সালটা ১৮৮৪। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রচার পত্রিকায় প্রকাশিত হলো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ‘ কাঙ্গালিনী।’ কবিতার বিষয় আসন্ন দুর্গোৎসব।রবীন্দ্রনাথ লিখলেন –
” আনন্দময়ীর আগমনে/আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে।”
ঘরের মেয়ে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাপেরবাড়িতে পা রাখলে আনন্দ হয় বৈকি!আর এতো শুধু উমার বাপেরবাড়ি আগমন নয়,তার সাথে সাথে পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং মাতৃপক্ষের শুভ মহরতও বটে।আর বছরের এই একটা সময় বাংলার আকাশ বাতাস যে আনন্দে হিল্লোলিত হবে সে তো জানা কথায়। তবে শুধুই কি আনন্দ?না তা হয়তো নয়।মুদ্রার উল্টোপিঠও নিশ্চয় আছে।দুর্গাপুজোর কয়েকটা দিন যখন আপামর বাঙালি আনন্দে মাতোয়ারা ঠিক তখনই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো সকলের থেকে নিজেদের আড়াল করে রাখে একদল মানুষ।শুধু এখানেই শেষ নয় দুর্গাপুজোর চারটে দিন রীতিমতো শোক পালন করা হয় এই বাংলারই বেশ কিছু অঞ্চলে।
আলিপুরদুয়ারের একটি চা বাগান।পুঁজিবাদী মালিক আর নিষ্পেষিত শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যেকার পার্থক্যটা ভীষণ প্রকট এই সব অঞ্চলে।সকালে সূর্য ওঠার আগেই শুরু হয় এই সব অঞ্চলের চা বাগানের শ্রমিকদের দিন গুজরানের লড়াই।চা পাতা তোলা থেকে তাকে বাণিজ্যের উপযুক্ত করে তোলা সব কাজেই মালিক শ্রেণী প্রচন্ডভাবে নির্ভরশীল এই সব শ্রমিকদের উপরেই।তারপরেও দিন বদল হয় না এদের।একদিকে সংসারের নিত্যদিনের ঘরকন্নার কাজ অন্যদিকে সংসার – সীমান্তে লড়াইয়ের জন্য, দু মুঠো ডাল – ভাতের জন্যই প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যেতে হয় এসব শ্রমিকদের।নিতান্তই নিস্তরঙ্গ জীবন।দুর্গাপুজো যতই কাছে এগিয়ে আসে ততই মন ভারী হয়ে আসে আলিপুরদুয়ারের চা বাগানের এই সব শ্রমিকদের।প্রকৃতপক্ষে এই চা বাগানের শ্রমিকদের পদবী ‘ অসুর।’ ফলে মহিষাসুর তাদের কাছে কখনোই অশুভের ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠেননি,সর্বদাই তিনি পেয়েছেন শহীদের মর্যাদা।নৃতাত্বিক গবেষণায় উঠে আসে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য।এই ‘ অসুর ‘ পদবীর মানুষেরা আসলে অস্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত।এমনকি ১৯৯১ সালের জনগননা থেকে জানা যায় এদের সংখ্যা প্রায় ৪৮৬৪ জন।দুর্গা এদের কাছে কোনো দেবী নন,তিনি পরিচিত তাদের পূর্বপুরুষের হত্যাকারী রূপে।ফলে দুর্গাপুজোর চারটে দিন এখানের মানুষের পরনে ওঠে সাদা থান,শোক পালনের অঙ্গ হিসেবে অনেকের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় অরন্ধন।
তবে শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গের চা বাগান নয়।অসুরের আরাধনা করেন বর্ধমানের আউশগ্রামের বাসিন্দারাও।তাছাড়া শালবনির কুরমি সম্প্রদায়ভুক্ত অধিবাসীদের মধ্যেও প্রচলিত আছে অসুর পুজো। কিছু বছর আগে খাস কলকাতার বুকেও আয়োজন করা হয়েছিল অসুরপুজোর।গড়িয়ার প্রকৃতি সেবাশ্রম সংঘের কর্মকর্তারা ছিলেন এর মূল উদ্যোক্তা।তাদের অনেকেই আগ্রহী অনার্য সভ্যতা নিয়ে।ফলে তারাও মনে করেন অসুর কোনো অশুভ শক্তি নয়,তিনি শহীদ। মায়ের আগমন থেকে অষ্টমীর সন্ধিপুজো সমগ্র বাংলা যখন ঘরের মেয়ের ঘরের ফেরার অনাবিল আনন্দ উদযাপনে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় এই বাংলারই এক কোণে উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত চা বাগান অথবা পুরুলিয়ার রুক্ষ শুষ্ক মাটি মেতে ওঠে অসুর আরাধনায়।দুর্গাপুজো বা অসুরপুজো যায় হোক না কেন বারো মাসে তেরো পার্বণ যে বাঙালির রক্তে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।