এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  স্মৃতিচারণ   স্মৃতিকথা

  • এল ডোরাডো

    যোষিতা লেখকের গ্রাহক হোন
    স্মৃতিচারণ | স্মৃতিকথা | ৩০ নভেম্বর ২০২৩ | ৮৯১১ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৬ জন)
  • এখানে লিখব সোনার দেশ সুইটজারল্যান্ডের নানান অভিজ্ঞতা ও মানুষের কথা।
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • :|: | 174.251.161.84 | ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৯:৩০741791
  • বাচ্চার পাসপোর্টে বাবা আর মায়ের নাম চাইছে। পাসপোর্ট বাচ্চার হচ্ছে আর তার একজন জন্মদাতা পিতাও আছেন। সেখানে ওই নাম দুটো লেখায় আপত্তিটা বুঝতে পারছিনা। বাচ্চার মায়ের যদি বিয়ে না হয়ে থাকে সেখানে তিনি স্বামীর নামের জায়গাটা ফাঁকা রাখতেই পারেন। কিন্তু এটা তো মায়ের নয় বাচ্চার পাসপোর্ট। তাহলে সমস্যাটা কী সেটা আসলেই বুঝতে পারছি না। শিশুটির একজন জন্মদাতা পিতা আছেন সেটা তো ঘটনা!  
  • যোষিতা | ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ০৯:৫৮741792
  • নন্দাই পুরো সাহেব। শুধু সাহেব নয়, জাতে জার্মান। আমি তখন কে সুইস, কে জার্মান, কে অস্ট্রিয়ান, হাঙ্গেরিয়ান, চেক, পোলিশ, স্লোভাক, ডাচ, চেহারা দেখে তো বুঝিই না, উচ্চারণ শুনেও না। সামনের মাসে জার্মান ক্লাসে ভর্তি হব। টাকা এসে গেছে হাতে, এখন আমায় পায় কে?
    নন্দাই এক ঝলকেই আমায় চিনতে পেরে রাস্তা ক্রস করে এসে হাত মেলালো হাতে। সামনের মাসেই তাঁর পঁয়ষট্টি বছর হচ্ছে, রিটায়ার করবে, একমাত্র পুত্রও সবে ঢুকেছে এই ব্যাংকে। এসব কথা বলতে বলতে ড্রাইভ করে নিয়ে চললেন বাড়িতে।
    মস্ত বাড়ি, প্রথমে দেখে দোতলা মনে হচ্ছিল। অন্ততঃ একশো বছরের পুরোন তো বটেই। তিনটে গ্যারেজ। বাড়িতে ঢুকতেই ননদের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি রান্নায় ব্যস্ত। বাড়িতে আরও অতিথি রয়েছে। বাড়ির পেছনে মাঠ ও বাগান। একটা বড়োসড়ো সুইমিং পুল। দিনের আলো একটু পরে পড়ে যাবে। মাঠের একধারে বড়ো বড়ো টেবিল জোড়া দিয়ে লম্বা করে খাবার টেবিল বানানো হয়েছে। অতিথিরা সব ওয়াইন খাচ্ছে। সব সাহেব মেম। জার্মানে কথা বলছে সব। ওদের বড় দুই মেয়ে অন্য দেশে থাকে, জার্মানী ও হংকং এ। ছোট মেয়ে ও পুত্র অনুপস্থিত। ননদ নন্দাইয়ের সমবয়স্ক বন্ধুদের মধ্যে আমাকে আলাপ করানো হলো। স্যালাদ পরিবেশিত হয়েছে। ঝপ করে ঠাণ্ডা পড়ে যাবে এরপরে। প্রত্যেকের আমাকে নিয়ে কৌতুহল। এই মেয়েটা কে? ইন্ডিয়া থেকে একা একা চলে এসেছে চাকরি করবে বলে? ওর বর এদের কাজিন? বর আসেনি কেন? কবে আসবে বর? কী কাজ করে মেয়েটা?
    ননদ আমার পাসপোর্ট ও ডকুমেন্ট দেখতে চাইল। পাসপোর্ট নিয়ে ঘুরি না। পারমিটের কাগজটা সঙ্গে রাখি। বের করে দেখালাম। বিকেলের মরা আলোয় সে ভালো করে পড়তে পারছে না, তবু চেষ্টা করছে। নন্দাই তার হাত থেকে টেনে নেয় কাগজ। আমায় ফিরিয়ে দিয়ে ননদকে বলে, ঢের হয়েছে, খাবার দিয়ে দাও।
    নন্দাই আমাকে বলে, জানো আমিও একসময়ে রাশিয়ায় থেকেছি। ব্যাংকের কাজে।
    দুয়েকটা শব্দও বলে সে রাশিয়ানে।
    তারপর তার কাজ নিয়ে কিছু গল্প করে। জানতে পারি, টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ইউগোস্লাভিয়ার বিপুল ঋণ কীভাবে শোধ বা মকুব হবে সেসবের সিদ্ধান্ত নিতে নিতেই এদের দিন কাটছে।
  • | ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:০০741793
  • জার্মান শেখার ক্লাসেই গোল্ডির সাথে আলাপ তো। অপেক্ষায়... 
  • যোষিতা | ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ১৩:০৬741796
  • খাওয়া দাওয়া গালগল্প হতে হতে অনেক রাত। প্রায় এগারোটা। অতিথিরা সব চলে গেলে ননদিনী আমায় নিয়ে বাড়ির বৈঠকখানায় বসালেন। সে ঘরে প্রকাণ্ড গ্র্যান্ড পিয়ানো ছাড়াও রয়েছে একটা দাঁড়ানো পিয়ানো, চেলো, বেহালা ইস্তক নানান বাদ্যযন্ত্র। উনি এখানেই মিউজিকের ক্লাস নেন। বড়ো মেয়ে ফ্লুট বাজিয়ে, যে হংকংএ থাকে, মিলেনিয়ামের রাতে গোয়ায় গিয়েছিল বিয়ে করতে। মেঝমেয়ে চেলো এবং বেহালা বাজিয়ে, বরের সঙ্গে জার্মানীতে থাকে। দুজনেই পেশাদার বাজিয়ে। পুত্রকে গানবাজনার লাইন থেকে সযত্নে দূরে সরিয়ে কমার্স পড়ানো হয়েছে এবং সে বাপের পেশায় ঢুকেছে। ছোটমেয়ের বয়স সবে ষোলো, ইস্কুলে শেষ বছর, সেও গানবাজনার পেশায় যাবে বলে আঁচ করা যাচ্ছে। 
    ননদিনী এবার আমার সঙ্গে খুঁটিয়ে আলাপ শুরু করলেন। নন্দাই গুডনাইট জানিয়ে ঘুমোতে চলে গেলেন। ওরে বাবা প্রশ্ন আর শেষ হয় না। আমি চোখ খুলে রাখতে পারছি না। আমার সমস্ত খবর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। কাল সকালে ফিরব জুরিখ, সেরকমই কথা।
    এমন সময় ছেলে ফিরল বাড়ি বান্ধবীকে নিয়ে। তার একুশ বছরের জন্মদিন গেছে সবে। জন্মদিনের উপহার পেয়েছে বাবার কাছ থেকে লাল রঙের স্পোর্টস কার। সেই প্রথম শুনলাম, গাড়ির নাম ফেরারি। সেই গাড়িতেই ঘুরতে বেরিয়েছিল।
    ওরা দুজনে চলে গেল ঘুমোতে। শেষে প্রায় রাত তিনটে নাগাদ আমাকে ঘুমোনোর জন্য নিয়ে চললেন তিনি। বাইরে থেকে দোতলা মনে হচ্ছিল, কিন্তু তিনতলাও আছে। সেই তিনতলায় দুটি হলঘর, একটায় বিলিয়ার্ড খেলার ব্যবস্থা, অন্যটা গেস্টরুম। আমি বিছানায় পড়ামাত্র ঘুম।
    পরদিন সকালে ননদি এসে জাগালেন। জলদি চলো। ছোটো মেয়ে ইস্কুলের এক্সকারশানে ফ্রান্সে যাবে। আমার আবার আজ বাজার করার দিন। আমি হুড়মুড়িয়ে উঠলাম। চা খেয়ে আমায় নিয়ে গাড়ি চালিয়ে চললেন ননদি ইস্টিশানে পৌঁছে দিতে। পথে যেতেই শুনলাম তিনি বাজার করেন কখনো ফ্রান্সে তো কখনো জার্মানিতে গিয়ে। দুটো দেশই বাসেল শহরের সীমান্তে। শুনে আমি হাঁ! বলে কীরে? ফরেনে গিয়ে চাল ডাল শাক সবজি মাছ মাংস কেনে! কেন? হাতের কাছেই তো কত্ত দোকান রয়েছে। মহিলাটা কি ছিটিয়াল, না কী?
     
  • kk | 2607:fb91:87a:52eb:c07b:363f:5bc6:56c8 | ০২ জানুয়ারি ২০২৪ ২০:৩৯741799
  • খুব ভালো লাগছে পড়তে।
  • যোষিতা | ০৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:৫৯741814
  • সেদিন জুরিখে ফিরেই পাড়ার সুইসকমের দোকান থেকে কিনলাম এরিকসনের লেটেস্ট ডিজাইনের মোবাইল ফোন। জীবনে প্রথম হাতে এলো মোবাইল ফোন। কোলকাতায় কত লোকের হাতে দেখেছি মোবাইল, কোনওদিনও ছুঁয়ে দেখার স্কোপ হয় নি। এই ফোনটা সেসবের চেয়ে অনেক আধুনিক ডিজাইনের। ফোন রিসিভ করতে কোনও বোতাম টিপতে হয় না, ফ্ল্যাপটা টেনে খুললেই কানেকটেড, অসম্ভব কিউট দেখতে। সেলসম্যান যত্ন করে বোঝাচ্ছে আমায় এই যন্ত্রপাতির নিয়মকানুন। সঙ্গে কানেকশন নেওয়া হলো। ফোনের বিল মাসে পঁচিশ ফ্রাংক অবধি অফিসই দেবে। এছাড়া অফিসে ল্যাণ্ড লাইন তো আছেই। এমন স্বপ্নের মতো অফিস আমি কোনওদিনও দেখি নি। একটা কাফেটেরিয়া আছে রিসেপশন পেরিয়েই। সেখানে কোনও টাকাপয়সার লেনদেন নেই। হরেক রকমের চা, গোটা বিশ রকমের কফি, কোল্ড ডিংক্স নানান রকমের, জুস, টাটকা ফল, ইয়োগুর্ট, মিলশেক, দুধ, স্যান্ডুইচ, ফ্রুট স্যালাদ, থরে থরে সাজানো। সব ফ্রি। আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারি নি। কিন্তু সত্যিই তাই। সাধে কি ট্যাঁক খালি অবস্থায় মাসটা কাটিয়েছি? আরো একটা ব্যাপার আছে অফিস বিল্ডিং এর বাইরে। একটা ছোট্ট চালাঘর। সেখানে দুটো বড়ো বড়ো ফ্রিজারে ভর্তি আইসক্রিম। আমাদের জন্য। যত পারো খাও, দাম টামের ব্যাপার নেই।
    আমার কোলিগ হেরমানের বৌ নাকি এসব দেখে বলেছিল, "লুক্সুস"! সত্যিই এমন লাক্সারি এর আগে কখনও দেখি নি। এখন মাসে শেষে হবে আমাদের ইন্ডাক্শন ওয়ার্কশপ। দুরাত তিনদিন আমরা থাকব বাইরে। একত্রিশে রাতে ফিরিয়ে দেবে শহরে। যদি কেউ বাড়ি ফিরতে না পারে, সেজন্য সেরাতে ফাইভস্টার হোটেলের ব্যবস্থা আমাদের জন্য। ঐ ইন্ডাকশনের সময়েই আলাপ হবে গত দুতিন মাস মিলিয়ে নতুন যারা জয়েন করেছে তাদের সঙ্গে। আমার মাঝে মধ্যে সন্দেহ হয়, আমি কি সত্যিই জেগে রয়েছি? নাকি স্বপ্ন দেখছি?
    ওহো, স্বপ্ন বলতে মনে পড়লো, আমি দুটো অদ্ভূত স্বপ্ন দেখছি পালা করে করে। একটা স্বপ্ন ঠিকঠাক, অন্যটা অসম্ভব কনফিউজিং। হয়ত দুঃস্বপ্ন ক্যাটেগোরির।
  • Kuntala | ০৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১৮:১৫741819
  • আরো হোক
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ০৪ জানুয়ারি ২০২৪ ০০:২২741827
  • আজকে একসাথে সব জমানো পর্ব পড়ে নিলাম।heart
     
    সে-দি, তোমার লেখা যেমন পাওয়ার কথা তেমনই পাচ্ছি, নানান অনভূতির ঢেউ আসছে-যাচ্ছে, এর মধ্যে একটা জায়গায় এসে হা-হা করে হেসে উঠেছি। কোথায় জানো? 
    "কিন্তু  সব প্রশ্ন সব জায়গায় করতে নেই।" laugh
     
    কোনদিন কি তোমার সাথে সামনা-সামনি বসে আড্ডা হবে! হবে না, জানি।sad
  • যোষিতা | ০৪ জানুয়ারি ২০২৪ ০১:৪০741829
  • সুটকেস তখনো আসেনি। সারাক্ষণ বসবার ঘরে টেলিফোনের কাছে চামড়ার সোফার ওপর শুয়ে থাকি। কখন যেন ঘুমিয়েও পড়ি। সেই সময় স্বপ্ন দেখলাম, সন্ধে হয়ে গেছে, একটা স্টেশনে থেমেছে ট্রেন। ট্রেন আর যাবে না, ওখানেই শেষ। কামরার আলো নিভে গেছে। আমি চেন থেকে নামতে গিয়ে দেখি জমি অনেক নীচে। প্ল্যাটফর্ম ওখানে শেষ হয়ে গেছে। ঝাঁপিয়ে নামলাম। নীচে নুড়ি পাথর। আমার পায়ে রবারের চটি। জোরে হাঁটে পারছি না। ট্রেন চলতে শুরু করেছে মনে হয় লোকোশেডের দিকে, ট্রেনের কামরায় আমার মেয়ে রয়ে গেছে, সে নামতে পারে নি। আমি দৌড়তে চাই, রবারের চটি জড়িয়ে যাচ্ছে পাথরের নুড়িতে। আবছা অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি চার্চের সিলুয়েট। আমি জানি, মানে বুঝতে পারছি জায়গাটা সুইটজারল্যান্ড। এরকম সময়েই ঘুমটা ভেঙে গেল।
    কদিন পরপরই এই স্বপ্ন আরও কবার দেখেছি। দ্বিতীয় তৃতীয়বারে রোখ চেপে যায় দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে নামানোর। পারি না। এই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? ঐ জায়গাটাই বা কোথায়? ওরকম আবছা ছায়ন্ধকারে ট্রেন আমায় নামিয়ে দিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে চলে যায় কেন প্রত্যেকবার?
    অন্য স্বপ্নটা একটা নদীর কাছে। এটাও রাতের পরিবেশ। জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনের মত পরিবেশ। নদীর ওপর চওড়া মস্ত ব্রীজ। শুধু হাঁটার ব্রীজ। তার ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা অনেকে। আশেপাশে ঝাপসা অন্ধকার পাহাড়। অনেকে মিলে হাঁটলেও বাকিদের আমি চিনি কিনা জানি না। তারা অস্পষ্ট।
    এই দুটো স্বপ্নের কথা আমার মনে থাকবে সারাজীবন।
    এরকম আরও স্বপ্ন আসবে আমার ভবিষ্যতে।
    যাইহোক সকলে নতুনরা মিলে ট্রেনের ফার্স্টক্লাসে চললাম জুরিখের পাশের জেলায়। এই জেলার নাম শুইৎস্। জায়গাটার নাম প্ফেফিকন। মফঃস্বল। সেখানে চমৎকার এক হোটেলে আমরা থাকব আজ রাতে। প্রত্যেককে একটা করে ঘর দিয়েছে। বিলাসে মাখামাখি অবস্থা। কাল থেকে সেই ওয়ার্কশপ। খেয়ে দেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমোব ভাবছিলাম, কিন্তু অন্যরা দরজায় এসে ডাকে। 
    এত সকাল সকাল ঘুম কেন? নীচে চল।
    নীচে বসেছে বিশাল মদের আসর। কিছু মদ ফ্রি। তবে সব কিছু নয়। 
    এরিক বির্খলার বলে একটা ছেলে আমার নতুন ককটেল খাওয়ানোর জন্য পেড়াপিড়ি করতে থাকে।
    সকলেই নিজে নিজে সেই বিশেষ ককটেল কেনে। এক এক করে সেই আগুন ধরানো ককটেল নিয়ে সব এগিয়ে আসছে, এরিক আমার দন্য অমন আগুন জ্বালানো মদ নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে খাও। জ্বলন্ত মদের ভেতর স্ট্র ঢোকানো, টেনে টেনে খেতে হবে। আমি ভয় পেয়ে সেই পাত্র মেঝেয় নামিয়ে দিই। জ্বলে জ্বলে মদ শেষ হয় কিনা জানি না। আগুন নিভে যায়। এরিক বিমর্ষ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
  • যোষিতা | ০৪ জানুয়ারি ২০২৪ ০৩:০০741830
  • আমার খুবই অপরাধী লাগছিল নিজেকে। আসলে আমি নিজেই এদের সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারছি না। আমার অজস্র ব্যাগেজ, যা আমাকে বয়ে বেড়াতে হয় সর্বক্ষণ, সেগুলোর ভারে এতটাই নুয়ে রয়েছি যে এটাই আমার ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের আকার নিয়েছে। 
    যেসব জিনিস নিয়ে এই বড়লোক দেশের মানুষদের চিন্তাই করতে হয় না, সেগুলো আমার প্রাত্যহিক জীবনে বাধা সৃষ্টি করে করে এমন করে তুলেছে, যে সহজ রাস্তায় হাঁটতে দিলেও আমার মনে হবে রবারের চটি পরে নুড়িভরা এবড়ো খেবড়ো পথে হাঁটছি। ওরা সব গ্লাস হাতে গল্প করছে, আমি হাসি মুখে কমিউনিফেকিং করছি। 
    স্বাস্থ্য, শিক্ষার অধিকার, জন্ম পরিচয়, শিশুর অধিকার, কাজের অধিকার, এরকম একগাদা ব্যাপার নিয়ে লড়াই করে করে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। এদের কাছে এই সমস্যাগুলো একজিস্টই করে না। কত সময়, কত পরিশ্রম এদের বেঁচে গেছে। কত দুশ্চিন্তা এদের অহেতুক চেপে ধরে নি। 
    কে কোন পোশাক পরবে, কে কার সঙ্গে মিশবে, কার বিয়ে হয়েছে বা হয় নি, কে কতটা ভার্জিন, এসব ফালতু ব্যাগেজ এরা অনেক আগেই ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। আমি ফেলতে পারছি না। দুই সংস্কৃতির বৈপরীত্যের কাঁচির মধ্যে পড়ে গেছি। সংসারটাকে এখানে নিয়ে আনার কাজ সহজ নয়। যদি বেটাছেলে হতাম, হ্যান্ডব্যাগেজের মত বৌ বাচ্চা নিয়ে হুট করে চলে আসতে পারতাম। যতই মুখে সমান বলিনা কেন, আমি মেয়েছেলে, আমার কথা একবাক্যে মেনে নেবার মত সমাজ এখনও আসে নি,  কাঁচির দুপাশেই। 
    ওরা গল্প করছিল, আমি ভাবছিলাম এসব মুখে হাসির ভঙ্গি অটুট রেখে।
    মদের পাত্র শেষ। ওরা বাইরে যেতে চায়। হাঁটবে।
    আমাকেও যেতে হবে। লম্বা পথ অন্ধকারে হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। আমরা গোটা চারেক মেয়ে, গোচা ছয়েক পুরুষ।
    হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে চলেছি কোনও এক দিকে। ওরা জানে, ওরা চেনে সব। আমার চিন্তা নেই , শুধু পা মেলাই। শেষ অগস্টের মধ্যরাত, হঠাৎ হুঁশ ফেরে আমার। এ কোথায় এলাম আমি?
    বাকিরা আনন্দে হাসছে, তবে জোরে নয়, ফিসফিসিয়ে।
    আমার মাথা ঘুরছে। এও সম্ভব? এবার আমি নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাচ্ছি।
    স্বপ্নের সেই ব্রীজটা আমার সামনে, অন্যরা এগিয়ে চলেছে ব্রীজের ওপর দিয়ে। কাঠের ব্রীজ। লম্বা, এবং বেশ চওড়া। তলায় জুরিখ লেক। হুবহু এই দৃশ্য আমি দেখেছি। পেছনে দূরে চার্চের মতো চুড়াওলা একটা স্ট্রাকচার ঝাপসা মতো। সেদিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে এরিক বির্খলার ঘোষণা করে, ওটা একটা দুর্গ। গতমাসে ঐ দুর্গে এসেছিল সে, তার মায়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে।
  • সমরেশ মুখার্জী | ০৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১৩:৫৬741836
  • আপনার (দুঃ)স্বপ্ন বর্ণনা পড়ে মনে হোলো হয়তো আপনি আমার "দু নৌকায় পা" লেখার - ১ম পর্বের শেষটার সাথে কিছু একটা রিলেট করতে পেরেছিলেন। তাই ভালো লেগেছিল। ২য় পর্বে ঘটনাক্রম বাস্তবে‌র মাটিতে আছড়ে পড়তে ছন্দপতন লেগেছিল। 
     
    "কমিউনিফেকিং" -  আমি সোজাসাপ্টা মানুষ - এটা ঠিক আসে না - তাই অনেক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। তবে এটা অনুভব করেছি অনেকের মধ‍্যে। শব্দচয়নের এই ইম্প্রোভাইজেশন‌টা আগে দেখিনি। ইন্টারেস্টিং লাগলো। 
  • যোষিতা | ০৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:০৬741837
  • পরের দিন যেসব জিনিস হলো ওয়ার্কশপে, সবই মন্তেস্যরি বা কিন্ডারগার্টেনের খেলা খেলা সারা বেলা। আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি করে, নেটওয়ার্কিং থেকে শুরু করে হরেক রকমের কাজ। একেক রকমের খেলার জন্য একেক রকমের লেকেশন। হাসি ঠাট্টা মজা। সকালে দুপুরে সন্ধেয় এলাহি ভোজনের আয়োজন। মদের ফোয়ারা। সন্ধেবেলা নিয়ে গেল আমাদের সেই দুর্গটার মধ্যে। সেখানেও অনেক মজা অনেক খেলা। দুর্গের মধ্যেই রেস্টুরেন্ট, এরিকের মায়ের বিয়ের অনুষ্ঠান এখানেই হয়েছিল। সে জানে এই রেস্টুরেন্টের কোন কোন খাবার বেশি ভালো খেতে। হৈ হৈ করে কাটছে সময়। পরের দিনও সারাক্ষণ অনেক মদা অনেক আনন্দের পর বিকেলে আমরা ফিরবার পথে। লেকের ঘাট থেকে উঠলাম বিশাল এক বজরায়। এই বজরা আমাদের নিয়ে যাবে জুরিখ শহরের মূল ঘাটে, সিটি সেন্টারের কাছে। সেখান থেকে আমার বাড়ি ফিরতে মাত্র দশ বারো স্টপ ট্রামে। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বজরা চলতেই থাকে লেকে। ভেতরে নানান শো হচ্ছে, ম্যাজিশিয়ান ঘুরে ঘুরে ম্যাজিক শো করে যায়। বুফেতে প্রচুর খাবার প্রচুর মদ ডেসার্টের ছড়াছড়ি। মধ্য রাতে পৌঁছে দে্য় জুরিখের ঘাটে। টলতে টলতে কেউ ফিরছি বাড়ি, কেউ চলেছে সেই আগে থেকে বুক করে রাখা হোটেলে।
    আমায় কাল ভোরে ছাড়তে হবে অ্যাপার্টমেন্ট। কাল আমি যাব আমার নিজস্ব বাসস্থানে। আজ রাতেই গুছিয়ে ফেলতে সমস্ত জিনিস পত্তর, হোক না তা আট কেজি কি ন কেজি,  কিছু যেন ফেলা না যায়। আমার এই অ্যাপার্টমেন্টের লেটার বক্সে আমার নাম সরিয়ে দিয়ে লেখা রয়েছে অন্য নাম। যে আসবে কাল। কী আশ্চর্য, নামটা ভারতীয় অনিল বাসওয়ানি। মনে হচ্ছে সেপ্টেম্বরে এও জয়েন করবে আমাদের অফিসে।
    পরদিন সকালে আমি বাসাবদল করলাম। এরিকার বাড়িতে এরপর থাকব, যতদিন না ফ্যামিলি আনার ব্যবস্থা করতে পারি।
  • Ranjan Roy | ০৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:৫৬741838
  • টুপি খুলलाम।
  • Bratin Das | ০৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:১৬741840
  • আবার পরে নিন। এই ঠান্ডা লেগে যাবে
  • যোষিতা | ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:৫৫741841
  • সেপ্টেম্বরের গোড়াতেই আমার নিজের জন্য দরকারি খরচটুকু হিসেব করে নিয়ে, মাইনের বাকি টাকাগুলো ট্রান্সফার করে দিলাম কোলকাতার ব্যাঙ্কে। আমার স্বামী টাকা পেয়ে বেশ আনন্দিত। আমার তখন খরচ বলতে বাড়িভাড়া, হেল্থ ইনশিওরেন্সের প্রিমিয়াম মাসিক শচারেক, মাসিক ট্রান্সপোর্টের টিকিট জুরিখ শহরের জন্য সত্তর টাকা, আর খাওয়া দাওয়া যত কমে করা যায়, তিনশো হলেই চলবে। এছাড়া দরকার ছিল শীতের জন্য ভাল একটা ওভারকোট, কিছু জামাপ্যান্ট, কয়েকজোড়া জুতো, একজোড়া বরফের জুতো। এসব মিলিয়ে হাজার খানেক। বেতনের সিংহভাগই বেঁচে গেছল। এখানে তো ব্যাংকে টাকা রাখলে সুদ টুদের বালাই নেই। বরং স্বামী পরামর্শ দিল, ভারতে টাকা রাখলে সুদে বাড়বে। 
    ছাত্রজীবনে বেশ সৌখীন ছিলাম, ক্রমে সখের জিনিসপত্র একে একে কিনব। 
    অফিসে তিন চারজন মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। পোল্যান্ডের মেয়ে গশা, চীনের মেয়ে কিং ওয়াং, সিঙ্গাপুরের মেয়ে হেলেন এবং সুইস মেয়ে কিয়ের্স্টেন। 
    হেলেন এবং কিং ওয়াং সম্ভবত আমার প্রিয় বন্ধু ছিল।
    আমি জার্মান ভাষার ক্লাস শুরু করেছি। প্রতি শনিবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চারঘন্টা করে ক্লাস হচ্ছে। সেই বাবদ খরচ ভালই। সে এক অদ্ভূত ক্লাস। গোটা আটদশ ছাত্রছাত্রী মিলে নতুন একটা ভাষা শেখা। ডিরেক্ট মেথডে।  এই একই পদ্ধতিতে রাশিয়ান ভাষা শিখেছি আগে। যা ক্রমে আমার দ্বিতীয় মাতৃভাষা বনে গেছল। তখন বয়স ছিল কম, শেখানোর মধ্যে দরদও ছিল অনেক।
    এখানে পরিস্থিতি ভিন্ন। বিভিন্ন বয়সী ছাত্রছাত্রী ক্লাসে। তাদের বয়সও কাছাকাছি নয়। 
    দুতিন জন রিফিউজি ভেঙে যাওয়া ইউগোসলাভিয়া থেকে। তাদের পরষ্পরের মধ্যে ভয়ানক বৈরীতা।
    একজন ঘোর মাতাল। শনিবারের সকালে তার মদের ঘোর কাটে না। একজন ভারতীয় ছেলেও ছিল, পাঞ্জাবের। সে কেমন করে যেন এদেশে এসে এক ইতালিয়ান মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে। একটা চাকরিও করে। অল্প অল্প জার্মান নিজে নিজেই শিখেছে। সেই ছেলেটার সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হলো। প্রথম দিকে হুহু করে ভাষা শিখে ফেলছিলাম। 
     
    এর মধ্যে সত্যি সত্যিই সেই বাসওয়ানি আমাদের অফিসে জয়েন করেছে। সে এসেছে অ্যামেরিকা থেকে। ওখান থেকেই পড়াশোনা, চাকরিও করেছে অ্যামেরিকায় বেশ কিছু বছর।
    সেই ছেলেটি একদিন নতুন ফোন কিনে নিয়ে এসেছে অফিসে। আমার ঠিক পেছনেই তার বসবার জায়গা। নতুন ফোন আনবক্সিং করছে, এটা ওটা সেটা পড়ে যাচ্ছে মেঝেয়, কার্পেটের কারনে শব্দ হচ্ছে না জোরে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে সে সেট করছে ফোনের এটা সেটা। আবার মাঝে মাঝে নিজের ল্যাপটপের স্ক্রীনেও কীসব দেখছে।
    আমি সেরকম পেছন ফিরে খেয়াল করি নি। হঠাৎ ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠল "ও শীট!" বলে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সে চোখ গোল্লা গোল্লা করে চেয়ে রয়েছে স্ক্রীনের দিকে। কী হলো? আমরা কয়েকজন উঠে গেলাম তার দিকে, হালকা চালে হেঁটে তার কাছে পৌঁছনর সঙ্গে সঙ্গে সে আবার চেঁচালো। 
    তার স্ক্রীনে একটা নিউজ চ্যানেলের কিছু ছবি। উঁচু একটা বাড়িতে এরোপ্লেন ঠোক্কর খেয়েছে। পরপর দুটো পাশাপাশি বাড়িতে পরপর দুটো এরোপ্লেন একইভাবে। 
    এর আগে টুইন টাওয়ারের নাম আমি জানতাম না। 
    সেই ঘটনার নাম হয়ে গেল নাইন ইলেভেন। যা সম্ভবত বদলে দিল আমাদের অনেকের জীবন। তাৎক্ষণিক না হলেও, ধীরে ধীরে তো বটেই।
  • যোষিতা | ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:৩০741844
  • আসলে ঐ একই দিনে রিলিজ করেছিল নিনো জাকুসো প্রযোজিত ও পরিচালিত সিনেমা "ESCAPE TO PARADISE". মাত্র দেড়ঘন্টার চলচ্চিত্র। যারা দেখেছে তারা জানে এই সিনেমায় কতটা হাস্যরস ও কতটা করুণ রস। সুইটজারল্যান্ডের প্রতিবেশি পাঁচটি দেশের মধ্যে তিন প্রতিবেশিই সিনেমা বানাতে ওস্তাদ। সংখ্যায় বেশি না হলেও ফরাসী ও ইতালিয়ান সিনেমার গুণমান বরাবরই ভালো। জার্মানিও সিনেমা বানায়, পর্ণোগ্রাফির জন্যই তারা বিখ্যাত। কিন্তু সুইটজারল্যান্ডের সিনেমা শিল্প অত গতিশীল নয়, বেশ কয়েকবছর পরে একটা কি দুটো সিনেমা হলো কি হলো না। কিন্তু যখন হবে, ভালো জিনিস হবে।
    তো এই "ESCAPE TO PARADISE" এর থীম আদি ও অকৃত্রিম ইমিগ্রেশনকে নিয়েই। ছবির ধাঁচটা সেই ১৯৭৮ সালের কমেডি সিনেমা Die Schweizermacher (সুইস নির্মাতা - সরাসরি অনুবাদ করলে এর মানেটা যেমন দাঁড়ায়) এর থেকে বিস্তর আলাদা, কিন্তু থীম বড্ড কাছাকাছি। সুইসরা বিলক্ষণ জানে, এই এল ডোরাডোতে মাইগ্রেট করবার জন্য কত রকমের ঘোল বিদ্যমান।
    "ESCAPE TO PARADISE" এর গল্পটা এক উদ্বাস্তু পরিবারের অ্যাসাইলাম পাওয়া না পাওয়ার অনিশ্চয়তার ওপরে। যথেষ্ট ডকুমেন্ট, যথেষ্ট তথ্যাবলী দিয়ে প্রমাণ করবার তাগিদ, এক কুর্দিশ পরিবারের, যে আমরা সত্যি সত্যিই সঙ্গত কারণেই উদ্বাস্তু। কিন্তু যখন সুচতুর সরকারি কর্মকর্তারা প্রশ্ন শুরু করে, আচ্ছা বলুন তো যেদিন আপনারা অমুক জায়গা থেকে তমুক অঞ্চলে পালাচ্ছিলেন, সেদিন কি বৃষ্টি পড়েছিল? ঠিক ঐ তারিখে?
    কর্মকর্তাদের সামনে ঐ সময়ের প্রত্যেক দিনের আবহাওয়ার রেকর্ড। এতটুকু সময়, তারিখ, বার, ঘটনা, আবহাওয়া, ভুল করবার জো নেই।
    এই নিয়েই ছবি।
    কিন্তু এই ছবি দেখবেটা কে? পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ব্লকবাস্টার চলছে তখন টিভির নিউজ চ্যানেলগুলোয়। এসকেপ টু প্যারাডাইস ফ্লপ করল শুধু এই কারণেই।

    https://www.swissfilms.ch/en/movie/escape-to-paradise/13A6924F9E744A96873794DA41FA6A15
  • যোষিতা | ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:৩৭741845
  • এর অনেক অনেক পরে আমার মেয়ে যখন ইস্কুলে পড়াকালীন ছোট্টো একটা ফিল্ম তৈরি করেছিল, তখন সেও দেখেছিল এই সিনেমাটা।

    তার সেই ইস্কুলের গল্প তখন সে সে লিখেও ফেলেছিল একটি ওয়েবজিনে। সেইটে এখানে তুলে দিচ্ছি।
     
    একেই বলে শুটিং
    পারিজাত, সুইটজারল্যান্ড
    ৮.২.২০০৭
    হলিউড-বলিউডের সঙ্গে কোনো তুলনা চলে না। সোলোথুর্ন পুঁচকে শহর, সুইটজারল্যান্ডের ফিল্মসিটি। কজন লোক নাম শুনেছে সোলোথুর্নের? আর কটা সুইস ফিল্মের নাম আমরা জানি? খুব ভেবে চিন্তে বললে বলব "হাইডি', "শোয়াইৎসারমাখার' (এষং ঢ়ষ থনদষলন ত জংভড়ড়?), "এস্‌কেপ্‌ টু প্যারাডাইস্‌', আর আর আর মনে পড়ছে না, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, গতবছর বেরোলো, "গ্রাউন্ডিং'। এরা সিনেমা কম বানায়, কিন্তু ভালো করে বানায়। সেরকম হাই বাজেট সিনেমা বানায় না, এগুলো সবই লো বাজেট ফিল্ম, কিন্তু যত্ন করে বানানো।

    তো আমাদের মনে খুব ইচ্ছে হয়েছিল আমরাও সব সিনেমা বানাব। ষোলো বছর বয়েসে এরকম ইচ্ছে হলে কেউ পাগল বলে না, বলে ওটা পিউবার্টির দোষ। অতএব আমরা ইস্কুলে আবদার করলাম, আমরাও ফিল্মমেকার হব। সেপ্টেম্বরে শরৎকালের ছুটি থাকে এক সপ্তাহ, সোম থেকে শুক্রের মধ্যে এত কিছু করে ফেলতে পারি আর একটা সামান্য সিনেমা বানাতে পারব না? কী এমন হাইফাই ফান্ডা লাগে সিনেমা বানাতে? স্টোরি? আছে। মানে নেই, কিন্তু এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি। বানালাম গল্প। গল্পের একটা স্টাইলিশ নাম দিলাম হেভি কায়দা মেরে - "দেজাভু'। ফ্রেঞ্চ নাম। শুধু নাম দেখিয়ে হাউসফুল করে দেব। আর কী লাগে? ভিডিও ক্যামেরা। সে হয়ে যাবে, কোনও বড়লোক ক্লাসমেটের কাছ থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ম্যানেজ করে নেব, ঘুষ হিসেবে তাকে সিনেমায় একটা রোল পাইয়ে দেব। অ্যাকটর অ্যাক্ট্রেস অনেক আছে, কত চাই? ডিরেক্টর কাম ক্যামেরাম্যান আমি নিজে। ওটাই মোস্ট দায়িত্বফুল কাজ। আর চাই, আর চাই, মুভিমেকার সফ্‌টওয়্যার আর বেশ ভালো হার্ড ডিস্কওয়ালা একটা ল্যাপটপ। ব্যাস, আমরা রেডি। অ্যাক্‌শান!

    আমাদের ক্লাস টিচার ফ্রাউ স্টুকি, যাঁকে আমাদের ইংলিশের টিচার হের ফিশার আড়ালে "মিসেস্‌ স্টাকি" বলে থাকেন, সেই স্টুকি আমার বানানো গল্পটা শুনলেন। এবং যা ভয় পেয়েছিলাম, তাইই হল, স্টুকি এই গল্পে নিজস্ব মতামত দিতে গিয়ে গল্পটার সাড়ে বারোটা বাজিয়ে ছাড়লেন। আমার গল্পটা ছিল এইরকম :- একটা লোক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন একটা হকার তার হাতে একটা ফ্রি নিউজপেপার ধরিয়ে দিল। লোকটা কাগজটায় অল্প চোখ বুলিয়ে একদম তাজ্জব। সে তখন হকারটাকে খুঁজতে গিয়ে আর তাকে দেখতে পেল না। এমন সময়ে একটা লোক ছুটতে ছুটতে এসে এই লোকটার হাত থেকে ওই খবরের কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়। লোকটার হঠাৎ খেয়াল হল যে, ওই হকারই খবরের কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে গেল। তখন লোকটাও ওই হকারের পেছনে দৌড় লাগাল, অনেকক্ষণ দৌড়নোর পরে এক সময়ে সে দেখল হকারটা আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেছে। তারপরে আবার কোনও একটা দেয়ালের পেছন থেকে হকারটা বেরিয়ে এসে লোকটার সঙ্গে একটু কথা বলেই লোকটাকে গুলি করে মেরে ফেলল। এই কথা বলার সময়ে বোঝা গেছিল যে ওই হকারটা লোকটাকে চেনে। খুন টুন করে, হকার শান্ত ভাবে খবরের কাগজটা ডাস্টবিনে ফেলে দিল, আর বিড়বিড় করে বলল, "উ: যত রাজ্যের রাবিশ খবর এরা কাগজে ছাপে'। এবার ক্যামেরা জুম করল ডাস্টবিনে, আর সেখানে দেখা যাবে যে লোকটা এইমাত্র খুন হল, তার খুনের খবর উইথ ফোটো অলরেডি ফার্স্ট পেজের হেডলাইন, আর কাগজের নাম "দেজাভু'।

    তিনমিনিটের সিনেমার জন্যে এর থেকে বড় আর ইন্টারেস্টিং গল্প আমার মাথায় খেলেনি। স্টুকির গাইডেন্সে, হকার বনে গেল "শয়তান'। সেই শয়তানের সঙ্গে ওই লোকটা একটা কন্‌ট্র্যাক্ট সই করল, আল্টিমেটলি সেই খুন ই হল। কিন্তু আমার গল্পের সব চার্ম মরে গেল। কী করব? স্টুকি আমার জার্মানের টিচার, তার হাতেই ক্ষমতা, সোলোথুর্নে গিয়ে শুটিং করার অনুমতি তিনিই দেবেন। কাজেই কম্প্রোমাইজ করলাম। এবার আরও অনেক কিছুর সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করা শুরু হল। আসল নায়ক যে হবে, তেমন কোনও ছেলে পাওয়া গেল না, কেউ লড়াই না করে খুন হতে রাজি নয়। কিন্তু এ সিনেমায় ফাইটিং সিকোয়েন্সের স্কোপ নেই। তাই লোকের জায়গায় মেয়ে এল। নাম সারা। সে বেশ নায়িকা নায়িকা দেখতে, অনেক দামি দামি জামাকাপড় আছে তার, ফিগার ভালো, শুধু অ্যাকটিংটা সে পারে না। দেড় লাইন ডায়ালগ সারা ফিল্মে, সেটা বলতে সে পনেরোবার হাসে, তার মধ্যে বারোবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে যায়। তাকে বেশি বকে ধমকে দিলে সে কেঁদে ফেলতে পারে, তখন তাকে তোয়াজ করে আবার শান্ত করতে হয়। ডিরেক্টরদের অনেক ঝামেলা সহ্য করতে হয়। বলতে এক্কেবারে ভুলে গেছি। আমরা কিন্তু সেই ছুটির সপ্তাহের সোমবারে ট্রেনে চেপে সোলোথুর্ন পৌঁছে গেছি। স্টুকি আমাদের সঙ্গ নিয়েছেন, আর আছেন ভুগোলের টিচার হের্‌ স্টাউফার। (হের্‌ মানে মিস্টার, ফ্রাউ মানে মিসেস্‌ - যারা জার্মান জানেন না তাঁদের জন্যে।) হের্‌ স্টাউফার ভালো লোক, যাকে বলে "কুল' লোক। আগবাড়িয়ে কোনও ঝামেলা করেন না। আমরা রইলাম ইউথ হস্টেলে।

    এদিকে মার্টিন, আমাদের ক্লাসমেট, সেও রোল চায়। সিনেমায়। তখন আমি একবার ভেবেছিলাম, ওকে "এগ্‌রোল' দিলে কেমন হয়। কিন্তু "এগ্‌রোল' কী জিনিস, কেমন খেতে সেসব সুইস্‌রা জানে না, তাই এসব আর বলিনি। অনেক ভেবে চিন্তে মার্টিনের জন্যে একটা মাতালের রোল ঠিক করা হল, সে পথের ধারে মদের বোতল নিয়ে হা`ফ বেহুঁশ হয়ে বসে আছে। মার্টিন তাতেই খুশি। ওকে দশ সেকেন্ডের মতো স্ক্রিনে দেখা যাবে। তিন মিনিটের সিনেমায় দশ সেকেন্ড মানে প্রচুর। ইয়ার্কি নাকি! আমরা সিনেমাটা রিয়্যালিস্টিক করব, জালি জিনিস চলবে না, মার্টিনের মদের বোতলে আসল খাঁটি ভোদ্‌কা-ত্রো`ইকা থাকবে, লাল রঙের। শুটিং শেষ হলে, সিনেমা রিলিজ করবে কি করবে না, কিন্তু বোতলটা খালি করবার কোনও অসুবিধা হবে না। আমাদের গ্রুপের ছেলে এডি, দুবার ফেল করে তার বয়েস আঠারো, তাই সে গিয়ে বীরের মতো ভোদ্‌কা কিনে নিয়ে এল। আমরা বাচ্চা বলে আমাদের কেউ মদ বেচবে না।

    মোটকথা আমরা রেডি। অ্যাকশন বললেই শুটিং এ ঝাঁপিয়ে পড়ব। সোমবার এসব গোছাতে গোছাতেই কখন সূর্য ডুবে গেল। মঙ্গলবার আমাদের ক্লাস নিতে এলেন, নিনো জাকুসো। বিখ্যাত সুইস্‌ ডিরেক্টর। সোলোথুর্নের একটা বিশেষ সিনেমা হলে বসে দেখলাম তাঁর বানানো ফিল্ম "এস্‌কেপ্‌ টু প্যারাডাইস্‌'। যা তা অসহ্য ভালো সিনেমা। একটা টার্কিশ রিফিউজি পরিবারের গল্প, কীভাবে তারা এই দেশে অ্যাসাইলাম পেল তার ডিটেল। গল্পটাও নিনো-র নিজের লেখা। সিনেমাটা চলেনি। এত ভালো ফিল্ম চলল না? নিনো বললেন, চলেনি কারণ খুব ভুল একটা দিনে এই সিনেমা রিলিজ করেছিল। ১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১, ঠিক সেই দিনে দুনিয়ায় আরেকটা ব্লক বাস্টার রিলিজ করে, জলজ্যান্ত। সবাই সেসময়ে শুধু টিভি দেখত, কেউ সিনেমা হলে ঢুকত না। নিনোর কাছে ফিল্ম বানানোর কিছু টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি নিয়ে হাতে খড়ি হল আমাদের। কিন্তু তর সইছে না, কখন শুটিং শুরু করব? কখন?

    সোলোথুর্নের রাস্তায় রাস্তায় শুরু হল শুটিং, পুরোটাই আউটডোর। কখনও ক্যামেরা নিয়ে দৌড়চ্ছি, ট্রলি নেই, আমরা গরীব স্টুডেন্ট। একটাই ক্যামেরা, কাজেই এক অ্যাঙ্গেল থেকেই একেকটা সিন নিতে হচ্ছে, শুটিং চলছে, সামনে দিয়ে লোকজন হেঁটে গেল। কাট! সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এডিটিং, ল্যাপটপে মেমরি কম, ল্যাপ্‌টপ হ্যাং করে যাচ্ছে, তবু দমছি না আমরা। বাকিরা সন্ধেবেলা "আরে' নদীর ধারে আনন্দ করছে, আর আমরা কয়েকজন তখন বুঝতে পারছি সাউন্ড ডাবিং না করলে এ সিনেমার দেড়খানা ডায়ালগের আধখানাও কেউ বুঝতে পারবে না। এই করতে করতে বুধ শেষ হল, বেস্পতিবারও প্রায় শেষ। শুটিং শেষ। এডিটিং শেষ। ডাবিং এর কোনও চান্স নেই, তাই আমরা ওটাকে সায়লেন্ট মুভি বানিয়ে ফেললাম। উইথ সাবটাইটেল। সাবটাইটেলের ভাষা নির্ভেজাল সুইস্‌ জার্মান। ভাষা নয় ডায়ালেক্ট। আরেকটু আর্টিস্টিক টাচ দেবার জন্যে সিনেমাটাকে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট করে দেওয়া হল। রং নেবো ও না, রং দেবো ও না। শুধু নামটাই একটু ঘেঁটে গেল। সেটা স্টুকির দোষ। দেজাভু-র বদলে "শয়তানের দেজাভু'। এত খারাপ নাম লোকের মাথায় কীকরে আসে? সিনেমাকে ডিভিডিতে বার্ণ করে নেওয়া হল।

    শুক্রবার আমরা ফিরছি দুপুরের ট্রেন জুরিখের দিকে। অতএব বেষ্পতিবার রাতে একটু বেশিক্ষণ বাইরে থাকার অনুমতি পাওয়া গেল। খুব বেশি নয়, জাস্ট রাত বারোটা অবধি। আর আমাদের পায় কে? আমরা হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছি সোলোথুর্ন শহরে। রেস্টুরেন্টে যাবার পয়সা যাদের কাছে নেই, যেমন আমি, তারা নদী টদি দেখে , গান গল্প করে বেজায় ক্লান্ত হয়ে গেলাম, এমন সময়ে খবর এল, আমাদের নায়িকা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সারা। যিনি খুন হলেন সিনেমায়। সেই বোতল, যেটা সিনেমায় দেখা গেছিল সেটা তো শেষ হয়েইছে, এডি-র সাহায্যে এরকম আরও কিছু পানীয় এসেছে এবং শেষ হয়েছে। মোট পাঁচজন এইসব কীর্তি করেছে, কিন্তু সারা নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রায় অজ্ঞান। অ্যাম্বুলেন্স এল। সারাকে নিয়ে ফ্রাউ স্টুকি হাসপাতালে গেলেন। গোটা ইউথ হস্টেলে থম্‌থমে ভাব। সারা বাঁচবে তো? বিষক্রিয়া? সেই পাঁচজনের মধ্যে চারজনকে (কারণ সারা বাদ, সে হাসপাতালে) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, কিন্তু তারা সব চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুম। কিন্তু শুক্রবার সকাল হতেই পাঁচজনকে ভোরের ট্রেনে জুরিখ পাঠিয়ে দেওয়া হল। সারাও তাদের সঙ্গে। ও তখনও অসুস্থ, স্টুকি ওকে ভোরবেলাই হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। ওদের বলে দেওয়া হল, সোজা ইস্কুলে যাবে আর রেক্টরের সঙ্গে দেখা করবে! এদিকে ওদের প্রত্যেকের বাড়িতে ফোন করে করে বাবা-মাকে জানানো হয়েছে, আপনার ছেলে বা মেয়ে এই কীর্তি করেছে। সবচেয়ে বেশি ভয় হয়েছিলো আমার। আমিই তো ডিরেক্টর, ওই রিয়্যালিস্টিক কান্ডকারখানর জন্যে রিয়েল অ্যাল্‌কোহলের পার্মিশান তো আমি দিয়েছিলাম। ওরা আমাকে এক ফোঁটাও দেয়নি, আমি চাইওনি, তবুও আমারও যদি শাস্তি হয়? যদি ওরা বলে, মদ কে এনেছিল, কেন এনেছিল, এসব বুদ্ধি কে দিয়েছিল?

    খুব ভয়ে ভয়ে সোমবার ইস্কুল গেলাম। কিচ্ছু হয়নি। আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন ভুগোলের টিচার। উ:, কী ভালো লোক। সারা যেহেতু হাসপাতাল অবধি যাবার মতো অবস্থায় নিজেকে নিয়ে গেছল, তাই ওকে একটা ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে, আর ওদের পাঁচজনকে ইস্কুল বাড়ি পরিষ্কার করতে হবে। শাস্তি। এই সব ঝামেলায় সিনেমার ব্যাপারটাই সবাই ভুলে গেল। সেদিন দেখছিলাম ডিভিডিটা। আমার নিজের বানানো প্রথম সিনেমা। দ্বিতীয়টা এখনো বানানো হয়নি যদিও। আর লিখেই ফেললাম এই প্রবাসীর পত্র যতক্ষণ প্রবাসী আছি।
     
  • সমরেশ মুখার্জী | ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ ২০:০৩741846
  • সিনেমার অরিজিনাল আইডিয়া‌টা খাসা ছিল, তবে সিনেমার থেকেও সিনেমা বানানো‌র বিবরণ দারুণ লাগলো। শুধু একটা‌ই জিজ্ঞাস‍্য, বিবরণটা কী মেয়ের‌ই লেখা নাকি সে লিখেছি‌ল জার্মানে এবং ফ্রাউ স্টুকির মতো সেটি এখানে বাংলা‌য় পরিবেশিত হলো মায়ের কলমে। যদি মেয়ে‌ই এটা বাংলায় লিখে থাকে - একরাশ ভালো‌লাগার সাথে উপহার দিলুম একটি ভার্চুয়াল সুইশ চকোলেট, যদিও সে মেয়ে হয়তো চকোলেট খাওয়া‌র বয়স পেরিয়ে গেছে অনেক আগে‌ই।
  • যোষিতা | ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:০৫741849
  • বাংলাতেই লেখে। ওতো বাঙালি মেয়ে! কথা বলবার সময় ইংরিজি বা হিন্দি বা জারর্মান বা ফ্রেঞ্চ শব্দ ব্যবহার করে না, এমনকি যে সব শব্দ আমরা আকছার ব্যবহার করি সেগুলোও নয়। বাংলা ইস্কুলে পড়ত ছোটবেলা, তখন ইংরিজি পড়ানো হতো না পশ্চিমবঙ্গে।
  • সমরেশ মুখার্জী | ০৮ জানুয়ারি ২০২৪ ২২:২০741851
  • তাহলে আপনার মেয়েকে জানাই অ-নে-ক অভিনন্দন। ইদানিং অনেক বাঙালির‌‌ বাংলায় প্রকাশভঙ্গি‌র নমুনা দেখে খারাপ লাগে .... অসংলগ্ন বা বিকৃতভাবে লেখা যেন এখন একটা ফ‍্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে ... বেশী‌দূর যেতে হবে না ... গুরুতে মন্তব্যের পাতায় নজর রাখলেই তেমন নমুনা প্রচুর চোখে পড়বে।
  • যোষিতা | ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০২:১২741853
  • যাইহোক, মেয়ের এই লেখা তো অনেক পরের ঘটনা। মূল ঘটনাক্রমে আসি।
    সেপ্টেম্বরের ঐ সময়েই হাফ ডে ছুটি নিয়ে চলে গেছলাম বের্ণ শহরের ভারতীয় দূতাবাসে, কির্খেনফেল্ডষ্ট্রাসসে তে একটা অতি ক্ষুদ্র পুরোনো দোতলা বাড়ি। সামনে পেছনে পাশে বাগান করার জন্য সামান্য জমি, তাতে আগাছার জঙ্গল। একেবারেই ছোট্ট বাড়ি। এতবড়ো দেশের এইটুকুনি দূতাবাস? তাশখন্দে কনুসেলেট ছিল প্রাসাদোপম বিশাল দুখানা বাড়ি। পরে কী হয়েছে জানা নেই যদিও।
    আমার এখন নিজের কাজ হওয়া নিয়ে কথা। রিসেপশনে শাড়িপরা একজন মধ্যবয়সী মহিলা, দেখে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। তাঁকেই কাগজপত্র পাসপোর্ট ইত্যাদি দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করতেই তিনি খিটখিট করে উঠলেন।  পারলে ওখান থেকেই আমায় দূর করে দেন। কিন্তু কাজ না করে বেরিয়ে যাবার মত দুর্বল আমি নই সেদিন। পন করে এসেছি মনে মনে, যে করেই হোক পদবী বদল করতে হবে, আরও যা যা সমস্যা রয়েছে সবকিছুর সমাধান করতে হবে। আমি অল্প সরে গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। আমি ছাড়া আর কেনও ভিজিটর নেই। উনি সেই জানলা মত কাউন্টার থেকে সরে গেলেন। এরপর এক ট্রাভেল এজেন্ট এলো একতাড়া পাশপোর্ট নিয়ে ভিসার জন্য। কোনো টুরিস্ট দল ইন্ডিয়া ভ্রমনে যাচ্ছে। মহিলাকে জানলায় ফিরতেই হলো। 
    ট্রাভেল এজেন্ট বিদায় নিলে, ভেতর থেকে একজন মধ্যবয়সী লোক আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দরজা খুলে সেই বৈঠকখানার মত রিসেপশনে এসে বললেন, আপনি কী কাজের জন্য এসেছেন?
    আমি আবারও বলি যে আমার বিয়ে হয়েছে মাসখানেক আগে, পাসপোর্টে পদবী বদলাতে হবে, এই আমার পাসপোর্ট, এই হচ্ছে ম্যারেজ সার্টিফিকেট, পাসপোর্টে কিছু ভুল ছিল...
    ভদ্রলোক আমার কথা সব শুনছেন না মনে হয়, অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে বলেন, আপনি বিয়ে করে তার পরে এই দেশে এসেছেন!
    —হ্যাঁ, মানে বিয়ের দিন বারো দিনের মাথায়।
    —আপনার হাজবেন্ড সুইস?
    — না না, ভারতীয়। এই দেখুন না, হাজবেন্ডের পাসপোর্টের কপি।
    — আপনি বসুন। চলুন ঐখানে বসি। আমি ফার্স্ট সেক্রেটারি।
    ভদ্রলেক নিজের নাম বললেন। দক্ষিণ ভারতীয় নাম। আমি সব কথা গড়গড় করে বলে গেলাম। উনি ঠাণ্ডা মাথায় সব শুনে নিয়ে বললেন, নতুন পাসপোর্ট করাতে হবে, এটা ক্যানসেল্ড হবে। নিজেই ফর্ম নিয়ে এলেন ভেতর থেকে। সব নথিপত্র ভেতরে নিয়ে গেলেন। সম্ভবতঃ ফেটে কপি করিয়ে আনলেন। মূল নথিগুলো ফেরৎ দিয়ে বললেন কাছেই পেস্ট অফিস, সেখানে গিয়ে এমব্যাসীর কনসুলার সেকশনের পাসপোর্ট সংক্রান্ত সার্ভিসের জন্য কিছু টাকা অ্যাকাউন্টে পেমেন্ট করে আসতে। দুটো পৃথক বিল। একটা সম্ভবত নব্বই ফ্রাংক, আরেকটা চল্লিশ। 
    আমি দৌড়ে গিয়ে পোস্টপিস খুঁজে বের করে টাকা জমা করে এলাম, রসিদ জমা দিলাম কাউন্টার্র মহিলাটিকে। 
    ফার্স্ট সেক্রেটারি বললেন যে পুরো জিনিসটা ভেরিফাই হতে যাবে উজবেকিস্তানে। কিছুদিন পরে খোঁজ নিতে। ক্লিয়ার হয়ে গেলে একদিন এসে পাসপোর্ট নিয়ে যেতে পারব। নতুন পাসপোর্ট। তার জন্য ফোটো নিয়ে আসতে হবে।
    আনন্দে টগবগিয়ে জুরিখ ফিরলাম।।
    প্রত্যেক সপ্তাহে খোঁজ নিই, প্রেমপত্র আর আসেই না।
    অক্টোবরের মাঝামাঝির দিকে আমার স্বামী তুমুল ঝামেলা করতে লাগল, এত দেরি কেন হচ্ছে পাসপোর্ট পেতে? সেপ্টেম্বরের শেষেই প্রায় পুরো বেতন আবারও তাকে পাঠিয়ে দিয়েছি। প্রথম কিছুদিন ভাল থাকে, তারপরেই খিটখিট করে। আমি কী করব? এমব্যাসি কি আমার খাতিরের লোক, যে বললেই কাজ হয়ে যাবে?
    আমার কাঁদতে বাকি শুধু। আবার এমব্যাসীতে ফোন করলাম। আজ উচ্চপদস্থ কারো সঙ্গে কথা না বলে ছাড়ব না। এই পদ্ধতিই কাজে দিল। এবং সুসংবাদ। ক্লিয়রেন্স্র চিঠি বেশ কদিন আগেই এসে গেছে। আমি গেলেই নতুন পাসপোর্ট বানিয়ে দেবে।
    পরদিনই চলে গেছলাম বের্ণ এ।
    সেইদিনই পাসপোর্ট পাই। সেদিন একটার পর একটা ঘটনা ঘটছিল, সেই ঘটনা অন্যত্র আগে লিখেছি। সেদিন ফার্স্ট সেক্রেটরি মশাই ছিলেন না। ছিলেন এক বাঙালি। সম্ভবত সেকেন্ড সেক্রেটারি।
     
  • যোষিতা | ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০২:১৯741854
  • সেদিনের ঘটনা আগে "ভারতীয় দূতাবাসের বিবিধ সেক্সি স্টোরিজ" নামে অন্য টই তে লিখেছি।
    এদিনের বর্ণনা তাই কপি পেস্ট করে দিচ্ছি।
     
    • সেজেগুজে মনে আনন্দে চলেছি রাজধানী বের্ণ-এ। সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়েছি ভালো করে, কখন কোথায় আরো কীকী ফি ভরতে হবে বলা তো যায় না, দরকারী কাগজপত্র, পাসপোর্ট, গোটা কয়েক পাসপোর্ট সাইজ ফোটো, আরো অনেক টুকিটাকি।
      আজ ইচ্ছে আছে কাজ শেষ হয়ে গেলে ওদিকটায় ভালো করে ঘুরবার,এত দাম দিয়ে রেলের টিকিট কাটা হচ্ছে বারবার, সেটার সদ্ব্যবহার হওয়া দরকার।
      আজও সেই খিঁটখিঁটে রিসেপ্‌শনিস্ট। ও মেজাজ দেখালেও আমার পাত্তা দেবার দরকার নেই। তঁকে গিয়ে বললাম, পাসপোর্ট দেখালাম, তিনি পাসপোর্ট নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।
      দাঁড়িয়ে আছি, দেখলাম ভেতর থেকে তিনি জানলার দিকে আসছেন, সঙ্গে এক ভদ্রলোক বেশ কোট প্যান্ট পরা, আমার পাসপোর্টটা তাঁর হাতে। মহিলা ইঙ্গিতে আমাকে দেখিয়ে দিয়ে ভেতরে কোথায় যেন চলে গেলেন।
      ভদ্রলোক তো মহিলার চেয়ারে বসলেন এবং আমাকে চমকে দিয়ে খাঁটি বাংলায় বললেন, আপনি বসুন আমি কাগজপত্র নিয়ে আসছি।
      আমার তো মনটা আনন্দে হুহু করে ওঠে, উঃ, বাঙালী পাওয়া গেল এতক্ষণে।
      একটু পরেই তিনি বাইরে এসে সেই বসবার জায়গায় আমার পাশে এসে বসলেন, বয়সে আমার চেয়ে বছর কয়েকের ছোটো ও হতে পারেন মনে হোলো - গুছিয়ে বসে বললেন, আপনার এনোসি তো এসে গেছে।
      - জানি, সেইজন্যেই তো এলাম।
      - কিন্তু এখন কারেকশান করাবেন?
      আমার বুকের মধ্যে ঢিপ্‌ঢিপ্‌, আবার কী ফ্যাক্‌ড়ারে বাবা! কিন্তু মনের ভাব চেপে রেখে শান্ত মুখে বললাম, কেন ? এখন করাতে অসুবিধেটা কোথায়?
      - না অসুবিধে নেই তেমন, তবে ঐ কাটাকুটি, তার ওপরে পাসপোর্ট তো এক্স্‌পায়ার করতে খুব বেশি বাকি নেই
      - না তা নেই, বছর দেড় দুই..
      - হুঁ, (চিন্তা করছেন) সঙ্গে ফোটো এনেছেন?
      - (জয় বাবা) এনেছি তো! এই দেখুন তিনটে, নানা পাঁচটা।
      - অতো গুলো লাগবেনা, এক কাজ করুন, একটা নতুন ফর্ম দিচ্ছি আনকোরা নতুন পাসপোর্ট করে নিন।
      এতো মেঘ না চাইতেই জল! এই না হলে বাঙালী? অথচ আমরা বলি কিনা বাঙালীই বাঙালীর মস্ত শত্রু, ছিঃ!
      আমি কৃতজ্ঞতায় প্রায় কেঁদে ফেলি।
      ফর্ম ভরে চলেছি, আর তিনি টুকটাক আমার অন্যান্য খবর জেনে নিচ্ছেন, কোথায় থাকি, কী করি, কেমন করে এদেশে এলাম, দেশে কে কে আছে। আমিও বলে চলেছি।
      ফর্ম ভরা হয়ে গেলে তিনি ফর্ম হাতে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন, আমিও পাশের পোস্টাপিসে গিয়ে ফি এর পেমেন্ট করে এলাম।
      ফিরে আসতেই উনি বললেন, দেখুন বারোটায় তো এম্ব্যাসী বন্ধ হয়ে যাবে, আপনি যদি বারোটা অবধি কোথাও একটু ঘুরে আসতে পারেন তবে লাঞ্চে বেরোনোর সময় আপনাকে নিয়ে আমার বাড়ীতে যাবো, আমার স্ত্রীকে ফোনে বলে রেখেছি, আজ দুপুরে আপনি আমাদের বাড়ীতেই খাবেন।
      আমি সঙ্গে সঙ্গে নেমন্তন্ন অ্যাকসেপ্ট করলাম। ভদ্রলোক আমার সঙ্গে বেশ হেসে হেসে গল্প করলেন, কোলকাতায় কোথায় বাড়ী, স্ত্রী ও দুটি ছেলেমেয়ে রয়েছে এখানে, আরো নানান গল্প, কোন কলেজ, কোথায় কোথায় পোস্টিং হয়েছে এর আগে।
      আমিও খলবলিয়ে গল্প করে যাচ্ছি। তারপরে বাইরে গিয়ে অল্প গিফ্‌ট কিনে আনলাম বাচ্চাদের জন্যে সামান্য চকোলেট, ছোটো পুতুল, লোকের বাড়ী প্রথম যাবো, খালি হাতে কেমন করে যাবো? 
      ফিরে আসতে আসতেই প্রায় বারোটা, দেখি তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন, আরো কয়েকজন বেরোলো, দরজায় তালা পড়ে গেল। লাঞ্চের পরে আর বাইরের লোক অ্যালাউড নয়।
      সকলেই নিজ নিজ বাড়ীতে লাঞ্চ খেতে চলল।
      পাশের গলিতেই তাঁর গাড়ী পার্ক করে রাখা, সেটা চড়ে বসলাম। গাড়ী ঘোরাতে ঘোরাতে ভদ্রলোক বললেন, সেই রিসেপশনিস্টের নাম করে, সেকি আপনাকে দেখল?
      - কে?
      - ঐ রিসেপশনিস্ট মহিলাটি
      - কই আমি তো দেখিনি! কেন?
      - না মানে আমরা দুজনে একসঙ্গে বেরোলাম তো, তাই।
      - একসঙ্গে বেরোলে কী হয়েছে?
      - আপনি খুব সরল, খুব সিম্পল, আপনি বুঝবেন না, এরা খুব প্যাঁচালো যাগ্গে বাদ্দিন। আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না, চলুন না আজ অন্য কোথাও গিয়ে খাই? রেস্টুরেন্টে?
      - রেস্টুরেন্টে! কেন? সেতো খুব খরচের ব্যাপার, আপনি যে বললেন বাড়ীতে যাবেন?
      - বলেতো ছিলাম, এখন গাড়ী ঘুরিয়ে নিচ্ছি। (মুচকি হেসে) দাঁড়ান ..

      এই বলে মোবাইলে বৌকে ফোন করলেন, হ্যালো হ্যাঁ শোনো, উনি মানে যে ভদ্রমহিলার কথা বলেছিলাম, উনি আসলে ঠিক আসতে চাইছেন না, ওঁর তাড়া আছে ফিরে যেতে চান, ধরে রেখে কী হবে? 

      ওদিক থেকে বৌয়ের হুংকার ফোন ভেদ করে শোনা যায়- তবে যে আমি অ্যাতো রান্না করলাম, তার কী হবে? চালাকি পেয়েছো?
      - ঠিকাছে নিয়ে আসছি।

      আমি যে শুনতে পেয়েছি সেটা উনি বুঝেছেন কিনা বুঝলাম না।
      উনি চলতে লাগলেন চুপচাপ। মাঝে একটা দুটো কথা। মিনিট দশের মধ্যেই গাড়ী পৌঁছে গেল সেই বহুতলের আন্ডারগ্রাউন্ডে। গাড়ী পার্ক করা হয়ে গেলে লিফটে করে আমরা উঠে গেলাম সাত তলায়। লিফ্‌ট্‌ থেকে বেরোতেই দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক সুন্দরী মহিলা, বেগুনী রঙ্গের সিল্কের শাড়ী।
      আমায় দেখেই বললেল - আসুন আসুন।
      মুখে স্নিগ্ধ স্মিত হাসি।
  • যোষিতা | ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০২:২৫741855
  • আমায় বৌয়ের জিম্মায় গচ্ছিত রেখে তিনি গপাগপ লাঞ্চ খেয়ে বেরিয়ে গেলেন। সারা দুপুর বিকেল সেখানেই কাটালাম।
    সেদিন সন্ধ্যেয় আমার নতুন পাসপোর্ট নিয়ে তাঁর প্রত্যাগমন।
    গল্প এইটুকুই হতে পারতো, কিন্তু গল্পের মধ্যেও আরেকটা গল্প আছে, এবং সেটাও দূতাবাসের গল্প - যেটা শুনেছিলাম সেই দুপুরে ওঁর স্ত্রীর মুখে।
    সেটা হচ্ছে বেইরুটের গল্প।
     
    অ্যারেঞ্জড্‌ ম্যারেজ
    -------------------

    এই শিরোনামেই লিখব গল্পের ভেতরের গল্পটা।
     
    আপনাকে এবারে ভাত বেড়ে দি? আপনার সঙ্গে একসাথে খাবো বলে তখন ওকে আগে খাইয়ে দিলাম। কিছু মনে করেন নি তো? আজ আমার চান করা হোলো না জানেন তো। আসলে ও আমাকে আগেই বলেছে আপনার কথা, আপনার ফাইল নিয়ে ও ই তো কাজ করছিলো - তাই বাড়ী এসে বলল। আপনি শুক্তো খান তো? এখানে তেতো বলতে ঐ শুক্তো। কতদিন নিম বেগুন খাইনা সর্ষে ফোড়োন দিয়ে। একটু ডাল দিই? ডালটা আমি রোজই করি। সঙ্গে দুয়েকটা ভাজা। মাছ তো দেশের মতো পাওয়া যায় না, আর যা দাম, বাব্বা। মাংসও ঐরকম। খাসির মাংস দেশের মতো কোথায় পাবো? তারপরে টিনটিন খুব ডাল ভালোবাসে।
    টিনটিন?
    ছেলে। ইন্টারন্যাশানাল স্কুলে যাচ্ছে। এখন এই ক্লাস ওয়ান হোলো। মেয়েটা ওর ছোটো। এখোন প্লেস্কুলে দেবার ইচ্ছে আছে। আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না। আচ্ছা ফোনটা বাজল মনে হোলো না? আপনি কি শুনতে পেলেন?
    না, কিছু শুনতে পাইনি তো
    দাঁড়ান ফোনটা এখানে কাছে এনে রাখি।

    না কোনো ফোন আসেনি। আসলে ফ্ল্যাটটা খুব বড়ো তো ঐ .. ও ই দিকের ঘরটায় মোবাইল বাজলে এখান থেকে শোনা যায় না। একবার তো ব্যাটারি লো হয়ে গিয়ে ফোনটা কোথায় লুকিয়ে গিয়েছিলো। আচ্ছা আপনি এমনিতে লাঞ্চে কী খান? বাইরে খান নিশ্চই? নাকি বাড়ি গিয়ে? ছুটির দিনে নিশ্চই রান্না করে খান? হ্যাঁ রোজ রোজ লাঞ্চে বাড়ি গিয়ে কেমন করে খাবেন। আপনি তো জব করেন। সার্ভিস। আমিও আগে সার্ভিস করতাম জানেন তো? ও বলেনি আপনাকে?
    আমার সঙ্গে তো জাস্ট অল্প কথা কথা হয়েছে।
    তার মানে বলেনি। আমি এর আগে স্কুলে পড়িয়েছি। দিল্লীতে যখন ছিলাম স্কুলে পড়াতাম। বাচ্চা হবার পরেও কন্টিনিউ করেছি। তারপরে একটার পর একটা ট্রান্সফার। দুবছর তিনবছর পরপরই তল্পিতল্পা গুটিয়ে নতুন জায়গায় চলো।
    দারুন তো!
    হ্যাঁ দারুন। এমনিতে অনেক দেশ দেখা হয়। সমস্তই গর্মেন্ট থেকে অ্যারেঞ্জ করে দেয় জিনিষপত্র লাগেজ ফ্ল্যাট বাচ্চাদের স্কুল টুল থাকলে।
    বেড়ান না? কত কি দেখবার আছে?
    হ্যাঁ বেড়াই তো। ছুটি দিন হলেই আগে খুব বেড়াতাম, এখন মেয়েটা হয়ে গিয়ে, আচ্ছা আপনি হাতটা ধুয়ে আসুন তারপরে একটা জিনিস খাওয়াবো। আইসক্রীম খান তো? এটা নতুন টেস্ট। লেবুর টেস্ট খেয়েছেন এর আগে?
    খাইনি।
    একী! না না ছি ছি একদম বাসনে হাত দেবেন্না আমি তুলে নেবো দুটো তো মাত্র প্লেট। বাকী সব ঢুকে যাবে ফ্রীজে।

    আপনারা তো বাইরে বেরোন কত কি খান, হয়তো খেয়েও থাকতে পারেন। কেম্নি একটু গলে গলে যাচ্ছে না? আমি কিন্তু এই ডীপফ্রীজ থেকে বার করলাম আপনি যখন হাত ধুতে গেস্‌লেন।
    না এটা আমি খাইনি। কী লেখা রয়েছে বাক্সের গায়ে? 
    সর্বেট্‌। নতুন টাইপের আইসক্রীম না? আমার কিন্তু বেশ ভালোই লাগছে টেস্টটা। চলুননা ঐ ওখানে সোফায় বসে খাই। আপনি কী সার্ভিস করেন? কম্পিউটার? কীরকম স্যালারি দেয়?
    বাঃ এখান থেকে তো বাইরের অপূর্ব ভিউ পাওয়া যায়।
    হ্যাঁ সারাক্ষন তো ঐ ভিউ ই দেখছি। দাঁড়ান অ্যালবামটা নিয়ে আসি।
     
    এগুলো সব হচ্ছে এখানকার ফোটো, এই লাস্ট এক দেড় বছরের। শুটিং খুব হয়তো, সব ফিল্মস্টারের সঙ্গেই তুলেছি।
    হবি?
    হ্যাঁ ঐ আরকি। শুটিং হচ্ছে খবর পেলেই চলে যেতাম, তারপরে একটু কাছে গিয়ে রিকোয়েস্ট করলে পাশে দাঁড়িয়ে ফোটো তুলতে দেয়। এই যে এগুলো মাধুরী, অনিল কাপুরের সঙ্গে অনেকগুলো আছে, ঋষি কাপুরের সঙ্গে যেগুলো ছিলো ওগুলো বোধয় এখন নেই দেশে রেখে এসেছি লাস্টবারে যখন গেলাম। প্রীটি জিন্টা খুব ভালো জানেন তো? রিকোয়েস্টও করতে হয় না, নিজেই ডেকে নেয়, বলে তোলো, আরেকটা তোলো। কি মিষ্টি না? নিজে নিজেই পোজ দেয়, আলগা হয়ে থাকে না, ও নিজেই আপনার কাঁধে হাতে দিয়ে দাঁড়াবে। এইখানে এটা খুব লাভ হয়েছে অনেক ফিল্মস্টারের সঙ্গে ফোটো তুলেছি। 
    অন্যদেশে যেখানে থাকতেন সেখানে হিন্দি সিনেমার শুটিং হোতো না?
    না। কোথায়? বেইরুটে সিনেমার শুটিং কোথায়? সেখানে তো অন্য শুটিং, খুব ট্রাব্‌ল্‌ড্‌ জায়গা। তবে আপনি হয়তো ভাবছেন সবসময় মারামারি যেমন দেখায় আরকি টিভিতে সেরকম কিন্তু নয়, অন্তত আমরা সেরকম কোনো ঝামেলা পাইনি। খুব সুন্দর দেশ লেবানন। মানে মিড্‌ল্‌ ইস্ট বলতেই যে ছবিটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তেমনটা নয়। আচ্ছা এখন কটা বাজল?
    দুটো প্রায়।
    ও তাহলে ঠিক আছে। আসলে বাচ্চারা আসবে সাড়ে তিনটেয়। কোনো কোনো দিন পোনে চারটে চারটেও হয়ে যায়। একটা আসবে ক্রেশ থেকে, অন্যটা স্কুলের পরে ঐ ওখান থেকেই ক্রেশ হয়ে, নীচের ফ্লোরের একটা ফ্যামিলি আছে ওরাই নিয়ে আসে, ওদের বাচ্চারাও যায়। শুনুন না, ঐ বেইরুটে যখন ছিলাম.. আচ্ছা আপনার কি টায়ার্ড লাগছে? দুপুরে ঘুমোনোর ওব্যেশ আছে? ও না, আপনি তো সার্ভিস করেন। আমিও দুপুরে ঘুমোই না। এখন তো তাও মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি, ওয়েটটা বেড়ে যাচ্ছে।
    কই না তো! আপনার তো দিব্যি স্লীম ফিগার।
    ধুস্‌ কী যে বলেন। আগে একদম পাতলা রোগা ছিলাম। বিয়ের আগে, মেয়ে হবার আগে অবধি। সেসব ফোটো, দাঁড়ান অন্য অ্যালবামে আছে বোধয় খুঁজে দেখতে হবে, হয় বাচ্চাদের ঘরে নাহলে কোলকাতায় রেখে এসেছি, এখন খুঁজতে গেলে আপনি বোর হয়ে যাবেন। যখন জব করতাম তখন তো ঘুমোনোর প্রশ্নই ছিলো না। আচ্ছা আপনি আমাকে একটা চাকরি খুঁজে দিন না। আপনার তো অফিস টফিসে অনেক চেনাজানা আছে।
     
    এখন দিন ছোটো হয়ে যাচ্ছে তো, বিকেল বলে তেমন কিছু নেই ঝপ্‌ করে সন্ধ্যে হয়ে যাবে, লেবাননে কিন্তু অ্যাতটা তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয় না। ওয়েদারটাও খুব ভালো পেয়েছি। সী বীচ্‌ আছে, এই অ্যাতটুকুটুকু ড্রেস পরে মেয়েরা ঘোরে। খুব স্মার্ট খুব ফ্যাশনেবল। ওটাকে তো মীড্‌ল্‌ ইস্টের প্যারিস বলে। ফ্রেঞ্চে কথা বলছে, অ্যারাবিকের মধ্যেও আবার ফ্রেঞ্চ মেশানো।
    আপনি বলতে পারেন?
    কী? ফ্রেঞ্চ না অ্যারাবিক? না বাবা। তখন কিছু শব্দ বুঝতাম। ইংলিশ ওখানেও চলে তবে খুব অল্প।
    লোকাল ভাষা শেখাটা তবে দরকারি নয় ওখানে?
    সে লাগতে পারে, যারা জব করছে তাদের লাগে। ইন্ডিয়ানদের মধ্যে একজনকে জানি যে ফ্লুয়েন্ট অ্যারাবিক বলতে পারতো। সে কিন্তু এমনিতে একদম নিরক্ষর প্রায়। অবাক লাগছে না? সে একটা পাঞ্জাবী মেয়ে। মেয়ে মানে বৌ। দাঁড়ান কাপড়গুলো ব্যালকনিতে রেখে এসেছি, এখন ঘরে না তুললে আর শুকোবে না।
     
    এই একটা ঝামেলা এখানে জানেন তো বাইরে কাপড় শুকুদ্দিয়েসে একবার ভুলে গেলে সব আবার ভিজে ন্যাতা হয়ে যাবে। লেবাননে এই সব ঝামেলাই ছিলো না। কাজের লোক পাওয়া যায়, আঙুল নাড়িয়ে কাজ করানো যায়। এখানে ওসব ভুলে যান। অফিস থেকে এসবের অ্যালাওয়েন্সই দেবে না। ঐ যে পাঞ্জাবী বৌটার কথা বললাম, বেইরুটে সেই বৌটা টানা চারমাস ছিলো আমাদের বাড়ীতে। চারমাসের আরো বেশি হবে। পাঁচমাসের ওপরে ছিলো। আমি তো তখন খুব অসুস্থ।
    অসুস্থ ছিলেন?
    হ্যাঁ ঐ মেয়ে হবার আগে শরীর খুব খারাপ পুরো বেডরেস্ট। তারপরে মেয়ে হবার পরেও শরীর খুব খারাপ গেছে। শুধু বিছানায় শুয়ে থাকতাম। উঠে দাঁড়াবার শক্তি ছিলো না। টিনটিনও খুবই ছোটো তখন, এই মনে করুন তিন সাড়ে তিন বছর আগের কথা বলছি। এমনিতে রান্নাবান্না ঘরের সমস্ত কাজ, তার ওপরে আমার ঐ অবস্থা। ছেলেও তখন প্রচন্ড দুষ্টু হয়ে গেছে, এক মুহূর্ত সামালানো যাচ্ছে না। তখন এম্ব্যাসী থেকেই ওরা খবর দিলো যে একটা লোক পাওয়া গেছে। খুবই নিডি মেয়ে। এম্ব্যাসীতে সাহায্য চাইতে এসেছিলো, তখন ওরাই আমাদের কন্‌ট্যাক্ট করে বলে নেবো কিনা। মেয়েটা খুব কাজের ছিলো। পরিশ্রমী। এমনিতে রান্নাবান্নার কাজ বেশি নয়, ওসব দেশে তো কিচেন অ্যাপ্লায়েন্স খুব ভালো। খুব মডার্ণ কিচেন। আরব দেশের মেয়েদের কিচেনের সব যন্ত্রপাতি দেখলে না আপনার তাক লেগে যাবে। কত্ত রকমের ফুড প্রোসেসার গ্রাইন্ডার ওভেন, মানে কী নেই? এসব দেশে সে তুলনায় কিচেনে আদ্দেক জিনিসই নেই। এরা তো রান্নাবান্নাই তেমন করে না। লেবাননে মেয়েরা খুব ভালোভালো রান্না করে, খুব যত্ন নেয় রান্নায়। আর ভীষন বিউটি কন্‌শাস্‌। ঐ পাঞ্জাবী মেয়েটাও ছিলো খুব স্টাইলিশ্‌। ভুরু প্লাক করা, নেলপালিশ, ক্রীম মেকাপ, চুলের স্টাইল, সবসময় সেজেগুজে ফিট্‌ফাট্‌। রান্নাটাও ভালো করত। তখন আমার রীচ্‌ খাবার খাওয়া একদম বারণ। কিন্তু ওর কাছে শুনেছি রান্না ভালো করত। লেবানিজরাও তো অনেক মশলা খায়। আমাদের মতো খায় না যদিও। আপনি বিকেলে চায়ের সঙ্গে কী খাবেন? মুড়ি মাখব? আমার কাছে মুড়ির মশলা আছে কিন্তু।
    আরে না না আবার এখন চা কেন? সবে তো ভাত খেলাম, আপনি বসুন তো।
    সেই মেয়েটাকে একটা আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছিলো। এমনিতে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কিন্তু কি স্যাড লাইফ। মানে এমনিতে ম্যারেড। পাঞ্জাবের গ্রাম টাম থেকে এসেছে। স্বাস্থ্য ভালো দেখতেও মোটামুটি - মানে খারাপ নয়। কিন্তু লেখাপড়া শেখেনি। তারপরে যা হয় ওর হাসবেন্ডই ব্যবস্থা করে ওকে মিড্‌ল্‌ ইস্টে একটা কাজ করতে পাঠায়। সৌদিতে। 
    কীরকম কাজ?
    কীরকম কাজ আবার হবে? অশিক্ষিত তো। ঐ সার্ভেন্ট মেইড এইসবই হবে কিছু। মানে ওর হাসবেন্ডই দালাল ফালালের থ্রু ব্যবস্থা করেছিলো। খরচও করেছিলো। কিন্তু ওকে দিয়ে ওরা অন্য কাজ করাতো। মারতো। অন্য কাজ মানে প্রস্‌টিটিউশান। খেতে দিতো না, বন্ধ করে রাখতো। হাসবেন্ডের সঙ্গে কোনো কন্‌ট্যাক্‌টই করতে পারছিলো না। কয়েক বছর পরে ও সেই চক্র থেকে পালায়। কীরকম করে জানি পালিয়ে প্রথমে আরেকটা দেশে গেছল, জর্ডন মনে হয়। তারপরে সেখান থেকে লেবানন। কীরকম চালু মেয়ে ভেবে দেখুন। আমি টুক করে চায়ের জলটা চাপিয়ে আসি।
     
    আরবী ভাষা শিখে গেল?
    গেল। ওতো যেসব লোকেদের সঙ্গে মিশতো তারা তো... মানে ওর কাস্টমাররা তো আর হিন্দি বলবে না। ঐ ভাষাটা জানত বলেই ওর আরো সুবিধে হয়েছে লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে লেবাননে আসবার। মানে কল্পনা করতে পারবেন না। পাসপোর্ট পর্যন্ত নেই। তারপরে বেইরুটের এম্ব্যাসীতে এসে বলছে আমায় দেশে পাঠিয়ে দাও। তখন ইন্ডিয়ান গর্মেন্টের থ্রু খোঁজ খবর নেওয়া হোলো। যতদিন না ওর একটা ব্যবস্থা হচ্ছে ও কোথায় থাকবে? সেইজন্যেই আমরা থাকতে দিলাম আর কি। এসব কাজ তো একদিনে হয় না। সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এই যে আপনার পাসপোর্টে একটা ভুল জিনিস ছিলো দেখলেন তো সেটা ঠিক করতে কতো ঝামেলা?
    হ্যাঁ, কিন্তু আপনার হাসবেন্ড যেরকম হেল্প করলেন, সেরকম কোথাও দেখা যায় না।
    আচ্ছা শুনুন, আপনার আজ অফিস কামাই হোলো না? 
    আমিতো ছুটি নিয়েছি আগেই।
    ছুটি আগে থেকেই নেওয়া আছে? তবে যে ও বলল আপনার তাড়া আছে? কি জানি কী শুনেছি তখন। চা টা ঠিক হয়েছে?
    চমৎকার চা। আসাম?
    আসাম দার্জ্জিলিং মেশানো, এটা আমরা এম্ব্যাসী থেকে পাই। লেবাননে আবার চায়ের টেস্ট ফ্লেভার সব অন্যরকম। হ্যাঁ যা বলছিলাম, মেয়েটা জানেন তো আমাকে সব দেখিয়েছিলো, সারা গায়ে ভর্তি দাগ। মানে কী বলব আপনাকে - দেখে শিউরে উঠতে হয়। পিঠে তো আছেই, মানে কেটে গর্ত হয়ে হয়ে গেছে, পুড়িয়ে দিয়েছে, আরই কী কী করেছে কে জানে। সামনেও এমনকি ব্রেস্ট ফেস্টেও যাতা রকমের মারের দাগ। এমনি ড্রেস পরে থাকলে বাইরে থেকে কিচ্ছু বুঝতে পারবেন না। খারাপ লাগে। তারপরে ওর কাছ থেকে অ্যাড্রেস ফ্যাড্রেস নিয়ে দেখা গেল যে হ্যাঁ জেনুইন কেস, ও সত্যি সত্যিই ইন্ডিয়ান। তখন পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে দেখিয়ে আরেকটা পাসপোর্ট ইস্যু করে দেওয়া হোলো, ওর হাসবেন্ডকে কন্ট্যাক্ট করল এম্ব্যাসী সব জানিয়েই। মানে সে ওকে ফেরৎ নেবে কি না। কিন্তু হাসবেন্ড রাজি হোলো না ফেরৎ নিতে। রাজি হলে এম্ব্যাসী এরকম কেসে টিকিট কেটে দেশে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে পারত। কিন্তু ওর হাসবেন্ড বলছে - না, ওর ফিরে এসে কী হবে? মোটকথা ওকে আর ঘরে তুলতে চাইছে না। আসলে ওতো আর ঐ সমাজে ঠিক মানিয়ে নিতে পারবে না। এই সমস্ত কিছু জানবার পরে লোকটা বৌকে কীকরে অ্যাকসেপ্ট করবে? তার পরে ওর স্বভাব চরিত্রও পাল্টে গেছে। মানে কী বলব আপনাকে, আমি তো শুয়ে থাকি উঠতে পারি না, তার মধ্যেই দেখছি ও আমার দামী দামী সালোয়ার কামিজগুলো পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুটিকের জিনিস। অথচ ওকে কিন্তু দেওয়া হয়েছে। ও যখন এসেছিলো কিচ্ছু ছিলো না তো সঙ্গে? সমস্ত কাপড়জামা আমি নিজের আলমারি থেকে বের করে ওকে দিয়েছি। তা সত্ত্বেও আমার জিনিস বের করে পরেছে। ওর পরা জিনিস কি আমি আবার পরতে পারব বলুন? তারপরে আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, সেটা অনেক পরে। ওয়াশিং মেশিনে ওর জামাকাপড় আমাদের জামাকাপড় সব এক লটে ঢুকিয়ে দিয়ে কাচছে। জাস্ট চিন্তা করুন। মাথা গরম হয়ে যায় না? কোত্থেকে কী অসুখ নিয়ে এসেছে সেসব কি আমরা জানি? এই সমস্ত দেখবার পরে আমার হেল্‌থটা একটু রিকভার করতেই ওকে ছাড়িয়ে দিলাম। ওরও তখন আরেকটা ট্রানস্‌ফার ডিউ হয়ে গেছে। যেসব কাপড় জামা দিয়েছিলাম সেসব তো নিলই, সেইসঙ্গে দুশো ডলার দেওয়া হোলো পারিশ্রমিক বাবদ।
    তারপর?
    তারপরে তো আমরা প্যারিসে ছিলাম, মধ্যিখানে দিল্লীতে মাস দুয়েক। ও আচ্ছা ঐ মেয়েটার তারপরে কী হোলো তারপরে সেইটা জানতে চাচ্ছেন? আবার কোথাও গিয়ে নিজের ব্যবস্থা করে নেবে। সেসব ব্যাপারে সেয়ানা আছে।
     
    দেখেছেন কেমন করে সময় কেটে গেল? বাচ্চারা এসে গেল।
    হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি বাচ্চাদের দেখুন, আমাকে নিয়ে ভাববেন না।
    হ্যাঁ ওদের এখন খাবার করে দিই। আপনি আসুন না এদিকটায় রান্নাঘরে বসে বসেই কথা বলি। আচ্ছা আপনি অফ্‌টাইমে কী করেন? টিভি দেখেন? স্টোরি বুক্‌স্‌? এখানে তো টিভি প্রোগ্রাম সব জার্মানে নয় ফ্রেঞ্চে। গল্পের বই আগে পড়তাম না, এখনও বিশেষ মন দিতে পারি না। ম্যাগাজিন পড়তে ভালো লাগে। সেদিন একটা বই কিনলাম ইংলিশ বুকশপ থেকে- অ্যারেঞ্জ্‌ড্‌ ম্যারেজ।
    অ্যারেঞ্জ্‌ড্‌ ম্যারেজ?
    আমাদের নয়, ঐ বইটার নাম। আমাদের হচ্ছে ভাব করে বিয়ে। তারপরে বিয়ের ফাংশান টাংশান সবই আমাদের দুজনের বাড়ী থেকেই করেছে। কিন্তু বিয়েটা অ্যারেঞ্জ্‌ড্‌ ম্যারেজ নয়। ঐ বইটাতে অনেক ছোটোছোটো গল্প আছে, তার মধ্যে একটা গল্পে মিল পাই ঐ পাঞ্জাবী বৌটার। ঠিক হুবহু মিল নয় কিন্তু একটু ভাব আছে। আপনি পড়েননি না? আপনাকে দিতে পারতাম পড়তে কিন্তু ফেরৎ দিতে তো আবার এতদূরে আসতে হবে।
    ফেরৎ দেয়াটা সমস্যা নয়, বাই পোস্ট পাঠিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু আমার এখন বই পড়ার তেমন নেশা নেই। ভবিষ্যতে বইটা জোগাড় করে পড়ে নেবো।
  • যোষিতা | ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:২১741858
  • নতুন পাসপোর্ট পাবার আনন্দে মশগুল ছিলাম কটা দিন। সিঙ্গাপুরের মেয়েটার সঙ্গে দুপুরে একসঙ্গে খেতে বের হতাম। ওর নাম হেলেন। ওর স্বামী জার্মান। বছর তিনেক বিয়ে হয়েছে। হেলেন বেশ সুন্দরী। ওর মনটার জন্য আরও বেশি। ওরা পূর্বপুরুষরা মনে হয় ভারতের কেরালা থেকে সিঙ্গাপুরে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছিল। হেলেন ইমিগ্র্যান্টদের সমস্যা বোঝে। সিঙ্গাপুরে মান্দারিন ভাষা খুব ভালো না জানলে ডিসক্রিমিনেশন প্রচণ্ড। শুধু ইংরেজি জানলেই চলবে না। হেলেন অবশ্য চাকরিতে আমার সিনিয়র। বয়সে হয়তো আমরা কম বেশি সমান সমান। 
    এই সময়ে সেই কারখানার মতো দেখতে অফিস ছাড়বার পালা। নতুন অফিসে সবাই শিফট করব। নতুন অফিস দেখতে পুরো কর্পোরেট অফিসের মতো। সিনেমাতে যেমন দেখায়। সেখানেও এই সমস্ত সুবিধেই থাকবে। কেবল অনেকখানি সময় আমার কাটবে মাটির অনেক নীচে ডিমিলিটারাইজ জোনে। যেসব যন্ত্রপাতি নিয়ে আমার কাজ, সেটার জন্য ঐখানটাই সবচেয়ে নিরাপদ।
    এই কারখানা অফিসে যেখানে যন্ত্রপাতি ছিল, সেখানে সবার যাতায়াত। 
    আমার ইমিডিয়েট বস যিনি তিনি কাজ করেন বের্নের অফিস থেকে, মার্কো। মার্কো ডেফ্লোরিন। এর হবি প্লেন চালানো। ছুটির দিন কাটে তার ফ্লাইং ক্লাবেই বেশিরভাগ। 
    দুটো দিন আমাদের ছুটি দেওয়া হবে শিফটিং এর জন্য। যদিও নতুন অফিস এই পুরোন কারখানা থেকে মেরে কেটে একশো মিটার দূরে। 
    আমাকে ডেফ্লোরিন ডেকে নিয়ে গেছল সার্ভার রুমে। এমনি কথাবার্তা বলছিল। তারপরে এটা ওটা যন্ত্রপাতি ধরে ধরে দেখছিল। একজনের কাছে একটা ট্রলিব্যাগ চাইল, কোনো কোম্পানি থেকে গিফট এসেছে মনে হয়। তারপর বিশেষ কিছু হয় নি। আমি ওখান থেকে নিজের জায়গায় চলে এলাম। ও রয়ে গেল নাকি চলে গেল খেয়াল নেই। সম্ভবত অন্য কারো সঙ্গে কথা বলছিল। এটা বুধবার। বেস্পতি শুক্র অফিস নেই। সোমবারে নতুন অফিস। চারতলায় আমাদের ডিপার্টমেন্ট। গ্রাউন্ডফ্লোরে মানে একতলায় সেরকম কিছু নেই, ক্যান্টিনটা ঐখানেই। আমরা নিজ নিজ ক্যাডি নিয়ে বসবার জায়গায় সবকিছু গুছোচ্ছিলাম। ওপর থেকে বড়ো বড়ো কাচের দেয়াল দিয়ে বাইরেটা চমৎকার লাগছিল দেখতে। 
    সেদিনও ডেফ্লোরিন এসেছে জুরিখ অফিসে। আমাকে ডাকল আরও বড়ো বসের ঘরে॥ তার নামও মার্কো। সম্ভবত সুইস-ইতালিয়ান। তারপর বলল বুধবার থেকে একটা রাউটার গায়েব হয়ে গেছে পুরোন অফিসের সার্ভাররুম থেকে। আমি সেটা দেখেছি কি না।
    আমি দেখেছি মনে আছে। সবুজ রঙের রাউটারটা এক কোণে পড়ে থাকত। কিন্তু ওটা আমার কাজের জিনিস নয়। কেন বলুন তো?
    তুমি ছাড়া আর কে নিতে পারে?
    মানে?
    তুমি ওটা নিয়ে থাকলে ফেরৎ দিয়ে দাও।
    আমার মাথার ভেতরটা অদ্ভূত জ্বলতে থাকে। এদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছেই করে না। এরা রেসিস্ট আমি বুঝে গেছি। 
    আমি সম্ভবত বলেছিলাম, আপনারা এভাবে আমাকে ইনসাল্ট করতে পারেন না। প্রমাণ থাকলে পুলিশ ডাকুন। আমি রেডি।
    এই বলে আমি বেরিয়ে নিজের সীটে গিয়ে বসেছিলাম।
    রেসিস্টদের আমি চিনি। আমি ভারতবর্ষ থেকে এসেছি। এই ছক আমার চেনা। হায়! এ কোথায় এলাম আমি?
  • যোষিতা | ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:৫৮741859
  • দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে অভিশাপ বেরিয়ে আসে আমার মন থেকে। ধ্বংস হয়ে যাবি, তোরা ধ্বংস হয়ে যাবি।
    পশ্চিমের সভ্যতা আমাদের শিখিয়েছে এবং মানতে বাধ্য করেছে কতগুলো জিনিস, যেগুলো আমরা নিঃশর্তে ভক্তিভরে মেনে নিয়েছি। সেগুলোর একটা হচ্ছে, কান্না মানে উইকনেস। দুর্বলতা।
    হ্যাঁ, আমি দুর্বল। আমি চোখের দল আটকাতে পারি না। আমি সবল নই। আমি দুর্বল। দুর্বলের কি বেঁচে থাকার অধিকার নেই?
    আমার বসবার জায়গাটা একেবারে একটা কোণে, পেছনে দেয়াল, ডানপাশে কাচের দেয়াল। আমি হুহু করে কাঁদছি। আমাকে এরা চোর ভাবল? আমার গায়ের রঙ কালে বলে? আমি ভারতবর্ষ থেকে এতদূরে টাকা রোজগার করতে এসেছি বলে? ঐ রাউটার নিয়ে আমি করবটা কী? ওর পাসওয়ার্ডও আমার জানা নেই। ডেফ্লোরিন জানে পাসওয়ার্ড। চুরি করেছে নির্ঘাৎ ও নিজেই। মরুক গে! কিন্তু এতো ভয়ানক রেসিস্ট দেশ। এদেশের ভাষা আমি জানি না। মানুষজনের মনোভাব বুঝি না। হতে পারি আমি গরীব, তাই বলে চোর?
    আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দে হেলেন। ও বলল, কী হয়েছে?
    আমি কথা বলার মত অবস্থায় ছিলাম না। হেলেন বলল, চল, নীচে চল।
    লিফটে করে নেমে কাফেটেরিয়ায় এসে বসলাম। সেখানে কাজ করে যে মেয়েটি সে জিম্বাবুয়ের মেয়ে, যদিও এখন সুইস। সে আমাদের জন্য হট চকোলেট বানিয়ে দিয়ে যায়।
    আমি হেলেন কে সব বলি।
    হেলেন বলে, বাস্টার্ডস!
    বলে, বি স্ট্রং, কাঁদবে না। কাঁদলে তোমাকে উইক ভাববে ওরা।
    কী অদ্ভূত এই দুনিয়া! উইক বলেই তোমায় স্ট্রং রা এসে শেষ করে দেবে। শুধু ফাইট ফাইট ফাইট! আমি তো ফাইট করতে ভালোবাসি না। এমন নিয়ম কেন? পৃথিবীটাকি যুদ্ধক্ষেত্র?
    হেলেন একটু পরে আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে কিছু কথা বলে। জিজ্ঞাসা করে, তুমি অঙ্কে কেমন?
    কীরকম অঙ্ক?
    পাটিগণিত।
    মোটামুটি। কেন?
    বলোতো, চারশো কে পনের দিয়ে গুণ করলে কত হয়?
    ছহাজার।
    ভুল।
    কেন? চার পনেরোং ষাট, তারপর দুটো শূন্য, ছহাজার।
    না। আটহাজার পাঁচশো।
    তুমি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছ? হাসানোর জন্য?
    না যোষিতা। গত দু সপ্তাহ ধরে আমি ইন্টার্নাল অডিটের জন্য ফাইল চেক করে যাচ্ছি। আকছার এরকম সব হিসেব। এই হিসেব মেলানোর কাজ আমাকে দেওয়া হয়েছে। অসংখ্য এরকম হিসেব। জিনিস কেনা হয়েছে এরকমের হিসেবে।
    তাহলে তুমি কর্তৃপক্ষকে জানাও! 
    আমি আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছি। সে বলল, জানিয়ে কিছু হবে না। জানালে ভালো হবে না।
     
    সেদিন হেলেন আমাকে ড্রাইভ করে আমার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। 
  • যোষিতা | ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৬:৩৩741880
  • নতুন বিল্ডিংএ আমার অধিকাংশ কাজের সময়টুকুই কাটত ডিমিলিটারাইজড জোনে। সে জায়গা মাটির নীচের দ্বিতীয় লেভেলে। সে জায়গা ওপরের ঝাঁ চকচকে অফিস স্পেসের মত মসৃণ নয়। সেখানে মনুষ্যপ্রাণী বলতে আমি একাই। মাঝে সাঝে হয়ত করিডোরে ক্বচিৎ শব্দ পাওয়া যেতে পারে কোনও কর্মীর, যে কিনা ঝাড়পোঁছের জন্য এসেছে। এছাড়া চুপচাপ, লঘু ডেসিবেলে যন্ত্রের শব্দ, এবং ... এবং অদ্ভূতভাবে এই নিঃস্তব্ধতায় যখন আমার কান তৈরি হয়ে গেল সামান্য মৃদু কম্পনকেও চিনে নিতে, কাজের মধ্যেই শুনতে পেতাম জলের শব্দ। সে শব্দ কোনও ভূগর্ভস্থ নদীর তা হলফ করে বলা যায়। 
    এরকম ওয়ার্কপ্লেসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করলেও সময়ের হিসেব রাখা যায় না। বিকেলের দিকটা আমি উঠে আসি ভূপৃষ্ঠের ওপরে। তখন দেখা হয়ে যায় গশা, হেলেন, কিং ওয়াং দের সঙ্গে।
    এর মধ্যে আমার বসের বস ঠিক করলেন আমায় ওয়ার্কশপের জন্য জার্মানি পাঠাবেন। আবার ভিসার দরকার। সুইটজারল্যান্ড শেংগেনে নয়, তাই যেহেতু আমার ভারতীয় পাসপোর্ট, তাই ছুটতে হলো ভিসা নিতে বের্নের জার্মান এমব্যাসীতে। শুধু আমি নই, আমার অফিস থেকে যাবে আরও একটি মেয়ে সেই ওয়ার্কশপে। তার নাম উমা। উমা কালিদিন্দি।
    যাবার আগের দিন উমা এসেছিল আমার কাছে। পুরো ভারতীয় চেহারা, ইংরিজি অসম্ভব ভাল বলে। তা আমি বললাম, চল না, দুজনে একসঙ্গেই যাই।
    উমা বলল যে সে বাসেলে থাকে, বাসেল অফিসে কাজ করে, বাসেল থেকে সে ড্রাইভ করে চলে যাবে জার্মানি।
    অবশ্য আমার ট্রেনের টিকিট অফিসেই এনে দিল আমার সেক্রেটারি মেয়েটি, সঙ্গে হোটেলের বুকিং। পরদিন অফিসের পরই আমি ট্রেন ধরেছিলাম সরাসরি। রাতে পৌঁছলাম হাইডেলব্যার্গ শহরে। অনেধকার হলেও ট্যাক্সিতে যেতে যেতে বুঝছিলাম অপূর্ব সুন্দর এই শহর। একটা নদী পার হলাম। তারপর আমার হোটেল, ম্যারিয়ট। 
    হোটেলের রেস্টুরেন্ট তখন বন্ধ করে দিচ্ছে, দৌড়ে সেখানে ঢুকে ডিনার করব বলে খাবার অর্ডার করতে গেলে, তারা বলে, এখন তো কিছুই নেই... দাঁড়ান দেখে আসছি।
    একটাই খাবার এখন পাওয়া যাবে। হরিণের স্টেক।
    সেই প্রথম রেড ওয়াইন দিয়ে হরিণের মাংস খেলাম।
    পরদিন সকালে গাড়ি এলো, হোটেল থেকে চেকাউট করে চললাম কাছের একটা গ্রামে, সেখানেই ওয়ার্কশপ।
  • যোষিতা | ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:৩০741885
  • বারো বছর পরে আবার জার্মানি এসেছি। গেলবারের জার্মানি দর্শন এবং এবারের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। সেবার দেশটা ছিল দুটুকরো, বের্লিনের পাঁচিলের দুপাশে দুটো দেশের মধ্যে শত্রুতার সম্পর্ক ছিলো তখন। এখন জুড়ে গিয়ে ফের অখণ্ড জার্মানি। এরকম ভাঙা দেশ জুড়ে যাবার ঘটনা সত্যিই বিরল। ইয়েমেন জুড়ে গেছল, সেও প্রায় চোখে দেখা ঘটনা। দক্ষিণের সঙ্গে উত্তর ইয়েমেন জোড়া লেগে গেল গত শতাব্দীর শেষ দশকে।
    এবার হাইডেলবের্গে এসে নিজেকেই অন্যরকম লাগে। আগেরবারে ছিলাম ভীতু টুরিস্ট, পয়সাকড়ি সঙ্গে ছিল কম, এবারে কোম্পানির দেওয়া দামী ক্রেডিট কার্ড, ভালো হোটেল, ট্যাক্সি চড়ছি কোম্পানীর পয়সায়।
    সেদিন ঐ ওয়ার্কশপে এসে লাভের লাভ যেটা হলো, সেটা বেড়ানো, গালগল্প করা ছাড়া আর কিচ্ছু না। উমা সেদিন লাঞ্চব্রেকে পুরো মক্ষীরাণীর ভূমিকায় অবতীর্ণা। ওয়ার্কশপের বাকি পুরুষ পার্টিসিপেন্টরা তাকে গোল করে ঘিরে ধরে তার কথা শুনছে হাঁ করে। আমরা দুজনেই শুধু সুইটজারল্যাণ্ড থেকে এসেছি, বাকীরা সব জার্মানীরই নানান জায়গা থেকে। উমা চমৎকার জার্মান বলে, ওর বর জার্মান। তবুও জার্মান বলবার ফাঁকে ফাঁকে ও সুইচ করে যাচ্ছে ইংরিজিতে, সম্ভবতঃ আমার জন্য। আর যখন ইংরিজিতে সুইচ করছে, তখন ঐ ছেলেদের দল আরও মোহিত হয়ে যাচ্ছে ওর কথায়। জার্মানিতে ইংরিজি জানা লোকজনের বড়ই অভাব সেটা সেদিনই ভালো করে বুঝলাম।
    এই ওয়ার্কশপে যা যা শেখালো, তার একটাও নতুন নয় আমার কাছে। তবু ভালো লাগছিল এটা বুঝে, যে কোম্পানী পয়সা খরচ করে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কোর্স বা ওয়ার্কশপ করতে পাঠায়। এর আগে ভারতে কোনও কোম্পানী আমাকে পয়সা খরচ করে কোর্স করায় নি। নিজে নিজে কাজ করতে করতে ঠেকে ঠেকে শিখতে হয়েছে।
    উমা আমার সঙ্গেও অনেক গল্প করল বিকেলে ওয়ার্কশপ শেষ হবার পরে। ওর জন্ম ও শৈশব ভারতের হায়দারাবাদে। মাতৃভাষা তেলুগু হলেও, ও সেই ভাষা ভুলে গেছে। বারো বছর বয়সে বাবার কাছে চলে যায় ইংল্যান্ডে। বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে গেছল, ছোটো ভাই মায়ের কাছে রয়ে গেল। উমা ইংল্যান্ডে ইস্কুলের পড়া শেষ করে সম্ভবতঃ জার্মানিতে কিছু একটা পড়তে গেছল, হয়ত ভাষা, ও খুলে কিছু বলেনি, তারপরে জার্মানিতেই প্রেম, পরে ইদানীং বিয়ে করেছে। ও আমারই মতো এই দুহাজার একেই জয়েন করেছে নতুন চাকরিতে। তবে ওর পদমর্যাদা আমার চেয়ে উঁচুতে। এতটুকু বলে, সে আমার কথা জানতে চাইল। আমি বললাম, যে আমিও অগস্টে জয়েন করেছি, দেশে ফেলে এসেছি বর এবং মেয়েকে।
    ও জানে যে আমি বাঙালি, আর বাঙালি শুনলেই লোকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করে বাংলাদেশি কি না। মানে বাংলাদেশ থেকে এসেছি কি না। তখন অদ্ভূত লাগে, বলছি যে আমি ভারতীয়, তবে বারবার এমন যাচাই করা কেন? যদিও মুখে তা প্রকাশ করি না। কেবল জিজ্ঞাসা করতে থাকে, তোমরা তো বর্ডার স্টেট তাই না? তোমাদের ওখানে ঝামেলা হয় না?

    - ঝামেলা মানে?
    - বর্ডার অঞ্চলে বাংলাদেশ থেকে মুসলিমরা প্রবলেম ক্রিয়েট করে না?

    এরকম আজব প্রশ্ন আমি এর আগে কখনও শুনি নি। দিব্যি এটা ওটা সেটা নিয়ে গল্প হচ্ছিলো, খামোখা এসব কথা কেন? হতে পারো তুমি ব্রিটিশ নাগরিক, বা এখন নিশ্চয় জার্মান নাগরিক, তাই বলে আমাকে নিয়ে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য কেন?
    তবে এসব কথা মনের মধ্যেই রেখে দিলাম। তবে প্রশ্নটার কোনও উত্তর দিলাম না।
    বললাম, তুমি কখন ফিরবে আজ? গাড়িতে এসেছো, আজই কি ড্রাইভ করে ফিরে যাবে বাসেলে?
    উমা কেমন যেন চমকে গিয়ে বলে, না না, আমি এখন যাব না, পরে যাব, তুমি চলে যাও।
    অনেক বছর পরে জেনেছিলাম, ও আদৌ তখন সুইটজারল্যান্ডে থাকতই না। যদিও ছেলেদের কাছে ও বারবার বলছিলো বাসেলে থাকে। ও আসলে জার্মানিতেই থাকত, সুইস বর্ডার অঞ্চলে একটা গ্রামে।

    আসার পথে অন্য রুটে এসেছিলাম। ফিরবার সময়ে আর হাইডেলব্যার্গ নয়। ঐ গ্রামেরই স্টেশন থেকে কার্লসরুহে অবধি গিয়ে টেন পাল্টে বাসেল বর্ডার দিয়ে ঢুকে জুরিখ অবধি। সেই রাতে বাসেল বর্ডারে প্রথম অনুভব করলাম বর্ণবিদ্বেষ। ট্রেনের কামরায় বেছে বেছে কেবল আমারই পাসপোর্ট চেক হয়েছিল। সুইটজারল্যান্ডে।
    প্রথমদিকে তো ভাষা বুঝতাম না, তাই অনেক কিছুই বুঝতাম না। ক্রমশঃ ভাষা শিখছি, সেই সঙ্গে বুঝতে শুরু করেছি কথা বলার টোন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন