এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হঠাৎ সুনামি 

    Rashmita Das লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১৪২ বার পঠিত
  • পর্ব ২

    বেশ। তুমি তাহলে হাত মুখ ধুয়ে এসো আমি বিলটা পে করে আসি। তিয়াসা লক্ষী মেয়ের মতো ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে রাতুলের অঙ্গুলি নির্দেশ অনুসরণ করে মুখ ধোওয়ার বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল। রাতুল খাবার বিল পে করে নিয়ে তিয়াসাকে নিতে এল ভিতরে। ভিতরে এসে তার একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ার মতো অবস্হা হল। সে দেখল, হাতমুখ ধুতে গিয়ে মেয়েটা কলের জলে পুরো স্নান করে গিয়েছে। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে তিয়াসাকে বলল, এসো। আমার হাত ধরো।

    জনবহুল রাস্তার ধারে ভীড় ও হকারে ঠাসা ফুটপাতের মাঝ দিয়ে একজন অচেনা পুরুষের হাত ধরে এক জড়বুদ্ধি অবোধ নারী অদ্ভুত এক বিশ্বাস এবং অজানা এক ভরসার স্নিগ্ধ আশ্বাসে ধীর পায়ে চলতে লাগল অনিশ্চিত কোনো গন্তব্যের অভিমুখে।

    শিশুকালে পিতৃবিয়োগ হওয়ার পরে আপন যৌথ পরিবার হতে ক্রমাগত অপমানিত আর অবশেষে বিতাড়িত হওয়ার পরে বাবার সঞ্চয় করে রাখা স্বল্প পুঁজি হাতে নিয়ে প্রায় এক কাপড়েই সদ্য বিধবা মায়ের সাথে সাত কি আট বছর বয়সে প্রথম অচেনা শহর কলকাতায় পা রেখেছিল ছোট্ট রাতুল। তারপর চরম দারিদ্র্য, জীবনযুদ্ধের চড়াই উতরাই রাস্তায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতে অবশেষে এই অচেনা শহরের বুকে গড়ে নেয় তার ছোট্ট একটি স্হায়ী আস্তানা। রাতুল চাকরি পাওয়ার মাস কয়েকের মধ্যেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরলোকে পাড়ি দেন তার মা। তারপর থেকেই কার্যত এই এত বড় পৃথিবীর বুকে সে যন্ত্রের মতো বেঁচে আছে। একা। তার দু কামরা বিশিষ্ট একার এই সংসারটাতে জীবনের সমস্ত অর্থ যেন ভাষাহীন... দিশাহীন। ঘরদোরের প্রতিটি দিক, প্রতিটি কোণা যেন সেই দিকভ্রষ্টতার দিশাহীনতা তীব্রভাবে প্রতিফলিত করে চলেছে। ঘরখানার দশা এমন, যে সে ঘরে আদৌ মানুষ থাকে নাকি গোরু ছাগল থাকে প্রথমটা সেইটাই ঠাহর করা মুশকিল হবে। সাত পাঁচ কিছুমাত্র চিন্তাভাবনা না করেই সে ঘরে আজ দিনশেষে রাতুল সাথে করে নিয়ে এসেছে এক নতুন অতিথিকে। বারান্দার গেটের তালা খুলে রাতুল দরজার লক খুলে ভিতরে ঢুকতে যাবে, এই সময়ে সে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, নবাগত অতিথিটি এখনো একবুক সংকোচ নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। "ভিতরে এসো... লজ্জা কি!" - বলে রাতুল বাইরে এসে তিয়াসার হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে প্রায় টেনে নিয়ে এল ঘরের ভিতরে। ঘরের ভিতরে পা দিয়ে সে প্রথম উপলব্ধি করল, এই ঘর কোনো মানুষের বাসযোগ্য নয়। বিছানার উপর সপ্তাহখানেকের উপর হতে জমিয়ে আসা অগোছালো জামাকাপড়ের ডাঁই এতটাই উঁচু একখানা ঢিবির রূপ নিয়ে নিয়েছে যে বেশ কদিন তো রাতুল অফিস থেকে ফিরে খাওয়া সেরে মেঝেতেই মাদুর পেতে ঘুমের কাজ সারছে। চেয়ারের উপর অফিসের ফাইলপত্রের ডাঁই আর সারা টেবিল জুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেন হরেকমালের দোকান দিয়েছে। বাসনপত্র রান্নাঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে বসা কাম শোওয়ার একমাত্র এই ঘরটিতে তার দখলদারি ছড়িয়েছে। মা গত হওয়ার পর থেকে কোনোদিন ঘরখানার দিকে রাতুল ঠিকভাবে তাকায়নি। আজ হঠাৎ এমন এক ঘটনাচক্রে সে এক নবাগতা অতিথির হাত ধরে তার নিজের এই ঘরখানায় প্রবেশ করেই হঠাৎ যেন তার সবকিছু অসহ্য ঠেকল। এতদিন বাদে সে যখন প্রথম উপলব্ধি করল তার এই ঘরখানা আসলেই মানুষের বাস করার অযোগ্য, সে তখন মনে মনে নিজেকেই নিজে গাল পাড়তে লাগল। তারপর চেয়ার টেবিল ছোট আলমারী আর খাটখানার মাঝে একখানা মাদুর পেতে দিয়ে তিয়াসাকে বলল, তুুমি এইখানে একটু বসো, আমি ততক্ষণ ঘরটা একটু গুছিয়ে দিই। তিয়াসা তার কথামতো মাদুরে গিয়ে বসে ঘরদোরের ছিরিছাঁদ ফেরাতে ব্যস্তসমস্ত রাতুলের দিকে এক অদ্ভুত মায়াময় দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে। বছরের পর বছর ধরে যে কাজগুলির কোনো প্রয়োজনীয়তাই রাতুল অনুভব করেনি আজ হঠাৎ কোন এক অজ্ঞাত তাগিদে প্রায় এক লহমায় জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখা থেকে শুরু করে ঘরের প্রতিটি জিনিসকে তার সঠিক জায়গাতে গুছিয়ে রেখে ঘর ঝাঁটপোছ করে ঘরখানার প্রায় ভোল পালটে ফেলল। তারপর তিয়াসার জন্য সুন্দর করে মশারি খাটিয়ে বিছানা করে দিল। কিন্তু মুশকিল হল, তিয়াসার পরনের পোশাকখানি নিয়ে। এমন দামী আর শৌখিন পোশাক পরে তো আর বিছানায় শোওয়া যায় না... আর রাতুলের ঘরে তো পোশাক বলতে তার নিজের শার্ট প্যান্ট আর গেঞ্জি পাজামা ছাড়া আর কিছুই নেই। মায়ের কিছু শাড়ি আছে অবশ্য, কিন্তু এই জড়বুদ্ধি হাবা মেয়েটির গায়ে শাড়ি যদি কোনোভাবে জড়িয়েও দেওয়া যায়, সেই শাড়িতে সে নিজেই জড়িয়ে টরিয়ে মেঝেয় পড়ে হাড়গোড় ভাঙবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কি করা যায়... উপায় না দেখে রাতুল নিজের ঘরে পরার একটা ট্রাউজার আর একটা টি শার্ট নিয়ে এল তিয়াসার সামনে। সে তিয়াসার সামনে গিয়ে সন্তর্পণে দাঁড়াল। সে লক্ষ্য করল, তিয়াসা দেওয়ালের একটা কোণ আঁকড়ে গুটিসুটি হয়ে একেবারে সিঁটিয়ে বসে আছে। রাতুল ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আস্তে করে ওর চিবুকটা তুলে ধরল। কয়েক মূহুর্তের জন্য সে তিয়াসার কাজল টানা দীঘল চোখদুটির নিষ্পাপ আর সরল চাহনির নিটোল মায়ায় কেমন যেন হারিয়ে গেল। রাস্তার পাশে হঠাৎ সজোরে বারোটার ঘন্টা বেজে উঠতেই তার সম্বিৎ ফিরল। হাতে ধরা টি শার্ট আর ট্রাউজার টা তিয়াসার সামনে এগিয়ে ধরে রাতুল বলল, এই নাও। এখনকার মতো এই জামা দিয়ে কাজ চালিয়ে নাও। কাল সকালে তোমার জন্য নতুন জামা কিনে আনব কেমন!

    রাতুলের হাতে ধরা টি শার্ট আর ট্রাউজার খানি খপ্ করে ধরে ফেলল তিয়াসা। তারপর সারাদিন ধরে গায়ে চেপে থাকা এই দামী পোশাকের ধড়াচূড়োখানা অপটু হাতে টান মেরে খুলে ফেলতে গেল সে। রাতুল কোনোমতে তাকে আটকাল। তারপর বলল, এখানে নয়। তুমি বাথরুমে যাও। ফ্রেশ হও। আমি ততক্ষণে খাওয়াটা শেষ করে নিই কেমন!রাতুলের কথা শুনে সে বাধ্য মেয়ের মতো তার অঙ্গুলি নির্দেশ অনুসরণ করে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। রাতুল রান্নাঘরের দিকে গেল নিজের জন্য কিছু খাবারের বন্দোবস্ত করতে। সন্ধ্যের পরে অন্য সব দিনে সে অফিস থেকে ফিরে এসে ফ্রিজ থেকে সকালের কুটে রাখা সব্জি আর ভেজে রাখা মাছ দিয়ে ভাতের সাথে একটা ঝোল বা তরকারি যা হোক কিছু চাপিয়ে দেয়। সেটা হতেও খুব বেশি সময় লাগে না। কিন্তু আজ তো সে একা নয়, ফিরেছে দোকা হয়ে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন