এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  স্মৃতিচারণ  আত্মজৈবনিক

  • ছন্নছেঁড়া জীবন (২০)

    Jayeeta Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    স্মৃতিচারণ | আত্মজৈবনিক | ০৫ এপ্রিল ২০২৩ | ৪৫২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • 1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12
    ছন্নছেঁড়া জীবন : জয়িতা ভট্টাচার্য

    গ্রাম এখনো দুর্বলতা। এখনো দেখতে পাই স্ফটিক আলো ফড়িংয়ের ডানায়। এখনও ভর দুপুরে কুবো পাখি হেঁটে যায় পা পা করে শৈশবের দিকে। আসলে ওইটুকুই সঞ্চয়। আর বাকি সব হিসেবের খাতা। ডেবিট আর ক্রেডিট। অর্থনীতি আর হিসাবশাস্ত্র পড়াই কিন্তু কিছুতেই ব্যালান্স শিট সমান হয় না।

    "এ কেবল ফুটা পাত্রে জল ঢালি দিনে রাত্রে বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মেটাবার"।

    আমরা সকলেই মনে করি আমার চেয়ে দুঃখী কেউ নেই। আমরা ভাবি আমার কষ্টটা একমাত্র দুর্বিষহ। আমি অতুলনীয় এই জগতে আর আমি যে সব সময়ই ঠিক এ আর বেশি কথা কী।

    আমিময় এই সংসারে কামিনী-কাঞ্চনের চেয়েও বিষ অহং, ব্যক্তিগত ও সংকীর্ণ এই অহংবোধ। আমি এর ব্যতিক্রম নয়। এই আমিত্ব আমার দেবত্ব কে ঢেকে দিয়েছে বহু সময়। এই অহং দুভাবেই আসে। আমি সর্বদা ভুল আর আমারই সকল দোষ এমন ভাবনাও দারুন এক আত্মগর্ব।  
     
    সবার জীবনেই নাটক থাকে, নাটকের চেয়ে বেশি নাটকীয় জীবন। কিন্তু আমার জীবননাট্য সব নাটক ছাড়িয়ে যায়। সে যাই হোক। মনের গতি বোঝা ভার।

    একসময় এমন কুসংস্কার হলো যে গান গাইলেই কিছু খারাপ ঘটবে।

    যখনই গান গাই, যখনই একটু আনন্দে থাকি পরক্ষণেই একটা অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটে।

    মনের ভয়ে অনেক দিন গান গাই না। মনে পড়ে মা সন্ধ্যেবেলা গা ধুয়ে কাচা শাড়ি পরে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে ঠাকুরের সন্ধ্যা দিতেন শাঁখ বাজিয়ে, ধূপ জ্বেলে তারপর বাবার জন্য জলখাবার করতেন। আমাকে দুপাতা করে কথামৃত পড়তে হতো। বাবা ফিরলে দুজনে কত গল্প করতেন ছাদে চাঁদের আলোয় বসে।

    কখনো দুজনে বাজারে যেতেন একটু বেড়াবার ছলে। এমন মধুর দাম্পত্য দেখে আর মনে রেখে ভাবতাম পৃথিবীতে বোধহয় কালো নেই কোনো।

    আমি তো এই যুগে প্রায় বালিকা বধূ। বিবাহের পর স্বামী সোহাগ ছিল কিন্তু তা পুরোপুরি জৈবিক। সে বাড়িতে কেউ ফিরে দেখে নি আমি খেলাম কিনা, কাঁদলাম কেন অথবা শরীরটা খারাপ কেন। নাহ কেউ নয় একজন ছাড়া।

    শ বছরের পুরোনো তিনমহলা শশুর বাড়ি কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে, ঘটি ডোবে না।

    গুব গুব করে পায়রা ঘুরে বেড়াত পায়ে নূপুর পরে, আমিও। কিন্তু আমার ফুঁপিয়ে কান্না কেউ শোনে নি। দেখে নি।

    একজন মানুষ রোগা ছিপছিপে লম্বা ছ ফুট। আদর্শবাদী রাজনীতি কর্মী। আমার শশুর যাকে বাবা বলি বাড়িতে প্রায় থাকতেন না। পার্টির সক্রিয় কর্মী। সে সময় ক্লাস হতো। মাঝে মধ্যে সেমিনার। চেন স্মোকার। বাবা প্রথম দিকে অযৌক্তিক অপছন্দ করতেন। জীবনে দু একজন ভালোবাসার মানুষের মধ্যে একজন।

    এসব দিনের মাঝে আসতেন বড় মামাশ্বশুর। তিনি অকৃতদার। বাংলার মাস্টারমশাই। নিরেট বামপন্থী। সাহিত্যপ্রেমী সঙ্গীতপ্রেমী। ভালোবাসতাম খুব মানুষটিকে।

    বাড়ির সদর দরজা বাবা থাকা কালীন কখনও বন্ধ হয় নি। একজন ভুলভাল স্বপ্ন দেখা সৎ কমিউনিস্ট ছিল বাবা। বাইরেটা কঠোর কিন্তু আসলে স্নেহশীল। এই মানুষটি একাই আমার অন্তঃসত্ত্বা সময়ে উনকোটি খেয়াল রাখতেন। একা একটি ভগ্নস্তুপে এক অনভিজ্ঞ মেয়ে ও একজন বৃদ্ধ প্রায় মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ। আমার জন্য তার সেকি ভাবনা। ছেলেমানুষের মতো সব সময় মায়ের খোঁজ।

    জীবন এক কেলিডোস্কোপ।

    চিলেকোঠার ঘরে দুপুরের রোদ্দুর, পুরোনো বাতিল ছবি সব।

    বড়মামাশশুর এলে আমার মন ভালো হতো কটা দিন।

    শ্বশুর শাশুড়ি গত হবার পরেও তিনি এসেছেন থেকেছেন কতবার নবদ্বীপ থেকে এসে।

    জীবনের অলিতে গলিতে প্রতারণা প্রবঞ্চনা কানা গলিতে অপেক্ষা করে কখনও আবার গলি গিয়ে শেষ হয়েছে গঙ্গার ঘাটে।

    খারাপ সময় যখন ধারাবাহিক হয়ে যায় অবসাদ তার মধ্যেই খুঁজে নেয় ছোটো ছোটো চাঁদ। কখনো কালো জলে তো কখনো শূন্য পথের ওপর।দুজনেই একাকী ভাবনা করি মুখ চাওয়া চাওয়ি করি সুখ কৈ, সুখ?

    আসলে সুখ নামে ওই সুখ পাখিটি বড়োই লুকোচুরি।

    শিক্ষিত সমাজে দেখেছি এক নারী ও এক পুরুষ পাশাপাশি বসে কথা বললে একসাথে হেঁটে গেলেও ফিসফাস।

    লেডিস কম্পার্টমেন্ট  দেশের একটি ছোট্ট ছবি তাতে যাকে শিক্ষিত মানুষরা সাবঅল্টার্ন বলে থাকেন তাদের দেখেছি অনেক অভাবেও মুখ উজ্জ্বল। হয়ত স্বপ্ন তাদের অল্প তাই। তারা আরাম করে বিড়ি ধরায়।

    কখনো জিআরপি উঠলে তাদের সঙ্গে চটুল রসিকতা, বিড়ি অফার করে।

    তাদের ঘরে মারপিট হয় স্বামী স্ত্রীর। বিবাহিত অসন্তুষ্ট বউটি সন্ধ্যায় তার প্রেমিকের সঙ্গে ফিলিম দেখতে যাবে তাই চুড়িওলার থেকে একজোড়া রঙিন চুড়িও কিনে নেয় অনায়াসে। কারো বর কর্মহীন মাতাল গুণ্ডা তবু কী এক প্রণয়পাশে বাঁধা দেখি কাউকে। ওরা ভালো বা খারাপ ঠিক বা বেঠিক তত ভাবে না।

    কার ছেলেকে সাপে কেটেছে, কার মেয়ে জলে ডুবে কবে মরে গেছে, কার সোয়ামি সতীন এনেছে সে গল্প অনয়াসেই করতে দেখি।

    এদের সঙ্গে থাকলে অহং চলে যায়, যে পৃথিবীর আমি সবচেয়ে দুঃখী এবং বিস্তীর্ণ মানুষ এই বোধ মুছে যায়।

    আসলে সাদা পাতার সোজা উল্টো নেই। যেভাবেই দ্যাখো জীবন সোজা করে আঁকলে বা কী আর উল্টো করেই বা কী। গুছিয়ে সংসার করা হয় নি। সংসারী মন নয়। চাই নি তাই হয় নি।

    আমার জীবনের মতোই আমার ঘর থাকে এলোমেলো অগোছলো।

    এক ছোটো মামাশ্বশুর প্রায় আমার স্বামীর বয়সী। তখনকার দিনে হতো। ভাসুর দেওর নেই। সে এলে একটা জানলা খুলে যেত। বাতাস আসত। হাসিমুখ হতো। শুনতে হয়েছিল এর জন্য এক পিসিশাশুড়ি বলেছিলেন আলগা ইশারায়, এত কিসের গল্প! এত  ভাব কেন!

    পাঁকে পদ্ম ফোটে।

    ইতর না থাকলে সাধু চেনা যায় না। শুধু খারাপ বা শুধু ভালো হয় না। দুটোই গ্রহণ করা দরকার। তবে এসব বয়সের অনুভব।

    শিক্ষা কমল হিরে আর তার বিচ্ছুরণ কালচার। আজও সমান সত্য।

    (ক্রমশ)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12
  • স্মৃতিচারণ | ০৫ এপ্রিল ২০২৩ | ৪৫২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন