এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  স্মৃতিচারণ   আত্মজৈবনিক

  • ময়ুর-ময়ুরী

    সে
    স্মৃতিচারণ | আত্মজৈবনিক | ৩১ জানুয়ারি ২০২২ | ১৬৫১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • সে রাতে আমরা ঘুমোতে চাইনি। আমরা তিনজন। ইনফ্যাক্ট ঘুম আমার পাচ্ছিল না। যেটা পাচ্ছিল সেটার নাম ভয় এবং উৎকণ্ঠা। অনেক দিন ধরে তিলে তিলে যে ইচ্ছেটাকে মনের ভেতরে বাড়িয়ে তুলেছি, সেটাকে একা আর বইবার শক্তি ছিল না। একটা থ্রেশোল্ড লিমিট বা ওই জাতীয় কিছু তখন অতিক্রম করবার পর্যায়ে পৌঁছেছে। হয় এসপার নয় ওসপার না করলে ভয়ঙ্কর কিছু হয়ে যেতে পারে। কী যে হয়ে যাবে তা যদিও জানতাম না, তবু বুঝেছিলাম ওটাই লিমিট, এখন বলে দেবার পালা, জানিয়ে দেবার সময়। আমার বুঝতে বাকি ছিল না যে এর নামই প্রেম। হ্যাঁ প্রেমই।
    বাকি যে দুজন আমার সঙ্গে রাত জাগছিল, তারা পাশে ছিল সলিডারিটি প্রিন্সিপল বজায় রাখতে। মে মাসের তাশকেন্ত শহর। আমি সে রাতে নিজের হস্টেলে ছিলাম না। নিজের ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছিল না মোটে। আমাকে মনের জোর জুগিয়েছিল আমার বান্ধবী মীণাক্ষি। ওর হস্টেলে চলে গিয়েছিলাম সন্ধের দিকে। অনেক আলোচনা হয়েছিল। রাত দশটা নাগাদ একটা ছেলে এল গল্প করতে সে ঘরে। নাম সমীর ―পাকিস্তানি ছেলে। সে ও তখন শুনেছিল আমাদের আলোচনা, ঢুকে পড়েছিল আলোচনার মধ্যে। কিছুক্ষণ পরে আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলাম ওদের ―হয় এসপার নয় ওসপার। এইবারে ওই বাড়িয়ে তোলা ইচ্ছের বোঝাটা একা আর বইব না, মনের কথা জানিয়ে দিতে হবে তাকে, যাকে নিয়ে এত কিছু।  মনে হল তক্ষুণি জানিয়ে দিই, রাত অনেক লম্বা লাগছে, অতক্ষণ কি অপেক্ষা করতে পারব?
    ওরা সাহস দিচ্ছিল, নিশ্চয় পারবি তুই। কেবল ঘুমিয়ে পড়িস না। তোকে জেগে থাকতে হবে। এত রাতে যাস না, ভাল দেখায় না। যেই ভোর হবে, বেশি লোকজন থাকবে না চারদিকে, তখন যাস। মনে সাহস নিয়ে যাবি, মনের কথা যেমন করে পারবি বলে দিবি তাকে। লজ্জা ভয় কুণ্ঠা এদের কারোকে আসতে দিস না কাছে ওই সময়টুকুর জন্য। তার পরে দেখাই যাক না কী হয়।
    ওরা খুব সিরিয়াস ছিল আমায় পরামর্শ দেবার সময়ে। ঠাট্টা ইয়ার্কির ব্যাপারই নয়। ওদের জোগানো সাহসের  উপর ভরসা করে আমি জীবনে সেই প্রথম চিরাচরিত সংস্কার ভেঙে নিজের সিদ্ধান্তের উপর আস্থা পাচ্ছিলাম, কিন্তু ঘুমোতে ভয় করছিল, যদি ঘুম থেকে উঠলে আমার মনোবল ভেঙে যায়? যদি ঘুম থেকে উঠলে দেখি এ সমস্তই স্বপ্ন ছিল! ভোর চারটে নাগাদ চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছিল আমাদের। সমীর উঠে চলে গেছিল নিজের ঘরে। মীণাক্ষি বলল― তুই একটু ঘুমিয়ে নে, আমি জেগে আছি, ছ’টায় তোকে ডেকে দেব পাক্কা! ভোর ছ’টাই বেস্ট সময়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে যাবি তার হস্টেলে, কেউ দেখতেও পাবে না অত ভোরে। নে, একটু ঘুমিয়ে নে।
    আমি ওর বিছানায় কুঁকড়ে গুটিয়ে শুয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মীণাক্ষি একটা চেয়ারে বসে গল্পের বই পড়ছিল জেগে থাকার জন্য। যখন ঘুম ভাঙল আমার, জানলার বাইরের আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। মীণাক্ষি চেয়ারে নেই, সে আমার পাশেই কুঁকড়ে শুয়ে আছে, ঘুমোচ্ছে। কটা বাজে! সর্বনাশ! সাড়ে ছটা বেজে গিয়েছে। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে আমি বেরিয়ে যাই।
    সোভিয়েত উজবেকিস্তানের তাশকেন্ত শহরের এই জায়গাটার নাম ভুজগারাদোক। বাংলা করলে দাঁড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহরতলি। এখানে কেবল ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট এবং গাদা গাদা হস্টেল। এক একটা হস্টেলের এক একটা নম্বর। মীনাক্ষির হস্টেল পঁচাশি নম্বর, আমারটা তিরিশের বি। যার কাছে মনের কথা বলতে যাব, তার হস্টেলের নম্বর তিরিশের এ। পঁচাশি নম্বর হস্টেলের পুরনো কাঠের সিঁড়িতে বড্ড আওয়াজ হয়, হস্টেল থেকে বেরিয়ে একশো মিটারের মতো হাঁটা পথ। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে, একটা ঘোরের মধ্যে চলেছি আমি, ঘুম থেকে উঠে দাঁত পর্যন্ত মাজা হয়নি। ঘুমোতে যাবার আগে শেষ মুহূর্তে ঠিক করে নিয়েছিলাম, মুখ ফুটে বলতে না পারলে লেখা চিরকুট ধরিয়ে দেব তার হাতে। যদি গলা ধরে আসে, যদি সাহসে না কুলোয়, যদি আর কেউ থাকে সেখানে, যদি সে বলবার সুযোগটুকু না দেয়, যদি আরও কিছু ঘটে, যদি এই, যদি সেই...
    হাতের মুঠোয় চিরকুট নিয়ে চুপচাপ ঢুকে যাই তাদের ব্লকে। গেটের চৌকিদার আমায় দেখতেও পায় না। এত ভোরে চৌকিদার হয়তো টয়লেটে গিয়েছে। তার চেয়ারটা খালি। সোভিয়েত দেশের প্রায় সমস্ত ছাত্রাবাসের চৌকিদারই মহিলা এবং অধিকাংশই অবসরপ্রাপ্তা মহিলা। এদের বয়স বাষট্টি থেকেন ব্বই, কি আরও বেশি। লিফট নিই না, সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই চারতলায়। বারো নম্বর ঘরের সামনে এসে দরজায় টোকা দিই একবার, কোনও সাড়া নেই। তবে কি খুব আস্তে টোকা দেওয়া হয়ে গেছে? এবার জোরে জোরে দুবার টোকা দিই। দাঁড়িয়ে থেকে একটু অপেক্ষা করে আরও দুবার। কেউ দরজা খোলে না, ভেতর থেকে কোনও সাড়া-শব্দ শোনা যায় না। 
    আমার কেমন শীত করতে থাকে। অসহায় লাগতে থাকে। করিডোরের শেষের ঘর থেকে কে যেন বেরিয়ে এল, আমার সামনে দিয়েই হেঁটে চলে গেল একজন।
    ইঞ্জিনিয়ারিংএ বিদেশি ছাত্ররা অধিকাংশই ছেলে। এই তিরিশের বি বিদেশি ছাত্রদের হস্টেল, এখানে সবাই ছেলে।এত সকালে একটা মেয়েকে এখানে কেউ এক্সপেক্ট করে না। আমার অপ্রস্তুত  মতো লাগে। ওখানে দাঁড়াতে পারি না। ফিরবার পথ ধরি। বুকের ভেতরটা কেমন যেন লাগছে, ধীরে ধীরে হেঁটে মীণাক্ষির ঘরে ফিরে যাই। আমায় দেখে সে চোখ কচলে উঠে বলে, কেয়া হুয়া? বলে দিয়েছিস? কী বলল সে সব শুনে? অ্যাঁ! বলবি তো রে! অ্যাই―
    ―সে নেই। দরজা বন্ধ, কতবার টোকা দিলাম, খুললই না।
    টাইম মেশিন বলে নাকি একটা জিনিস হয়, সিনেমায় দেখিয়েছে― সে সিনেমা আমার দেখা হয়নি যদিও। ইংরিজি সিনেমা আর কটাই বা দেখেছি, হাতে গোনা, জানিনা কেমন দেখতে সে মেশিন, তবে শুনেছি সে মেশিনে চাপলে অন্য সময়ে চলে যাওয়া যায়। আমার কেমন যেন মনে হয় এই শহরে যত রাজ্যের বিদেশি স্টুডেন্ট রয়েছি সকলেই নিজের নিজের দেশ সমাজ কালচারের থেকে সরে গিয়ে টাইম মেশিনে চড়ে এখানে থাকতে এসেছি কটা বছরের জন্য, উচ্চশিক্ষার অজুহাতে। আমাদের সবার ভাষা, ধর্ম, গায়ের রং, সামাজিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও এই কটা বছর আমরা অন্যরকমের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাব। পড়াশুনোর পাট শেষ হলেই ব্যাক টু দ্য ফিউচার ... না! ফিউচার কী করে হবে? ফিউচার নয়, ব্যাক টু দ্য পাস্ট, বা প্রেজেন্ট। কলকাতার নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়ে আমি সামাজিক প্রথার তোয়াক্কা না করে এক বিদেশি ছেলেকে আগ বাড়িয়ে প্রেম নিবেদন করবার সাহস পেতাম কোনওদিনও, মানে এই উনিশশো সাতাশি সালে? আমার ভেতরকার কুণ্ঠা বারে বারে মনে করিয়ে দিত নাকি, যে মেয়ে হয়ে এই নির্লজ্জতা আমাকে মানায় না? দিত। দিচ্ছেও। তাও সাহস করে এগোচ্ছি, প্রত্যাখ্যানের ভয়টাই সবচেয়ে বেশি। যদি সে অ্যাকসেপ্ট না করে, তখন কী হবে? এই মুখ আমি আর দেখাব কী করে সকলকে? এসব ভেবে যেমন পিছিয়ে যেতে চাই, তেমনি ভেতর থেকে টাইম মেশিনে বসা মেয়েটা একটা চান্স নিতে চায়, কে বলতে পারে হয়তো সে অ্যাকসেপ্ট করেই নিল আমার প্রস্তাব। ফিফটি ফিফটি চান্স তো আছেই।
    মীণাক্ষি আমায় আবার যেতে বলে। হয়তো সে ঘুমিয়ে ছিল, শুনতে পায়নি। এমনওতো হতে পারে সে হয়তো বাথরুমে গেছল। সে জানবেই বা কেমন করে যে আমিই এসে দরজায় টোকা দিচ্ছি!
    ঠিক যুক্তি। যুক্তিটা আমার মনে ধরে। গত দু’তিন মাস ধরে যে কত রকমের চেষ্টা চালিয়েছি তাকে বোঝানোর, সেসব তো মীণাক্ষির অজানা নয়। ও বলে, আর একবার তুই যা। কী হবে? হয় মেনে নেবে নয় ফিরিয়ে দেবে― এইই তো। এর চেয়ে বেশি অপশন তো নেই, তাই না? তবে তোর মাথার চুল উস্কোখুস্কো হয়ে আছে, চিরুনি নে, ভাল করে চুল টুল আঁচড়ে, দাঁত মেজে, চোখে মুখে জল-টল দিয়ে তবে যা, ভূতের  মতো দেখাচ্ছে তোকে।
    আমি ঘড়ির দিকে তাকাই। নাহ, পরিপাটি হয়ে বেরুতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। তার সাড়ে আটটায় ক্লাস, যদি বেরিয়ে যায়, তাহলে? ―তাহলে কাল যাবি, বা পরশু, সে তো আর চলে যচ্ছে না আজই দেশ ছেড়ে! আমার মন বলে, এমনি সাহস তুমি কাল না ও পেতে পারো, এখনই যাও। আমি ফের হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে যাই। একটা ঘোরের  মতোন পুরো পথটা অতিক্রম করে সোজা আবার সেই চারের বারো ঘরের সামনে গিয়ে দেখি দরজাটা অল্প খোলা। উঁকি দেব? নাহ। টোকা দিই খোলা দরজাতেই। আর তক্ষুনি সে দরজার পাল্লটা পুরো খুলে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে― কী খবর?
    কথা বলবার ক্ষমতা হারিয়েছি তখন। চিরকুটটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে আসছি, সে বলে― দাঁড়াও! দাঁড়িয়ে আছি ঘরের বাইরে। সে ভেতরে গিয়ে কাগজটা পড়ছে তাও দেখতে পাচ্ছি। একটা জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে নেয়, হাতে নেয় ব্রিফকেস, তার মানে এখনি বেরিয়ে যাচ্ছিল ক্লাসে। ভাগ্যিস সময়মতো এসে পড়েছিলাম। কিন্তু ও তো চিরকুটটা পড়ল, কিছু বলছে না তো! হ্যাঁ কি না, কিছু তো একটা বলুক। সে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার চাবি ঘুরিয়ে বলে, চলো। আমি তার সঙ্গে সঙ্গে চলি। এখন আর আমার মনে কোনও ভয় নেই, যা বলবার বলে দিয়েছি। আমরা একতলার ক্যান্টিনে যাই। সে আমায় বসতে বলে একটা টেবিল দেখিয়ে, তার পরে দুজনের জন্য খাবার নিয়ে আসে, গরম সুপ, ক্রিম, রুটি, গরম কম্পোত। আমি সিঁটিয়ে বসে আছি দেখে সে বলে, নাও খেতে শুরু করো। অ্যালুমিনিয়ামের চামচে করে গরম সুপ খেতে গিয়ে আমার ঠোঁট জিভ পুড়ে যাচ্ছে, খেতে পারছি না। সে চটপট খেয়ে নেয়, আমার খাবার অভুক্ত পড়ে থাকে। তার তখন ক্লাসে যাবার তাড়া। কোনও কথা বলিনি আমরা খাবার সময়ে। সে হস্টেল থেকে বেরিয়ে যাবার সময় আমায় বলে, সন্ধেবেলা কথা হবে।
    আমি দৌড়তে দৌড়তে ফের মীণাক্ষির হস্টেলে, সে যা বলল তার অন্তর্নিহিত অর্থ কী, তা মীণাক্ষি নিশ্চয় বুঝবে, আমি তো কিছুই বুঝলাম না।
    ―মীণাক্ষি শোন, চিরকুট দিয়েছি।
    ―কী বলল চিরকুট পড়ে?
    ―কিছুই না, ক্যান্টিনে নিয়ে গেল, দুজনে খেলাম, তারপরে ক্লাসে চলে গেল, বলল সন্ধেবেলা কথা হবে।
    ―সন্ধেবেলা কোথায় কথা হবে?
    ―তা তো জানি না!
    ―জিজ্ঞেস করলি না?
    ―নাহ। আমার কথা বলবার অবস্থা ছিল না। আজ আমি আর ক্লাসে যাচ্ছি না, বুঝলি?
    আমার জন্য মীণাক্ষিও ক্লাস কামাই করে সেদিন। তার পরে আমরা প্ল্যান করতে থাকি সন্ধেবেলা কী হবে, কী হতে পারে, কী করা যায়। মুখের উপরে প্রত্যাখ্যান তো করেনি। চান্স আছে। সেই চান্সের সদ্ব্যবহার করতে হবে। শাস্ত্রে বলেছে পুরুষের মন জয় করতে হয় ভাল খাবার দাবার খাইয়ে। আজ দারুণ কিছু রান্না করতে হবে, সুস্বাদু খাবার। সারাটা দিন সময় আছে হাতে। 
    ―বাজপাখীর কাছে ধরা দিতে চলেছিস তুই, তোকে ভাল করে প্রস্তুত হতে হবে।
    ―বাজপাখী কেন? ও আবার কী কথা!
    ―বাহ, তুই জানিস না, শাহীন মানে কী? শিকারি পাখি বাবা। এমন একটা হ্যান্ডসাম ছেলের গার্লফ্রেন্ড হতে চাইছিস, তোকে স্মার্ট হতে হবে। কিন্তু তার আগে ঠিক করে নিই আজ সন্ধের মেন্যু। বাংলাদেশি ছেলে যখন, তখন বাঙালি খাবারই বানানো উচিৎ।
    ―আমি তো তেমন কিছু রান্না করতে পারি না।
    ―তাহলে আমার  উপর ছেড়ে দে, আফগানি মেয়েদের থেকে পোলাওয়ের রেসিপি জেনে নিয়ে আজ আফগানি পোলাও বানাব, সঙ্গে থাকবে মাংস। এমন সুন্দর করে রান্না করতে হবে যে শাহীন তোর কেনা গোলাম হয়ে থাকবে। চল চল, কাঁচা বাজারের শপিংটা সকাল সকাল করে আসি।
    এমন কথা শুনলে মন হাল্কা হয়ে যায়। আমরা নিমেষের মধ্যে বাজার করতে বেরিয়ে যাই।


    আজ ক মাস ধরে আমরা কাছ থেকে মিশছি, প্রেম দিয়ে যে সম্পর্কের গোড়াপত্তন, তা এগিয়ে চলেছে দ্রুত বেগে। আর কে না জানে অধিকাংশ প্রেমই বিয়েকে টার্গেট করে এগোয়। যতই টাইম মেশিনে বসবাস করি না কেন, যুগ যুগ ধরে পাখি পড়া করে যা আমাদের শেখানো হয়ে গিয়েছে, যা রক্তের মধ্যে মিলে মিশে স্বতঃসিদ্ধের মতো মানবজাতিকে বুঝিয়েছে, তা হল প্রেমের আল্টিমেট পূর্ণতা বলো, কি পরিণতি বলো, ইন অ্যা পজিটিভ সেন্স, তা হচ্ছে বিয়ে। ভালবাসবার আগে না হলেও, ভালবাসতে বাসতে তো মনের ভেতরে এসব চিন্তা-ভাবনা এসেই যায়। মুখে বলতে হয়তো সঙ্কোচ করি আমরা, কিন্তু মন তো অনেক দূর অবধি ভেবে রাখে।
    এই ছেলের সঙ্গে এক ঘরে না থাকলেও মিশছি তো! খাচ্ছি দাচ্ছি এক সঙ্গে ঘুরছি শুচ্ছি, সবই হচ্ছে, তো তার একটা নির্দিষ্ট পরিণতি, একটা গোল ভেবে রাখব না? মনে মনে তো অনেক কিছুই ভেবে রাখা থাকে, মুখ ফুটে প্রকাশ করাটাই কঠিন কাজ। সে মুসলমান আমি হিন্দু, সে বাংলাদেশি আমি ভারতীয়, তার ভাষা সিরাজগঞ্জের,  আমারটা কলকাতার, তারা কনজার্ভেটিভ আমরা খোলামেলা, তবু এই ছেলেকেই বেছেছি আমি ভবিষ্যতের জীবনসাথী করে নেব বলে। সে ও কি এমন করেই ভেবে রেখেছে? তাকে কি একথা জিজ্ঞেস করা যায়?
    হস্টেলে নিজের ব্লকে গিয়ে আমি নিজের ঘরের নিজের টেবিলের উপর থেকে বই খাতা প্রজেক্টের কাগজপত্র দেখতে দেখতে ভাবি, পড়াশুনোয় আমি ভাল হয়ে গেছি এদেশে এসে। পাশ টাস করে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে শাহীনের গলায় মালা দিয়ে... ―আচ্ছা মুসলমানরা কি মালাবদল করে বিয়ে করে? আমায় কি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে বিয়ে করবার জন্য? তখন নিশ্চয় আমার নামটাও মুসলমান মেয়েদের মতো হয়ে যাবে। আর পদবীও পাল্টাবে। শাহীনদের সব ভায়ের একই রকম পদবী― চৌধুরী, অথচ বোনেদের নামের পেছনে চৌধুরী নেই, ওরা তিন ভাই পাঁচ বোন। ও সবার চেয়ে বড়। তার মানে ওর বিয়ে সবার আগে হবে, নাকি ওর পরের বোনটার আগে হবে বিয়ে? মেয়েদের বিয়ে তো আগে আগে হয়। আমাদের ইস্কুলে একই ক্লাসে একটা মুসলমান মেয়ে ছিল― নার্গিস। গোটা ইস্কুলে ওই একটা মুসলমান মেয়ে। নার্গিস নামটা সুন্দর, কিন্তু আমি একটা অন্য নাম নেব, আরও সুন্দর কোনও নাম। 
    কলকাতায় আমার আপনজন, বন্ধু, আত্মীয়, চেনা-জানা যারা আছে, সবাইকে ছেড়ে বাংলাদেশে গিয়ে থাকব। আমার নাগরিকত্বও কি পাল্টে যাবে? নিশ্চয় যাবে। যেতে বাধ্য। ভারতের সংবিধানে কীসব নিয়ম-টিয়ম আছে, মেয়েরা অন্যদেশিকে বিয়ে করলে নাগরিকত্ব হারায়, আর ছেলেরা অন্যদেশিকে বিয়ে করলে তার বউ ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করে। সিম্পল ব্যাপার। বাংলাদেশের সংবিধানও ওরকম কাছাকাছি কিছু একটা হবে নির্ঘাৎ। তার পরে দু’দেশের মধ্যে যাতায়াত করবার জন্য ভিসা টিসার ব্যাপার তো থাকবেই। ইশ্ বাবা কত দূর ভেবে রেখেছি আমি! কিন্তু ভেবে রাখাটা ভাল।  এই দ্যাখো... প্রোজেক্টের কাজের হিসেবগুলো সব কষেই রেখেছিলাম দেখছি, এখন শুধু সেটা কাগজে এঁকে ফেলা বাকি। আমি বোর্ডের  উপর কাগজ সেঁটে, স্কেল পেন্সিল নিয়ে ঝুঁকে পড়ে হিসেব করে করে ড্রয়িং করতে থাকি।
    অনেকেই শুনে একটু আশ্চর্য হয় আমাদের কতগুলো ব্যাপার জানলে, না না হিন্দু মুসলমান, কি অন্য দেশ, সেসব নয়। ওরা অবাক হয় জানলে যে আমি এখনও আমার প্রেমিককে আপনি আপনি করে সম্বোধন করি, অথচ সে কিন্তু আমাকে তুমি তুমি করে বলছে। আইডিয়াটা তারই, কী, না আমি বয়সে ছোট। এর পেছনে যুক্তি দেওয়া যায় যে তাহলে তো দুনিয়ার সমস্ত বউই তাদের বরদের আপনি আপনি করে ডাকত, তা কি করে? অবশ্য আমরা তো বর-বউ নই। আমরা হচ্ছি বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড যারা কিনা আমার যুক্তিতে টাইম মেশিনের যাত্রী। এখানে সব সম্ভব। আর আমি তো স্বাধীন মেয়ে, যে স্বাধীনতা আমি বাই বার্থ পাইনি। কে একজন বলেছিল না, ফ্রিডম ইজ মাই বার্থ রাইট অ্যান্ড আই শ্যাল হ্যাভ ইট। মাধ্যমিকের ইতিহাসের সিলেবাসে ছিল, এই উক্তিটি কার? একদম মনে পড়ছে না। তা সেই বার্থ রাইট নিয়ে তো মেয়েরা জন্মায়ই না দুনিয়ায়। সেই ফ্রিডম আমাদের ফ্রিতে আসে না, চড়াদাম দিয়ে কিনতে হয়। আজ একটু একটু করে ফ্রিডম কিনতে কিনতে খাপছাড়া ভাবে কতকটা এগিয়েছি, মেয়েরা উচ্চাশিক্ষা করছি, ইঞ্জিনিয়ারিং বাওয়া, কম কথা নয়... খুব প্রগ্রেসিভ মেয়ে আমি। কলকাতায় থাকতে, এমনকি কদিন আগে পর্যন্তও জিনস পরতাম, ক্লিভেজ দেখানো ব্লাউজ ছিল জিন্সের উপরে। মিনি স্কার্ট, সেক্সি লেগ্স দেখানো, সেসব পেরিয়ে এসেছি। সেসব আর হবে না, স্বাধীনতার জন্য যেমন দাম দিতে হয়, তেমনি প্রেমের জন্যেও এখন দাম চোকাচ্ছি। 
    এখন বেশির ভাগ সময় শাড়িই পরি, ঘরে বাইরে। আমার প্রিয় বন্ধু মীণাক্ষি― যে আমার এই প্রেমটা যাতে ক্লিক করে তার জন্য প্রচুর খেটেছিল, যাকে আমি কথা দিয়েছিলাম যে তার প্রিয় মানুষটার সঙ্গেও তার আমি মিলনের ব্যবস্থা করিয়ে দেবো ইন রিটার্ন, যে কথা আমি রাখতে পারিনি, সেই মীণাক্ষির সঙ্গে আমি পারতপক্ষে মিশি না, মানে মেশাটা বন্ধ করে দিয়েছি, সরাসরি তো তাকে বলতে পারিনি যে তোর সঙ্গে আর মিশব না, তবে এড়িয়ে যাই। পালিয়ে থাকি। আচ্ছা, হ্যাভ মানে খাওয়া না? হ্যাভ সাম ফুড বলে তো লোকে, মানে― খাও। ফ্রিডমকেও হ্যাভ করতে গিয়ে খেয়েই ফেললাম মনে হচ্ছে। হ্যাভ সাম ফ্রিডম― এরকম হবে কি এর ইংরিজিটা? তোমার স্বাধীনতাকে তুমি গিলে খাও, ... হিঃ হিঃ হি।  নাঃ অনেকটা ড্রয়িং করে ফেলেছি। এখন খেতে হবে। ওই ব্লকে রান্না হয়ে গেছে নিশ্চয়ই, একবার গিয়েই দেখে আসি, খিদে পেটে ড্রয়িং করলে ভুল হবে। শাহীনের ঘরে ঢুকবার আগেই গন্ধে মালুম দিচ্ছে রান্না শেষ। ঘরে ঢুকে দেখি সে তার পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়নটা গলায় ঝোলাচ্ছে। এখানে তো হারমোনিয়াম নেই, তাই ওটাই কিনেছে, ওটাই বাজায়, সবই রবীন্দ্রসংগীত। আমরা গাইছি
    আমার চোখে তো সকলই শোভন,
    সকলই নবীন, সকলই বিমল―
    দরজা খোলাই থাকে, আমরা পরস্পরের চোখের দিকে চেয়ে গান গাই। অন্য ফ্লোর থেকে তার বন্ধুরা এসে হাজির হয়, যারা বাংলা বোঝে।
    আমার মতন সুখী কে আছে আয় সখী, আয় আমার কাছে—
    সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ ।
    প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা—
    একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা
    ভাবনা কাহারে বলে―
    কোথা থেকে যেন শাহীনের বন্ধু খুরশিদদা হাততালি দিতে দিতে এগিয়ে এসে বলেন, খুব ভাল আছেন আপনারা, দেখে চোখ সার্থক হয়। আল্লার কসম ইয়ার্কি করছি না, আসলেই।
     
     
    মীণাক্ষিকে দেওয়া কথা যে আমি রাখতে পারিনি তার পেছনে আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা দায় তো থেকেই যায়। পঁচাশি নম্বর হস্টেলের বাসিন্দা মীণাক্ষিকে গোড়া থেকেই দেখেছি একঘরে হয়ে থাকতে ভারতীয়দের সমাজ থেকে। তাই বলে কি কেউ ওর সঙ্গে মিশত না? মিশত। কিন্তু যারা মিশত, ওর ঘরে গিয়ে গল্প আড্ডায় অংশ নিত, তারাই আড়ালে ওকে ঘৃণা করত, লেংড়ি রান্ডি বলে উল্লেখ করত। মীণাক্ষির দুটো পা ই পোলিওর প্রকোপে শুকিয়ে যাওয়া, বাঁ পা টা বেশি শুকনো, ডান পায়ের অবস্থা অতটা খারাপ নয়, ও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটত। ও পড়ত রাশিয়ান ফিলোলজি― ভাষাতত্ত্ব। তাশকেন্তে বসবাসের প্রথম থেকেই শুনেছিলাম যে মেয়েটার দুর্নাম আছে, ওর স্বভাব চরিত্র ভাল নয়। পরে যখন ওর হস্টেলের কাছের হস্টেলেই আমি থাকতে এলাম, ও যেচে আলাপ জমিয়েছিল আমার সঙ্গে। ক্রমশ আমরা বন্ধু হয়ে যাই। মীণাক্ষি শাড়ি পরত না, পাঞ্জাবি মেয়েরা বিয়ের আগে শাড়ি পরে না। ওকে আমি সবসময় দেখেছি প্যান্ট পরতে, তাতে কে কী বলল রটালো ওর নামে সেসবের তোয়াক্কা ও করেনি। হয়তো পোলিও হওয়া খোঁড়া মেয়ে বলেই ও আর সমাজের বিধি-নিষেদের তোয়াক্কা বেশি করত না, জানতই যে ওই খোঁড়া পা দুটোর জন্য এমনিতেই সম্বন্ধ করে বিয়ে টিয়ে হবার সম্ভাবনা নেই।
    বিয়ে তো একটা জরুরী ব্যাপার ছিলই ভারতীয় মেয়েদের জন্য। সৌন্দর্য, নম্রতা, মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলা, এ সবই তো নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলবার জন্য, যাতে ছেলেরা পছন্দ করে, প্রেম হোক কি সম্বন্ধ করে বিয়ে, যাতে পাত্রপক্ষ বুঝতে পারে মেয়েটা স্বামীর ঘরে মানিয়ে গুছিয়ে নেবে, ঝামেলার সৃষ্টি করবে না, প্রতিবাদী হবে না। কিন্তু যে মেয়ের পা দুটোই রুগ্ন, যে মেয়ে হাঁটতেই পারে না ভাল করে, তার জন্য তো বিয়ের চিন্তা আউট অফ কোয়েশ্চেন। তার উপরে মেয়েটার ছিল হাঁপানির রোগ। চতুর্দিকে এত নীরোগ, সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী মেয়ে থাকতে কেন লোকে একটা বিকলাঙ্গ মেয়ের দিকে সাধ করে ঝুঁকবে, বাজারে কি সুস্থ শরীরের মেয়ের অভাব পড়েছে? তবু মনের গভীর থেকে মীণাক্ষি তা মানতে চায় না, অবুঝ  মতো হয়ে থাকে, আমায় বলত― দেখ আমার মুখটা কি যথেষ্ট সুন্দর নয়, ওই দেখ অমুক মেয়েটাকে দেখ, কী বিচ্ছিরি দেখতে, তবু ওই ছেলেটা ওই মেয়েটার জন্য পাগল। এইরকম সব কথাবার্তা।
    ওর খুব কাছের বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও বলতে পারিনি, যে মুখটা যতই তোর সুন্দর হোক না কেন, সব আটকে যাচ্ছে ওই খোঁড়া পা দুটোর জন্য। এভাবে মুখের উপরে কঠিন সত্য বলে দেওয়া যায় না। তবে ও নিশ্চয় তা বুঝত, এবং যখন আমি শাহীনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি, তাকে কিছুতেই বলে বা বুঝিয়ে উঠতে পারছি না মনের কথা, তখন আমরা দুই সখী সারাক্ষণ গল্প গুজব করতাম, সব আলোচনারই টপিক থাকত― প্রেম। কীভাবে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, কীভাবে চোখের ভাষায় জানিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু আমার সমস্ত চেষ্টাই বিফলে যাচ্ছিল।

    এমনি সময়ে আমরা অন্যান্য ছাত্রদের কাছ থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জেনে নেবার চেষ্টা করতাম যে আমার অভিষ্ট মানুষটার ‘কেউ’ আছে কি না, মানে সে অলরেডি অন্য কারও সঙ্গে এনগেজড কিনা, মানে আমার আদৌ কোনও আশা আছে কি নেই। নানান রকমের ইনফরমেশন পেতাম, কেউ বলত ওর রাশিয়ান গার্লফ্রেন্ড আছে, কেউ বলত জানে না, কেউ জোর দিয়ে বলত কোনওদিনও কোনও মেয়ের সঙ্গে ঘুরতে দেখেনি। কেউ বলত বাংলাদেশিদের কাছ থেকে জেনে নিলে সঠিক খবর মিলবে। এই প্রস্তাবটা আমাদের দুজনেরই মনে ধরেছিল। তখন আমরা ফন্দি ফিকির করে ছক কষতে বসে গেছলাম, কোন বাংলাদেশিকে জিজ্ঞেস করা যায়, রিলায়াবেল সোর্স চাই, তেমন হলে মীণাক্ষি নিজেই উপযাজক হয়ে সব খবর বের করে আনবে। তেমনি একজনের নাম উঠে এসেছিল আমাদের লিস্টে, সাত্তার। বলেছিলাম তুই সাত্তারের কাছ থেকে জেনে নিতে পারবি?
    মীণাক্ষির মুখে অদ্ভূত অভিব্যক্তি খেলে গেছল। সেই সময় ও জানিয়েছিল যে সাত্তারকে ওর পছন্দ। মহম্মদ আবদুস সাত্তার, থার্ড ইয়ার ইলেট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাঝারি হাইট, কিউট  মতো দেখতে, পড়াশুনোয় চৌখশ, এবং শাহীনের দেশের বাড়ির খুব কাছেই নাকি থাকে, ওরা একসঙ্গে রান্না করে খায়, একই ব্লকে থাকে, সাত তলার এগারো নম্বর ঘর। মরে গেলেও সাত্তারের ঘরে গিয়ে ও তাকে ডেকে আনতে পারবে না, তবে আমি যদি ডেকে আনি তাকে, তবে কথা বলার কাজটা মীণাক্ষি করে দেবে, এবং যদি আমি আমার অভিষ্ট মানুষটার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি, তবে মীণাক্ষির মনের কথা সাত্তারকে জানিয়ে দেবার একটা কর্তব্য আমারও থেকে যাচ্ছে। ও যেমন আমার জন্য এত কিছু করছে, আমিও যেন প্রতিদানে ওর জন্য কিছু করি। মীণাক্ষিও থার্ড ইয়ার, সামনে আরও দু-তিন বছর রয়েছে, সেই আগামী বছরগুলো যেন ও প্রেমে আনন্দে কাটাতে পারে, বিয়ে টিয়ের  মতো অত সুদূরপ্রসারী অ্যাম্বিশন ওর নেই, সেসব ইচ্ছে কবে কোন কালে মরে ভূত হয়ে গিয়েছে।
    আমি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেছলাম। এ তো এক ধরণের ডিল। তুই আমার জন্য করছিস, আমি তোর জন্য করব। আমারটা সফল না হলেও করব, শত হলেও বন্ধু তো আমরা। তখুনি ছুটে যেতে চেয়েছিলাম সাত্তারের ঘরে, মীণাক্ষি বাধা দিয়েছিল, এখনই যাস না, এখন দেখতে বিশ্রী হয়ে রয়েছি, কাল যাস, কাল সন্ধেবেলায় ডেকে নিয়ে আসিস আমার ঘরে , না... না... আমার ঘরে নয়, তোর ঘরে নিয়ে যাস, আমি তোর ঘরেই থাকব, তোর রুমমেটকে সে সময়ে চলে যেতে বলিস।
    পরের দিন মীণাক্ষি সেলুন থেকে চুল কাটিয়ে এসেছিল, দু’হাতের নখে নতুন রং লাগিয়েছিল, ফিরোজি রঙের একটা ব্লাউজ পরেছিল কালো ডেনিমের উপরে। ওর চেহারার সবচেয়ে সুন্দর যে অঙ্গ― ওর চোখদুটো ও অনেক যত্ন করে সাজিয়েছিল আই লাইনার, মাস্কারা, আইশ্যাডো দিয়ে। এইই তো আমাদের এক সমস্যা আমরা মুখ ফুটে নিজের মনের কথা সরাসরি বলতে পারি না, সব সময় সাহায্য নিতে হয় ইশারা ইঙ্গিতের। সরাসরি নিজে থেকে মুখ ফুটে বলতে যাওয়ার সাহস আমাদের থাকে না, আমাদের আভাসে জানতে হয় সব। এসমস্ত কথাই বলছিলাম, হাসি ঠাট্টাও করছিলাম, আমাদের ভয়েস শোনা যায় না, সবই মনের ভেতরে চাপা থাকে, মানে আমরা অ্যাকটিভ ভয়েস হতে পারলাম না, প্যাসিভ ভয়েস হয়েই রইলাম, ইত্যাদি। 

    তার পরে আমি সোজা সাত্তারের ঘরে গিয়ে তাকে ডেকে এনেছিলাম, বলেছিলাম মীণাক্ষি এসেছে, ডাকছে, কথা আছে। সাত্তার নিমেষে পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে আমার সঙ্গে চলতে শুরু করেছিল, একটা ব্লক থেকে অন্য ব্লক অবধি যাবার পথে বারবার জিজ্ঞেস করছিল, কী নিয়ে কথা, কেন মীণাক্ষি ডাকছে। আমি মুখ ফুটে বলিনি আসল কারণ।
    ওরা নিজেদের মধ্যে রাশিয়ানে কথা বলেছিল, আমি দূরে দূরে ছিলাম। মীণাক্ষি এক এক করে জেনে নিচ্ছিল শাহীনের ব্যাপারে, আমি চা বানাচ্ছিলাম, কি অন্য কিছু কাজ করছিলাম, কাছাকাছি যাচ্ছিলাম না। দূর থেকে মীণাক্ষি চোখের ইশারায় জানাচ্ছিল যে আমার চিন্তার কিছু নেই, খুব হাসছিল ওরা দুজন। সাত্তার যেন মাঝে মাঝেই আমার দিকে তাকাচ্ছিল, আমি বুঝতে পারছিলাম না কী বলতে চাইছে সে চোখ দিয়ে। আলোচনার শেষে তিনজনেই হস্টেলের বাইরে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, তখন বেশ অনেকটাই রাত হয়ে গিয়েছে। দূরের স্ট্রিট ল্যাম্প থেকে যেটুকু আলো ছড়াচ্ছিল খুব বেশি নয়।ওদেরকে আলাদা হাঁটতে দিয়ে আমি ইচ্ছে করেই একটু এগিয়ে এগিয়ে হাঁটছিলাম। আর পঁচাশি নম্বরের প্রায় সামনেটায় পৌঁছে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম নিঃস্তব্ধ ফাঁকা রাস্তাটার  উপর একটা ছোট্ট কিয়স্কের পাশে দাঁড়িয়ে ওরা চুমু খাচ্ছে।

    প্রেমে পড়তে পড়তেই গরমও পড়ে গেল। জুন মাস। পরীক্ষার মাস। এই সময়টা আমার আর মীণাক্ষির সঙ্গে সর্বদা সঙ্গ দিয়েছিলেন একজন― কিশোরকুমার। খুব শুনতাম গাইতাম কিশোরকুমারের গান, বিশেষ করে সেই গানটা ―তারে আমি চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি―
    যখন হস্টেলের সামনে দিয়ে হাঁটতাম তখন শুনতে পেতাম বাংলাদেশিদের ঘরের জানলা দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা গান, ওদের সব ওয়াকম্যান ছিল, সেগুলোয় অ্যাম্পলিফায়ার লাগিয়ে স্পীকারের সঙ্গে জুড়ে দিব্যি মিউজিক সিস্টেম বানিয়ে নিত। চেনা গান শুনতে পেলেই সেটা মনে মনে গাইতে ইচ্ছে করে, হয়তো মীণাক্ষির সঙ্গে চলেছি, অমনি শুনে শুনে এক কলি গেয়ে নিলাম, আসতে যেতে এ এ ছলকিয়া যায় রে যৌবন, অমনি মীণাক্ষি জিজ্ঞেস করবে এই কলির মানে কী? তখন আমায় তা বোঝাতে হবে তাকে, না জানি আমি হিন্দি, না পড়েছি ইংরিজি ইস্কুলে, রাশিয়ানেও অত দড় হয়ে উঠিনি, তবু যাহোক তাহোক করে মানে বুঝিয়ে দিতাম। মন খারাপের দিনে মীণাক্ষি নিজেই গেয়ে ফেলত― বিষের আবার ভালমন্দ কী রে যখন আমি মরতে বসেছি। তার পরে বারবার বলত, যোশি ও গানা ফিরসে সুনানা, আমরা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে গান গাইছি, সুর টুর সব ঠিক মতো লাগছেও না, তবু সে এক অন্যরকম ব্যাপার, বারবার একই কলি ফিরে ফিরে গাইছি, মীণাক্ষির পছন্দের কলি।
    পরীক্ষার মাসে সবাই মোটামুটি ব্যস্ত থাকে। রোজদিন যদিও পরীক্ষা থাকে না। আমার তখন সেকেন্ড সেমেস্টার। তখন আমার একমাত্র পোশাক শাড়ি। একটা ছাইরঙা খোলের গোলাপি পাড়ওয়ালা তাঁতের শাড়ি ছিল, সেটা প্রায় প্রায়ই পরতাম। আমার রুমমেট ছিল মঙ্গোলিয়ার মেয়ে― তুমে। ওর পুরো নাম তুমেন্দেনবেরে সাইদারাহিন। ছোটো করে তুমে নামেই সে পরিচিত ছিল। তুমে থার্ড ইয়ার ইলেট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং, খুব চুপচাপ মেয়ে, ওর ছিল ভোরের শিফটের ক্লাস, সাড়ে আটটা থেকে শুরু, আমার দুপুরের শিফট বারোটা চল্লিশে ক্লাস শুরু হত, চলত সন্ধে ছটা পঞ্চাশ অবধি। তুমে বেরিয়ে যাবার পরে আমি ঘরে একাই থাকতাম। কোনও কোনও দিন তুমের ক্লাসমেট একটা ছেলে খোঁজ করতে আসত তার। আফ্রিকান কোনও দেশের ছেলে হবে, অন্তত গায়ের রং দেখে যতটা চেনা যায়। ছেলেটার হাতে একটা খাতা থাকত, দরজায় টোকা দিলে আমি দরজা খুলে দিতাম, সে ঘরের ভেতরে উঁকি মেরে শুধোত তুমে আছে কি না, আমি বলতাম, না সে তো এখন নেই, বিকেলে এলে পাওয়া যেতে পারে, কিছু বলব কি সে এলে? ছেলেটা বলত, নাহ দরকার নেই, আমি খুঁজে নেব তাকে। তবুও তুমেকে আমি মনে করে করে জানিয়েছি, জানিস একটা ছেলে তোর খোঁজে এসেছিল আজ, গত পরশু, গেল সপ্তাহেও দু-তিন দিন খোঁজ করে গেছে। শুনে তুমে মিটিমিটি হাসে, তার পরে ডেসক্রিপশান জানতে চায় ছেলেটার চেহারার, আমি বলি বেশ লম্বা চওড়া একটা আফ্রিকান ছেলে, কিন্তু নামটা জেনে রাখা হয়নি। তুমে বলে, ও আচ্ছা বুঝেছি কে। তার পর সে যথারীতি তড়িঘড়ি বেরিয়ে যায় অন্য ব্লকের দিকে, সেখানে তার বয়ফ্রেন্ড আম্রা থাকে। আম্রাও মঙ্গোলিয়ার ছেলে।
    পরীক্ষার দিনের রুটিন একটু অন্যরকম। সমস্ত পরীক্ষাই শুরু হয় সকাল সাড়ে আটটায়। আমি ভোরের দিকেই পরীক্ষা দিতে যেতে পছন্দ করি। দেরি করে গেলে ফিরতে ফিরতেও দেরি হবে, তখন লম্বা লাইন লেগে যায় পরীক্ষার ঘরের বাইরে। সব পরীক্ষাই মৌখিক। সাড়ে নটা থেকে দশটা সাড়ে দশটার ভেতরে নাচতে নাচতে হস্টেলে ফিরে আমি ঘরেই থাকি, হয়তো মীণাক্ষির হস্টেলের দিকে একটু চুপি চুপি গেলাম, কিন্তু সে ও খুব সাবধানে, শাহীন বারণ করে দিয়েছে ওর সঙ্গে বেশি মেলামেশা করতে, ও মেয়ে ভাল নয়, ওর সঙ্গে মিশলে শাহীন যদি আমার সঙ্গে আর কথা না বলে? তবু যাই, লুকিয়ে চুরিয়ে যাই, মীণাক্ষিকে তো বলতে পারি না যে আমার  উপর এখন এমনি বিধিনিষেধ, দুঃখ পাবে ও। সব দিক বাঁচাতে বাঁচাতে তাই আমায় গোপনীয়তা বজায় রাখতে হচ্ছে। সন্ধের দিকে ডাকলে মীণাক্ষিকে বলে দিই, সন্ধেবেলায় পারব না রে। তাও কখনো সখনো যাই, চুরি করে।
    মীণাক্ষির পরীক্ষাগুলো খুব শক্ত। ও এমন একটা সাবজেক্ট পড়ছে যেটা রাশিয়ান ওর মাতৃভাষা হলেও খুবই শক্ত হত। দারুণ দারুণ সব সাহিত্য বিশ্লেষণ করতে করতে― তা সে দস্তয়ভস্কিই হোক কি তুর্গেনিয়েভ, সব কিছুর রস কষ বেরিয়ে গিয়ে সিঙ্গাড়া বুলবুলি মস্তক অবস্থা। আর পরীক্ষকেরাও তেমনি সব শাঁসালো মক্কেল― দুমদাম ফেল করিয়ে দেয়। একে বেচারি অসুস্থ, তায় প্রেমে পড়েছে, এসব তো আর তাগড়া প্রোফেসররা বুঝবে না। সাত্তারও আর পাত্তা দেয়নি ওকে। সেই চুমুটুমু খেল ওরা, ব্যস। আর কোনও উচ্চবাচ্য নেই, খুব অবাক হয়ে যায় মীণাক্ষি, কেন এমন হল! আমায় অনেক বলেছে একটু তদ্বির করতে, কেন এমন হল সেটুকু জেনে আসতে। আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে পারি না, বলি, জেনে তো নেবই কিন্তু কেন পড়ে আছিস তুই সাত্তারের পেছনে, ভুলে যা না, ভুলে যা।
    ―সত্যিই কি ভুলে যাওয়া অত সহজ, তুই পারতিস ভুলে যেতে যদি তোর এমন হত?
    আমি কথা ঘুরিয়ে নিই, বা চুপ করে যাই। আসল কথাগুলো ওকে বলতে দ্বিধা হয়। শুনলে কী হবে তা তো জানি না। বিশ্বাস করবে কি ও আমাকে?
    আমায় বেশ কয়েকটা পরীক্ষায় বসতে হচ্ছিল না, ক্লাসের পারফর্মেন্সের উপর নির্ভর করেই আগেভাগে নম্বর  পেয়ে গেছলাম, কিন্তু সেটা রেজাল্টবুকে লিখিয়ে আনতে হয় পরীক্ষার দিনই। তেমনি একদিন খুব তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে দরজাটা সবে দিয়েছি, কে যেন টোকা দিল, খুলে দেখি সেই ছেলেটা আবার, যে তুমের খোঁজে এর আগে বহুবার এসেছে। সে কোনও প্রশ্ন করবার আগেই জানিয়ে দিলাম, তুমে তো নেই, সম্ভবত আজ ওর কোনও পরীক্ষা... ছেলেটা বলে, তুমে নয়, আমি তোমার কাছেই এসেছি।
    ―আমার কাছে! কোনও দরকারে?
    সে চুপ করে থাকে, একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে। তার পরে অনেক কথা বলে যায় অনর্গল, এক কথাও বারে বারে বলে। গত দেড়-দু’মাস ধরে নানান ছলছুতো করে সে দেখা করতে আসত আমার সঙ্গে। তুমের ক্লাসে সে পড়েও না, তার বিষয়ও অন্য। তুমে বেরিয়ে যাবার পরে আসত ওইজন্য। এখন আর চেপে রাখতে পারছে না মনের কথা, আমি পরীক্ষা দিয়ে ফিরি সে দেখেছে, আজ দেখতে পেয়ে পিছু নিয়েছিল, বদ্ধপরিকর ছিল যে আজ সে বলবেই, বলে দেবেই যে সে ভালবেসে ফেলেছে। তার দেশ গেনে বিসাউ। 
    আফ্রিকার কোথায় এই দেশ তা আমি জানিও না। ছেলেটা নিজের নাম বলে, জানু। এই জ এর উচ্চারণ ফরাসী genre শব্দে g এর যেমন উচ্চারণ তেমনি, বাংলা বর্ণমালায় এরকম কোনও অক্ষর নেই। জানুর ভাষা পোর্তুগীজ, সে কাঁদো কাঁদো মুখে আমার সামনে একটা নড়বড়ে চেয়ারে বসে রয়েছে। তাকে বলি যে আমি তো অন্য একজনকে ভালবাসি। জানুর দুচোখ দিয়ে জল গড়ায়, প্রায় সাড়ে ছফুট লম্বা তেমনি চওড়া দৈত্যাকৃতি ছেলেটা কিছুক্ষণ বসে বসে কাঁদে।  বলি, জল খাবে বা পেপসি? সে মাথা নাড়ে, জল টল খেতে চায় না, চুপ করে বসে কীসব ভাবে। বলে, ঠিক আছে, কী আর করা যাবে, আমি আজ অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম, আজ সন্ধেবেলায় তোমাকে নিমন্ত্রণ করব বলে। সব আয়োজন করা হয়ে গেছে, তুমি জাস্ট একজন বন্ধু হিসেবে আসবে আমার নিমন্ত্রণে? আমি ভেবে জবাব দিই, কেন নয়, অবশ্যই যাব। এই মনে করো বিকেল চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ। আধঘণ্টা  মতোন থাকব। তার পরে আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে সময় কাটাতে হয় আমাকে, অনেক কাজ থাকে, যাব, নিশ্চয় যাব। জানু একটু হাসি হাসি মুখ করে চলে যায়। সওয়া চারটে নাগাদ শাহীনদের ব্লকে শাহীনদেরই ফ্লোরে জানুর ঘরের দরজায় আমি বেশ ক’বার টোকা দিই। সে দরজা খোলেনি।

    ভালবাসার প্রকাশ কে কেমন করে করবে, তার সবগুলোতো টেক্সটবুকে লেখা নেই, থাকেও না। আমরা নিজেদের  মতো করে করে মানে বের করে নিতেই ভালবাসতাম। শাহীনরা চারপাঁচজনে মিলে রাতের রান্নাটা করত। শাহীন, সাত্তার, রউফ, চাচা এই চারজন ফিক্সড মেম্বার, তাছাড়া এক এক দিন হয়তো অন্য কোনও বাংলাদেশি এসে যোগ দিল। এই চারজনই সিরাজগঞ্জের, কারও বাড়ি সিরাজগঞ্জ শহরে তো কারও বাড়ি শাহাজাদপুরে। সাত্তারকে বাদ দিলে বাকি তিনজনই শাহাজাদপুরের ছেলে, এমনকি একই ইস্কুলে পড়েছে, শাহীন বলেছে যে ইস্কুলের হেডমাস্টার ওর আব্বা। রউফ মাঝে মাঝেই বলে স্যারের কাছে ইংরিজি পড়ত, কী ভাল পড়াতেন, ইত্যাদি। ওরা ক্লাসমেট। চাচা নামক লোকটা একটু বয়স্ক, সম্পর্কে সত্যিই শাহীনের চাচা হয়, নাম মুকুল, এখন একসঙ্গেই পড়ছে। চাচার রান্নার হাত অসম্ভব ভাল। হায়রে, চাচার হাতের রান্না যে ছেলে প্রত্যেকদিন খায়, তাকে অপটু হাতে আফগানি পোলাও খাইয়ে বশ করতে চেয়েছিলাম ভেবেই লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় আমার। নতুন প্রেমের কারণে ওই ব্লকে ঘন ঘন যাতায়াত শুরু হল আমার, ওদের সঙ্গেই রান্নাবান্না শুরু করে দিলাম। প্রথম দু-এক দিন সাত্তার খেয়েছিল একই সঙ্গে, তারপর সে আর আসত না। চাচা অনিয়মিত হয়ে পড়ল। তার পরে ছেড়ে দিল একসঙ্গে রান্না করা। রউফ ও অনিয়মিত হতে হতে নানান অজুহাত দিয়ে সরে পড়ল। রয়ে গেলাম আমরা দু’জন। 
    তবু ওই ভাঙনের সময়েই টুকটাক রান্না শিখে নিয়েছিলাম চাচার থেকে। তার মধ্যে পরে সবচেয়ে বেশি যেটা রেঁধেছি, সেটা হচ্ছে ভেড়ার মাংসের ভুনা। এক বিন্দু জল না দিয়ে এবং গোটা গোটা মশলার সাহায্যে এই জিনিস রাঁধতে হত। মশলা হোক কি পেঁয়াজ রসুন, বাটাবাটির কোনও সিনই ছিল না। চাচা যখন ভারি ভারি ডেচকিতে ―যেটাকে ওদের ভাষায় পাতিল বলে, যেটা শুনলেই আমার স্মিতা পাতিল মনে পড়ে যেত, পেঁয়াজ মশলা যত্ন করে ভাজত, দূর থেকে তার মুখটা দেখতে পেতাম, সে যে কী অসম্ভব মনোযোগের মুখ। মুখ অল্প হাঁ হয়ে চোয়ালটা ঝুলে পড়ছে, চোখদুটো গোল্লা গোল্লা হয়ে যাচ্ছে, চাচা নেড়েই চলেছে মশলা, একেবারে ব্রাহ্ম মুহূর্তে তাতে মাংস দিতে না পারলে যেন দুনিয়া রসাতলে চলে যাবে।
    জানুর ঘরে নিমন্ত্রিত হবার দিন দুয়েক পরে একটু বিকেল বিকেলই শাহীনের ঘরে গেছি। পরীক্ষা শেষ, দেশে যাবার সঙ্গতি নেই, কমাস আগে একটা চুরি হয়ে গেছল আমার ঘরে, সব টাকা পয়সা চুরি হয়ে খুবই খারাপ অবস্থা। দেশে যাবার জন্য কোনও তাগিদও তেমন অনুভব করছিলাম না তখন― নতুন প্রেমিককে ছেড়ে থাকতে কে চায়! এত কষ্ট করে, এত চেষ্টা করে যার মন পেয়েছি, তাকে ছেড়ে থাকতে একটুও ইচ্ছে করে না। শাহীনের রুমমেট ছিল একজন মরক্কোর ছেলে। একই ক্লাসে পড়ত ওরা কিন্তু অন্য সেকশানে। মানে দুজনেরই সেবার ফোর্থ ইয়ার শেষ হয়ে ফিফথ ইয়ার হতে চলেছে। ওদের ছুটি একমাস পরে পড়বে, তখন প্রোজেক্টের কাজ চলছে। ওরা দুজনেই ঘরে ছিল তখন। সেই ছেলেটার নাম এল্ দ্রিস্। বাংলায় হয়তো এই নাম হবে ইদ্রিস, কিন্তু মরক্কোর আরবীতে দ্রিস, ওদের আরবীতে ফরাসী শব্দ ঝুড়িঝুড়ি।
    এমনিতে আমি গেলেই দ্রিস বেরিয়ে যায়, সেদিনও বেরোবার উপক্রম করছিল, হয়তো আমাদের মধ্যিখানে কাবাবমে হাড্ডি হতে চায় না, কিন্তু আমিই বারণ করলাম, তুই বোস তো, যাস না, এরকম করলে আমি বরং আর আসব না। বেচারা লাজুক লাজুক মুখ করে বসে রইল।  শাহীনের মুখ দেখে কিছুতেই বোঝার উপায় নেই তার মনের প্রতিক্রিয়া। এমনিতে সবাই জানে সে খুব শান্ত শিষ্ঠ ভদ্র ছেলে, কেবল মদ টদ খেলে তাকে নাকি আর চেনা যায় না। তা তখন তো সে মদ খেয়ে নেই। প্রোজেক্টের কাজের পড়াশুনো করছে, আমি পাশেই বসে থাকি বরং।
    একটু কাজ করবার পর সে কাগজপত্র সরিয়ে রাখে। একথা সেকথার পরে হঠাৎ রিসেন্ট টপিক নিয়ে কথা শুরু করে― এইচ-আই-ভি এইডস, রাশিয়ানে স্পিদ।
    আমাদের সকলকেই তখন এইচ-আই-ভি র জন্য রক্ত পরীক্ষা দিতে হচ্ছিল বাধ্যতামূলকভাবে। পাছে কেউ এইচ-আই-ভি পজিটিভ বেরিয়ে পড়ে এই সব কারণেই এই পরীক্ষা। চতুর্দ্দিকে এইচ-আই-ভি সচেতনতা বাড়ানোর ক্যাম্পেইন। মনে রাখতে হবে সেটা গত শতাব্দীর আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধ, এইচ-আই-ভি এইডস সম্পর্কে তখনও অধিকাংশ মানুষের কোনও ধারণাই নেই। যাইহোক, প্রথমে গেল কিছুক্ষণ এইডস নিয়ে কথা, হঠাৎ কেন এমন টপিক নিয়ে কথা বলছে বুঝতে পারলাম না, তারপরে টপিক ঘুরে গেছে আফ্রিকানদের উপরে। আফ্রিকানদের নাকি খুব এইডস হয়, আমি চুপচাপ শুনলাম। সে যখন বলছে হয়তো খবরে দেখেছে পড়েছে বলেই বলছে। তারপর শুরু হল আফ্রিকান পুরুষদের সেক্সুয়াল পারফর্ম্যান্সের উপর কথা। আমার কেমন যেন খটকা লাগছে, কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে। ঠিক বুঝতে পারছি না। অন্য কেউ ওরকম আলোচনা করলে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতাম কি মুখের  উপর ধমক দিতাম, কিন্তু আমি তো নিরুপায়, একেবারে বিক্রি হয়ে গিয়েছি তার কাছে আপাদমস্তক। আফ্রিকার ছেলেরা কত হিংস্র, কত ভয়ানক, কত শক্তিশালী, কতরকমের রোগ আছে তাদের, সব বলে যাচ্ছে সে। 
    বুঝতে পারছি সে কোনও একটা ক্ষোভ বা আক্রোশ থেকে এইসব আলোচনা শুরু করেছে। আরও দেখছি যে আমাদের থেকে অল্প দূরত্বে বসে দ্রিস এসমস্ত আলোচনা লক্ষ্য করছে, সে বাংলা না বুঝলেও এটুকু বোঝে যে যা হচ্ছে আমাদের মধ্যে তা আর যা ই হোক প্রেমালাপ নয়। পরিবেশটা অন্যরকম হয়ে গেলেও আমি উঠে চলে আসতে পারছি না, শাহীন হঠাৎ আচমকা জিজ্ঞেস করে― ওই ওদিকের ঘরের আফ্রিকান ছেলেটার সঙ্গে তোমার কী?  ―কোন ছেলেটা? আমি প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, ওহ জানু? ―বাবা, ওর নামও জানো দেখছি। আমরা এক ফ্লোরে থাকি আমরা তো অত নামধাম জানি না। ছেলেটার ঘরে তুমি নিয়মিত যাও, লোকে দেখেছে। 
    আমি যতই বলি যে একবারই গেছলাম, তাও ভেতরে ঢুকিনি, সে দরজাই খোলেনি, কিন্তু সেসব কথা তার কানে ঢোকে না। তার কাছে পাকা খবর আছে যে আমি নিয়মিত জানুর ঘরে যাই, শাহীনের মনে ভয় ঢুকেছে আমি ওই ছেলেটার সঙ্গে শুই, আরও অনেক কিছু সে বলে যায়। একবার ভাবি ছুটে পালিয়ে চলে আসব, কিন্তু মাথা ঝিমঝিম করে, প্রতিবাদ করতে ইচ্ছেই করে না। আমায় চুপ করে থাকতে দেখে সে আরও বিচলিত, যেন একটা ঝগড়া করবার আশা করেছিল, ঝগড়াটা হয়ে গেলেই হয়তো ভাল হত, কিন্তু আমি তখন অন্য কথা ভাবি, এত মাস ধরে এত যত্ন করে যাকে ভালবাসবার এবং তা জানাবার আয়োজন করেছি তার পরিণতি এই? 
    শাহীন আমায় উঠে যেতে দেয় না, হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয়, কেন আমি জানুর ঘরে গেছলাম? উত্তর চাই তার।
    আমি সব বলে দিই। ভেবেছিলাম বলে দিলে সে বুঝবে, আমায় ভুল বুঝবে না, কিন্তু সে নিজের মতো করে বোঝে। বলে, তোমাকেই হঠাৎ সে ভালবাসার কথা জানাতে গেল কেন? আর কি মেয়ে কম ছিল এই হস্টেলে? আরও তো কত মেয়ে রয়েছে, কই তাদেরকে তো গিয়ে এরকম কথা বলবার সাহস পায় না! তোমাকে বলে কেন?  কারোকে ভালবাসার কথা জানানো যে স্পর্ধার ব্যাপার এটাই এতক্ষণ আমার মাথায় ঢোকেনি। ভালবাসা মানে যে অপমান করতে চাওয়া নয়, জানু যে কত ভদ্রভাবে আমাকে তার মনের কথা জানিয়েছিল সে সব একে বোঝানো যাবে না, এর মাথা গরম হয়ে রয়েছে, একে কেউ অনেক মিথ্যে কথা বলেছে। সে আমার গায়ে হাত তোলে। দ্রিস সব দেখছিল দাঁড়িয়ে। এরপর সে আমার কপালে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দিতে এগিয়ে গেলে দ্রিস তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে সরিয়ে ফেলে― কী করছিস তুই? মেয়েটার মুখে সারাজীবন একটা পোড়া দাগ করে দিবি? জানিস না সিগারেটের দাগ কখনো ওঠে না!
    শাহীন মানবেই না, বারবার বলে, তুমি ভাল হয়ে যেতে পারো না? এই প্রশ্নের কী উত্তর দেব আমি! যেন কারোকে বলছে― চুরি করা বন্ধ করতে পারো না? উত্তর হ্যাঁয়ে দিলেও স্বীকার করা হয় যে সে চোর, নায়ে দিলেও তাই। আমার সেরকম অবস্থা। আমি তো খারাপ বলে জানতাম না নিজেকে, ও এরকম বলছে কেন? আমিও শেষ অবধি দেখব বলে অপেক্ষা করছি, সে আমায় পোড়াবেই, শেষে আমার ডানহাতের কব্জির ভেতরে সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বলে, একটা দাগ করে দিলাম, আর কোনও ছেলের মুখের দিকে তাকাবার আগে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখো। আমি সোজা চলে গেছলাম মীণাক্ষির ঘরে। তখনও জল লাগেনি, ফোস্কা পড়েনি। সব দেখে মীণাক্ষি বলেছিল, হি ইজ ভেরি পজেসিভ, লেকিন পেয়ার করতা হ্যায়। 
    মীণাক্ষি তো কত বেশি সাহিত্য পড়েছে আমার থেকে, ও নিশ্চয় জানবে। ও, ওর  মতো করে বোঝায় আমাকে।
    পরের দিন শাহীনের ঘরে গেলে দ্রিস দরজা খুলে দেয়, শাহীন ছিল না, আমি চলে আসব না কি বসে অপেক্ষা করব এইসব ভাবছি, দ্রিস নামের সেই মরোক্কান ছেলেটা বলেছিল― কেন তুই একটা ফালতু ছেলের সঙ্গে ঘুরছিস? ও তোকে ভালবাসে না, সম্মান করে না। ভালবাসার মানুষকে কেউ পুড়িয়ে দিতে পারে? কেউ সন্দেহ করতে পারে? পারে না। তোকে কয়েকদিন ধরে কাছ থেকে দেখছি, তুই আমার বান্ধবী হ, শাহীনকে ছেড়ে দে। আমরা ফ্রান্সে চলে যাব, ভয় পাস না, তোকে আফ্রিকায় নিয়ে যাব না, আমরা ফ্রান্সে গিয়ে বিয়ে করে সেটল করব, যাবি? বিশ্বাস কর তোর কোনও ক্ষতি আমি করব না।
    আমি সেখান থেকে চলে যাই, দ্রিসকে বলি সম্ভব নয়, আমার নিজেরও তো পছন্দ অপছন্দ, মন এসব আছে। খালি মনে হয়, কার বিশ্লেষণটা ঠিক, দ্রিসের না মীণাক্ষির? সত্যিই আমাকে ভালবাসে না শাহীন! তা কী করে হবে? মীণাক্ষি তো প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দিল কত সাহিত্য খুঁজে শেক্সপিয়ার থেকে শরৎচন্দ্র সবখানে ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে পুরুষেরা ভালবাসলে সন্দেহ করে, খুন পর্যন্ত করে ফেলে প্রেমিকাকে, ক্ল্যাসিক ফ্যাসিক কি বাদ দেওয়া যায়? এমনকি হিন্দিতে অনুবাদ করা দেবদাস পড়েছে মীণাক্ষি, সেখানেও দেবদাস তার প্রেমিকার মুখে মেরে দাগ করে দিয়েছিল পার্মানেন্টলি।  গভীর প্রেমে এরকমই হয়। এরকম হতেই হবে। অবিশ্বাস, সন্দেহ, আঘাত করা, সব মিলে যাচ্ছে... এর নাম কষ্ঠিপাথরে যাচাই করে নেওয়া, প্রেম আছে কি নেই। তুই তো চেয়েছিলি সত্যিকারের প্রেম, এখন সত্যিই তা পেয়েছিস। ওরে পাগলি দু:খ নয়, আনন্দ কর, আনন্দ কর, তুই সাকসেসফুল!
     
     
    আমরা কাছে কাছে থেকেও দূরে ছিলাম, একই হস্টেলের দুটো আলাদা ব্লকে, আলাদা আলাদা রুমমেট নিয়ে, যেন একই সঙ্গে একই ঘরে থাকলে লোকে ছি ছি করবে, যেন সবাই জেনে ফেলবে এই ছেলেমেয়ে দু’টোর মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে। অথচ তা জানতে তো কারোরই বাকি ছিল না। ভারতীয় সমাজ আমাকে সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করেছে। হোলি হোক কি দিওয়ালি বা বাৎসরিক ভোটাভুটি― যেগুলো ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে হয়, সেসবে কেউ আমায় ডাকে না, খবর টবরও দেয় না, চাঁদাও চায় না। আমি যেন ভারতীয় নাগরিকত্ব হারিয়েছি অলিখিতভাবে। পঞ্চাশ ষাটজন ভারতীয়ের মধ্যে সে কি অদ্ভূত কোঅর্ডিনেশন, তারা আমায় দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নিত, কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমার ক্লাসে একটা ছেলে পড়ত― কলকাতার ছেলে, সে ও সেইরকম, ক্লাসে দেখা হলেও কথা বলতে চাইত না। অথচ শাহীনের সঙ্গে তারা কথা বলত, ভদ্রতা করে লোক যেমন কথা বলে। ভারতীয়রা আমাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল, ভারতীয় মেয়ে হয়ে কী করে এক বিদেশির সঙ্গে চলে গেলাম সেটা তারা মানতে পারেনি বলেই, তাদের ইজ্জতে লেগেছে। খুব অদ্ভূত জিনিস এই ইজ্জত, একজন বিদেশি মেয়ে ভারতীয় ছেলের সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি করলে তাদের ইজ্জত বাড়ে বই কমে না। কিন্তু মেয়ে! তারা তো দেশের ইজ্জত, দেশের সম্পত্তি। তারা বিদেশির কাছে ভালবাসা চাইতে গেলে সে খুব ঘেন্নার ব্যাপার, তখন মেয়েটাকে ত্যাগ করে দিতে হয়।
    এইটে করে ওরা ভালই করেছিল। আমি নিজের জায়গাটা বুঝে যাচ্ছিলাম তাড়াতাড়ি, হয়তো জীবন সম্পর্কে যে সব ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকি, বা যেগুলোকে বিশ্বাস করতে মন রাজি হয় না, সেগুলো খুব তাড়াতাড়ি পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল― এই দুনিয়ায় আমার অবস্থানটা, পুরোপুরি না হলেও অন্ততঃ কিছুটা তো বটেই। এটা যেমন প্রথমে মন খারাপ করে দেয়, পরে এটাই অনেক শক্তি সাহস জোগায় কঠিন দিনগুলোয়। আবার বিদেশি ছেলেদের সঙ্গেও শাহীন আমায় মিশতে দিত না। হস্টেলের মধ্যে কোনও পুরুষের সঙ্গে কথা বলা চলবে না, কারও ঘরে যাওয়া চলবে না, কঠিন হোমওয়ার্কের সমাধান খুঁজতে গ্রুপ স্টাডিও নিষিদ্ধ। তারাও যেন আমার ঘরে পড়া বুঝতে এলে আমি এন্টারটেইন না করি, ঢুকতে না দিই, বসতে না দিই। আমার রুমমেটের বয়ফ্রেন্ড ছিল, তার ক্লাসের ছেলেরাও আসত যেত, সেসব এড়াতে আমার ঘরটাই পাল্টে দেওয়া হল জোর করে। এই নতুন ঘরে দুটি উজবেক মেয়ে, আমি সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি, তারা সবে ফার্স্ট ইয়ারে এসে ভর্তি হয়েছে, একবর্ণ রাশিয়ান বলতে পারে না। অনেক দূরের কোনও গ্রামে তাদের বাড়ি। তাশকেন্ত তাদের চোখে দেখা প্রথম শহর। মেয়েদুটো ছেলেদের চোখের দিকে তাকাতে পারে না। ফলে আমার ঘরে আর যেই আসুক শাহীন ব্যতীত আর কোনও পুরুষ আসতে পারবে না। এই সমস্ত বিধিনিষেধ আমার একটু একটু করে গা সওয়া হয়ে যাচ্ছিল। যে আমি এক সময়ে ছেলেদের সঙ্গে নাটকে অভিনয় করেছি, সেখানে তো কতরকমের ভূমিকা থাকে, গা বাঁচিয়ে তো চলা যায় না, সেই আমি একরকমের পর্দানশিন হয়ে গেলাম। অথচ এ সমস্তই তো আমার নিজের পছন্দের মানুষটাকে চাইবার জন্যই হচ্ছে। মীণাক্ষিতো বলেই দিয়েছে, ওই ছেলে খুব পোজেসিভ। 
    কাছে থেকেও যেমন দূরে ছিলাম তেমনি দূরে দূরে থেকেও আমরা খুব কাছেই থেকেছি। সারাটা সন্ধে তো একসঙ্গেই থাকা, বন্ধু-বান্ধব সব আসছে যাচ্ছে তার ঘরে, রান্না হোক কি গল্প, কি গান, বা টিভি দেখা, গান শোনা, তাস খেলা, উঃ বাবা সে কি তাসের আসর বসত, সে খেলার নাম টোয়েন্টি নাইন, দেখতে দেখতে কবে একদিন খেলার মধ্যেই ঢুকে গিয়েছি, ডবর-রিডবল, কালোর সেট, লালের সেট, সে এক নেশা বটে।  আবার এমনও দিন গেছে সারা দিন কি দুপুর গল্প পড়ে পড়ে শুনিয়েছি তাকে, কি গোটা একটা বাংলা উপন্যাসই এক নাগাড়ে পড়ে গেছি তাকে শোনানোর জন্য। লোকে দরজার বাইরে থেকে টোকা দিয়ে ফিরে চলে গেছে, হয়তো অন্য মানে করেছে তারা, আমরা দরজা খুলিনি, গল্প পড়ার মাঝখানে কেউ যেন ডিস্টার্ব করতে না পারে। আবার সেদিন, যেদিন সন্ধেয় সে তার বন্ধু ফিরোজের হস্টেলে যাবে, সেদিন খুব বরফ, ফিরোজের হস্টেল বহুদূরে, ট্যাক্সি নিয়ে শহর পেরিয়ে এক নির্জন জায়গায় সেই ইন্সটিটিউট, সে কৃষিবিদ্যার ছাত্র। ট্যাক্সি আমাদের নামিয়ে দিয়ে বরফে ঢাকা রাস্তার উপর দিয়ে যেন দিগন্তের দিকে চলে গেল। দুটো লাল আলো ছোটো হতে হতে অন্ধকারে বিন্দু হয়ে মিশে গেল। আমরা ঠাওর করতে পারছি না কোনটা রাস্তা কোনটা মাঠ, সবই তো বরফে ঢাকা। তাও আন্দাজ করতে করতে এগোই। ঠাণ্ডায় আমার পা জমে যাচ্ছে, কোনও উন্মাদও ওই শীতে শাড়ি পরবে না, আর কঠোর অনুশাসনের জেরে আমি তখনও শাড়ি পরে প্রমাণ দিয়ে চলেছি আমার ভালবাসা কত নিখাদ, কত অনুগত।
    এমনি পায়ে হাঁটার রাস্তা যে কোনটা তা স্থানীয় লোক ছাড়া আর কারও জানবার উপায় নেই। কোনও কোনও জায়গায় প্রায় হাঁটু অবধি ডুবে যাচ্ছে বরফের মধ্যে, তার নীচে রয়েছে জল কাদা কি নরম মাটি, হয়তো চাষের জমি। শাড়ি পরে হাঁটা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। এবার দেখা গেল ফিরোজদার হস্টেলটা একটা হালকা মতো বনের আড়ালে। 
    আর ঠিক তখনই ঘটল সিনেমার  মতো ব্যাপার। আমায় দুহাতে তুলে নিয়ে, ঠিক যেমনটা দেখায় সিনেমার শেষ দৃশ্যে, শাহীন এগিয়ে চলল সেই গাছপালা ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে দিয়ে জল কাদা বরফ অতিক্রম করে করে। আমি ভয় পাচ্ছিলাম না পড়ে যাবার। আকাশের যে একটা নিজস্ব আলো থাকে তা বরফে প্রতিফলিত হয়ে অপূর্ব মায়াময় পরিবেশ। কতক্ষণ সে আমায় নিয়ে হেঁটেছিল মনে নেই, হয়তো দু মিনিট, হয়তো চার মিনিট। সে অবলীলাক্রমে আমায় দুহাতে তুলে নিয়ে চলেছে, আমি নীচের দিকে তাকাচ্ছি না, হয়তো কোনও দিকেই তাকাচ্ছি না, কী ভাবছি তাও জানি না, কিন্তু সে এক না ভোলার  মতো অবাস্তব পরিস্থিতি।
    ফিরোজদা ছাড়াও আরও দুজন বাংলাদেশি থাকত ওই হস্টেলে, খুরশিদদা আর ইউসুফদা। তারা আমাদের সে রাতে আর ছাড়বেই না। বলে, থেকে যাও থেকে যাও, একটা রুম তোমাদের জন্য ছেড়ে দিচ্ছি, কোনও অসুবিধা হবে না। যাবার পর থেকেই তো ওরা মদ নিয়ে বসল, মদ যত খাচ্ছে, তত থেকে যাবার দিকে জোর দিচ্ছে, বলছে অনেক রাত হল, কাল তো রোববার, এত রাতে আর ট্যাক্সি পাবে কোথায়? আমি কিছুতেই রাজি হই না। আমার পেটে ব্যাথা শুরু হয়েছে, আমায় ফিরতেই হবে সে রাতে। এরা ছেলেরা তো এসব বুঝবে না, বলাও যাচ্ছে না। চারজন মাতালকে কি কিছু বোঝানো সম্ভব? আমি জেদ করে বসে আছি, ফিরে যাবই আজ রাতে। শাহীন হঠাৎ উঠে পড়ে বলল, বেশ, চলো, উঠলাম রে ফিরোজ।
    বুঝলাম সে রেগে গিয়েছে। ওরা ভাল রাস্তা দেখিয়ে দেয়, তার পরে ফিরে যায়। একটা বনের ধারে সরু নির্জন রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে আমরা অপেক্ষা করি কোনও গাড়ি যদি এদিক দিয়ে যায় তো থামাব, প্রাইভেট গাড়িও এদেশে ভাড়ায় খাটে। উঁচু মাঝারি অসংখ্য গাছ সাদা হয়ে আছে, ছপ ছপ করে বরফ খসে পড়ে অল্প একটু হাওয়া দিলেই। শাহীন রেগে আছে, কথা বলে না, দুটো গাড়ি চলে যায়, হাত দেখালেও থামে না। সে হঠাৎ রেগে উঠে বলে― তোমার কী এমন সম্মান হানি হত আজ এখানে থেকে গেলে? খুব সতীসাধ্বী দেখাতে চাও নিজেকে, না কি?
    না, তা নয়, অন্য কারণ আছে আপনাকে বললাম তো! শুনলেন না, আমার শরীর ভাল লাগছে না, হস্টেলে ফিরতেই হবে। এর পরে তাকে ডিটেলে বলি সব। তাতেও সে বুঝতে চায় না। চেঁচায়। হঠাৎ সেই নির্জন বনের ধারে গলা নামিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, একটা কথার জবাব তুমি আমাকে দেবে? সত্যি কথা বোলো, আমি কিচ্ছু বলব না। এখানে তো আমরা দুজন ছাড়া কেউ নাই, তুমি কি সাত্তারের সঙ্গে শুয়েছিলে?

    মনে হল ওখান থেকে হেঁটেই চলে যাই সে রাতে, আমার সঙ্গে টাকা নেই পয়সা নেই কোনও নথিপত্র নেই, হয়তো আর একটু পরে ওই ঠাণ্ডায় পড়ে যাব, মাইনাস পনেরো কুড়ি তো হবেই তখন, মরে গেলেও ক্ষতি নেই, আর কী হবে বেঁচে থেকে! কোনও উত্তর দিইনি তার কথার, কোনও স্পষ্ট উত্তর দিইনি, বলেছি, আপনার যেমনটা মনে হয় তেমনটা ভেবে নিন। সে এই উত্তরে খুশি হয় না, অনেক কিছু বলতে থাকে, চাচা নাকি তাকে বলেছে এসব, যে চাচা একবার বলেছিল আমি জানুর ঘরে নিয়মিত যাই, যে চাচা নিপাট ভালমানুষের  মতো গোশতো পাক করত, এখনও করে নিশ্চয়। চাচা বলল তাকে, চাচাকে বলল সাত্তার! বাহ! আমি দোষী সাব্যস্ত হলাম। আমি শাহীনকে কিচ্ছু বলি না, চুপ করে থাকি। সে আমাকে মারে, আবার মারে। আমি বুঝতে চেষ্টা করি এরা এমন করছে কেন। মীণাক্ষিকে চুমু খাবার সেই রাতে, সাত্তারের সঙ্গেই হস্টেলে যাবার বাকি পথটুকু ফিরেছিলাম। তখন সাত্তার চুপ ঠিক ছিল না, কেমন একটা হাসি হাসি মুখ করে ছিল, হস্টেলের একদম কাছে এসে বলেছিল, কী ওই শাহীন শাহীন করে মরছিস, আমার পেছনেই বা ওই খোঁড়া মেয়েটাকে লেলিয়ে দিচ্ছিস কেন তুই? এসব রিলেশনের কোনও ফিউচার নেই, কটা বছরের জন্য এদেশে থাকা, ফুর্তি লুটব চলে যাব, তুইও তাই কর, ভেবে দেখ আমার সঙ্গে থাকবি?
    ওর কথাগুলো শুনে কোনও উত্তর দিইনি আমি, নিজের ঘরে চলে গেছলাম, সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে ভাবছিলাম এই কঠিন কথাগুলো মীণাক্ষিকে কী করে বলব? ও তো মরে যাবে শুনলে। ও কি বিশ্বাস করবে আমার কথা? ঘরে ঢুকে আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখলাম দুটো বাল্বের একটা কেটে গেছে। নতুন বাল্ব লাগাতে গিয়ে চেয়ারের  উপর থেকে পড়ে আমার হেড ইনজুরি হয়েছিল, পরদিন মীণাক্ষিই নিয়ে গেছল হাসপাতালে, তখনও ওকে বলা হয়নি। তার পরে চিকেন পক্স হল আমার, তিন সপ্তাহ হাসপাতালে ছিলাম, সংক্রামক রোগের হাসপাতালে। শুনেছিলাম সেসময়ে কারা যেন রটিয়ে দিয়েছিল যে আমার যৌন রোগ হয়েছে, সে কারণেই নাকি সংক্রামক রোগের হাসপাতালে নিয়ে গেছে আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে। মীণাক্ষিই বলেছিল একথা আমি হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে। এরা কত সহজে কত কিছু রটিয়ে দেয় মানুষের নামে। সেই তখনই আমরা একটা রাত জেগে ঠিক করেছিলাম, আর অপেক্ষা করব না, এখনই সময় তাকে জানিয়ে দেবার, যে তাকে আমি ভালবেসেছি। এসব তো আট দশমাস আগের কথা। এতকিছু হয়ে গেল এই সময়ের মধ্যে আর সে আমাকে এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারল না? প্রথমেই তো ফিরিয়ে দিতে পারত, যেদিন চিরকুট হাতে নিয়ে ভিখিরির মতো দরজায় টোকা দিয়েছিলাম। এর নাম প্রেম? এ কোথায় এসে দাঁড়ালাম আমি! একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায় হঠাৎ। শাহীন দরজা খুলে বলো, চলো চলো এখানে সিন ক্রিয়েট করার দরকার নেই।

    শীত থাকুক, আরও থাকুক যতদিন সম্ভব। শীত শেষ হয়ে গেলেই আসছে বসন্তের দিন, আমাদের সম্পর্কের একটা বছর পুর্তি হবে, যদিও কোনও তারিখ আমি লিখে রাখিনি কোথাও, মনের মধ্যেও নয়, তবুও শীত শেষ হওয়া মানেই শাহীনের ফাইনাল সেমেস্টারের প্রজেক্ট শুরু। এটা ভাবলেই আমার হৃদপিণ্ড ডবল স্পিডে চলতে থাকে, মন খারাপ হতে হতে এমন হয়ে যায় যে কিছুই করতে ভাল লাগে না। শাহীন পাশ করে চলে যাবে জুন জুলাই কি অগস্ট মাসে, যত তাড়াতাড়ি ফাইনাল ডিগ্রির জন্য প্রোজেক্ট ডিফেন্ড করতে পারবে তত তাড়াতাড়ি সে দেশে ফিরে যাবে। আমি তখন কী করব এখানে একা একা? আমি তো ফাঁকা হয়ে যাব! আমার তো সেই আগামী দিনগুলোর জন্য কোনও পরিকল্পনা নেই। পড়াশুনো করতে পারব? আমার সারাটা বিকেল সন্ধে রাত কেমন করে কাটবে?
    কোনও পরিকল্পনা নেই আমাদের ভবিষ্যতের। এই নিয়ে কোনওদিন কোনও কথাই বলা হয়নি, কথা বলবার কোনও পরিসরই তৈরি করতে দেওয়া হয়নি। ডিগ্রিকে রাশিয়ান ভাষায় বলে ডিপ্লোম। হয়তো কখনো আমিই আগ বাড়িয়ে বলতে গেছি, ডিপ্লোম পেয়ে গেলে তো আপনি ফিরে যাবেন, তাই না? উত্তরে সে কখনো বলে, আগে তো ডিপ্লোমটা হাতে পাই, প্রচুর কাজ প্রজেক্টের, সহজ নয়, একদম সহজ নয়। এই কথার পরে আর কথা বাড়াতে পারি না। অন্য সময়ে আবার নতুন করে এই প্রসঙ্গ তুললে সে বলে, পাশ করে দেশে ফেরারই তো কথা, দেশে ফিরে চাকরির যা অবস্থা, ইত্যাদি। 
    একবারও সে বলে না আমার কথা, সে যখন চলে যাবে তখন আমি কী করব? আমি কি তারই সঙ্গে চলে যেতে পারি? চুলোয় যাক আমার লেখাপড়া, এত বছর একা একা এই দেশে আমি বাঁচব কেমন করে! বা সে আমায় আশ্বাস দিক যে তার দেশে, তার কাছে যেতে পারব পড়াশোনা শেষ করে, তাহলে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারি। কিন্তু প্রসঙ্গ উঠলেই তো সে কথা ঘুরিয়ে দেয়। মনে মনে ঠিক করি, যদি না নিয়ে যায়, যদি একবারও আমার কথা না তোলে তবে কী দরকার আমার যেচে যেচে এই প্রসঙ্গ বারবার তোলার? আবার কখনো ভাবি, পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আমি একদিন বাংলাদেশের ভিসা নিয়ে চলে যাব ওদেশে, সটান গিয়ে উপস্থিত হব তার বাড়ি, সেই সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরে, ঠিকানা যদিও জানি না, কিন্তু ইস্কুলের হেডমাস্টারমশায়ের বাড়ি বললে নিশ্চয় লোকে চিনিয়ে দেবে, সশরীরে পৌঁছে একেবারে চমকে দেব তাকে। এ সমস্তই আমার মনের মধ্যে নিজের সঙ্গে জল্পনা কল্পনা, এরকমটা তো আর সত্যি সত্যিই হতে যাচ্ছে না। কারও সঙ্গে আলোচনা করবারও উপায় নেই, সবার থেকে দূরত্ব রাখতে রাখতে আমি শেষটায় একটা দ্বীপের মধ্যে বাস করছি। একটা বন্ধু নেই আমার, একটা লোক নেই কথা বলবার। 
    ফিরোজদারা জিনিসপত্র কেনাকাটার কথা বলাবলি করছে। পড়াশোনার শেষে হাজার কেজি অবধি জিনিস দেশে পাঠানো যায় কন্টেনারে করে। সেসবেরই ব্যবস্থা হচ্ছে এদের। ফিরোজদা একটা পিয়ানো কিনেছে, গ্র্যান্ড পিয়ানো। সেই পিয়ানো তিন চার মাস সময় নিয়ে জাহাজে করে পৌঁছবে বাংলাদেশ। শুধু পিয়ানো কেন, আরও অনেক কিছু কিনবে এরা। ফ্রিজ, ফ্রিজার, আলমারি, খাট আরও কত কি কেনে লোকে, মায় ট্র্যাক্টর পর্যন্ত! হস্টেলের নীচে বিশাল বড় লবিতে ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রদের কেনা জিনিস বোঝাই হতে থাকে দিনকে দিন। হস্টেলের সামনেটায়, যেখানে দুপাশে দু’টো ফোয়ারা আছে, সেই ফোয়ারাগুলোর পাশ ঘেঁষে তৈরি হয় বড় বড় কাঠের বাক্স, প্যাকিং বাক্স। সেই বাক্স ঢুকে যাবে কন্টেনারে। পেল্লায় উঁচু সেই বাক্সগুলো দেড়-দু’মানুষ  মতো উঁচু। এরকম জিনিসপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা সব দেশি ছাত্রছাত্রীদের জন্যই আছে। তবে আমি কিনা বাংলাদেশিদের সঙ্গে বেশি মিশি তাই তাদেরটাই কাছ থেকে দেখতে পাই। এশিয়ার দেশগুলোয় এখান থেকে কন্টেইনার পাঠানোর খরচ তেমন বেশি নয়, যারা অন্য মাহাদেশ থেকে এসেছে তাদের খরচ বহুগুণ বেশি, তারা অতশত ঝঞ্ঝাটের মধ্যে যেতে চায় না।
    কদিন পরে শাহীনও বাক্স বানানোর ব্যবস্থা করে। শীত চলে গিয়ে বসন্ত এসে গেছে যে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে চলছে আমাদের শপিং। কত কি কিনি আমরা। সব সময়ে আমায় নিয়ে নিয়ে শপিংএ যায় সে। ফ্রিজ, ফ্রিজার তো কেনা হলই, স্ট্যান্ডার্ড আইটেম ওগুলো। কেনা হল ফ্রন্টওপেন অটোম্যাটিক ওয়াশিং মেশিন, সেই ওয়াশিং মেশিন হস্টেলে নিয়ে এসে কাপড় কেচে পরীক্ষা করে দেখা হল। নিমেষের মধ্যে সাবানের গুঁড়ো গায়েব হয়ে যাচ্ছে, আমাদের ব্লকে আমাদের কলঘরের কলে পাইপ লাগিয়ে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এক ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত কাপড় কেচে ধুয়ে নিঙড়ে একবারে রেডি। উঃ কত পরিশ্রম আমার বেঁচে যাবে। পরেরদিন শাহীন ওয়াশিং মেশিনটা প্যাক করে ফেরৎ দিয়ে দিতে চায় দোকানে। কেন ফেরৎ দিচ্ছেন? আমার তো খুব পছন্দ হয়েছিল জিনিসটা।
    না, আমাদের বাড়িতে এত জল, কুয়ো থেকে জল তুলে কাচে ওরা কাপড়জামা, এ জিনিস নষ্ট হয়ে যাবে।
    নাঃ, কিচ্ছু নষ্ট হবে না, আমি যত্ন করে ব্যবহার করব... সে কথা শোনে না, ফেরত দিয়ে অন্য একটা সস্তার মেশিন কিনে আনে। আনুকগে! ওই মেশিন আমি নেব না ব্যস।
    অনেক জিনিস, কার্পেট, টুকিটাকি কেনা হল, হাজার কিলো ছাড়িয়ে গেছে, তবু আমাদের শপিংয়ের শেষ আর হয় না। সব শেষে আমি আব্দার করে কিনলাম একটা দোলনা। তাদের বাড়িতে তো কত নাকি জায়গা, ঘরের মধ্যে রাখতে হবে না, বাড়ির বাইরে উঠোনে কি বারান্দায় থাকবে দোলনাটা, দুজন পাশাপাশি বসা যায়, দারুণ সুন্দর জিনিসটা। প্রথমে সে নিতেই চায় না, বলে কী হবে এটা নিয়ে? ―কেন? দোলনা তো দুলবার জন্য। সে হো হো করে হাসে, বলে― তোমার মাথা একেবারেই খারাপ। কে দুলবে এই দোলনায়? পড়ে গেলে মাথা ফাটবে তো।
    ―কিচ্ছু মাথা ফাটবে না, যার খুশি সে দুলবে। বলতে পারি না মুখ ফুটে একবারও― কেন, আমরাও দুলব!

    সে কিনল দোলনাটা, অবিশ্বাস্য রকমের সস্তা ছিল জিনিসটা। সব জিনিস কিনে কিনে আমরা একতলায় জড়ো করি, সারাক্ষণ পাহারা দেবার জন্য চৌকিদার রয়েছে, চুরি ওখান থেকে কিছু হয় না। বাকি সময়টা আমি তাকে ড্রয়িং এ সাহায্য করি, প্রজেক্টে সে বানাচ্ছে একটা আস্ত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ওটাই তো ওর সাবজেক্ট। আমার প্রেমিক মস্ত এক ইঞ্জিনিয়ার, কম গর্বের কথা! এক এক করে বাক্স তৈরি হয় এক এক ছাত্রের, গড়ে দিনে দুটো কি তিনটে। যাদের বাক্স তৈরি হয়ে যায় তারা বাক্স জিনিস-পত্র ট্রাকে তুলে চলে যায় মাল পাঠানোর জায়গায়, অমনি নতুন নতুন বাক্স বানানো হতে থাকে, ছুতোর মিস্তিরিরা অনেক সন্ধে অবধি কাজ করে হস্টেলের সামনে।
    শাহীনের বাক্সটা তৈরি হবার পরেরদিন আমরাও চলে গেলাম কার্গো পাঠানোর জায়গায়। এমন একটা অনুভূতি আমার মনের মধ্যে হচ্ছে যা হয়তো নতুন সংসার পাতবার সময়ে হয়। এ সমস্তই আমার নিজের সংসার পাতবার সামগ্রী। আমরা একটু একটু করে বেছে পছন্দ করে যাচাই করে করে প্রত্যেকটা জিনিস কিনেছি। সোফাসেটটা থাকবে বসবার ঘরে। তার সামনেই থাকবে সেন্টার টেবিলটা। ডাইনিং টেবিলটা আর একটু বড় হলে হয়তো ভাল হত, কিন্তু এটাও ভাল, খুব টেঁকসই, ভেতরে আয়না লাগানো ওয়াড্রোব ... এ সব কে ছাপিয়ে গিয়েছে দোলনাটা। বিশাল শপিং। জিনিসগুলো যখন ট্রাকে তোলা হচ্ছিল, কে যেন মন্তব্য করল, আবার দোলনাও আছে! কে দুলবে? রাধাকৃষ্ণ নাকি?

    খুব ভাল রেজাল্ট করে সে পাশ করেছে, চাচা, রউফ, এদের থেকে অনেক অনেক ভাল। কদিন আগে মামুন ইসলাম ও পাশ করল, তার পরে মদ খেয়ে খুব ঝামেলা হট্টগোল পাকিয়েছিল সে। তাকে বেশি দিন থাকতে দেওয়া হয়নি, সপরিবারে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। অন্যরা অবিশ্যি রয়ে সয়ে ঘরে ফিরছে। খুব অল্প সংখ্যক ছাত্র গবেষণা করবার সুযোগ পায়, একেবারে হাতে গোনা কজন। আমি খুব চাইছিলাম শাহীন কটা বছর থেকে যাক, গবেষণা করুক, তার মধ্যে আমারও পাশ করা হয়ে যাবে। সে বলেছিল, অত সোজা না, মস্কো থেকে পার্মিশান লাগে, চাইলেই হয় না। আমি দমে যেতে গিয়েও দমতে পারি না। বলি, আপনি একটু চেষ্টা করে দেখবেন না? দেখুন না একটু। সেও বলে, গবেষণা শেষ করে দেশে ফিরলে অধ্যাপনার চাকরি পাওয়া যেতে পারে, এমনিতে ইঞ্জিনিয়ারের চাকরিতে পাওয়া অনেক ঝামেলার। সে ভেতরে ভেতরে চেষ্টা চালায়, আমিও দিন কে দিন কেমন একটা হয়ে যাচ্ছি, নির্লিপ্তের  মতো।

    ওদের তো তাশকেন্ত থেকে সরাসরি ফ্লাইট নেই ঢাকা যাবার। ফেরার টিকিট― এক পিঠের টিকিট সে পেয়েছে ইন্সটিটিউট থেকে। প্রথমে যাবে মস্কো, সেখান থেকে ঢাকা। ওর সহপাঠি রউফ হপ্তা দু’য়েক আগেই চলে গেছে। রউফের এক গার্লফ্রেন্ড ছিল এখানে, রউফ বলত মাশা। শুনে সবাই হাসত, মাশা! আরে মাশা তো রাশিয়ান মেয়েদের নাম হয়, উজবেক মেয়ের নাম কি মাশা হয়? ওর নাম তো মামলাকাৎ, তাকে কায়দা করে মাশা বলছে! সেই মাশাকে অনেক ভালবাসা আর ঘর বাঁধাবার আশা টাশা দেখিয়ে ফাইনালি রউফ চলে গেল দেশে, গবেষণার কাজে চান্স পাবার কোনও আশা সে দেখতে পায়নি, আবার বিয়ে করে মাশাকে দেশে নিয়ে যাবার মতো মনের জোরও তার ছিল না। আব্বাকে খুব ভয় পায় রউফ, যতই বীরত্ব প্রেম ইত্যাদি করে বেড়াক না কেন, আব্বা জানতে পারলে কী বলবে? আব্বার মনে দুঃখ সে দিতে পারবে না। সেই মাশা ওরফে মামলাকাৎ কে আমি কখনো দেখিনি। অত হৃদ্যতা ছিলনা রউফের সঙ্গে। 

    এর মধ্যে নতুন একটা ছেলে এল ফার্স্ট ইয়ারে পড়তে। শাহীনের ঘর তো ফাঁকা হয়ে যাবে। এল' দ্রিস অনেক আগেই ফিরে গেছে, হয়তো সে কাসাব্লাঙ্কায় চলে গেছে, নয়তো প্যারিসে, ফ্রান্সে যাবার খুবই ইচ্ছে ছিল তার। কামাল এসে ঘরটা চাইল, শাহীনভাই এই ঘরটায় আমি থাকতে পারি আপনি চলে গেলে? আপনার ফেলে যাওয়া টুকিটাকি জিনিসগুলো ব্যবহার করব, এই ঘরটা আমাকে নতুন করে সাজাতে হবে না। শাহীন একবাক্যে রাজি― কামাল খুব ভাল ছেলে, মিষ্টি ছেলে, মদ সিগারেট খায় না, কেবল লাজুক লাজুক মুখ করে হাসে। কামালকেই ঘরটা পাবার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তার পরে এক সন্ধ্যায়, শাহীন এয়ারপোর্টে চলে যায়, খুব বেশি জিনিস তার নেই সঙ্গে করে নেবার। আমায় সি অফ করতে দেবে না এয়ারপোর্ট অবধি। বলে, তুমি থাকো, মস্কোয় গিয়ে যদি সত্যিই কিছু হয়, আমি ফিরে আসব। এসব কথা সে সবার সামনে বলে না। অন্য জুনিয়ররা বলে, কী আপা আপনি যাবেন না এয়ারপোর্টে এমনও কি হয়, চলেন চলেন, আসেন আমরা অন্য ট্যাক্সিতে যাই।
    সে মস্কো চলে যায়, এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে অভ্যাস মতো ওদের ব্লকে ঢুকতে গিয়েই খেয়াল হল, আরে, চারের বারোয় তো এখন আমার যাবার উপায় নেই, সে ঘরে থাকছে কামাল, আমি নিজের ঘরে গিয়ে ভাবতে থাকি ফ্লাইট কখন পৌঁছবে মস্কোয়, কবে সে ঢাকার ফ্লাইট ধরবে, কতদিনে আমাদের সেই জিনিসপত্র পৌঁছবে চট্টগ্রামের বন্দরে। এখন থেকে জীবন আমার চলবে খুব ধীর লয়ে। হয়তো সে চিঠি লিখবে আমায় ফিরে গিয়ে, কুড়ি দিন কি একমাস বাদে সে চিঠি এসে পৌঁছবে আমার হাতে। আমিও তাকে উত্তর লিখব সুন্দর করে, তার বাড়িতে নিশ্চয় সবাই অবাক হয়ে যাবে এদেশের খাম পেয়ে। আরও তিন বছরেও বেশি অপেক্ষা। আমায় নতুন করে রাঁধতে হচ্ছে নিজের জায়গায়, সব কেমন যেন নতুন নতুন লাগে। মীণাক্ষির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখি সে নেই, ছুটিতে দেশে গেছে দেরি করে, ওদের এ’বছর নাকি দেরি করে ছুটি পড়েছে। আমাদেরও ক্লাস শুরু হয়ে গেছল শাহীন চলে যাবার আগেই। আমার ঘরে কোনও রুমমেটও নেই, সেই মেয়ে দু’টো ফেল করে কোথায় যেন চলে গেছে, হয়তো বাড়িই ফিরে গেছে। এ বছর এখনও অবধি তেমন কোনও নতুন মেয়ে আসেনি, মেয়েদের ফ্লোরে তাই সব ঘরই ফাঁকা ফাঁকা।
    শাহীন চলে যাবার দিন তিনেকের মাথায় রাত দশটা টশটা হবে, কে যেন টোকা দেয় জোরে জোরে আমার দরজায়। তখনও রাতের পোশাক পরিনি, হাতকাটা একটা ফ্রক পরা অবস্থায় দরজার পাল্লাটা খুলেই দেখি একটা অপরিচিত মুখ। একটা ছেলে; কোন দেশি কে জানে! সে আমাকে বলে নীচে যেতে, গেটের চৌকিদার নাকি আমায় ডাকছে। আমায় ডাকছে? এত রাতে! কেন? ফোন এসেছে না কি যেন একটা বলে, তার উচ্চারণ ভাল বুঝতে পারি না, ছেলেটা এটুকু বলেই চলে যায়। কে ফোন করবে আমাকে? কেনই বা করবে? তবে কি শাহীন দেশে পৌঁছে গিয়েছে এত তাড়তাড়ি? দেশে ফিরেই তার আমার কথা মনে পড়েছে! ওই অবস্থাতেই দৌড়ে যাই নীচে, ব্রা পর্যন্ত পরা নেই জামার ভেতরে, কিন্তু ফোন যে করছে তার তো বিল উঠছে। একতলায় একটাই ফোন সেটা আমাদের ব্লকের উল্টোদিকে শাহীনদের ব্লকের চৌকিদারের টেবিলের উপরে থাকে। ক্বচিৎ কদাচিৎ কারও কারও ফোন আসে। চৌকিদার বুড়ি আমায় দেখতে পেয়েই বলে, অ্যাই অ্যাই, দ্যাখ তোর ফোন এসেছিল, এখন লাইন কেটে গেল।
    কে ফোন করেছিল? সে বলতে পারে না, আমাকেই করেছিল কিনা সেটাও জোর দিয়ে বলতে পারছে না। কে জানবে আমার হস্টেলের ফোন নম্বর? আমি নিজেও তো জানি না। তবে কি অন্য কারও সঙ্গে গোলাচ্ছে, বা তবে কি কোনও বিপদ হয়েছে, শাহীনের, বা আমার দেশে, আমার বাড়িতে কলকাতায়? ঠিক তখুনি বেজে ওঠে ফোনটা আবার, চৌকিদার বুড়ি ফোন তুলেই বলে আমায় , নেঃ! তোর ফোন, আবার করেছে। আমি কাঁপা হাতে রিসিভারটা কানে চেপে বলি- আলো! ওপাশ থেকে শাহীনের গলা, শোনো একটা ভাল খবর আছে, আমার পিএইচডির পার্মিশান হয়ে গেছে, আজই হল, গত দুদিন ধরে খুব ঘোরাঘুরি গেছে। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসছি, এসব কথা কারোকে বলতে যেও না এখন। কামালকেও না। বুঝছ?  ফোন কেটে যায়। চৌকিদার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করছে, মানে সব ভাল খবর কিনা, আর কীই বা জিজ্ঞেস করবে সে। 
    আমার চারিদিকে যেন অর্কেস্ট্রা বাজছে, অসংখ্য সুর, বাজনা, তাল ঝমঝমিয়ে ওঠে। নিজের ঘরে ফিরব কি, আমি খোলা দরজা দিয়ে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে যাই হস্টেল থেকে, আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়, টপ টপ করে বড় বড় ফোঁটার জল, ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, শরতের গোড়ায় এমন বৃষ্টি তো হয়ই, এ সেই বৃষ্টি, আমি ফুটবল গ্রাউন্ডের দিকটায় হেঁটে চলেছি, বৃষ্টির ঝাপটায় সমস্ত গোলাপের পাপড়ি ঝরে পড়ে যাচ্ছে, আমি গাইছি মনে মনে নাকি আওয়াজ করে জোরে জোরে তা বুঝতে পারি না।
    দিশি দিশি সচকিত দা আ মিনী চমকিত
    চমকি উঠিছে হরিণী- তরাসে!
    ভিজেই গেলাম। কিন্তু ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করছে না যে!
    গগনে ঘনঘটা, শিহরে তরুলতা... ময়ূর ময়ূরী নাচিছে হরষে
    আচ্ছা শাহীনকে ওরা বাজপাখি বলেছিল কেন? বাজপাখি নয়, ময়ূর। ময়ূর ময়ূরী নাচিছে হরষে―
    সে ময়ূরের মতো সুন্দর। আর কীই বা পারি আমি, শত হলেও ইন্ডিয়ান মেয়ে তো, ইন্ডিয়ান সিনেমার  মতো করেই তো ভাবি, সেই মতো আনন্দে গেয়ে উঠি। একটা গান শেষ হতে না হতেই মাথা তোলপাড় করে সুর বাজছে, এ আমি ওই চৌকিদার বুড়িগুলোকে বোঝাব কেমন করে! বেশ খানিক পরে যখন হস্টেলে ঢুকছি দুই ব্লকের দুই বুড়ি আমায় দেখিয়ে বলে, এই যে পাগলিটা ফিরল এখন। আর ঠিক তার পরের দিন সন্ধেয় কামাল এসে আমার ঘরের দরজায় টোকা দেয়, আপা আসেন, দেখেন কে আসছে, সারপ্রাইজ। চারের বারোয় গিয়ে দেখি বেজায় ভিড় সেখানে, অন্যরা আগেই চলে এসেছে, তার এই অপ্রত্যাশিত দ্রুত প্রত্যাগমনে যাকে বলে পুলকিত লোকজন। ভিড়ের ফাঁক দিকে উঁকি মেরে দেখি সে আমার দিকে চেয়ে অল্প অল্প হাসছে।

    কামালের ঘরে নয়, শাহীন অন্য একটা ঘর পেল তিনতলায়। এ ঘরটা হস্টেলের পেছনের দিকটায়, যেদিকের জানলা দিয়ে এবড় খেবড় জমি, গাছ, অগোছালো বাগান ঝোপ এবং অন্য কিছু হস্টেল দেখা যায়। আমার ঘরটাও ওই একই দিকে, পেছনের দিকে। তবে আমরা এখনও রয়ে গেলাম আলাদা আলাদা ব্লকে। একটা গোটা রাত সে কখনই আমার ঘরে থাকতে চায়নি বা তার ঘরে আমায় থাকতে দেয়নি। একটা ক্ষীণ আশা ছিল মনে যে হয়তো এবার একটা ঘরেই দুজনে থাকব। কিন্তু না, একসঙ্গে থাকার ব্যাপারে সে একটুও আগ্রহী নয়, এতে নাকি ইমপ্রেশন খারাপ হয়! এই ‘ইমপ্রেশন’টা আমি বুঝে উঠতে পারি না। এটা তো মুক্ত সমাজ, ছেলেদের মেয়েদের আলাদা করে হস্টেল নেই, মেলামেশায় বাধা নেই, কে কার ঘরে গেল, কী করল না করল, তা নিয়ে কোনও বাধা-নিষেধ নেই, কত ঘরেই তো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে থেকেছে, থাকছে, আর পাবলিকের কি জানতে বাকি নেই যে আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা কী রকম? তাতে আমার বয়েই গেছে, কিন্তু শাহীনের তো বয়ে যায়নি। সবাই জানে সে খুব নম্র, ভদ্র, মিষ্টি স্বভাবের ছেলে, পড়াশোনায় ভাল, মদ টদ খায় না। কেউ কেউ হয়তো জানে যে সে মদ খায়। হই হল্লা করে না, মারামারি করে না, প্রফেসরদের সামনে বিনয়ী হয়ে থাকে, বেশি কথা বলে না, একটা-দু’টো উত্তর দেয় খুব ভেবে চিন্তে। তার ইমেজ নষ্ট হবে সেটা বুঝতে পারি। এই ইমেজের জোরেই সে আজ পিএইচডিতে চান্স পেল, শুধু ভাল রেজাল্ট করলেই পিএইচডি করবার সুযোগ সকলে পায় না, আরও অনেক ফ্যাক্টর আছে। 
    উপরমহলে তার অনেক চেনাশোনা, কিছু অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা সে হয়তো পাবে, কিন্তু সেসবের জেরে আমাকে যে মূল্য দিতে হচ্ছে তার কোনও হিসেব কি কোথাও রাখা হচ্ছে? কেউ কি জানতে পারছে যে আমি সমস্ত বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা চরম একাকীত্বময় জীবন কাটাচ্ছি? বিধি-নিষেধের ঘেরাটোপে আমার জীবনের এই সময়গুলো একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই অভিযোগ আমি কার কাছে করব? লোকে শুনলে বলবে, এই জীবন, এই অপশন, তুমি নিজেই বেছেছ, পছন্দ না হলে বেরিয়ে যাও, নিজের পছন্দ মতো বাঁচো, তাকে দোষ দিচ্ছ কেন? সে তার  মতো আছে, তাকে তো তুমি বদলাতে পারবে না। বেরিয়েই যদি যাই, তাহলে এই ঘেরাটোপে ঢুকবার আগের জীবনটাকি আমি ফিরে পাব? পাব না। যে বন্ধুত্বগুলো বা যে যোগাযোগগুলো বাধ্য হয়ে হয়ে ছিঁড়ে ফেলেছি, তারা কি আমায় অ্যাকসেপ্ট করবে আবার আগের মতো? করবে না। মীণাক্ষির সঙ্গেই সম্পর্ক সেই আগের মতো মধুর নেই। মীণাক্ষি জেনে গেছে, আমি স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী, নিজের কাজটুকু বুঝে নিয়েই ওকে কাটিয়ে দিয়েছি।এক এক সময় মনে হয় মীণাক্ষির ঘরে গিয়ে ওকে সব বলে দিই, সেই যেদিন ও চুমু খেলেছিল সাত্তারকে, সেই তখন থেকে শুরু করে আজ অবধি যা যা হয়েছে সমস্ত বলে দেওয়া দরকার। বাইরে থেকে দেখে আমায় যেমন মনে হয়, তেমনটি আমি নেই। চুড়ান্ত অনিশ্চয়তা আর আরও একটা কিছু নিয়ে আমি বাস করি, সেই আরও একটা কিছুকে যে কী বলে সেটা ভাষায় প্রকাশ করবার মতো শব্দ আমার ভোকাবুলারিতে নেই।
    শাহীন নতুন ঘর পেয়েই দেশে চলে গেল ছুটিতে। ফিরে এসে পড়াশোনায় মন দেবে, পিএইচডির পড়ায় তো আর ক্লাস করতে হয় না, কাজেই ক্লাস কামাইয়ের ভয় নেই, নিজের পছন্দ মতো সময়ে ছুটি নেওয়া যায়। তাছাড়া তারও দুটো কাজ আছে দেশে। এক হচ্ছে চট্টগ্রামের বন্দর থেকে কন্টেইনার ছাড়াতে হবে, আর দ্বিতীয় কাজটা যে ঠিক কী সে আমাকে খুলে বলে না। আমি মনে মনে আশঙ্কা করি সে দেশে গিয়ে বাড়ির লোকের কথায় তাদের পছন্দমতো কোনও মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছে না তো! এরকম তো নাকি করে, শোনা যাচ্ছে রউফই নাকি দেশে গিয়ে বিয়ে করেছে, যদিও সেই ঘটনার সত্যতা কেউ বিয়ের ফোটো দেখিয়ে যাচাই করে দেয়নি। তবুও ভয় করে।
    এক এক সময়ে ভাবি, সে কি সত্যিই আমায় ভালবাসে? তাকে আমি হাজারবার, লক্ষ বার বলেছি জানিয়েছি ভালবাসার কথা, সে কতবার বলেছে আমাকে? ভাবতে ভাবতে মাথা খারাপ হবার জোগাড়, একটিবারের জন্যেও বলেছে বলে মনে পড়ে না।
    দেশে যাবার সময়ে ওরা সবসময়েই দিল্লি থেকে কলকাতা ট্রেনে যায়, তারপরে কলকতা থেকে ঢাকার ফ্লাইট নেয়, খুব অল্প ক্ষেত্রে দিল্লি থেকে সরাসরি ঢাকার ফ্লাইট নেয়। কলকাতায় যখন থাকে, কোনও সাধারণ হোটেলে ওদের ঠাঁই মেলে না, ওরা তো বিদেশি মুসলমান, তাই ওদের জন্য বরাদ্দ হোটেল আছে জাকারিয়া স্ট্রিটে। এই জাকারিয়া স্ট্রিট আমি চিনি না, এতকাল কলকাতায় জন্মে বড় হয়ে উঠেও জানতাম না, এদের কাছ থেকে জেনেছি। বর্ণনা শুনে মনে হয় ধর্মতলার কাছে কোথাও বাগড়ি মার্কেটের দিকটায় হবে হয়তো। এমনি হোটেলে গেলে নাকি ওদের বলে দেয়, জায়গা নেই। কলকাতার মধ্যেও যে এত ধর্মীয় ভেদাভেদ আছে সে আমি নতুন করে জানছি। কলকাতা এয়ারপোর্টেও ঢাকার ফ্লাইটে উঠবার আগে নাকি কর্মচারীরা টিপস চায়, বকশিস চায়, না দিলে ঘ্যান ঘ্যান করে। একজন-দু’জন নয়, সবার কাছ থেকেই এই রিপোর্ট, এই অভিযোগ আমি শুনেছি। খুব লজ্জা করে শুনলে এগুলো, আর এরাও এমন করে বলে যেন এই সব করাপশানের দায় সব আমারই। 
    এবারে শাহীন কলকাতায় যাবে আমার বাড়িতে আমার মা-বোনের সঙ্গে দেখা করতে। সে আমায় বলেনি যে চুপি চুপি সঙ্গে করে নিয়েছে একটা ভাল স্টেথোস্কোপ, আমার ডাক্তারি পড়া বোনকে উপহার দেবে বলে। দিন পনেরো বাদেই সে ফিরে আসে, তবে একা নয়। তার ফিরে আসবার দিন-ক্ষণ কিছুই আমি জানতাম না, ফিরেছে কখন তাও জানিনি, হঠাৎ বেশ রাত করেই সে আমার ঘরে আসে, ভেতরে ঢোকে না। একি! আপনি কখন ফিরলেন?
    ফিরেছি কয়েক ঘণ্টা আগে। ভাল করে ড্রেস করে আমার ঘরে এসো। আব্বা এসেছেন বেড়াতে। ওখানে গিয়ে দেখা সাক্ষাৎ করে চার পাঁচ মিনিট থেকে উঠে চলে যাবে, আমার বেডের উপর বসবে না, চেয়ারে বসবে। আমি চলে যাচ্ছি, তুমি এই দশ পনের মিনিট পরে যেও।
    আব্বা এসেছে! তার মানে শাহীন তার সঙ্গে আমায় পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছে। আমি কি শাড়ি পরে যাব, নাকি ভাল দেখে একটা সালোয়ার কামিজ, কী পরব বুঝতে পারছি না। শাড়িই পরি, শত হলেও ভবিষ্যতে যিনি আমার শ্বশুর হতে যাচ্ছেন তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হবে। শাহীনের বাবা বিছানার  উপর বসে সিগারেট খাচ্ছিলেন, পাশেই রাখা আছে ডানহিল ইন্টারন্যাশানালের প্যাকেট। রোগা পাতলা চেহারা, মানে শাহীনের চেয়ে রোগা এবং আর একটু লম্বা হলেও হতে পারেন। আমি প্রণাম করতে ভুলে গেলাম, চেয়ারে বসতে ভুলে গেলাম, ধপাস করে উল্টোদিকের খাটটায় বসে ভাবতে লাগলাম, এঁর সঙ্গে কেমন করে আলাপ জমানো যায়। মানে, এঁকে ঠিক মতো কব্জা করে ফেললে আমার পথ অনেকটাই পরিস্কার হবে।

    লম্বা ছুটি নিয়ে নিয়ে এসেছিলেন ওসমান গনি, প্রায় দেড় মাস তো বটেই। বললেন, ইস্কুলের হেডমাস্টার খুব ভাল লোক, ছেলের কাছে যাচ্ছেন জেনে এক কথায় ছুটি মঞ্জুর করে দিয়েছেন। তখনই জেনেছিলাম যে ইস্কুলের হেডমাস্টার অন্য কেউ। তাতে অবশ্য আমার তেমন কিছু খারাপ লাগেনি। ওসমান গনি ওরফে আমার হবু শ্বশুরমশাইকে দেখলাম বেশ অমায়িক টাইপের লোক। বড়ছেলে বিদেশি বিধর্মি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছে দেখে এতটুকুও বিরক্ত হননি। শাহীন ও আমার মধ্যেকার সম্পর্ক বুঝতে ওঁর পাঁচ সেকেন্ডও সময় লাগেনি। আমায় বেটি বেটি করে ডাকতে শুরু দিলেন, চেইন স্মোকার, ইংরিজি পড়ান ইস্কুলে এবং আমার সঙ্গে যখন তখন তর্কাতর্কি শুরু হতে লাগল। অধিকাংশ সময়েই উনি হেরে যেতেন। যেমন একদিন আমি ওঁকে প্রায় চেপেই ধরেছি যে আপনার বড় মেয়েটিকে আপনি লেখাপড়া শেখালেন না কেন? সে কোনওদিন ইস্কুলে গেল না, আজ তার বিশ বাইশ বছর বয়স হয়ে গেছে, এটা আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে কীভাবে পারলেন? এদিকে ছেলেদের পড়াশোনা করিয়েছেন, পরের তিনটে মেয়েকেও ইস্কুলে পড়াচ্ছেন, ছোট মেয়েটি নাহয় খুবই ছোট, তাকেও তো মুখ্যু বানিয়ে রাখবেন না, তাই না? উনি হার স্বীকার করেন, বড্ড ভুল হয়ে গেছে তা মেনে নেন। বলি, তাহলে এখনও তো শেখাতে পারেন, পারেন না কি? না, এখন সে মেয়ে বড় হয়ে গেছে তো, নতুন করে শুরু থেকে পড়তে লজ্জা পায়, ও ঘরের কাজ শিখেছে, রান্না-বান্না, সেলাই-ফোঁড়াই, ঘরে মেহমান এলে তাদের যত্ন করা, সব পারে। বড্ড ভাল মেয়েটা, ওকে একটা ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দিতে হবে। ওই এক কথা, বড্ড ভাল। ওই এক কথায় অনেক কিছু ঢেকে দেওয়া যায় তা আগেও দেখেছি, আবারও দেখে নিলাম।
    এই সময়টুকুর মধ্যে ওঁর অনেক অনেক মেডিকেল টেস্ট করানো হল অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে। সবই হাসপাতালে এবং চিকিৎসা যেহেতু বিনামূল্যে হয়, তাই এই টুরিস্টের জন্যেও বিনামূল্যেই হল। কোনও রোগ পাওয়া গেল না। সমস্ত ব্যবস্থা শাহীনই করেছিল এক বাংলাদেশি গবেষক ডাক্তারের সাহায্যে― আইয়ুব ভাই। খুবই সিনিয়র লোক এই আইয়ুব খান। দেখতে শুনতে যেমন প্রকাণ্ড, তেমনি পুরু লেন্সের চশমা চোখে। স্থানীয় এক উজবেক মহিলাকে বিয়ে করেছেন, সন্তানও আছে। তা সেই আইয়ুবভাইয়ের দিদিও এই একই সময়ে ভায়ের কাছে এসেছেন চিকিৎসার কারণে। একটা অপারেশন হয়েছে দিদির পেটে, এখন তিনি সুস্থ, হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন, তাই আইয়ুবভাই আমাদের তিনজনকে দাওয়াত দিয়ে ফেললেন একদিন। মানে শাহীন ও তার আব্বাকেই দাওয়াত দিতে এসেছিলেন, ঘটনাচক্রে ওই ঘরে তখন আমি ছিলাম, তাই ভদ্রতা রক্ষার জন্য শাহীনকে বলা, ওকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসো।
    যাইহোক, কবে দাওয়াত জানা সত্ত্বেও কেউ আমায় সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি। এর কদিন পরে কিন্তু সত্যিই আমার কাছে একটা অপ্রত্যাশিত অফার এলো বেড়াতে যাবার। তখন অক্টোবর মাস, শীত সেবার দেরি করে পড়ছে, শাহীন আমার ঘরে এসে বলল― কী, বেড়াতে যাবে নাকি?
    আমি তো একপায়ে খাড়া।
    তাহলে তিন-চারদিনের মতো জিনিস গুছিয়ে নাও, কাল আমরা বেরোচ্ছি।
    কোথায় যাচ্ছি?
    এই আশেপাশেই, সামারকান্দ বুখারা...
    এসব জায়গার কথা কেবল ইতিহাসের বইয়ে পড়েছি, এবার চাক্ষুষ দেখা হবে ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। তার চেয়েও বেশি আনন্দ হচ্ছে, এই প্রথম, এই প্রথম শাহীনের সঙ্গে কোথাও একটা বেড়াতে যাচ্ছি। ও তো শপিং ছাড়া আর কিছু বোঝে না, খালি জিনিস কিনছে আর দেশে নিয়ে যাচ্ছে বাক্স বোঝাই করে। গত বছর, যখন আমাদের প্রেমটা জাস্ট শুরু হয়েছিল, গরমের ছুটিতে চলে গেল লন্ডন, ট্রেনে করে। আমায় সঙ্গে নিতে পারত তো! নেয়নি। বলেছে, পথ নারী বিবর্জিতা― না মানে এই বাক্যটা বলেনি, শাহীন তো সংস্কৃত পড়েনি, ও বাংলায় যা বলেছিল, তা ওই তিনটে শব্দ দিয়েই প্রেসি করে ফেলা যায়। এখন কথা হচ্ছে যে, এই যে বেড়াতে যাচ্ছি, আব্বাও যাচ্ছে অবভিয়াসলি, তা এই আনন্দ সংবাদটা কি মীণাক্ষিকে বলব না চেপে যাব।  আমার মনের কথা শাহীন কীকরে বুঝল কে জানে, বলল, এটা কারোকে বলা চলবে না, শহর থেকে চল্লিশ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে যাচ্ছি আমরা, আলাদা করে পার্মিশান নেবার ফ্যাকড়া অনেক, চুপচাপ যাব কারোকে না জানালেই কোনও সমস্যা নেই।
    আনন্দে লাফাতে লাফাতে মীণাক্ষির ঘরে গেলাম, শাহীনের বাবা আসবার পর থেকে প্রায় রোজই যাই, শাহীন যখন দেশে গেছল তখনও যেতাম। মাঝে মাঝে শাহীন আমার খোঁজে এসে ঘরে না পেয়ে মীণাক্ষির হস্টেলে গিয়ে আমায় ডেকে আনত। আমি কতবার ভেবেছি ফিরিয়ে দেব তাকে, বলব, না আজ আপনি ফিরে যান, আমি যাব না আপনার সঙ্গে― কিন্তু পারিনি।
    কতবার মীণাক্ষিকে বলেছি, আজ যখন আমায় নিতে আসবে, বলবি আমি নেই, আসিনি, দেখব কী করে তখন।
    কিন্তু প্রতিবারেই সে এলে আমার সমস্ত রাগ গলে জল হয়ে যেত। এর নাম কি প্রেম, নাকি অভ্যেস? আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার পথটায় আমরা কোনও কথা বলতাম না। সে রাগারাগিও করত না মীণাক্ষির কাছে গিয়েছি বলে। মীণাক্ষির তখন নতুন বয়ফ্রেন্ড, স্টেডি বয়ফ্রেন্ড, পাকিস্তানের ছেলে কমর। সে আমার ক্লাসেই পড়ত, ফেল করে জুনিয়র হয়ে গেছে― কমর আব্বাস খান, বাড়ি ইসলামাবাদ, জাতে পুশতুন।
    প্রথমে আমরা গিয়েছিলাম বুখারা, ওটাই সবচেয়ে বেশি দূরে তাশকেন্ত থেকে, কিন্তু বড্ড বেশি রুক্ষ্ম জায়গা। যে ট্রেনটায় করে আমরা গেছলাম, সেই ট্রেনেই থাকার ব্যবস্থা, ওখানেই খাওয়া, মানে এলাহি ব্যাপার। আলাদা করে কোনও হোটেল ভাড়া করবার ব্যাপার নেই। ট্রেন আমাদের এক একটা জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, আমরা গাইডসহ বিশাল বিশাল গ্রুপ ঘুরছি ফিরছি ঐতিহাসিক জায়গাপাতি দেখছি, বাইরে একটু খেলাম, তার পরে টায়ার্ড হয়ে পায়ে ব্যাথা নিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ফেরা ট্রেনের মধ্যে। বুখারা থেকে ফেরার সময়ে সামারকান্দ। এই জায়গাটা অনেক বেশি প্রাণবন্ত, অনেক রঙিন বুখারার চেয়ে। এখানেও ইতিহাসের জিনিস, আর শুধু মোজাইকের কাজ। হাঁটতে হাঁটতে শরীরে আর দেয় না। আব্বারও সেম অবস্থা, তিনি অল্প-স্বল্প জায়গা দেখে নিয়ে গাছের তলা কি স্মৃতিসৌধের ছায়া, নিদেন পক্ষে ধাপওয়ালা সিঁড়ি খুঁজে নিয়ে ডানহিলের প্যাকেট কোটের পকেট থেকে বের করে মৌতাত করেন। আর বাকিরা― এহ বলাই হয়নি তো, আমরা শুধু তিনজনে নই, আমাদের সঙ্গে আছেন আরও তিনজন, সেই আইয়ুব খান দিদিসহ এবং আইয়ুব খানের ছোট শালী। বউ বাচ্চা সঙ্গে আসেনি ওঁর। আমরা ছজনে মিলে দু’টো কম্পার্টমেন্ট। শালী টুরিজমের চাকরি করেন, তিনিই এই বেড়ানোর ব্যাপারটা ঠিক করে দিয়েছেন। 
    বেড়িয়ে ফিরে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে ঢুকলেই এরা প্রতি রাতে মদ নিয়ে বসে। আব্বা সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রায় দম বন্ধ করিয়ে দেন আমার। আইয়ুব খান ফষ্টি নষ্টি শুরু করে দেন শালীর সঙ্গে। আইয়ুব খানের দিদি কেমন একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বসে থাকেন সব দেখেও না দেখার ভান করে। দিদির মাথায় সামান্য গণ্ডগোল আছে মনে হয়, একই গল্প আমায় বারে বারে শোনান, প্রত্যেকবারেই গল্পটা অল্প করে করে পাল্টে যায়। 
    আমি একা হয়ে যাই। অতজন মানুষের মাঝে একা। শাহীন কোথায় কোথায় যেন চলে যায় ট্রেনের ভেতরেই। বাইরে মরুভূমির মতো আবছা দৃশ্য, রাতের মরুভূমি কি মরূদ্যান, ট্রেন চলেছে ধীর লয়ে। ভেতরে আব্বা সিগারেট খচ্ছেন, নয়তো ঘুমোন, নয় উনিও কোথায় কোথায় যেন চলে যান। আইয়ুব খানের কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক দিদি নিজের মনে থাকেন, নয় শাহীনের আব্বা কি নিজের ভায়ের সঙ্গে কথা বার্তা বলেন। শালী সবসময়েই ব্যস্ত, সে এই ট্রেনের মধ্যেও কী একটা কাজ করে যেন। আইয়ুব খান ও শাহীন সর্বদাই মদ খেয়ে রয়েছে, বিশেষ করে রাতের দিকটায়। ফিরবার রাতটায় আমার ধৈর্যচ্যূতি হয়েছিল, আমি রেগে গিয়ে করিডোরে শাহীনকে দেখতে পেয়ে চেঁচামিচি লাগিয়ে দিই, কম্পার্টমেন্টের লাইটটা বারবার কে জ্বালিয়ে দিচ্ছে? ঘুমোতে দিচ্ছে না কেন? রাত আড়াইটে বেজে গেছে, কাল ভোরে তো তাশকেন্তে পৌঁছবে ট্রেন, ঘুমোব কখন? শাহীন হঠাৎ কেমন রেগে যায়, তার পরে ঘুঁষি মেরে মেরে আমার মুখটা ফুলিয়ে দেয়। মুখ, চোখ, কপাল। আইয়ুব খান দেখতে পেয়ে ওকে সরিয়ে নিয়ে যায়। শাহীনের আব্বা সিগারেট হাতে চুপ করে দাঁড়িয়ে যান।  আর কিছু সময় পরেই ট্রেনটা তাশকেন্তের উত্তরের স্টেশনে থেমে দাঁড়িয়ে যায়, ভোরের আলো না ফোটা অবধি আমরা এই ট্রেনেই থাকব। 
    ট্রেন থেকে বের হলে ট্যাক্সি নিয়ে হস্টেলে ফিরতে হবে। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি অভাব বোধ করছি একটা পোশাকের, একটা বোরখা থাকলে মন্দ হত না, কেউ দেখতে পেত না আমার এই ক্ষত-বিক্ষত মুখ। বা নিদেনপক্ষে একটা শাড়ি, একগলা ঘোমটা দিয়ে হেঁটে যেতে পারতাম, কি বোকামি করেছি সালোয়ার কামিজ পরে, পাতলা ওড়নায় কিছুই ঢাকা যাবে না। এ মুখ আমি সর্বসমক্ষে দেখাব কেমন করে?

    প্রফেসর সাদিকভ আমাদের তখন পোলিটিক্যাল ইকনমি পড়াতেন। উৎকির কারিমোভিচ সাদিকভ। তখন অক্টোবরের কোনও এক সময়, আসন্ন বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনায় ছুটি পড়ে গেছে সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যাবতীয় সোভিয়েত ছাত্র-ছাত্রীদের আপৎকালীন তৎপরতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তুলোর খেতে, বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হবার আগেই তুলো সব তুলে আনতে হবে। এই সময়টায় আমরা বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীরা প্রায় ছুটিই উপভোগ করি, শুধু দুটো ক্লাস হত নিয়মিত হস্টেলের মধ্যেই― রাশিয়ান ভাষা এবং পলিটিক্যাল ইকনমি। সাদিকভ সোজা আমায় নিয়ে ঘরে চলে এলেন। দরজাটা নিজেই বন্ধ করে বসলেন আমার সামনে― আমায় তুই সত্যি কথা বল। গাড়ির দরজায় ধাক্কা খেয়ে তোর মুখের এ অবস্থা হয়েছে, এ আমাকে মেরে ফেললেও আমি মেনে নেব না। আমি আর কী বলব। মিথ্যে বলতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছি সাদিকভের কাছে। উনি সবই জানেন আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে। উনি চাইছেন শাহীনের শাস্তি হোক, তাকে ইন্সটিটিউট থেকে বহিস্কার করে পাঠিয়ে দেওয়া হোক নিজের দেশে। এরকম বিচ্ছিরি অপরাধের বিচার হওয়া দরকার। কিন্তু আমি সেসব চাই না, আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি, আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করবার পরে লজ্জিত হওয়া দূরে থাক, সে আমার ঘরে একবারের জন্যেও দেখা করতে আসেনি, এই মুখ নিয়ে আমার পক্ষে বাইরে বের হওয়া, খাবার দাবার কিনতে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। 
    সাদিকভ থম মেরে বসেই থাকেন। ক্লাস নেন না সেদিন, সম্ভবত ছাত্র-ছাত্রীরা অপেক্ষা করে করে ফিরে চলে যায়। উনি নিজের কথা বলেন, নিজের ছেলের কথা। ওঁর ছেলে একজন প্রফেশনাল ব্যালে নর্তক। তারও স্বভাব ভাল না। নিজের বান্ধবীকে ধরে মারত, বান্ধবী ব্যালে নর্তকী। তাদের এখন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, মেয়েটির একটা সন্তান হয়েছে, এখন সে বেশ কিছুদিন নাচতে পারবে না। নিজের ছেলেকে নিয়ে সাদিকভ লজ্জিত, ঠিক এমনটাই আমাকে বলেছিলেন ওসমান গনি ট্রেন থেকে নেমে যখন হস্টেলে ফিরছিলাম― বেটি, আমার ছেলেকে আমি মানুষ করতে পারিনি। সাদিকভ বলেন, তুই ওর কাছে একদম যাবি না। দূরত্ব রাখ। দূরত্ব খুব দরকার। ও ভেবেছে ও তোকে অধিকার করে। 
    আমি সাদিকভের সব কথা তখন বুঝতে পারছি না। হয়তো বয়স কম বলে, অভিজ্ঞতা কম বলে। মন বলছে, যাকে এত ভালবাসছি সে এরকম হয়ে যাচ্ছে কেন? আমি কি কিছু ভুল করছি? সে নিশ্চয়ই একদিন ভাল হয়ে যাবে, সে ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই। সে আমায় ছেড়ে চলে গেলে, কি তাড়িয়ে দিলে আমি তো নিমেষের মধ্যে মরে যাব। বেঁচে থাকার আর কোনও অবলম্বন থাকবে না। সাদিকভ বোঝাচ্ছেন, তা কেন? তুই পড়াশোনায় এত ভাল, শাহীনের চেয়ে অনেক বেশি ভাল তোর রেজাল্ট, তোর কথা আমি অন্য শিক্ষকদের কাছে শুনেছি, তুই ভাল রেজাল্ট করে দেশে ফিরে― ধুস্! কী যে বলেন আপনি, লেখাপড়া আর প্রেম কি এক জিনিস? আচ্ছা, আপনি তাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন না? উনি চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ, বলেন, তা আমি কথা বলতে পারি তার সঙ্গে, কিন্তু তাতে কোনও সুরাহা হবে না, মানুষের চরিত্র পাল্টায় না, এত সহজে তো আরওই না। তুই শুধু কথা দে, তুই দূরত্ব রেখে চলবি, পুরুষদের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পন করতে নেই, পেয়ে বসে। হাজার হাজার বছরের সভ্যতার নিয়ম, একে একদিনে বদলানো যায় না। যত কম সহজলভ্য হবি তত তোর দর বাড়বে এটা জেনে রাখ।
    আমি শুনে নিলাম কিন্তু এত অপমানের পরেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। আমি কেঁদে চলেছি দিন-রাত। সে একবারও দেখা করতে এল না আমার সঙ্গে? এত ঘৃণা, এত রাগ? কলকাতার যে লোকগুলো খারাপ ব্যবহার করেছে তার সঙ্গে, যে হোটেলে থাকতে দেয়নি, যে কাস্টমস অফিসার ঘুষ চেয়েছে, তাদের সবার অপরাধের শাস্তি আমাকে পেতে হচ্ছে কেন?
    প্রায় সাত আট দিন পরে শাহীন আসে আমার ঘরে, বলে, আব্বা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। আমার মুখের দাগ তখনও ভাল করে মিলিয়ে যায়নি, তাও গেলাম অন্য ব্লকে। ওসমান গনি হাতে ধরে ক্ষমা চাইলেন ছেলের পক্ষ থেকে, আর দু’দিন পরে ফিরে যাচ্ছেন, কলকাতার উপর দিয়ে যাবেন, আমার পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে দেখা করতে চান। কিভাবে তা সম্ভব জানতে চান। বললাম, বেশ, আমি যাব আপনাদের সঙ্গে, আমি আলাপ করিয়ে দেব।
    ১৯৮৮। ডিরেক্ট ফ্লাইট নেই, কাবুল হয়ে দিল্লি যেতে হবে। শাহীনরা আফগান ভিসা পেল, আমায় ফিরিয়ে দিল অ্যাম্বাসি, বলল আমাদের কনসুলেট থেকে নো অবজেকশন লেটার নিয়ে আসতে, ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নাকি তেমন ভাল নেই আর আফগানিস্তানের। ভারতীয় কনসুলেটে গেলে ভাইস কনসাল বললেন, যেও না আফগানিস্তান, সোভিয়েতরা ফিরে আসছে, তোমার লাইফের কোনও গ্যারান্টি নেই ওখানে, আমি কিছুতেই তোমায় নো অবজেকশান লেটার দিতে পারি না। আমায় মাফ করো। কী আর করব, বিনা ভিসাতেই চেপে বসলাম কাবুলের ফ্লাইটে। কাবুলে পৌঁছনোর ঘণ্টা চারেক পরে একটা ফ্লাইট যাবে দিল্লি, সেটা ধরে নেব, চার ঘণ্টা এয়ারপোর্টে বসে থাকব, ওদেশে তো ট্রানজিট লাউঞ্জ নেই। শাহীনরা দু-তিন দিন থাকবে ওখানে, ঘুরবে। ওর আব্বা খুব মুজতবা আলির ভক্ত, এখন নিজের চোখে একটা শহরের ভগ্নাবশেষ দেখতে চান। আমরা একই ফ্লাইটে কাবুল গেলাম। ওরা শহরে ঢুকে গেল, আমায় পাহারা দিতে লাগল একটা টিন এজার আফগান সৈনিক। রানওয়ের পাশে একটা ছেঁড়া তাঁবুতে বসে আছি আমরা দুজনে। ছেলেটা পোড়া পোড়া শুকনো নান খাচ্ছে, আমাকে বলছে― খাবে একটু? আমি খাই না। সে রুটি খায়, চা খায়, চা ও অফার করে, সেটাও ফিরিয়ে দিই আমি। তার পর ছেলেটা আপন মনে গান গায়, হয়তো তা কোনও হিন্দি সিনেমার গানের সুর, কিন্তু তার গলা বড়ই বেসুরো।
    অন্ধকার নেমেছে কাবুল এয়ারপোর্টে, তাঁবুর ফাটা তেরপল দিয়ে হু হু করে ঢোকে ঠাণ্ডা হাওয়া। একটা-দু’টো বিমান দেখা যায় অন্ধকারে, সবই মনে হয় নাক ভোঁতা জঙ্গী বিমান, যেন মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। ঘন নীল অন্ধকার রানওয়েতে। ছেলেটা আমার মনযোগ কাড়বার জন্য তার বন্দুকটা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করল, একটা টিন এজারের জন্য একটু ভারী খেলনা এটা। যেন খুব পারদর্শী, এমনি ভাব দেখিয়ে সে বন্দুকের বিভিন্ন অংশ ভুরু টুরু কুঁচকে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। আমি ভাবছি ফ্লাইট কখন আসবে দিল্লি থেকে, যেটা আসবে সেটাই ফিরে যাবে। আচ্ছা ইন্ডিয়ার সঙ্গে ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশনশিপ কি শেষ হয়ে গেছে? আমরা প্রতিবেশি রাষ্ট্র না? নাকি সেই কমন বর্ডারটা আর নেই, মানচিত্র হয়তো বদলে গেছে, কিন্তু ভারতীয় দূতাবাস... সেটাও কি উঠে গেল নাকি কাবুল থেকে! তাহলে তো শাহীনেরা ইন্ডিয়ার ভিসা পাবে না, কী হবে তখন? আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিই, ন্যাঃ অতটা খারাপ সিচুয়েশন নয়, অ্যাম্বাসি আছে, থাকতে বাধ্য, ভিসা দিতে বাধা দিচ্ছে সেটা অন্য ব্যাপার, শত হলেও যুদ্ধক্ষেত্র তো।
    উল্টোপাল্টা অনেক কিছু ভাবি, ভুলে থাকতে চাই এই সৈনিকের কড়া পাহারার সামনে বসে আমার ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা, মানে যেটা বাস্তব। যদি আজ কোনও কারণে ফ্লাইট না আসে ইন্ডিয়া থেকে, তবে সারাটা রাতই হয়তো এইখানেই কাটাতে হবে। এরকম অদ্ভুত এয়ারপোর্ট বোধহয় দুনিয়ার কোনও দেশে নেই, অবশ্য এদেশে তো যুদ্ধ হচ্ছে। হ্যাঁ, যেটা ভাবছিলাম, মানে ভাবতে চাইছিলাম, সেটা মাত্র কয়েকমাস আগে ঘটেছে। শাহীন মস্কো যাবার ঠিক আগে, সেই পুরোনো ঘরে, সেই চারের বারোয় বসে আছি খাটের  উপর, বেশ রাত হয়েছে, কিন্তু অন্ধকার নামেনি তেমন করে, শুনি জানলার বাইরে রাস্তা থেকে কে যেন নাম ধরে ডাকে শাহীনের। অচেনা কণ্ঠস্বর, যে ডাকছে সে বাঙালি নয় অন্তত। আমি উঁকি দেবার আগেই শাহীন কাচের পাল্লা খুলে ঝুঁকে পড়ে সেই লোকটার সঙ্গে রশিয়ানে কথা বলে, নীচেই দাঁড়াতে বলে। তার পর আমায় বলে, কী সব কাণ্ড! রউফের শালা আসছে, রউফের বান্ধবীকে হাসপাতালে নিতে হবে, যাবে নাকি আমার সঙ্গে? আমি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যাই, কী হয়েছে রউফের বান্ধবীর? পেইন উঠছে। প্রসব বেদনা।
    একটা ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিল রউফের শালা, সেটাতে করেই আমরা গেলাম রউফের বান্ধবীর বাড়ি। মামলাকাৎ কে ধীরে ধীরে ধরে হাঁটিয়ে বাইরে আনা হল, অ্যাম্বুলেন্সও ডাকা যেত, কিন্তু রউফের শালা অত্যন্ত ধড়িবাজ, সে চাপ দিয়ে আমাদের থেকে কিছু টাকা আদায় করতে চায়। ওই ট্যাক্সিতেই তাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছিয়ে ভর্তি করিয়ে শালাবাবুকে তার বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হল। ট্যাক্সির বিল আমরাই চোকালাম এবং শালাবাবু মদ খাবার জন্য কিছু টাকা না নিয়ে যাবেই না। সে সব না হয় হল, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রউফ কি ফিরবে আর তাশকেন্তে? শোনা যায় সে নাকি দেশে ফিরে বিয়ে-শাদী করেছে? শাহীন বলে, অতটা জানি না, তবে চাকরি না পেয়ে বিয়ে করার  মতো কাঁচা কাজ সে করবে বলে মনে হয় না। চাকরি না পেলে এখানে ফিরেও আসতে পারে, পারমিশান করাতে একটু ছোটাছুটি তো আছেই। সেই রউফ সত্যিই ফিরে এসেছিল। শাহীনের বাবার সঙ্গে দেখা করতে এল মামলাকাৎ কে নিয়ে, বলল, স্যার একটা কাজ করে ফেলেছি, বিয়ে করেছি। তার পরে বউয়ের দিকে ইশারা করে, মামলাকাৎ ঝুঁকে নীচু হয়ে শাহীনের আব্বাকে প্রণামের ভঙ্গীতে সম্মান জানায়। তারমানে সবাই বেইমান নয়, দুনিয়ায় ভালবাসার টান বলে যে জিনিসটা আছে, তার জোর কম নয়। 
    আবার সামাদের কথাও মনে পড়ে। মহম্মদ আব্দুস সামাদ। উক্রাইনায় ল্ভভ শহরে ডাক্তারি পড়ত। বছর বছর ফেল করতে করতে এমন অবস্থা যে ইনস্টিটিউট আর তাকে রাখবে না। রাখবে না মানে একেবারেই রাখবে না। সামাদ তখন প্রেম করত একটা ইস্কুলের মেয়ের সঙ্গে, ততদিনে মেয়েটা ইস্কুল থেকে পাশ করে গেছে, আর পড়তে চায় না, সামাদের সঙ্গেই থাকে, মেয়ের মা আবার জজ সাহেবা। অনেক কষ্টে ইনস্টিটিউটের এক ডিনকে পটিয়ে পাটিয়ে সামাদ তার বহিস্কার রুখে ফেলল, বলল একেবারে দেশ থেকে তাড়াবেন না স্যার, মরে যাব, দেশে ফিরে না খেতে পেয়ে মরব, একটা সেকেন্ড চান্স দিন, অন্য শহরে ট্রান্সফার করে দিন আমায়, আমি সেখানে গিয়ে খুব মন দিয়ে পড়ে ডাক্তারিটা পাশ করব, কথা দিচ্ছি। চাটুবাক্যে ভুলে ডিন তার বদলির অর্ডার পাশ করিয়ে দিল। ব্যস অমনি সেই বান্ধবীকে নিয়ে সামাদ সটান তাশকেন্তে এসে উপস্থিত। এখানে তার অনেকদিনের পুরানো দোস্তো শাহীন হাসান তো আছেই। বান্ধবী ইউলিয়াকে সঙ্গে নিয়ে এক বসন্তের বিকেলে সামাদ আমাদের হস্টেলের সামনে ফোয়ারাটার কাছে উশখুস করছিল, তাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না চৌকিদার। শাড়ি পরা আমাকে দেখে সে এগিয়ে এসে বলে― বাংগালি নাকি? 
    ―হ্যাঁ
    ―দেখেন না, একটা কাউর হৈসে, আমাকে ঢুকতে দেয় না আপনাদের হস্টেলে, সঙ্গে বান্ধবী আছে তো, ভাবছে খারাপ মেয়ে নিয়ে ঢুকত্যাসি। আপনি শাহীনকে চেনেন? শাহীন হাসান চৌধুরী। একটু ডেকে দেন না, বলবেন সামাদ আসছে।
    সেই সামাদ এখন লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক, এক বছরেই সে অদ্ভুত মন্ত্র বলে নিজের ভোল নিজেই পাল্টে ফেলেছে, বান্ধবী ইউলিয়াকে বিয়ে করেছে, খুবই শৌখিন জীবন যাপন করে তারা। আজকাল আমার সঙ্গে ব্যবহারও ভাল করে না। সময়ের সঙ্গে খুব দ্রুত রূপ পাল্টায় সে। এত সব ভাবতে ভাবতে খুব জোরে হাওয়া দিল, সঙ্গে আওয়াজ, এ আওয়াজ যুদ্ধের আওয়াজ নয়, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান ল্যান্ড করল আমাদের থেকে তিরিশ মিটার  মতো দূরে।

    কলকাতা এয়ারপোর্টের ডোমেস্টিক টার্মিনালের দোতলার রেস্টুরেন্টে আমাদের আবার দেখা হল। আমার নিজের দেশের মাটিতে, নিজস্ব পরিবেশে আমি আলাপ করিয়ে দিচ্ছি তাদেরকে আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। তখনও আমার চোখের নীচে রক্তের দাগ, কপাল তখনও কিছুটা ফোলা। আপনজনেদের কাছে সেই মিথ্যে গল্পটাই খুব বিশ্বাসযোগ্য করে বলেছি যেটা সাদিকভকে বিশ্বাস করানো অসম্ভব ছিল। কিন্তু সময় তো অনেকটাই বয়ে গিয়েছে, আঘাতের চিহ্নও তাই অনেক কমে গেছে। তারা বিশ্বাস করে ফেলল সহজেই। শাহীনের আব্বা কিছুই প্রায় খেতে চাইলেন না, ঢাকাগামী বিমান ছাড়তে যদিও তখন অনেক দেরি, তবুও তিনি তাড়া দিতে লাগলেন, হয়তো আমার চোখের দিকে তাকাতে তাঁর অস্বস্তি হচ্ছিল, বা অন্য কোনও কারণও থেকে থাকতে পারে। 
    সেবারে খুব অল্প সময়ের জন্য কলকাতা যাওয়া, তবুও মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, এবার দু’টো কাজ আমায় করে ফেলতে হবে। আমিও বিদেশে বেড়াতে যাব, যেমনটি অন্যরা যায়, শাহীনও গেছল। দুই, আমার পরিবারের সদস্যদেরও ওই দেশটা দেখিয়ে আনার একটা কর্তব্য মনের ভেতরে অনুভব করছি। হয়তো কেউ সাহায্য করবে না, তবু আমি চেষ্টা করব। মা কে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সোভিয়েত দেশে বেড়াতে যেতে চাও? সে বলে, তাতে তো অনেক খরচ! খরচটা তেমন কিছু নয়, নগন্য, আসলে যেটা কঠিন সেটা হচ্ছে পারমিশান বের করা, সমাজতান্ত্রিক দেশ তো, আইনকানুন বড্ড কড়া। অন্তত তার পাসপোর্টটা এবার বানিয়ে ফেলা দরকার। আপনজনদের জন্য তো কিছু করিনি এতদিন, নিজেরটাই ভেবেছি স্বার্থপরের মতো। এর পরে সামনে কী রকম জীবন আসছে তা জানি না, হয়তো বাংলাদেশেই চলে যেতে হবে, সেই নতুন দেশে কেমন করে জীবন যাপন করব তা তো জানি না।
    সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে, যে আমার মা এই সম্পর্কের এতটুকুও বিরোধী নয়, অথচ তার কাছ থেকেই অসম্মতি বাধা ইত্যাদি পাব ভেবেছিলাম। ছোটোবেলা থেকে সমতা ইত্যাদি যা যা শিখেছি বাড়িতে, তার সবটা তো সব সময় বাস্তবের সঙ্গে মেলে না, মুখে অনেকেই বলে জাত ধর্ম দেশ ইত্যাদি নিয়ে মানুষে মানুষে কেন ভেদাভেদ থাকবে, কিন্তু বাস্তবে তো তেমনটা ঘটে না, বিয়ে-টিয়ের সময় সমস্তই কষ্ঠিপাথরে যাচাই হয়ে যায়। বিশেষ করে আমার মা, যে কিনা ধর্মের ভেদাভেদের কারণে একদিন উদ্বাস্তু হয়েছিল, নিজের দেশ, নিজের ঘর, বন্ধু, পরিবেশ, ভাষা, সমস্ত ছেড়ে তাকে চলে আসতে হয়েছিল অচেনা জায়গায়। আজ সেটাই তার নিজের দেশ, আজ সে দেশের পাসপোর্টের জন্য সে অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম ফিলাপ করছে। সে কেমন নির্দ্বিধায় নিজের সন্তানকে ছেড়ে দিতে পারছে অজানা দেশে ঘর বাঁধতে।  অবশ্য বিয়ে টিয়ের ব্যাপারে কোনও আলোচনা হয়নি ওই রেস্টুরেন্টে বসে, কিন্তু এ তো বোঝাই যাচ্ছে, কেন সকাল সকাল সেজে গুজে তাদের সঙ্গে নিয়ে আমি এয়ারপোর্টে গেছি।
    তাশকেন্তে ফিরে গিয়ে বুঝলাম, যে দু’টো কাজের টার্গেট রেখেছি সেই কাজ দু’টো সম্পন্ন করতে গিয়েই আমার অনেক সময় এবং শ্রম ব্যয় হবে। সে এক দিক দিয়ে ভালই হল। মাকে আনবার প্ল্যানটা আমি কারোকে বলিনি, মীণাক্ষিকেও না। শাহীনের ঘরে আবারও যাই, সে ও আসে আমার ঘরে, কিন্তু কোথায় যেন ধীরে ধীরে তাল কেটে যাচ্ছে, সেটা কি সে বুঝতে পারে? একটা জিনিস হয়তো বোঝে যে, সেই আগের  মতো আবেগ উচ্ছ্বাস আর নেই। সে তো এমনটাই চেয়েছিল, কম কম মিশব, কম কম সময় একসঙ্গে কাটাব, অপ্রয়োজনে তার কাছে যাব না, যা বলবে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব, কোনও প্রতিশ্রুতির প্রসঙ্গ তুলব না। সে এখন নিজের জন্য অনেকটা জায়গা পেয়েছে, আমরা আর এক সঙ্গে রাঁধি না। আমি নিজের মতো রাঁধি, নিজের খুশি মতো খাই দাই, ঘুরে বেড়াই, মীণাক্ষিও নিজের একটা বৃত্ত তৈরি করে ফেলেছে, যে বৃত্তের পরিধির বাইরে আমি। তাতে প্রথম দিকে মনটা খারাপ হয়ে গেলেও বুঝলাম আমি নিজেও তো এমনটাই আগে করেছিলাম তার সঙ্গে। হয়তো কমরকে নিয়ে মীণাক্ষি এখন বেজায় আনন্দে দিন কাটাচ্ছে, কী দরকার আমার ওদের বিরক্ত করবার?
    সমস্ত ব্যবস্থা ধীরে ধীরে হয়ে যাচ্ছিল কারোকে ঘুণাক্ষরেও জানাইনি। একদিন শাহীনের সঙ্গে সামাদের ওখানে গেছি, খুব বড় ঘর জোগাড় করেছে সামাদ, তার বউ ইউলিয়া তখন অন্তঃসত্ত্বা। খামোখা আমায় অপমান করে সামাদ কথা বলছে― দিদি, আপনার বসা-ই খারাপ। এ হচ্ছে ওর কথা বলার ধরণ। এই বাক্যের অর্থ ঝপ করে বুঝে উঠতে পারিনি, তবে বুঝলাম আমাকে অপমান করে মজা পাচ্ছে। এইরকম ইয়ার্কি করেই সে আনন্দ পায়। ইউলিয়া বাংলা বোঝে খুবই কম, তার কোনও মাথাব্যথা নেই সামাদের বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে। সে নিজের মনেই থাকে, দামি দামি জিনিস কেনে, দামি পোশাক পরে, দামি খাবার খায়, সে তাতেই খুশি। শাহীনও প্রতিবাদ করে না সামাদের এ সমস্ত উক্তিতে। আমি বিরক্ত হয়ে উঠে চলে আসতে চাই, ওরা কেউ বাধা দেয় না। উঠবার আগের মুহূর্তে সামাদ বলে, দোস্তো পুরুষমানুষের দোষেই মেয়েমানুষ খারাপ হয় এইটা বুজছস তো? এটাও খুব জটিল কোনও বাক্য হবে যার অর্থ সামাদই জানে, সামাদই একটু পরে এর অর্থ প্রাঞ্জল করে বুঝিয়ে দেবে। আমি পায়ে জুতো গলিয়ে বেরোচ্ছি, তখন ইউলিয়াও আমার সঙ্গে বেরিয়ে আসে। সামাদ তখন বোঝাচ্ছে শাহীনকে― তোর মেয়েমানুষকে তুই যদি কন্ট্রোল করে না রাখতে পারিস, সেটা তোর দোষ, আমাকে দেখ, আমি আমার বউকে...
    বাকিটা শোনা হল না, শোনার দরকারও নেই, ইউলিয়ার সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়েছি বাইরে। এই প্রথম আমরা দু’জন কথা বললাম নিজেদের মধ্যে। আমার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের ছোট সে, কিন্তু বুঝতে পারছিল যে ওই ঘরে যে আলোচনা হচ্ছিল, তা স্বাস্থ্যকর নয়। ও আমায় ট্যাক্সি করে পৌঁছে দিতে চায় আমার হস্টেলে, আমি বলি না আমি বাসেই চলে যাব। সে জোর করে ট্যাক্সি ডাকে, ব্যাগ খুলে দেখায়, তাতে অনেকগুলো একশ রুবলের নোট। সামাদ ওকে গাদা গাদা টাকা দেয় হাত খরচের জন্য। আমার হস্টেলে, আমার ঘরে এসে ইউলিয়া অনেকক্ষণ বসে থাকে, কিছুই খেতে চায় না। তোর বর পাশ করে ডাক্তার হয়ে গেলে তুই কি পরে এদেশ ছেড়ে তোর স্বামীর সঙ্গে গিয়ে থাকবি?
    আগে তো পাশ করুক।
    তোর ভবিষ্যতের জন্য কোনও প্ল্যান নেই?
    তোর আছে?
    আমি উত্তর দিতে পারিনি ইউলিয়ার এই প্রশ্নের। ওইটুকু একটা মেয়ে, কত ম্যাচিওর্ড তা ওই একটা বাক্যেই বোঝা যায়। ওকে আবার বেরিয়ে গিয়ে ট্যাক্সিতে তুলে দিই। আশ্চর্য লাগে এই মেয়েটা কী করে সারাটা দিন সামাদের সঙ্গে কাটায়।
    সেবার গ্রীষ্মে খুব কম্পিউটার কিনবার হিড়িক পড়ল। যাদের হাতে কাঁচা টাকা আছে তারা বাইরের দেশ থেকে কম্পিউটার কিনে এনে চড়া দামে বেচতে শুরু করে দিল, ওটাই ব্যবসা। কারও হাতে খুব বেশি পুঁজি, যেমন সামাদ কি আইয়ুব খান, এরা নিজেরা আর কত কম্পিউটার সঙ্গে করে বয়ে আনবে, যাদের পুঁজি নেই তাদের মজুরি দিয়ে বাইরে পাঠাতে লাগল, কম্পিউটার নিয়ে এলে তার লভ্যাংশ থেকে কিছুটা দেবে এই কড়ারে।
    তখন গরমের ছুটি পড়ব পড়ব করছে, আমার থার্ড ইয়ার শেষ হতে চলল। শাহীনও আমায় বলেনি সে কবে দেশে যাচ্ছে, আদৌ যাচ্ছে কি না, বা অন্য কোথাও যদি যায়, কিছুই বলেনি। কিন্তু আমি একদিন বিকেলে ঠিক করলাম সাহস সঞ্চয় করে বেরিয়েই পড়ি। পিঠে একটা ব্যাগ নিয়ে আর টাকা পয়সা যা ছিল সঙ্গে এবং অন্যান্য কাগজপত্র এক্সিট ভিসা পাসপোর্ট, সবই নিলাম, এবং শাহীনের ঘরে গিয়ে বললাম, শুনুন আমি বেরোচ্ছি।
    ―কোথায় চললে?
    আপাতত মস্কো, সেখান থেকে লন্ডন কি রোম, জানি না, মস্কোয় গিয়ে তো দেখি। আপনি কোথাও যাবেন না এই ছুটিতে?
    ―নাহ, আমার আপাতত সেরকম কোনও প্ল্যান নেই।
    এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি ঘণ্টা দুয়েক পরে মস্কোর যে ফ্লাইট তাতে কোনও ফাঁকা জায়গা নেই, অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করছি, দেখি আমার নাকের ডগা দিয়ে শাহীন ও সামাদ মস্কোর ফ্লাইটে চলে যায়। বাহ রে বাহ, কিছুই বলবার থাকে না। অনেক রাতের একটা ফ্লাইটের টিকিট পাই, গভীর রাতে মস্কো পৌঁছে শুরু হয় আমার একা একা চলবার, একা একা বেড়ানোর দিনগুলো। সত্যিই তো, আমি এতদিন একজনকে ভালবেসে আঁকড়ে ধরে এমন হয়ে ছিলাম, যে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আস্তে আস্তে লোপ পেতে বসেছিল। সেবারের সেই ভ্রমণ ছিল যেমন ঘটনাবহুল তেমনি মজাদার। ইয়োরোপের নানান দেশ একা ঘুরতে ঘুরতে অনেক কিছু শিখছিলাম, জানছিলাম, আর সম্ভবত নিজের উপরে ভরসাটা আবার ফিরে আসছিল।
    অনেক শপিং, অনেক আনন্দ, অনেক ঝামেলা, টেনশন , সব মিলিয়ে যখন ফিরে এলাম তাশকেন্তে তখন আমি নিজের  উপর কনফিডেন্স ফিরে পাচ্ছি। প্রেম হয়তো একটু জোলো হয়ে গিয়েছে, কিন্তু যে অপরিসীম ভয়ের মধ্যে দুটো বছর কাটিয়েছি সেই ভয়ের অনেকটাই কেটে গিয়েছে। এখন থেকে আমার ইচ্ছেকে, স্বাধীনতাকে, ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশনকে কন্ট্রোল করবার অধিকার আমি কারোকে দিতে চাইব না। আর কদিন পরে মা আসবে, তার ভিসার ব্যবস্থা, টিকিটের ব্যবস্থা সমস্ত করা হয়ে গেছে। আমি কারোর সাহায্য না নিয়েই এগুলো করতে পেরেছি। আরও অনেক নতুন নতুন প্ল্যান খেলছে আমার মাথায়। মস্কোতেই আমি ত্যাগ করেছিলাম শাড়ি। যদিও একটা বাঙালি মেয়েকে শাড়িতেই সবচেয়ে সুন্দর দেখায়, তা শুনতে শুনতে উপলব্ধি করতে করতে কান পচে গেছে, ঠাণ্ডায় পায়ের আঙুল নীল হয়ে গেছে, ব্যথায় যন্ত্রণায় কষ্ট পেয়েছি একা, অত সুন্দর দেখতে হয়ে কী সুবিধেটা হয়েছে এই দু’বছরে? মাথার চুল কাটা বারণ ছিল, লম্বা চুল রাখলে খুব সুন্দর দেখায়। মার খেয়ে মুখ ফেটে গেলে নিশ্চয়ই আরও সুন্দর দেখায়।
    অনেক পরিশ্রম করে অর্জন করা এই স্বাধীনতা কোনও কিছুর বিনিময়েই বেচে দেওয়াটা ঠিক হবে না। আপনি চাইবেন আমি পড়াশোনা করব, ভাল রেজাল্ট করব, টাকা রোজগার করব, সেসব ঠিক আছে, কিন্তু বাকিটুকু থাকবে ট্র্যাডিশন মেনে, সেই মহানগর সিনেমায় আরতি যেমন বলেছিল, এই দ্যাখো তিল, চিনতে পারছ? সেই তেমনই আছি, ঘরের বউ। এর অন্যথা হলেই সেটা হবে ব্যাভিচার। উঁহু, লেখাপড়া শিখে, টাকা রোজগার করে যেমন স্বাধীন হচ্ছি, তেমনি আমার নিজের ইচ্ছেগুলোর উপরেও আমার স্বাধীনতা থাকুক। আপনি বলে দিয়েছেন শাহীন, এটা করবে না, ওটা করবে না, এর সঙ্গে মিশবে না, ওর সঙ্গে কথা বলবে না― আপনি কে আমার ইচ্ছেগুলোকে কন্ট্রোল করবার? হ্যাঁ ভাল আপনাকে বাসি, কিন্তু আমার সব গুলিয়ে গেছল, আমি সবটুকু সমর্পন করে বসেছিলাম আপনার কাছে। সাদিকভ হাজার বছরের পুরনো ফর্মুলা অ্যাপ্লাই করে আমাকে সংযত করতে চেয়েছিলেন, উনি এর বাইরে কিছু জানেন না বলেই, উনি তো মেয়ে নন। উনি তো জানে না স্বাধীনতা কত কষ্ট করে, কত দাম দিয়ে দিয়ে অর্জন করতে হয়। উনি মিন করেন শরীর। আমি বলি শরীর কিছু না। কিচ্ছু না। একেবারেই নগন্য ফালতু জিনিস। মীণাক্ষিও ওই রকমই ভেবেছে, ও বলেছিল, শরীর একবার দিয়ে দিলেই তোর দাম কমে যায়, ওরা তোকে চিপ ভাববে।
    আমি তর্ক করেছিলাম। এই ‘দিয়ে দেওয়া’ শব্দবন্ধতেই আমার আপত্তি। পুরুষ চায়, নারী দেয়। কী ভয়ানক এক আদান-প্রদান, দিয়ে দিলেই সব গেল, দাম কমে গেল, সম্মান কমে গেল, তাই দিতে নেই। মীণাক্ষি অবিশ্যি ফাইনালি ‘দিয়েছে’, না দিয়ে কোনও বিশেষ লাভ ওর হত না, বিয়ের সম্ভাবনা যখন আর নেই এই জীবনে।

    শরীর কিছু না, তা ও শরীরে দাগ পড়লে তা দেখা যায় তো। তোমার ভেতরে ভেতরে কী কী হচ্ছে তা শরীরের পরিবর্তনে চোখে পড়বে। শাহীনের সেই কমপিউটার কেনা বেচার কারবার চলছিল তা বুঝতে পারি, তাকে ঘনঘন অন্য দেশে যেতে হচ্ছিল, ঘরের দরজা বন্ধ থাকছিল দিনের পর দিন, তার দেখা পাচ্ছিলাম না। আবার হঠাৎ হঠাৎ দেখা যাচ্ছিল। এরই মধ্যে মা কে এই দেশ দেখানোর কাজ শুরু হয়ে গেল আমার। শাহীন যেমন যেমন করে তার আব্বাকে নানান জায়গা ঘুরিয়েছে, নানান জনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে, আমিও সেই ব্যাপার গুলো নকল করতে থাকি। আইয়ুব খানের শালী তো আর আমাদের ট্রেনে করে লাক্সারী ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেবে না, কিন্তু আমারও চেষ্টার ত্রুটি নেই, আমি বাসের টিকিট কিনি, বুখারা অবধি না যেতে পারলেও সামাকান্দটা ঘুরে আসি মায়ে-ঝিয়ে, বলতে গেলে জায়গাটা তো আমার চেনা, বছর খানেকও হয়নি ঘুরে গেছি। ইন্সটিটিউটের যাদের যাদেরকে ডেকে এনে এনে শাহীন নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিল, যখন আমি সেইসব অতিথি ও শাহীনের আব্বার মধ্যে ইন্টারপ্রেটরের ভূমিকা নিতাম, সেই অতিথিদের কারও কারোকে আমিও নিমন্ত্রন করে করে ফেলি ঝোঁকের মাথায়। তারা নিমন্ত্রন রক্ষা করে। এদের মধ্যে একজন আমাদের বিদেশি ছাত্রদের ডিনের অফিসের কেরানি, নাম ফ্লোরা, ফ্লোরা আবার ক্যাশিয়ারও, সে আমাদের স্টাইপেন্ডের টাকা গুণে গুণে দেয় মাসের শুরুতে। 

    ফ্লোরার বয়স ছত্রিশ, সে নিজেই বলল। আমার ঘরে এসে সে গল্প জুড়ে দেয়, সেখানে আবারও আমি ইন্টারপ্রেটরের ভূমিকায়। গল্প করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে যায়, সে তার নিজের জীবনের কথা বলে, মানে একটা অ্যাভারেজ উজবেক মেয়ের জীবন যেমন হয় বা হতে পারে, সেইসব। ফ্লোরা বিয়ে করেনি, ৩৬ বছর বয়স হয়ে গেছে, এখন বিয়ে হওয়া খুব শক্ত, বয়সটা মূল ফ্যাক্টর নয়, মূল ফ্যাক্টর হচ্ছে যে ওই বয়স অবধি তাকে ভার্জিন থাকতে হবে, সেটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের ডিম্যান্ড ওদের সমাজে, বিয়ের রাতে পুরো পরীক্ষা দিতে হয় কনেকে, ওই রকম প্রথার মুখে আগুন, ফ্লোরা বিয়ের পথেই হাঁটবে না। সে আমাদের পাল্টা নেমন্তন্ন করে তার বাড়িতে, তাশকেন্তের পুরনো শহরে, সামারকান্দ দারভাজা নামক মহল্লায়। সেই এলাকায় কোনও বাড়িতে বাইরের দিকে জানলা নেই একটাও, কেবল টানা দেয়াল, নয় পাঁচিল। কয়েকশো বছরের পুরনো সেই বাড়ির ভেতরে উঠোন পেরিয়ে বসবার ঘর, ঠাণ্ডা চিমনির গা ঘেঁষে গালচে পাতা তক্তপোশের উপর বসে আমরা রাতের খাবার খাই, শুরপা, পোলাও। আমার বিধবা মা আমিষ খায় না, ফ্লোরার নব্বই বছুরে ঠাকুমা চোখ টিপে বলে― নাও নাও চুপ করে খেয়ে নাও, তোমার দেশে কেউ জানতেও পারবে না।
    অতিথি না থাকলে বা দূরে কোথাও বেড়ানোর না থাকলে রোজ সন্ধেয় মা কে নিয়ে আমি একটা করে নতুন সিনেমা দেখি, অধিকাংশই হয় ফরাসি, নয় পুর্ব ইয়োরোপের, নয় অ্যামেরিকান ছবি। এই করতে করতে তার ফেরার সময় ঘনিয়ে আসে। মা থাকাকালীন শাহীন প্রায় রোজই আসত আমায় ডাকতে, দরজায় টোকা দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকত, আমি বেরিয়ে দেখতাম সে আমায় ডাকছে। অন্তত ঘণ্টাখানেক তার ঘরে গিয়ে তাকে সঙ্গ দিতে হবেই, আমি তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছলাম। অথচ একটিবারের জন্যেও সে আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করল না, যাকে সে চেনে, পরিচয় আছে, দেখাও হয়েছে দু-দু’বার কলকাতায়। কীসের এত সঙ্কোচ!
    মা কে কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে আসবার ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম, আর কিছু দিনের মধ্যেই নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে চলেছে, যাবার আগের দিন রাতে কে যেন খবর দিয়ে গেল, তিনজন বাঙালি এসেছে কলকাতা থেকে, একেবারে আনকোরা নতুন তিনজন জুনিয়র। আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠি! এত বছর পরে ভারত থেকে তিনজন বাঙালি স্টুডেন্ট এল? আমি ছাড়া আর কোনও ভারতীয় বাঙালি ছিল না এই শহরে, আর একটা ছেলে ছিল আমার ক্লাসে, কিন্তু সে ও প্রায় দেড়-দু’বছর হল অন্য শহরে চলে গিয়েছে। দৌড়ে চলে যাই প্রিপারেটরি ফ্যাকাল্টির হস্টেলে। তিনতলার একটা ঘরে সেই তিনটে ছেলে, এরা আমার থেকে চার বছরের জুনিয়র, আমি এদের সিনিয়র বলে কথা! বলি― তোমাদের কারও বাড়িতে চিঠি পোস্ট করে দেবার থাকলে আমায় দাও, আমি কাল ভোরের ফ্লাইটে ইন্ডিয়া যাচ্ছি। ওরা খুব খুশি হয়ে খশখশ করে চিঠি লিখে দেয়, দু’টো ছেলে কলকাতার, তারা বারবার অনুরোধ করে তাদের বাড়িতে যেতে, অন্য ছেলেটা শিলংএর, সে খুব বেশি কথা বলে না, বাঙালি, কিন্তু বাংলা ভাল বলতে পারছে না। মনে মনে ভাবি, এ কিছু নয়, সামনে অন্তত আরও দু’টো বছর তো আমার আছে, বাংলা শিখিয়ে গড়ে পিটে মানুষ করে নেব ওদেরকে।
    সাতদিন পরে দেশ থেকে ফিরে এসে দেখলাম আমার ঘরেও একজন রুমমেট দিয়েছে, ওদেসা থেকে এসেছে একটা ইন্ডিয়ান মেয়ে, নাগেশ্বরী রামুনি, সংক্ষেপে নাগেশ। মেয়েটা আমার বছরেরই, কিন্তু কী সব কারণে একটা বছর রিপিট করবে তাশকেন্তে। এই প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং এ আরও ভারতীয় মেয়ে যোগ হল এই শহরে। করিডোরের ওপাশের ঘরে আরও একটা ভারতীয় মেয়ে এসেছে, পুরো পুনম ধিলোনের মতো দেখতে, নাম সরুপিন্দর কৌর, সংক্ষেপে সরু। চন্ডীগড়, রামেশ্বরম আর কলকাতা, ভারতের তিন প্রান্তের তিনটে মেয়ের মধ্যে আলাপ জমে উঠল। দেশ থেকে ফিরবার দ্বিতীয় দিনেই নাগেশ জানিয়ে দিল প্রিপারেটরি ফ্যাকল্টিতে জনা দশ বারো তামিল ছেলে এসেছে, সিনিয়র হিসেবে তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে ও, চাইলে আমিও যেতে পারি। তক্ষুনি আমার মনে পড়ে গেছে সেই তিনটে বাঙালি ছেলের কথা। নাগেশের সঙ্গে বিকেলের আগেই পৌঁছে গেছি জুনিয়রদের হস্টেলে। সেখানে দু-দু’টো সিনিয়র মেয়েকে দেখে ছেলেগুলোর সে কি আনন্দ! প্রায় লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। নাগেশ নীচু স্বরে আমায় রাশিয়ানে বলছে, এদেরকে একটা সিনেমা দেখিয়ে আনলে কেমন হয়?
    আমি একটু দ্বিধাগ্রস্থ, তাশকেন্তে মন্দ অভিজ্ঞতা তো কম হয়নি এই ক’বছরে, কোত্থেকে কারা রটিয়ে দেবেই দুটো মেয়ে এসে প্রাদেশিকতার বীজ বপন করছে, বংগালি লোক বংগালি কে সাথ, মাদ্রাসি লোক মাদ্রাসি.. ইত্যাঃ, হবেই হবেই, আমি বলে দিচ্ছি তুই লিখে রাখ নাগেশ।
    নাগেশ বলে, ছাড়ান দে! আমরাও এখন সিনিয়র, কেউ ক্যাদরানি মারতে এলে দেবো এক ঘুরিয়ে... সত্যিই তো! খেয়াল হয়নি বটে, কতগুলো বছর কেটে গিয়েছে এই শহরে, ছিলাম এলেবেলে জুনিয়র, এখন তো আমরাই সিনিয়র, র‌্যালা নেবার এইই তো সঠিক সময়। কিন্তু চোদ্দোজন তামিল প্লাস তিনটে বাঙালি ছেলে, প্লাস আমরা দু’জন, একুনে ঊনিশ জনের সিনেমার টিকিট, ট্যাক্সি লাগবে গোটা পাঁচেক, তার পর জুনিয়রদের হাতে কোল্ড ড্রিঙ্কস, পেস্ট্রি এক পিস করে দিতে গেলে তো প্রচুর খরচ হয়ে যাবে রে! তোর কাছে কত আছে? অন্তত ষাট সত্তর রুবলের ধাক্কা তো! নাগেশ নিমেষে সমস্ত সমস্যার নিষ্পত্তি করে দেয়, বলে ট্যাক্সি আমার কেন? সরকারি ট্রলিবাসে করে নিয়ে যাব। চার-পাঁচটা স্টপেজ দূরে একটা সিনেমা হল দেখেছি। আমিও চিনি হলটা। উনিশ-কুড়ি জনের একটা দল ট্রলিবাসে চেপে গুঞ্চা সিনেমার সামনে নামলাম। কি একটা ফালতু হিন্দি বই চলছে সেখানে, এবং বই শুরু হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। আমি মাথা গুনছি― এক দুই, চার সাত... পুরো সংখ্যাটা এক রুবল চল্লিশ কোপেক দিয়ে গুণ করলে কত হবে তার একটা কুইক ক্যালকুলেশন মাথার মধ্যে, ছাব্বিশ সাতাশ রুবল, এবং...
    নাগেশ্বরী টিকিট কাউন্টারের কাছেই যায় না, গেটে কাছে গিয়ে গেটকিপারের হাতে একটা পাঁচ আর একটা তিন রুবলের নোট গুঁজে দেয়। জয় করাপশান। লাইন দিয়ে সবাই বসে বড়ি পর পর দুটো রো দখল করে। পেস্ট্রি- টেস্ট্রি কিনবার সময়ও ছিল না, এমনিতেই দেরিতে ঢুকেছি হলে, নাগেশ ও আমি ফিসফিসিয়ে মতোলব এঁটে নিই মাথায়, এখন বাইরে খাওয়ানোর ঝামেলায় যাবার দরকার নেই, সিনেমার শেষে হস্টেলে নিয়ে গিয়ে এদেরকে ঝোল-ভাত (নাগেশের ভাষায় রসম অ্যান্ড রাইস) খাইয়ে দিলেই চলবে। আহা রে গত কদিনে এরা দেশি খাবার খায়নি, আমাদেরও তো নিজেদের সেই প্রথম দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।
    আমার পাশে বসেছে শিলং এর সেই ছেলেটা, ও বাংলা খুব কম বলতে পারে, তবে বোঝে। পর্দায় একটা হিন্দি বই চলছে যেটার গান বাদে সমস্তই রাশিয়ানে ডাব করা। সানি দেওলকে দেখা যাচ্ছে, একটু ঝুঁকে হাঁটছে, রূপকথা টাইপের স্টোরি লাইন, আমরা দু’জন দেখছি আর হাসছি, নায়িকাকে সরুর মতো দেখতে, অর্থাৎ ইনিই পুনম ধিলোন। ডায়ালগ ফলো না করে শুধু ছবি দেখলে যা হয়, উদুম হাসি পাচ্ছে, হাসছিও, উঃ কত দিন কত মাস কত বছর পরে এমন প্রাণখোলা হাসছি আমি। এদিকে হলে সিরিয়াস দর্শকদের খুব ডিস্টার্ব হচ্ছে, গেটকিপার লোকটা আমাদের একটু ওয়ার্নিং দিয়ে গেল, স্লাইট বকে দিল আর কি, কিন্তু ওই বকে দেওয়ার পরে হাসি আরও বাড়ছে, গ্যাসের  মতো চাপ দিচ্ছে, দু’জনেই হাসতে হাসতে মুখ পেট চেপে কুঁজো হয়ে যাচ্ছি, আর ওই কলকাতার ছেলে দু’টো আমাদেরকে চুপ করিয়ে দিতে গিয়ে নিজেরাও হাসছে।
    এবার নির্ঘাৎ আমাদেরকে বের করে দেবে, নিজেদেরই বেরিয়ে যাওয়া উচিত। নাগেশ গম্ভীরভাবে তামিলে ট্রান্সলেট করছে ছবিটা সিন বাই সিন, সেটা দেখে আরোই, মানে তখন তো আর কোনও স্পেসিফিক কারণ লাগছে না আর হাসবার। আমি সেই ছেলেটার সঙ্গে হল থেকে বেরিয়ে গেলাম, দেখাদেখি কলকাতার বাঙালি ছেলেদুটোয় কী আর করবে পিছু পিছু বেরিয়ে এল। আমরা চারজনে ট্যাক্সি করে আমার হস্টেলের সামনেটায় এসে ভাড়া চোকাচ্ছি, দেখে শাহীন পাশ দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল। অন্য কেউ ভাববে সে আমাদের দেখতে পায়নি, আসলে খুব বেশি করেই দেখতে পেয়েছে, সেইজন্যেই আরও বেশি করে না দেখার  মতো ভাব করল। ছেলেগুলোকে বললাম, চল আমার ঘরে, এখন রান্নাবান্না করব, খেয়ে দেয়ে তবে যাবি।
    খাওয় দাওয়ার পাট চুকবার আগেই নাগেশ এসে উপস্থিত। সে অবশ্য ওই এক দঙ্গল ছেলেদের সকলকে সঙ্গে করে আনেনি, গোটা তিন-চার তার সঙ্গে এসেছে। নাগেশও রাঁধবে রসম ইত্যাদি, ভাবছি জুনিয়রগুলোকে নিয়ে বাইরে একটু হেঁটে আসব না কি, তা মাথায় প্ল্যান খেলে গেল, শাহীনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া দরকার। 
    চল তোদের সঙ্গে আমার বয়ফ্রেন্ডের আলাপ করিয়ে দিই। জুনিয়রের মধ্যে যে ছেলেটার নাম অনুপ, সে কিঞ্চিৎ বিষম খেয়ে বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ সে তো খুবই ভাল। অন্য দু’জন অপেক্ষাকৃত চালাক, মনোভাব চেপে রাখতে জানে, আমরা সোজা অন্য ব্লকে গিয়ে শাহীনের ঘরে টোকা মেরে গটগটিয়ে ঢুকে পড়ি। দেখুন নতুন নতুন তিনটে জুনিয়র, অ্যাই তোদের নাম বল। শাহীন চায়ের জল চাপাতে চায়, কলকাতার অন্য ছেলেটা যার নাম তাপস, সে বেঁকে বসে, আঁমি চাঁ খাঁই না।
    তাহলে ভদকা খাবে? কে কে ভদকা খাবে হাত তোলো।
    আমিও হাত তুলেছি, তাপস তখনও ন্যাকামি করে যাচ্ছে, আঁমি কঁমপ্ল্যান খেতে পারি। সেই বস্তুটা যে কী, তা শাহীনকে বোঝানোর সময় তখন আমাদের নেই। এই প্রথম সে চক্ষুলজ্জার খাতিরে আমাকেও এক পাত্র ভদকা ঢেলে দিল নিজের হাতে। আমি সপ্রতিভভাবে পাত্রখানা হাতে তুলে চিয়ার্স বলে বটমআপ। এখন সে মুখখানা এমন করে রেখেছে যেন কিছুই হয়নি, ভেতরে ভেতরে তো ফুঁসছে রাগে, আমায় একা পেলে কী করবে ভগবান জানে। কিন্তু এখন সেসব নিয়ে ভাববার দরকার নেই। দু’পাত্তর গলা দিয়ে নেমে যেতেই শাহীনের গান পায়, আর জুনিয়র গুলো ও শাহীনদা শাহীনদা করে নেওটামির চুড়ান্ত করছে। কমপ্ল্যান বয়কে দুধ অফার করা হয়েছিল, সে সেই অফার গ্রহন করেছে, একটা সাইডে বসে দুধ খাচ্ছে।
    শাহীন তার পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ানটা বের করে ঝাড়ন দিয়ে অল্প ঝেড়ে নেয় রিডগুলো। তার পরে গলায় ঝুলিয়ে বাজাতে শুরু করে, এই সুর গুলো বাজতে শুরু করলেই আমি জানি কোনটা গাইতে হবে। আমাদের ডুয়েট তো সর্বজন বিদিত ব্যাপার। দু’টো গান পরষ্পরের চোখের দিকে চেয়ে গাইলাম, ছেলেগুলো চুপচাপ মদ বা দুধে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। হয়তো ওরা একটু বোর হলেও হতে পারে, ওদের দিয়ে গাওয়াতে চায় শাহীন, বলে, এই তোমরাও গলা মেলাও! শিলংএর ছেলেটা বাংলা গান কিছুই জানে না, একটা জানে― ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু। ওটা জমবে না এই মজলিশে। তাপস একটা গান খুব ভাল জানে, সেটা হচ্ছে হারে রেরে রেরে আমায় ছেড়ে দেরে দেরে― ব্যস অমনি বেজে ওঠে শাহীনের আঙুল, আমরা সুরে-বেসুরে তারস্বরে গাইতে থাকি
    হারে রেরে রেরে আমায় রাখবে ধরে কেরে―
    দাবানলের নাচন যেমন সকল কানন ঘেএ এরে।
    গান চলাকালীনই দেখি শিলংএর ছেলেটা মাঝে মাঝে আমায় দেখে। সে রাতে ওদের হস্টেলে পৌঁছে দিচ্ছি যখন, ফুটবল গ্রাউন্ডটা পেরোনোর সময় মাঝমাঠে সে আমায় জিজ্ঞেস করে― তুমি অ্যাসামিজ জানো না, না?

    নতুন ছেলেগুলো চলে আসায় আমার অনেক কাজ বেড়ে গেছে জীবনে। পড়াশোনার চাপ কখনোই অনুভব করিনি, এর আগে ছিল একাকীত্বের চাপ, জুনিয়র হয়ে কোণঠাসা হয়ে থাকার চাপ, মাতৃভাষায় কথা বলতে না পারার চাপ। এ সমস্ত রাতারাতি বদলে গেছে। ক’দিনের জন্য অন্য শহর থেকে একটা ছেলে এল, বাকু থেকে। কৌশিক। দু’টো দিনের জন্য। আমরা কৈশোরে টিভিতে ছোটখাটো অনুষ্ঠানে কাজ করেছি। এখন বিদেশের মাটিতেও দু’টো আলাদা শহরে যে চেনা লোক রয়েছে সেটা ভাবলেও ভাল লাগে। কৌশিক ছোটোবেলায় সত্যজিৎ রায়ের দু’টো ছবিতে অ্যাকটিং করেছে, সাইড রোলে। একটা হচ্ছে হীরক রাজার দেশে অন্যটা ফটিকচাঁদ। ওর জন্য পুডিং বানাতে লেগে যাই, আমাদের ব্লকে আমাদের রান্নাঘরে উনুন খালি পাচ্ছি না, কুছ পরোয়া নেহি, শাহীনদের ব্লকেই চলে যাই ভারি ডেচকি হাতে নিয়ে, দৌড়ে দৌড়ে এক ব্লক থেকে অন্য ব্লক, সেই সঙ্গে কৌশিক ক্রমাগত ঠাট্টা ইয়ার্কি করে চলেছে। কোথায় ছিলো এরা এত দিন?  চল কৌশিক তোকে আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।
    আলাপ হবার পরে শাহীন আর গান বাজনার কথা তোলে না। সে দিন কে দিন কেমন যেন ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে।
    আমার আজকাল সময় খুব কমই থাকে অন্য ব্লকে যাবার। একে তো নতুন সেমেস্টার প্রায় শুরু হতে চলল, সরু বলে মেয়েটা ল্ভভ থেকে এসেই সাড়া জাগিয়ে তুলেছে ইন্ডিয়ানদের মধ্যে, প্রায় স্বয়ংবর সভার  মতো রেষরেষি চলছে ছেলেদের ভেতরে। তাদের মধ্যে অরুণ বলে একজন টল ডার্ক হ্যান্ডসামকে সরুর পছন্দ। অরুণকে নিয়ে আড্ডাটা আমার ঘরেই বসে, নাগেশকে সন্ধের পরে খুঁজে পাওয়া যায় না; সে আমাদের ব্লকেই ছ’তলায় একটি কাশ্মিরী ছেলে আফতাবের প্রেমে পড়েছে― আফতাব আহমেদ শাহ। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকায় প্রেমের ধারা বয়ে যাচ্ছে বলে আমরা ওকে খেপাই। তা সন্ধের আসরে সেই শিলংএর ছেলেটাকেও ধরে আনে অরুণ। ক্রমশ আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয়ে যাচ্ছে, চারজনে ছাড়া আড্ডাটা জমেই না। কে জুনিয়র, কে সিনিয়র, ওসবের ভেদাভেদ বালাই সব উঠে গেছে। মনে পড়ে আমার সেই প্রথম দুটো তিনটে বছরের বিভীষিকাময় দিনগুলো, সিনিয়রদের উৎপাতে সিঁটিয়ে থাকতে হত। আপদগুলো পাশ করে বিদেয় হয়েছে বাঁচা গেছে।  ইদানীং সরু ও অরুণের ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। সময় এই টাইম মেশিনে খুব দ্রুত কাটে। সম্পর্ক তৈরি হতে বা ভাঙতেও দেরি করে না। খুব বেশি ভণিতা বা কুণ্ঠাজনিত ব্যাপারগুলো বাদ দিয়েই আমরা সম্পর্ক তৈরি করতে এগোই― এটাই এই টাইমের মেশিনের বৈশিষ্ট।
    সেই শনিবারে আমি চুল কাটিয়ে এসেছিলাম ছোট করে। শুধু তাইই নয়, চুল ব্লীচ করে তাতে হালকা রঙও লাগানো হয়েছিলো সেলুনে। সবটুকু নয়, সরু সরু গোছা ধরে ধরে নানারকম হালকা, গাঢ় রঙের শেড, সোনালি থেকে ব্রাউন অবধি। তখন ওটাই লেটেস্ট ফ্যাশন, বেশ খরচ করতে হয়েছিল আমায়। আন্দাজ করেইছিলাম যে শাহীন রেগে যাবে, অসন্তুষ্ট হবে, বিরক্ত হবে, কটা কটু কথা শুনিয়েও দিতে পারে। কিন্তু আমি তা আর গায়ে মাখব না, সবাই বলছে যখন দেখতে ভাল লাগছে, তখন ওই একজনের মন্তব্যকে গুরুত্ব না দিলেও চলবে, সে কোনওদিনই আমার রূপের প্রশংসা করেনি, করবার সম্ভাবনাও আর দেখি না। নীচে কী একটা কারণে গেছলাম, সম্ভবত মীণাক্ষিকে দেখাতে যাব নতুন হেয়ার কাট, শাহীন দেখতে পেয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায় আর কি! আমার এত সাহস! বলে, এক্ষুণি গিয়ে মাথার সব চুলে কালো রং করিয়ে এসো। আরও বলে, ইশ অত লম্বা চুল এভাবে কেটে ফেললে? আ হাহা হাহা! আমি বলি, আবার গজাবে, আবার লম্বা হবে হুশহুশ করে। সে ভাবতেই পারে না এরকম অবলীলাক্রমে উত্তর দেব তাকে। মীণাক্ষি তো আমার চুল দেখে পুরো ফিদা! ওরও ওরকম চাই, কোন সেলুন, কত রুবল নিলো, কতক্ষণ সময় লাগে, এইসব আলোচনা করতে করতেই আড্ডা জমে ক্ষীর।
    মাঝখান থেকে জুনিয়র ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেলাম। সেও পড়ল। সে এক প্রচণ্ড ব্যস্ত সময়। হু হু করে প্রায় দু’মাস কেটে গেছে, অক্টোবরের শেষাশেষি সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। তবে ততক্ষণে খুব দেরি হয়ে গিয়েছে।

    ইন্ডিয়ান সিনেমার ঐতিহ্য বজায় রাখতে আমার এই লাভস্টোরির শেষ অঙ্কে এক ঘামাসান মারপিটের সিন থাকছে। ইতিহাস সাক্ষী আছে, তাশকেন্তের সেই তিরিশ নম্বর হস্টেলের বি ব্লকের তিনশো পাঁচ নম্বর ঘরও এই মারামারির সাক্ষী। 
    নতুন প্রেমিককে নিয়ে আমি মহানন্দে ছিলাম, সেও আমাকে নিয়ে যাকে বলে ডগমগো। গতিক সুবিধের নয় দেখে নাগেশ ইতিমধ্যেই অন্য ঘরের খোঁজ করছে। মনের মধ্যে কোনও ভয় ডর আর ছিল না। বুঝতেই পেরেছিলাম যে শাহীনকে ছেড়ে চলে গেলে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে, আমি তার জীবনে বোঝা বই তো আর কিছু নই। কিছুতেই তার মনের মতো হয়ে উঠতে পারিনি, সে যেমনটি সতী-সাধ্বী, গৃহকর্মনিপুণা শাড়ি পরা, অলরাউন্ডার ইঞ্জিনিয়ার প্রেমিকা চাইছিল সেরকম তো আর হওয়া যাচ্ছে না। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাব অক্লেশে, কিন্তু বাকি দাবিগুলো পূর্ণ করা যাবে না। বরং অত না খেটে একটু নিজের  মতো ফ্যাশন ট্যাশন করি, মদ টদ, হই-হুল্লোড়, আনন্দ-মস্তি। ওই জীবনটা আমার কাছেও বোঝা হয়ে গিয়েছে। মার-ধোর তো একটা ছোট পার্ট, ধর্তব্যের মধ্যেই নেই, আরও অনেক দামি জিনিস আমি খোয়াতে বসেছি― স্বাধীনতা।
    তবে হ্যাঁ এই সম্পর্কটার প্রয়োজন আমার ছিল, নইলে স্বাধীনতার মূল্য বুঝতাম না। যেটা ছিল, সেটা রেস্ট্রিক্টেড স্বাধীনতা। শিক্ষা রোজগার, এগুলো অ্যালাওড, এর বাইরে আর কিছু অ্যালাওড নয়। নিজের সাজ পোশাকের  উপর বাধা-নিষেধ, ফ্রিডম অফ মুভমেন্টের উপর বাধা-নিষেধ, একটা সময়ের পর নেওয়া যায় না, বিশেষ করে অন্য একটা অপশন যখন হাতে রয়েছে। তার ঘরে আর আমি যাই না দেখে সে সম্ভবত গোঁজ হয়ে ছিল কিছুদিন, ভেবেছিল ঠিক যাব আবার সুড়সুড় করে। সবাই তো জেনে গিয়েছে তারই প্রেমিকা আমি, আর কোনও ছেলে আমায় ছোঁবে না, খুব পাতি ভাষায় ‘এঁটো’ জিনিস সাধারণত কেউ নিতে চায় না। ভুলে গেলে চলবে না, সেটা ১৯৮৯ সাল।
    নতুন প্রেমিকের সঙ্গে তখন জমিয়ে প্ল্যান করছি সামনে আমার জন্মদিনে কীরকম পার্টি হবে, নিউ ইয়ার্স পার্টিই বা কোথায় সেলিব্রেট করব। আরও অনেক প্ল্যান আমাদের। আমরা বিয়ে-থায়ের মধ্যে যাব না। যেমন আছি তেমনি থাকব, যেদিন মনে হবে সম্পর্ক আলগা হয়ে গেছে নির্দ্বিধায় আলাদা হয়ে যাব, আইন নিয়ে টাগ অফ ওয়ার খেলব না। মেয়ে হয়ে জন্মানোর সুবাদে ডিভোর্সের অ্যালিমনি নেব না। বাচ্চাকাচ্চা হলে হবে, ভালবেসেই আনব তাদের দুনিয়ায়, এইরকম সব ভাবনা চিন্তা করতাম আমরা এবং মনে প্রাণে তা বিশ্বাসও করতাম। লোকে শুনলে বলবে পাগল, কিন্তু খানিকটা পাগল হয়েই বেশ ছিলাম আমরা। সে তখন বলতে গেলে আমার ঘরেই বেশিক্ষণ থাকে। 
    নাগেশ সন্ধের দিকে একটু ঢুঁ মারে, ফের ছ’তলায় অদৃশ্য হয়ে যায়। এমনিই চলছিল। খবরে প্রকাশ শাহীনের অনেক সাঙ্গপাঙ্গো জুটেছে, কিছু জুনিয়র পোলাপান। তারা সারাটা দিন শাহীনভাইকে তেল দিচ্ছে, শাহীনভাই এক কলি গেয়ে ফেললে তারা এত বেশি বেশি প্রশংসা করছে যে, বাইরের কেউ দেখলে ব্যাপারটা নিয়ে সন্দেহ করবে। আসলে কিছুই নয়, তাদেরও স্বার্থ আছে, বিনি পয়সায় মদ খাওয়া যায় নিশ্চিন্তে। শাহীন কিছু রাঁধলে তারা তোফা তোফা করে খায়, আহ শাহীনভাই কী পাক করছেন, আলা হৈছে গোশতোটা। শাহীনও চাটুবাক্যকে সত্যিকারের প্রশংসা বলে ভাবে। নিজের প্রশংসা শুনতে কে না ভালবাসে। প্রতি সন্ধ্যায়ই মদের আসর বসে জমিয়ে। তা মাস দু’য়েক হয়ে গেল, আমি আর তার ঘরের দরজায় একটিবারের জন্যেও টোকা দিলাম না, এইটা তাকে খুব আশ্চর্য করে, জুনিয়র পোলাপান পারভেজ, জামিল, আলম, এরা জানায় আমার নাকি একটা বয়ফ্রেন্ড হয়েছে। একদিন বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে সে সদলবলে হানা দেয় আমার ঘরে।
    ও যে এরকম কিছু একটা করবে তা কল্পনাও করিনি। কিন্তু সে এল সঙ্গে একটা অজুহাত নিয়ে। আগে তো টাকা পয়সা সব তার কাছেই রাখতাম সিংহভাগ, মা আসবার আগে কি তারও আগে ল্ন্ডনে যাবার কিছু আগে থেকেই নিজের টাকা নিজের কাছে রাখছিলাম, মা চলে যাবার টাইমে টাকায় টান পড়েছিল পঞ্চাশ ডলার ধার নিয়েছিলাম, একেবারে ভুলে গেছলাম সেকথা। টাকা ফেরত চাইতে এল সে।
    হই হই করে এল। দরজা খোলাই ছিল, আমি আমার প্রেমিকের সঙ্গে বসেছিলাম, তাকে কিছু একটা পড়াচ্ছিলাম, ক্লাসের হোম ওয়ার্ক হবে, টুইনওয়ানে চলছিল কেনি রজার্সের কান্ট্রি, গানের কথা ও সুর একটা আবহ সৃষ্টি করেছিল। শাহীন ঘরে ঢুকে নাটকীয়ভাবে হাততালি দিল, ক্ল্যাপ ক্ল্যাপ ক্ল্যাপ। মানে এখন ডায়ালগ শুরু হবে। তার পেছনের দিকে একটু আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুই স্যাঙাৎ পারভেজ আর খুব সম্ভবত আলম। শাহীন যথেষ্ট মদ খেয়ে এসেছে, তা তার মুখের হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। প্রথমে এক মিনিট সে খুব তারিফ করল আমাদের, বাহ বাহ করে, তারপর সেই নতুন প্রেমিকটিকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে আরও নাটকীয়ভাবে তাকে কী সব বোঝাতে লেগেছে। সে তো বাংলা ভাল বোঝে না, বলছে― আমি বাংলা শুনতে পারি, বুঝতে পারি না! ব্যস আর যায় কোথায়, অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল শাহীন। ‘বাংলা শুনতে পারি, বুঝতে পারি না’, অ্যাই অ্যাই আবার বলো, কথাটা আবার বলো শুনি। সে বেচারি ভ্যাবাচাকা খেয়ে সরে আসবে, তার উপায় নেই ছ’ফুটিয়া শাহীন তার কব্জি ধরে রেখেছে শক্ত করে। ছেলেটা তো আমার চেয়েও এক সেন্টিমিটার বেঁটে, তেমনি রোগা মতো। সে পারবে কেন?
    গোলমাল দেখে নাগেশ কোত্থেকে যেন এসে উপস্থিত। পাশের ঘর থেকে দু-একটা আফগানি মুখ উঁকি মারে, এবং সরুর ঘরে যাবার পথে গোলমালের আওয়াজ পেয়ে অরুণও ঢুকে পড়েছে ঘরে। বেশ ভিড় মতো হয়ে যায়।
    এবার সে টাকা চায়। একশো ডলার।
    একশো তো নিইনি ধার। পঞ্চাশ নিয়েছিলাম। সে মানবেই না, একশো দিতে হবে। আমি হিসেব বোঝাচ্ছি, অত তারিখ অতটা নাগাদ আপনার কাছে চাইলাম, মনে নেই আপনার? একশো আমার দরকারই ছিল না, পঞ্চাশ নিয়েছি, আমার পরিষ্কার মনে আছে। সে এমন একটা হাসি দেয়, যেন ধার মকুব করে দিচ্ছে। তারপর বলে ঠিক আছে সেভেন্টি ফাইভ দাও। যেন বার্গেইন হচ্ছে। আমার জেদ চেপে চায়, কিছুতেই ভুল অঙ্ক দেব না। পঞ্চাশ নিয়েছি, পঞ্চাশই দেব। তার পরে সেটা কমে ষাটে নামালো। ষাট দেওয়া খুব ঝামেলার, হয় তিনটে কুড়ি নয় একটা পঞ্চাশ একটা দশের বিল লাগবে। খুচরো অত পাওয়া যায় না বিদেশ বিভুঁইয়ে। ষাটের নীচে সে নামবেই না। তখনও ছেলেটার হাত ধরে রেখেছে। আমি টাকা বের করতে পারছি না অতজনের সামনে, কোথায় টাকা রাখি সকলকে জানানোর তো দরকার নেই। ছেলেটিকে বলি, তোর কাছে আছে?
    তার পার্সে ষাট ডলার আছে, তাকে পার্স বের করতে দিচ্ছে না। তখন নাগেশ এগিয়ে এসে, “আইয়ো দাদা, লিসন হিয়ার” বলে একটু অন্যমনস্ক করে দিতেই ছেলেটা হাত ছাড়াতে পেরেছে। শাহীন সেটা বুঝতে পেরেই তার হাত না পেয়ে নাগেশের হাত ধরে কব্জিতে ভুলভাল চাপ দিয়ে ফেলেছে, নাগেশের কব্জির একটা অংশ জয়েন্ট থেকে খুলে গেছে। সে যন্ত্রণায় চিৎকার জুড়েছে, অমনি রে রে করে ইন্ডিয়ানরা চলে এসেছে সেখানে। তক্ষুনি একটা লণ্ডভণ্ড ভাঙচুর মারামারি না হয়ে যায় না।

    কেউ বলে অ্যাম্বুলেন্স ডাক, তো কেউ বলে মিলিৎসিয়া ডাক। এর মধ্যে কেমন করে যেন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যে শাহীন ভার্সেস নতুন প্রেমিকের মধ্যে ফাইট হবে, যে জিতবে আমি তার। বাঙালিরা মারামারি হাতাহাতির থেকেও বেশি যেটা করতে পারে সেটা হচ্ছে গলাবাজি। দূর থেকে গলাবাজি শুনলে লোকে ভাববে বিরাট মারপিট হচ্ছে, কিন্তু কাছে গেলে দেখা যাবে দু’টো দল শুধু ফুঁষছে আর শাসাচ্ছে কে আগে ঝাঁপিয়ে আক্রমন করবে তা নিয়ে। এখানেও তার অন্যথা হচ্ছে না। যে ইন্ডিয়ানরা এত বছর আমাকে ব্রাত্য করে রেখেছিল তারাই এখন আমাদের দলে। কেবল প্রথম ঘুঁষিটা কে মারবে তার অপেক্ষা। দু’তরফেই প্রবল আস্ফালন চলছে। হঠাৎ মনে হল, কী যেন একটা কাজ আমি করতে ভুলে গেছি, কিছু একটা দরকারি কাজ যেটা হুট করে মাথায় আসছে না।
    শাহীন নানান রকমের কথা বলে চলেছে, ইন্ডিয়ানরা বাংলা বোঝে না বলে জুৎ করে জবাব দিতে পারছে না, কিন্তু খিস্তি দিয়ে যাচ্ছে, আব্বে সালে, তেরি বেহেন কি, মা কি― ইত্যাদি ইত্যাদি।

    শাহীন সেসবে পাত্তা দিচ্ছে না, কেবল নতুন প্রেমিককে বলে চলেছে, ও না তোমার থেকে সিনিয়র, বয়সে চার পাঁচ বছরের বড়! ওকে না তুমি দিদি দিদি বলে ডাকতে! নতুন প্রেমিক, বাংলা শুনতে শুনতে এখন বুঝতেও পারছে, বিশেষ করে ‘দিদি দিদি’ করে ডাকা বেশি বয়সি সিনিয়রের সঙ্গে প্রেম করে ফেলার মতো কাজ করে ফেলেছে, যেটা নিয়ে সর্বসমক্ষে তাকে হ্যারাস করা হচ্ছে, তার উপযুক্ত উত্তর সে দেবে বলে উশখুস করলেও, হয়তো বাংলা ভোকাবুলারির অভাব তাকে চুপ করিয়ে রেখেছে। তার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে শাহীন আমাকে সরাসরি প্রশ্ন করে, একবারও লজ্জা করল না তোমার, ছোটো ভায়ের বয়সি পোলাপানের সঙ্গে এসব করতে? এ মেয়ে তো খানকির খানকি! লজ্জা করে না তোমার একটা ছোটো ছেলেকে এভাবে ফাঁসাতে? নতুন প্রেমিক খুব উত্তেজিত হয়ে বলে, সো হোয়াট? ইয়েস আয়্যাম ইয়াংগার দ্যান হার, সো?

    এই বাংগালির বাচ্চা, বাংলায় কথা বলতে পারছস না? বাংলা শুনতে পারি বলতে পারি না! হা হা হা। এই তো বলতে পারছ। অ্যাঃ এক্কেরে সায়েবের বাচ্চা! ওই তো গায়ের রং! নাক টিপলে দুধ বারায়, এদিকে দিদির সঙ্গে বিছানায় লটঘট করতে ওস্তাদ। আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেছে, সেই জরুরি কাজটা। বেশ কিছুক্ষণ আগে রান্নাঘরে উনুনের  উপর একটা মস্ত সাইজের বেগুন রেখে এসেছিলাম পোড়ানোর জন্য, সেটা সময় মতো উল্টোনো হয়নি, এতক্ষণে নির্ঘাৎ পুরোটাই পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে। রাতে তাহলে আমরা খাব কী? কারোকে বলা দরকার রান্নাঘরে বেগুনটার অবস্থা দেখে আসতে। দরজার কাছে সরু এসে দাঁড়িয়েছে, একটু দেরিতে এসেছে, সরু সেজেগুজে মেকাপ না করে কোত্থাও বের হয় না। টয়লেটেও না। ওকেই বললাম, কিচেনে গিয়ে দেখে আয় তো কিছু পুড়ছে কিনা! সরু চলে যেতেই আবার কবির লড়াইয়ের মতো দু পক্ষের বাক্যবাণ শুরু হয়ে গেল। এতক্ষণে নতুন প্রেমিক যুক্তি খুঁজে পেয়েছে, বলছে, ইউ আর অলসো ওলডার দ্যান হার, ইউ আর অলসো লাইক হার দাদা।
    ―বাংলা বল হারামির বাচ্চা!
    এবার ইন্ডিয়ানরা খচে যায়, হারামি শব্দটা কমন পড়েছে― আব্বে, হারামি কৌন বোলা রে? একটা ষণ্ডা মার্কা নতুন মুখ এগিয়ে আসে, নতুন ছেলে, নতুন প্রেমিকের ক্লাসমেট মনে হচ্ছে, আর হেভি মারকুটে টাইপ চোখমুখের ভাব। খেমরাজ নাম হ্যায় মেরা, কৌন বোলা হারামি? ফিরসে বোল!
    সরু এসে ইশারায় জানিয়ে দিল বেগুন ঠিক আছে, হটপ্লেট অফ করে দিয়েছে কেউ। কে একজন বলল, শাহীনভাই চলেন চলেন, এই ছোটোলোকের ম্যালের মধ্যে থাকার দরকার নাই। হাঁটুর বইসি পোলাপানের সাথে এইসব, ছি ছি। 
    হঠাৎ মারামারি করতে এগিয়ে আসে শাহীন, নতুন প্রেমিককে টেনে ধরে এক হ্যাঁচকায় পেড়ে ফেলে মেঝেয়। তাকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করে অন্যরা, কিন্তু তারই মধ্যে সে এলোপাতাড়ি ঘুঁষি চালাতে থাকে, সবগুলোই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ভুলভাল লোকজনের গায়ে লাগে।
    নতুন প্রেমিক প্রথম ঘায়েই নক আউট। তাহলে আমি এখন কার?
    পারভেজ চেঁচায়, আহ ওই একটা মাগিকে নিয়ে এত কাউর কেন? ও হেলেন ভাবছে নাকি নিজেকে?
    ―আব্বে কৌন হেলেন বোলা রে? ভাবি বোল।
    আবার খেমরাজ। সে শার্টের হাতা গুটিয়ে এগিয়ে এসেছে, হেলেন বলতে সে একজনকেই চেনে যে হিন্দি সিনেমায় কখনো খলনায়িকা, কখনো ক্যাবারে ডান্সার। খুব অসম্মানজনক কমেন্ট এটা তার কাছে। সে প্রায় ঝাঁপিয়েই পড়বে, ভিড়ের মধ্যে থেকে অরুণ থামিয়ে দেয়, আরে বো হেলেন নেহি, হি ইজ মীনিং দ্য আদার ওয়ান, হেলেন অফ ট্রয় ড্যামিট!
    মারামারিটা জমে না ঠিক। বরং নাগেশ সবচেয়ে বেশি মার খেল। শর্ত মতো এখন কি তবে আমার মালিকানা বদল হবে? ওরা আরও ঝামেলা পাকিয়ে মিলিৎসিয়া ডেকে এনে একটা ক্যাচাল সৃষ্টি করবার মতোলবে আছে। এবার শাহীন আমাকে ধরে টান মারবে, অন্যদিকে নতুন প্রেমিক আমাকে ধরে রেখেছে আঁকড়ে, এবং শাহীনের গায়ে প্রচণ্ড জোর, সে আমাদের দুজনকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার দিকে, মারবে হয়তো। ইন্ডিয়ানরা ঝাঁপিয়ে পড়বার মুহূর্তে সরু চিৎকার করে ওঠে, ডোন্ট হিট হার! শী ইজ প্রেগন্যান্ট!
    ব্যস! সমস্ত হুড়োহুড়ি চেঁচামিচি নিমেষে থেমে গেল। সবাই চুপ। শাহীনও হাত ছেড়ে দিয়েছে। কেস টা কী হল হজম করতে পারছে না কেউ।
    ―আই অ্যাম সরি যোশি...
    প্রায় কেঁদেই ফেলে সরু। ছ্যা ছ্যা করতে করতে বাংলাদেশিরা চলে গেল। টাকা পয়সার হিসেব মিটিয়ে দিয়ে ওদেরকে গেট আউট করে দেবার লোভ সামলাতে পারি না। ভিড় অনেকটাই পাতলা হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ানরা চিন্তিত, যারা এতক্ষণ মারামারিতে আমাদের পক্ষ সমর্থন করেছে। একটু ভ্যাবাচাকা। প্রথমে হয়তো বিশ্বাস করেনি, ভেবেছে সরু এই মারামরিটা থামাতে মিথ্যে কথা বলেছে। ওরা আমার কাছ থেকে জানতে চায়, কথাটা সত্যি কিনা। জানতে পেরে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার পরে একে একে চলে যায় থম ধরা অবস্থায়। এ হচ্ছে ঝড়ের আগের অবস্থা। কী আর হবে, ঝড় উঠলে উঠবে। দেখা যাবে। নাগেশকে কাল পলিক্লিনিকে নিয়ে যেতে হবে, হাতটা বেশ ফুলেছে। আপাতত ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে কেউ। সে আফতাবের ঘরে চলে গেল সে রাতের  মতো। 
    আমার খবরটা নিমেষেই রটে গেল। সাধারণত এসব খবরে লোকে অভিনন্দন জানায়, বলে কনগ্র্যাটস ইয়ার! এখন কেউ বলল না। এও এক রকমের দুনিয়া। যে দুনিয়ায় আইন নয়, ভালবাসাকে সঙ্গে নিয়ে এগোব। একটু আলাদা। বাট দ্যাটস মাই চয়েস।

     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Amit | 121.200.237.26 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:০৩735557
  • রিয়েল লাইফের গল্পের কাছে বলিউড হার মেনে যাবে। 
    সিরিয়াসলি কেউ আপনাকে এখনো জিগায় নি বইয়ের প্লট নিয়ে মুভি বানাতে পারে কি না ? 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:b52d:53cc:23ff:da71 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:০৯735558
  • মতামতের জন্য ধন্যবাদ ছাড়া আর কী বলব? ;-)
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:d5ee:e24d:c118:83 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১০:৫৩735560
  • বড্ডো লম্বা হবে না? ধন্যবাদ মিঃ চক্রবর্তী।
  • R.K | 203.18.35.200 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:২০735561
  • জীবন থেকে যে শিক্ষা তার চেয়ে কার্যকরি কোনো শিক্ষা নাই। তার প্রশংসা করি যে সেই কষ্টার্জিত সত্য কে 
    পাথেয় করতে  পারে আর সেই শিক্ষা থেকে নিজেকে আলোকিত করতে পারে। 
    আপনাকে অভিনন্দন।  
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:d5ee:e24d:c118:83 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:২৩735562
  • ধন্যবাদ।
  • syandi | 45.250.246.131 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:৪৫735563
  • এটা আগে পড়িনি।'সে'এর এই টইগুলো একেবারে অসম্ভব টাইপের ভালো। উনি লেখেনও সুন্দর। ভাবছি ওনার কাছে একটা বেয়াড়া আব্দার পেশ করব।
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:d5ee:e24d:c118:83 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:৪৭735564
  • কী আবদার স্যান্ডি? পেশ করা হৌক।
  • syandi | 45.250.246.131 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:৫১735565
  • ভাবছিলাম আপনার রাশিয়ার টইটা যদি কন্টিনিউ করতে রাজি হন তাহলে বড়ই আহ্লাদিত হই। 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:d5ee:e24d:c118:83 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:৫৫735566
  • ওকে ডান।
  • syandi | 45.250.246.131 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৯:০৬735567
  • মানে কোন চাপ নেবেন না। আপনার অবসর সময়ে ছোট ছোট ঘটনা, আ্যানেকডোটগুলো লিখবেন আমাদের জন্য। আসলে রাশিয়াতে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন প্লাস লেখালেখির অভ্যাস আছে এরকম বাঙালি(সব জেন্ডার)-এর সংখ্য়া বড়ই কম। তাই রাশিয়ার সম্পর্কে খুব বেশি জানা ছিল না। যেটুকু জানা ছিল তার বিশ্বাসযোগ্যতাটাও বেশি নয়। 

    ধন্যবাদ জানবেন।
     
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:d5ee:e24d:c118:83 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৯:১৪735568
  • ইদানীংকালেও দুবার ঘুরে এসেছি। সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশিদের একটা পত্রিকায় লিখতে দিয়েছিল বছরখানেক আগে, লিখেওছিলাম। 
    তখন আর এখনের তফাৎ খুবই চোখে পড়ে।
  • জয় | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২৩:০৩735571
  • নিরাপদ ডাল ভাত খেতে গিয়ে পৃথিবীটাই অজানা থেকে গেল, সেদি। মাতাল হয়ে ফিকশন লিখতে গিয়েও কোন লেখক নায়িকার জীবনে এত নাটক ঢোকাতে পারবে না। কি অভিজ্ঞতা!
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:d5ee:e24d:c118:83 | ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২৩:৫১735572
  • জয়,
    ভাল লেগেছে জেনে ভরসা পেলাম মনে। আরও রোমহর্ষক ঘটনা আছে "আইটি আইটি পা পা" বইটিতে। সময় করতে পারলে পড়ে দেখতে পারো। এছাড়া "কাপালিক" লেখা হয়ে গেছে। চাইলে সেটাও পেস্ট করে দেবোখন।
     
  • জয় | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:৫৩735578
  • চাই না মানে?! অবশ্যই চাই! একশবার চাই!! হাজারবার চাই!!!
  • &/ | 151.141.84.216 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:৫৬735579
  • ওঃ, সে দি, তাসকেন্তে তোমাদের সেই প্রেশারকুকারে রসগোল্লা বানানোর গল্প কতবার যে ঘুরে ঘুরে পড়তাম আর হাসতাম।
    ফিরিয়ে এনেছো সেই দিনগুলো। ঃ-)
  • aranya | 2601:84:4600:5410:b477:5315:8bbc:1e3c | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৩:৩১735580
  • সে বড় ভাল লেখেন 
  • kk | 2600:6c40:7b00:1231:3ccf:9995:f0a6:ceae | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৩:৪৫735581
  • ভালো লাগলো। আপনার লেখায় একটা খুব অকপট সততা আছে। সেইটা খুব ভালো লাগে।
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:d5ee:e24d:c118:83 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৫:১৩735609
  • kk
    একথা তোমার জন্যও সত্য।
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:d5ee:e24d:c118:83 | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৫:১৩735610
  • অ্যান্ডর এবং অরণ্যবাবুকে ধন্যবাদ।
  • kaktarua | 192.82.150.101 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:১১735655
  •  দুর্দান্ত লাগলো পড়তে। জীবনের শিক্ষা যে কি জরুরি। 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:111:8305:1c1c:a3e8 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:১৬735656
  • থ্যাংকস কাকতাড়ুয়া।
  • kaktarua | 192.82.150.101 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:৩৩735657
  • আপনার কোনো ই মেল আইডি পাওয়া যাবে? তাহলে আরো চাট্টি উপলব্ধি শেয়ার করতুম। 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:111:8305:1c1c:a3e8 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:৫৫735658
  • amodডটboshtumi জিমেইল
  • kaktarua | 192.82.150.101 | ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০১:০৮735660
  • অনেক ধন্যবাদ 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:5cea:d118:9cd:3d29 | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:০৮735789
  • স্বাতী,
    অনেক থ্যাংকস গো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন