর্থনের মাধ্যমে। ঘাতক তারাই যারা পাকিস্তোনদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনে মেতেছে। তাই জামায়াত সদস্যদের ঘাতক ও দালাল বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী বলা হয়নি, এটা হচ্ছে মূর্খের দাবি, যা অল্পশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিতদের কনভিন্স করবে। অবশ্য জামায়াত বরাবরই এদেশে শিক্ষায় অনগ্রসর অংশটাকে পুঁজি করে যা-তা বুঝিয়ে ফায়দা লুটেছে। সময় এসেছে সেই মিথ্যাচারের মুখোশ খোলার।

    1(3)
    ১৯৭৩ সালে যে আইনটি করা হয়েছিল সেটা পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী ও তাদের এদেশীয় দালাল দু’পক্ষের কথা মাথায় রেখেই করা। এর আগে ’৭২ সালের দালাল আইনে যে বিচার চলছিল তা ছিল এদেশীয় আইন। এই বিচারকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতেই স্পেশাল ট্রাইবুনাল অ্যাক্ট করা হয়। সেই আইনের শুরুতেই স্পষ্ট করে লেখা আছে–

    ACT NO XIX OF 1973*

    An Act to provide for the detention, prosecution and punishment of persons for genocide, crimes against humanity, war crimes and other crimes under international law

    [Published in the Bangladesh Gazette, Extra., on July 20, 1973]

    Whereas It is expedient to provide for the detention, prosecution and punishment of persons for genocide, crimes against humanity, war crimes and other crimes under international law and for matters connected therewith;

    It is hereby enacted as follows :

    1. Short title, extent and commencement.

    (1) This Act may be called the International Crimes (Tribunals) Act 1973.
    (2) It extends to the whole of Bangladesh.
    (3) It shall come into force at once.

    2. Definitions.

    In this Act, unless there is anything repugnant in the subject or context.-

    (a) ‘auxiliary forces’ includes forces placed under the control of the Armed Forces for operational, administrative, static and other purposes;
    (b) ‘Government’ means the Government of the People’s Republic of Bangladesh;
    (c) ‘Republic’ means the People’s Republic of Bangladesh;
    (d) ‘service law’ means the Army Act, 1952 (XXXIX of 1952), the Air Force Act, 1953 (VI of 1953) or the Navy Ordinance, 1961 (XXXV of 1961) and includes the rules and regulations under any of them;
    (e) ‘territory of Bangladesh’ means the territory of the Republic as defined in article 2 of the Constitution of the People’s Republic Of Bangladesh;
    (f) ‘Tribunal’ means a Tribunal set up under this act.

    3. Jurisdiction of Tribunal and crimes.

    (1) A tribunal shall have the power to try and punish a person irrespective of his nationality who, being a member of any armed, defence or auxiliary force, commits or has committed in the territory of Bangladesh, whether before or after the commencement of this Act, any of the following crimes.

    (2) The following acts or any of them are crimes within the jurisdiction of a Tribunal for which there shall be individual responsibility, namely : –

    (a) Crimes against Humanity : namely murder, extermination, enslavement, deportation, imprisonment, abduction, confinement, torture, rape or other inhumane acts committed against any civilian population or prosecution on political, racial, ethnic or religious ground whether or not in violation of the domestic law of the country where perpetrated;

    (b) Crimes against Peace : namely planning, preparation, initiation or waging of a war of aggression or a war of violation of international treaties, agreements or assurances;

    (c) Genocide : meaning and including any of the following acts committed with intent to destroy in whole or in part, a national ethnic, racial, religious or political group, such as :

    (i) killing members of the group;
    (ii) causing serious bodily or mental harm to members of the group;
    (iii) deliberately inflicting on the group conditions of life calculated to bring about its physical destruction in Whole or in part;
    (iv) imposing measures intended to prevent births within the group;
    (v) forcibly transferring children of the group to another group;

    (d) War Crimes : namely, violation of laws of customs of war which include but are limited to murder, ill treatment or deportation to slave labour or for any other purpose of civilian population in the territory of Bangladesh; murder, ill treatment of prisoners of war or persons on the seas, killing of hostages and detenues, plunder of public or private property, wanton destruction of cities, towns or villages or devastation justified by military necessity;

    (e) violation fo any humanitarian rules applicable in armed conflicts laid down in the Geneva Conventions of 1949;

    (f) any other crimes under international law;

    (g) attempt abetment or conspiracy to commit any such crimes;
    h. complicity in or failure to prevent commission of any such crimes.

    4. Liability for Crimes.

    (1) When any crime specified in section 3 is committed by several persons, each of such person is liable for that crime in the same manner as if it was done by him alone;

    (2) Any Commander or superior officer who orders, permits, acquiesces or participates in the commission of any of the crimes specified in section 3 is connected with any plans or activities involving the commission of such crimes or who fails or omits to discharge his duty to maintain discipline or to control or supervise the actions of the persons under his command or his subordinates or any of them commit any such crimes or who fails to take necessary measures to prevent the commission of such crimes is guilty of such crimes.

    আইনে স্পষ্ট করেই উল্লেখ হয়েছে সামরিক বাহিনী এবং তাদের সহযোগী বাহিনীর কথা। এখানে সামরিক বাহিনী মানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তাদের সহযোগী বাহিনী হচ্ছে রাজাকার (আল-শামস ও আল-বদর), মুজাহিদ, ইপিসিএএফ-এর মতো আধা-সামরিক বাহিনীগুলো। যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের স্পষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এই আইনে।

    যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতকে অভিযুক্ত করার জন্য নিচের কারণগুলোই যথেষ্ট–

    ১. জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তানের আমির গোলাম আযম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং শীর্ষ নেতাদের একজন ছিল। শান্তি কমিটির নেতৃত্বে সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ভার তার এবং তার সংগঠনের ওপর বর্তায়।

    ২. জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যাবতীয় তৎপরতাকে রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছিল। এসব তৎপরতায় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং বাস্তভিটা থেকে উচ্ছেদের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ অন্তর্ভূক্ত। এসব অপরাধের সমান দায় তাদেরকে নিতেই হবে।

    ৩. জামায়াতে ইসলামী রাজাকার বাহিনী এবং এর অধীনস্থ বিশেষ ঘাতক সংস্থা আল-বদর গঠন করে। এসব বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত। এখানে এটা উল্লেখ করা দরকার যে, রাজাকার বাহিনীকে (আল-শামস ও আল-বদর নামে বিভক্ত) ব্যবহার করে জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নির্মূল এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ চালাচ্ছে এমন অভিযোগ তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোই সে সময় করেছিল। জামায়াত এসব সমালোচনাকে ইসলাম ও পাকিস্তানবিরোধী বলে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে নিজেদের কর্মকাণ্ড ন্যায্য বলে দাবি করে।

    ৪. আল-বদর বাহিনী সুনির্দিষ্টভাবে গঠিত হয়েছিল জামায়াতের ছাত্ রসংগঠন পূর্ব পাকিস্তানি ইসলামী জামায়াতে তালাবা বা ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির) সদস্যদের নিয়ে। বিজয়ের আগে বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য এই আল-বদর সদস্যরা অভিযুক্ত।

    দেখা যাক এসব অভিযোগের স্বপক্ষে কী কী প্রমাণ আছে আমাদের হাতে।

    ১. প্রসঙ্গ: নৃশংসতায় জামায়াতের দলীয় দায়

    জামায়াতে ইসলামী দলীয়ভাবে কী ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তার প্রমাণ হিসেবে তুলে দেওয়া যেতে পারে একটি ভিডিও ফাইল। ব্রিটেনভিত্তিক চ্যানেল ফোর প্রযোজিত ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ নামের তথ্যচিত্রটি থেকে নেওয়া এই ফুটেজে সিলেটে জামায়াতের একটি জনসভার কর্মকাণ্ড এবং তারপর সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা শোনা যাক প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে। প্রসঙ্গত, এ হত্যাকাণ্ড জামায়াত রাজাকার বা আলবদরের সামরিক লেবাসে ঘটায়নি।

    লিংক:



    ২. প্রসঙ্গ: শান্তি কমিটির নেতৃত্বের দায়

    ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল নুরুল আমিনের নেতৃত্বে খাজা খয়েরউদ্দিন এবং গোলাম আযমসহ ১২ জন রাজনৈতিক নেতা পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে এবং সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক সমর্থন দেওয়ার আশ্বাস দেয় এবং এ জন্য ‘সর্বদলীয় নাগরিক কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব দেয়। এ বিষয়ে ৫ এপ্রিল প্রকাশিত পূর্বদেশ পত্রিকায় লেখা হয়, প্রতিনিধিদল টিক্কা খানকে ‘অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সামরিক আইন প্রশাসনকে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস এবং জনগণের মন থেকে ভিত্তিহীন ভয় দূর করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়।’

    টিক্কা খান তাদের ‘শুধু বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় ফলপ্রসূ কাজ করতে নির্দেশ দেন।’… ‘বৈঠক শেষে নেতৃবৃন্দ রেডিওতে ভাষণ দিয়ে সামরিক কর্তৃপক্ষকে সহায়তার প্রতিজ্ঞা করেন’ সে প্রতিজ্ঞা পালন করেছিল গোলাম আযম।

    2(3)
    টিক্কা খান চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের এসব মৌলবাদী দল একই প্লাটফর্মে থেকে সামরিক বাহিনীকে সার্বিক সহযোগিতা করবে। সেটা ধাক্কা খায় শান্তি কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগের তিনটি অংশ (কাউন্সিল, কাইয়ুম ও কনভেনশন) এবং পিডিপির সংঘাতে। বিশেষ করে মৌলভী ফরিদ আহমদ (নেজামে ইসলামী প্রধান) ও নুরুজ্জামান (পাকিস্তান পিপলস পার্টির পূর্ব পাকিস্তান প্রধান) জামায়াতের নেতৃত্বে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ কারণে ৬ এপ্রিল পাকিস্তান অবজারভার সম্পাদক হামিদুল হক চৌধুরীকে নিয়ে টিক্কা খানের সঙ্গে আবারও দেখা করে গোলাম আযম এবং আগের প্রস্তাবনাটি আরেকটু ঘষামাজা করে ‘নাগরিক শান্তি কমিটি’ গঠনের অনুমোদন চায়। মূলত হামিদুল হক চৌধুরীর মধ্যস্থতাতেই জামায়াতের সঙ্গে অন্য দলগুলোর মতপার্থক্য ভুলে রাজনৈতিক সমঝোতা হয় সর্বদলীয় শান্তি কমিটি গঠনে।

    3(2)
    ৯ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ নেয় টিক্কা খান। একই দিন খাজা খয়েরউদ্দিনকে আহবায়ক করে ১৪০ জন সদস্য নিয়ে ঢাকায় নাগরিক শান্তি কমিটি আত্মপ্রকাশ করে। এর সংগঠক হিসেবে নাম দেওয়া হয় তিনজনের, অধ্যাপক গোলাম আযম, এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম এবং মওলানা সৈয়দ মাসুম। তবে পত্রিকায় এই খবর আসে ১১ এপ্রিল। কারণ গঠনের পরপরই এর নেতৃত্বে আবারও কোন্দল দেখা দেয়। ১০ তারিখ মৌলভী ফরিদ আহমদকে সভাপতি করে ৯ সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে মূল শান্তি কমিটি থেকে বের হয়ে যায় এবং গঠন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান শান্তি ও কল্যাণ কাউন্সিল’।

    4(2)
    ১৩ এপ্রিল বায়তুল মোকাররমে জোহরের নামাজের পর একটি মিছিল বের করে শান্তি কমিটি। ‘পাক-চীন জিন্দাবাদ, দুষ্কৃতিকারীরা দূর হও, মুসলিম জাহান এক হও, ভারতকে খতম কর’ ইত্যাদি ফেস্টুন নিয়ে মিছিলটি ঢাকার প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে নিউমার্কেটে শেষ হয়। মিছিল শেষে খাজা খয়েরউদ্দিন বক্তৃতা করে এবং মোনাজাত পরিচালনা করে গোলাম আযম। সমাবেশ শেষে মিছিলকারীরা আজিমপুর কলোনি, শান্তিনগর, শাঁখারি বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বাঙালিদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয় এবং অনেককে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখে।

    5
    ১৪ এপ্রিল নাগরিক শান্তি কমিটির বৈঠক বসে। সেখানে নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি’ রাখা হয়। এর ফলে কমিটি সারা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে বলে সভার প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, প্রয়োজন অনুসারে কমিটি যে কোনো সময় সদস্য সংখ্যা বাড়াতে পারবে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিট গঠন করে ‘মিশনের কাজ’ সাফল্যমণ্ডিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

    সভা যে কোনো বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কার্যকর করার জন্য ২১ সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করে যার অন্যতম সদস্য ছিল গোলাম আযম। বর্ষীয়ান খায়েরউদ্দিনকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করলেও জামায়াতে ইসলামীর হাতেই ছিল এর নেতৃত্ব। যার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় অফিসের ঠিকানা। মগবাজারের ৫ নং এলিফ্যান্ট লেনের সেই বাড়িটি এখন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৬ এপ্রিল আবার টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করে নিজেদের কার্যক্রম শুরু করার কথা জানায় গোলাম আযমসহ শান্তি কমিটির শীর্ষ নেতৃত্ব।

    প্রথমেই এটা জেনে নেওয়া যাক শান্তি কমিটি আসলে কতখানি শক্তিধর ছিল যে তাদের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো একই যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা যাবে! বিস্তারিত আখ্যানে যাওয়ার আগে সে সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষিত আমলে আনা যাক।

    পূর্ব পাকিস্তান তখন সামরিক আইনের আওতায় চলছিল এবং সামরিক বিধিবলে সব ধরনের মিটিং-মিছিল এবং বেসামরিক লোকজনের সশস্ত্র চলাফেরা নিষিদ্ধ ছিল। তবে ইসলামি সমাবেশের ক্ষেত্রে এই আইন ছিল শিথিল, শান্তি কমিটির ক্ষেত্রে পুরোপুরি ছাড় দেওয়া হয়েছিল আইনটিতে।

    ১৫ জুন সামরিক অধ্যাদেশ নং-২১ জারি করে এলাকাভিত্তিক ও আঞ্চলিক সব স্থানীয় কমিটি বিলুপ্ত করার অধিকার আদায় করে টিক্কা খানের অধীনস্থ প্রশাসন। মহল্লার সর্দার প্রথা, ইউনিয়ন কমিশনার কিংবা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা বিলুপ্ত করে সে জায়গা এককভাবে দেওয়া হয় শান্তি কমিটিকে। তারাই সরাসরি সামরিক প্রশাসকের বেসামরিক প্রতিনিধির মর্যাদা পায়। একইভাবে অস্ত্রবহন ও স্থানান্তরের বিধিটিও (সামরিক অধ্যাদেশ নং-১২২) শান্তি কমিটির অধীনে অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং তাদের সেগুলো ব্যবহারের অনুমোদন জায়েজ করা হয়।

    এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন–

    http://www.scribd.com/doc/78585904/MLO-No-21

    মূলত আওয়ামী লীগ, হিন্দু এবং স্বাধীনতাপন্থীদের তালিকা তৈরি করে সেগুলো সামরিক প্রশাসনকে সরবরাহ করার দায়িত্বে ছিল শান্তি কমিটি। পরে তারা এই সহযোগিতা সামরিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত করার অধিকার আদায় করে নেয়। গঠন করে বিভিন্ন রকমের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। এমন বাহিনীর মধ্যে রাজাকার, মুজাহিদ, ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস অন্যতম।

    শান্তি কমিটির ছায়ায় জামায়াত গঠন করে রাজাকার, যার দুটো শাখা ছিল, আল-শামস (সদস্য ও সমমনাদের নিয়ে গঠিত) এবং আল-বদর (ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে গঠিত)। মুজাহিদ বাহিনী শান্তি কমিটির আওতাভুক্ত হলেও এতে অন্তভূর্ক্ত ছিল অন্য দলগুলোর সদস্যরা। যদিও এদের অস্ত্র বণ্টন ও সনদ জামায়াতে ইসলামীর প্যাডেও অনেক সময় দেওয়া হয়েছে। এর একটা কারণ হতে পারে মূল প্রতিপক্ষ নেজামে ইসলামীর চেয়ে জামায়াতের সাংগঠনিক বিন্যাস আরও বিস্তৃত ছিল এবং মুসলিম লীগ তিন খণ্ডে বিভক্ত হওয়ায় তারাও বাধ্য হয়ে জামায়াতের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল।

    6-1
    রাজাকার নির্বাচন, নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ শান্তি কমিটির অন্যতম দায়িত্ব ছিল। এর প্রমাণ হিসেবে ‘৭১এর ২১ জুন শান্তি কমিটির ওয়ার্কিং কমিটির তরফে শাখা কমিটিগুলোর কাছে পাঠানো নির্দেশনাটি তুলে ধরা যেতে পারে–

    http://www.scribd.com/doc/78589198/Peace-Com-Directive

    মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা এই দলিলটিতে একদম উপরে ডানে ওয়ার্কিং কমিটির এক নম্বর সদস্য হিসেবে গোলাম আযমের নাম লেখা হয়েছে। নির্দেশনার ‘ই’ পরিচ্ছদে বলা হয়েছে–

    সামরিক প্রশাসকের দফতর থেকে আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে দেশপ্রেমিকদের নিয়ে রাজাকার এবং গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করার নির্দেশ পাঠানো হয়েছে এবং তাদের রাইফেল ও প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দেওয়া হবে । জেলা এবং বিভাগীয় শান্তি কমিটিগুলোকে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট সামরিক আইন প্রশাসকের কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। কারণ শান্তি কমিটির সুপারিশেই সরকার রাজাকারদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোয় শান্তিকমিটির তত্বাবধানে অবিলম্বে প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপ-কমিটি গঠন করতে হবে এবং তারা শুধু এই বিষয়টাতেই পুরোপুরি এবং সর্বোতভাবে মনযোগ দেবে। একই নির্দেশনায় পরিত্যক্ত বাড়িঘর দখলের নির্দেশনাও রয়েছে।

    7(1)
    শান্তি কমিটির দেশজুড়ে স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতায় কতখানি সংশ্লিষ্টতা ছিল তার প্রমাণ হিসেবে আমরা কিছু উপাত্ত তুলে ধরতে পারি–

    ক. ঢাকা শহরের একজন রাজাকারের পরিচয়পত্র। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত এ পরিচয়পত্রটিতে শান্তি কমিটির উল্লেখ লালদাগ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে।

    8
    খ. পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে কষ্ট করে ঘরে ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করতে হত না। বরং শান্তি কমিটিই তাদের জন্য নিয়মিত মেয়ে সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছিল। প্রমাণ হিসেবে একটা চিঠি তুলে দেওয়া যেতে পারে। ‘৭১ এর ২৮ মে বরিশালের ঝালকাঠি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছলিমুদ্দিন মিয়া এক চিঠি পাঠিয়েছিলেন কীর্তিপাশা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আজহার মিয়াকে। শান্তি কমিটির আঞ্চলিক প্যাডে লেখা চিঠির কথাগুলো এ রকম–

    “ভাইসাহেব

    সালামবাদ সমাচার, আপনার কীর্তিশালা কমিটিতে ইউনিট কমান্ডার হিসেবে আ. রবের নাম শাহ আলম ছার পাশ করিয়া নিয়েছেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে উত্তর দিকের শয়তান দমন করার জন্য যাইতে হইবে। আপনার এলাকার সব ইন্ডিয়ান দালালদের যত তাড়াতাড়ি পারেন ধরিয়া ক্যাম্পে পাঠাবেন। ওদের হেদায়েত করার পর উত্তর দিকের অপারেশন শুরু করা হইবে। এদিকে ইতিপূর্বে পাঠানো অস্ত্র যেন ইন্ডিয়ার দালালরা খুঁজে নিতে না পারে। বেগ সাহেবের জন্য ভালো মাল পাঠাবেন। রোজ অন্তত একটা অন্যদের জন্য মাল পারেন। খোদা আমাদের সহায় আছেন। আল্লাহ হাফেজ।”

    9
    গ. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রক্ষিত এই চিঠিটি বঙ্গবন্ধুকে লিখেছিলেন এক বীরাঙ্গনার বাবা। ১৩ ডিসেম্বর তার বাড়ি ঘেরাও করে তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পাশাপাশি মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় রাজাকাররা।

    10
    ঘ. ৩১ জুলাই নাটোরের মিনার সিনেমা হলের ম্যানেজারকে পাঠানো চিঠি। প্রশিক্ষণরত রাজাকারদের মাইন্ড রিফ্রেশের জন্য নাইট শোতে বিনে পয়সায় সিনেমা দেখানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শান্তি কমিটির প্যাডে–

    11
    ঙ. ভুরুঙ্গমারির এক মুসলিম লীগ নেতার ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদনপত্র। শমসের-ই-মূর্তজা নামে ওই লোক দাবি করে মুক্তিবাহিনী তার ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে এবং রংপুরে একটি পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল করে সেখানে বাড়ি নির্মাণে সহায়তা চেয়ে ১৮ হাজার ৩২০ টাকা দাবি করে। তার আবেদনটি মঞ্জুর করে শান্তি কমিটি।

    12(1)
    চ. ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী এবং দুষ্কৃতিকারীদের (দুটোই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জামায়াতি সম্বোধন) নিয়মিতই তারা হত্যা করছিল এবং সেগুলো খবরও হচ্ছিল। প্রমাণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে ৬ আগস্ট পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশিত তাদের একটি সাফল্যের খবর। কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে ৬ জন ভারতীয় দালালকে (মুক্তিযোদ্ধা) হত্যা এবং দুজনকে বন্দী করার ওই খবরে স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের (জামায়াত সদস্য) স্ত্রীও অংশ নিয়েছেন বলে লেখা হয়।

    13
    ৩. প্রসঙ্গ: পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক সমর্থনের দায়

    জামায়াতের রাজনৈতিক সহযোগিতার প্রমাণ হিসেবে আমরা আমলে নিতে পারি ১৯৭১ সালের ১৮ থেকে ২১ আগস্ট লাহোরে অনুষ্ঠিত জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের সারবত্তা। টানা চারদিনের ওই বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামী এর কেন্দ্রীয় নেতাদের সম্মতিক্রমে একটি রাজনৈতিক সংহতিপত্র (পলিটিকাল রেজ্যুলুশন) প্রকাশ করে যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যাবতীয় কর্মকাণ্ড বৈধ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং তাতে সমর্থন জানানো হয়।

    একই বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরাতে সেনাবাহিনীকে আরও কঠোর হওয়ার আহবান জানায় তারা। ২০ আগস্ট পাকিস্তানি বার্তাসংস্থা পিপিআইর বরাত দিয়ে Jamaat upholds action to crush armed rebellion শিরোনামে দ্য মর্নিং নিউজ পত্রিকায় লেখা হয়–

    The action taken by the Government of Pakistan to crush the armed rebellion in East Pakistan by the outlawed Awami League in connection with Indian warlords and their agent has been fully upheld by the central council of the Jamaat-i-Islami which went into session for the third consecutive day here today under the presidentship of the Deputy chief of the party Maulana Abdur Rahim.

    আগেই বলা হয়েছে, সামরিক সমর্থনে বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে আলাদাভাবে নিজেদের চেনাতে উদ্যোগী ছিলো জামায়াত। এর নমুনা মেলে গোলামের একটি বক্তব্যে। ১৭ আগস্ট ওই বৈঠক উপলক্ষে লাহোরে নামার পর পাকিস্তানি সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেয় সে। পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জোটে জামায়াতের অন্তর্ভূক্তির প্রশ্নে গোলাম স্পষ্ট জানায়–

    Jamaat had nothing to do with the merger of various political parties. The Jamaat, he said, would keep its entity as it could not accept readymade leadership.

    [morning news, 18th august, 1971]

    বিস্তারিত:

    http://www.scribd.com/doc/78586625/Jaamat-Resolution

    দলীয় সংবিধানে এই সমর্থন সর্বসম্মতিতে পাশ করানোর আগে থেকেই অবশ্য বক্তৃতা-বিবৃতিতে এসব কথা বলছিল গোলাম আযম। প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে ২০ জুন লাহোরে জামাত কার্যালয়ে তার বক্তৃতার অংশবিশেষ। ২১ জুন বার্তাসংস্থা এপিপির বরাতে ‘সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া দেশকে রক্ষা করার বিকল্প ছিল না’ শিরোনামে গোলামের বক্তব্য ছাপে পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রিকা।

    14

    ৪ ও ৫. প্রসঙ্গ: রাজাকার ও আল-বদরের মাধ্যমে সামরিক সহযোগিতার দায়

    জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক এবং সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডে সমর্থনসূচক সংহতিপত্র ঘোষণার পরদিনই, অর্থাৎ ২২ আগস্ট ‘রাজাকার অধ্যাদেশ’ ঘোষণা করে পাকিস্তান সরকার। এই অধ্যাদেশ বলে আনসার বাহিনী বিলুপ্ত করে এর যাবতীয় তহবিল, সম্পদ, এবং সুযোগ-সুবিধা রাজাকার বাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা হয়।

    বিস্তারিত:

    http://www.scribd.com/doc/82198260/19710822-Po-e-Pakistan-Razakars-Ordinance

    অধ্যাদেশে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, ভবিষ্যতে রাজাকারদের পুলিশ আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এটা ভাবা ভুল হবে যে, এই অধ্যাদেশ ঘোষণার পর রাজাকার বাহিনী গঠন শুরু হয়। বরং এটি দিয়ে রাজাকারদের সেনাবাহিনীর সহযোগী সংগঠন হিসেবে বৈধতা দেওয়া হয়। এই রাজাকাররা এতদিন ছিল জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি সশস্ত্র দল মাত্র।

    15
    ‘৭১ এর মে মাসে খুলনা শাহজাহান আলী রোডে অবস্থিত আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত কর্মীকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীর সূচনা করে জামায়াত নেতা মওলানা একেএম ইউসুফ। এই আনসার ক্যাম্পই পরে অধ্যাদেশবলে রাজাকার সদর দফতর হিসেবে ঘোষিত হয়। শুরুতে এই বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতের ছাত্র সংগঠন, যার নাম এখন ইসলামী ছাত্র শিবির) সভাপতিকে।

    রাজাকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে আনসার অধ্যাদেশ সংশোধন করে এই বাহিনীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আত্মীকরণ করা হয়। এই বাহিনীকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়, আল-শামস ও আল-বদর। অছাত্র, বয়স্ক, অর্ধশিক্ষিত এবং অশিক্ষিতদের নিয়ে আল-শামস গঠন করা হয়। এদের মধ্যে জামায়াতিরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। আল-বদর গঠন করা হয় শুধু ইসলামী ছাত্র সংঘের ছাত্রদের নিয়ে যাদের আরেক নাম ছিলো ইসলামী জমিয়াতুল তালিবা। এরা ছিল বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘাতক দল।

    আল-শামস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযানের পাশাপাশি রাস্তা, পুল পাহারা দিত। অন্যদিক আল-বদরের দায়িত্ব ছিল স্পেশাল মিশন। আর সেই বিশেষত্ব তারা দেখিয়েছে স্বাধীনতালাভের সামান্য আগে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে।

    প্রসঙ্গত, আল-বদরও কিন্তু একটি আঞ্চলিক বাহিনী হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। ময়মনসিংহ ছাত্র সংঘের সভাপতি আশরাফ হোসাইন জামালপুরে এ বাহিনী গঠন করে ২২ এপ্রিল (যদিও ভিন্ন সূত্রে এই বাহিনীর গঠনকাল উল্লেখ করা হয়েছে ২৭ জুন বলে)। রাজাকার বাহিনীতে জামায়াতের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর ছাত্রসংঘ আলাদা হয়ে যায় আল-বদর নাম নিয়ে।

    16
    সাধারণ নাগরিকদের সশস্ত্র করে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় চরদের (দুটোই মুক্তিযোদ্ধাদের জামায়াতি সম্বোধন) দমন করার আবেদন জামায়াত শুরু থেকেই করছিল। রাজাকার অধ্যাদেশের আগেই এ ধরনের ঘাতক বাহিনী গঠন করলেও এদের সরকারি স্বীকৃতির জন্য মরিয়া ছিল তারা। কারণ তাদের পরিকল্পনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার যে নীল নকশাটি ছিল, তা অন্যভাবে বাস্তবায়ন করলে আইনি ঝামেলায় পড়ার সমূহ সম্ভাবনা (যে বিপদে এখন জামায়াত নেতারা পড়েছে, যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইবুনালে) ছিল।

    এ কারণেই দলীয় ক্যাডারদের সরাসরি সামরিক বাহিনীর তত্বাবধানে ট্রেনিং দেওয়ার আবেদন জানিয়েছে গোলাম আযম তার বিভিন্ন বক্তৃতায় এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামও এ নিয়ে অনেকবার সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। উদাহরণ দেওয়া যাক, ২০ জুন লাহোরে জামায়াতের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন আহবান করে গোলাম। সেখানে সে বলে–

    the authorities should win the confidence of the people in East Pakistan. The citizens should feel confident and should know that they were trusted by the administration. He also said that miscreants were still active there and to counter their activities, peace loving citizens should be armed for their own defence.

    [The Morning News, 21 June, 1971]

    17
    একই দিন একই বিষয়ে দৈনিক সংগ্রাম ‘গোলাম আযমের সংবাদ সম্মেলন’ শিরোনামে লিখে–

    ‘পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠা ও দুষ্কৃতিকারীদের উচ্ছেদের ব্যাপারে অধ্যাপক গোলাম আযম তার সাংবাদিক সম্মেলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করেছেন। তিনি দুষ্কৃতিকারীদের মোকাবেলার উদ্দেশ্যে দেশের আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। সুতরাং দুষ্কৃতিকারীদের মোকাবেলায় দেশের আদর্শ সংহতিতে বিশ্বাসী লোকদের কর্মতৎপরতাকে অধিকতর ফলপ্রসূ করে তোলার উল্লেখিত প্রস্তাবটিকে সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখবেন বলে আমাদের বিশ্বাস আছে।’

    বিবৃতিতে ঢালাওভাবে বলা হলেও, পরবর্তীতে অনেক বক্তৃতায় পাকিস্তানের আদর্শ ও সংহতিতে বিশ্বাসী হিসেবে শুধুমাত্র জামায়াতকেই মেনেছে গোলাম। মূলত দলীয় বাহিনীকে সামরিক লেবাস পড়াতে ইয়াহিয়ার ছাড়পত্র আনতেই সেবার পাকিস্তানে গিয়েছিল গোলাম। আর তার প্রমাণ পাওয়া যায় জুনের শেষ সপ্তাহেই রাজাকারদের অস্ত্রসজ্জিত ও ট্রেনিং দেওয়ার সামরিক অনুমোদন, যার কথা উপরে শান্তি কমিটি সাক্ষরিত দলিলটিতে বলা হয়েছে।

    18
    দৈনিক সংগ্রামও এ ব্যাপারে নিয়মিতই সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় ছেপেছে। রাজাকার-আলবদরের প্রাথমিক আইডিয়া প্রকাশনায় আসে মূলত তাদের তরফেই। এ ব্যাপারে ২৮ মে ‘বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড’ শিরোনামের সম্পাদকীয়টি বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। সেখানে লেখা হয়–

    ‘দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানরত এসব দুষ্কৃতিকারী দমনের ব্যাপারে আমরা ইতিপূর্বেও সম্পাদকীয় এবং উপসম্পাদকীয় একাধিক নিবন্ধে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস পাকিস্তান ও জাতীয় আদর্শে বিশ্বাসী নির্ভরযোগ্য লোকদের সমন্বয়ে একটি বেসামরিক পোষাকধারী বাহিনী গঠন করে তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে অতি তাড়াতাড়ি এসব দুষ্কৃতিকারীকে নির্মূল করা সহজ হবে।’

    19
    রাজাকারদের একটি অধ্যাদেশের আওতায় আনার জন্য জামায়াতের চাপের আরও নজির পাওয়া যাবে। যেমন, ১ আগস্ট পিরোজপুরে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের এক সমাবেশে ইসলামপন্থী জনগণকে সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়ার দাবি জানানো হয়। অথচ সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে তাদের ট্রেনিং চলছিল জুনের শেষভাগ থেকেই। ১৭ জুলাই পাকিস্তান অবজারভার টাঙ্গাইলে রাজাকারদের ট্রেনিং দেখতে যাওয়া নিয়াজীর একটি ছবি ছাপে।

    ৪ জুলাই সংগ্রামের প্রথম পাতার প্রথম কলামে ‘আজ বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে রাজাকারদের গুলি চালানোর ট্রেনিং’ শিরোনামে লেখা হয়–

    ‘যেসব রাজাকার ট্রেনিং গ্রহণ করছেন আজ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে তাদেরকে ক্ষুদ্র অস্ত্রের সাহায্য গুলি চালনা শিক্ষা দেওয়া হবে।’

    ৯ জুলাই জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেকের বরাতে ‘জনগণ ভারতের অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছে’ শিরোনামে লেখা হয়–

    ‘সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী ও ডাকাতদের নির্মূলের জন্য জনগন এখন স্বেচ্ছায় রাজাকার ট্রেনিং নিচ্ছে’।

    ২৬ জুলাই আরেকটি সম্পাদকীয়তে রাজাকারদের প্রশংসা করে লেখা হয়–

    ‘ইতিমধ্যে প্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় রেজাকার বাহিনী গঠিত হয়ে তারা দুষ্কৃতিকারীদের দমনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যেসব স্থানে রেজাকার বাহিনী গঠিত হয়নি, সেসব স্থানেও শিগগিরই গঠিত হতে যাচ্ছে।… দুষ্কৃতিকারীদের দমনে যাতে আদৌ সেনাবাহিনী ব্যবহারের প্রয়োজন না হয়সে লক্ষ্য নিয়েই জনগন ও অন্যান্য সংস্থাকে পারস্পরিক সহযোগিতা সহকারে কাজ করে যেতে হবে।’

    ৪ আগস্ট ‘রাজাকার বাহিনীর প্রথম গ্রুপের ট্রেনিং সমাপ্ত’ শিরোনামে খবর ছাপায় সংগ্রাম।

    20
    পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান লে.জেনারেল নিয়াজী তার ‘The Betrayal of East Pakistan’ বইয়ে লিখেছেন–

    The proposal for raising an organised Razakar Force remained under consideration with HQ, CMLA and GHQ for a long time. Although their recruitment had started earlier, sanction for the raising of this force was given at the end of August 1971….A separate Razakars Directorate was established, and the whole set up started taking proper shape. Two separate wings called Al-Badr and AL-Shams were organised. Well educated and properly motivated students from the schools and madrasas were put in Al-Badr wing, where they were trained to undertake ‘Specialised Operations’, while the remainder were grouped together under Al-Shams, which was responsible for the protection of bridges, vital points and other areas,

    21
    রাজাকার এবং আল-বদর যে জামায়াতে ইসলামী ও তার ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে ছিল এর স্বপক্ষে প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায়। সাবেক পাকিস্তানি জেনারেল হাকিম আহমেদ কোরেশী The IndoPak War নামে একটি বই লিখেছেন, ২০০২ সালে অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত বইটির পৃষ্ঠা ৯১য়ে লেখা হয়েছে–

    Maulana Tufail Muhammad of the Jamaat-e-Islami visited us after the military action. He was, I think, the only leader of national stature from West Pakistan who took the trouble of travelling to the remote corners of East Pakistan to make a personal assessment of the prevailing conditions. It was good to know that, besides men in uniform, there were others equally concerned about the future of this ideologically and geographically unique country. The Maulana was particularly concerned about the performance of the Razakars, (volunteers) locally recruited and belonging to his party, and was happy to learn that their conduct was commendable. He jokingly remarked that his party cadres had always come to the rescue of the Army in tough situations, but my state of mind at the time was not receptive to this light-hearted observation; I thought it limited the scope of co-operation between Jamat and the Army. In fact, neither was the Army acting to preserve itself, nor the mujahids to perpetuate army rule; they were co-operating in the national interest, not doing each other any favours. Let it be said, to the credit of Jamat-i-Islami and these motivated Bengali Muslims, that they stuck it out with us till the end. They were prepared to go all the way to their graves in the name of Islam and Pakistan; unfortunately we decided to raise the white flag.

    [সামরিক হস্তক্ষেপের পর জামায়াতে ইসলামীর মওলানা তোফায়েল মোহাম্মদ আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমার ধারণা জাতীয় পর্যায়ের তিনিই একমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা যিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো ঘুরে সেখানকার সার্বিক অবস্থা অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। জেনে ভালো লাগলো যে সামরিক উর্দির বাইরেও এদেশের আদর্শিক ও ভৌগলিক একতা নিয়ে ভাবার মতো অন্যরাও আছে। মাওলানার যাবতীয় উদ্বেগ দেখা গেলো রাজাকাররা কেমন করছে তা নিয়ে, কারণ এসব স্বেচ্ছাসেবকরা স্থানীয় পর্যায়ে অধিভুক্ত এবং তার দলের সদস্য। তাদের কার্যক্রমের প্রশংসা শুনে বেশ খুশীই হলেন তিনি। মজা করে বললেন তার দলের ক্যাডাররা বরাবরই সামরিক বাহিনীকে কঠিন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে অভ্যস্ত। কিন্তু আমার মন তখন এসব রসিকতা বোঝার মতো অবস্থায় ছিল না। বরং মনে হচ্ছিল এতে জামায়াত এবং সেনাবাহিনীর পারস্পরিক সহযোগিতায় সীমাবদ্ধতা তৈরী হচ্ছে। বাস্তবে সেনাবাহিনী যেমন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়ছিল না, তেমনি এসব মুজাহিদরাও তাদের টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করছিল না। তারা জাতীয় স্বার্থেই পরস্পরকে সহযোগিতা করছিল, কেউ কারো উপকার করছিল না। তবে জামায়াতে ইসলামী এবং এসব উজ্জীবিত বাঙালী মুসলমানদের প্রশংসা করে বলতেই হয় যে তারা আমাদের সঙ্গে একদম শেষ পর্যন্ত লেগে ছিল।ইসলাম এবং পাকিস্তানের জন্য তারা মরতেও প্রস্তত ছিল কিন্তু দূর্ভাগ্য যে আমরা আত্মসমর্পন করে ফেললাম।]

    22
    এ ব্যাপারে সবচেয়ে চমকপ্রদ উদ্ধৃতিটি আসলে ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) সিদ্দিক সালিকের। ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে যুদ্ধবন্দী এই পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তা লিখেছেন–

    In September 1971 a political delegation from erstwhile West Pakistan complained to General Niazi that he had raised an army comprising men nominated by Jamaat-e-Islami. …The general [Niazi] called me to his office and said: From now on, you will call the Razakars — Al-Badr and Al Shams — to give the impression that they do not belong to one single party.

    [page: 105]

    ভাবানুবাদ হচ্ছে–

    ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক প্রতিনিধিদলের সদস্যরা জেনারেল নিয়াজীর কাছে অভিযোগ করেন যে তিনি জামায়াতে ইসলামী মনোনীতদের নিয়ে একটি সামরিক বাহিনী গঠন করেছেন। জেনারেল আমাকে তার অফিসে ডেকে নির্দেশ দিলেন, এখন থেকে তুমি রাজাকারদের আল-বদর ও আল শামস বলে অভিহিত করবে যাতে বোঝা যায় এরা কোনো একটি সুনির্দিষ্ট দলের সদস্য নয়। যে অভিযোগের উল্লেখ সিদ্দিক সালিক করেছেন সেটি মোটেও হালকা কিছু নয়।

    23
    সালিক যা বলেছেন সেই অভিযোগ এসেছিল পিপলস পার্টির তরফে। সেবার পূর্ব পাকিস্তান সফর করে এসে মাহমুদ আলি কাসুরি অভিযোগ করেন জামায়াতে ইসলামী ক্যাডাররা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নিশ্চিহ্ন করার কাজে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করছে। এ ব্যাপারে পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোও একটি বিবৃতিতে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ডানপন্থী রাজাকাররা বামপন্থীদের হত্যা করছে।’

    এর প্রতিবাদ করেন মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) প্রধান খান কাইয়ুম খান। ৬ সেপ্টেম্বর ‘অপবাদ মূলত সামরিক সরকারকেই দেওয়া হচ্ছে’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে লিখেন–

    ‘যে রেজাকারদের সর্বদলীয় শান্তি কমিটির সহযোগিতায় সামরিক সরকারই বাছাই করেছেন এবং ট্রেনিং দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগিয়েছেন, তারা কী করে দল বিশেষের পক্ষ হয়ে অন্যান্য দলের কর্মীদের খতম করেছে তা ভাবতেই অবাক লাগে। অপবাদ কি মূলত সামরিক সরকারকেই দেওয়া হচ্ছে না?’

    24
    অক্টোবরে এই বিতর্ক আবার শুরু হয়। ১১ অক্টোবর বার্তা সংস্থা রয়টার্স সংবাদ পরিবেশন করে ‘PEOPLE’S PARTY LEADER ADMITS RAZAKAR TERROR’ শিরোনামে, যেখানে লেখা হয়–

    A leading People’s Party official dropped out of a party delegation hours before it left for East Bengal, alleging that power in the eastern wing had been handed over to reactionary and anti-people parties who had massacred political opponents. Meiraj Mohammed Khan, the party’s Karachi secretary, said yesterday (October 10) that he felt it was “futile for me to go”.

    The 10-man party delegation was scheduled to go to Dacca to survey the situation in view of forthcoming by-elections for 78 seats formerly held by mem¬bers of the Awami League.

    Meiraj alleged that in East Bengal “power in effect has been transferred to those reactionary and anti-people political parties defeated in the elections and rejected by the people”.

    He named one party-the Muslim Jammaat-e-Islami group-of indulging in wholesale massacre of political opponents for which they are using their Razakars.

    25
    এমন নয় যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানেই এ নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। জামায়াতে ইসলামী যে রাজাকারদের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে সে অভিযোগ উঠেছিল জামায়াতের রাজনৈতিক সহযোগী দলগুলোর মধ্যেও। তার প্রমাণ মেলে পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক গোয়েন্দা নথিতে। ৩ অক্টোবর নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) নির্বাহী কমিটির এক জরুরি সভায় পূর্ব পাকিস্তানে হত্যা ও নৈরাজ্যের জন্য জামায়াতে ইসলামী এবং রাজাকারদের দায়ী করে বক্তৃতা দেয় ক’জন নেতা।

    মজার ব্যাপার হচ্ছে রাজাকারদের নিয়ে পিপিপি’র ভাইস চেয়ারম্যান মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরি আর নুরুল আমিনের প্রশংসা নিয়ে ১৩ নভেম্বর একটি সংবাদ ছাপে হামিদুল হক চৌধুরী সম্পাদিত পাকিস্তান অবজারভার। লাহোর থেকে তাদের বিশেষ সংবাদদাতার পাঠানো Row over Razakars: PPP’s Mysterious Seats খবরটি মোটামুটি জামায়াতের লাইনে পরিবেশিত এবং পিপিপিকে একহাত দেখে নেওয়া হয়েছে।

    26
    রাজাকারদের সবচেয়ে দূর্ধর্ষ অংশ আল-বদরের সঙ্গে বর্তমান জামায়াত নেতৃত্বের সম্পর্ক কী? এ প্রসঙ্গে সে সময় ইসলামী ছাত্র সংঘের শীর্ষ নেতৃত্বের তালিকা তুলে ধরা জরুরি যারা বাই-ডিফল্ট আল বদরেরও শীর্ষ নেতৃত্বে ছিল।

    লিংক:

    http://www.somewhereinblog.net/blog/omipialblog/20826

    তালিকায় চোখ বোলালেই বোঝা যায় এই লোকগুলোই এখন জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত। তাই চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তাদের গ্রেফতার এবং কাঠগড়ায় ওঠানোটা যদি জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে রাজনৈতিক হেনস্থা বোঝায়, সেটা হবে আরেকটি বড় মিথ্যাচার। বরং এটিই হচ্ছে ঘটনার পর্যায়ক্রমে বাধ্যতামূলকভাবেই প্রত্যাশিত এক প্রক্রিয়া মাত্র।

    বন্ধু ফখরুল আরেফীন একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন ‘আল-বদর’ নামে যা বর্তমান ট্রাইবুনালে অন্যতম প্রামাণ্য উপাত্ত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। তার কয়েকটি ফুটেজ এই পোস্টে আমি ব্যবহার করেছি। এর একটি আল-বদর ও জামায়াত নেতৃত্বের সম্পর্ক নিয়ে, যাতে স্পষ্ট এতে আলী আহসান মুজাহিদ, মতিউর রহমান নিজামীদের সংশ্লিষ্টতা।

    প্রখ্যাত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির কনভেনর ডা.এম এ হাসান, প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব কামালের মুখে শোনা যাক–

    লিংক:



    এবার আসা যাক এ সংক্রান্ত সবচেয়ে অথেনটিক উপাত্তে। ১৯৭১ সালে এই ছাত্র সংঘের সদস্যদের আল-বদর নামের খুনে বাহিনীতে রিক্রুট করার দায়িত্ব ছিল আইএসআইর মেজর রিয়াজ হুসেইন মালিকের ওপর। বলা হয়, আল-বদর নামটাও তারই দেওয়া। উইকিপিডিয়াতে লেখা হয়েছিল (অতীতবাচ্যে বললাম, কারণ আমার একটা পোস্টে এই উদ্ধৃতি ব্যবহার করার পর দেখা গেছে লেখাটা এডিট করে সেখানে বসানো হয়েছে যে, যদিও জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গ সংগঠন হিসেবে আল বদরদের অভিযুক্ত করা হয়, কিন্তু আসলে তাদের তেমন ট্রেনিং ছিল না, অস্ত্রও ছিল না। বরং এদের বেশিরভাগ ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দিয়েছে। নাউজুবিল্লাহ!)–

    The name Al-Badar was given by major Riaz hussain during the passing out ceremony of first Al-badar group.

    ১৯৯৭ সালে পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে উর্দুতে একটা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয় ‘জমিয়াত কি পঞ্চাশ সাল’ নামে। সেই বিশাল চিত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী জমিয়াতে তালাবা সম্পর্কে রিয়াজ হুসেইনের প্রশংসাধন্য বয়ান মিলে। প্রামাণ্যচিত্রটির একটা সংক্ষিপ্ত ভার্সন আছে ইউটিউবে। ‘আল-বদর ১৯৭১’ নামে ওই ফুটেজটি পাকিস্তানিদেরই আপলোড করা। সেখানে ভূমিকায় সমাজতান্ত্রিক ও সেক্যুলার ছাত্রদের (ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন) মোকাবেলায় যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে আইজেটিকেই মানা হয় এবং এসব প্রগতিশীল ছাত্ররা যখন মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে সক্রিয়, তখন তাদের ঠেকাতে ছাত্রসংঘের বন্দুক ধরাও ফরজ বিবেচিত হয়েছে।

    রিয়াজ হুসেইন উর্দুতে কয়েকটা ঘটনার বর্ননা দিয়ে এদের মাহাত্ম্য প্রচার করেছে এবং শুরুতেই উল্লেখ করেছে ইসলামী ছাত্র সংঘের নাম, তাদের ইসলামপ্রেম ও পাকিস্তানপ্রেম। বিভিন্ন কাহিনির মধ্যে রয়েছে একজন ছাত্র সংঘ সদস্য নাকি তার আপন ভাইকে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছে, সে মুক্তিবাহিনী এবং সুবাদে ভারতের দালাল বিধায়। তার যুক্তি এমন ভাইয়ের মরে যাওয়াই উচিত যে তার কোটি মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে বেইমানি করছে!

    আরেক জন মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত ভাইয়ের জানাজা পড়েই (সে জানাজায় নাকি রিয়াজও ছিল) আবার ডিউটিতে হাজির। এ রকমই নানা গল্পের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রের গুণকীর্তন করা হয়েছে।

    লিংক:



    পাকিস্তানের জমিয়াতে তালাবার ওয়েবসাইটেও রয়েছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগঠনটির বীরত্বের কথা। তখনকার গোটা পাকিস্তানের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সম্পর্কে সেখানে লেখা হয়েছে–

    Motiur Rahman Nizam is the current chief (Ameer) of the Jamaat-e-Islami Bangladesh, which is the largest Islamic political party in Bangladesh. Nizami rose in the ranks of the Jamaat-e-Islami in East Pakistan in the 1960s, after being a leader of a student organization, Islamic Chhatro Shango (now Islami Chhatro Shibir). During the liberation war of 1971, Nizami actively supported the cause of West Pakistan and formed the Al-Badr Force in which he acted as the supreme commander of the Al-Badr Militia.

    লিংক:



    আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ মানা যেতে পারে ইসলামী ছাত্র সংঘের সাবেক সদস্য এবং ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা মিসবাহউর রহমান চৌধুরীর মতিউর রহমান নিজামীকে অভিযুক্ত করে দেওয়া বক্তব্য এবং আল-বদর গঠন সংক্রান্ত ছাত্র সংঘের একটি নির্দেশনামাকে। এক টিভি সাক্ষাতকারে মিসবাহ সে সময় ইসলামী ছাত্র সংঘের সদর দপ্তর থেকে আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে পাঠানো একটি চিঠি তুলে ধরেছেন যেখানে লেখা হয়েছে–

    ‘আগামী ১০ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্র সংঘের সকল নেতাকর্মীকে আল-বদর বাহিনীতে যোগদানের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হইয়াছে। ১০ আগস্ট আপনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মৌলভীবাজার কমান্ডের অফিসে সকাল ১০টার মধ্যে মেজর ফখরুল ইসলামের সাথে সাক্ষাত করিয়া যোগদানপত্র গ্রহণ করিবেন।’

    27
    বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে উস্কানি দিয়ে গোলাম আযাম ও জামায়াতের মুখপাত্র সংগ্রামের প্রচুর উপসম্পাদকীয় ও বিবৃতির খোঁজ মেলে। তার কয়েকটি তুলে ধরা যাক।

    দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ ‘সম্পাদক সমীপেষু’ কলামে আবদুল বারী নামে এক আলবদর কমান্ডারের এই চিঠি ছাপা হয়–

    জনাব,

    স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আলবদর বাহিনীর নাম আজ প্রদেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরে পৌঁছে গেছে। গত ২৭ জুন জামালপুর মহকুমায় আলবদর বাহিনী গঠিত হবার পর আজ সমগ্র মোমেনশাহী জেলা ও প্রদেশের আরো দুয়েকটি জেলায় এর কাজ শুরু হয়েছে বলে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। আলবদর বাহিনী পাকিস্তানবাদী ইসলামপন্থী দেশপ্রেমিক ছাত্রদের দ্বারা গঠিত। এতে ইস্কুলের ১২ বছরের ছেলে থেকে আরম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র রয়েছে।

    যতদূর জানা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে জামালপুর মহকুমাতেই পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। এখানে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ৪০% থেকে ৫০% ছেলে পরীক্ষা দিয়েছে। জামালপুর মহকুমার শেরপুর, নলিতাবাড়ি, ইসলামপুর, দেওয়ান গঞ্জ ও জামালপুর শহরে দুষ্কৃতিকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে।

    জামালপুরের বিভিন্ন জায়গায় সীমান্তবর্তী এলাকায় আলবদর বাহিনী সাহসিকতা ও সাফল্যের সঙ্গে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের মোকাবেলা করেছে। আলবদর বাহিনীর তৎপরতা দেখে ভারতীয় অনুচর নাপাক বাহিনীর লোকেরা জামালপুর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে বলে ক্রমাগত সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। আলবদর বাহিনীর বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রতিটি ছেলেই শিক্ষিত এবং নামাজ পড়ে। ধনসম্পদ ও নারীর প্রতি কোনো লোভ নেই। বদর বাহিনীর গত তিনমাসের কাজে কোনো চারিত্রিক দূর্বলতা দেখা যায়নি। এজন্যই জনগণের কাছে আশার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের প্রিয় নাম আলবদর। জামালপুরে রেজাকার, পুলিশ, মুজাহিদ ও রেঞ্জাররা পুল ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পাহারা দিচ্ছে আর পাক ফৌজ ও আলবদর বাহিনী অপারেশন করছে।

    আমি পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক ইসলামপন্থী ছাত্রজনতার কাছে আহবান জানাচ্ছি সামরিক কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা ও সাহায্য নিয়ে দ্রুত প্রদেশের সর্বত্র আলবদর বাহিনী গঠন করতে। বদর বাহিনী ছাড়া শুধু রেজাকার ও পুলিশ দিয়ে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি আয়ত্বে আনা সম্ভব নয়। আমাদের কাছে রেজাকার, বদর বাহিনী ও মুজাহিদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমরা সবাইকে মনে করি সমান। ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও তার দালালদের শায়েস্তা করতে আজ তাই প্রদেশের সর্বত্র আলবদর বাহিনী গঠন করা প্রয়োজন।

    দেশের বর্তমান নাজুক ও সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে যত তাড়াতাড়ি আলবদর বাহিনী প্রদেশের সর্বত্র গঠিত হয় ততই দেশ ও জাতির মঙ্গল। আল্লাহ আমাদের তার পথে কাজ করা তৌফিক দান করুন। আমিন।

    মোহাম্মদ আবদুল বারী

    ইনচার্জ, আলবদর ক্যাম্প, ইসলামপুর থানা, মোমেনশাহী
    ও প্রচার সম্পাদক, জামালপুর মহকুমা শান্তি কমিটি

    28
    স্বাধীনতার পর এই আবদুল বারীর ব্যক্তিগত ডায়েরিটি উদ্ধার করা হয়। সেখানে মিলে চিঠির সঙ্গে বদরদের চারিত্রিক গুণাবলীর অসঙ্গতির চিত্র। ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকে মুদ্রিত ডায়েরির প্রধান বিবরণগুলি হচ্ছে–

    টাঙ্গাইলে successful operation হয়েছে। হাজার দেড়েকের মতো মুক্তিফৌজ মারা পড়েছে আলবদর ও আর্মির হাতে।

    1.Haidar Ali 2. Nazmul Haque. Rs 2500.00

    তিতপল্লার শিমকুড়া গ্রাম- জব্বারের কাছে ২৯/১০/৭১ আর তিন হাজার নেওয়ার পরিকল্পনাআছে

    24-10-71…… Prostitution Quarter

    26-10-71… Raping Case… Hindu Girl

    37
    আল-বদরদের একদম স্পেসিফিক মিশনই ছিল দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা। এটি যত না পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তার চেয়েও বেশি ছিল জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব এজেন্ডা। কারণ যেসব মিথ্যা অবলম্বন করে তারা রাজনীতি করে তার মুখোশটা সহজেই খুলে দেওয়ার ক্ষমতা এই বুদ্ধিজীবীরা রাখতেন। দেশের জনগণের একটা বড় অংশই অশিক্ষিত বলে এদের ধর্মের দোহাই দিয়ে বশে রাখা যায়, শিক্ষিতদের সেটা সম্ভব নয়। জামায়াত-শিবির মিথ্যা অপপ্রচার এবং ঘটনা বিকৃত করে নিজের ফায়দায় কাজে লাগানোর যে চর্চায় অভ্যস্ত যুগ যুগ ধরে তা বজায় রাখতে এদের নিশ্চিহ্ন করাটা তাই জরুরি ছিল।

    আগেই বলেছি এ ব্যাপারে অজস্র এবং অসংখ্যবার উস্কানি এসেছে গোলাম আযমসহ জামায়াতের বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে। এ প্রসঙ্গে নিচে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত কিছু সংবাদ ও সম্পাদকীয়ের অংশবিশেষ তুলে ধরা হল। তাতেই পাঠক প্রমাণ পাবেন গোলাম আযম, জামাতের শীর্ষ নেতৃত্ব কোনোভাবেই রাজাকার এবং আল-বদরদের সংগঠিত এবং ব্যবহার করে এসব হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে এবং যুদ্ধাপরাধ আদালতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনো অভিযুক্তের উপস্থিতি ছাড়াই স্রেফ এই একটি সুনির্দিষ্ট গণহত্যার অপরাধেই তাদের প্রত্যেকের শাস্তি হতে পারে।

    intellecuals-report-ed
    ২ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রাম এক সম্পাদকীয়তে গোলাম আযমের সুপারিশ মেনে বেসামরিক পাকিস্তানপন্থীদের সশস্ত্র করার জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানায়। সে লেখায় মওলানা আবদুর রহিমের বরাতে বাংলাদেশের পক্ষে প্রোপোগাণ্ডা চালানোর জন্য বিভিন্ন সরকারি অফিসের কর্মচারিদের অভিযুক্ত করা হয়। ১১ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুবাষিকীতে কার্জন হলে ইসলামী ছাত্র সংঘের এক অনুষ্ঠানে আল-বদরদের আগমনী উপলক্ষে শুভেচ্ছা বার্তা শোনা যায় গোলামের কণ্ঠে–

    29
    ২৩ সেপ্টেম্বর মতিউর রহমান নিজামী কোনো রাখঢাক না করেই সুস্পষ্ট অভিযোগের আঙুল তোলে বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে। ইসলামিক একাডেমিতে আয়োজিত সিরাত সম্মেলনে গোলাম আযমের উপস্থিতিতে পাকিস্তান ছাত্র সংঘ প্রধান বলে, যারা ইসলামকে ভালোবাসে, শুধুমাত্র তারাই পাকিস্তানকে ভালোবাসে। এবারের উদঘাটিত এই সত্যটি যাতে আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা ভুলে যেতে না পারেন, সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

    30
    ১০ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভারতের দালাল ও বিশ্বাসঘাতকদের খুঁজে বের করে হত্যা করার যুক্তি দেয় দৈনিক সংগ্রাম ‘বাবুদের আরেক রূপ’ শিরোনামে–

    31
    ১২ নভেম্বর ‘রোকেয়া হলের ঘটনা’ শিরোনামে এক উপসম্পাদকীয়তে আবারও অফিস এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা সন্দেহজনকদের খুঁজে বের করে হত্যার কথা বলে সংগ্রাম:

    32
    ১৪ নভেম্বর মতিউর রহমান নিজামীর লেখা ‘পাকিস্তান ও আল বদর’ নামে একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় সংগ্রামে। সেখানে নিজামী লিখে–

    ‘‘… আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। পাকসেনার সহযোগিতায় এ এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্র সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল তিনশত তের। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে ৩১৩ জন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বদর যোদ্ধাদের সেইসব গুণাবলীর কথা আমরা আলোচনা করেছি, আলবদর তরুণ মুজাহিদদের মধ্যে ইনশাল্লাহ সেই সর্বগুণাবলী আমরা দেখতে পাব।

    পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে গঠিত আলবদরের যুবকেরা এবারে বদর দিবসে নতুন করে শপথ নিয়েছে, তাদের তেজোদ্দীপ্ত কর্মীদের তৎপরতার ফলেই বদর দিবসের কর্মসূচী দেশবাসী তথা দুনিয়ার মুসলমানদের সামনে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছে। ইনশাল্লাহ, বদর যুদ্ধের বাস্তব স্মৃতিও তারা তুলে ধরতে সক্ষম। তরুণ যুবকরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে।’’

    33
    একই সংখ্যায় আলী আহসান মুজাহিদ লেখে ‘অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র, যুক্ত নয় নামে একটি প্রবন্ধ।

    ২৩ নভেম্বর সারাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করে ইয়াহিয়া সরকার। এ সময়ই মাঠে নামে আল-বদর। এর আগে তারা তাদের টার্গেট বুদ্ধিজীবীদের একটি চিঠি পাঠায়। শহীদ সিরাজউদ্দিন হোসেনের পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠিতে লেখা ছিল–

    শয়তান,

    ব্রাক্ষণ্যবাদী হিন্দুদের যেসব পা চাটা কুকুর আর ভারতীয় ইন্দিরাবাদের দালাল নানা ছুতানাতায় মুসলমানদের বৃহত্তম আবাসভূমি পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে তুমি তাদের অন্যতম। তোমার মনোভাব, চালচলন ও কাজকর্ম কোনোটাই আমাদের অজানা নেই। অবিলম্বে হুশিয়ার হও এবং ভারতের পদলেহন থেকে বিরত হও, না হয় তোমার নিস্তার নেই। এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে নির্মূল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।

    শনি

    34
    ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা হত্যাকাণ্ডের অপারেশন ইন-চার্জ ছিল চৌধুরী মুঈনউদ্দিন, যে এখন ইংল্যান্ডে বসে বিরাট ধর্মীয় নেতা বনে গেছে। আর মূল ঘাতকের ভূমিকায় ছিল আশরাফুজ্জামান, যে এখন নিউইয়র্কে এক মসজিদে ইমামতি করছে। স্বাধীনতার পর মোস্ট ওয়ান্টেড এই দুজন এখন ইসলাম বিক্রি করে খাচ্ছে বিদেশে এবং জামায়াতে ইসলামীর নেতা হিসেবেই।

    35
    আল-বদরদের মাটিলেপা মাইক্রোর (যেটি করে তারা বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়ে আসত) ড্রাইভারের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, ইসলামী ছাত্র সংঘের হাই কমান্ডের কার কী ভূমিকা। ক’দিন পর ধরা পড়া জামাতের প্রচার সম্পাদক (বর্তমানে আধুনিক প্রকাশনীর দায়িত্বে এবং বাংলাদেশের বেশ ক’জন উঠতি বুদ্ধিজীবীর দেখাশোনা করে) আবদুল খালেক তার জবানবন্দীতে স্বীকার করে ইসলামী ছাত্র সংঘের এই ভয়াবহ নীলনক্সা।

    36
    এতো নৃশংস নির্মমতার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে যে অনেকের লাশের হদিসও মেলেনি। আজ, এই চল্লিশ বছর বুকে পাথর বেঁধে রাখা শহীদের স্বজনরা সেই হত্যাকাণ্ডের বিচারের উপলক্ষ পেয়েছেন। তা ভণ্ডুলের চেষ্টা চলবে, কিন্তু অস্বীকার করার প্রবণতা আমরা রুখে দেব। মাথায় টুপি পরে, হাতে কোরান নিয়ে যারা গণহত্যায় নামতে পারে, তারা মুসলমান নয়, মোনাফেক। এরা মিথ্যেবাদী প্রতারক। এদের রেহাই আল্লাহ এই দুনিয়াতেও দেননি।

    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/17966
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:৪১582830
  • জামায়াত শিবিরের হেডকোয়ার্টার কিন্তু লাহোর!
    অমি রহমান পিয়াল

    অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে গোলাম আযমের সেই সাফাই সাক্ষাতকারটির কথা। ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকদের ডেকে একাত্তরে নিজের এবং তার দল জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধ অস্বীকার করেছিলেন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান আমির। সেই সাক্ষাতকারেই তিনি বলছিলেন জামায়াতের হেডকোয়ার্টার তখনও লাহোরে ছিল, এখনও লাহোরে। না, এটা মোটেও ব্লুপার কিংবা মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাওয়া কোনো ভ্রান্তি ছিল না। এটাই বাস্তব। জামায়াতে ইসলামীর সদর দফতর লাহোরেই। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এখনও তাদের আঞ্চলিক সংগঠন হিসেবেই নথিবদ্ধ।

    ইউটিউবে এই সাক্ষাৎকারটির ভিডিও এই লিংকে দেখুন–



    কথাগুলো নতুন করে বলতে হচ্ছে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে। ক’দিন আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করেছে বাংলাদেশ সরকার। এরপর নানা বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। অনলাইনে এতদিন সবচেয়ে আলোচিত ছিল অভিযুক্ত কাদের মোল্লা আর একাত্তরের কসাই কাদের নাকি এক ব্যক্তি নয়। এই বিতর্ক আরও উস্কে দিয়েছিলেন সরকারদলীয় সাংসদ গোলাম মওলা রনি।

    তিনি একটি চিরকুট প্রকাশ করেছেন ফেসবুকে, দাবি করেছেন সেটা কাদের মোল্লার লেখা এবং চিরকুটে তাকে অনুরোধ করা হয়েছে জনগণকে এটা জানাতে যে কাদের মোল্লা আরেকজন কাদেরের দায় নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলছেন। রনির চিরকুট এবং সম্পূরক স্ট্যাটাস বার্তাটি যে ডাহা মিথ্যা তা প্রকাশ হয়ে যায় যখন কাদের মোল্লার স্ত্রীকে লেখা একটি চিঠি অনলাইনে আসে। দুটো চিঠির লেখনী এবং নাম স্বাক্ষরে পার্থক্যেই ধরা পড়ে রনি বানোয়াট গল্প ফেঁদেছিলেন।

    রনির তথাকথিত চিরকুট এবং স্ত্রীকে লেখা মোল্লার চিঠি
    রনির তথাকথিত চিরকুট এবং স্ত্রীকে লেখা মোল্লার চিঠি
    তবে পুরো ব্যাপারটিকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে গেছে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া। কাদের মোল্লাকে একজন প্রকৃত ‘পাকিস্তানপ্রেমিক’ হিসেবে প্রশংসা করে তার ফাঁসির নিন্দা জানানো হয়েছে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে। এই বিবৃতিতে আমাদের মনে আর কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয় জামায়াতের যুদ্ধাপরাধ ও পাকিস্তান-প্রেম নিয়ে। তাদের পক্ষে পাকিস্তানের স্বীকৃতির এই রূপ দেখে আমাদের অবাক হওয়ারও কিছু নেই।

    2
    জামায়াতে ইসলামীকে আমরা যে একটা যুদ্ধাপরাধী দল বলি এবং এর শীর্ষনেতারা সব যে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত, সেটা কোন ভিত্তিতে? এর একটা বড় কারণ আমাদের বুদ্ধিজীবী হত্যা। এই দায়টা প্রমাণিতভাবেই আল-বদর বাহিনীর কাঁধে পড়ে। আর কে না জানে এই আল-বদর বাহিনী গঠিত হয়েছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে। ১৯৭১ সালে ছাত্র সংঘের পাকিস্তান সভাপতি মতিউর রহমান নিযামী, পূর্ব পাকিস্তান সভাপতি আলী আহসান মুজাহিদ, হাই কমান্ডের মীর কাশেম আলী, কামারুজ্জামান– এরাই তো যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেফতারের আগে জামায়াতের নেতৃত্বে ছিলেন।

    এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আসাটা কোন অর্থে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক? নাকি বলতে চান আল-বদর বাহিনী যে ইসলামী ছাত্র সংঘই গঠন করছিল তার প্রমাণ দিতে হবে আগে! সেটা তো আছেই ভুরিভুরি। নাকি বাঙালি প্রমাণে চলবে না, খাঁটি পাকিস্তানি প্রমাণ লাগবে?

    3
    চাইলে সেটাও দেওয়া যাবে। তার আগে একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠনের নাম ‘ইসলামী জমিয়াত তালাবা’ (আইজেটি)। পূর্ব পাকিস্তানে এটারই বাংলা নাম ছিল ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার ফেরত পাওয়ার পর এরা নাম নেয় ইসলামী ছাত্র শিবির (দুই সংগঠনের লোগোতেও ব্যাপক মিল)। ১৯৭১ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের আল-বদর নামের ‘খুনে’ বাহিনীতে রিক্রুট করার দায়িত্ব ছিল আইএসআই-এর মেজর রিয়াজ হুসেইন মালিকের ওপর। বলা হয়, আল-বদর নামটাও তারই দেওয়া। সংশোধন করে বাদ দেওয়ার আগে উইকিপিডিয়াতে লেখা ছিল–

    The name Al-Badar was given by major Riaz Hussain during the passing out ceremony of first Al-badar group.

    4
    ১৯৯৭ সালে জমিয়াতের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয় ‘জমিয়াত কি পঞ্চাশ সাল’ নামে। সেই বিশাল প্রামাণ্যচিত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী জমিয়াতে তালাবা সম্পর্কে রিয়াজ হুসেইনের প্রশংসাধন্য বয়ান মিলে। প্রামাণ্যচিত্রটির একটা সংক্ষিপ্ত ভার্সন আছে ইউটিউবে। ‘আল-বদর ১৯৭১’ নামের ওই ফুটেজটি পাকিস্তানিদেরই আপলোড করা। ফুটেজটির ভূমিকায় দেখা যায়, সমাজতান্ত্রিক ও সেকুলার ছাত্রদের (ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন) মোকাবেলায় যোগ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে আইজেটিকেই মানা হয়েছে; সেকুলাররা যখন বন্দুক ধরেছে (মুক্তিবাহিনী হিসেবে) তখন তাদের ঠেকাতে ছাত্র সংঘের বন্দুক ধরাও ফরজ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।



    রিয়াজ হুসেইন কয়েকটি ঘটনার বর্ণণা দিয়ে এদের মাহাত্ম্য প্রচার করেছেন (একদম ইসলামী ছাত্র সংঘ নামটা উল্লেখ করেই)। যেমন একজন ছাত্র সংঘ সদস্য নাকি তার আপন ভাইকে পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছিল, কারণ তার ভাইটি ছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্য এবং সে সুবাদে ‘ভারতের দালাল’। তার যুক্তি– ‘এমন ভাইয়ের মরে যাওয়াই উচিত যে আমার কোটি মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে বেঈমানি করছে’!

    আরেকজন সদস্য তার ভাইয়ের জানাজা পড়েই আবার ডিউটিতে এসে হাজির। একজন সদস্য দেখতে ছোটখাটো বলে রিয়াজ তাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন ‘তোমার বয়স কম’ বলে। জবাবে সে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে বলেছে– ‘এখন তো বড় হয়ে গেছি’! তার জেহাদী তাগদে মুগ্ধ রিয়াজ তাকে রিক্রুট করছিলেন। আর সেই আল-বদরের নামে নাকি মুক্তিবাহিনী ভয়ে কাঁপত!

    5
    মূল জামায়াতের বক্তব্যে বেশ আফসোস এই কারণে যে এই আল-বদরদের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেনি পাকিস্তান। সেই ফুটেজে আমাদের স্বাধীনতার পর এদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। কোন ফুটেজটা ব্যবহার করা হয়েছে জানেন? আমাদের বুদ্ধিজীবীদের লাশের। তারা যে গণহত্যাকাণ্ডের দায়ে অপরাধী, সেই হত্যাকাণ্ডকেই নিজেদের সঙ্গী-সাথীদের হত্যাকাণ্ড বলে প্রচার করছে বিশ্বজুড়ে!

    6
    আফসোস হয় যখন পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ভক্ত বাঙালিদের দেখি। মুসলমান ক্রিকেটার হওয়ায় তাদের সমর্থন করাটাকে ঈমানের অংশ মনে করে তারা। ২০০৯ সালে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ ইসলামী জমিয়াতে তালাবা একটা ফুটবল-ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করে যার নাম ছিল ‘আল-বদর স্পোর্টস ফেস্টিভ্যাল ২০০৯’। সেই ক্রীড়ানুষ্ঠান উৎসর্গ করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে শহীদ (!) আল-বদরদের উদ্দেশ্যে। সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।

    নিচে রয়েছে একটি ভিডিও ফুটেজের স্ক্রিনশট, যেখানে ইনফোতে লেখা আছে–

    Nazim e Ala Islami Jamiat Talaba Pakistan,Br. Ateeq ur Rehman Khan Speaks in IJT Punjab Medical College’s Albadar Floodlight Sports Festival 2009. Dedicated to the martyrs of Albadr East Pakistan

    7
    পাকিস্তানের জমিয়তে তালাবার সঙ্গে ইসলামী ছাত্র শিবিরের যোগসূত্রটা মিথ্যা মনে হচ্ছে? তাহলে সরাসরি তাদের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারতে পারেন। দুটো স্ক্রিনশট দেওয়া হল প্রমাণ হিসেবে (যার ওপরের দিকে ইউআরএল আছে এবং সেখানেই সত্যমিথ্যা যাচাই হয়ে যাবে)। মতিউর রহমান নিযামী ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মতো জমিয়তে তালাবার সভাপতি নির্বাচিত হন (যদিও জামায়াতি প্রচারণা হচ্ছে তিনি তখন হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যেতেন)। ১৯৭১ সালে নিযামী পুনঃনির্বাচিত হন। এই নিযামী এবং তার গোলামী সম্পর্কে বিশেষ প্রশংসাসূচক বাক্য লেখা আছে জমিয়াতে তালাবার ব্লগস্পটে।

    নিযামী সম্পর্কে সেখানে বলা হয়েছে–

    Motiur Rahman Nizami (Born 31 March 1943) : Motiur Rahman Nizam is the current chief (Ameer) of the Jamaat-e-Islami Bangladesh, which is the largest Islamic political party in Bangladesh. Nizami rose in the ranks of the Jamaat-e-Islami in East Pakistan in the 1960s, after being a leader of a student organization, Islamic Chhatro Shango (now Islami Chhatro Shibir). During the liberation war of 1971, Nizami actively supported the cause of West Pakistan and formed the Al-Badr Force in which he acted as the supreme commander of the Al-Badr Militia).

    8
    অন্য আরেকটি স্ক্রিনশটে দেখা যায়, ১৯৮১ সাল থেকে জমিয়তে তালাবা পাকিস্তান তাদের ‘বেংলাদেশি’ (Bengladesh– বানান লক্ষ্যণীয়) সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীগুলোয় অংশ নেয়; তাদের পূর্ব পাকিস্তানি ভাইয়েরাও ‘বেংলাদেশ’ থেকে তাদের অনুষ্ঠানে যায়। আল-বদর ফ্যান ক্লাবও ফেসবুকে আছে। সেখানে জমিয়তে তালাবার ‘পাকি’ আর ‘বেঙ্গা’ দুই অংশেরই ব্যাপক অংশগ্রহণ।

    9
    এর বাইরে আরও কিছু ওপেন আর ক্লোজ গ্রুপ আছে বদরদের সম্মানে।

    এবার একটা গানের কথা বলি। তার আগে জমিয়াতে তালেবার পতাকাটা দেখুন, লাল-সবুজটা কাকতালীয় হলেও ওটায় কিন্তু পাকিস্তান লেখা নেই, লেখা আছে ‘বাগেস্তান’। গানটা ওদের দলীয় সঙ্গীত। ঠিক ২ মিনিট ৬ সেকেন্ডে শুনবেন ‘বাঙাল’ আর ‘আল-বদর’।



    10
    সবশেষে একটি ছবি দেখাই। ২০১১ সালের বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করে ইসলামী ছাত্র শিবির। দেখতেই পাচ্ছেন সেই টুর্নামেন্টের বিজয়ী কারা! পাকিস্তানের জার্সি পরিয়ে জেতানো এই অবুঝ কিশোরদের বিপরীতে কারা খেলেছিল? কোন দল?

    একটু মাথা খাটালেই উত্তরটা পেয়ে যাবেন। জ্বি, বাংলাদেশ।
    http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/13911
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:৫৪582831
  • বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেন পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে-সিনেমায় উপেক্ষিত
    অমিতাভ ভট্টশালী
    বিবিসি বাংলা, কলকাতা
    ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

    ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসা প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে, যাঁদের দুর্বিসহ জীবন দেখে যুক্তরাষ্ট্রের কবি অ্যালেন গিনসবার্গ লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড'।
    সেইসময়ে কলকাতা শহরেরই একটি বাড়িতে চলেছে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
    বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সেই দিনগুলোর পরে কেটে গেছে ৪৫টা বছর..
    কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে পাশে থাকার যে আবেগ ছিল পশ্চিমবঙ্গের মানুষের, তারপরের সাড়ে চার দশকে সেই আবেগ থেকে কি অনেকটা দূরে সরে গেছেন কলকাতার মানুষ? যে কারণে এতগুলো বছরেও পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা বা সাহিত্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এখনও প্রায় অনুপস্থিত?
    সাহিত্যিক অমর মিত্র: উপন্যাস লিখছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে
    Image caption
    সাহিত্যিক অমর মিত্র: উপন্যাস লিখছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে
    যে লড়াইয়ের অন্যতম স্তম্ভ থেকেছে যে ভাষাটা - সেই একই ভাষাতে যাঁরা সাহিত্য চর্চা করেন বা ছবি বানিয়ে থাকেন, সেই পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক বা চলচ্চিত্রকারেরা কী করে নিস্পৃহ হয়ে পড়লেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে?
    প্রশ্নটা করেছিলাম পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র বিশ্লেষক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টডিজ বিভাগের অধ্যাপক, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে।
    "১৯৭১ থেকে এই ২০১৬ সাল পর্যন্ত ওপার বাংলায় গদ্য সাহিত্য, চলচ্চিত্র বা কবিতা - সব ক্ষেত্রেই ভাষাকে অবলম্বন করে একটা আত্মপরিচয় খোঁজার চেষ্টা চলেছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপরে ভিত্তি করে ১৯৪৭-এ যে দেশ ভাগ, সেটা যে ভুল, তার প্রমাণ ওঁরা পেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের সমস্যাটা হচ্ছে যে ৭১ থিতিয়ে যাওয়ার পরে এখানে সকলে যেমন দ্বিজাতি তত্ত্ব যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে, সেটা মেনে নেন, কিন্তু এই জয়টাকে মূলত ভারতীয় সেনাবাহিনীর জয় বলেই মনে করেন," বলছিলেন মি. মুখোপাধ্যায়।
    তাঁর কথায়, " পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা যেহেতু একটা অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা, এখানে অনেকগুলো ভাষার মধ্যে একটা হল বাংলা, তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জয়টাকে নিজেরা কখনই হয়তো উপলব্ধি করতে পারেন নি এদিকের মানুষ, কিন্তু নিঃসন্দেহে সমর্থন করেছে। যারা বয়সে খুব প্রবীণ, তাদের ক্ষেত্রে এটা নস্টালজিয়া, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও তরুণ প্রজন্মের কাছে তো সেই স্মৃতি নেই, তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিজেদের রিলেট করতে পারে না।"
    নামী প্রকাশক ও কলকাতা বই মেলার অন্যতম প্রধান সংগঠক ত্রিদিব চ্যাটার্জীও স্বীকার করছিলেন যে সত্যিই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এপারের বাংলা সাহিত্যে সেভাবে উঠে আসে নি।
    তথ্যচিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার
    Image caption
    তথ্যচিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার
    "১৯৭১ আর তার ঠিক পরবর্তী সময়ে কিন্তু বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস আমার মনে পড়ছে, যেগুলো মুক্তিযুদ্ধকে নিয়েই লেখা হয়েছিল। প্রফুল্ল রায়, শঙ্কর এঁদের উপন্যাসগুলি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়াও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদারের লেখায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। কিন্তু নবীন প্রজন্মের যে লেখকরা, তাঁরা কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন বলে মনে করতে পারি না। আশির দশকের মধ্যভাগের পরে তো কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তো কেউ লেখেনই নি," বলছিলেন মি. চ্যাটার্জী।
    কারণ হিসাবে তিনি বলছিলেন, "বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের চিন্তা বা মননে হয়তো কোনও ফারাক নেই। কিন্তু নতুন প্রজন্মের লেখকদের কাছে এই দুই দিকের সাঁকোটা জোড়া লাগে নি। দুর্ভাগ্যের হলেও এটা মানতে হবে। আসলে ৭১ পরবর্তী যে রাজনৈতিক ঘটনাগুলো বাংলাদেশে হয়েছে, মুজিব হত্যা, নতুন সামরিক প্রশাসন - সব মিলিয়ে যে একটা ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ পেরলো, বা তারপরেও অস্থিরতা - সব কিছু দেখে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছুটা নিরুত্তাপ হয়ে গেছেন।''
    ''তবে ২১শে ফেব্রুয়ারি কিন্তু এখনও কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে নাড়া দেয়। কিন্তু ত্রিপুরা বা বরাকের মানুষের কাছে এখনও বাংলাদেশ নামটাই অন্য মাত্রা বহন করে, সেগুলো তাদের লেখাতেও বোঝা যায়।"
    পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছুটা নিরুত্তাপ হয়ে যাওয়ার অন্য দুটি কারণের কথা বলছিলেন তথ্যচিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার।
    "৭১-এ যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল, ঠিক সেই সময়েই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন চলছে। প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছেন, পুলিশ গুলি চালাচ্ছে, প্রায় প্রতিটা পাড়া থেকেই যুবকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ - একটা চূড়ান্ত অস্থির সময় ছিল সেটা। নিজের রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে যতটা আলোড়িত হয়েছিলেন লেখক- চলচ্চিত্র নির্মাতারা, সেই পরিবেশে তাঁরা আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশি হয়তো মাথা ঘামাতে পারেন নি। এছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের তরফে যা সাহায্য সহায়তা করা হয়েছিল, তার কেন্দ্রে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু ঘটনাচক্রে নকশাল আন্দোলন বা তার পরের জরুরি অবস্থার কারণে বহু মানুষই - বিশেষত বুদ্ধিজীবিদের একটা বড় অংশ মিসেস গান্ধীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, সেজন্যও হয়তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এদিকের মানুষ কিছুটা নিরুত্তাপ থেকেছেন," বলছিলেন মি. দস্তিদার।
    সাহিত্য পুরস্কার জয়ী লেখক অমর মিত্রও মানছেন যে তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিরুত্তাপই থেকেছেন এতগুলো বছর ধরে।
    মি. মিত্রর কথায়, "লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। সেখানকার সাহিত্যে যে প্রভাব মুক্তিযুদ্ধ ফেলেছে, সেটা যে আমাদের এদিকে পড়বে না, এটা স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব তো বাংলাদেশের সাহিত্যটাকে অনেকটা পাল্টে দিয়েছে। কোনও ব্যক্তিবিশেষের লেখায় হয়তো মুক্তিযুদ্ধ প্রভাব পড়ে থাকতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে সেটা ঘটে নি।"
    মি. মিত্র অবশ্য এত বছর পরে এসে সাতক্ষীরায় ফেলে আসা শিকড়ের টান অনুভব করছেন। এর আগে যদিও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সীমান্তে ওষুধ বয়ে নিয়ে যাওয়ার তরুণ বয়সের অভিজ্ঞতা থেকে একটা গল্প লিখেছিলেন, কিন্তু এখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রীতিমতো রিসার্চ করে একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন অতি সম্প্রতি।
    "বয়স যতো বাড়ছে, ততই বোধহয় শিকড়ের টান অনুভব করছি," বলছিলেন অমর মিত্র।
    সেই টান কেন অন্য সাহিত্যকার বা চলচ্চিত্রকারেরা অনুভব করেন না, কেন উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা নিয়ে তাদের গল্প-উপন্যাস বা কবিতা লেখার কথা বা সিনেমা তৈরির কথা মনে হয় না, সেটা জানতে যখন আরও বেশ কয়েকজন প্রথিতযশা সাহিত্যিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, তারা বলেই দিলেন এ বিষয়ে কোনও কথা বলবেন না তারা।
    http://www.bbc.com/bengali/news-38343194
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:৫৬582832
  • বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো মুক্তিযুদ্ধ কেন বড় ফ্যাক্টর?
    শারমিন রমা
    বিবিসি বাংলা, ঢাকা
    ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

    মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নানা পরিবর্তন এলেও দেশটির রাজনীতি এখনো আবর্তিত হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। ১৯৭১ সালে কার কী ভূমিকা ছিল, স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি কারা এরকম ইস্যুতে প্রধান রাজনৈতিকদলগুলো এখনও পরস্পর বিতর্কে জড়াচ্ছে।
    ৪৫ বছর পরও কেন ''মুক্তিযুদ্ধ'' এদেশের রাজনীতিতে একটা বড় ইস্যু? এ প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেন, বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন এই মুক্তিযুদ্ধ।
    "স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ সবসময়ই আমাদের প্রেরণার উৎস। এটা অনন্তকাল ধরে চলবে," বলেন তোফায়েল আহমেদ।
    বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সাধারণ জনগণ। কিন্তু অভিযোগ আছে, কোটি মানুষের অংশগ্রহণে মুক্তিযুদ্ধে অর্জনের কৃতিত্বটা পুরোটাই দাবি ক'রে, এর মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধি করতে চায় আওয়ামী লীগ। যদিও এই দাবি যৌক্তিক বলেই মনে করে দলটি।
    "আওয়ামী লীগই তো এই স্বাধীনতার চেতনা এবং মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে সারা বাংলাদেশের মানুষকে আজ ঐক্যবদ্ধ করেছে। সুতরাং যারা স্বাধীনতা বিরোধী তারা তো স্বাধীনতার মর্যাদা বুঝবে না বা বোঝে না। সেই কারণেই তারা আওয়ামী লীগকে এইরকম দায়ী করে," মন্তব্য তোফায়েল আহমেদের।
    বিএনপির নেতা মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদের মতে, রাজনৈতিক দলের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কটি রাজনীতিরই মারপ্যাঁচের অংশ।
    "যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে তারা জনগণের কাছে ঘৃণার পাত্র। সুতরাং এই দুই দলেরই চেষ্টা থাকে প্রতিপক্ষকে ঘৃণার দলে ফেলে দেবার জন্যে। তারাও বলে যে আমাদের নেতা মুক্তিযোদ্ধা না। তিনি আইএসআই'র এজেন্ট ছিলেন। আমরাও বলি তোমরা তো পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছ, স্বাধীনতার ঘোষণা তো তোমরা দাও নাই।"
    তোফায়েল আহমেদ
    Image caption
    তোফায়েল আহমেদ
    বাংলাদেশের দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিভক্তির একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা হয় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে।
    মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দলটির বিতর্কিত ভূমিকার ভিত্তিতেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে উঠে এসেছে স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষ শক্তি নিয়ে বিতর্ক।
    তোফায়েল আহমেদ বলেন, "বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া, তিনিই তো সেই স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে পতাকা দিয়ে মুজাহিদকে মন্ত্রী করেছেন, নিজামীকে মন্ত্রী করেছেন। তার মানে কী? তার মানে, আপনি কি তাদেরকে বলতে পারেন তারা স্বাধীনতার পক্ষে? আজ পর্যন্ত তারা জামায়াতকে ত্যাগ করতে পারে নাই।"
    অন্যদিকে, বিএনপির নেতা মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদের যুক্তি জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল, বিএনপি আওয়ামী লীগও রাজনৈতিক দল।
    "ক্ষমতায় যাবার জন্য আওয়ামী লীগ জামায়াতকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে, বিএনপিও জামায়াতকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। সুতরাং এটি যদি দোষের হয় তাহলে উভয় দলই সমভাবে দোষী। এটি একটি নির্বাচনী মৈত্রী, এটি আদর্শিক কোনো জোট নয়"।
    কে স্বাধীনতা পক্ষের শক্তি কে বিপক্ষের এ নিয়ে ৪৫ বছর ধরে চলছে বিতর্ক
    Image caption
    কে স্বাধীনতা পক্ষের শক্তি কে বিপক্ষের এ নিয়ে ৪৫ বছর ধরে চলছে বিতর্ক
    মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে রাজনীতিতে ব্যবহারের ক্ষেত্রে গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন স্বাধীনতার ঘোষক কে তা নিয়ে বিতর্ক ইতিহাসের গবেষকদের আশ্চর্য করে।
    "যেটা বিতর্ক তৈরি হয়েছে এবং ১৯৭৫ সালের পরে যে বিতর্কটা সবল হয়েছে সেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের কে ঘোষক? এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক তৈরি হতে পারে এটা আমার কাছে একজন ইতিহাসের গবেষক হিসেবে আশ্চর্য লাগে। কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধ তো কোনো দিন-ক্ষণ-সন দেখে মানুষ করে না। এটাতো একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শেষ পর্যায়। বস্তুতপক্ষে শুধু জাতীয়তাবাদীও নয়, এটা শ্রেণীর আন্দোলন, সমাজের আন্দোলন, জনগোষ্ঠীর আন্দোলন।"
    মি. চৌধুরীর মতে, স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে অস্বস্তি কিংবা বিতর্ক দেশের সব জনগোষ্ঠীর সমস্যা নয়, এটি কেবল স্বল্পসংখ্যক রাজনীতিবিদের সমস্যা।
    তিনি বলেন দলগুলোর মধ্যে এমন কোনো মৌলিক অর্থনৈতিক, সামাজিক-রাজনৈতিক পার্থক্য নেই।
    ''যে পার্থক্যটা তারা টানতে পারে সেটা হচ্ছে, আওয়ামী লীগতো স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান দল, অতএব সেই ব্যাপারে তারা নিশ্চিত। আর অন্যদিকে যেটা হলো, বিএনপি পঁচাত্তর সালের পরে জামায়াত ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করেছে। এটাতো একটা মৌলিক বিভাজন। মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের জন্মের সূত্র, এর তো অন্য কোনো বিকল্প নাই, এটা তো আমাদের জন্মের ইতিহাস।"
    http://www.bbc.com/bengali/news-38332019
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:৫৭582833
  • বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কেন বাড়ছে?
    আবুল কালাম আজাদ
    বিবিসি বাংলা, ঢাকা
    ২৬ জানুয়ারি ২০১৭

    বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা এখন সনদ নেয়ার জন্য বিপুল আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
    কর্তৃপক্ষের কাছে অনলাইন এবং হাতে লেখা অন্তত ১ লাখ ৩৪ হাজার দরখাস্ত পড়েছে যাদের যাচাই বাছাই করে চূড়ান্ত তালিকা করারও কার্যক্রম এখন শুরু হয়েছে।
    মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পাঁচবার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও বেড়েছে।
    ৮০'র দশকে সর্বপ্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় তালিকা প্রণয়ন হয়। সেসময় ঐ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এক লক্ষেরও কিছু বেশি সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে। পরবর্তীতে আরও কয়েক দফা যাচাই-বাছাই শেষে বিএনপি সরকারের আমলে প্রায় দুই লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার তালিকার গেজেট প্রণয়ন করা হয়। বর্তমান গেজেট-ভুক্ত রয়েছেন প্রায় ২ লক্ষ কুড়ি হাজার মুক্তিযোদ্ধা।
    বাংলাদেশ স্বাধীন করতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সর্বস্তরের মানুষ। যাদের অনেকেই ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিয়মিত ও বেসামরিক বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন।
    মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরী
    Image caption
    মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরী
    মুক্তিযুদ্ধ এবং ৭১ এর প্রসঙ্গ এলে প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাই আবেগপ্রবণ হন। মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরী বলেন, দেশের স্বাধীনতা ছাড়া তখন কোন কিছু পাওয়ার আশা কেউ করেনি।
    "তখন কিন্তু আমিও যুদ্ধ করতে গেছি। আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু আমার কোনো কাগজ নাই। আমি জানতাম না আমার দেশ দেখবো কিনা, আমি আমার দেশ পাব কিনা, আমি নিজে বেঁচে থাকবো কিনা। তখন কিন্তু আমি মরতে গেছি।"
    আক্কু চৌধুরীর মতো এরকম চিন্তাভাবনা থেকেই সবাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।
    দুই নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন নজরুলই ইসলাম। পেশায় ক্ষৌরকার এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, সুযোগ সুবিধা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠিতরা ছাড়া সবাই এখন সার্টিফিকেটকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি বলেন,
    "অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষুক আছে, অনেকে রিকশা চালাইতাছে, অনেক মুক্তিযোদ্ধা চা'র দোকানদারি করছে। সব সরকারই তালিকা করিছে কিন্তু যে সুবিধা ছিল ৩শ-৪শ টাকা তা অনেকে নিতিও যাইনি। এখন সরকার যে সুযোগ সুবিধা দেচ্ছে তাতে সবাই আগ্রহ পাচ্ছে"।
    মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম
    Image caption
    মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম
    বাংলাদেশে এখন মুক্তিযোদ্ধারা মাসে ন্যুনতম ১০ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা পান। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি নাতনিরা ৩০ ভাগ কোটা সুবিধা পান। মুক্তিযোদ্ধারা সরকারি চাকুরীজীবী হলে দুই বছর বেশি চাকরি করার সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসা, আবাসন ও রেশনসহ নানারকম সুযোগ সুবিধা আছে। এসব সুবিধা পেতে অনেকেই এখন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আসতে চান। নতুন আবেদনকারীদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিতে সারাদেশে যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।
    পুন্যব্রত চৌধুরী, মহাপরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল
    Image caption
    পুন্যব্রত চৌধুরী, মহাপরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল
    জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক পুন্যব্রত চৌধুরী জানান পুরনো সব গেজেট এবং লাল তালিকায় থাকা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে সবার যাচাই বাছাই হবে।
    "এই সার্টিফিকেট নিয়েতো কোনো বিতর্ক থাকার কথা না। একমাত্র ভারতীয় তালিকা এবং লালমুক্তিবার্তাটা আমরা সঠিক ধরে নিচ্ছি। যদিও লাল মুক্তিবার্তায় থাকার পরও দেখা গেছে কেউ কেউ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত সনদ এটাও স্ক্যানিং করে জাল পাওয়া গেছে"।
    বাংলাদেশে সচিব পদমর্যাদার আমলাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হতে দেখা গেছে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এবং মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া বলেন,
    "মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অকাতরে কানাকড়ির দামে প্রাণ আর কোনো জাতি দেয় নাই। সেটাকে যখন আমরা কলঙ্কিত করে ফেলি, কলুষিত করে ফেলি আমাদের লজ্জার শেষ থাকে না"।
    মুক্তিযোদ্ধা
    Image caption
    মুক্তিযোদ্ধার বর্তমান সংখ্যা দুই লাখের বেশী
    মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে মি. হাসান বলেন, "রাজনৈতিক দলের স্বার্থ আছে, প্রভাব আছে। কাজেই একজন যে নিরপেক্ষ ছিল সে এখন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি এবং সনদ পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাজনৈতিক দল দেখছে আমার সমর্থক বাড়ছে, ভোট বাড়ছে। কাজেই স্বার্থটা উভয় পক্ষের"।
    এদিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে ২০১৬ সালে নতুন সংজ্ঞা দিয়েছে। সেখানে ৭১ এ মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণ হয়েছে ১৩ বছর। রণাঙ্গনের যোদ্ধা ছাড়াও ৭১'এ নির্যাতিত নারী বা বীরাঙ্গনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবদান রাখা পেশাজীবী, শিল্পী, ফুটবল খেলোয়াড়, ডাক্তার নার্স এবং সাংবাদিকরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবেন। দেখা যাচ্ছে এসব কারণেও মুক্তিযোদ্ধা বাড়বে।
    http://www.bbc.com/bengali/news-38758647
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৫:৫৯582834
  • পদ্মার চরে গণকবরে বাবার মরদেহ পাওয়া যায়'
    ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬

    ১৯৭১ সালের ২৫শে নভেম্বর রাজশাহী শহরের বাসা থেকে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মীর আব্দুল কাইয়ুমকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। শিক্ষক মি: কাইয়ুমকে যখন তুলে নেয়া হয় তখন রাত আনুমানিক নয়টা ।
    রাত নয়টার দিকে এক ব্যক্তি মি: কাইয়ুমের বাসা গিয়ে জনান যে তাকে বাইরে একজন আর্মি অফিসার ডাকছে।
    মি: কাইয়ুম সে আর্মি অফিসারের সাথে দেখা করতে গেলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তিন আর কখনো বাসায় ফিরে আসেননি।
    বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দুইদিন পরে রাজশাহীর শহরের কাছে পদ্মার চরে একটি গণকবরে শিক্ষক মীর আব্দুল কাইয়ুমের মরদেহ পাওয়া যায়।
    নিহত শিক্ষক মীর আব্দুল কাইয়ুমের বড় ছেলে মীর মাসুদ কবির বিবিসি বাংলার কাছে বলছিলেন, বাবার হত্যাকাণ্ডের সময় তার বয়স ছিল সাড়ে ছয় বছর।
    তিনি বলেন, "বিজয় দিবসের পরে কেউ একজন আমাদের বাসায় খবর দেন যে আমার বাবার মতো দেখতে একজনের লাশ রাজশাহীর পদ্মার চরে পাওয়া গেছে। সেটা শুনে আমার বড় মামা এবং আমার আম্মার মামা সেখানে যান। আমার বাবার শার্ট এবং হাতের আংটি দেখে ওনারা মৃতদেহ শনাক্ত করেন।"
    ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তৎকালীন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক এবং সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের হত্যা করে পাকিস্তানী বাহিনী। তাদের সহযোগিতা করেছিল আলবদর বাহিনী।
    মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন সময় এসব হত্যাকাণ্ড হলেও ১৪ই ডিসেম্বর একযোগে বহু বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের স্মরণ করতে বুধবার বাংলাদেশে পালন করা হচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।
    মি: কবির বলছিলেন, "আমরা রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের চার নেতার এক নেতা কামরুজ্জামান সাহেবের পাশের বাসায় থাকতাম। পারিবারিকভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে ওনার সাথে আমার বাবার একটা সখ্যতা ছিল। আমার মামারা বামপন্থী রাজনীতি করতেন। সেখানেও আমার বাবার একটা পৃষ্ঠপোষকতা ছিল।"
    তাছাড়া শিক্ষক মীর আব্দুল কাইয়ুম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন তরুণ শিক্ষক হিসেবে অনেক শিক্ষার্থীর কাছে তিনি বেশ গ্রহণযোগ্য ছিলেন। এসব কারণে তাকে পাকিস্তানী বাহিনী হত্যা করেছে বলে ধারণা করেন তার পরিবার।
    মি: কবির বলছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এপ্রিল মাসে তৎকালীন শিক্ষক মীর আব্দুল কাইয়ুমের রাজশাহীর বাসা অগ্নিসংযোগ করে পাকিস্তানী বাহিনী।
    স্বাধীনতার ৪৫ বছরের মাথায় যুদ্ধাপরাধের এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত শীর্ষ অভিযুক্তদের বিচার হয়েছে। মি: কবির মনে করেন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সবার বিচার হলে ৪৫ বছর আগের ঘটনার ন্যায় বিচার হবে।
    http://www.bbc.com/bengali/news-38311721
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৬:০০582835
  • 'এ সম্মাননা নিহত ভারতীয়দের প্রতি বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতা'
    ২১ নভেম্বর ২০১৬

    বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয় নাগরিকদের 'মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা' ও অর্থ-সহায়তা দিতে যাচ্ছে ।
    আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় সাতজনের পরিবারের কাছে এই সম্মাননা তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
    সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা এবং অর্থ সহায়তা হিসেবে পাঁচ লাখ রুপি দেয়া হবে ১৬৬৮ জন ভারতীয় সেনাকে।
    এছাড়াও তাদের প্রতি সম্মান জানাতে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণেরও পরিকল্পনা করছে সরকার। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই স্মৃতিফলক নির্মাণ হবে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক।
    মুক্তিযুদ্ধের প্রায় চার দশক পর ভারতীয় সেনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে বাংলাদেশ এই উদ্যোগ নিল।
    এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক বলছেন, "বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও আগেই এ পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল, কিন্তু নানাবিধ কারণে এত দেরিতে এ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।"
    মি: হক বলেন, "শহীদ ১৬৬৮ ভারতীয় সেনার মুক্তিযুদ্ধে অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি নগদ পাঁচ লাখ টাকাও দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ সম্মাননা ভারতীয় সেনাদের প্রতি বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতা।"
    ১৯৭১ সালের যুদ্ধের চিত্রছবির কপিরাইটAFP
    Image caption
    মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর লড়াইয়ে ভারতীয় সেনারাও প্রাণ হারায়।
    "১৯৭১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর লড়াইয়ে বাংলাদেশের যোদ্ধাদের পাশাপাশি ভারতীয় সৈন্যরাও নিহত হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতায় তাদের অনেক অবদান রয়েছে। তাদের প্রতি আমরা যে কৃতজ্ঞ এটারই প্রতীক এই মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা"- বলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক।
    মি: হক জানান ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয়দের নাম, ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ১৬৬৮ জন ভারতীয় সেনার নাম।
    প্রতিটি শহীদ পরিবারের হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ক্রেস্ট ও মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা দেয়া হবে এবং প্রত্যেক পরিবারকে নগদ পাঁচ লাখ টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
    আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ভারত সফর করবেন, সেখানে তিনি নিহত ভারতীয় সাতজনের পরিবারের হাতে মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা তুলে দিবেন।
    পরবর্তীতে ভারতে সাতটি জায়গায় গিয়ে বাকিদের সম্মাননা দেয়া হবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে। মি: হক জানান যে শহীদদের পরিবারদের কোন জায়গায় সম্মাননা দেয়া হবে সেটা ভারতের কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে।
    http://www.bbc.com/bengali/news-38048151
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৬:১৬582836
  • 'এখনও লক্ষ্য পূরণ হয়নি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির'
    আকবর হোসেন
    বিবিসি বাংলা, ঢাকা
    ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

    শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়।
    বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র বিশ বছরের মাথায় চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীরা যখন রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠছিলেন সে সময় তার প্রতিবাদ করার জন্য কেউ-কেউ একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
    জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হবার পর ১৯৮১ সালে জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আজম পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এরপর তার নানা ধরনের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়।
    শেষ পর্যন্ত খোলস ছাড়িয়ে ১৯৯১ সালে গোলাম আজমকে জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচন করা হয়। তার আগেই জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে।
    গোলাম আজমের রাজনীতিতে ফিরে আসার প্রতিবাদ জানাতেই গড়ে উঠেছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সংগঠনটির বর্তমান নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জড়িত ছিলেন।
    মি: কবির বলছিলেন, " ১৯৯১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর যেদিন আমরা কাগজে দেখলাম, একাত্তরের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী এবং তখনো পাকিস্তানের নাগরিক গোলাম আজমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের আমীর ঘোষণা করেছে। তখনই মুক্তিযুদ্ধের সাত নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামান আমাকে টেলিফোন করে বললেন যে এর বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদ করা দরকার।"
    মুনতাসির মামুনছবির কপিরাইটBBC BANGLA
    Image caption
    একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেছেন সংগঠনটির এখনো পুরো লক্ষ্য পূরণ হয়নি
    তখনই দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯২ সালের ১৯শে জানুয়ারি আম্মা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়।
    একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতি শুরুর দিকে শহরাঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের ব্যাপক সমর্থন ছিল। ১৯৯৪ সালে এক প্রতীকী বিচারের মাধ্যমে গোলাম আজমের ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। যেটিকে তারা 'গণ আদালত' বলে বর্ণনা করেন।
    এর ২০ বছর পরে এসে গোলাম আজমসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের সাজা হয়। এ ২০ বছর বিচারের দাবীতে সক্রিয় ছিল সংগঠনটি। তারা বলছে যে দু'টো লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল তার মধ্যে একটি লক্ষ্য - অর্থাৎ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে।
    কিন্তু এখনো পুরো লক্ষ্য পূরণ হয়নি বলে উল্লেখ করছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি অধ্যাপক মুনতাসির মামুন।
    তিনি বলেন, "যারা ঘাতক তাদের কাছ থেকে উদ্ভূত হয়েছে মৌলবাদী রাজনীতির। এখন আমাদের আন্দোলন হচ্ছে বিচার চালিয়ে যাওয়া এবং একই সাথে জঙ্গি-মৌলবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের আন্দোলন এখন বাংলাদেশে মৌলবাদ প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে।"
    ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিছবির কপিরাইটFOCUSBANGLA
    Image caption
    ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বর্তমান নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন তাদের আন্দোলন থামাতে নানা রাজনৈতিক বক্তব্য সামনে আনা হয়েছিল।
    বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বরুপ উন্মোচনের জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বড় ভূমিকা রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
    এ সংগঠনটির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় সরকারের রোষানলেও পড়েছেন। বিশেষ করে বিএনপি সরকারের সময়।
    একাত্তরের ঘাতক দালাল কমিটির বিরোধীতাকারীরা এমন অভিযোগও তুলেছে যে সংগঠনটি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাজ করছে।
    শাহরিয়ার কবির মনে করেন তাদের আন্দোলনকে থামিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে নানা ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য সামনে আনা হয়েছিল।
    মি: কবির বলছিলেন, "বামপন্থীরা বলে আমরা আওয়ামী লীগের পক্ষে চলে গেছি। আবার আওয়ামী লীগ বলে আমরা বামদের কথা বলি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দাঁড়িয়ে আছি। সেখানে কারও সাথে আমাদের কখনো মিলেছে, আবার কখনো মিলেনি। কিন্তু আমরা এগিয়ে চলেছি।"
    যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচারের দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভের একটি দৃশ্যছবির কপিরাইটFOCUS BANGLA
    Image caption
    যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচারের দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভের একটি দৃশ্য (ফাইল ছবি)
    ২৫ বছর আগে যখন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয়েছিল তখন রাজনৈতিক সমর্থন চেয়েছিল সংগঠনটি। কারণ তারা বুঝতে পারছিলেন যে রাজনৈতিক সমর্থন না থাকলে তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
    তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি'র সাথে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক মিত্রতা থাকায় বিএনপি এগিয়ে আসেনি। বরং নির্মূল কমিটির নেতাদের জন্য নানা প্রতিবন্ধকতা এবং হয়রানি তৈরি করেছে।
    অধ্যাপক মুনতাসির মামুন মনে করেন, আওয়ামী লীগের সমর্থন না থাকলে তাদের আন্দোলন এগুতেই পারত না ।
    অধ্যাপক মামুন বলছিলেন, "রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া কোন আন্দোলন সফল হতে পারে না । জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনা যদি পাশে না দাঁড়াতেন, তহালে গণ আন্দোলন বা গণবিচার করা সম্ভব হতো না।"
    একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতারা বলছেন তাদের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এবং গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও হয়েছে।
    সংগঠনটির অনেক নেতা মনে করেন, তাদের দিক থেকে চাপ অব্যাহত ছিল বলেই ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
    http://www.bbc.com/bengali/news-38677523
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৬:১৭582837
  • শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেলেন ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী
    ১১ অগাস্ট ২০১৬

    বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৪৪ বছর পর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী।
    বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ সম্পর্কিত গেজেট প্রকাশ করেছে।
    মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন দেরীতে হলেও গেজেটটি প্রকাশ হওয়ায় তারা আনন্দিত।

    Image caption
    মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন
    “অনেক আগেই ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর এই স্বীকৃতি প্রাপ্য ছিলেন। নানা কারণে গেজেট প্রকাশে দেরী হয়ে গেছে। তবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উনি শুরু থেকেই প্রাপ্য সব সুবিধা পাবেন”।
    এর আগে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ৩৫তম সভায় ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীকে মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গনা) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
    তার আবেদনের প্রেক্ষিতে কাউন্সিল এ সিদ্ধান্ত নেয়।
    কয়েক মাস আগে তিনি এ আবেদন করেছিলেন।
    সরকার এর আগে ১২২জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে।
    http://www.bbc.com/bengali/news/2016/08/160811_ferdousi_priovashini_recognition_freedom_fighter
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৬:২০582838
  • সে এক দারুণ সময় ছিল আমার জন্যে: সৈয়দ শামসুল হক
    ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

    সৈয়দ শামসুল হক লন্ডনের লেস্টার স্কয়ারে উইলিয়াম শেক্সপীয়রের এই ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে এই ছবিটি তুলেছিলেন
    সৈয়দ শামসুল হক লন্ডনে বিবিসির বাংলা বিভাগে ৭ বছর কাজ করেছেন প্রযোজক হিসেবে। বিবিসি বাংলার ৭০ বছর উপলক্ষে ২০১১ সালে প্রকাশিত স্মরণিকায় তার এই লেখাটি ছাপা হয়েছিলো। ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে ঢাকায় তিনি মারা গেছেন
    সে এক দারুণ সময় ছিল আমার জন্যে৷ একাত্তরের নভেম্বরে লন্ডনে পৌঁছই শরণার্থী হয়ে। আমার ধারণা ছিলো মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে চলবে, হয়তো বছর তিনেক লেগে যাবে। শরীর ভেঙে পড়েছিল বন্দী স্বদেশে। ভেবেছিলাম, শরীর খানিকটা ঠিক হলেই ভারতে ফিরে আসবো, সরাসরি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবো।
    লন্ডনে আসবার পরপরই বন্ধুরা আমাকে বিবিসিতে নিয়ে এলেন আর সেখানে পরদিন থেকেই খবর ও খবর-ভাষ্য প্রচারে লেগে গেলাম। প্রায় প্রতিদিনই বেতারে কণ্ঠ দিচ্ছি আর, স্বজন প্রিয়জন আর সিলেট অঞ্চলের অজানা অনেক মানুষের কল্যাণে থাকা খাওয়া চলছিলো। তাদের সেই অনুগ্রহ আর যত্নের কথা সারাজীবন আমি ভুলবো না।
    এরই মধ্যে যুদ্ধের খবর স্থানীয় লন্ডনবাসীদের জানাবার জন্যে প্রতিদিন রেডিও লন্ডন থেকেও সংবাদ প্রচারিত হতে লাগল সন্ধ্যেবেলায়। সে বেতার প্রচারেও নিয়মিত অংশ নিচ্ছি। দেশের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। স্বজনেরা, আমার স্ত্রী পুত্রকন্যা কেমন আছে, কোনো খবর পাচ্ছি না। সেই সময়টার কথা মনে করলে আজও আমার মন উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে৷
    এরই মধ্যে বিজয় এলো মুক্তিযুদ্ধে। একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলো মিত্রবাহিনী অর্থাৎ সম্মিলিত ভারতীয় সেনা ও মুক্তিবাহিনীর কাছে। আমার বেতার-জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত : আত্মসর্মপণের খবরটি আমি পাঠ করেছিলাম সেদিন বিবিসি বাংলা খবরে।
    সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬)ছবির কপিরাইটBBC BANGLA
    Image caption
    সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬)
    দেশ তো স্বাধীন হলো, বিবিসি সিদ্ধান্ত নিলো বাংলা সম্প্রচারের সময় বৃদ্ধি করবে। আর, আমাকেও বিবিসি প্রস্তাব করলো যেন বেতার-সম্প্রচারক হিসেবে যোগদান করি। যোগ দিলাম বাহাত্তর সালের তেসরা আগস্ট তারিখে। আমাদের অংশ নিতে হতো খবর পাঠ ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালায়। তার একটি অনুষ্ঠান শিল্পসাহিত্য সম্পর্কে - তার দায়িত্ব দেয়া হলো আমাকে। অনুষ্ঠানের নামটিও আমাকে দিতে হলো - শিল্পপ্রাঙ্গণ৷ প্রতি সপ্তাহে শুক্রবারে পনেরো মিনিটের জন্যে সে অনুষ্ঠান।
    তখন বাংলা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন এভান চার্লটন। এই মানুষটির কাছে আমি নানা কারণে কৃতজ্ঞ, সে কথা আরেকদিন বলা যাবে। আমাকে চাকুরিতে নেবার প্রস্তাবটিও ছিলো তাঁরই। সম্প্রসারিত বাংলা বিভাগের দায়িত্বে এলেন জন ক্ল্যাপহ্যাম। একদিন তিনিই আমাকে বললেন শিল্পপ্রাঙ্গণ অনুষ্ঠানে আমি যেন ধারাবাহিক নাট্যপ্রচার শুরু করি। তারই পরামর্শে হোমারের মহাকাব্য থেকে আমি বেছে নিই ট্রয়ের যুদ্ধ শেষে অডিসিয়সের ইথাকায় তাঁর দেশে ফিরে আসার কাহিনিটি। আমার এই নির্বাচনের পেছনে ভাবনা ছিলো বাংলাদেশে শরণার্থী মানুষদের ফিরে আসবার একটি সমান্তরাল ভাবনা সৃজন। তেরো পর্বে করেছিলাম সে নাটক। এছাড়াও পরে পরে আরো কয়েকটি ধারাবাহিক নাটক আমি রচনা প্রযোজনা করি শিল্পপ্রাঙ্গণ অনুষ্ঠানে। পিলগ্রিমস প্রগ্রেস, টেস অব দি ডার্বেভেল, ম্যাকবেথ। এ ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে ইংরেজি সাহিত্যের বিভিন্ন দিক ও নতুন ভাবনাচিন্তাগুলোও স্থান পেতো এ অনুষ্ঠানে। আমার নিয়মিত অনুষ্ঠানে যাঁরা সেদিন অংশ নিতেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে মনে পড়ে নাজির আহমদ, আশুতোষ বন্দোপাধ্যায়, নরেশ বন্দোপাধ্যায়, নিমাই চট্টোপাধ্যায়, নুরুল ইসলাম, আতিউর রহমান আর বিবাহিত হয়ে সদ্য লন্ডনে আগত মানসী বড়ুয়ার কথা। আমি বিবিসি থেকে দেশে ফিরে আসবার সময়, উনিশশ' আটাত্তর সালে শিল্পপ্রাঙ্গণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নিমাই চট্টোপাধ্যায়। এবং আমার বলতে দ্বিধা নেই, শিল্পপ্রাঙ্গণ অনুষ্ঠানটিকে আরো প্রাণবন্ত ও প্রাসঙ্গিক করে তোলেন নিমাই চট্টোপাধ্যায়। আজ তিনি প্রয়াত। তাঁর মতো সাহিত্যবিশারদ ও জ্ঞানী মানুষ আমি খুব কমই পেয়েছি আমার বন্ধু হিসেবে।
    সেই সত্তর দশকে লন্ডনে শিল্পপ্রাঙ্গণ অনুষ্ঠান এবং বিশেষ করে নাটক করবার মতো বাঙালিজন খুব কমই পাওয়া যেত। যাঁরা ছিলেন, তাঁদের গড়েপিটে নিয়ে যে অনুষ্ঠানগুলো করি তার জন্যে আজও আমি গর্ব অনুভব করি। অনেকের মধ্যে অজিত বন্দোপাধ্যায়, নরেশ বন্দোপাধ্যায়, নুরুস সোবহান, এঁদের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে। কী ধৈর্য ধরেই না তাঁরা আমার নির্দেশ মেনে কাজ করেছেন। আরো কত জন, যাঁদের কথা এই দূরত্বে আর আলাদা করে মনে পড়ছে না। কিন্তু তাঁরা ছিলেন প্রত্যেকেই নিবেদিত প্রাণ শিল্পী।
    শিল্পপ্রাঙ্গণ অনুষ্ঠানে যে ক'টি সাক্ষাৎকার আমি প্রচার করি, তা বেতার-প্রচারের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। কবি জসিমুদ্দিন, কবীর চৌধুরী, উৎপল দত্ত, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন - এঁরা বিভিন্ন সময়ে লন্ডন সফরে আসেন, শিল্পপ্রাঙ্গণে তাঁদের সাক্ষাৎকারগুলো যদি আজও বিবিসি আর্কাইভে যদি থেকে থাকে। জানিনা আছে কিনা। বিশেষ করে জয়নুল আবেদিনের সাক্ষাৎকারটি। এসেছিলেন তিনি গলায় ক্যানসার নিয়ে, চিকিৎসার জন্যে। জীবনের ও শিল্পের বিষয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বলেছিলেন সেদিন।
    আর মনে পড়ে হেদার বন্ডের কথা, যিনি আমার সবগুলো নাটকেরই ধারক ও সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। তিনি আজ আমাদের মাঝে আর নেই। তাঁর সঙ্গে কাজ করে যেমন আনন্দ পেয়েছি তেমনি অনেক কিছু শিখেওছি তাঁর কাছে।
    সাতটি বছর একটানা কাজ করেছি বিবিসি বাংলা বিভাগে। সে শুধু আমার চাকুরি করাই ছিলো না। শুধু অর্থ উপার্জনই ছিল না। ছিল, দেখা ও শোনার এক মহাপার্বণ। আমি সমৃদ্ধ হয়েছি অনেকদিক থেকে। তার ভেতরে একটি তো এই যে, আমি নাট্যরচনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছি। আজ আমার নাট্যরচনায় যদি কিছু সুকৃতি থেকে থাকে তবে তার পেছনে রয়েছে বিবিসি বাংলাবিভাগে নাটক করবার অভিজ্ঞতা। সে কী কেবল বেতার মারফতেই? তা নয়৷ দর্শক সমুখেও একাধিক নাটক করেছি লন্ডনে বিবিসির বাংলা বিভাগের বিশেষ শ্রোতা-দর্শক সমাবেশে অনুষ্ঠানে।
    অনেক দিন পার হয়ে গেছে। অনেক কথা ভুলে গিয়েছি। কিন্তু যে আনন্দ এবং অভিজ্ঞতা পেয়েছি বিবিসতে কাজ করে, তা আমাকে আমি করে তুলতে বিরাট একটি ভূমিকা রেখেছে৷ এই কথাটি বলতে পেরে খুব ভালো লাগছে।
    http://www.bbc.com/bengali/news-37487087
  • বিপ্লব রহমান | ০৫ মার্চ ২০১৭ ১৬:২৬582839
  • কিভাবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতেন সাংবাদিকেরা?
    আকবর হোসেন
    বিবিসি বাংলা, ঢাকা
    ২৪ মার্চ ২০১৬

    ৭ই মার্চের এই ভাষণের পরই বোঝা যাচ্ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কোন দিকে এগুচ্ছে।
    আর দু’দিন পরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে।
    ১৯৭১ সালে নয় মাস বাংলাদেশে যুদ্ধের ভয়াবহতা আড়ালে রাখতে, তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার সব ধরনের চেষ্টাই করেছিল।
    যার মধ্যে অন্যতম ছিল সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেয়া।
    যুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন অনেক সাংবাদিকও।
    তা স্বত্ত্বেও যুদ্ধের খবরাখবর প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
    ১৯৭১ এর সেই অবরুদ্ধ সময়ে সাংবাদিকেরা কিভাবে যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করতেন?
    ৭ই মার্চের ভাষণের পরই বোঝা যাচ্ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কোন দিকে এগুচ্ছে।
    অনেক বিদেশী সাংবাদিক খবরাখবর সংগ্রহের জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসতে থাকেন।
    ২৫শে মার্চ ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর উপর গণহত্যা চালায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী।
    এই খবর যাতে দেশের বাইরে প্রচারিত না হয় সেজন্য বন্দুকের মুখে সকল বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল আটকে রাখা হয় এবং ধরে করাচি পাঠিয়ে দেয়া হয়।
    ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার ২৬ বছর বয়সী সাইমন ড্রিং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চোখ এড়িয়ে থেকে যেতে সক্ষম হন।
    পরে তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে ব্যাংককে গিয়ে যে প্রতিবেদন পাঠান সেটি ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছাপা হয়।
    বাংলাদেশ জেনোসাইড এন্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস বইতে অনূদিত সে রিপোর্টের কয়েকটি লাইন তুলে ধরা হলো...
    “আমি নিরাপত্তা রক্ষীদের তল্লাশী ফাঁকি দিয়ে মুহুর্তের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানগামী বিমানে উঠতে সমর্থ হই। তারপরও আমাকে দু’দুবার আটক করা হয় এবং ব্যাগেজসহ আমাকে তন্নতন্ন করে তল্লাশীর মুখে পড়তে হয়। তবুও আমার এ প্রতিবেদন তৈরীর নোট ব্যাংকক পর্যন্ত অক্ষত ছিল"।
    "ঢাকা এখন ধ্বংস এবং ভীতির নগরী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠান্ডা মাথায় ২৪ ঘন্টাব্যাপী অবিরাম শের বর্ষনে সেখানে সাত হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে। ছাত্রাবাসে নিজেদের বিছানাতেই ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে।বাজারগুলোতে কসাইদেরকে নিজেদের দোকানের পিছনে হত্যা করা হয়েছে"।
    সাংবাদিকেরা কিভাবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতেন? ছবির কপিরাইটGETTY
    Image caption
    সাংবাদিকেরা অনেক বাধার মুখে পড়লেও বিভিন্নভাবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করেছেন।
    ২৫ এবং ২৬শে মার্চে ঢাকায় বেশ কয়েকটি পত্রিকা আক্রান্ত হবার পর অনেক সাংবাদিক আত্নগোপনে ছিলেন।
    ঢাকা থেকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যরা তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
    হত্যাযজ্ঞের খবর ছাপানোর কোন উপায় নেই।
    তিনমাস বন্ধ থাকার পর স্বল্প পরিসরে বেরিয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাক।
    পত্রিকার তৎকালীন প্রতিবেদক সৈয়দ শাহজাহান জানালেন তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রন এতাটাই জোড়ালো ছিল যে যুদ্ধের খবর ছাপানোর কোন উপায় নেই।
    সদ্য স্বাধীনতা ঘোষণাকারী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের খবরাখবর তখনও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছিল।
    ২৫শে মার্চের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে জোরপূর্বক সব বিদেশী সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হলেও এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিনিধি ড্যান কগিনস ভারত সীমান্ত পার হয়ে কুষ্টিয়ায় পৌঁছান।
    ২৬শে মার্চ সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা কিভাবে প্রতিরোধ যু্দ্ধ শুরু করে তার বর্ণনা দিয়েছেন মি: কগিনস। ১৯শে এপ্রিল টাইম সাময়িকীতে সেটি প্রকাশিত হয় ...
    “সান্ধ্য আইনের পুরো ৪৮ ঘন্টাই কুষ্টিয়া শহরটি নীরব ছিল।কারফিউয়ের সময় রাস্তায় বের হবার অপরাধে পাক সৈন্যদের গুলিতে নিহত হয় সাতজন। এদের অধিকাংশই কৃষক।ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতো না তারা। ২৮শে মার্চ সকালে কারফিউ তুলে নেয়া হয়। সাথে সাথেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সংঘবদ্ধ হতে থাকে এলাকাবাসী"।
    সাংবাদিকেরা কিভাবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতেন? ছবির কপিরাইটGETTY
    Image caption
    একাত্তরের যুদ্ধের সময় এক সৈনিক।
    এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বিবিসি’র মার্ক টালি বাংলাদেশে এসেছিলেন।
    তিনি তখন দু’সপ্তাহ এখানে ছিলেন।
    সেই প্রথম এবং শেষ বারের মতো পাকিস্তানী সরকার দু’জন সাংবাদিককে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দিয়েছিল।
    মার্ক টালি বলছিলেন ১৯৭১ সালের সেই সফরে তিনি ঢাকা থেকে সড়ক পথে রাজশাহী গিয়েছিলেন।
    “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যখন সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত পৌঁছালো এবং তারা মনে করলো যে পরিস্থিতির উপর তাদের নিয়ন্ত্রন আছে, তখনই তারা আমাদের আসার অনুমতি দিয়েছিল। আমার সাথে তখন ছিলেন ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ পত্রিকার যুদ্ধ বিষয়ক সংবাদদাতা ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ। আমরা যেহেতু স্বাধীনভাবে ঘুরে বেরিয়ে পরিস্থিতি দেখার সুযোগ পেয়েছি সেজন্য আমাদের সংবাদের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ হয়েছে। আমি ঢাকা থেকে রাজশাহী যাবার পথে সড়কের দু’পাশে দেখেছিলাম যে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে"।
    মার্ক টালির আগে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানী সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সে দেশের আটজন সাংবাদিককে পূর্ব বাংলায় নিয়ে আসে।
    উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলায় যে তাদের ভাষায় সব কিছুই স্বাভাবিক সেটি তুলে ধরা।
    এদের মধ্যে সাতজন সাংবাদিক পাকিস্তানী সরকারের চাহিদা অনুযায়ী রিপোর্ট করেন।
    সাংবাদিকেরা কিভাবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতেন?
    Image caption
    মার্ক টালি ১৯৭১ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশে এসেছিলেন,তখন তিনি ঢাকা থেকে সড়ক পথে রাজশাহী গিয়েছিলেন।
    কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম ঘটে করাচির মর্নিং নিউজের সাংবাদিক এবং ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাতা এন্থনি মাসকারেনহাস-এর ক্ষেত্রে।
    তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে পাকিস্তান ছেড়ে ১৮ই মে লন্ডনে সানডে টাইমসের দপ্তরে হাজির হয়ে জানান যে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি একটি প্রতিবেদন লিখতে চান।
    কিন্তু এ প্রতিবেদন লিখলে তার পক্ষে পাকিস্তানে থাকা সম্ভব হবেনা বলে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে তার স্ত্রী এবং সন্তানদের বের করে না আনা পর্যন্ত এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা যাবেনা।
    সেই প্রতিবেদনে মি: মাসকারেনহাস উল্লেখ করেন "পূর্ব বাংলার শ্যামল প্রান্তর জুড়ে আমি আমার প্রথম চাহনিতেই জমাট রক্তপুঞ্জের দাগ দেখতে পেয়েছিলাম। এই সংঘবদ্ধ নীপিড়নের শিকার কেবলমাত্র হিন্দুরাই নয়। বরং হাজার হাজার বাঙালী মুসলমানও এ নির্মমতার শিকার”।
    ১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসের পর যুদ্ধক্ষেত্র আর কোন সরেজমিন প্রতিবেদন হয়নি।
    এরপর মূলত কূটনৈতিক তৎপরতা, শরণার্থী ক্যাম্পের অবস্থা, বিশ্লেষণ এবং সম্পাদকীয়ই ছিল মুখ্য।
    যুদ্ধ চলাকালীন কলকাতা থেকে বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো যাতে বাংলাদেশের যুদ্ধের খবরা-খবরই ছিল মুখ্য।
    মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবং সাংবাদিক আফসান চৌধুরী বলছেন সাংবাদিকতার স্বাভাবিক নিয়মে যেভাবে খবর যাচাই-বাছাই করতে হয়, তখন সে পরিস্থিতি ছিলনা।
    তিনি বলেন ১৯৭১ সালে গণমাধ্যম দৃশ্যত দুটো ভাগে ভাগ হয়েছিল।
    একটি অংশ পাকিস্তানের পক্ষে। অন্যটি পাকিস্তানের বিপক্ষে অর্থাৎ নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে।
    যুদ্ধের সময় তখন বিবিসি নিয়মিত অবরুদ্ধ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে খবর এবং বিশ্লেষণ দিয়েছে।
    সাংবাদিকেরা কিভাবে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতেন?
    Image caption
    যুদ্ধের অবরুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন সময় খবর ও বিশ্লেষণ দিয়েছে বিবিসি।
    সে সময়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিবিসি’র মার্ক টালির নাম লোকমুখে।
    যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কিভাবে খবর সংগ্রহ করতেন?
    মার্ক টালি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন “যুদ্ধকালীন অধিকাংশ সময় আমি লন্ডনেই অবস্থান করেছি। তখন সেখানে বসে যুদ্ধের নানাদিক নিয়ে বিশ্লেষণ এবং মন্তব্য লিখেছি এবং প্রচার করেছি। যেসব খবরাখববের উপর ভিত্তি করে এসব লিখতাম তার বেশিরভাগই আসতো কলকাতা থেকে"।
    "যখন শরণার্থী সংকট শুরু হলো তখন তাদের কাছ থেকে নানা ধরনের খবরাখবর পাওয়া যেত। নিজামউদ্দিন নামের আমাদের বেশ ভালো একজন সংবাদদাতা ছিলেন। তিনি দেশের ভেতরেই অবস্থান করছিলেন। তিনিও খবরা-খবর পাঠাতেন। যুদ্ধের শেষের দিকে তাকে হত্যা করা হয়"।
    "এছাড়া আমাকে অনেক সহায়তা করেছিল লন্ডনে অবস্থিত বিবিসি বাংলা বিভাগের সহকর্মীরা। তাদের অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব দেশে থাকতো। তাদের সাথে বাংলা বিভাগের সহকর্মীরা যোগাযোগের চেষ্টা করতেন বিভিন্ন উপায়ে। সেসব তথ্য আমার কাজে লাগতো"।
    মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বলছেন যুদ্ধের সময় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের গণমাধ্যমে কিংবা অবরুদ্ধ ঢাকায় সংবাদপত্র পাঠ করে, রেডিও শুনে কিংবা টিভি দেখে পরিস্থিতি আঁচ করার কোন উপায় ছিলনা।
    কারণ ছিল পাকিস্তানী সরকারের কঠোর বিধি-নিষেধ। কিন্তু তাতে সাধারন মানুষের জণ্য খবর থেমে থাকেনি বলে উল্লেখ করেন আফসান চৌধুরী।
    সাংবাদিক এবং গবেষকরা বলছেন যুদ্ধ শুরু হবার কিছু দিনের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে ধীরে-ধীরে যে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে উঠেছিল তার কারণ হচ্ছে বিদেশী পত্র-পত্রিকার খবর।
    পাকিস্তানী শাসকরা নৃশংসতা এবং যুদ্ধের খবর চেপে রাখার জোর চেষ্টা করলেও সেটি সফল হয়নি। বিভিন্ন ফাঁক গলে খবর ঠিকই বেরিয়েছে।
    http://www.bbc.com/bengali/news/2016/03/160324_bangladesh_independence_day_45_years
  • বিপ্লব রহমান | ১৫ মার্চ ২০১৭ ১২:২৮582841
  • ফিরে আসুক একাত্তরের গানগুলো’
    জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
    Published: 2017-03-15 10:59:30.0 BdST Updated: 2017-03-15 10:59:30.0 BdST

    একাত্তরের যুদ্ধদিনে যে গানগুলো অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধাদের, দেশ গঠনের লড়াইয়ে সেই সব গান আজকের তরুণদেরও প্রেরণা দিতে পারে বলে মনে করছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার সুজেয় শ্যাম।

    সাড়ে চার দশক পর স্বাধীন বাংলা বেতারের বেশ কিছু গান জয় বাংলা কনসার্টের মাধ্যমে এই সময়ের তরুণদের মধ্যে ফেরায় এক ধরনের ‘তৃপ্তি’ও অনুভব করছেন একাত্তরের অনেক আলোড়ন সৃষ্টিকারী গানের এই সুরকার।

    যৌবনে নতুন দেশের স্বপ্নে যে সব সুরে সব সঁপে দিয়েছিলেন, স্বাধীন দেশে তার অনেকগুলোই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে দেখেছেন ৭১ বছর বয়সী সুজেয় শ্যাম। জীবনের শেষ বেলায় গানগুলোর প্রত্যাবর্তন দেখে ‘দারুণ উজ্জীবিত’ তিনি।

    চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার আগে বুধবার এই সুরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন সেই অনুভূতির কথা।

    “যে গানগুলো লাইফ সাপোর্টে ছিল, সেই গানগুলো জয় বাংলা কনসার্ট নতুন প্রজন্মকে দিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর যে আনন্দ পেয়েছিলাম, ঠিক সেই আনন্দ পেয়েছি।”

    তিনি মনে করেন, বাঙালি ও এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে বাংলাদেশের জন্মযুদ্ধের ইতিহাস যেমন চিরদিন থাকবে, তেমনি এই সব গানও অনুপ্রেরণা যোগাবে।

    “তবে এ জন্য গানগুলোকে আলোয় রাখতে হবে, থাকতে হবে চর্চায়, জানাতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। এ প্রজন্ম অনেক কিছু জানে না, জানালে পরেই না উজ্জীবিত হবে।”

    ১৯৪৬ সালে সিলেটে জন্ম নেওয়া সুজেয় শ্যাম জানান, রবীন্দ্র-নজরুল-লালন সংগীতের বাইরে স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য লেখা ও সুর করা মোট গানের সংখ্যা দেড়শর মত।

    “এরই মধ্যে অনেক গান হারিয়ে গেছে বা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। তবে এখনও সঠিকভাবে চেষ্টা করলে সেই গানগুলো ফিরে পাওয়া সম্ভব। এ বিষয়ে আর দেরি করা ঠিক নয়। সরকার বা বেসরকারি তরফে দ্রুত এই ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া দরকার।”

    স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেই গানগুলো গত ৭ মার্চ ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে জয় বাংলা কনসার্টে ফিরিয়ে আনায় আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান সুজেয় শ্যাম।

    “কনসার্টে গাওয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলোর একজন সুরকার হিসেবে আমি গর্ববোধ করছি, এই কনসার্টের কারণে প্রায় ৫ লাখ দর্শক-শ্রোতা আমার নামটি জানতে পেরেছে, আমার গানগুলো শুনতে পেরেছে।”
    কথা ও সুর ঠিক রেখে এ ধরনের আরও গান যদি ব্যান্ডগুলোর মাধ্যমে তরুণদের কাছে তুলে ধরা যায়, তাহলে তারা গানগুলোর সঙ্গে এবং বাঙালির সংগ্রামের সেই সময়ের সঙ্গে নিজেদের আরও সম্পৃক্ত করতে পারবে বলে মনে করেন এই সুরকার।

    “আমাদের সবাইকে এটা মনে রাখতে হবে, এ ধরনের অনেক গান যেমন ‘তীরহারা এই ঢেঊয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে’ বর্তমান প্রজন্মের কাছে অনেক জনপ্রিয় হয়েছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেশাত্মবোধের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
    স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে থাকাকালে মোট নয়টি গানে সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম, যেগুলো একাত্তরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গাওয়া হয়েছিল।

    এর মধ্যে রয়েছে ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘ওরে শোনরে তোরা শোন’, ‘রক্ত চাই রক্ত চাই’, ‘আজ রণ সাজে বাজিয়ে বিষাণ’। ছিল বিশ্বপ্রিয়’র লেখা ‘আহা ধন্য আমার’, কবি দিলওয়ারের লেখা ‘আয়রে চাষী মজুর কুলী’।
    এর মধ্যে ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’ এবং ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গান দুটি যে কোনো জাতীয় দিবসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। কিন্তু বাকি সাতটি গান এখন আর তেমন গাওয়া হয় না বলে জানান সুজেয় শ্যাম।

    তিনি বলেন, “এখন শেষ জীবনে ইচ্ছা, এই গানগুলো বেঁচে থাকুক মানুষের মাঝে। ফিরে আসুক হারিয়ে যাওয়া স্বাধীন বাংলা বেতারের বাকি গানগুলোও।”

    http://bangla.bdnews24.com/glitz/article1303415.bdnews
  • বিপ্লব রহমান | ১১ জুলাই ২০১৮ ০৭:৩৮582842
  • ",মোটেও যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল না একাত্তরে, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যাদের কখনও দেখা হয়নি, তাদের অনেকেই নাকি নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে। আমি তো তাহলে তাদের চেয়েও বড় মুক্তিযোদ্ধা। বয়স ছিল ন'বছর। দাপুনিয়ার একটি বাড়ির মাটির মেঝেয় খড় পেতে ঘুমোতাম। খড়ের তলায় থাকতো মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেল। রাইফেলগুলো আমরা লুকিয়ে রাখতাম। কাউকে বলতাম না রাইফেলের কথা । বাড়িটা আমার মামার বন্ধুর বাড়ি ছিল। আমরা যুদ্ধের সময় ওই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমার মামা তখন যুদ্ধ করছে। মামার বন্ধুও। ওই বাড়িতে গভীর রাতে যখন মুক্তিযোদ্ধারা খেতে আসতো, বাড়ির লোকেরা তাদের খাবার দিত। আমিও দৌড়ে দৌড়ে ডালের বাটি ভাতের থালা রান্নাঘর থেকে নিঃশব্দে নিয়ে আসতাম। ওরা কুপির আবছা আলোয় দ্রুত খেয়ে উঠতো। বিস্মিত আর মুগ্ধ চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ওরা যে গভীর রাতে আসতো, এ কথাও আমরা কাউকে বলতাম না।"

    --তসলিমা নাসরিন, ফেসবুক নোট
  • বিপ্লব রহমান | ১১ জুলাই ২০১৮ ১৪:১৪582843
  • "একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই"
    Muhammad Sadequzzaman Sharif
    একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই। সহজ ও সোজা একটা কথা। কিন্তু এই সহজ ও সোজা কথাটার মাঝে অনেক কিছুই লুকিয়ে আছে। লুকিয়ে আছে জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় গৌরব কে অবহেলায় ফেলে রাখার লজ্জা, আছে জাতি হিসেবে আমরা কতখানি নির্বোধ তার পরিচয়, এর মধ্যেই আছে রক্তের দামে কেনা স্বাধীনতার বর্তমান অবস্থা।

    বিশ্বের বড় বড় গণহত্যার থেকে কোন অংশে কম হয়নি একাত্তর সালে এই বাংলায়। নয় মাসে ত্রিশ লক্ষ মানুষ কে মেরে ফেলা।এত অল্প সময়ে এত সংখ্যক মানুষ কে মেরে ফেলা, এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই আর। সংখ্যাটাও এতই অবিশ্বাস্য যে আজকের যুগের অনেক মানুষকেই বিশ্বাস করানো যায় আসলে অত মানুষ মরে নাই। মানুষ বিশ্বাস করে কারন সংখ্যাটা আসলেই অবিশ্বাস। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও দিনের আলোর মত সত্য এই সংখ্যা। জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় লজ্জা হল শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন যত না পাকিস্তানীরা তুলেছে সম্ভবত তার চেয়ে বেশি তুলেছে এই দেশের জল বাতাস খেয়ে বেড়ে উঠা মানুষের মত দেখতে কিছু প্রাণী। এদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চেষ্টায় আজকে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ মনে করে মুক্তিযুদ্ধ একটা ভারতের চক্রান্ত, মুজিব আসলে দেশ স্বাধীন করতে চায় নাই, বুদ্ধিজীবীরা আসলে বড় মাপের বেকুব ছিল আর ত্রিশ লক্ষ আসলে অনেক অনেক বড় সংখ্যা, খুব বেশি হলে তিন লক্ষ লোক মারা গেছে!! ত্রিশ থেকে কমিয়ে তিন করতে পারলে কার কি লাভ জানা নেই। তিন লক্ষ কে মারা জায়েজ কিনা তাও জানি না। মুনতাসীর মামুন নিয়াজির সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় নিয়াজির ত্রিশ লক্ষ শহীদ অনেক বেশি উত্তর শুনে জিজ্ঞাস করেছিলেন উনার কত মনে হয়? কত মানুষ মারা গেছিল মুক্তিযুদ্ধে? তিনি কয়েক লাখ থেকে নেমে নেমে যখন পঞ্চাশ হাজার বললেন তখন নিয়াজি বললেন, হতে পারে, ৫০ হাজার হতে পারে। মুনতাসীর মামুন এর অপেক্ষাই ছিলেন। তিনি বলেন, আপনার কাছে ৫০ হাজার মানুষ হত্যাকে গণহত্যা বলে মনে হয় না? আমারও জিজ্ঞাসা, দেশের ভিতরে যারা গণহত্যার বিরোধী কথা বলেন তারা কোন সংখ্যাটাকে গণহত্যা বলতে চান? সংখ্যা কমিয়ে আসলে লাভ কার?

    গণহত্যার সংজ্ঞা কী? ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডে গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ আছে। কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া—এই পাঁচটি উপাদানের কোনো একটি থাকলেই কোনো ঘটনা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে। ইতিহাসবিদদের মধ্যে এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথম চারটি বৈশিষ্ট্য ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞের রয়েছে। তাই এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার কোন কারণ নেই।
    অথচ জাতি হিসেবে উদাসীন আমরা আজ পর্যন্ত এত বড় গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি। আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস আমাদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে শুধু মাত্র আমাদের গাফলতির কারনে। কিন্তু গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সুযোগ এখনো আছে। সময়ে চলে গেছে অনেক, তাই এখন আর নষ্ট করার মত সময় নাই আমাদের। এই স্বীকৃতি আদায়ের অন্য কোন বিকল্প নাই আমাদের।

    কিন্তু এই স্বীকৃতি আসলে কি দরকার? মানুষ তো জানেই গণহত্যা হয়েছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না হলেই কি হয়? বহু মানুষের কাছে শুনেছি এই অবান্তর প্রশ্ন। মেজাজ হারিয়েছি বহুবার। পরে মনে হয়েছে আসলেই মানুষ জানে না কি দরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির। এই স্বীকৃতি দরকার আমাদের জন্য, আমাদের মত ভোলা মনে জাতির জন্য। যারা অল্পেই প্যাচ গুজ খেয়ে গণহত্যা হইছে না হয় নাই এই ধন্দে পরে যাই, যারা ত্রিশ লক্ষ না তিন লক্ষ, দুই লক্ষ না কয়েক হাজার মা বোনের সম্ভ্রম ইত্যাদি নানা কুতর্কে মূল পথ হারাই তাদের জন্য এই স্বীকৃতি দরকার। দেশের ভিতরেই যদি এমন প্রশ্ন থেকে থাকে আমাদের বুঝতে হবে দেশের বাহিরে পাকিস্তান কি পরিমাণ গুজব ছড়িয়েছে এই গণহত্যা নিয়ে? পাকিস্তান একা না, তাদের মিত্র যে দেশ গুলা আছে তারাও আজো এই গণহত্যা নিয়ে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। আজকে স্বীকৃতি না থাকার কারনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এই কথা বলতে সাহস পায় যে মুক্তিযুদ্ধ কে ভুলে বাংলাদেশ কে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এত বড় একটা গণহত্যা কিন্তু বহির্বিশ্বে তা নিয়ে তেমন কোন আলোচনা নেই। কারন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নাই। আর এই সুযোগে পাকিস্তান আর তার বন্ধুরা যেমন ইচ্ছা তেমন ইতিহাস পাঠ করিয়েছে। এই ভুল ইতিহাস থেকে বাঁচার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার জন্য স্বীকৃতি প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় দরকার পাকিস্তান কে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য। পাকিস্তান কে করজোড়ে ক্ষমা চাইতে দেখার জন্য এই স্বীকৃতি আদায় ভিন্ন অন্য কোন পথ নাই।
    http://www.guruchandali.com/blog/2018/07/09/1531148787012.html
  • বিপ্লব রহমান | ১৩ জুলাই ২০১৮ ০৫:০০582844
  • শুভ জন্মদিন শহীদ আজাদ
    Muhammad Sadequzzaman Sharif
    আজকে এক বাঙ্গালি বীরের জন্মদিন। আজকে শহীদ আজাদের জন্মদিন। মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকার কিংবদন্তীর ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য, রুমির সহযোদ্ধা এবং অবশ্যই অবশ্যই মোসাম্মাৎ সাফিয়া বেগমের সন্তান। শহীদ আজাদ হচ্ছেন এমন একজন মানুষ যার কথা বলতে গেলে তার মার কথা বলতে হয় অবধারিত ভাবেই। মার কথা বলব তার আগে আজাদের কথা বলি।

    শহীদ আজাদের জন্ম ১৯৪৬ সালের ১১ জুলাই। নিউ ইস্কাটনে থাকতেন। বাবা তৎকালীন সময়ের বড় ব্যবসায়ী ইউনুস আহমেদ চৌধুরী। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর আজাদ কে নিয়ে আলাদা থাকা শুরু করেন মা সাফিয়া বেগম। আজাদ করাচী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করেন। তারপর ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে।এরপরেই মুক্তিযুদ্ধ। ক্র্যাক প্লাটুনের বেশ কিছু অপারেশনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ৩০ আগস্ট নিজ বাসাতেই পাকিস্তান আর্মির কাছে ধরা পরেন তিনি। ক্র্যাক প্লাটুনের আরও অনেকেই সেদিন ধরা পরেন। ধরা পরেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সন্তান রুমি। ক্র্যাক প্লাটুনের সব এক সাথে ধরা পরা নিয়ে নানা মতভেদ আছে।বিশ্বাসঘাতকতার গল্প আছে, ভীরুতার কথা আছে, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। আজাদ ধরা পরে যাওয়ার পরেই আজাদের মা সাফিয়া বেগমের গল্প শুরু। একজন মা কি করতে পারেন তার সন্তানের জন্য তা অনন্য নজির তৈরি করেছেন তিনি।

    যারা ধরা পড়েছে তারা কোথায় আছে, কেমন আছে এসব জানার জন্য নানা লোকজন কে ধরাধরি করে খবর পেলেন তারা রমনা থানায় আছে। মা গেলেন রমনা থানায়। আজাদের দেখা পেলেন। আজাদের সাথে তাকে দেখা করতে দেওয়ার আগে তাকে বলা হয়েছিল যদি আজাদ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঠিকানা বলে দেয় তাহলে আজাদ কে মুক্তি দেওয়া হবে। পাকিস্তান আর্মি মা কে ব্যবহার করে তথ্য আদায় করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তখনো এই মা কে চিনেনি। মা আজাদের সাথে দেখা করলেন এবং করলেন পুরো উল্টো কাজ। আজাদ কে নাম ঠিকানা বলে দেওয়ার জায়গায় বললেন একজন মায়ের জন্য সবচেয়ে কষ্টের এই সাথে সাহসের কথা। তিনি আজাদ কে বললেন, বাবা, শক্ত হয়ে থেকো, কোন কিছু স্বীকার কর না।মা দেখা করার আগেই আজাদদের উপরে অমানুষিক নির্যাতন শুরু হয়ে গিয়েছিল। আজাদের অবস্থা দেখেও মা তাকে বললেন, কোন কিছু স্বীকার করো না, সহ্য করে থেকো!! একজন মা কিভাবে পারে? কোন ধাতুতে তৈরি আমাদের মারা? একজন মা ছেলেকে নির্দ্বিধায় বলে দেন, যা তোকে দেশের নামে কুরবানি করে দিলাম। আরেকজন মা বলছেন শত কষ্টেও কোন কিছু যেন ছেলে স্বীকার না করে। যুগে যুগে এমন মায়ের আশায়ই থাকে জাতি, যে কোন জাতি।
    শেষ মুহূর্তে আজাদ মা কে বলে, এরপর আসলে ভাত নিয়ে এসো, দুই দিন ভাত খাইনি। মা পরেরদিন ভাত নিয়ে থানায় গেলেন কিন্তু আজাদের দেখা আর পানি। আজাদ কে আর ভাত খাওয়াতে পারেননি মা।

    ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিল মা। মারা যান ঠিক ৩০ আগস্ট। যেদিন ধরা পড়েছিল আজাদেরা। যে ১৪ বছর বেঁচে ছিল মা সেই ১৪ বছরে আর কোনদিন ভাত খাননি তিনি। এক বেলা রুটি খেয়ে থেকেছেন। বিছানায় ঘুমাননি তিনি আর। মেঝেতে শুয়ে কাটিয়েছেন বাকি জীবন। শীত বর্ষা কোন কিছুতেই তিনি আর বিছানায় শুতে যান নি। কিভাবে যাবে? তার ছেলে তো টর্চার সেলে বিছানা পায়নি। বাকি জীবন ভাত না খেয়ে আর বিছানায় না শুয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। এমন মায়ের সন্তান বলেই শহীদ আজাদও তেমনই ছিলেন। জীবন দিয়ে দিয়েছেন তবু মুখ খুলেননি। বাঁচার রাস্তা তো খুব সহজ ও সোজাই ছিল।

    এমন মা আর এমন সন্তান আমাদের দিকে কি তাকিয়ে করুণার হাসি দেয়? আমরা যারা স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ কে খুব সহজ হিসেব বলে মনে করি। আমরা যাদের বোধের বাহিরে থেকে যায় পতাকার রঙের মর্মার্থ, যারা খুব করে প্রমাণ করতে চাই দেশ ব্যাপারটা আসলে পুরোই বায়বীয় জিনিস, যেনতেন ভাবে দেশ ছাড়াটাই যাদের কাছে মোক্ষ লাভ। আমাদের কারো পক্ষে কি সম্ভব শহীদ আজাদের বা মায়ের মুখোমুখি হওয়া?

    শুভ জন্মদিন ভাই। আমরা খুব দুর্বল ভাই তোমার। আমরা এখন ব্যস্ত আমাদের ব্যস্ততা নিয়ে। দেশ ও দেশপ্রেম খুব প্রাচীন একটা ব্যাপার ব্যস্ত হওয়ার জন্য।ক্ষমা করো ভাই।

    http://www.guruchandali.com/blog/2018/07/12/1531399564736.html#writehere
  • বিপ্লব রহমান | ১৭ জুলাই ২০১৮ ২০:১১582845
  • ৩৮ বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি
    জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
    Published: Jul 17, 18 5:10pm BdST

    একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত আরও ৩৮ জন বীরাঙ্গনার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার।

    জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ৫৪তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে সম্প্রতি গেজেট জারি করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

    নীলফামারীর জলঢাকার মোছা. শাহেলা বেগম, ঠাকুরগাঁও সদরের মোছা. আমেনা বেওয়া এবং লালমনিরহাট সদরের শেফালী রানী, মোছা. রেজিয়া, মোছা. মোসলেহা বেগম এবং শ্রীমতি জ্ঞানো বালা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন।

    চট্টগ্রামের পটিয়ার আছিয়া বেগম, ফেনীর ছাগলনাইয়ার রহিমা বেগম এবং কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের আফিয়া খাতুন খঞ্জনীকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার।

    জয়পুরহাট সদরের মোসা. জাহানারা বেগম, নওগাঁ সাপাহারের মৃত পান বিলাসী, নাটোর বড়াইগ্রামের মোছা. হনুফা এবং সিরাজগঞ্জের তাড়াশের অর্চনা সিংহ ও মৃত পচি বেওয়া মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন।

    চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার মোছা. ওজিফা খাতুন, দয়ারানী পরামানিক ও মোছা. রাবেয়া খাতুন; কুষ্টিয়ার কুমারখালীর মাছুদা খাতুন মোছা. মোমেনা খাতুন ও মোছা. এলেজান নেছা; কুষ্টিয়া সদরের মৃত রাজিয়া বেগম এবং বাগেরহাটের রামপালের মোসা. ফরিদা বেগমের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মিলেছে।

    শেরপুরের নালিতাবাড়ীর মোছা. মহিরন বেওয়া, মোছা. আকিরন নেছা, মোছা. জতিরন বেওয়া, মোছা. হোসনে আরা, মোছা. হাজেরা বেগম (পিতা মৃত উমেদ আলী) ও হাজেরা বেগম (পিতা মৃত হাসেন আলী) এবং শেরপুরের ঝিনাইগাতীর মৃত ফিরোজা খাতুনকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার।

    শরীয়তপুর সদরের জুগল বালা পোদ্দার, যোগমায়া ও সুমিত্রা মালো; গোপালগঞ্জ সদরের হেলেনা বেগম ও ফরিদা বেগম এবং গাজীপুরের কালীগঞ্জের মোসা. আনোয়ারা বেগমের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মিলেছে।

    এছাড়া ঝালকাঠি সদরের সীমা বেগম ও মোসা. আলেয়া বেগম এবং হবিগঞ্জের মাধবপুরের সন্ধ্যা ঘোষকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

    এনিয়ে ২৩১ জন বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন।

    মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া বীরাঙ্গনারা প্রতি মাসে ভাতাসহ মুক্তিযোদ্ধাদের মত অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

    মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক আগেই জানিয়েছেন, ৪০০ থেকে ৫০০ জন বীরঙ্গনাদের তালিকা নিয়ে কাজ করছেন তারা, পর্যায়ক্রমে সবাইকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

    ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যা‌তিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সম্মান জানান। তার নির্দেশনায় বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়, যা ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আগ পর্য‌ন্ত চলছিল।

    বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সামরিক শাসকদের মাধ্যমে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানি জান্তার সহযোগীদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়।

    আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরই মধ্যে এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনাও আসে।

    শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চার দশক পর ২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। পরের বছরের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ওই প্রস্তাব পাস হয়।

    ~~~~
    ৩৮ বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি https://t.co/E3eT8jgBCo
  • | 342323.191.3423.234 | ১৭ জুলাই ২০১৮ ২২:২৪582846
  • মাহিম | 103.133.202.105 | ২৮ আগস্ট ২০২২ ১৭:০৩738275
  • কিশোরের মুক্তিযুদ্ব সহকারে বনন্া দাও
  • বিপ্লব রহমান | ২৫ মার্চ ২০২৪ ১৬:৪৫742611
  • ইনার গ্রুপ: স্বাধীনতার প্রথম প্রয়াস
    ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করার প্রচেষ্টা শুরু হয় ইনার গ্রুপের মাধ্যমে। পরবর্তীতে পাকিস্তান জন্মের পর পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার জন্য গোপন প্রচেষ্টা শুরু করে ইনার গ্রুপ।
     (১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রহর প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করলেও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য নানা তৎপরতার শুরু হয়েছিল আরও কয়েক দশক আগে। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম বীজ বপন করা হয়। স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম পর্ব।)
    পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে চল্লিশের দশক থেকেই শুরু হয় নানা কার্যক্রম ও তৎপরতার। এসব কর্মকাণ্ডে নানা পর্যায়ে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ অনেকে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরী, আবদুল আজিজ বাগমার, সিরাজুল আলম খানসহ অনেকেই।
    পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার প্রক্রিয়ায় সবগুলো কর্মকাণ্ড সম্পর্কেই অবগত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এর মধ্যে বেশিরভাগ কর্মকাণ্ডেই  তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন।
    এই প্রতিবেদনে আফসান চৌধুরী রচিত 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ধারাবাহিকতার ইতিহাস', মহিউদ্দিন আহমদ রচিত 'প্রতিনায়ক', মোরশেদ শফিউল হাসানের 'স্বাধীনতার পটভূমি ১৯৬০ দশক' এবং ডা. মাহফুজুর রহমানের 'বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ' এবং আবদুল আজিজ বাগমার রচিত 'স্বাধীনতার স্বপ্ন উন্মেষ ও অর্জন' এর তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

    স্বাধীনতার প্রথম প্রয়াস
    ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করার প্রচেষ্টা শুরু হয় ইনার গ্রুপের মাধ্যমে। পরবর্তীতে পাকিস্তান জন্মের পর পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার জন্য গোপন প্রচেষ্টা শুরু করে ইনার গ্রুপ।

    গবেষক আফসান চৌধুরী রচিত 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ধারাবাহিকতার ইতিহাস' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ইনার গ্রুপের প্রধান সংগঠক ছিলেন রাজনীতিবিদ ও সংগঠক মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরী। গ্রুপের সঙ্গে আরও যুক্ত ছিলেন সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও কূটনীতিবিদ কামরুদ্দীন আহমদ, রুহুল কুদ্দুস  (পরবর্তীকালে সচিব) প্রমুখ।

    পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই ইনার গ্রুপের সদস্যরা স্বাধীনতায় সহায়তার জন্য ভারতীয় দূতাবাস ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ শুরু করেন। এ জন্য ইনার গ্রুপের কয়েকজন সদস্য কলকাতায় কয়েক মাস অবস্থান করে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। ভারত সরকার স্বাধীনতার জন্য তাদের মেঘালয়ে গোপন ট্রান্সমিটার বসাতে দিতেও রাজি ছিল।

    ইনার গ্রুপের বিষয়ে আফসান চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইনার গ্রুপই সর্বপ্রথম স্বাধীনতার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছিল। ওই গ্রুপের সদস্যরা আগে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের ছাত্রফ্রন্টে করতো এবং বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ওদের আদর্শ ছিল সুভাষ চন্দ্র বসু। ওরা চেয়েছিল শেখ সাহেবকে লন্ডনে পাঠিয়ে সুভাষ বসুর মতো আন্দোলন করা। কিন্তু ১৯৫৫ সালের পর তারা বুঝতে পারেন যে সুভাষ বোসের মডেলে স্বাধীনতা সম্ভব নয়।'

    ইনার গ্রুপের কার্যক্রম কেবল ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৫৮ সালে  দেশে সামরিক শাসন জারি হলে ইনার গ্রুপের কার্যক্রমে কিছুটা ভাটা পড়ে। তবে এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যতিক্রম ছিল স্বাধীনতার আরেকটি প্রচেষ্টা।

    ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট
    ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে দেশে সামরিক শাসন জারির পর ইনার গ্রুপের কার্যক্রমে ভাটা পড়লেও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার উদ্যোগে ময়মনসিংহের জামালপুর মহকুমায় গঠিত হয় 'ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট'। সংগঠনটির প্রচারপত্রের বয়ান ছিল 'পূর্ব বাংলা বাঙালিদের, পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ছাড়ো'। স্বল্প সময়েই ফ্রন্টের জামালপুর, নেত্রকোণা, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ মহকুমা কমিটি গঠিত হয়েছিল।

    মহিউদ্দিন আহমদের 'প্রতিনায়ক' ও আফসান চৌধুরীর 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ধারাবাহিকতার ইতিহাস' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, 'ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টও ভারতের সাহায্যে সশস্ত্র উপায়ে দেশ স্বাধীন করতে চেয়েছিল। ১৯৫৯ সালের মার্চে গোপনে ভারতের আসামের মাইনকার চর ও ধুবড়ী হয়ে কলকাতা যান ফ্রন্টের নেতারা। কলকাতায় তাদের সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা সুরেন ঘোষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। সুরেন ঘোষই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ করিয়ে দেন।  যদিও ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ায় সে কথা স্মরণ করিয়ে নেহেরু অস্ত্র সাহায্যের বিষয়ে সীমাবদ্ধতার কথা জানান।'

    গ্রন্থ দুটির সূত্রে আরও জানা যায়, ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট সম্পর্কে অবগত ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমেদ, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। প্রাথমিক পর্যায়ে শেখ মুজিব ফ্রন্টের জন্য নগদ অর্থ প্রদান করেছিলেন।

    ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট রাজনৈতিকভাবে তেমন প্রভাব রাখতে না পারলেও 'পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা' শিরোনামে পোস্টার ও লিফলেট ছাপিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা তোলে। ফ্রন্টের কর্মীরা সচিবালয়, সিনেমা হলসহ জনবহুল স্থানে এসব পোস্টার লাগালে তা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের পাশাপাশি সরকারি মহলেও চাঞ্চল্যের তৈরি করে।

    যদিও দ্রুতই পাকিস্তানি প্রশাসন ফ্রন্টের কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করলে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল ফ্রন্টটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একইসঙ্গে পাকিস্তানি প্রশাসনের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা হয়, দেশের বিরুদ্ধে বড়সড় ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

    ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্টের কথা বলতে গিয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট স্বাধীনতার স্বপক্ষে প্রথম বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিল। ষাটের দশকে অনেক গ্রুপই তো কাজ করেছে। তবে তাদের কার্যক্রম খুবই সীমিত ছিল। এক্টিভিস্ট গ্রুপ বলতে যা ছিল তা ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট।'

    শরীফ শিক্ষা কমিশন
    পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার পথচলায় গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্দোলন ছিল ষাটের দশকে শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন।

    'বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ', 'প্রতিনায়ক' ও 'স্বাধীনতার পটভূমি ১৯৬০ দশক' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ক্ষমতায় আরোহণের দুমাস পরই পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে শিক্ষাসচিব এস শরীফের নেতৃত্বে কমিশন অন ন্যাশনাল এডুকেশন নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। সংক্ষেপে শরীফ শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত এই কমিশনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষাবিদরা সদস্য হিসেবে ছিলেন।

    ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট আইয়ুব খানের কাছে ৩৫০ পৃষ্ঠার একটি খসড়া প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ছিল দুই বছরের বিএ পাস কোর্সকে তিন বছর করা, অবৈতনিক শিক্ষা তুলে দেওয়া, উর্দু ও বাংলা বর্ণমালা সংস্কার করে রোমান বর্ণমালায় অক্ষরান্ত করা, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা ইত্যাদি।

    কমিশনের এই প্রতিবেদন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। ফলে কমিশনের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। প্রথমে ঢাকা কলেজে এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরো দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

    মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, 'আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্ররা তখন আন্দোলনের একটি সুযোগ খুঁজছিল। এ সময় সোহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তার হন। আবার তখন শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টও বের হয়ে। ফলে সব মিলে ছাত্রদের আন্দোলন শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধেই গড়ে উঠে।'

    লেখক ও গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিক্ষা কমিশনের সুপারিশগুলো তখন বাস্তবায়িত না হলেও পরবর্তীতে আমরা সবগুলোই কিন্তু গ্রহণ করেছি। মূলত আন্দোলনে নামার ক্ষেত্র হিসেবে শিক্ষা কমিশনকেই টার্গেট করেছিল ছাত্ররা।'

    আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির বৈঠক
    'প্রতিনায়ক' ও 'স্বাধীনতার পটভূমি ১৯৬০ দশক' গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ১৯৬১ সালের শেষের দিকে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ এবং খোকা রায়ের মধ্যে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে শেখ মুজিব বলেন, 'এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হনে। আন্দোলনের প্রোগ্রামে ওই দাবি রাখতে হবে।'

    আফসান চৌধুরী বলেন, 'শেখ সাহেব যখন মণি সিংহ এবং খোকা রায়ের সঙ্গে বৈঠকে স্বাধীনতার প্রস্তাবটি তুললেন, তখন মণি সিংহরা রাশিয়াতে জিজ্ঞেস করে যে আমরা এই উদ্যোগে জড়িত হবো কি না। কিন্তু রাশিয়া থেকে সম্মতি না আসায় তারা বলেন, আমরা মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে থাকতে চাই। ১৯৬৮ সালের আগে এরপর আর কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতার পক্ষে কোনো কাজ করেনি।'

    শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ বরাবরই স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার ছিল। 'প্রতিনায়ক' সূত্রে আরও জানা যায়, '১৯৬১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসেও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণিসহ ছাত্রলীগের একাধিক নেতার নেতৃত্বে রাতের অন্ধকারে "স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কায়েম কর" লিখিত লিফলেট ও পোস্টার বিলি করেছিলেন। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গোপনে পূর্ব বঙ্গ মুক্তি ফ্রন্টের প্রচারণা চালানো হয়। এই লিফলেটটিতে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার আহ্বান জানিয়ে লেখা হয়েছিল।'

    স্বাধীনতার জন্য ষাটের দশক থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান কতোটা সক্রিয়  ছিলেন তার প্রমাণ মিলে 'প্রতিনায়ক' গ্রন্থে।

    ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে স্বাধীনতার পক্ষে ভারত সরকারের সমর্থনের জন্য গোপনে ত্রিপুরা সফর করেন শেখ মুজিব। এই ত্রিপুরা সফরে শেখ মুজিবের সহযাত্রী ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা রেজা আলী। তার ভাষ্য অনুযায়ী, গোপনীয়তার স্বার্থে নারায়ণগঞ্জ থেকে সিলেটগামী ট্রেনে তারা টঙ্গী স্টেশন থেকে উঠেছিলেন।

    টিকেটও কাটা হয়েছিল ছাত্র ইউনিয়নের অন্য দুই নেতার নামে। ফলে শেখ মুজিবের ওই ট্রেন ভ্রমণের রেকর্ড রেলওয়ে বিভাগের কাছে ছিল না।

    মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, 'সে সফরে ভুল বোঝাবুঝির কারণে বঙ্গবন্ধু কিন্তু একদিন জেলেও ছিলেন। সেই সফর কিন্তু ব্যর্থ হয়। তিনি ফিরে এসে পরদিনই জননিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন।'

    কয়েকমাস পর মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব ডিসেম্বরে ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়ার উদ্যোগে ইত্তেফাক অফিসে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় কূটনীতিবিদ শশাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী গোপন বৈঠক করেন।

    বৈঠকের একপর্যায়ে শেখ মুজিব তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুকে ব্যক্তিগতভাবে সম্বোধন করা একটি চিঠি দেন। চিঠিতে ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে লন্ডন থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও প্রবাসী সরকার গঠনের একটি কর্মপরিকল্পনাও ছিল।

    এ নিয়ে নেহেরুর সঙ্গে বৈঠকের ইচ্ছেও প্রকাশ করেন মুজিব। কিন্তু এমন সময় চীন-ভারত যুদ্ধ হওয়ায় আরেকটি যুদ্ধে যেতে রাজি হয়নি ভারত। ফলে দিল্লি থেকে অপেক্ষায় থাকতে বলা হয়। কিন্তু শেখ মুজিব ধরে নিয়েছিলেন যে ভারতীয় আমলাদের জন্যই দেরী হচ্ছে। তাই ভারত সরকারের চূড়ান্ত মনোভাব জানতে ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে ত্রিপুরায় মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের সঙ্গে দেখা করেন শেখ মুজিব।

    শেখ মুজিবকে আগরতলায় রেখেই দিল্লি যান মুখ্যমন্ত্রী। দিল্লিতে নেহেরু ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, শেখ মুজিবের প্রস্তাবের বিষয়ে ভারত অবগত রয়েছে। এরপর থেকে তিনি যেন একমাত্র ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমেই দিল্লিতে যোগাযোগ করেন।

    অপূর্ব সংসদ
    শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা রেখেছিল  ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গঠিত হওয়া পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফোরাম। ফোরামের সভাপতি ছিলেন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ ওয়ারেস ইমাম ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের ছাত্রনেতা আবদুল আজিজ বাগমার।

    প্রথমে দেশে সামরিক আইন থাকার কারণে আন্দোলন কিছুটা সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৯৬২ সালের ১ মার্চ সামরিক শাসন তুলে নেওয়া মাত্রই শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

    সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জের এক ছাত্রসভায় ছাত্রনেতা আবদুল আজিজ বাগমার পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিষয়টি উচ্চারণ করেন। বাগমার তার রচিত 'স্বাধীনতার স্বপ্ন, উন্মেষ ও অর্জন' গ্রন্থে 'স্বাধীনতার প্রথম স্লোগান' অনুচ্ছেদে লিখেছেন, '১৯৬২ সালে এ ধ্বনিটি বা স্লোগানটি আমিই উচ্চারণ করেছিলাম।' সেই ছাত্রসভায় সবাই স্বাধীনতার পক্ষে শপথ নেওয়ার উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, 'তারা আরও একটি শপথ নেয় যে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করা হবে।'

    শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের মাঝেই ১৯৬২ সালের ১ অক্টোবর স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা গড়ে তোলার জন্য জন্ম হয় আরেকটি নতুন গোপন সংগঠনের—অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার। সাংস্কৃতিক নাম অপূর্ব সংসদ।

    কবি সুফিয়া কামালকে রাষ্ট্রপতি, আবদুল আজিজ বাগমারকে প্রধানমন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ শরীফ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুহম্মদ আবদুল হাই ও শওকত ওসমানকে উপদেষ্টা করে অপূর্ব সংসদের একটি সরকার কাঠামোও ঠিক হয়। অপূর্ব সংসদের মনোগ্রাম অঙ্কন করেন প্রাণেশকুমার মণ্ডল।

    ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত 'বাঙালি কি চায়? স্বাধীনতা', 'শকুন-শৃগালের আবার বাংলা আক্রমণ', 'ইতিহাসের ধারায় বাঙালী' শিরোনামে অপূর্ব সংসদের তিনটি ইশতেহার প্রকাশিত হয়।

    অপূর্ব সংসদের উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল রবীন্দ্রনাথের 'আমার সোনার বাংলা' গানটিকে ভবিষ্যতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলা। স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণার জন্য অপূর্ব সংসদের কর্মীরা মূলত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের ট্রেনের ইন্টারক্লাস যাত্রীদেরই বেছে নিতেন। অপূর্ব সংসদ সম্পর্কে অবগত ছিলেন শেখ মুজিব থেকে মওলানা ভাসানীসহ অন্যান্য জাতীয় নেতারা।

    অপূর্ব সংসদ বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অপূর্ব সংসদ ছিল ছাত্রলীগের মধ্যেই একটি গ্রুপ। তবে তাদের প্রকাশ্যে কোনো প্রচার ছিল না। যা করেছিল সব গোপনেই। তবে তাদের তৃতীয় ইশতেহার "ইতিহাসের ধারায় বাঙালি" ভীষণ দূরদর্শী ছিল। এটি লিখেছিলেন অধ্যাপক আহমদ শরীফ।'

    ষাটের দশকের প্রতিটি আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা  পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর সংযোগ ছিল জানিয়ে লেখক ও গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, 'শেখ সাহেব আসলে একটিভ পার্টিসিপেন্ট ছিলেন। স্বাধীনতার কোনো প্রচেষ্টা হলেই শেখ সাহেব, মওলানা ভাসানী, মানিক মিয়ার কাছে আসতেন। যাদের সঙ্গে শেখ সাহেবের সম্পর্ক পূর্বে ছিল না, তারাও শেখ সাহেবের কাছে গিয়েছেন। সুতরাং বলা যায়, স্বাধীনতার যতোগুলো প্রচেষ্টা ছিল সবগুলোর সঙ্গে শেখ সাহেবের একটি সংযোগ ছিল।'
    https://bangla.thedailystar.net/literature/history-tradition/history/news-570036
     
  • বিপ্লব রহমান | ২৬ মার্চ ২০২৪ ২০:৩৫742629
  • মওলানা ভাসানী মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে কেমন ছিলেন?
    আকবর হোসেন, বিবিসি নিউজ বাংলা, ২৫ মার্চ ২০২৪
     
    বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী এক চরিত্র আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, যিনি তার অনুসারীদের কাছে মওলানা ভাসানী হিসেবে পরিচিত।
    শুধু বাংলাদেশের ইতিহাস নয়, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু করে এ অঞ্চলে সারাজীবন মওলানা ভাসানী রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ছিলেন।
    মওলানা ভাসানী ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পাকিস্তান শাসনামলেও ভাসানীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশ জনপ্রিয় ছিল।
    কিন্তু এক সময় ভাসানীকে ছাপিয়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার নামের ওপর ভিত্তি করেই স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান।
    প্রশ্ন হচ্ছে, তৎকালীন আরেকজন প্রভাবশালী নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন?
    এনিয়ে অনেকের মধ্যেই আগ্রহের কমতি নেই। এ লেখার মাধ্যমে ভাসানীর সেই সময়ের দিকে ফিরে তাকানো হয়েছে।
     
    মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে
    মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে মওলানা ভাসানী বাংলাদেশেই ছিলেন। তখন তিনি টাঙ্গাইলে অবস্থান করছিলেন। তবে তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে নিজ বাড়িতে ছিলেন না।
    নিজ বাড়ি ছেড়ে সেসময় তিনি উঠেছিলেন টাঙ্গাইলের বিন্যাফৈর নামের আরেকটি গ্রামে তার এক অনুসারীর বাড়িতে।
    এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করতে টাঙ্গাইলে গিয়েছিলেন দুইজন বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেনন এবং হায়দার আকবর খান রনো।
    মি. রনো তার 'শতাব্দী পেরিয়ে' বইয়ে লিখেছেন, তাদের পক্ষ থেকে মওলানা ভাসানীকে ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হলেও তিনি সেটি গ্রহণ করেননি। তিনি চেয়েছিলেন টাঙ্গাইলে থেকে চীনের সাথে যোগাযোগ করতে।
    ততক্ষণে টাঙ্গাইলে পাকিস্তানী বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে এবং টাঙ্গাইল শহর দখল করে তারা গ্রামের দিকে এগুচ্ছিল।
    হায়দার আকবর খান রনো লিখেছেন, “আমি বললাম, চীনের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করবেন? চীন দূতাবাসের পক্ষেও আপনার এখানে আসা সম্ভব নয়, পথে তো যুদ্ধ হচ্ছে।
    মওলানা সাহেব তারপরেও বললেন – হবে, যোগাযোগ হবে, সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। বুঝলাম, তিনি অযৌক্তিক কথা বলছেন।”
    পাকিস্তানী বাহিনী টাঙ্গাইলের সন্তোষে মওলানা ভাসানীর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

    এরপর তারা বিন্যাফৈর গ্রামের দিকে অগ্রসর হওয়ার আগে মওলানা ভাসানী কৃষকের বেশে ওই গ্রাম ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে তিনি সিরাজগঞ্জ যান।
    সেখানে একজন বামপন্থী নেতা সাইফুল ইসলামকে সাথে নিয়ে মওলানা ভাসানী আসাম দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন।
    মওলানা ভাসানীর সহচর সাইফুল ইসলাম ছিলেন পাবনায় তৎকালীন ন্যাপ (মোজাফফর) নেতা।
    ভাসানীর সাথে অবস্থানের নানা ঘটনার বর্ণনা উঠে এসেছে সাইফুল ইসলামের লেখা বই ‘ভাসানী স্বাধীনতা ভারত’ নামক বইতে।
    সেখানে মি. ইসলাম লিখেছেন, বিন্যাফৈর গ্রাম আক্রান্ত হবার আগে মওলানা ভাসানী পাশের আরেকটি গ্রামে গিয়েছিলেন।
    পরবর্তীতে তিনি নদী পার হয়ে সিরাজগঞ্জে আসেন। পরে সাইফুল ইসলামকে সাথে নিয়ে তিনি যমুনা নদী ধরে আসামে পৌঁছান।
     
    ভারতে প্রবেশ
    ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে মওলানা ভাসানী এবং তার সহচরদের কয়েকদিন সময় লেগে যায়।
    তবে ভাসানী প্রথমে ভারতে ঢুকতে পারছিলেন না।
    কারণ, সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান বিষয়টি নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সেখানে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কাউকে সে এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়ার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ নিষেধ করেছে।
    মওলানা ভাসানীকে নিয়ে গবেষণা করেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লেখক ও গবেষক সৌমিত্র দস্তিদার। ‘আমি ও আমার মওলানা ভাসানী’ শিরোনামে তার একটি বইও রয়েছে।
    মি. দস্তিদার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “মওলানা ভাসানী যখন আসাম সীমান্তে আসলেন তখন তাকে অভ্যর্থনা করা হয়েছিল ভালো মতোই। তখন আসামের মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী মওলানা ভাসানীর শিষ্যের মতোই ছিলেন।”
    তবে, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মওলানা ভাসানী ভারত যেতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন লন্ডন যেতে।
     
    'মওলানা ভাসানী হঠাৎ অদৃশ্য'
    ভাসানী ভারতে থাকাকালীন ভারত এবং তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলে অনেকেই তার কোন খোঁজ-খবর জানতেন না।
    তার মতো একজন সুপরিচিত এবং প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ কেন হঠাৎ লোকচক্ষুর অন্তরালে রয়েছেন - তা নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি হয়েছিল ভারতের তৎকালীন রাজনীতিবিদদের মধ্যে।
    রাজনৈতিক মহলে অনেকে জানতেন যে মওলানা ভাসানী ভারতে আছেন। তবে তিনি ঠিক কোথায় আছেন এবং কীভাবে আছেন সেটি ছিল অনেকের অজানা।
    মুক্তিযুদ্ধ শুরু এবং অস্থায়ী সরকার গঠন করা হলেও মওলানা ভাসানী ছিলেন যুদ্ধের মূলধারা থেকে আলাদা।
    অনেকে ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো নিজ থেকেই নির্বাসিত জীবন-যাপন করছেন।

    তার সাথে সবসময় থাকতেন পাবনার মুজাফফর ন্যাপ কর্মী সাইফুল ইসলাম। তার কাজ ছিল ভাসানীর বিবৃতি ও চিঠি বিভিন্ন জায়গায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
    শাহ আহমদ রেজা ১৯৭১ সালে প্রকাশিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাকে উদ্ধৃত করে ‘যুগে যুগে মওলানা ভাসানীর সংগ্রাম’ বইতে লিখেছেন, "পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় মার্কসবাদী কমিউনিস্ট নেতা হরে কৃষ্ণ কোঙার ১৪ই মে অভিযোগ করেছিলেন যে, 'মওলানা ভাসানীকে কলকাতাতেই কোথাও অন্তরীণ রাখা হয়েছে'।"
    জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, মওলানা ভাসানী কোথায় আছে সেটা তিনি বা তার সরকার জানেন না।"
    মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ’ – এর ২১শে মে ১৯৭১ সংখ্যার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘ভাসানী কলকাতাতেই অন্তরীণ, কিন্তু সরকার নীরব!’
    “আমরা রাজ্য সরকারের কাছে দাবি জানাইতেছি যে, অবিলম্বে তারা এই রহস্যজাল ভেদ করুন এবং ভাসানী সাহেবের নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করিয়া যে উদ্বেগ এবং সংশয়ের সৃষ্টি হইয়াছে তা দূর করুন।”
    সেসময়কার বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মওলানা ভাসানী ভারতের কোন একটি জায়গায় ছিলেন।
    তিনি বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন। কখনো থেকেছেন কলকাতায়, কখনো আসামে, কখনো বা দেরাদুনে।
     
    মওলানা ভাসানী কি ভারতে গৃহবন্দী ছিলেন?
    মওলানা ভাসানীর অনুসারীদের অনেকে মনে করেন, ভারতে প্রবেশ করে তিনি কার্যত নিজের স্বাধীনতা খুঁইয়েছিলেন।
    সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ (প্রয়াত) তার 'মধ্যরাতের অশ্বারোহী' বইতে লিখেছেন, “তিনি যদি ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত না নিতেন, তবে হয়তো তার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো।”
    ফয়েজ আহমদ লিখেছেন, "ভারতে থাকার সময় মওলানা ভাসানীর গতিবিধি ছিল নিয়ন্ত্রিত। কেবলমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের সাথে তিনি ঘুরতে পারতেন।"
    রাজনৈতিক ইতিহাসবিদদের অনেকের লেখায় ‌উল্লেখ আছে, নিরাপত্তার অজুহাতে তাকে সবসময় নজরদারিতে রাখা হতো। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার কর্মকর্তা কিংবা একজন ম্যাজিস্ট্রেট সবসময় ভাসানীর সাথে থাকতো।
    বিভিন্ন লেখায় দেখা যায়, প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতার বাইরে অন্য কেউ তার সাথে দেখা করতে পারতেন না। মওলানা ভাসানীর সাথে কে দেখা করবেন এবং কে করবেন না সেটি নির্ভর করতো ভারত সরকারের মর্জির ওপর।
    এমনকি ভাসানীর একান্ত অনুগত ও অনুসারী হিসেবে পরিচিত হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন এবং কাজী জাফর আহমেদও তার সাথে দেখা করতে পারেননি।
    "আমরা মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করার অনেক চেষ্টা করেছি। সিপিআই(এম)-এর সাহায্য চেয়েছি, কোনভাবে ভাসানীর দেখা পাওয়া যায় কী না। তবে, তারা প্রকাশ্যে এবং পার্লামেন্টে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, মওলানা ভাসানী কোথায়? ভারত সরকার নিরুত্তর ছিল," লিখেছেন হায়দার আকবর খান রনো।

    মুক্তিযুদ্ধ শুরুর হবার আগে মওলানা ভাসানী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে লন্ডনে বিপ্লবী অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
    সে লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের আটই এপ্রিল লন্ডনের পথে আত্মগোপন করে ভারতের অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।
    ফয়েজ আহমদ লিখেছেন, “ভারত থেকে লন্ডনে পৌঁছানোর সহজ পথ বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল ভ্রান্ত। এই রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের ফলেই তিনি ভারত সরকার কর্তৃক অঘোষিত গৃহবন্দী হয়ে পড়েন।
    এবং তার বিপ্লবী সরকার গঠনের পরিকল্পনাটি স্বাভাবিকভাবেই বানচাল হয়ে যায়। জীবনে তার সবচাইতে বেদনাদায়ক ঘটনা ছিল এই ব্যর্থতা।”
    এপ্রিল মাসের শেষের দিকে তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে মওলানা ভাসানী যে বাসায় থাকতেন সেখানে দেখা করতে যান।
    “তিনি দেরাদুনে আদর-আপ্যায়নের মধ্যে আটকাবস্থায় আগস্ট মাসেই জানতেন যে, ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করবে,” লিখেছেন ফয়েজ আহমদ।
    অস্থায়ী সরকারের সাথে মওলানা ভাসানীর খুব বেশি যোগাযোগ ছিলনা।

    'ভারত বিরোধী নেতা'
    পাকিস্তানের রাজনীতিতে মওলানা ভাসানী অনেকের কাছে ‘ভারত বিরোধী’ নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
    যে কারণে তিনি ভারত সরকারের পছন্দের তালিকায় ছিলেন না। তবে রাজনীতিবিদ হিসেবে ভাসানীকে উপেক্ষা করার সুযোগও ছিল না।
    কলকাতার লেখক ও গবেষক সৌমিত্র দস্তিদারও বলছেন, "মওলানা ভাসানীকে নিয়ে তৎকালীন ভারত সরকারের মধ্যে অস্বস্তি ছিল। এর বড় কারণ হচ্ছে, তার চীনপন্থী রাজনীতি।
    ভারত যেহেতু চীনের প্রতিপক্ষ সেজন্য মওলানা ভাসানীকে আস্থায় নিতো না ভারত সরকার। তবে ভারতের অনেক রাজনীতিবিদদের মধ্যে মওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা ছিল।"
    বিবিসি বাংলাকে সৌমিত্র দস্তিদার বলেন, “ওনার গায়ে চীনপন্থী হিসেবে ছাপ ছিল। উনি সেটা অস্বীকারও করতেন না। তখন তো পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন ভয়ঙ্কর চেহারায় ছিল। তারাও ছিল চীনপন্থী।
    যদি মওলানাও কখনো নকশালদের সমর্থন করেন সে চিন্তাও ছিল ভারত সরকারের মনে। এসব নিয়ে গোয়েন্দা রিপোর্ট মওলানার বিপক্ষে ছিল। সে আশংকা থেকে ভারত সরকার মওলানাকে নিয়ে ঝুঁকি নিতে চায়নি।”
    ভাসানীর ভারত বিরোধী মনোভাব থাকায় ভারতের ইন্দিরা গান্ধী সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে নজরবন্দি করে রেখেছিল।

    বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব যাতে বামপন্থীদের হাতে চলে না যায় সেজন্য বেশ চিন্তিত ছিল ভারত সরকার। সেজন্য তারা মওলানা ভাসানীকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল বলেও বিভিন্ন লেখায় উঠে আসে।
    "ভারতে থেকে মওলানা ভাসানী যদি কথা বলেন তাহলে অন্য নেতাদের কথাগুলো গৌণ হয়ে যাবে। গণমাধ্যমে এবং রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো ভাসানীকেই গুরুত্ব দেবে। এসব কারণেও ভারত সরকার মওলানা ভাসানীকে প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি," বলে মনে সৌমিত্র দস্তিদার।
    মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের অংশগ্রহণের প্রশ্নে কলকাতায় একটি সমন্বয় কমিটি গঠনের চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে মওলানা ভাসানীর নামও ঘোষণা করা হয়েছিল।
    কিন্তু সেই সমন্বয় কমিটির সাথে মওলানা ভাসানীর যোগাযোগ ভারত সরকার পছন্দ করেনি।
    তিনি যাতে রাজনৈতিক কারণে বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করতে না পারেন, সেজন্য তাকে কলকাতা থেকে কুঁচবিহারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল।
    কলকাতা ত্যাগের আগে সরকারি উদ্যোগে কলকাতা প্রেসক্লাবে একটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। কিন্তু ভারত সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে মওলানা ভাসানী সেই সংবাদ সম্মেলনে যেতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।
    ফলে মওলানা ভাসানীর সহচর সাইফুল ইসলাম প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত হয়ে মওলানা ভাসানীর পক্ষে একটি বিবৃতি পাঠ করেন।
    সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ লিখেছেন, ‘’ভারতে অবস্থানকালে কোন এক সময় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর বৈঠক হয়েছিল।’’
    বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিচালনার জন্য পঞ্চদলীয় একটা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির বৈঠকে তিনি একবার যোগ দিয়েছিলেন। সেই বৈঠকের একটি ছবি তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।
    মওলানা ভাসানীর অনুসারীরা তাদের বিভিন্ন লেখায় লিখেছেন, এর মাধ্যমে ভারত সরকার প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, মওলানা ভাসানী ভারতে ভালো আছেন, সুস্থ আছেন এবং তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।
     
    তবে ফয়েজ আহমদের ভাষায়, যেদিন বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে, সেই ১৬ই ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী ভারতের দেরাদুরে অঘোষিত গৃহবন্দী হিসাবে অবস্থান করছিলেন।
  • বিপ্লব রহমান | ২৬ মার্চ ২০২৪ ২১:০৩742630
  • ‘জয় বাংলা’ যেভাবে জনগণের স্লোগান হলো

    ‘বাংলার জয়’ শব্দ দুটি ছিল বাঙালির ভাগ্য গঠনে চেতনা, ঐক্য, দেশপ্রেম ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

    পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের নির্মম শোষণ, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের লড়াইয়ে এই আইকনিক স্লোগানটি অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা পালন করেছিল।
    এই স্লোগান বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে, যার ফলে আজ আমরা গর্বভরে দেশের ৫৪তম স্বাধীনতা দিবস পালন করছি।
     
    'জয় বাংলা' ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে জনসাধারণের স্লোগানে পরিণত হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়িয়েছে।
     
    ১৯২২ সালে ভারতে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে যখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম 'পূর্ণ অভিনন্দন' কবিতায় এই শব্দগুলো লিখেছিলেন।
    কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুরে জেলে থাকার সময় এটি লিখেছিলেন।
     
    কবিতার বিষয়বস্তু ছিল ঔপনিবেশিকতা, বিদেশি নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং 'জয় বাংলা' শব্দগুলো কিছুটা ভিন্নভাবে ব্যবহার করা হলেও পঞ্চম স্তবকে উপস্থিত হয়েছে, 'জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি -অন্তরীণ! জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!'
     
    কবিতাটি ব্রিটিশ বিরোধী বীর পূর্ণচন্দ্র দাসকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন মাদারীপুরের একজন স্কুল শিক্ষক এবং কারাগারে নজরুলের সহবন্দী।
     
    পূর্ণচন্দ্র বহরমপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তার মুক্তি উপলক্ষে মাদারীপুরে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেখানে পূর্ণচন্দ্র সম্পর্কে কিছু লেখার জন্য কাজী নজরুলকে অনুরোধ করেন কালিপদ রায়চৌধুরী। কালিপদও কাজী নজরুলের সঙ্গে কারাবন্দী ছিলেন।
     
    কবিতাটি পরে ১৯২৪ সালে তার কাব্যগ্রন্থ 'ভাঙার গান'-এ প্রকাশিত হয়।
     
    ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুল কারাগার থেকে মুক্তি পান।
    বিদ্রোহী কবি পরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এক পৃষ্ঠার সান্ধ্য দৈনিক নবযুগে 'বাঙালির বাংলা' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন।
     
    ১৯৪২ সালের এপ্রিলে (৩ বৈশাখ, ১৩৪৯) প্রকাশিত প্রবন্ধে কবি বাঙালিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
     
    কবি লিখেছেন, 'বাংলা বাঙালির হক, বাংলার জয় হক, বাঙালির জয় হক'।
     
    ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে ঔপনিবেশিক বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন দেশ—ভারত ও পাকিস্তান (পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে গঠিত)।

    কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নতুন শাসকদের অধীনে বাঙালিদের কাছে স্বাধীনতা অধরা থাকায় 'জয় বাংলা' ধীরে ধীরে স্লোগান হিসেবে পুনরুত্থিত হয়।
     
    ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস 'জয় বাংলা' স্লোগানকে সামনে নিয়ে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক গোপন ছাত্র সংগঠন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ 'জয় বাংলা' নামে একটি হাতে লেখা সংবাদ প্রকাশ করত। (সিরাজুল আলম খানের স্বাধীনতা-সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ)
     
    ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা চলাকালীন স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের দুই সদস্য—আফতাব উদ্দিন আহমেদ এবং চিস্তি শাহ হেলালুর রহমান—'জয় বাংলা' স্লোগান দেন।
     
    ছাত্রলীগ নেতা আফতাব ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এবং চিস্তি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও দর্শনের শিক্ষার্থী।
     
    আফতাবের 'জয় বাংলা' স্লোগান দেওয়ার একটি নিজস্ব পটভূমিকা ছিল।
     
    ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রউফের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন।
     
    ফিরে আসার পর রউফ মধুর ক্যান্টিনে অন্যদের সঙ্গে তার সফরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তিনি বলেন, জিএম সৈয়দের নেতৃত্বে সিন্ধুতে একটি আন্দোলন চলছে এবং এর মূল স্লোগান ছিল 'জয় সিন্ধ'।
     
    আলোচনার এক পর্যায়ে আফতাব বলেন, তারাও 'জয় বাংলা' ব্যবহার করতে পারেন। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর মধুর ক্যান্টিনে তিনি নিজেই স্লোগানটি দেন। (স্লোগানে স্লোগানে রাজনীতি: আবু সাঈদ খান)
    এর মধ্য দিয়ে 'জয় বাংলা' আন্দোলিত হতে থাকে।
     
    ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্ররা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি সমাবেশে এই স্লোগান দেয়। সেখানে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন।
     
    এর দুই সপ্তাহ পর ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশে উচ্চারিত হতে থাকে 'জয় বাংলা' শব্দ দুটি।
     
    সমাবেশ পরিচালনাকারী সিরাজুল আলম খান মঞ্চ থেকে বারবার স্লোগানটি দিতে থাকেন। (সিরাজুল আলম খানের স্বাধীনতা-সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ)
     
    ৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পল্টন ময়দানে আরেকটি সমাবেশের আয়োজন করে, যেখানে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে 'স্বাধীনতার ইশতেহার' উন্মোচন করেন।
    ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে, 'জয় বাংলা' হবে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান।
     
    পরে বিতরণ করা লিফলেটের শিরোনাম ছিল 'স্বাধীনতার ইশতেহার: জয় বাংলা'। (মহিউদ্দিন আহমদের প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান)
     
    ১৯৭০ সালের ৭ জুন ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদানের জন্য একটি বিশেষ বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর নাম ছিল 'জয় বাংলা বাহিনী', যার প্রধান ছিলেন এএসএম রব। (বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র: কাজী আরেফ আহমেদ)
     
    ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সব সদস্যকে রাজপথে নামতে বলা হয়েছিল এবং পরিষদের সব সদস্যের কাছে নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সাইক্লোস্টাইল পেপার 'জয় বাংলা' প্রকাশিত হয়েছিল।
    নির্বাচন যতই ঘনিয়ে এসেছে, ততই 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ'র বদলে সর্বত্র 'জয় বাংলা' স্লোগান দেওয়া হয়েছে।
     
    ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে—বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে—বঙ্গবন্ধু যখন তার ১৯ মিনিটের মহাকাব্যিক ভাষণটি 'জয় বাংলা' দিয়ে শেষ করেছিলেন, এরপর থেকে স্লোগানটি ছড়িয়ে পরে সর্বত্র। এই স্লোগান শুনে উপস্থিত জনতা গর্জে ওঠে নতুন উদ্যমে।
     
    ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার প্রথম বেতার ভাষণ শেষ করেন 'জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ' বলে। পরের দিন এটি রেডিওতে প্রচারিত হয়।
    ২০২২ সালের ২ মার্চ আওয়ামী লীগ সরকার 'জয় বাংলা'কে জাতীয় স্লোগান করে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন