সার দিয়ে পিঁপড়ের মত মানুষ চলছে, বুড়ো থেকে বাচ্চা, লটবহর মাথায় নিয়ে, কেউ কেউ গরুও সাথে নিয়েছে। সামনে একটা কাঁটাতারের বেড়া, তাতে আটকে থাকা একটা ছেঁড়া ঘুড়ি দমকা হাওয়ায় ফড়ফড় শব্দ করছে, উড়তে পারছে না। আর নেপথ্যে ফিরে ফিরে আসছে একটা গানের ধুয়ো - “মোদের কোনও দিশা নাই, মোদের কোনও দেশ নাই…”
কমলেশ্বর মুখার্জি পরিচালিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’র (২০১৩) দৃশ্য। ঋত্বিক ঘটকের জীবনের অংশ নিয়ে তৈরি ছবির দৃশ্য। দেশভাগ হওয়ার পরবর্তী জীবনের দৃশ্য।
এ না হয় ছায়াছবির দৃশ্য। আসলে কেমন ছিল ১৯৪৭-এর আগস্ট? কেউ উদযাপন করছিল সদ্য পাওয়া স্বাধীনতা দিবস বিনা পয়সায় বাসে চড়ে আর ফ্রিতে সিনেমা দেখে, আর কারও কাছে সে দিন ভরা ছিল জন্মভূমি হারানোর বেদনায়।
এমন একটা সময় ঘিরে কাজ করেছে নানা ধরনের আবেগ, কাউকে মনের দুঃখ মনে চেপে রেখে তুলতে হয়েছে পাকিস্তানের পতাকা, আবার কেউ কেউ আনন্দিত হয়েছে কিছু অসামান্য গুজব শুনে আর তাকে সত্যি ভেবে।
কিছু দিন আগে সাহিত্যিক শংকর আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এক অনুষ্ঠানে বলছিলেন সেই সময়ের কথা।
“নানারকম গুজব রটেছিল, জানেন? কিছু ভাল খবর ছিল। প্রথম যেটা ভাল খবর বেরোল সেটা হল আর থানা বলে কিছু থাকবে না। সব থানাই ইস্কুল হয়ে যাবে। তারপর শোনা গেল পরীক্ষা বলে কোনও জিনিস আর থাকবে না। রটে গেছিল আনন্দবাজার আর স্টেটসম্যান পত্রিকা সেদিন নাকি বিনা পয়সায় দেওয়া হবে। কাগজ নিতে গিয়ে দেখা গেল মোটেই তা নয়। তবে কাগজওয়ালা জানাল এখন কিনে রাখ, পরে এর দাম হবে খুব। শুনেছিলাম খাবারের দোকানে সব ফ্রি, দুলালচন্দ্র ঘোষের দোকানে গিয়ে দেখা গেল ফ্রি তো নয়ই, বরং সাইজ ছোট হয়ে গেছে। রিক্সাওয়ালা ডবল ভাড়া চাইল,” বলছিলেন শংকর, ১৯৪৭-এ যাঁর বয়স ছিল ১৪ বছর।
তবে সবই তো আর খারাপ হয় না, ভাল কিছু থেকেই যায়।
“শেষ পর্যন্ত একটা বাসে উঠলাম, সেখানে পয়সা নিল না। বাসে করে হাওড়া স্টেশনে এলাম। সেখান থেকে আর একটা বাস ধরে সিনেমা হলে চলে এলাম, সেখানে বিরাট ভিড়, টিকিট লাগছে না। কী সিনেমা মনে নেই। সিনেমা দেখে সেখান থেকে গেলাম লাটসাহেবের বাড়ি, সেখানে বেজায় ভিড়। সব লোক ঢুকে পড়েছে। তাই বিনা পয়সার বাসে করে চলে গেলাম বেলেঘাটা গান্ধী আশ্রমে। উনি তখন ওখানেই ছিলেন,” বললেন শংকর।
হাওড়ার বাসিন্দা ছিলেন বলে অন্য অনেকের মত বাস্তুচ্যুত হওয়ার যন্ত্রণা ওনাকে পেতে হয়নি, তবে ওই ১৯৪৭-এই বাবাকে হারান শংকর আর পথে নামতে হয় রোজগারের সন্ধানে, যে বন্ধুর পথ আর সেই পথের বাঁকের বন্ধুরা তাঁকে ভবিষ্যতে কলম ধরতে শেখাবে।
পথ কি কেবল একই রকম হয়? তা তো নয়। পথের প্রান্তে হারিয়ে যায় ছোট বেলার স্বপ্ন, কৈশোরের জন্মভূমি।
“আমার জন্মভূমি বলতে কয়েকটা টিনের ঘর, মাটির ভিটি, একটা পাকা ভিটি ছিল। কিছু গাছপালা, পুকুর, আর আদিগন্ত প্রকৃতি… সামনে বিখ্যাত ব্রহ্মপুত্র, ব্রিজ, কদম গাছ, একটা সাইকেল… এই সমস্ত মিলেমিশে আমার ছোট্ট দেশ। সম্পন্ন নয়, খুব তুচ্ছ কিছু জিনিস, মহার্ঘ নয়, কিন্তু বড্ড মায়াময়। এ যার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়, যখন সে ছিন্নমূল হয়… তখন যে বেদনা, রাগ ক্রোধ জন্মায়… সে ক্রোধ এখনও আমার ভেতরে ভেতরে আছে। তাকে দমন করে রাখি, ঝাঁপিতে ভরা সাপের মত। আমি তো একা নই, আমার মত লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি লোক আছে…।”
শীর্ষেন্দুর স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে ফিরে আসে সেই মানুষরা যাঁরা নিজেদের ঘরবাড়ি, নিজেদের দেশ, সব ফেলে রেখে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন অচেনা জায়গায়, অজানা ভবিষতের পথে। “মোদের কোনও দিশা নাই, মোদের কোনও দেশ নাই…”
সেই উৎখাতের স্মৃতি এখনও, ৮৭ বছর বয়সে এসেও শীর্ষেন্দুকে তাড়া করে। “এই বয়সেও আমার মনে হয় আমার জীবন থেকে একটা কিছু খসে গেছে। এই ট্রাজিক ঘটনাটা সে বুঝতে পারবে না যে তার মাতৃভূমিকে হারায়নি। এটা যখন হল তখন মনে হয়েছিল এসব কারা করে? দেশ স্বাধীন হল এটা ঠিক, কিন্তু কোটি কোটি মানুষ ঘরছাড়া হল, উদ্বাস্তু হল। জন্মভূমি থেকে উৎখাত হয়ে গেল…।”
মৈমনসিংহে বাড়ি ছিল তাঁর। কারোর কলমের এক খোঁচায় ভারত নামের দেশের এক ভাগ হয়ে গেল পাকিস্তান, যার জন্ম হল ১৪ আগস্ট, ১৯৪৭।
“আমার তখন ১১ সাড়ে ১১ বছর বয়স। আমার মা-বাবা, আমার ছোট ছোট ভাই-বোন সব চলে গেছে ভারতে। কেবল আমি রয়ে গেছি, আমার দিদি, আমার ঠাকুমা আর দাদা। চুপচাপ বসে আছি, একজন এলেন বাড়িতে, এসে বললেন ফ্ল্যাগ তোলস নাই ক্যান? ফ্ল্যাগ তুলতে হবে সেটা মাথায় ছিল না, সেটা পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ। উনি বললেন ফ্ল্যাগ পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সেই সবুজ পতাকা তুললাম। বেরোলাম শহরের আনন্দ উৎসব দেখতে। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে পরেছে। নতুন জামাকাপড় পরা, বোম ফাটছে পর পর। চারদিকে লোকের মুখে হাসি, আর তাদের মাঝে কোথায় যেন আমি একা। বিরাট নিঃসঙ্গতা আমাকে পেয়ে বসেছে। সারা শহর ঘুরে বেরাচ্ছি, মন ভাল নেই।”
মন ভাল থাকার কথাও নয়, আমাদের মনে পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা যেখানে এক সাঁকোর কথা বলা হয়েছে। ঊরু ডোবা জলে ভরা, ধনুকের মত বাঁকা পড়শি নদীটির ওপর সেই “সাঁকোটা দুলছে এই আমি তোর কাছে…”
কিন্তু কেন এই বিশেষ দিনটি স্থির হল? অন্য কোনও দিন কেন নয়? শংকর জানালেন আরও এক অদ্ভুত তথ্য।
“কুষ্ঠি যারা দেখে, তারা বলেছে ১৫ আগস্ট খুব খারাপ দিন… খুব অপয়া দিন। কেন অপয়া দিন? কারণ ওটা মাউন্টব্যাটেন ঠিক করে দিয়েছে। কেন মাউন্টব্যাটেন ঠিক করল? কারণ ওটা নাকি ওনার জন্য খুব পয়া দিন। কেন পয়া দিন? না, ওই দিন জাপান আত্মসমর্পন করেছিল (১৯৪৫ সালে)। উনি নাকি ভেবেছিলেন একই দিনেই দুটো থাকুক।”
একই দিনে দুটো দিন থাকল, একই দেশ দু-ভাগ হল।
“কয়েক মাস পরে আমরা সে দেশ ছেড়ে চলেও এলাম। এটা জেনে যে ওই ব্রহ্মপুত্রের ধারে আমার ছায়া আর কখনও পড়বে না, কদম গাছে ফুল আর কখনও পাড়ব না। করমচা গাছ থেকে করমচা, পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা… (আর কখনও পাড়ব না) , ওই পুকুরে সাঁতার, ওই ব্রহ্মপুত্রে সাঁতার… সব শেষ হয়ে গেল। আমার শৈশব ওইখানেই রয়ে গেল…।”
বলছিলেন শীর্ষেন্দু, টাটা স্টিল কলকাতা লিটেরারি মিট-এ। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের শ্বেতপাথরের দেওয়াল, সবুজ লন আর ফোয়ারার জল ছাপিয়ে তাঁর মন যেন চলে যাচ্ছিল অনেক অনেক দূরে, সাত দশক পেরিয়ে যার দিশা আর পাওয়া যায় না…
(‘৪৭-এর সেই আগস্ট’ শীর্ষক এই সভায় ২১ জানুয়ারি ২০২৩-এ দুই সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার বিজয়ী লেখক ছাড়াও ছিলেন সাংবাদিক সেমন্তী ঘোষ। সঞ্চালনা করছিলেন লেখক-শিক্ষাবিদ অপরাজিতা দাসগুপ্ত। সঙ্গের ছবিটি লেখকের তোলা)