আপনি নিজে একা বা ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে গিয়ে যখন কোন হোটেলে ওঠেন, তখন কোনদিন সেই হোটেলের ‘ফায়ার-এসকেপ’ ব্যবস্থা নিয়ে ভেবেছেন? মানে ধরুণ আপনি সেই হোটেলের পাঁচতলায় আছেন, হঠাৎ রাতের বেলা আগুন লেগে গেল কোন কারণে! কি করবেন আপনি? এটা আমরা সবাই জানি যে আগুন লাগলে লিফট ব্যবহার করা উচিত নয় (আর এমনিতেই আগুন লাগলে লিফট অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যাবার কথা) – তাহলে আপনি কিভাবে নামবেন নীচে? বেশী সময় নেই কিন্তু আপনার হাতে – আগে থেকে দেখে রেখেছেন কি সিঁড়িটা কোন দিকে যাতে বিপদের সময় আপনাকে খুঁজতে না হয়! ... ...
আমরা সবাই, অর্থাৎ লেখক, শিল্প, স্থাপত্যবিদ, আর্কিটেক্ট এবং প্যারিস শহরের সৌন্দর্য্য ভালোবাসা লোকেরা একযোগে প্রতিবাদ করছি এই সিদ্ধান্তের যা এই শহরের সৌন্দর্য্যের প্রতি এবং তার থেকেও বড় কথা ফরাসীদের সৌন্দর্য বোধের, যা আমাদের অত্যন্ত গর্বের এক বিষয় তার প্রতি এক প্রবল আঘাত হানতে চলেছে। কি ভাবে যে আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় এই শহরের বুকে, একদম মধ্যভাগে বলতে গেলে – এই একদম ফালতু এবং দৈত্যাকার আইফেল টাওয়ার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল – তা আমরা অনেক চিন্তা করেও বুঝতে পারছি না। আমার কি আমাদের প্রিয় প্যারিস শহরের শত শত বছরের এলিগ্যান্ট এবং মনোহর স্থাপত্য দিয়ে গর্ব করা ভুলে গেলাম যে এমন এক অদ্ভুত কারখানার কালো চিমনির মত টাওয়ার শহরের মাঝখানে খাড়া করতে হবে? এই কাঠামো শুধু হাস্যকরই নয়, এক বর্বরোচিত প্রচেষ্টা যা আমাদের ফরাসী সংস্কৃতির প্রতি অবমাননা – এবং এই প্ল্যান কার্যকরী হলে সুন্দরী প্যারিসের বুকে আমরা আগামী কুড়ি বছর ধরে এক কুৎসিত নাট-বল্টু লাগানো ধাতব টাওয়ারের কালো ছায়া দেখতে চলেছি – এ যেন এক সুন্দর ক্যানভাসকে জেনেশুনে কালিমালিপ্ত করা ... ...
আমাকে যদি কেউ চট করে জিজ্ঞেস কর, ভাই বেড়াতে বেড়িয়ে তোমার অনুভূত এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে ওভার-হাইপড জিনিস কি? খুব বেশী না ভেবে যে জিনিসটির কথা আমার মনে সর্বপ্রথম চলে আসবে তা হল – ভেনিসে গন্ডোলা চেপে ঘোরা!বেশ কিছু ইতালি বা মলটা দেশের বন্ধু বান্ধব থাকার জন্য গন্ডোলা নিয়ে আজকের দিনের ওভার-হাইপড ব্যাপারটা আগেই শুনেছিলাম। কিন্তু যা হয় আর কি – জেনেশুনেই বিষ পান করতে হয় আমাদের সবাইকেই মাঝে মাঝে। বিশেষ করে যেখানে এই গন্ডোলার সাথে কিভাবে যেন রোমান্টিকতা জুড়ে যায় – তার পর আর কিভাবে এ জিনিস চাপা থেকে নিজেকে এড়াতে পারেন যদি কেবল আপনারা দুটি-তে ঘুরতে যান! গন্ডোলা যার রোমান্টিক চাপে পড়ে চেপেছিলেন, নৌকাবিহার শেষে সে আপনাকে জিজ্ঞেস করবে – “কি দারুণ, না?” আপনি বুদ্ধিমান হলে শুধু “হুঁ” বলে চুপ করে যাবেন - ... ...
কলম্বাস বাবু শুধু ভারতকে নিয়েই কনফিউশনে ভোগেন নি – ক্যারাবিয়ান দ্বীপে পৌঁছেও বেশ ছড়িয়ে ছিলেন, ছড়ানোর মধ্যে এক অন্যতম উদাহরণ হছে চিলি-এর সাথে পেপার-কে ঘুলিয়ে ফেলা! ক্যারাবিয়ান দ্বীপ সান সালভাদরে (আজকের দিনের ওয়াটলিং দ্বীপ) পৌঁছে ঝাল ঝাল খাবার খেয়ে তিনি মনস্থির করে নিলেন যে যা থেকে ঝালের স্বাদ আসচে তাহাই ব্ল্যাক পেপার! কালো মরিচের স্বপ্নে তাঁর মন আচ্ছন্ন ছিল তখনো! যতক্ষণে তিনি বুঝতে পারলেন যে সেই ঝাল কালো মরিচ থেকে নয় বরং ছোট কুঁড়ি জাতীয় ফল এর জন্য এর জন্য দায়ী – ততক্ষণে বড় দেরী হয়ে গেছে। স্প্যানিশরা এই ছোট কুঁড়ি ফলকে পেপার বলে ডাকতে শুরু করে দেয় – সেই থেকে নামটা প্রচলন হয়ে গেছে! ... ...
এটা আমরা সবাই জানি বা ইতিহাস পড়ে দেখেছি যে প্রাচীন কালে সাম্রাজ্য, রাজত্ব, রাজা ইত্যাদি অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ জিনিসগুলো হাত ধরাধরি করে চলত ধর্মের সাথে – তা সে প্রাচীন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টধর্ম বা পরের দিকে ইসলাম – যাই হোক না কেন। ভারতের বাইরে হিন্দু মন্দিরের সবচেয়ে প্রাচীন উপস্থিতি টের পাওয়া যায় আজকের দিনের ভিয়েতনামে, খৃষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত – সূর্্য দেবতা, শিব এবং বিষ্ণুকে নিবেদিত। আমি উপরে যে ‘বৃহত্তর ভারত’ এর উল্লেখ করেছি তা একসময় বিস্তৃত ছিল আজকের দিনের মায়নামার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কাম্বোডিয়া, লাওস এবং ভিয়েতনাম জুড়ে। সংস্কৃতে লেখা পাথরে খোদাই পাওয়া গেছে ভিয়েতনামে খৃষ্টীয় দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শতাব্দীতে ভিয়েতনামে বা চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীতে কাম্বোডিয়াতে। সেই সময় থেকে শুরু হয়ে দেখা গেছে প্রায় ১৪শ শাতাব্দী অবধি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সব দেশে স্থানীয় প্রভাব যুক্ত হিন্দু মন্দির তৈরী হয়েছে। অনেকসময় হিন্দু এবং বৌদ্ধধর্ম পুরোপুরি আলাদা না থেকে জন্ম দিয়েছে এক মিশ্র ঐতিহ্য এই দেশগুলিতে এবং মন্দিরে এই সব ছাপ রয়ে গেছে। পরের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মূলত বৌদ্ধ ধর্ম থেকে যায় কেবল মাত্র মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশীয়া ছাড়া – এই দুই দেশে ইসলাম ধর্মে এসে বৌদ্ধধর্মকে প্রতিস্থাপন করেছিল। ... ...
ধানজমির মাঝে এক্সোটিক রেষ্টুরান্ট! জীবনে ভাবিনি এ জিনিসও দেখতে হবে! যাঁরা বালি গেছেন তাঁরা হয়ত জানবেন আরো নানাবিধ খাবারের মধ্যে বাইরের লোকেদের কাছে বালির এক অন্যতম জনপ্রিয় ডিসের নাম ‘ক্রিসপি ডাক’। মানে ঠিক হাঁসের মাংস ডিপ ফ্রায়েড বললে ওই ডিসটিকে ঠিক ঠাক সম্মান দেওয়া হবে না, কিন্তু অনেকটা তাই। এমনিতে বালির প্রায় সব রেষ্টুরান্টেই এই ক্রিসপি ডাক সার্ভ করা হয় – তবে আমি বলব যদি বালি যান তাহলে উবুদের দিকে বিস্তৃর্ণ ধানক্ষেতের মধ্যে বেশ কিছু খুব সুন্দর সুন্দর রেষ্টুরান্ট আছে, সেখানেই খেতে। এগুলো মূলত টুরিষ্টের কথা ভেবেই বানানো – কিন্তু একটা অভিজ্ঞতা। অনেক রেষ্টুরান্ট আছে, কিন্তু সব থেকে বিখ্যাত বা জনপ্রিয় মনে হয় ‘বেবেক টেপি সাওয়া’ (Bebek Tepi Sawah) নামক রেষ্টুরান্টটি। ... ...
আউটডোর জিনিসপত্র – সে খেলাধূলাই হোক বা ট্রেকিং বা হাইকিং সবকিছুতেই বিশাল ইন্টারেষ্ট ছিল এককালে। তবে আজকাল সেই ইন্টারেষ্ট কিছুটা হলেও কমে এসেছে, বিশেষ করে যদি একসাথে ডরমিটারি-তে থাকতে হয় যেখানে খানিক দূরেই জুতো-জামাকাপড়-ব্যাগ রাখা থাকবে। এর কারণটা বিশেষ কিছু নয় – জুতো এবং মোজার গন্ধ। তা সে নিজের জুতো-মোজাই হোক বা অন্যের। নিজেরটা যদিও নাক চেপে সহ্য করে নেওয়া যায়, কিন্তু অপরের জুতো-মোজার গন্ধে একেবারে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে। ... ...
যদি গুগুল সার্চ করেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ – তো মনে হয় না প্রথম দশে আপনি মলটা দেশের নাম পাবেন – সেখানে দেখবেন ফিনল্যান্ড এবং অন্যান্য স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলিরই আধিক্য। কিন্তু এই সুখীর সংজ্ঞার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ বা আমরা যাকে বলি ‘আনন্দে’ বেঁচে থাকা তা ঘুলিয়ে ফেললে চলবে না। তেমন লিষ্টী বানাতে হলে প্রথম বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে মলটার নাম একেবারে প্রথম দিকে থাকবে। বিশাল আনন্দে এবং টেনশন ফ্রী জীবন কি ভাবে কাটাতে হয় এদের কাছ থেকে শেখা যেতে পারে। ... ...
সমন্বিত ইতালির দ্বিতীয় রাজা প্রথম উমবার্তো এবং তাঁর স্ত্রী রাণী মার্গারিটা নেপলস্ ভ্রমণে আসবেন বলে ঠিক হল ১৮৮৯ সালে। চারিদিকে হই হই লেগে গেল – থাকা ইত্যাদি তো ঠিক আছে, কিন্তু রাণী এখানে এসে খাবেন কি! তো ডাক গেল তখনকার নেপলসের বিখ্যাত পিৎজা বানানো শেফের কাছে – পিজারিয়া ব্র্যান্ডির রাফায়েলে এস্পোসিতো। তাঁকে বলা হল তুমি বাপু নানা রকম পিৎজা বানিয়ে রাজা রাণীকে পরিবেশন কর। আর গতানুগতিক জিনিস না বানিয়ে, মাথা ঘামিয়ে নতুন কিছু বানাও। রাফায়েলে এস্পোসিতো বানালেন বেশ কিছু রকমের পিৎজা - তিনি একটা পিৎজা বানালেন লার্ড, কাচ্চিয়াকাভাল্লো, এবং বেসিল দিয়ে, একটা বানালেন ছোট ছোট মাছ দিয়ে, আর একটা বানালেন ট্যামাটো, মোজারেল্লা এবং বেসিল সহযোগে। এই শেষের ডিসটি তখনো নেপলস্-এর বাজারে পরিচিত ছিল ‘পিৎজা আলা মোজারেল্লা’ নামে। এবং এই পিৎজা খেয়েই রাণী কুপোকাত – বিশাল ভালোবেসে ফেলে ডিক্লেয়ার করে দিলেন যে এটাই তাঁর সবথেকে প্রিয় পিৎজা। ... ...
বেশী বেড়ালেও বিপদ, আবার কম বেড়ালেও। অন্তত ভ্রমণ সংক্রান্ত কিছু মিথ বা অতিকথন বা ভ্রান্ত ধারণা গড়ে তুলতে। বেশী বেড়ানো মানেই বেশী জানা নয়, আর পুরোপুরি ঠিক জানা তো নয়ই। কিন্তু হয় কি বেশী বেড়ালে আমাদের মধ্যে অনেকসময় একটা ভ্রান্ত ধারনা চেপে বসে যে আমি যেটা জানি বা যার মুখোমুখি হয়েছি, সেটাই চরম সত্যি! এর বাইরে আর কিছুই হতে পারে না। আমার অভিজ্ঞতার বাইরেও যে অন্য কেউ অন্য ভাবে সমগ্র জিনিসটা দেখতে বা অনুভব করতে পারে, সেটা মানতেই চাই না আমরা – এতটাই সঙ্কীর্ণমনা এবং অধৈর্য্য হয়ে উঠি অনেক সময়। আর এই ব্যাপারগুলোই বেশীর ভাগ সময় জন্ম দেয় ‘মিথ’ এবং ভ্রান্ত ধরণার। এর কিছু কিছু ব্যাপার হয়ত ক্ষেত্র বিশেষে সত্যি, কিন্তু সেগুলোই একমাত্র সত্যি নয় বা চিরন্তন সত্য নয়। তেমন কিছু বিষয় নিয়েই ভাবলাম আজকে কিছু লিখি ... ...