এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শাম্ব শুধুই পৌরাণিক চরিত্র?

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৩ মার্চ ২০২৩ | ৫৮২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • 'শাম্ব' উপন্যাস

    ভাগবত পুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী ভল্লুকরাজের কন্যা এবং শ্রীকৃষ্ণের অষ্ঠভার্যার অন্যতম জাম্ববতীর জৈষ্ঠ্যপুত্র ছিলেন শাম্ব। পুরাণ অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের মোট ১৬১০৮ জন রমণী ছিলেন যাঁদের ওপর শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণ অধিকার ছিল। রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, গান্ধারী (ধৃতরাষ্ট্র পত্নী নন), হৈমবতী, শৈবা, প্রস্বাসিনী এবং ব্রতিনী ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অষ্ঠভার্যা (মতান্তরে রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী, কালিন্দি, মিত্রবৃন্দা, নগ্নাজিতি, ভদ্রা এবং লক্ষণা)। এছাড়াও শ্রীকৃষ্ণ প্রাগজ্যোতিষপুরে নরকাসুরকে বধ করে তার প্রাসাদ থেকে ১৬১০০ রমণীকে উদ্ধার করে গ্রহণ করেছিলেন। পুরাণ বা মহাভারতে অনেক বর্ণনা থাকলেও শ্রীকৃষ্ণের পরিবার সম্পর্কে জনমানসে খুব বেশী ধারণা নেই। বিগত শতকের আশির দশকে ধারাবাহিক ভাবে দেশ পত্রিকায় উপন্যাস বেড়িয়েছিল 'শাম্ব', অতি পরিচিত এবং ভালোবাসার লেখক সমরেশ বসুর। লিখেছিলেন কালকুট ছদ্মনামে, বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছিল এবং প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই 'শাম্ব' উপন্যাসটি। উপন্যাসে লেখক তাঁর চরিত্রদের পৌরাণিক দৃষ্টিতে না দেখে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। ফলে পুরাণ বা মহাভারতের সাথে কিছুটা পার্থক্য হয়েছিল। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক না বেঠিক সেই আলোচনা করার মতো ধৃষ্টতা বা জ্ঞান কোনোটাই আমার নেই, ফলে সেই রাস্তায় যাবো না। কিন্তু কালকুটের সেই উপন্যাসের পরে জনমানসে শাম্বের পরিচিতি অনেকটাই বৃদ্ধি পায়। আমারও সেটা কৈশোর কাল ছিল, ফলে উপন্যাসের অনেক কিছুই বুঝতে পারিনি সঠিকভাবে, কিন্তু মনের গভীরে দাগ কেটেছিল অনেকখানি। পরবর্তীতে আবার পড়েছিলাম উপন্যাসটি। পুরাণের বর্ণনাকে বাস্তবের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার যে ক্ষমতা এবং পুরাণের অতিবর্ণনাকে পরিহার করার ইচ্ছে, তাকে কুর্নিশ করতেই হয়। অন্যান্য অনেক গল্প বা উপন্যাসের মতোই একটি অসাধারণ উপন্যাস আমরা পেয়েছিলাম কালকুটের কলম থেকে।

    শাম্বের মুষল প্রসব

    পুরাণ অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের মোট এক লক্ষ আশি হাজার সন্তান সন্ততি ছিল। কিন্তু তার মধ্যে শাম্ব যতটা পরিচিত অন্য সন্তানেরা বলতে গেলে একদমই পরিচিত নয় আমাদের কাছে (প্রদুম্ন্য ছাড়া)। পিতা শ্রীকৃষ্ণের জনপ্রিয়তার কাছে পুত্রের পরিচিতি চাপা পড়ে গেলেও পিতা এবং পুত্র দুজনেরই বিষাদময় পরিণতি হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণের শেষের পরিণতি আমরা জানি বলে আলোচনায় যাচ্ছি না। এখানে আলোচনা করবো শাম্বের শেষ পরিণতি নিয়ে। যাদব কুলপতি মথুরা থেকে পাঠ চুকিয়ে দ্বারকা নগরীতে বসবাস শুরু করার পরে শাম্বের আবির্ভাব। এই দ্বারকা নগরী আজকের দ্বারকা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। আমরা দ্বারকা বলে উল্লেখ করলেও পুরাণ অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ জরাসন্ধের হাত থেকে যদু বংশকে রক্ষা করার জন্য মথুরা থেকে দ্বারাবতী নগরে নতুন করে রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। সময়কাল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কিছু আগে বা পরে অর্থাৎ সমসাময়িক। পুরাণ বর্ণিত সেই দ্বারাবতী নগরের সাথে আজকের দ্বারকা নগরীর অবস্থানজনিত বা অন্য কোনরকম মিল নেই। সেই দ্বারাবতী নগরীর সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ায় সম্ভাবনাই প্রবল। শাম্বের বেড়ে ওঠা, যোদ্ধা হয়ে ওঠা, রাজনীতির পাঠ, সবই সেই দ্বারাবতী নগরীতে। কাঞ্চনের অধিক উজ্জ্বল বর্ণ, আয়ত চোখে কামনার অনল বহ্নি, মুগ্ধ দৃষ্টি, চিত্তজয়ী দুর্বার আকর্ষণ, তুলনাহীন তার রতিকুশলতা - এইভাবেই শাম্বের বর্ণনা পাই আমরা। রূপে, গুনে তিনি যাদব কুলশ্রেষ্ঠ হিসেবেও বর্ণিত। তৎকালীন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের দুইজন, সুদর্শনচক্রধারী শ্রীকৃষ্ণ এবং হলধর বলরামের যথাক্রমে পুত্র এবং ভাইপো হলো শাম্ব। আবার সাম্রাজ্যের দিক দিয়ে দেখতে গেলেও যদু বংশের সাম্রাজ্য সেইসময়ে সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যগুলোর একটি ছিল। সুতরাং শাম্বের গুরুত্ব সেইসময়ে অপরিসীম ছিল তা বলাই বাহুল্য। আবার শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতির কারণে বিভিন্ন দেব - দেবী, মুনি - ঋষিদের প্রায়ই আগমন ঘটতো সেই নগরীতে। একবার শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরামের অনুপস্থিতিতে বিশ্বামিত্র, কণ্ব এবং নারদ দ্বারকায় উপস্থিত হলে কৃতবর্মা প্রমুখেরা শাম্বকে মেয়ে সাজিয়ে মুনিদের সঙ্গে রসিকতা করতে চান। তাঁরা মেয়ের ছদ্মবেশে শাম্বকে দেখিয়ে বলে, “এ হল বভ্রুর স্ত্রী। এর কী সন্তান হবে?” অন্তর্যামী তপস্বীদের এই প্রতারণার কথা কিছুই অজানা ছিল না। তাঁরা অভিশাপ দেন, এই প্রতারণার জন্য কৃষ্ণপুত্র সত্যি সত্যিই একটি মুষল প্রসব করবেন। আর তা থেকেই ধ্বংস হবে যদুবংশ। হলও তাই। পরদিন সকালে একটি লোহার মুষল প্রসব করলেন শাম্ব। এরপর ঘটে যায় নানা ঘটনা। শ্রীকৃষ্ণ এবং বলরাম ফিরে এলে প্রথমে তো তাঁরা চূড়ান্ত ক্রুদ্ধ হন। তারপর মুষলটি চূর্ণ করে সমুদ্রে ফেলার নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই সমুদ্র তীরেই জন্মায় নল - খাগড়ার গাছ এবং পরবর্তীতে দেখা যায় যদুবংশীয়েরা সেই গাছের কাণ্ড নিয়ে যখন নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল, সেই কাণ্ডগুলোই মুষলে পরিণত হয়ে যাচ্ছিল। শাম্বের প্রসব করা সেই মুষলই শেষ অব্দি যদুবংশের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল।

    শাম্বের বিবাহ

    মহাভারত অনুযায়ী দুুুুর্যোধন এবং ভানুমতীর কন্যা ছিলেন লক্ষণা। তার একজন যমজ ভাই ছিল লক্ষণ। রূপেগুণে অনুপমা, সর্বগুণযুক্তা, ভুবনমোহিনী, সুলক্ষণা, বিভূষণা বলে তার নাম রাখা হয় লক্ষণা। তিনি যুবতী হলে দুর্যোধন লক্ষণার জন্য সম্ভাব্য স্বামী নির্ধারণের জন্য স্বয়ংবরের আয়োজন করেছিল। নারদের মুখে তার রূপ বর্ণনা শুনে শাম্ব তার প্রেমে পড়েন। সবার অলক্ষ্যে তিনি রথে চড়ে স্বয়ংম্বরের জন্য যাত্রা করেন। স্বয়ংবর সভায় লক্ষণার রূপের বর্ণনা পাওয়া যায় যে, অনুপম মুখ তার যিনি শরদিন্দু (শরৎকালের স্নিগ্ধ চাঁদকেও জয় করে)। ঝলমল কুন্ডল তার, মিহির (সূর্য) যেন অধর (ঠোঁট)কে রাঙ্গিয়ে তুলেছে। ভ্রূভঙ্গে অনঙ্গ (কামদেব) জয় সম্ভব। পাখির মত চঞ্চল চক্ষু (খঞ্জন) অঞ্জনে (কাজলে) রঞ্জিত। শুকচঞ্চুর (টিয়াপাখির ঠোঁট) মত নাক, শ্রুতি (কান) গৃধিনীকেও (শকুনী) লজ্জা দেবে। বিপুল নিতম্ব গতি মরালের (রাজহাঁস) মত। চরণে রসাল কিঙ্কিণী ও নূপুর বাজে। ধূমহীন অগ্নি কিংবা বিদ্যুতে যেন এর সৃষ্টি। শিশু সূর্যের যেন উদয় হল। তাকে দেখা মাত্র রাজারা চেতনা হারায়। স্বয়ংবরে অংশ নেওয়ার পরিবর্তে শাম্ব লক্ষ্মণার রূপে বিমোহিত হয়ে তাকে নিয়ে হস্তিনাপুর থেকে দ্বারাবতীর উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। বিষয়টি জানাজানির পর কৌরবরা ক্ষুব্ধ হয়ে শাম্বকে তাড়া করে। কর্ণ (মহাভারত) ইন্দ্রজাল অস্ত্র প্রয়োগ করে শাম্বকে বেঁধে ফেলে এবং বন্দী করে। যা জানতে পেরে যাদব কুলপতিরা শাম্বকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসে। যাদব ও কৌরবদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকার কারণে শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলরাম শান্তিপূর্ণ এবং পারিবারিকভাবে সমস্যার সমাধান করতে হস্তিনাপুর যান। হস্তিনাপুর গিয়ে বলরাম বলেন, মথুরার যাদবদের রাজা উগ্রসেন শাম্বকে মুক্তি দিতে অনুরোধ করেছেন কিন্তু কৌরবরা সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। উপরন্তু বলরামকে সেই সভায় অপমান করা হয়। এতে বলরাম চরম ক্ষুব্ধ হন। ক্রোধে উন্মত্ত অবস্থায় বলরাম পায়ের গোড়ালি দিয়ে বসুধা বিদারিত করেন এবং বলেন যে, হস্তিনাপুরকে কৌরবসহ গঙ্গায় নিক্ষেপ করবেন। তিনি তাঁর হল বা লাঙ্গল নিক্ষেপ করে হস্তিনাপুরের প্রাকারে টান দেন। শহর হঠাৎ ঘুরছে দেখে কৌরবরা তৎক্ষণাৎ বলরামের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তারপর বলরাম হস্তিনাপুর শহরটিকে তার আসল অবস্থানে ফিরিয়ে আনেন। অবশেষে শাম্ব মুক্তি পায় এবং লক্ষণার সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়। দুর্যোধন মেয়ের বিয়েতে ৬০,০০০ হাতি, ১,২০০ ঘোড়া, ৬০,০০০ রথ, ১০০০ মহিলা দাসী ইত্যাদি দিয়েছিলেন।

    অভিশাপ এবং রোগমুক্তি

    একবার মহর্ষি নারদ তাঁর কয়েকজন শিষ্য সহ দ্বারকায় আগমন করেন। তাঁর আগমন সংবাদ পাওয়া মাত্র কৃষ্ণ এবং তাঁর বংশধরেরা সহ দ্বারকার প্রত্যেক যদুবংশীয় ব্যক্তি এসে তাঁকে অভ্যর্থনা করেন। কিন্তু শাম্ব তখন পার্শ্ববর্তী একটি কাননে কয়েকজন রমণীর সাথে প্রেমালাপে রত থাকায় নারদের প্রতি অবহেলা করেন। শাম্বর এই আচরণে অপমানিত বোধ করে নারদ তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার সংকল্প করেন। দ্বারকাত্যাগের আগে তিনি একবার কৃষ্ণের সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করে অভিযোগ করলেন যে নরকাসুরের কারাগার থেকে উদ্ধার হওয়া কৃষ্ণের ষোল হাজার রমণী শাম্বের প্রতি আসক্ত। কিন্তু কৃষ্ণ নারদের অভিযোগ অবিশ্বাস করে বললেন যে তাঁর প্রতি ষোল হাজার স্ত্রী সহচরী রমণীদের একনিষ্ঠ প্রণয় বিষয়ে তাঁর মনে কোন দ্বিধা বা দ্বন্দ্ব নেই এবং শাম্বের বিশ্বস্ততা ও পিতৃভক্তিও প্রশ্নাতীত। এই কথা শুনে এবং শাম্বকে দণ্ড দিতে না পেরে দেবর্ষি নারদ আরও ক্রুদ্ধ হলেন। সেইসময় তিনি দ্বারকা ত্যাগ করে কিছুকাল পরে আবার দ্বারকায় ফিরে এলেন। তখন এসে প্রথমেই তিনি রৈবতক পর্বতের গভীরে কৃষ্ণের প্রমোদকাননে গেলেন। সেখানে গিয়ে দূর থেকে নারদ দেখলেন যে কৃষ্ণ, তাঁর মহিষীগণ ও ষোল হাজার রমণীদের সঙ্গে সুখে জলকেলিতে মগ্ন। কৃষ্ণকে ঘিরে বিভিন্ন রমণী নানা ক্রীড়াকৌতুকে ভেসে বেড়াচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সুরাপান করে প্রমত্তা হয়ে প্রণয়বাক্য উচ্চারণ করছে ও অন্যান্য রমণীদেরও সুরাপাত্র এগিয়ে দিচ্ছে। কৃষ্ণও অতি উদার ও প্রমত্ত বাঞ্ছায় তাঁর প্রিয় রমণীদের ইচ্ছাপুরণ করে তাদের আহ্লাদিত করছেন। নারদ লক্ষ্য করলেন যে সুরাপানে আসক্ত রমণীদের বসনভূষণের শৈথিল্য ও নগ্নতার বিষয়ে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই কারণ রৈবতকে অবস্থিত সেই প্রমোদ উদ্যান ও সরোবরে একমাত্র কৃষ্ণ ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের উপস্থিতির কোন উপায় নেই। দ্বারকায় এইকথা সর্বজনবিদিত যে কৃষ্ণের প্রমোদকানন ও জলকেলি স্থান একমাত্র কৃষ্ণ ছাড়া আর সকল পুরুষের অগম্য। কেবলমাত্র কোন বিশেষ প্রয়োজন বোধ করলে কৃষ্ণ স্বয়ং সেখানে কাউকে ডেকে আনতে পারেন। রমণীদের সাথে কেলিতে মত্ত কৃষ্ণকে দেখে নারদ ছলনাপূর্বক শাম্বকে গিয়ে সংবাদ দিলেন কৃষ্ণ তাঁর প্রমোদ উদ্যানে শাম্বকে ডেকে পাঠিয়েছেন। অন্য সকলের মত শাম্বও জানতেন যে সেই প্রমোদকাননে কৃষ্ণ ছাড়া আর কারও প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু নারদের ছলনায় প্রভাবিত হয়ে তিনি ভাবলেন যে সত্যিই কৃষ্ণ তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাই তিনি দ্রুত সেখানে উপস্থিত হলেন। রমণীদের সাথে জলক্রীড়ারত কৃষ্ণ শাম্বকে সেই কেলিস্থলে দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। কিন্তু তাঁর ষোল হাজার রমণীকুল শাম্বকে দেখে সহসা উল্লসিত হয়ে উঠল। ক্ষণিকের জন্য তারা শাম্বের প্রতি আসক্তি বোধ করল। যে রমণীদের জীবনে একমাত্র পুরুষ কৃষ্ণ ছাড়া আর কারও স্থান নেই সেই রমণীরা স্বয়ং বাসুদেবের সামনেই অপর পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার স্পর্ধা দেখানোয় তাঁর ক্রোধানল প্রজ্জ্বলিত হল। পরমুহূর্তেই কৃষ্ণ ক্রোধে ও গ্লানিতে তাঁর রমণীদের প্রতি জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন ও তাদের শাপ দিলেন যে তাঁর মৃত্যুর পর তারা তস্কর দ্বারা লাঞ্ছিত হবে। এরপর তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে শাম্বকে অভিসম্পাত করলেন যে শাম্ব কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত হবে। তখন বিস্মিত ও আতঙ্কিত শাম্ব কৃষ্ণকে অনুনয় বিনয় করে বোঝালেন যে তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর প্রমোদকাননে আসেননি। তখন কৃষ্ণ প্রকৃত সত্য অনুধাবন করতে পেরে শাম্বকে বললেন যে, দেবর্ষি নারদই একমাত্র তাকে মুক্তির দিশা দেখাতে পারেন। তিনি তাকে কোনপ্রকার অভিশাপ দেননি, এটা আসলে শাম্বের ললাটলিখন। জন্মকুণ্ডলী অনুযায়ী শাম্বের কুষ্ঠরোগ হবেই এবং সেই সময় এখন আগত। তিনি শুধু ভবিতব্যকে উচ্চারণ করেছেন মাত্র। এরপরে শাম্ব দ্বারাবতী নগরী ত্যাগ করে নগরের বাইরে একাকী অবস্থান করেন এবং অপেক্ষা করতে থাকেন সেই বেদনাক্লিষ্ট ভবিষ্যতের। কিছুকালের মধ্যেই সেই রোগ শাম্বকে গ্রাস করলে নারদের সাক্ষাতের আশায় পিতার পরামর্শ নিতে দ্বারাবতী নগরীতে প্রবেশ করেন এবং সৌভাগ্যবশতঃ নারদের সাক্ষাৎ পান সেখানেই। নারদের পরামর্শ মত চন্দ্রভাগা নদীর তীরে অবস্থিত সূর্যক্ষেত্রের মিত্রবনে গিয়ে এক মহাপ্রভঃ ঋষির সাক্ষাৎ পান। সেই ঋষির নির্দেশমতো শাম্ব এরপরে দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে বিভিন্ন রকমের অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে, বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে মগ ব্রাহ্মণদের ভারতবর্ষে নিয়ে এসে এবং বিভিন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে নিজেকে বন্দী করে পূর্বের জীবন ফিরে পান। শাম্ব কিন্তু আর দ্বারাবতী নগরীতে ফিরে আসেননি, হয়তো অর্থের বা অন্য প্রয়োজনে এসেছেন, কিন্তু দ্বারাবতীর জীবনে আর ফিরে আসেননি। দ্বারাবতীতে রয়ে গিয়েছেন তার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, পরিজনেরা এবং সর্বোপরি লক্ষণা ও বাকী সঙ্গিনীরা।

    উপসংহার

    শাম্বের বিচিত্র জীবন, রোগ এবং রোগমুক্তির কথা কালকুট তাঁর শাম্ব উপন্যাসে বর্ণনা করেছেন অনেকদিন আগেই। সুতরাং পুনরায় বর্ণনা করার প্রয়োজনও নেই আর আমার বর্ণনা ক্ষমতা অতি সাধারণ মানের, ফলে সেটা করলে যারা শাম্ব পড়েছেন তাঁরা আমাকে তেড়ে আসবেন জানি। অনেকদিন ধরেই পারিপার্শ্বিকতার কারণে শাম্বের ঘটনাবলী মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। বলা হয়ে থাকে যে, রামের জন্মের আগেই রামায়ণ লেখা হয়েছিল। অর্থাৎ, মহাপুরুষেরা বা মহান লেখকেরা ভবিষ্যত দ্রষ্টা হন। বিভিন্ন পুরাণ লেখা হয়েছিল বেদের অনেক আগে, বছরের হিসেব ধরলে দশ হাজার হওয়া অবাকের কারণ হবে না। দশ হাজার বছর পরেও বাস্তবের সাথে পুরাণের কিরকম মিল সেটাই মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তারা পৌরাণিক চরিত্রগুলোকে নিশ্চয়ই বাস্তবের মাটি থেকেই তুলে এনেছিলেন, নইলে এত বছর পরেও বাস্তবে সেই ঘটনাক্রমের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই কি করে? নইলে সৃষ্টি কর্তার নির্দেশে একই ঘটনা পৃথিবীতে বারবার ঘটছে, শুধু চরিত্রের নাম পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। শুধুমাত্র পুরাণের অতিবর্ণনাকে কালকুটের মত পরিহার করতে হবে।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন