এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • এ কি আনন্দ তরঙ্গ রে!

    মোহাম্মদ কাজী মামুন লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ৬৫৫ বার পঠিত
  • খুঁড়ছিল, সর্বশক্তি দিয়ে সে খুঁড়ছিল। তার দেহমন ক্লান্তিতে নুয়ে এসেছিল, তবু এতটুকু বিরতি নেই। বয়ে যাচ্ছিল মিষ্টি হাওয়া, আকাশে ছিল মেঘের ভেলা, চারদিকে প্রাণের বন্যা। কিন্তু সেসবে তার খেয়াল ছিল সামান্যই, মাতালের মত বেলচা দিয়ে দিয়ে একের পর এক মাটি সরাচ্ছিল। মাঝে মাঝে হাতের আঙুলগুলো সাঁড়াশির মত চালিয়ে দেখে নিচ্ছিল কিছু উঠেছে কিনা অমূল্য!
     
    এক সময় হতাশায় মাথাটা ঝুলে পড়ে, নাহ্‌, বুঝি পাওয়া যাবে না! বাম হাতের তর্জনিটিকে চোখের নিম্নবর্তী হাড়ের উপর সেট করে বুড়ো আঙুলে থুতনিকে ঠেক দিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। পরে বাকি আঙুলগুলো নাকের নীচ দিয়ে ঠোঁটের উর্ধ্বভাগে খোলমত বানিয়ে বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে রইল সামনের গাছটির দিকে। গাছেরও কত কাহিনী আছে, কাঠ কাটার বিস্তারিত, বিশ্বাসযোগ্য অথচ মর্মন্তুদ সেসব গল্প, কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়ার মত!

    ‘খাইতে আয় বাবা’..মায়ের ডাকটা ধ্বনিত হতে হতে ইতিমধ্যে মিইয়ে গেছে। সে একবার অবশ্য অস্ফুট গলায় বলেছে, ‘আসছি, এই আর একটু’। গাছটা ইতোমধ্যে আরো কাছে চলে এসেছে। গাছেদেরও জীবন আছে, স্বপ্ন ও সাধ আছে, বনের গাছ কাটা না হলে চাপা পড়ত প্রাণীরা, গাছেরা রাজত্ব করত পৃথিবী জুড়ে। তখন ফরেস্ট থাকতো না কোথাও, অথবা পুরো পৃথিবীটাই ফরেস্ট হত। গাছের শাসনের বাড় বাড়ন্ত সবখানে, সাম্রাজ্যবাদের হুমকি সব কোণে, সেজনই এই নির্বিচার নিধন? গর্ভ যন্ত্রণার মত সারা শরীরে তার আড়মোড়া বয়ে যায়, বের হয় দুর্বোধ্য স্বরের চিৎকার। ‘বাজারে যাবি না? ফ্রিজডা খালি। মাছ-মাংস কিচ্ছু নাই।‘ – ওহ, আবার সেই আওয়াজ…. গহীন বনের স্তব্ধতা ভেঙ্গে খান্‌ খান্‌ হয়।

    সে দুই হাত পেটের সামনে বেঁধে রেখে শরীরটা নিয়ে ডানে বায়ে দুলতে থাকে। বৃদ্ধাংগুল ও তর্জনির গ্যাপ দিয়ে বানানো সাময়িক ফ্রেমটি দিয়ে সে গালের মাংসকে ঠেলে উপরে তুলতে থাকে কিছুটা সময়, এরপর সেই একই উপকরণ দিয়ে কপালের উপর আটা দলে দলে পরে চালিয়ে দেয় রোলারের মত, ফলে রাস্তাটি নতুন করে মিহি হতে থাকে। সেই রাস্তায় সে শুধু হাঁটছে, হাঁটছে, আর কিছুক্ষণ পর পর মানচিত্রটা খুলে খুলে দেখছে, কিছু পাওয়া যায় কিনা। হঠাৎ কোনো স্পন্দন পেয়ে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ে, মাটিগুলো কেমন লালচে, আর কি ভিন্নরকম, সে শাবল হাতে তুলে নেয়, উত্তেজনার বশে প্রবল বেগে চালায় হাতুড়ি, রক্তের মত বেরিয়ে আসে লাভা, ভয়ে পিছিয়ে যায় সে, দৌঁড়ুতে শুরু করে।

    কানে আসে বাবা-মায়ের চিৎকার, একে অন্যকে বিষ ঢেলে দিচ্ছে, তাদের বয়স হয়েছে, তারা জানে একে অপরকে তারা মেরে ফেলবে না, তবু যুদ্ধ করে তারা অবিরাম, কথা বলে বলে। কখন অনুতপ্ত হবে তারা? হঠাৎ শিহরণ খেলে যায় তার মধ্যে, এইতো পেয়েছে সে, পেয়েছে - মানুষ অন্যের দ্বারা কষ্ট পেয়েই শুধু আত্মহত্যা করে না, অন্যকে কষ্ট দিয়ে যে মর্মপীড়ায় ভোগে তার জন্যও আত্মহত্যা করে। শান্তি জাগে তার মনে, মুখে বিজয়ীর হাসি। ঘামে নেয়ে উঠেছিল, সামান্য হেলান দিয়ে বসে। কিন্তু সুড়ঙ্গের উপর উঁকি মারতে দেখা যায় ছোট্র সুফিয়াকে, সে হাত পেতে রয়েছে - সেও ঢুকবে সেখানে, খেলবে তার সরু দেয়াল ধরে। অগত্যালোকটিকে উঠতে হয়, পোড়ামাটির ঢাকনাটি চাপা দিয়ে সে সুফিয়ার হাতটি নিজের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে ফিরতি পথ ধরে।
     
    বিশ্রামের পর আবার খোঁড়াখুড়ি শুরু হয় সুড়ঙ্গে, অনেক দিন কারো হাত পড়েনি সেখানে, পাথুরে জঙ্গল, ঝুলন্ত শিকড়বাকড়ে ছেয়ে গেছে সর্বত্র …প্রবল বেগে দলাইমলাই চালাতে থাকে সে। খোদাই করা মাটি, ধূলো, পাথর, উদ্ভিদের শব - সব মিলে একটি স্তুপ গড়ে উঠেছিল তার পাশেই, আর তার উপরেই বসেছিল পাখিটি। প্রথমে খেয়াল করেনি, পরে পরান কাড়া সুরে পাখিটি যখন ডেকে উঠে, সে মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়। দেখতে পায় সেজেগুঁজে বেরুচ্ছে তার মামি, কোথায় যাচ্ছে এই পড়ন্ত বয়সে? কিছু খুঁজতে বেরিয়েছে? 
     
    আরো চোখে পড়ল কিছু চাকা, চালকের কঠোর শ্রমের পক্ষে বেশ শক্ত যুক্তি পেশ করলো তারা। এদিকে সদ্য গোঁফের রেখা জাগা ছেলেটিকে দেখে তার থেকে দু ক্লাস নীচের মেয়েটির মধ্যে বাঁকা হাসির রেখা জেগে উঠে নিমিষেই মুছে গেল। সব কিছু কেমন ব্যঞ্জণাময়! রহস্য মাখানো ক্যানভাসটি সে উল্টে-পাল্টে দেখতে থাকে! উদঘাটিত হতে শুরু করে পরম রহস্য যে লুকিয়ে থাকে মুড়ির ঠোঙার মধ্যে, উঁচু উঁচু দালানের ছাদে শুকোতে দেয়া কাপড়ে। ‘এ কি আনন্দ তরঙ্গ রে!’ – জুড়িয়ে যায় তার দেহ-মন।

    সে ক্ষণিক পায়চারি করে এল, ডান পায়ের আঙুল দিয়ে বাম পায়ের হাটুর নীচের মাংসে ক্রমান্বয়ে টোকা দিতে লাগলো। কিন্তু কেন জানি, ঘরটা ভীষণ গরম হয়ে উঠছে। আস্তে আস্তে কালো ধোঁয়ায় ভরে গেল আকাশ-বাতাস, শুনতে পেল ছোটাছুটি, চিৎকার, সাইরেন, হাহাকার, বুক ফাটানো আহাজারি। বস্তির আড়াইশো ঘর পুড়ে ছাই, একটি তদন্ত টিম গঠন হয়েছে, বস্তিটির পাশেই ছিল মান্যি এক লোকের বিশাল প্রপারটি… কালিঝুলি মাখা শতচ্ছিন্ন এক দল পতঙ্গ খুঁড়ে খুঁড়ে দেখছিল রয়েছে কিনা এখনো কিছু অবশিষ্ট… সুড়ঙ্গ খোঁড়ার গতি বাড়িয়ে দিল সে, গন্ধ শুঁকে বুঝতে পেরেছে অনেক অনেক খনিজ মিলবে এখানে…দিন-মাস-বছর-যুগ-শতাব্দী ধরে চলল সুড়ঙ্গ অভিযান।

    একদিন হঠাৎ ভীষণ আর্তনাদ করে বিষ্ফারিত হল চারপাশ, জেগে উঠল স্বর্গ। খুঁড়তে খুঁড়তে মিলল সেই দেশ যেখানে বাস করেন দেবতা, যেখানে মন যা চায়, তাই হাজির হয় চোখের সামনে, সেখানে ভীড় অপরূপ হুরদের, আমন্ত্রন জানায় মনোহর উদ্যান, আর চোখ জুড়োনো সরোবর দল।

    এখন আগের মত আর খুঁড়তে হয় না তাকে, অত শক্ত করে অত গভীরে ঢুকিয়ে দিতে হয় না বেলচা… অল্প কাঁচি চালালেই মিলছিল গুপ্তধন…যেদিক চোখ যায়, যতদূর চোখ যায় – শুধু সোনা, মণি-মানিক্য। সাত রাজার ধন…সে হাতে তুলে নিতে থেকে, ফেলতে থাকে, গড়াগড়ি খায়, হাসে, কাঁদে, চিৎকার করতে থেকে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে - তার অট্রহাসি সুড়ঙ্গের দেয়াল সব ধ্বসিয়ে দিতে থাকে।

    সে ধরে নিয়েছিল সব শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু দেখে কিছুই হয়নি, প্রায় সবটুকুই যে অনাবিষ্কৃত! সোনার এই বিপুল ভাণ্ডার সে বাইরে নিয়ে আসবে কি করে! ভার সইতে না পেরে থরথর করে কাঁপতে থাকে! এক সময় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে!

    অনেক দিন বাদে কিছু লোক তাকে দেখতে পায় একটি গাছ তলায়। একটি বেলচা দিয়ে তলোয়ারের মত করে মূহুর্মূহ আক্রমণ শাণাচ্ছিল সে অনন্ত শূণ্যকে লক্ষ্য করে। সে কি মাছি মারছিল? না কি গল্প তাড়াচ্ছিল, প্রতি মুহূর্তে যারা তার মাথায় ভর করত? সে বলত তার গল্প-পাওয়া রোগের কথা, কেউ সে কথা বিশ্বাস করেনি। একটা সময় সে সবকিছুতেই গল্প পেত, সব গল্প মিলেমিশে এমন গল্পহীন হয়ে উঠতো, সে শেষ খুঁজে পেত না আর!

    সে বলতো, সে খুঁড়ে খুঁড়ে স্বর্গকে খুঁজে পেয়েছিল, কেউ বিশ্বাস করতো না সে কথাও। সবাই বলত, এ আর এক গাঁজাখুরি গল্প। সবাই আরো বলতো, লোকটা একটা বদ্ধ উন্মাদ।
    …..
    বিনীত নিবেদক,
    মোহাম্মদ কাজী মামুন

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ৬৫৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন