এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  ভ্রমণ   যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে

  • উঠলো বাই

    সে
    ভ্রমণ | যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে | ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ | ৫৩৮৬ বার পঠিত
  • তখনও গোটা ইয়োরোপে দেশের সংখ্যা এখনকার চেয়ে ডজনখানেক কম, এশিয়ার দেশের সংখ্যাও বেশ কম। ইউরোস্টার রেলপথ তৈরিই হয়ে ওঠেনি, তবে সেটা তৈরি হলে খরচ যেমনই হোক না কেন মানবসভ্যতার ইতিহাসে যে একটা মাইলফলক সৃষ্টি হবে এরকম আলোচনা টুকটাক হয়। ইয়োরোপ তখনও দ্বিধাবিভক্ত এবং দ্বিধাগ্রস্ত।
    সোভিয়েত দেশে তখন স্ট্রাকচারাল পরিবর্তনের কথা পাবলিককে বুঝিয়ে দিয়ে তলে তলে সিস্টেমিক পরিবর্তনের সওদা হচ্ছে, কেও কিচ্ছুটি জানে না। এইরকম একটা টাইমে বয়ফ্রেন্ডের হাতে রেগুলার নিগৃহীত হতে হতে, মধ্য এশিয়ার একটা মরূদ্যান শহরে  আমার মনের মধ্যে হঠাৎ ঘটে গেল সিস্টেমিক পরিবর্তন।
    হাতে তখন আমার মোট দুটো অপশন, হয় পড়ে পড়ে মার খাও, নয়ত পালাও। আমি সেকেন্ডটা চুজ করলাম। গত শতাব্দীর আশির দশকে ভারতীয় মেয়েরা ভীতু হতে শুরু করেছিল (কারন অনেক থাকতে পারে, কিন্তু এটা অবজারভেশন) এবং নো ওয়ান্ডার আমিও সেই দলেই ছিলাম। কথায় কথায় ভয় পাওয়াটা একটা নেশার মতো আচ্ছন্ন করে রাখে। নিজেকে দুর্বল ভাবতে ভাবতে মানসিক ভাবে পরনির্ভরশীলতা গড়ে ওঠে, যেটা প্রথমদিকে আরামদায়ক এবং খানিকটা রোম্যান্টিক হলেও,  কেমন যেন দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার মতো আচ্ছন্ন করে রাখে। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে এক ঝটকায় বের হতে হয়, অ্যাটলিস্ট আমাকে বের হতে হয়েছিল এক ঝটকাতেই। সেই প্রসেসটাতে কয়েক ঘন্টার ভেতর ডিসিশন নিয়ে ফেলি যে, বেড়াতে যাবো। একা। এর আগের ছুটিগুলোতে দেশে যেতাম, সেসবে কর্তব্য দায়িত্ববোধ সামাজিকতা সেন্টিমেন্ট এইসব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে মড়িয়ে একাকার হয় থাকত। এবার সেসব বাহুল্য বাদ দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম একা, সম্পূর্ণ অজানার দিকে। গন্তব্য লন্ডন।
    প্রশ্ন উঠতে পারে, লন্ডন কেন? হোয়াই? বেড়ানোর জায়গা কি আর নেই?
    তা ঠিক নয়,  আশে পাশে অনেক জায়গা ছিল, কিন্তু অনেকটা দূরে যাওয়ার মধ্যে কেমন একটা নিজেকেই পরীক্ষা নেবার ব্যাপার থাকে, যেখানে থাকে শক্ত পরীক্ষায় পাশ করার আনন্দ, ফলে নিজেকেই বেশি নম্বর দেবার প্রবণতা, সম্ভবত নিজের ওপর বিশ্বাস আর ভরসা তৈরি করার জন্যই। 
    আশেপাশে আমাদের হস্টেলে অনেককেই দেখতাম লন্ডন ফেরৎ হয়ে খুব গর্ববোধ করতে, তাই কঠিন টার্গেটটাই সেট করলাম নিজের জন্য।
    প্রথমে হেঁটে, তারপর ট্রলিবাসে, তারপর এরোপ্লেনে চেপে মস্কো পৌঁছে বিশাল সব লাইন টাইনে দাঁড়িয়ে গোটাপাঁচেক দেশের ভিসা নেবার লম্বা প্রসেস অতিক্রম করতেই প্রায় দুসপ্তাহ লেগে গেছল। (এ প্রসঙ্গে আগে লিখেছি "তেহরানের স্বপ্ন" শিরোণামে) । দুটো রাত এবং তিনদিনের জার্নি, কিছুটা জলপথে, অধিকাংশটাই রেলপথে। শুরু হলো যাত্রা দুপুরবেলা। মস্কোর একটা রেলস্টেশন থেকে (বেলোরুস্কি ভাকজাল)।
    দীর্ঘ রেলযাত্রার খুঁটিনাটি এই লেখার প্রতিপাদ্য নয়, প্রাথমিক ঝটকায় ভয়টয় কাটিয়ে দুটো রাত ট্রেনে কাটিয়ে তৃতীয় দিন দুপুরে যখন ফেরিঘাটে ( হুক ভান হলান্ড)  ট্রেন থামল তখন আবার ভয় ভয় অনুভূতিটা ফিরে এলো। বেশ কয়েকঘন্টা পরে ফেরি যখন ভিড়বে ইংল্যান্ডের বন্দরে, তখন যাবোটা কোথায়?
    আমার তো কোনও ঠিকানা নেই।
     
    এটা ভ্রমণকাহিনী নয়। ভ্রমণ করতে গিয়ে বাঙালিদের থেকে সাহায্য পাবার ঘটনা।
    হারউইচে ফেরি থেকে নেমে লাইনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশনের ফর্ম ভর্তি করতে গিয়ে মুশকিলে পড়লাম, ঠিকানা লিখতে হবে। লম্বা  লাইন পাশাপাশি দুটো। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খশখশ করে ফর্ম ফিলাপ করছে। পেন নেই আমার। পাশের লাইনের একজন ছেলের কাছে পেন চাইলাম, ফর্ম ভর্তি করতে গিয়ে তাকে বললাম
    —আমার তো ঠিকানা এখানে কিছু নেই, কী লিখব এখানে?
    সে স্থিরভাবে বলল, তাহলে তুমি যেতে চাচ্ছো কোথায়?
    — লন্ডন।
    — লন্ডনে যেখানে গিয়ে উঠবে সেখানকার ঠিকানা লিখে দাও।
    — সেসব তো এখনও ঠিক নেই...
    ছেলেটা বিরক্ত হয়ে বলল, তাহলে আমি জানি না।
    লাইন সামনের দিকে এগোচ্ছে। ঝপ করে তার ফর্মে সে যা ঠিকানা লিখেছে সেটা দেখে নিয়ে যতটা মনে রাখতে পেরেছি নিজের ফর্মেও সেটা তাড়াতাড়ি লিখে নিয়ে তাকে কলমটা ফেরত দিলাম।
    ইমিগ্রেশন কিছুই সেভাবে খুঁটিয়ে দেখেনি। ফেরিঘাট থেকে ফের ট্রেন, সেখান থেকে লন্ডনের লিভারপুল স্ট্রিট পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা সাড়ে আটটা। আমার পিঠব্যাগটা অসম্ভব ভারি, তাতে রয়েছে খাবার, জলের গোটা পাঁচ ছয় বোতল এবং দুসেট সালোয়ার কামিজ। এই অবধিই আমার টিকিট কাটা ছিল। এখন বাসস্থান খুঁজতে হবে। গ্রীষ্মকাল, তাই শীতবস্ত্রের দরকার নেই, কিন্তু সূর্য অস্তমিত। 
    সিনিয়রদের কাছে শুনতাম তাদের লন্ডনে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব কিছুই নেই, তবু তারা বেড়াতে যেত, যদিও তারা সকলেই পুরুষ। মেয়ে সিনিয়র কেউ ছিল না তাই মেয়েদের অভিজ্ঞতা আমার অজানা।
     
    মস্কোয় যে হোটেলে থেকেছিলাম ভিসা নেবার সময়টায়, সেখানে রোজই নানানজনের সঙ্গে আলাপ হতো। একজন বাংলাদেশি ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সিনিয়র। আগেও দুবার লন্ডন গেছে। এবার যাবে কম্পিউটার কিনতে। পারসোনাল কম্পিউটার বলে একটা জিনিস বেরিয়েছে যেটা নাকি এমনি ছোটখাট কম্পিউটারের চেয়ে দামে বেশি এবং দেখতে শুনতেও খুব ভাল। মাইক্রোসফট বলে একটা কোম্পানীর অপারেটিং  সিস্টেমে ওটা চলে। লন্ডন কি সিংগাপুর থেকে কিনে এনে সোভিয়েত বাজারে বেচতে পারলে বিরাট লাভ। সবাই কিনতে পারে না, প্রচুর দাম, বেশ ওজনও আছে। 
    আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কম্পিউটার কিনতে কত পাউন্ড লাগে? তাতে সে যে সংখ্যাটা বলেছিল তেমন টাকা আমাকে বেচে ফেললেও পাওয়া যাবে না। তার নিজেরও অত পুঁজি নেই॥ যাদের অনেক পুঁজি আছে তারা এরকম ছেলেদের কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এবং যাতায়াত-খাবারদাবারের খরচ  টরচ দিয়ে কম্পিউটার আনানোর কাজ করে। মাথাপিছু একটা কম্পিউটার আনলে কাস্টমসে ট্যাক্স দিতে হয় না। যারা অন্যের পুঁজি নিয়ে কম্পিউটার আনতে যায় তাদের নাম "পাইলট"। এই সিনিয়র ভাইটিও একজন পাইলট।
    আমার মাথায় প্রশ্ন খেলে গেছল, তাই সরাসরি সেই ছেলেটিকে বলেছিলাম— আমিও পাইলট হতে চাই।
    — আপনি?
    ভুরু কুঁচকে আমার দিকে একটু তাকিয়েই সে আর হাসি চাপতে পারে নি।
    — হাসছেন কেন? 
    — আপনি কী করে পাইলট হবেন?
    — আপনার চেনা কেউ থাকলে তাকে একটু বলুন না, এই ট্রিরে আমিও তার জন্য কম্পিউটার এনে দেব। 
    সে আবারও হাসতে থাকে।
    — কী যে কন আপনি!
    — কেন? এতে হাসির কী আছে? টাকা নিয়ে তো  আর আমি পালাবো না, আমাকে তো ফিরে আসতে হবেই এখানে লেখাপড়া শেষ করতে!
    — মাইয়া মানুষ পাইলট। নাঃ। কেউ রাজি হবে না।
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:a0e0:dccc:e2ca:8880 | ২৩ জানুয়ারি ২০২২ ১৪:৫৬735431
  •  
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:a0e0:dccc:e2ca:8880 | ২৩ জানুয়ারি ২০২২ ২০:১৯735432
  • ইদের দিন দুপুর পেরিয়ে বিকেল হবে হবে, তখন ছেলেমেয়েরা সবাই বাড়ি এসে গেছে, আমাদের সেই পাঁচজনের গ্রুপ এবং মনোয়ারার বড়ো ছেলে ও ভাশুরের ছেলে, মোট সাতজনে পৌঁছে গেলাম রিজেন্ট পার্ক।
     
    (বাকিটা পরে লিখছি)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:a0e0:dccc:e2ca:8880 | ২৪ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৩৪735433
  • রিজেন্ট পার্ক একটা মোটামুটি মাঝারি সাইজের পার্ক। তুলনা করা যেহেতু আমার তখন স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে, তাই সোভিয়েত দেশের পার্কগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এটা খুবই ছোট্ট একটা পার্ক, আবার যে শহর আমার জন্মস্থান সেখানে ট্র্যাংগুলার পার্ক ও আছে, সে তুলনায় ইহা সুবিশাল। পার্কের একেবারে ধার ঘেঁষে সেই মস্ক অর্থাৎ মসজিদ। ছোট্ট মর্জিনা পরেছে কমলা রঙের একটা ছিটের ফ্রক, ছেলেরা সব নতুন নতুন শার্ট প্যান্ট, নতুন শার্টগুলো একটু খড়মড়িয়ে রয়েছে। আকন্দবাবু আজ কোট পরেন নি। মরিয়মের সাজ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সে টিনেজার, শ্যাম্পু করা বাদামি চুল পুরো খোলা, স্কিনটাইট জিন্স এবং হালকা গোলাপি স্লিভলেস ব্লাউজে তাকে পরীর মতো দেখাচ্ছে। মস্কের দিক থেকে এদের কয়েকজন চেনা লোককে আসতে দেখা গেল, কুশল বিনিময় করে করে তারা চলেও যাচ্ছে। রিজেন্ট পার্কে প্রচুর লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। 
    এখানে সম্ভবত আমরা বেশিক্ষণ থাকব না, কারন একটু আগেই প্ল্যান করা হচ্ছিল যে সবাই মিলে চিড়িয়াখানা যাওয়া হবে। লন্ডন জু।
    এখন মোটামুটি যেটা হচ্ছে সেটা সামাজিকতা রক্ষা টাইপের ব্যাপার। এরা কেও ধার্মিক নয়। তবে মনোয়ারা প্রত্যেক দিনই নামাজ পড়েন তা কয়েকবার নজর করেছি। 
    আজ সকালেই মনোয়ারা আমার ঘরে এসে বিছানার ওপর বসে তাঁর অদ্ভূত বিশ্বাসের কথা বলছিলেন। আজ সকাল থেকেই বেশ গরম, ইয়োরোপে অধিকাংশ বাড়িতেই পাখা থাকে না, এয়ারকন্ডিশনারের তো প্রশ্নই নেই। কথায় কথায় মনোয়ারা বললেন যে মক্কায় তাঁর স্বামীর কত কষ্ট হচ্ছে এখন গরমে।
    আমি উত্তরে বলেছিলাম যে সৌদিতে তো গ্রীষ্মে খুবই গরম, এই ইদে হজ করার তীর্থযাত্রীদের খুবই কষ্ট হবে।
    উনি ওঁর নিজের মতামত জানালেন — মক্কায় আছে আল্লাহর ঘর। সেই ঘরে থাকে চন্দ্র ও সূর্য। সূর্য সেই ঘর থেকে বের হলেই দিন হয়। চাঁদের ক্ষেত্রেও ঐভাবেই নানারকম সাইজ পূর্ণিমা, না বের হলে অমাবস্যা। সূর্যের অত তাপ ওখানে, তাই মক্কা অত গরম। তাই হজ করা এত কষ্টের।
    এঁকে কিছু বোঝানো বৃথা। যার যার বিশ্বাস তার কার কাছে। আমি কথা বাড়ানোর পথে যাই ই নি।
    আমার যেটা মনে হচ্ছিল সেটা হচ্ছে অনেক অনেক কথা জমে আছে মনোয়ারার ভেতরে। তার কিছু বাস্তব, কিছু কল্পনা, কিছু গর্ব, কিছু দুঃখ, হতাশা, আনন্দ, অসহায়তা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, অবহেলা, সব মিলে মিশে উপচে পড়ছে, অথচ সেসব ব্যক্ত করবার মাধ্যম নেই, শোনানোর পাত্র নেই। হয়ত সেজন্য সম্পূর্ণ অচেনা একজনকে তিনি বলে চলেন তাঁর কল্পনা ও বাস্তব মেশানো কথা। কত কিছু বললেন — লন্ডনের সিলেটি কমিউনিটির কথা, এঁরা নোয়াখালির লোক, প্রায় বিশ বছর আগে এদেশে আসার গল্প, এই দামী অ্যাপার্টমেন্ট কেনার পেছনে স্বামীর দীর্ঘ সঞ্চয়ের অবদান এবং কর্মক্ষেত্রের সাফল্য, তা সত্ত্বেও প্রচুর পাউন্ড কিস্তির জন্য গুনতে হচ্ছে এই অ্যাপার্টমেন্টের জন্য, সেই সঙ্গে তুলনা — আমরা অল্ডগেট ইস্টের বাংগালীদের মতো না, ওরা কাপড় কেচে বাইরে টানিয়ে রাখে, ন্যাস্টি, আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট বড়োলোকদের অ্যাপার্টমেন্ট, দেখেছেন তো এখানে কাপড় কাচার মেশিন বাথরুমের পাশের ঐ ছোটঘরটাতে, আমরা রান্নাঘরে ওয়াশিং মেশিন রাখি না।
     
    পার্কে সবাই সাজুগুজু করে এসেছে। সবাই মুসলমান তবে নানান দেশের, মরিয়ম খুব কায়দা করে হাঁটছে, তার চেনা বন্ধু বান্ধব সম্ভবত ক্লাসমেটদের সঙ্গেও কথা বলল। হঠাৎ একটু সাইডে পার্কের উঁচু রেলিং এর দিক থেকে কে বা কারা যেন শিস দিল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম চারজন ইয়াং ছেলে রেলিংএর ওপর ব্যালেন্স করে বসে পা নাচাচ্ছে। মরিয়ম সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে। একজন ছেলে আবার শিস দিলো, চেঁচিয়ে কী যেন বলল, লোকজনের কথাবার্তার নয়েজ এবং ঐ ছেলেটির ব্রিটিশ অ্যাকসেন্ট এসব মিলিয়ে কিছুই বুঝলাম না। 
    মরিয়ম বেশ দ্রুত পদক্ষেপে চলে গেল সেই ছেলেদের দিকে।
    বোঝো কাণ্ড! আমার মধ্যেকার রক্ষণশীলতাবোধ ফের জেগে উঠেছে। যতই নিজেকে আধুনিক মনে করি না কেন, শৈশবের পরিবেশ, শিক্ষা, সব মশলার মতো মিশে রয়েছে ম্যারিনেড হয়ে শিরায় শিরায় ধমনীতে ধমনীতে। 
    চারটে বখাটে ছেলে ডাকল আর মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে সে দিকে চলে গেল? বিরক্ত লাগল আমার। আকন্দবাবুকে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। মর্জিনা তার দাদাদের সঙ্গে ঘুরছে, নজরুলকে অবশ্য কাছেই দেখলাম, সে রাস্তা থেকে একটা সস্তার রিস্টওয়াচ কিনেছে, সেই রিস্টওয়াচ নিয়েই খুটখাট করছে। 
    পনের বিশ মিটার মত দূরত্ব পা চালিয়ে হেঁটে মরিয়ম ঐ পাঁচিলের নীচে দাঁড়িয়ে কী সব যেন বলল, অমনি ধুপ ধাপ করে  দুজন ছেলে নেমে পড়ল নীচে। চারটে ছেলের পরনেই ট্র্যাক সুট, যে ছেলেটি মরিয়মের একদম কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল তার পরনে বেগুনী রঙের আডিডাস ট্র্যাকসুট। আমি নিজের অজান্তেই এগিয়ে যাচ্ছি ওদিকে। খুব হাসাহাসি চলছে ওখানে। ছেলেটার মাথার চুল রুক্ষ্ম, চোখ দুটো ঘোলাটে, তারা চারজনে সিগারেট খাচ্ছিল একটু আগে। ব্যাপারটা ভাল করে বুঝবার জন্য আমি আরও কয়েক পা এগোলাম। 
    মরিয়ম এবার পাশ ফিরে আমাকে দেখতে পেল, কিন্তু তোয়াক্কা করল না, তার চোখ অন্য কারোকে খুঁজছে। 
    হ্যাঁ, পেয়ে গেছে। নজরুলকে দেখতে পেয়ে মরিয়ম, নজরুলও মরিয়মকে দেখা মাত্র তীরবেগে ছুট্টে চলে এল তার কাছে। তবে মরিয়ম নয়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঐ বেগুনী ট্র্যাকসুট পরা ছেলেটির ওপর। তারপর বলল — ইড মোবারক ভাইয়া!
    পাওয়া গেছে। মনিরুলকে পাওয়া গেছে।
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:ddfa:2afd:9c5a:40e5 | ২৫ জানুয়ারি ২০২২ ২৩:৫৩735460
  • মনিরুল কিন্তু তখন বাড়ি ফিরতে রাজি হলো না। তাকে লন্ডন জু তে বেড়াতে নিয়ে যাবার প্রলোভনও দেখানো হয়েছিল, এরা কেউই আগে লন্ডন জু দেখে নি, কোনও জু ই দেখেনি, তবু মনিরুল নাচার। আজ না ইদ? আজ না পরিবারের সঙ্গে উৎসব উদযাপন করতে হয়? তবু সে বন্ধুদের ছেড়ে যেতে রাজি নয়। সম্ভবত এখানে একটা প্রেস্টিজ ইশু জড়িয়ে আছে। বছর পনেরো ষোলোর মনিরুলের টিনএজার মন ঐ ঘড়ছাড়া বখাটে বল্ধুদের কাছেই থাকতে চায়। সে নিমরাজি হয়ে বলল, সন্ধেবেলা বাড়ি যাবে। 
    তাকে তেমন জোরাজুরি করল না কেউ। এমনিতেই সে বেশ এমব্যারাসড ফীল করছিল বন্ধুদের সামনে। পূর্বপ্ল্যানমাফিক আমরা চললাম চিড়িয়াখানা দেখতে। জন্তু জানোয়ারের সংখ্যা আলিপুর চিড়িয়াখানার তুলনায় হয়ত কম, কিন্তু এই চিড়িয়াখানায় পশুপাখিদের অনেক বেশি যত্ন করা হয় তা স্পষ্ট, তাদের জায়গাও দেওয়া হয়েছে বেশি, খুব মনোরম জায়গা। বেশিক্ষণ লাগল না পুরোটা ঘুরে দেখতে। 
    যতক্ষণ ঘুরেছি ততক্ষণ মনোয়ারার ভাশুরপো আমার ওপর বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছিল। বেড়ানোর পর সে আমাদের সকলকে আইসক্রিম কিনে খাওয়ালো। আমাকে ইমপ্রেস করবার জন্য সে নিজের সম্বন্ধে অনেক কিছু বলছিল। হয়ত মনে করেছিল আমি লন্ডনে থাকতে এসেছি। সবাই মিলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে। 
    বাড়িতে যাকে বলে আনন্দধারা বহিছে ভূবনে। আমরা ঢোকার মিনিট পাঁচেক আগেই মনিরুল বাড়িতে এসেছে। মনোয়ারা সেমাই বানাচ্ছেন রান্নাঘরে, মনিরুল ভিডিও চালিয়ে দিয়েছে — মাইকেল জ্যাকসনের নাচের। মাইকেল খরগোশ সেজে পালিয়ে যাচ্ছে, আর যেটা করছে পিছলে পিছলে হাঁটার মতো করে নাচা, ওর নাম মুন ওয়াকিং।
    নজরুল ভিডিও রিওয়াইন্ড করে করে ঐ মুনওয়কিংটা বারবার চালাচ্ছে এবং নিজেও সেটা করে চলেছে। জমে উঠেছে ইদের সন্ধ্যা।
    রান্নাঘরে গিয়ে মনোয়ারাকে সাহায্য করা আমার নৈতিক কর্তব্য। উনি ভয় পাচ্ছেন — ছেলে এসেছে বটে, কিন্তু যদি আবার চলে যায়? ওকে আটকে রাখা যায় কেমন করে? ওর আব্বা ফিরবে তিন চার দিনের মধ্যেই, তার আগেও ফরে আসতে পারে, ফিরে এসে মনিরুলের এসব কাহিনি শুনলে তো মহা গ্যাঞ্জাম হবে। সে সব সামাল দেওয়া কি সহজ হবে? দোষ তো পড়বে মনোয়ারা আর মনিরুলের ওপর।
    লিভিংরুমে কেউ ভিডিও দেখছে, কেউ কেউ সিরিয়াস আড্ডায় মশগুল, সারা বাড়ি ম ম করছে এলাচ দারুচিনি দেওয়া সেমাইয়ের গন্ধে। মাইকেল জ্যাকসন শেষ হবার পর চলছে গোভিন্দার একটা সিনেমা। 
    কোনও এক নায়িকার সঙ্গে তুমুল নাচছে গোভিন্দা। মনিরুল, নজরুল ও মেয়ে দুজন অপার বিষ্ময়ে দেখছে সেই নাচ। মনিরুল নাচ খুব ভালোবাসে সেটা বুঝে গেছি।
    ওদের কাছে গিয়ে মুরুব্বির মত ঘোষণা করলাম — হি ইজ গোভিন্দা, মাই কাজিনস ফ্রেন্ড।
    — রিয়েলি?!
    নাচ থেকে চোখ ঘুরিয়ে তিনজন আমাকে মনোযোগ দিল।
    — ইয়েস। 
    গুল মারলে বেশি কথা বলতে নেই।
    — ইজ হি বাংগালি?
    সেরেছে! এই সরল প্রশ্ন আমাকে ফাঁদে ফেলে দিয়েছে। 
    — নো।
    এবার ওরা হামলে পড়ল গোভিন্দা সম্পর্কে জানতে। আমার কাজিন কোথায় থাকে, তার কাছে গোভিন্দার ঠিকানা পাওয়া যাবে কি না, মিঠুন চক্রবর্তীকে চিনি কিনা, মিঠুন বাংগালি সেটা ওরা জানে। মোট কথা হিন্দি সিনেমা ওরা দেখে তেমন ভাষা টাশা না বুঝলেও নাচের জন্য দেখে।
    মনিরুলকে আটকে রাখার জন্য এত সব আজগুবি গল্প বলে যাচ্ছিলাম ঐসব তারকাদের বিষয়ে, যে আকন্দবাবুও কাছাকাছি এসে বসলেন। উনি নিশ্চয় বুঝেছিলেন যে গুল মারছি, ওঁক কৌতুকভরা দৃষ্টিই তা বলে দিচ্ছিল। 
    অবশ্য নাচের আলোচনার পর আলোচনা ঘুরে গেল অন্য দিকে, মনিরুল উৎসাহিত হয়ে বলতে শুরু করে দিল তার বাংলাদেশে বেড়াতে যাবার গল্প, নোয়াখালির সেই গ্রাম যেখানে তার নানাবাড়ি ছিল এককালে। সেখানকার অভিজ্ঞতা, কীরকম মজার লোকজন সেই দেশে, উহ কী বোকা তারা, অল্প টাকার লোভ দেখালেই তারা কত কী করে দেয়, আরও কত কী! 
    তারপর সেই সূত্র ধরে আরও গল্প, আরও মনগড়া ফিলিমস্টারদের গল্প করি, এই করতে করতে রাত এত বেশি হয়ে যায় যে মনিরুল ওখানেই রাতের খাবার খায়। 
    মনোয়ারা বলেন — এত রাতে আর গোসল করতে হবে না, শুয়ে পড়।
    ক্লান্ত মনিরুল বাধ্য ছেলের মতো ঘুমোতে চলে যায় নিজের ঘরে।
    মনোয়ারার মুখ থেকে আশঙ্কার মেঘ কেটে গিয়ে স্মিত হাসি। আল্লাহর রহমতে ছেলে ফিরে এসেছে। 
    আমি মনে মনে ভাবি আরব্য রজনীর মতো নাই বা হোক, আজকের রাতটা তো আটকে দিতে পারলাম ছেলেটাকে। মন্দ কী?
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:216d:7e39:13c9:9112 | ৩১ জানুয়ারি ২০২২ ০২:৫৭735542
  • এরপরের কটা দিন ঘুরলাম একা একাই উম্বলডন, গ্রীনিচের রেখা, লন্ডনের হাইড পার্ক, টাওয়ার ব্রীজ, ওয়েস্টমিন্সটার অ্যাবি, ইত্যাদি অবশ্য দ্রষ্টব্য জায়গাগুলো। সঙ্গে আমার ক্যামেরা নেই, তাই সব স্মৃতিগুলো মাথার মধ্যে রেখে দেওয়া। ক্যামেরা না থাকায় একদিক দিয়ে ভালোই হচ্ছিল, জায়গাগুলোর ছবি ফিল্মের রোলে ভরে রাখার বদলে মনের ভেতরে যত্ন করে রেখে দেওয়া যাচ্ছিল।
    গেলাম অক্সফোর্ড স্ট্রীট। লন্ডনে ফেলুদা পড়েছি বহুবছর আগে, লালমোহন বাবুর ভাষায় "ওশন অফ হিউম্যানিটি" দেখবার জন্য বড়ো আশা করে গেছলাম, কিন্তু আবার হতাশ হতে হলো। অক্সফোর্ড স্ট্রীটও তেমন চওড়া রাস্তা নয়, তবে দীর্ঘ রাস্তার দুপাশে সার দিয়ে শুধু দোকান পাট। কিছু কিনবার সামর্থ আমার নেই, কারন ফেরার পথে পশ্চিম বের্লিন থেকে পছন্দের জিনিস কিনবার একটু ইচ্ছে আছে, সেজন্য যেকটা ডলার সরিয়ে রাখা যায় সেটা আগেই সরিয়ে রেখেছি, মরে গেলেও সেটুকু এখানে খরচ করব না। লোকমুখে শুনেছি পশ্চিম জার্মানিতে জিনিসপত্রের দাম ইংলন্ডের চেয়ে বেশ কম।
    সর্বত্র প্লাস্টিকের বিপুল ব্যবহার দেখতে দেখতে ভাবছিলাম রাশিয়ানগুলো কী বোকা! পৃথিবীর অন্যতম প্রধান পেট্রোলিয়াম উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, আর পেট্রোলিয়ামের বাই প্রোডাক্টইতো প্লাস্টিক পলিমার। ওরা এত প্লাস্টিক ব্যবহার করে না কেন? এত কষ্ট করে করে স্টিল, কাঠ, কাঁচের গাবদা গাবদা ভারি জিনিসে ভরিয়ে রেখেছে কেন? (অনেক পরে জেনেছি সমস্ত প্লাস্টিক ওরা জলের দরে বেচে দিত জাপানে কোরিয়ায়— আবর্জনা নিজের দেশে না রেখে ফেলে দেবার এই ই ছিল নিয়ম)।
    কেম্ব্রিজ লন্ডন থেকে দূরে। আমার বড্ড ইচ্ছে ছিল দেখতে যাবার। একদিন দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরেছি একটু রেস্ট নিতে, দেখি আকন্দবাবু ফিটফাট হয়ে একটা বুরুশ দিয়ে কোটের ধুলো ঝাড়ছেন।
    — কোথায় চললেন?
    — হারলো।
    — এটা কোনও জায়গার নাম?
    — হ্যাঁ, যাবেন নাকি?
    — যাবো।
    অনেকগুলো zone এর টিকিট কাটতে হলো আমাদের। তবে লোকাল ট্রেন। 
    — জানেন আমার খুব কেম্ব্রিজ যাবার শখ।
    — এই টিকিটে আপনি কেম্ব্রিজ যেতে পারবেন।
    — সত্যি?
    — চলে যান। কেম্ব্রিজ লাইনের ট্রেন।
    আমি মত বদলালাম। নাহ আপনার সঙ্গেই গল্প করতে করতে যাই।
    ভদ্রলোক চলেছেন চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। ওঁর ওকালতির ডিগ্রী আছে যা বুঝলাম। হন্যে হয়ে খুঁজছেন চাকরি। নিয়মিত চাকরি খোঁজা, ইন্টারভিউ দেওয়া এবং সেসব নথিভূক্ত করে এম্পলয়মেন্ট অফিসে জমা না দিলে বেকারভাতা মিলবে না। ওঁর যমজ দুই কন্যার ফোটো রয়েছে পার্সের মধ্যে। ফুটফুটে দুটো ছোট্ট মেয়ে। 
    ট্রেনে সিগারেট খাওয়া যায় (তখনো নিয়ম ছিল, এমনকি এরোপ্লেনেও সিগারেট খাওয়া যেত), আমি দুপ্যাকেট সিগারেট প্রেজেন্ট করলাম ভদ্রলোককে।
    নানান গল্প হচ্ছে। কাজী সায়েবের কথাও উঠল। তিনি নাকি ব্রিটিশ আমলে একদম কিশোর বয়সে এদেশে এসেছিলেন কোনও একজন বাঙালির (তখন সকলেই ভারতীয়) ভৃত্য হিসেবে। তারপর এখানেই থেকে যান, নাগরিকত্ব পান, পরবর্তীতে দীর্ঘকাল ধরে কাজ করছেন সৌদি আরবের দূতাবাসে পাহারার কাজে। দীর্ঘ কর্মজীবনে ভাল কর্মী হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন, তারই পুরস্কারস্বরূপ কর্তৃপক্ষ তাঁর হজের সমস্ত খরচ বহন করছে।
    হারলো ছোট্ট জায়গা। গ্রীষ্মের বিকেল। একটা ছোট্ট পাঁচমাথার মোড়ে গাছের নীচে বেদী, কাছে কয়েকটা বেঞ্চি পাতা, একটা সিনেমা হল উঁকি মারলেই দেখা যাচ্ছে। ছিমছাম শান্ত পরিবেশ। আকন্দবাবুর ইন্টারভিউ দেবার জায়গা সামনেই একটা সরকারি অফিসে। আমি বেঞ্চিতে বসে রইলাম।
    আমার বেড়ানোর উৎসাহ এখন কমে আসছে। ফেরার পথ হাতছানি দিচ্ছে। আমি ঠিক ক্লান্ত নই, তবে উৎসাহে ভাঁটা পড়ছে ক্রমশঃ সেটা বুঝতে পারছি। এখন ফিরবার টিকিট নিয়ে স্টেশনে খোঁজ নিতে হবে কবে কখন ট্রেন আছে হল্যান্ড থেকে মস্কোর।
    আধঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে ফিরে এলেন মিস্টার আরবাব আকন্দ। মুখ দেখে মনে হলো ইন্টারভিউ দিয়ে উনি সন্তুষ্ট নন।
    যেসব চাকরি ওঁকে অফার করা হচ্ছে, ওঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার অনুপাতে সেসব নেওয়া বড্ড হতাশার।
    হয়ত শেষমেশ সেসব থেকেই একটা ওঁকে নিতে হবে, এভাবে আর কতদিন? আর কতদিন উনি অন্যের বাড়িতে অতিথি হয়ে থাকবেন। একটা চাকরি পেলে বৌ ও মেয়েদুটোকে আনতে পারবেন। কিন্তু বেতন বেশি নয়। অত অল্প বেতনে কেমন করে চলবে গোটা সংসার। ঢাকায় তো রীতিমতো বড়োলোকেদের মত জীবন যাপন করে এসেছেন। এত অল্প বেতনে, কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে থাকার জন্য কেন এসেন তিনি এতদূরে?
    প্রশ্নটা করেই ফেললাম ওঁকে।
    গাছের ছায়ায় পাশাপাশি বসে সিগারেট ধরিয়ে আমরা জিরিয়ে নিচ্ছি। ফেরার ট্রেন একটু পরে।
    আকন্দবাবু আমার প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:b52d:53cc:23ff:da71 | ৩১ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৩৫735543
  • শুক্রবার। 
    খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে আমার। ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরের আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি মনোয়ারা নামাজে। বাথরুম থেকে ফিরে দেখলাম উনি ঘরদোর পরিস্কারে ব্যস্ত। সব কিছু ঝেড়ে মুছে তকতকে করে ফেলছেন। আজ কি কোনও উৎসব?
    আমি টেলিফোনের বইটা হাতে নিয়ে রেলের অনুসন্ধান অফিসের নম্বরটা বের করে ফেললাম। মনোয়ারাকে জিজ্ঞাসা করলাম — একটা ফোন করব?
    — করেন। কাকে?
    — রেল স্টেশনে।
    — কেন?
    — ভাবছি আজ চলে যাব।
    মনোয়ারা অবাক হয়ে থাকেন। 
    — মাত্র কদিন তো থাকলেন। আর থাকবেন না? আজ তো জহিরের আব্বুর ফিরছে।
    অনুসন্ধান অফিস জানালো দুপুরের দিকেই হারউইচ থেকে ছাড়বে জাহাজ হুক-ভান-হল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। 
    তাহলে তো আমার হাতে সময় বেশি নেই। সাড়ে দশটা নাগাদ ট্রেন ছাড়বে লিভারপুল স্ট্রীট থেকে। এখনই বের হই। তাড়াহুড়ো করে ট্রেন ধরা বিশ্রী ব্যাপার।
    শাড়ি পরলাম আজ। সেই ঝোলাব্যাগ আজ হালকা, একটা বোতলও নেই। মনোয়ারাকে বললাম — চলি।
    — কই যাবেন? ইন্ডিয়া?
    — না। সোভিয়েত ইউনিয়ন।
    — সেটা কোথায়?
    — খুব বেশি দূরে নয়।
    উনি সম্ভবত জানেনই না অমন নামের কোনও দেশ আছে। 
    — আচ্ছা, আসেন।
    — অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের আতিথ্য না পেলে আমার এখানে থাকাই হতো না। সেই রাতেই বা পরেরদিন ফিরে যেতে হতো। চলি।
     
    লিভারপুলস্ট্রীট স্টেশনে এসে গেছি বড্ড তাড়াতাড়ি। বাইরে বেরিয়ে দেখি ছোট ছোট দোকান এক এক করে খুলছে। একটা দোকানে ভারি চমৎকার সব জিনসের প্যান্ট। একটা আকাশি রঙের স্কীনটাইট জিনস দেখে লোভ সামলাতে পারি না। কুড়ি পাউন্ড দাম। কিনে নিলাম। আর একবোতল জল। হয়ত এই জলে দুটো দিন কাটবে না, তবু অল্প অল্প করে খেলে দুদিন পরে যখন শ্বেতরাশিয়াতে পৌঁছব, তখন যত পারব জল খাব, যা খুশি তাই করব। সোভিয়েত দেশ আমার দ্বিতীয় মাতৃভূমি। সেখানে আমার এতটুকুও আড়ষ্ট লাগে না। আর এই কটা দিনে আমি তো অনেকটা বড়ো হয়ে গেছি, এই অভিজ্ঞতা, এই সফর, আমাকে অনেকটা সাহসী বানিয়ে দিয়েছে। দিগ্বিজয়ের আনন্দ আমার মনে। 
    এই আকাশী জিন্সটা পরব এবার থেকে। আমি জানি তাশখন্দে অনেক ভারতীয় এবং বাংলাদেশি ওপর বিরূপ হবে আমার এই পরিবর্তন দেখে, তবে আমি দমব না। 
    ট্রেনে বসে আজগুবি কত কী ভাবতে ভাবতে যাই। হারউইচে পৌঁছে ইমিগ্রেশন প্রায় দৌড়ে পার হতে হয়, জাহাজ এই ছেড়ে দিলো বলে। 
    ডেকে পৌঁছতে না পৌঁছতেই হারউইচ দূরে সরে যায়। ছটা ঘন্টা ডেকেই ঘোরাঘুরি করি। ইংলন্ডে পৌঁছনোর দিন যে দুরুদুরু মনে  ঘাবড়ে একশেষ হয়ে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম সে সব ভেবে মনে মনে মজা পাই। 
    কী অদ্ভূত না? যাবার সময় যত রোমাঞ্চ ছিল, তার বিন্দুমাত্রও এখন নেই।
    তবে সামনের পথে পড়ে আছে অনেক অজানা রোমহর্ষক ব্যাপার যা ঘটবে আগামীকাল পূর্ব ও পশ্চিম জারমানিতে। যা অবশ্য আমি তখনও জানি না।
    ১৯৮৯ এর জুলাই মাসের সেই ঘটনাগুলো আমি সারাটা জীবনেও ভুলতে পারব না।
     
    ===========শেষ==========
  • জয় | ৩১ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৫০735544
  • @সেদি
    দারুন। একটা বোকা বোকা প্রশ্ন করি? আপনি নোট/ ডায়েরী রাখেন? না সব স্মৃতি থেকে লেখেন? 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:b52d:53cc:23ff:da71 | ৩১ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৫৪735545
  • জয়,
    না রে ভাই ডায়েরি নেই। যেটুকু মনে পড়ে সেটুকু লিখি। এই সফরের পরে ১৯৮৯ থেকে জীবনে যা পরিবর্তন এসেছিল সেটা আমার স্মৃতিচারণা "ময়ুর ময়ুরী" তে আছে।
     
  • Amit | 121.200.237.26 | ৩১ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৫৮735546
  • এটা এখানেই শেষ ? তাহলে সেই জার্মানির রোমহর্ষক ঘটনা গুলো কোথায় লেখা হবে ? 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:b52d:53cc:23ff:da71 | ৩১ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:০৩735547
  • অমিত,
    তেহরানের স্বপ্নতে আছে ওগুলো।
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:b52d:53cc:23ff:da71 | ৩১ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:০৭735548
  • এই নাও লিংক
     
     
    এখান থেকে পড়বে — "সেবারের সফর খুব উত্তেজনাময় হয়েছিলো, আর রহস্য রোমাঞ্চে ভরপূর, বেড়ানোর পাশাপাশি শপিং চলছিলো সাধ্যের ভেতরেই। তবু কেন জানিনা, ড্রেস মেটিরিয়ালের দোকানে গিয়ে পাঁচমিটার-পাঁচমিটার করে সালোয়ার সুটের পিস্ আর কেনা হলোনা। লন্ডন থেকে ফেরার আগের দিন খুব সাহস করে একটা আকাশি রঙের জিন্স কিনি, কুড়ি পাউন্ড দিয়ে। স্কীন টাইট। পরে অনেক অনেক ব্যবহারে, ওর হাঁটুদুটো ছিঁড়ে যায়, আরো প্রিয় হয়ে ওঠে জিন্সটা আমার কাছে। কারণ ততদিনে হুইটনি হিউস্টনের "আইল বি য়োর বেবী টুনাইট" কাঁপিয়ে ফেলেছে দুনিয়া, এম্ টিভির টপ টেনে নাম্বার ওয়ান! কিন্তু সেতো অনেক পরের কথা। ...
  • Amit | 121.200.237.26 | ৩১ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:২৯735549
  • ওকে। হ্যা - এটা দেখেছি আগে 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:b52d:53cc:23ff:da71 | ৩১ জানুয়ারি ২০২২ ০৬:৩১735550
  • "ময়ুর ময়ুরী"  যদিও এখানে নেই, তবে ওটা আমার অন্যতম প্রিয় অধ্যায়।
  • জয় | ৩১ জানুয়ারি ২০২২ ২১:১২735554
  • সেদি
    ময়ুর ময়ুরী কি বই? গুরুর প্রকাশনা? ই-বুক? কিভাবে পড়ব/ সংগ্রহ করব?
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:b52d:53cc:23ff:da71 | ৩১ জানুয়ারি ২০২২ ২১:২৮735555
  • জয়,
    না। ওটা একটা চ্যাপটার। বইটার নাম "দশকর্ম ভাণ্ডার", প্রকাশনা ৯ঋকাল বুকস।
    ইংলন্ড থেকে কেমন করে কিনবে? আমি এখানে কিছু কিছু অংশ পেস্ট করে দেবোখন।
  • জয় | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২২:০৮735570
  • ধন্যবাদ সেদি এবং স্যান্ডি!
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:d5ee:e24d:c118:83 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:০৭735573
  •  
    জয় এটা রইল
  • জয় | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:৩৭735575
  • @সেদি
    এতো ক্রিসমাস কেম আর্লি!
  • &/ | 151.141.84.216 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:৪৪735576
  • সে দি, আহা, তোমার এই লেখাগুলো বাংলালাইভের মজলিশের দিনগুলো মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। সে কতকাল আগের কথা। সেখানেই তোমার এই গল্পগুলো শুনতাম তখন। সেই আমাদের ভালোবাসার বারান্দা বা মায়াঘর বা মধবীবিতান, যাই বলো। সেইখানেই শুনতাম তোমাদের সেই আঙুরপাতা মুড়ে মাংস রান্না, একজন নাছোড়বান্দাকে "সুরের গুরু দাও দাও দাও গো সুরের দী ঈ ঈ ক্ষা" গেয়ে তাড়ানো, তারপরে সেই "ঝুমকা গিরা রে, বেরিলি কি বাজার মে ঝুমকা গিরা রে।" ঃ-)
    সবাই শুনত। অঙ্গনা, প্রত্যুষা, তুলিরেখা, তিন্তিড়ী, তনুশ্রী --সবাই। ঃ-)
  • &/ | 151.141.84.216 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:৪৫735577
  • মাধবীবিতান 
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৯:১৩735583
  • ভাগ্যিস ময়ুর-ময়ুরী আগেই পড়ে ফেলেছি। তা না হলে এখন এই গল্প শেষ হয়ে গিয়ে মন-খারাপ হয়ে যেত। এবার জার্মানির গল্প পড়ব। লিঙ্কের জন্য অনেক ধন্যবাদ সে-দি! 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:d5ee:e24d:c118:83 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৫:১৬735611
  • সকলকে থ্যাংকস।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন