এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নজরুলের কবর ও অন্যান্য

    Ab Utsho লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১১৯৭ বার পঠিত
  • কবি নজরুল বাকরুদ্ধ ও জীবন্মৃত হয়ে যাওয়ার প্রায় ৬ বছর পর, তার বন্ধু কবি খান মুহম্মদ মঈনুদ্দিন তার হাতে কলম তুলে দেন একদিন। কবির পক্ষে কিছু লেখা তখন অসম্ভব। তবু তিনি লিখতে পেরেছিলেন চার লাইন অস্পষ্ট অক্ষরে। তিনি লিখেছিলেনঃ

    “কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবে চির
    বুলবুলকে গান গান শেখাব- গান শেখাব
    গান করার কবিতা গান করব-
    কবি কাজী নজরুল ইসলাম চিরদিন”

    চার লাইনের বেশি তিনি লিখতে পারেন নি।

    এই লেখা থেকে অন্তত বোঝা যায়, তিনি তার পুত্র বুলবুলকে গান শেখানোর কথা বলছেন। গানপাগল কবির ইচ্ছে ছিল প্রিয়পুত্রকে গান শেখানোর। কিন্তু গান শেখানোর বয়স হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করল বুলবুল মাত্র তিন বছর বয়সে। বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে। বুলবুলের শোক কবি ভুলতে পারেননি মস্তিষ্কবিকৃতির পরও, এই চারলাইন তাই বলে অন্তত। মানসিক মৃত্যুর পর প্রায় ৩৪ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। তার কোন আনন্দ ছিল না, অনুভূতি ছিল না, আবেগ ছিল না। কোনকিছু স্পর্শ করত না তাকে। এই ৩৪ বছর হয়তো তিনি শুধু মৃত পুত্রের কথাই ভেবেছিলেন। আমরা জানি না এসব, জানতে পারবও না কোনদিন।

    কবির চার পুত্রের মধ্যে তিন জনই মৃত্যুবরণ করেছিলেন তার মৃত্যুর আগেই। যখন কবি ঢাকায় তিরোধান করলেন, তখন তার একমাত্র জীবিত পুত্র কাজী সব্যসাচী ছিল কলকাতায়। তিনি তার পিতাকে শেষবার দেখতেও পারেননি। তার অজান্তেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে কবর দেয়া হয়েছে কবিকে তড়িঘড়ি করে!

    এই বিদ্রোহীর পুরো জীবনটাই ট্রাজিক। হিন্দু মুসলিম নয়- বাঙালি পরিচয়েই যে কবি পরিচিত হতে চেয়েছিলেন, লড়েছিলেন ধর্মীয় কুসংস্কার আর গোড়ামির বিরুদ্ধে, তার জীবদ্দশাতেই হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। ধর্ম, সমাজ আর বাস্তবতাকে চমকে দিয়ে, সব কিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে যাকে বিয়ে করেছিলেন, সেই প্রমীলা দেবীও পঙ্গু হয়ে যান ১৯৩৯ সালে। তার আগে মারা যায় দুই পুত্র কাজী কৃষ্ণ মোহাম্মদ ও কাজী অরিন্দম খালেদ (বুলবুল)।

    প্রমীলা দেবী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অসুস্থ অবস্থাতেও কবির সেবা করেছেন। কবিপত্নী শায়িত আছেন চুরুলিয়ায়। আর কবিকে কবর দেয়া হলো অন্য দেশে, যে দেশটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। প্রথমবার মৃত্যুর আগে, তিনি কি জানতেন, ধর্মের জন্য ভাগ হয়ে যাবে তার দেশ? তার দেশের মানুষেরাই ধর্ম নিয়ে খুনোখুনি করে মানচিত্রটাই ভাগ করে ফেলবে?

    কবি অভাবে পড়ে গান লেখা শুরু করেছিলেন, যদিও তার গানগুলো তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সে'সময়ে তার দরকার ছিল টাকার- কবিতা, গল্প লিখে চলছিল না সংসার। লেখা শুরু করেন গান - যা চলে বাজারে - ধর্মীয়, প্রেম, দেশাত্মবোধক - বাদ রাখলেন না কোনটাই। বাংলা গজল প্রথম তার হাত ধরেই আসে। লিখেছিলেন কীর্তন ও শ্যামাসংগীতও। মেগাফোন আর এইচ.এম.ভি'র রেকর্ডের জন্য লিখলেন দু’হাতে, সুর করলেন অবিরত। বেশি লিখলে রাগপ্রধান প্রেমের গান। সাথে গজল, শ্যামাসংগীত, কীর্তন। তেমনই একটা গানকে ভিত্তি করে তার পুত্রের মতামত না নিয়ে নিজগ্রামে কবর না দিয়ে ঢাবির মসজিদের পাশে, তার স্ত্রী পুত্র থেকে দূরে কবিকে কবর দেয়ার কাজটা ছিল রীতিমতো অমানবিক।

    কবি মৃত্যুবরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধ নিহত হওয়ার মাত্র এক বছর পর। সেদিনকার অবৈধ শাসকেরা তাকে তড়িঘড়ি করে মসজিদের পাশে সমাহিত করে হাসিল করেছিল নিজের স্বার্থ। যে লোকটাকে সুস্থ অবস্থায় কোনদিন ওরা পারত না বাগে আনতে, তাকেই তারা ব্যবহার করল নিজেদের মত করে তার মৃত্যুতে। '৭৫ এর পরেই শুরু হয়েছিল ধর্মের রাষ্ট্রীয়করণ। নজরুলকে মসজিদের পাশে কবর দেয়াটাও হয়তো ছিল সবকিছুকে ধর্মীয়করণ করার প্রথম প্রচেষ্টাগুলোর একটা।

    বর্ধমানের এক অজপাড়াগাঁ থেকে ঝটিকার মত উদয় হয়েছিলেন নজরুল। একা তিনি মৃত্যুর পরও। পাশে তার স্ত্রী নেই, নেই ক্ষণিকের ধন বুলবুলও।

    ধর্মনিরপেক্ষ, সাম্যবাদী, চির-বিদ্রোহী এই কবিকে এখন হাস্যকরভাবে মৌলবাদীরা নিজেদের সম্পদ মনে করে। তাকে বিন্দুমাত্র না পড়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে তাকে আশ্রয় করে, নামে বিষোদগারে। আজন্ম অসাম্প্রদায়িক এক অগ্নিবীণা আজ রাষ্ট্রধর্মওয়ালা একটা দেশের জাতীয় কবি!

    শাহবাগ দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার সময়, তার কবরের দিকে চোখ গেলেই মনে হয়, এখানে শুয়ে আছে হেরে যাওয়া সহস্র স্বপ্ন, যে স্বপ্নে গান, কবিতা, প্রেম আর মানুষ ছিল, সেখানে ধর্মীয় সামাজিক বিভেদ ছিল না, ছিল না কোন কাঁটাতার কিংবা বিজিবি বিএসএস, সে স্বপ্ন আজ মূর্খদের দুর্গন্ধ উপস্থিতিতে পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে।

    ছবিতে মস্তিষ্ক বিকৃতির পর নজরুলের লেখা সেই চার লাইন।

    ছবিসূত্রঃ নজরুল ইসলাম কিশোর জীবনী/ হায়াৎ মামুদ


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক প্রতিক্রিয়া দিন