এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • চলতে চলতে

    Swati Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    ০২ অক্টোবর ২০২১ | ৮১৪ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)
  • এক: হাফ্ প্যান্ট পরে ঘর্মসিক্ত মুখে বাজারের ব্যাগ হাতে কন্যাশ্রীর পিতা এলেন দু কিলো চাল, দু কিলো আলু, আড়াইশো চিনি, একটা সাবান নিতে। মেয়ে পড়ে ক্লাস সেভেনে। ফোন নেই। স্মার্ট ফোন। জিজ্ঞেস করলাম পড়াশোনা করে কি করে? জানাল, দিদি, পড়াশোনা করছে না। একবার একটা বন্ধুর থেকে প্রশ্ন নিয়েছিল তারপর করেছিল। বললাম আজকে যাবার সময় প্রশ্ন নিয়ে যাবেন, ওখানে দিদিমণির কাছ থেকে চাইবেন। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। কিন্তু যাওয়ার সময় দেখলাম সোজা চলে গেল।

    দুই: অভিভাবকদের স‌ই করে মিড ডে মিলের সামগ্ৰী নিতে হচ্ছে। কিন্তু পাশে ইঙ্ক প্যাড রাখা, যদি কারোর প্রয়োজন হয়। যাই হোক। দুরকম ব্যবস্হাতেই বিলি বন্টন চলছে। একজন অভিভাবক মেয়েকে নিয়ে এলেন। একটু বকলাম, কেন মেয়েকে এনেছেন? সলজ্জ হেসে বললেন মেয়ে নাম লিখে দেবে। আমি ওনাকে জানালাম টিপ স‌ই দেওয়ার ব্যবস্হা আছে। কিন্তু লক্ষ্য করলাম উনি তাতেও স্বচ্ছন্দ নন। ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না। তাই সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি সত্যি লিখতে পারেন না? অনীহা ধরা পরার ছাপ মুখে। জোর করে ওনাকে দিয়েই স‌ই করানো হল। এবং কোনোভাবেই যেন মেয়েকে সাথে না আনে বোঝালাম।

    তিন: দুজন অভিভাবক বেশ চেপে দাঁড়িয়ে আছে। দুমাসের মিড ডে মিল এর সামগ্ৰী একসাথে দিতে হবে কারন গতমাসের সামগ্ৰী সে নিতে পারে নি। আসে নি বলে। এবং সে শুনেছে সামগ্ৰীর পরিমাণও পৃথক। আমরা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম এভাবে না আসার কারণে সামগ্ৰী দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া পরিমাণও ঠিকই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তারা বোঝার ধারপাস দিয়েও যাচ্ছে না। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। জেদের কাছে চুপিচুপি হার মানতেই হয়।

    চার: ক্লাস টুয়েলভ এ পড়া মেয়ের বাবা মেয়েকে ধরে এনেছেন পরীক্ষার ফর্ম ফিল আপ করাতে। মেয়ে লুকিয়ে বিয়ে সেরেছে। বাবা জানে না। দিদিমণি জানে। মেয়ে কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মত সরকারী প্রকল্প থেকে বাদ পড়বে। ভ্যানচালক বাবার অসহায়, ক্ষোভে ফেটে পড়া চোখ দুটোর দিকে তাকানো যাচ্ছিল না সেদিন।

    পাঁচ: সাহিন ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু, ডাকাবুকো মেয়ে। রোজ অন্তত পক্ষে পাঁচটা অভিযোগ আসে। দিদিমণিদের বিচার ব্যবস্হার কঠিনতার ওপর ওর ভরসা ভীষন পাতলা, তাই কর্পোরাল পানিশমেন্ট এর দায়িত্বটা ওই মাঝেমধ্যে হাতে তুলে নেয়। কিন্তু খেলার মাঠে ভলেন্টিয়ার এর দায়িত্বর তালিকা থেকে একবছরও নাম বাদ পড়লে চলবে না, কারণ খেলার মাঠে কোনোরকম অনিয়ম তার পছন্দ নয়। পড়াশোনার প্রসঙ্গটা নেহাতই অপ্রাসঙ্গিক। তা এহেন সাহিন লকডাউনে গৃহবন্দী। পরীক্ষার সময়‌ও তার সাথে যোগাযোগ করা যায় নি। এমন অনেক ছাত্রীদের নিয়েই দুশ্চিন্তায় দিদিমনিরা। পরীক্ষার পর স্কুলে গিয়ে একদিন হঠাৎ সাহিনের সাথে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম কি করছ? ওর কর্মকাণ্ড শুনে মনে হল লকডাউনটা নেহাত অবহেলায় কাটিয়েছি। এক ডাক্তারের কাছে কিছু দিন চিকিৎসা করাতে গেছিল। সেই  স্বহৃদয়ের মানুষটি পরামর্শ দেন ওনার চেম্বারে আ্যটেনডেন্ট-এর কাজ শিখতে। ডাক্তারের চেম্বারে আ্যটেনডেন্ট এর কাজ শিখতে গেলে কিছু বেসিক ট্রিটমেন্ট এর কাজ শিখতে হয়। আগ্ৰহ বাড়ে ডাকাবুকো মেয়েটির। ভয় ঠিক ওর অভিধানে নেই। দক্ষ ডাক্তারবাবু হাতে ধরে শিখিয়েছেন ইনট্রাভেনাস এবং ইনট্রামাসকুলার ইনজেকশন। তিনি জানেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই শেষ কথা নয়। কথাগুলো যখন শুনছিলাম ওর ফোন নম্বরটাও নিলাম। জিজ্ঞেস করলাম অন্য বন্ধুদের কি খবর? বলল, জানি না দিদি, সময় নেই। ওরা সময় নষ্ট করে খুব। মনে মনে হাসি পেল। বললাম কেন কি করে ওরা। চুপ করে রইলো। সাহিনের জীবনের ব্যাটনটা দৈবক্রমে ওর জীবনীকার এর হাতেই পড়েছে। তাই গল্পটা ভালো হবে। ফিরে এলাম বাড়িতে।

    ছয়: চাকরীর প্রথম জীবনে সাক্ষাৎ হল এমন এক ছাত্রীর সাথে যার বিরুদ্ধে কানাঘুষো গুরুতর অভিযোগ সে নাকি স্কুলে তলে তলে নেশার সামগ্ৰী আদান প্রদান করছে। তার আচার আচরণও  পৃথক ধরনের। উদ্ধত প্রকৃতির। স্কুলের বাইরে দিদিমণির সামনে সিগারেট ধরাতে দ্বিধা করে না। দিদিমনি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন। শার্ট, প্যান্ট, বুট জুতো পড়ে সরস্বতী পূজোয় আসে। অভিজ্ঞ মাতৃসম শিক্ষিকারা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়াই শুরু করলেন কাউন্সেলিং। শুধু মাত্র স্নেহের ভরসায়। কমার্স-এ সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছিল। রেজাল্ট নিতে এসেছিল চেক শার্ট আর ফেডেড জিনিস পড়ে।

    সাত: ক্লাসের বেশ উজ্জ্বল মেয়ে। নাইনে উঠেছে। শিক্ষিকারা আশাবাদী। কিন্তু হঠাৎ আচরণে পরিবর্তন এলো। এই ক্লাস নাইন ভীষণ ভয়ের। অদৃশ্য দুটো ডানা গজায় মেয়েগুলোর। সতীর্থদের দিয়ে স্পাইং শুরু হল। খবর পাওয়া গেল যথারীতি প্রজাপতি ভর করেছেন। হঠাৎ একদিন মেয়ে উধাও হয়ে গেল। উদ্ভ্রান্ত পিতা স্কুলে ছুটে এলেন। ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়ানো দিদিমনি ছুটলেন পুলিশ সাজতে। নকল পুলিশ ফোন করল সিঁদুরের কৌটো নিয়ে মন্দিরে হাজির হবু বর বধূকে। পাকড়াও করে আনা হল। লায়লা মজনু তখন আসন্ন বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় কেঁদে আকুল। সামাজিক অসামাজিক সব রকমের দায়িত্ব পালন করে বাবার হাতে মেয়েকে তুলে দেওয়া হল। বাড়ির সবাই বাড়ির ছোটো ছেলেকে নিয়ে গেল। ছেলেটি হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।

    অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরতে থাকছি। জেতার থেকেও হেরে যাওয়াটা মনে রাখতে চেষ্টা করি বেশী। কারন বারবার জিতে যাওয়াটা মোস্ট পারফেকশনের দিকে নিয়ে যায়। যেটা অলৌকিক। রোজ নতুন কিছু শিখি তবে পূর্ব অভিজ্ঞতার ঠেকনাও থাকে বেশি। এ সবই নিজের ভাবনা। এভাবেই চলতে থাকবে হয়তো সবকিছু।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ০২ অক্টোবর ২০২১ ১৮:২৬498979
  • ডায়রির মত। ইন্টারেস্টিং লাগল। লিখুন এই অভিজ্ঞতাগুলো। 
  • Swati Chakraborty | ০২ অক্টোবর ২০২১ ২০:০৭498984
  • ধন্যবাদ:)
  • বিপ্লব রহমান | ০৩ অক্টোবর ২০২১ ১২:১১499008
  • করোনাকালে এরকম ছোট ছোট দুঃখ কথার পেছনে একেকটি পরিবারের কতই না দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে থাকে! 
     
    লেখার রিপোর্টাজ  স্টাইল ভাল লাগল। আরও লিখুন 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন