এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ঝরা শিউলির গন্ধ -- ৪

    Somnath mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ অক্টোবর ২০২৩ | ৩০৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)


  • সকালে হালকা মেঘ থাকলেও এখন আকাশ ঝকঝকে। শরতের এমনটাই দস্তুর। চারিদিকে যত বেনিয়মের বিশৃঙ্খলা, আকাশ তার থেকে আলাদা হয় কি করে ! আজ সকালেই এক সংবেদনশীল চিকিৎসক বন্ধু বার্তা পাঠিয়েছেন, তাঁর অধীনে থাকা সমস্ত অসুস্থ মানুষকে পুজোর এই আনন্দঘন মুহূর্তে সুস্থ করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে চান তিনি। এমন আন্তরিক অভীপ্সার কথা পড়ে মনটা খুব ভালো লাগছে। উৎসব মানে তো কেবল জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন নয়, আসলে এ হলো আমাদের আত্মশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ সময়। নিজেকে একটু ইতিবাচক ভাবনায় বদলে ফেললেই গোটা সমাজ বদলে যাবে। এ কিন্তু আমার আন্তরিক বিশ্বাসের কথা।

    আজ এই সকালে চারিদিক থেকে ভেসে আসছে নানা রকমের শব্দ। ভেসে আসছে পল্লীর আবাসিক সহনাগরিকদের উদ্দেশ্যে পুজো কমিটির সদস্যদের বিবিধ ঘোষণা। এখন‌ই মহাষ্টমীর মহাঞ্জলি শুরু হবে। আপনারা যারা মায়ের পায়ে অঞ্জলি নিবেদন করতে চান তাঁরা আমাদের মাতৃমণ্ডপে।এর‌ই খানিকটা সময় পরেই মাইকে ভেসে আসে পুরোহিত মশাইয়ের কন্ঠস্বর –

    ওঁম অপবিত্র: পবিত্রো বা
    সর্বাবস্থা্্ গতোহপি বা।
    য: স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষম্
    স বাহ্যাভ্যন্তর: শুচি:।
    ওঁম শুচি, ওঁম শুচি, ওঁম শুচি।।

    আমিও দূরাগত মাইকের শব্দ শুনে মনে মনে উচ্চারণ করি শুচি মন্ত্র। হে মাত: আমাদের পূর্ণ করো, শুদ্ধ করো,পূত পবিত্র করো। একটু পেছনে ফিরি।

    সেবার সপরিবারে গিয়েছি সুদূর দক্ষিণী রাজ্য কেরালায়। যেখানে আমাদের হোটেলটির অবস্থান তার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে নানান সম্প্রদায়ের প্রার্থনা স্থলগুলো – হিন্দু সম্প্রদায়ের বিষ্ণু মন্দির, খৃষ্টানদের চার্চ, মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদ, শিখ ধর্মাবলম্বীদের গুরুদ্বার। একেবারে উষালগ্নে এই উপাসনালয়গুলো থেকে একে একে ভেসে আসতো প্রভাতী প্রার্থনার সুর। মিলনের মহামন্ত্র ধ্বনি। ভীষণ ভালো লাগতো সেই সময়ে। সবার প্রার্থনার সুর মিলেমিশে একাকার। ভারতীয় যাপনের এইটিই যে মহামন্ত্র। একে ভুলে গেলেই বিসম্বাদ। যতক্ষণ নিজের খাতের মধ্য দিয়ে নদী ব‌ইছে ততক্ষণই তার স্বাতন্ত্র্যর গরিমা।যেই নদী গিয়ে সাগরে মিশে যায় তখন তার আলাদা পরিচিতিও বেমালুম হারিয়ে যায়। আমাদের মহামিলনের মন্ত্র জপতে হবে কয়মনোবাক্যে। তবেই না চিত্তশুদ্ধি, আত্মশুদ্ধি, জীবনশুদ্ধি। শাকম্ভরী শারদার আবাহন মন্ত্রেও যে তেমনই যাচনা নিহিত আছে। কেরালা ভ্রমণের সময় এমন পবিত্র মুহূর্তটির কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে কয়েকটি পঙক্তি লিখেছিলাম।

    হে মানবপুত্র!
    আজ পবিত্র হ‌ও,
    ভোরের আজানের মতো,
    গীর্জার গম্ভীর ঘন্টাধ্বনির মতো,
    ধম্মপদের পুণ্যশ্লোকের মতো
    গুরু বাণীর প্রার্থনার মতো
    যজ্ঞের অনলের মতো,
    পবিত্র হ‌ও মানবপুত্র —
    পবিত্র হ‌ও।



    বেলা বেড়েছে। অঞ্জলি মন্ত্রের পরিবর্তে এখন ধীর লয়ে ভেসে আসছে ঢাকের শব্দ। এই অবনদ্ধ বাদ্য যন্ত্র ছাড়া দেবীর আরাধনা পর্বটি বুঝি অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।

    তাই আজ আনন্দবাসরে সবার নিমন্ত্রণ। এবার আমাদের পাড়ায় ঢাক বাজাতে এসেছে হীরালাল দাস। বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপ‌ অঞ্চলে। গতবছর ঢাক নিয়ে গিয়েছিলো হলদিয়ায়। এবার এখানে। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে বছর বারোর ভাইপোটিকে,কলকাতা দেখাবে বলে। বললাম – অন্য সময় কী করা হয় ?

    হীরালাল উত্তর দেয়, "আমাদের সোদরবনের মাটিতে লুনের ভাগ বেশি, তাই চাষাবাদ তেমন জমেনা। সামান্য যা জমি আছে তাতে করে চাষবাস করে সারা বছরের খোরাক জোটাতে হিমসিম খেতে হয়। এখন গেরামে একশো দিনের কাজ‌ও বন্ধ।ওটা চালু থাকলে তবুও দুচার টাকা ঘরে আসে। এই ভরসায় তো আর হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা যায়না। ওই কোনোরকমে চলে যায় আর কি! এই পুজো পাব্বনের সিজিনে দুটো বাড়তি রোজগারের আশায় ঢাক কাঁধে বেইরে পরি।" হীরালাল আক্ষেপ করে বলে – কমিটির লোকজন প্রথমে যে টাকা দেবে বলে, পুজো মিটলেই সুর বদলে ফেলে। কি করবো বলেন? বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে তো আর হাতাহাতি করা যায়না। মেনে নিতে হয়।

    হীরালালের কিশোর বয়সি ভাইপোটির এতোসব বোঝার সময় হয়নি। তাই সে তার কাকার মুখের দিকে ক্লান্ত বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে থাকে।

    আর একটু পরেই সন্ধি লগ্নের মহাপূজা। অষ্টমী আর নবমী তিথির সংযুক্তির এই মহাক্ষণ বড়ো তাৎপর্যপূর্ণ। এই মিলন মুহূর্তে মা দুর্গা দেবী চামুণ্ডা রূপে পূজিতা হন। এই মাহেন্দ্রক্ষণেই দেবী চামুণ্ডা চণ্ড আর মুণ্ড নামের দুই অসুরকে নিধন করেন। খানিক পরেই মণ্ডপে মণ্ডপে জ্বলে উঠবে ১০৮টি প্রদীপ, দেবীর চরণে নিবেদিত হবে ১০৮টি শতদল। হীরালাল ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার ঢাক নিয়ে। আগামী আটচল্লিশ মিনিট ধরে চলবে অসুর দলনের পর্ব। হীরালালের ঢাকে সন্ধি পুজোর বোলচাল। হীরালালের ঢাক যেন বলতে চায় – মা গো আমাদের মনের আঁধার দূর করে দাও, দূর করে দাও সমস্ত বৈষম্য, অনাচার, অধর্ম। মা গো দূর করে দাও অপুষ্টি, অশিক্ষা, অজ্ঞানতা, অরাজকতা অসাম্য।এ রাই যে আমাদের কাছে সবথেকে বড়ো অসুর। হীরালালের ভাইপোর হাত থেকে কাঁসরটা নিয়ে ঢাকের তালে তালে সঙ্গত করতে থাকি। ওগুলো যে আমার‌ও চাওয়া মায়ের কাছে। সময় গড়াতেই জমে ওঠে আমাদের যুগলবন্দি। উপস্থিত সকলে মিলে চিৎকার করে জয়ধ্বনি দেয় – দুর্গা মাঈকি জয়। কাঁসর বাজাতে বাজাতে আমিও ওদের সুরে সুর মেলাই।

    মহাপূজা উপলক্ষে "ঝরা শিউলির গন্ধ" শীর্ষক নিবন্ধগুলো লেখা হয়েছে। এর আগে তিন কিস্তি প্রকাশ পেয়েছে। এইটি চতুর্থ কিস্তি। আগ্রহী পাঠকদের পূর্ববর্তী নিবন্ধগুলো পড়ে দেখার অনুরোধ রইলো।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ২৩ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:৩৫525038
  • ওঁ অপবিত্রো পবিত্রো বা--
  • উন্মেষ | 45.250.245.5 | ২৩ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:২০525044
  •  আপনার অভিজ্ঞতা লেখনীর গুনে খুব সাবলীল হয়েছে। আরও লিখুন। 
  • সপ্তর্ষি মিত্র | 2607:fea8:6c0:1e50:56a8:d1ff:1f65:6f8d | ২৩ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:২৪525046
  • ঝরা শিউলির gondho- চলুক
  • প্রসূন মজুমদার | 103.101.212.105 | ২৩ অক্টোবর ২০২৩ ১১:৪৫525052
  • কিস্তিতে হলেও প্রতিটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিস্তিমাত না করে কিস্তিতে চলুক! 
  • sarmistha lahiri | ২৩ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:২৮525072
  • শিউলি সত‍্যিই ঝরা ফুল। একে সযত্নে কুড়িয়ে নিতে হয়। এই ভাবে ছোট ছোট লেখা হলেও বিষয় ভাবনায় সমৃদ্ধ। একেও সযত্নে মনে গেঁথে নিতে হবে। 
  • ritabrata gupta | ২৪ অক্টোবর ২০২৩ ০০:২৯525088
  • অত্যন্ত সাবলীল গদ্য। অসাধারণ লেখা। পড়তে এতো ভাল লাগে, মন ছুঁয়ে যায় !
  • সৌম্যদীপ সাহা রায় | 2409:4060:a:e828:9907:d580:29bf:a90e | ২৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:১৪525105
  • কি ভালো যে লাগলো লেখাটি পড়ে!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন