ভারতে যখন ১৯৫৪ সালে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট চালু হয়, তখন তার বিরুদ্ধে প্রচুর প্রতিবাদ হয়। মাদ্রাজ হাইকোর্টে মামলা হয়, এবং ১৯৫৫ সালে মামলার রায়ে জানানো হয় স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট আইনবিরুদ্ধ। পরে সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টের সমর্থনে রায় দেয়। মুসলিম গোষ্ঠীগুলো ঐ মামলা করেছিল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদও বরাবরই স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টের বিরুদ্ধে সরব, এবং ২০১৯এ তারাও এই নিয়ে মামলা করে।
স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট নিয়ে এত চুলকানির কারণ হল এটা আন্তঃধর্ম বিবাহের অনুমোদন দেয়। ধর্মান্তর না করেও অন্য ধর্মের মানুষকে বিয়ে করার সুবিধা দেয়। এমনকি একই ধর্মের দুজন লোক স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করতে পারে। সেক্ষেত্রে সুবিধা হল নিজের ধর্মের রীতিনীতি বাইপাস করা যায়। সম্প্রতি কেরলে এক মুসলিম দম্পতি নিজেদের বিয়ে ভেঙে তালাক নিয়ে একে অপরকে পুনর্বিবাহ করেছেন স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে। কারণ, তাদের দুজন সন্তানই কন্যা সন্তান, অতএব মুসলিম বিবাহ আইন অনুযায়ী কন্যারা সম্পত্তির পূর্ণাঙ্গ উত্তরসূরি হতে পারবে না, ভাইপোরাও সম্পত্তির একটা বড় অংশ পাবে। স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে পুনর্বিবাহের ফলে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন খাটবে না এক্ষেত্রে। বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টের প্রতি বিদ্বেষের কারণ বোধগম্য।
দুজনেই হিন্দু এমন অনেকেও স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করেছেন, একাধিক কারণে। যেমন, ধর্মীয় বিয়ের রীতিনীতি তাদের লিঙ্গবৈষম্যকর মনে হয়েছে, বা অকারণ দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল মনে হয়েছে। সামাজিক বিয়ে না হলে কিন্তু হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টের বিয়ে কার্যকর হয় না।
এবার একটা মজার বিষয় বলি। আসলে মজার না, ভয়ের ব্যাপার। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এখন শিখে গেছে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টকে কীভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা যায়। ওরা বিভিন্ন কোর্টের নোটিশ বোর্ড থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। কীসের? বিয়ের। স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করলে কোর্টে নোটিশ টানিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক - বিয়ের একমাস আগে থেকে। বর বা বৌয়ের অন্য কোনো বৌ বা বর থাকলে তারা যাতে এসে অবজেকশন দিতে পারে। সঙ্গত কারণ। ধর্মীয় রেজিস্ট্রি বিয়েতে এই নোটিশটা জরুরি নয়।
কিন্তু এই নোটিশ বোর্ডের তথ্য নিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের লোকেরা কী করে? হিন্দু মেয়ের সঙ্গে মুসলিম ছেলের বিয়ে হচ্ছে কিনা খুঁজে বের করে! মূলতঃ নাম দেখে। তারপর ঝামেলা পাকায়, হুমকি দেয়, হেনস্থা করে। কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ - এই সব জায়গায় এই পদ্ধতিটা খুব প্রচলিত। ২০২১এ মহারাষ্ট্রে আব্দুল আর রাশিকা- এদেরকে গুণ্ডারা তাড়া করে বেরিয়েছিল এই নোটিশ বোর্ডে থেকে খুঁজে বার করে। কর্ণাটকে একটি আন্তঃধর্ম বিবাহ নিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মাণ্ড্য শহরে বনধ পর্যন্ত ডেকেছিল! অনেক সময় পুলিশও যোগ দেয় এদের সাথে।
এখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কাজ আরো সহজ হয়ে গেছে, কারণ এই নোটিশগুলো এখন অনলাইনেও দেয়া হয়। তবে এই ধরনের গুণ্ডাগিরির কথা মাথায় রেখে কেরলে রাজ্য সরকার অনলাইন নোটিশ বন্ধ করেছে। বাকি রাজ্যগুলোতেও করা উচিত।
ভারতের মতো দেশে যেখানে লোকে অন্য কাস্টে বিয়ে শুনলে আঁতকে ওঠে, অন্য ধর্মে বিয়ে বলতে শুধুই ধর্মান্তরীকরণ ভাবে, বিয়ে বলতে খালি বিয়ের রিচুয়ালগুলো বোঝে, সেখানে ১৯৫৪ সালে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট নিঃসন্দেহে একটা বিপ্লবী পদক্ষেপ ছিল। সমলিঙ্গ বিবাহ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে সমলিঙ্গ বিবাহও আসবে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টের আওতায়। কিন্তু সেইসঙ্গে সমকামী যুগলদের আইনি সুরক্ষারও ব্যবস্থা করতে হবে। নাহলে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো কোর্টের নোটিশ বোর্ড থেকে সমকামী যুগলদের নাম খুঁজে বার করে তাদেরও তাড়া করে বেড়াবে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।