অমিতাভ গুপ্ত একটা অসম্ভব ভালো লেখা লিখেছে রোব্বারের আনন্দবাজারে। য্দিও লেখাটার প্রতিপাদ্যের সঙ্গে আমি একমত নই, তার পরেও, বৈদ্যুতিন এবং সামাজিক মাধ্যম জুড়ে অজস্র চর্বিতচর্বণের মধ্যে, এ ধরণের বৌদ্ধিক লেখা পড়লে মগজের আরাম হয়। লেখাটা লম্বা, তবে তার যৌক্তিক মোটামুটি এইরকমঃ ১। ফেসবুক, বা সামগ্রিকভাবে সামাজিক মাধ্যমে অতি-দক্ষিণপন্থী দৃশ্য-শ্রাব্য-পাঠ্য বস্তুর সংখ্যা বাম-অতিবাম-মধ্য এদের যোগফলের চেয়েও বেশি। ২। এর একটা কারণ হল সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদম অতি-দ্ক্ষিণপন্থীদের সহায়তা করে বেশি (কেন, লেখক ব্যাখ্যা করেননি)। ৩। এর আরও একটা সম্ভাব্য কারণ আছে। একটা স্টাডিতে দেখা গেছে অতি-দক্ষিণপন্থায় বিশ্বাসীদের বৌদ্ধাঙ্ক, অর্থাৎ আইকিউ তুলনামূলকভাবে কম। সোজা বাংলায় বললে বোকাদের অতিদক্ষিণপন্থার দিকে টেনে আনা সোজা। কারণ, বুদ্ধি কম মানে পড়াশুনো কম, বহির্জগতে বীক্ষণ কম, চিন্তাভাবনার ক্ষমতা কম। ... ...
ক্রমশ কত কিছু শিখলাম। আমরা মফঃস্বল গঞ্জের ছেলেপুলেরা বুলি বলতে বুঝতাম মুখে যা ফোটে বা ফোটেনা। ওর মানে যে দলবদ্ধভাবে পিছনে লাগা, সে জানতে বহুদিন সময় লেগেছিল। কানাকে কানা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিওনা, এ অবশ্য জানা ছিল, কিন্তু তারপরেও এলাকায় তিনজন বাপির একজন ছিল কালা-বাপি, আরেকজন মোটা-বাপি, তৃতীয়জন ল্যাংড়া-বাপি (নাম বদলে দিলাম, কী দরকার)। এ সবই শারীরিক বৈশিষ্ট্যসূচক। কালার শ্রবণযন্ত্রে একটু সমস্যা ছিল, ল্যাংড়া ঠিকঠাকই হাঁটত, কিন্তু কোনো সময়ে খেলতে গিয়ে মনে হয় চোট পেয়েছিল। তখন এশিয়াডের ম্যাসকট বাচ্চা হাতি আপ্পু খুব হিট। প্রত্যেক ক্লাসেই থাকত নিজস্ব একটি আপ্পু। আমাদেরও ছিল। এই দুর্মর রাজনৈতিক সঠিকত্বের যুগে বোঝা কঠিন, যে, ওগুলো কেবলমাত্র বৈশিষ্ট্যবাচক ব্যাপার ছিল। রোগা-মোটা-কালো-ফরসা-কালা-টেকো -- এই সব নিয়েই পৃথিবী, যে যেমন, সবাই, যাকে বলে, ডিফারেন্টলি কেপেবল। তা বলে সব কিছু ভারি নিষ্পাপ ছিল এমন না। বুলির সবচেয়ে কাছাকাছি প্রতিশব্দ ছিল ক্ষ্যাপানো। সেও হত বিস্তর। পচা (আবারও নাম পরিবর্তিত) বলে একটি লোক, কেন কে জানে পুই-পুই শব্দটা শুনলেই খুব রেগে যেত। ইট-পাটকেল অবধি ছুঁড়ে মারত। তাকে দলবেঁধে ছেলেপুলে "পচা পুই পুই" বলবেই। অনুচিত জেনেও বলবে। বদামি যাকে বলে। এর চেয়ে ছোটো আকারেও "ক্ষ্যাপানো" হত। "লেডিস" ছিল ছেলেদের ক্ষ্যাপানোর একটা মূল মন্ত্র। মানে, ব্যাটা মেয়েলি। আরেকটা ছিল "লেডিস ফিংগার"। এর সঙ্গে মেয়েদের কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু ঢ্যাঁড়োশ না বলে যে কেন ইংরিজিতে বলা হত, জানা নেই। ... ...
বাংলায় যদি একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, তাহলে সমাজমাধ্যমে কী হয়? এখন যা হচ্ছে। সরকারপক্ষ, হয় চেপে যায়। নইলে বলে, দোষ আমাদের কেন হবে? মদ খেয়ে যদি কেউ খুন-ধর্ষণ কিছু একটা করে, তাহলে দোষ তো তাড়ির, তাড়ির না হলে নির্ঘাত খেজুর গাছের। পুলিশ তো আর গাছকে গ্রেপ্তার করতে পারেনা, ভারতীয় দন্ডবিধিতে তেমন ধারা নেই, তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। যদি প্রশ্ন করেন, কিন্তু খুনটা তো আর গাছ এসে করে দেয়নি, খুনিকে ধরলেন না কেন? তখন তাঁরা অম্লানবদনে বলবেন, আরে খুন হয়েছে জানবে, তবে তো। আইন আইনের পথে চলবে। আগে অভিযোগ, তারপর তদন্ত। খুন হবার আগে, সেই বেটি থানায় এসে অভিযোগ করেনি কেন? কোথাও কেউ প্রপার প্রসিডিওর ফলো করবেনা, আর সব দোষ হবে প্রশাসনের? মামার বাড়ি? সংখ্যাগুরু বিরোধীরা, সেই শুনে বলবেন, দেকেচ, আগেই বলেছিলাম, হিন্দু খতরেমে। খেজুর গাছের দোষ সরকার তো দেখতে পাবেইনা, ও গাছ তো আরব থেকে এসেছে। এরা সমুদ্রের নাম দিয়েছে, আরব সাগর, এদের পুলিশ আরবী ঘোড়া চড়ে, এদের একমাত্র দাওয়াই হল কেন্দ্র। কেন্দ্র থেকে তিনশছাপ্পান্ন লাও, দিল্লি থেকে সিবিআই। মারবে এখানে, বডি পড়বে তিহারে। জ্যায় শ্রীরাম। যদি মিনমিন করে প্রশ্ন করেন, কিন্তু এদিকে তো বঙ্গোপসাগর, তাছাড়া ওদিকেও তো হাথরাস-টাথরাস কীসব হয়েছে, তখন সিবিআই ঠিক কী করছিল? রেডিমেড জবাব, বড়-বড় কথা বলবেন না, আপনি কি সেকু-মাকু না লিবারবাল? কাশ্মীরে যখন পন্ডিতদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, তখন আপনি কোথায় ছিলেন? যখন আফগানিস্তানে বুদ্ধমূর্তি ভাঙা হচ্ছিল, আপনি কী করছিলেন? যখন নাইন-ইলেভেন হল, তখন... ইত্যাদি প্রভৃতি। ... ...
অমরদার পুরস্কার তো আমাদেরই পুরস্কার। যখন রিয়েলিটি শোতে ঢেকে যাচ্ছে দুনিয়া, লেখা-টেখা যা হচ্ছে, তাও বেশিরভাগই ভূত-প্রেত-তন্ত্র-মন্ত্র, যখন বিকট উচ্চকিত আলোর দুনিয়ায় শিল্পীরা ক্রমশ ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছেন, তখন যেকোনো সৃষ্টিশীল মানুষ স্বীকৃতি পেলেই মনে হয়, নিজেদের স্বীকৃতি। তার উপর এ তো অমরদা। এই তো সেদিনই গুটিগুটি স্টলে এসে চেয়ারে বসলেন, দুচারটি বাক্যবিনিময় হল। ফিল্মফেয়ার পাওয়া শিল্পী এলে ভিড় জমে যেত, অকাদেমী পাওয়া লেখক হলে, তেমন হয়না, কী আর করা যাবে। বুকার-টুকার পেলে হয়। অরুন্ধতী রায় কি ঝুম্পা লাহিড়ি এলে ভিড়ের সঙ্গে দুচাট্টি ক্যামেরাও কি আসতনা? এবার অমরদা এলেও হবে নির্ঘাত। তাতে যে অমরদার দুটি নতুন হাত গজাবে তা নয়। উনি যা লিখেছেন, তা তো আর একটা পুরস্কারে বদলে যাবেনা। এবং এ মোটেই আনন্দের ব্যাপারও না, যে বিদেশী পুরস্কার পেলে তবেই আমরা টের পাব ঘ্যাম কিছু একটা হচ্ছিল বটে। কিন্তু ও আমাদের ঐতিহ্য। রবীন্দ্রনাথও, শুনেছি, বিশ্বভারতীর খাটা-পায়খানার জন্য পয়সা তুলতে কলকাতায় মুখের ফেনা তুলে ফেলেছিলেন, তারপর যেই নোবেল পেলেন, ট্রেন রিজার্ভ করে আস্ত কলকাতাই বোলপুরে হাজির। নোবেল বাবা, ইয়ার্কি না। ... ...
সিদ্ধার্থ যদি দুহাজার বছর আগে না জন্মে এই দুর্মর পলিটিকাল-কারেক্টনেসের যুগে জন্মাতেন, সুজাতার হাতে পায়সান্ন খেয়ে তাঁর আর বুদ্ধদেব হওয়া হতনা। বদলে হাজতে বসে পুলিশের পিটুনি আর মোটা চালের ভাত খেতেন। বৌদ্ধধর্ম লাটে উঠে যেত, নির্বাণ লাভ আরও কয়েক জন্ম পিছিয়ে যেত, কারণ মাথায় যা মামলা চাপত, তাতে মিনিমাম ১৪ বছর জেল। একে তো নাবালিকা সুজাতাকে ফুসলানোর অপরাধে শ্লীলতাহানির কেস। তারপর "বিয়ে করে বৌ-ছেলেকে ফেলে পালিয়েছিস?" বলে প্রতারণার চার্জ । রিগ্রেসিভ-প্রগ্রেসিভ চুলচেরা বিশ্লেষণে অভ্যস্ত সমবেত ভদ্রমহোদয় ও মহিলাগণ মিডিয়া এবং সোশাল মিডিয়ায় হাঁ করে কেসের ধারাবিবরণী গিলতেন, তারপর "বেশ হয়েছে, আর পালাবি?" বলে হাততালি মারতেন। ... ...
ফলত, এই ২০১১ থেকে আফগানিস্তানের দুর্গম গ্রামগঞ্জ ভরে যেতে শুরু করে খোঁড়া, কানা, বিকলাঙ্গ মানুষে। এছাড়াও মাটির নিচে জমতে থাকে লাশ। আর কচি কচি বাচ্চারা ফুঁসতে থাকে প্রতিশোধের আকাঙ্খায়। তালিবান এদের হাতে অস্ত্র দিয়েছিল। মার্কিন বাহিনীর প্রতিটি বন্দুকের গুলি, প্রতিটি খুন, প্রতিটি সম্পত্তি নষ্ট, প্রতিটি ড্রোন আক্রমণ, এভাবেই জন্ম দিতে থাকে আরও অনেক অনেক তালিবানের। তারা তখন লড়ছিল প্রতিশোধের লড়াই। আর মার্কিনীরা কোনোক্রমে স্থিতাবস্থা বজায় রাখছিল। ... ...
পরে অবশ্য জানা যায়, যে, হেলিকপ্টারে আদৌ মৃতদেহ ঝুলছিলনা। কান্দাহারের প্রশাসক-ভবনের পাশে লম্বা কিছু পতাকার খুঁটি ছিল। হেলিকপ্টারে ঝুলে একজন তালিবান কর্মী তাতে তালিবান পতাকা লাগানোর চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। স্থানীয় সাংবাদিকরা ব্যাপারটি জানান। পরে একটি ভিডিওও আসে। দুনিয়া জুড়ে সংবাদমাধ্যমের বিখ্যাত ব্যক্তিরা, যাঁরা খবরটি ছড়াচ্ছিলেন, তাঁদের কেউ-কেউ নিজেদের সামাজিক মাধ্যমে করা পোস্ট মুছেও দেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমগুলি, যারা সোৎসাহে খবরটি ছাপছিল, তাদের কাউকে সেভাবে ভুল স্বীকার করতে দেখা যায়নি। ... ...
অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র একবার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন, যে, দিল্লির যোজনা কমিশনের সহসচিবকে তিনি বলেছিলেন, কলকাতা থেকে দিল্লি এলে তাঁর মনে হয়, গ্রাম থেকে শহরে এলেন। অস্যার্থঃ পশ্চিমবঙ্গ থেকে সম্পদ চুষে নিয়েই দিল্লি এবং পশ্চিমাঞ্চলের রমরমা। অশোক মিত্রের বর্ণনা অনুযায়ী সে বছর যোজনা কমিশনের অবশেষে পশ্চিমবঙ্গকে তার যথাযথ ভাগ দিতে সুপারিশ করে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী সেই সুপারিশ খারিজ করেন। এ কোনো রাজনৈতিক স্লোগান বা লাইন নয়, কিন্তু মূল ন্যারেটিভটি ছিল এইরকমই। যা লোকে বিশ্বাস করত। ... ...