এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  সমাজ  শনিবারবেলা

  • পেরিয়েছ দেশ কাল মাটি (২)

    সুকন্যা কর ভৌমিক
    ধারাবাহিক | সমাজ | ০৩ জুলাই ২০২১ | ২৪৮৫ বার পঠিত
  • ডিসেম্বর শুরু - ২০২০

    গাড়ি চালাচ্ছি। বাইরে থেকে খাবার তুলে নিয়ে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ একটা ফোন। ধরলাম। এরপর লাগাতার অনেক ফোন। একটা ধরছি তো পাঁচটা মিস্ হচ্ছে।

    যা শুনলাম - তারপর আর গাড়ি চালাতে পারছিলাম না। সার্ভিস লেনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে কিছুক্ষণ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। সব ফোন থেকে একটিই খবর।

    তিন বছর বিবাহবার্ষিকী আলাদা আলাদা কাটানোর পর অবশেষে ডিসেম্বরে পুরো পরিবার একসঙ্গে। খুব আনন্দ। ছুটি ছুটি ভাব। কিন্তু কোভিডের আতঙ্কও আছে। আবার আমার পরীক্ষাও সামনে। তবে সব মিলিয়ে ভালোই দিন কাটছে। মা-বাবা-মেয়ে - একসঙ্গে বাড়িতে বসে অফিস/ স্কুল/ কলেজ করি। কাজের দিনে বিবাহবার্ষিকীর আলাদা কিছু প্ল্যান করিনি। আর আলাদা সেলিব্রেশন করার মত পরিস্থিতিও নেই।
    আমিই একমাত্র বাড়ি থেকে বেরুই মাঝে মাঝে। অফিসে ঢুঁ মেরে কমিউনিটি যাই, আর টুকটাক বাজারহাট। কাজের শেষে দিনের শেষে তিনজন ফাঁকা লেকের চারদিকে হাঁটার ট্রেল, সাইকেলের রাস্তা। তো, সপ্তাহের শেষে আমরা একটু বাইরের খাবার খাব - সেই ভেবেই বেরিয়েছিলাম। এর মধ্যে ঐ ফোন।

    নভেম্বর মাসের শেষ - ২০২০

    অফিসে কাগজ ঠেলার থেকে কমিউনিটি ভিজিটে আমার আগ্রহ বেশি। নভেম্বরের শেষের দিক। শীত এসে গেছে। বেশ কিছু গরম জামাকাপড় আর কম্বল এসেছে অফিসে। ভাবলাম এই ছুতোয় ঘুরে আসি।
    ওসমানের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি পার্ক করে ডাকলাম। ওর বউ পরী বেরোল।

    আমি ওর প্রতি একটু বেশিই দুর্বল। আমার কাজ শুরুর সময় থেকে জানি। ১৯ বছরের মেয়ে। তিনটি বাচ্চা। বয়স তিন বছর, দু বছর, আট মাস। তৃতীয় বাচ্চা হবার আগের দিনও আমি ওকে রাস্তায় দেখেছি দুহাতে দু’ গ্যালন দুধের বোতল, সঙ্গে আরো কিছু বড় বড় ব্যাগ। এর মধ্যে ডিমের বাক্সও উঁকি দিচ্ছে। সঙ্গে দুই বাচ্চা। পেটে আরেকজন, যে আগামিকাল পৃথিবীর আলো দেখবে (পরে জেনেছি)। আমি ওকে দেখলাম ওর বাড়ি থেকে দেড় মাইল দূরে।

    কী আর করি! নিয়ম না মানার পরিবেশেই বড় হয়েছি। নিয়ম না মেনে চলার স্বাধীনতা পেয়েছি অনেক। এ দেশে এসে অনেক শুধরেছি। তবুও সব পারি কই। আমার মেয়ে আট পেরিয়ে গেছে। তাই গাড়িতে কার সিট্ নেই। কিন্তু ঐটুকু দুই বাচ্চাকে এভাবে তুললে - আর পুলিশ ধরলে - কত ফাইন আর কী যে শাস্তি - আন্দাজ নেই। ফাইন দিতে হবে - এটুকু নিশ্চিত জানি।

    সার্ভিস লেনে আবার গাড়ি দাঁড় করালাম। মা আর দুই বাচ্চাকে তুললাম। ওর গুচ্ছের বাজার ঢোকালাম গাড়িতে। এরপর ভগবান আর আল্লাহ্ পাকের ভরসায় দেড় মাইল রাস্তা ৩/৪ মিনিটে পেরুলাম।
    এই ঘটনা কোভিডের ঠিক আগে। পরদিন বিকেলে একজন জানালো ফোন করে - “পরী আর ওসমানের মেয়ে হয়েছে!”

    তা আট মাস পরে যখন ওদের আ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়ালাম - কোভিডের জন্য অতিরিক্ত সাবধান। পরী বলল “আপু, একটা পান খাইবা না!” গাড়ি থেকে নেমে ওর দরজার সামনে গেলাম। দরজা খোলা। এ কী! এত বাক্স আর প্যাকেট কিসের?

    আমি: এসব কী?
    ওরা: আপু, তিন মাস ভাড়া দিতে পারি নাই। নোটিস দিসে। আর দুই দিনের মধ্যে এই ঘর না ছাড়লে কোর্টে যাইতে হইব।
    - কী সাংঘাতিক! আমাকে জানাওনি কেন?
    - ফোন চুরি হইসে।
    - কীভাবে?
    - পাশের বাড়িতে চার্জে দিসিলাম। অনেক লোক ছিল ওদের ঘরে। কেউ একজন নিয়া গেসে।
    - পাশের বাড়ি কেন চার্জ দিতে গেলে?
    - জর্জিয়া পাওয়ার আর গ্যাসের লাইন কাইট্যা দিসে।
    - সর্বনাশ! কতদিন?
    - আজকে ১৭ দিন।

    আমি কাঁদব না বকব - বুঝতে পারছি না।
    আমি: রান্না করছ কীভাবে?
    ওরা: “পাশের দু তিন বাড়ির লোক মাঝে মাঝে খাবার দিসে।”
    আমি: তার মানে তো রেফ্রিজেরেটরও কাজ করে না। বাচ্চারা কী খায়?

    পরী একট সিগারেট লাইটার দেখাল। বাচ্চার দুধ এনে পাশের বাড়ির রেফ্রিজেরেটরে রেখেছে। এই লাইটার দিয়ে গরম করার চেষ্টা?
    আশেপাশের লোকেরাও নানাভাবে ধুঁকছে। কে কাকে সামলাবে?
    আমি আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলাম না।
    আমি: ওসমান, তোমার আনএম্পলয়মেন্ট তো আমিই ফাইল করলাম। আ্যাপ্রুভ হল। প্রতি সপ্তাহে আমিই আপডেট করি। তোমার আ্যাকাউন্টে তো অনেক টাকা ঢুকছে। এ অবস্থা কী করে হল? তুমি অন্যদের ফোন থেকে আমাকে জানালে না কেন?

    আমি ঐ কমিউনিটিতে বেশ কিছু পরিবারের কেস ম্যানেজার। আর আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে এ দেশের রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর অনেকের কাছেই আমার ফোন নম্বর আছে।

    ওসমান: আপনাকে এত বিরক্ত করতে শরম লাগে। আর আপু, আমার ব্যাঙ্কে কোন টাকা ঢোকে নাই।
    আমি: কী বলছ? সেই এপ্রিল থেকে প্রতি সপ্তাহে টাকা ঢুকছে! আমি সব দেখতে পাই!
    ওসমান: না আপু, আমার কোন টাকা ঢোকে নাই।

    মনে মনে ভাবলাম - সত্যি মিথ্যে পরে ভাবব। এখন যেটা আগে করতে হবে সেটা তো করি!
    আমাদের চেকলিস্ট তৈরিই থাকে, লিজিং অফিসার, এমারজেন্সি অ্যাসিস্ট্যান্স, পাওয়ার, গ্যাস, খাবার দাবার।

    আমাদের মত আরো অর্গানাইজেশন আছে যারা নানারকম প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করে। সবই ছোট ছোট ননপ্রফিট সংস্থা, নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, গ্র্যান্ট ফুরিয়ে যায়, সবার কাছে সব অ্যাপ্রুভাল সব সময় থাকে না। কোন সংস্থা যদি কোন একটা সার্ভিস না দিতে পারে তাহলে আমরা একে অপরের সাহায্য নিয়ে থাকি।

    পরের আঠাশ ঘণ্টায় সব হলো। ওদের লিজিং অফিস খোলে আটটায়। লিজিং ম্যানেজার ঠিক ২৪ ঘণ্টা সময় দিল। আমাদের দু'মাসের বকেয়া ভাড়ার গ্র্যান্ট ছিল, আরেক অফিস থেকে এক মাসের ভাড়া জোগাড় হল। আমাদের পাওয়ারের বিল দেওয়ার বাজেট ছিল। আরেক অফিসকে ধরলাম জর্জিয়া গ্যাসের টাকা দিতে।

    কাছের একটি রেস্টুরেন্ট এই কমিউনিটিতে ভলান্টিয়ার করে। আমরা যেসব পরিবারকে খাবার দিতে বলি - চুপচাপ এসে গরম খাবার রেখে যায়। সেই রেস্টুরেন্টকে জানিয়ে দিলাম পরের কয়েকদিনের খাবার যাতে ব্যবস্থা করে দেয়।

    ২৯ নভেম্বর ২০২০

    তিনজনের কনফারেন্স কল।
    আমি, জর্জিয়া পাওয়ার আর ওসমান। ওসমানের তো ফোন নেই। পাশের বাড়ির আমার আরেক ক্লায়েন্টকে ফোন করে তবে গিয়ে কাজ হল।
    জর্জিয়া পাওয়ার: “Are you giving us the permission to activate your account? “
    আমি ওসমানের ভাষায় ওকে বোঝালাম আর বললাম যে বল “yes”
    ওসমান: “yes”
    জর্জিয়া পাওয়ার: are you giving us the permission to work with this lady to activate your account and share information?
    আমি ওসমানের ভাষায় ওকে বোঝালাম আর বললাম যে বল “yes”
    ওসমান: “yes”
    ১৫ মিনিটের মত কল্ চলল। জর্জিয়া পাওয়ার জানালো কাজ শেষ। এখন লাইন আ্যক্টিভ।
    আমি নিজে যেতে পারিনি, অফিস থেকে পেমেন্ট প্রসেস করতে হচ্ছিল পাশাপাশি।
    দু মিনিট পর আবার ভিডিও কল করে ওসমান আর পরীকে খুঁজলাম। প্রতিবেশী ক্লায়েন্টও আবার দিয়ে গেল ফোন।
    আমি: ওসমান! পরী! দেখাও তো লাইট/ ফ্যান চালিয়ে! আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।
    ওসমান: আপা, এই যে ফ্যান চলতাসে।

    ঠিক এর পাঁচদিন পর সেই ফ্যানেই ওসমান ঝুলছিল।
    ফোনের পর ফোন। "আপু, ওসমান মারা গেসে। ফ্যান থিক্যা ঝুলতাসিল।"

    অক্টোবর প্রথম সপ্তাহ - ২০২০

    বেলা ১টা। অচেনা নম্বর থেকে ফোন।

    “হরেকৃষ্ণ দিদি, ভাল আছেন! আমি স্বপন। নতুন আমেরিকাতে এসেছি। আমি রেফ্যুজি। লালচাঁন দাদা আপনার নম্বর দিল।”
    ও হরি! এতদিনে আদাব, আসসালামআলেইকুম, ইনশাআল্লাহ এসব শব্দে কান অভ্যস্ত। হঠাৎ একেবারে হরেকৃষ্ণ!!

    আমার মোবাইল ২৪ ঘণ্টা বাজে। এদিকে বস্ বলে “ট্রাই টু মেক আ বাউন্ডারি।”

    রাত ৩: ১৫

    “দিদি ভালা আসেন নি! ঘুমাইতাসিলেন নি! বিরক্ত করলাম না তো!”
    কী উত্তর দেব? ঘুম চোখে বললাম “বল আকিব! কী হল এত রাতে! সব ঠিক আছে তো?”
    আকিব: আসে তো দিদি - বালা আসে সব। বউয়ের পায়ে সমস্যা। এখানে ডাক্তার দেখাইতে ডরায়। একটা বাংলাদেশ যাওনের ভিসা কইরা দও না!
    আমি: এর জন্য এই রাতে ফোন?
    আকিব: ভুল হইয়া গেসে দিদি। আর করতাম না।
    ৩/৪ দিন পর আবার রাত দু'টোয় ফোন।
    আমি: কী হল! তোমাকে যে জানালাম আমি ভিসা’র জন্য কী করতে হয় জানিনা! খবর পেলে জানাব। এর জন্য আবার এই রাতে ফোন?
    আকিব: কী করুম। চিন্তায় মাথা আউলাইয়া গেলে আপনের কথা মনে হয়। আপনে তো অনেক কিসু পারেন। এই যে কোভিডের মাঝে কলোরাডো থিক্যা আইলাম, আপনেই তো সব ঠিক কইরা দিলেন।
    আমি: ওসব কাজ আর ভিসা কি এক হল?

    মনে পড়ে আমার দাদুর মা বলতো মাথা ‘আউলাইয়া’ যাওয়া। খুব ছোটবেলায় আমি তাকে "বিলা" বলে ডাকতাম। বাউন্ডারি তোলা হয় না আর।

    যাই হোক, স্বপন, লালচাঁনরা আমার রোহিঙ্গা ক্লায়েন্টদের তুলনায় অনেক চটপটে, শিক্ষিত, তাছাড়া ওরা সিঙ্গল, বাড়িতে কোন মহিলা বা শিশু নেই। ওদের সঙ্গে এত নিয়মিত যোগাযোগ রাখার দরকার হয় না। অনেকদিন আর স্বপনের কথা মনে ছিল না।

    নভেম্বরের শেষ, ২০২০

    তিনজন একটি গাছের নিচে। কোভিড দূরত্ব মেনে।
    পরী, ওসমান আর আমি -ওদের কেস ম্যানেজার ।
    - ওসমান! তোমার সব বকেয়া মেটানো হয়েছে। আরেকটি অর্গানাইজেশন ডিসেম্বর আর জানুয়ারির বাড়ি ভাড়া দেবে। তোমার চাকরির ব্যবস্থাও হতে যাচ্ছে। আইনত তোমায় আমি জোর করতে পারি না। তবে, আমায় যে আপু ডাক, সেই অধিকারে বলছি - কোথায় গেল টাকা? অনেক অনেক টাকা - স্টিমুলাস এর টাকা। ট্যাক্স রিটার্নের টাকা - কী করলে?
    - আপু, আমার ব্যাঙ্কে টাকা ঢোকে নাই।

    অবিশ্বাস করতে মন চায় না। এ দেশটা বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অনেকটাই। কিন্তু কি করে আমি ওর কথা মানব? কিছু কিছু এমন ঘটনা শুনেছি যে একজনের টাকা আরেকজনের আ্যাকাউন্টে ঢুকে গেছে। ওসমান কি এই গোলযোগের শিকার? এদিকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম হওয়াতে DHS অফিসে কাউকে ফোনে পাওয়াই যায় না।
    আমরা সরাসরি কাজ করি DHS এর সঙ্গে। ই-মেল আর ফোনের মাধ্যমে কয়েকজনের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক। ভাবলাম, আমার কাছে তো ওসমানের পুরো ফাইল আছে অফিসে। বাড়ি গিয়ে ই-মেল করব। আপাতত এদের আশ্বস্ত করি আর বুঝিয়ে বলি যে ভয়ের কোন কারণ নেই।

    সব বুঝিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ওসমান দৌড়ে ঘরে গিয়ে আবার বেরিয়ে এল। হাতে ব্যাঙ্কের কার্ড।
    - আপু, এই আমার কার্ড। আর আমার পিন। একটু চেক করবেন?
    - আমি কী করে তোমার কার্ড নেব?
    - কিচ্ছু হইব না আপু। এই সমস্যার সমাধান কইরা দেন। এটিএম অনেক দূরে। আমার তো গাড়ি নাই। কোভিডের জন্য কেউ গাড়িতেও ঢুকাইব না।

    গাড়ির ড্যাসবোর্ডে ওর কার্ড আর ডিসপ্লে স্ক্রিনে স্টিকি নোটে পিন নম্বর লিখে বাড়ি চলে এলাম। এরপর অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে দিন শেষ করলাম। রাতের খাবার শেষ করে সব গুছিয়ে শুতে যাবার প্ল্যান করছি। হঠাৎ মনে পড়ল এটিএম কার্ড আমার গাড়িতে। ভীষণ কৌতুহল হল। বরকে বললাম “চল ঘুরে আসি এটিএম।” ও সমর্থন করে না আমার এই কার্ড নিয়ে আসাটা। কিন্তু আমায় বলে লাভ নেই। আমি অনেক নিয়মভঙ্গের খেলায় নিজেকে জড়াই। আমি কথা শুনি না।

    স্যানিটাইজার স্প্রে করলাম এটিএমের ডিসপ্লে টাচ্ স্ক্রিনে। গ্লাভস্ পরে ওসমানের কার্ড পুরলাম। পিন দিলাম।
    বিশ্বাসের জয় হবে না কি চিরাচরিত দুর্নামের ভাগী হবে ওসমান!
    আমার চোখ বন্ধ। বর হাতে স্লিপ নিয়ে জানাল “অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স তিন ডলার!”
    ডিটেইল ট্রানজাকশন নেই - কারণ দীর্ঘদিন ঐ অ্যাকাউন্টে “কোন টাকা ঢোকে নাই” !
    মনে হল এক্ষুনি ছুটে যাই। কী যে আনন্দ! ওসমান ভুল বলেনি! বিশ্বাস! ফোন করব? ওহ! ওদের তো ফোন নেই। কোন একটা অর্গানাইজেশনকে বলে ফোনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমার অফিস একটি কেসের পেছনে আর খরচ করতে পারবে না। বোর্ডের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।

    ৪ ডিসেম্বর, ২০২০

    ওসমানের প্রতিবেশীকে একটু বেলার দিকে ফোন করে বললাম যে ওসমানের সঙ্গে কথা বলব। ওরা সবাই দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে। প্রায় সবাই চিকেন ফ্যাক্টরিতে নাইট শিফটে কাজ করে। চিকেন ফ্যাক্টরির কাজ আরেক গল্প। সবাই সবদিন কাজ পায় না, কাজ পাওয়ার জন্যে লাইন দিতে হয়। সেই লাইন থেকে কাজ কারা পাবে তা স্থির করার লোককে উপযুক্ত উপঢৌকন দিতে হয়। এ নিয়ে পরে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করবো। যাই হোক, একটু অপেক্ষার পর জানতে পারলাম যে ও বাড়ি নেই। কোথা থেকে “দেশি” মুরগীর ডিম পেয়েছে - পাড়ায় বিলি করতে গেছে। পরীকে পেলাম। জানালাম যে সত্যিই টাকা নেই ব্যাঙ্কে।
    পরী বলল “আপু, হেয় অনেক খুশিতে আসে। দেশি ডিম কিনসে। সব বাচ্চারারে বিলাইতে গেসে। আইলে জানামু।”

    ৫ ডিসেম্বর, ২০২০

    পরী-ওসমানের সবচে’ বড় মেয়ে - যার বয়স ৩ বছর ৭ মাস - ঘুম থেকে ৯টা নাগাদ উঠে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে দেখে বাবা ফ্যান থেকে ঝুলে ওকে ভেলকি দেখাচ্ছে।
    ও বাবার পা ধরে নীচে নামতে বলছিল। ওর খিদে পেয়েছে। পরী দুই বাচ্চা নিয়ে তখনো ঘুমে। বাবা দুধ দিতে ফ্যান থেকে নামছে না দেখে ওপরে গিয়ে মা’কে বলছে আর ছোট ভাইকে ডেকে তুলছে ঘুম থেকে “নীচে আয়! বাবা মজার খেলা দেখাচ্ছে।” আট মাসের বোন খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত হল।

    বাচ্চার কথাগুলো পরীর মুখ থেকে পরে শুনেছি। পরী নীচে নেমে এসে ঐ খেলা দেখে প্রতিবেশীদের চিৎকার করে ডেকে আনে। প্রতিবেশীরা ৯১১ ডাকে। পরী শুধু বাংলা আপুরে ডাকে। একটি লাইন সবাইকে বলে গেছে “বাংলা আপুরে ডাক।” সেই বাংলা আপুরে ডাকতেই কমিউনিটি থেকে অসংখ্য ফোন গেছে। বাংলা আপু তখন রেস্টুরেন্টের খাবার নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। ড্যাশ বোর্ডে পরীর বরের এটিএম কার্ড। ডিসপ্লে স্ক্রিনে স্টিকি নোটে পিন।

    সামাজিক নিকটজনের মৃত্যুতে মানুষ সামাজিক পরিসরে সান্ত্বনা খোঁজে, পায়। এরা কি আমার নিকটজন? একটা ফাইল, একটা কেস বই তো নয়। অফিস থেকে দু'মাসের জন্যে আমার কাউন্সেলিংয়ের বুকিং করা হল। এই কাউন্সেলররা কেস ম্যানেজারদের কেস হ্যান্ডল করতে প্রশিক্ষিত।

    ৬ ডিসেম্বর, ২০২০

    ভোর বেলা ছুটে যাই পরীর কাছে। অন্য এক বাড়ি পরীকে আশ্রয় দিয়েছে। ওদের কন্ডো আ্যাপার্টমেন্ট পুলিশ সিল করে দিয়েছে। অন্যের বাড়ির সামনের বাগানের চেয়ারে বসি। একটু দূরে পরী। আমার মেয়ের জামা পরে বসে আছে পরী। আমার মেয়ে তখন ১০ - পরী ১৯। স্বাস্হ্য প্রায় এক। লম্বায়ও প্রায় এক।

    দুই বাচ্চা খালি পায়ে খেলছে ডিসেম্বর মাসের ঠান্ডায়। কোলের বাচ্চা একটা টেবিলে বসে।
    - ওসমান কিছু বলে গেছে তোমায়?
    - না আপু।
    - কোন চিঠি?
    - না আপু। আমরা তো পড়া লেখা জানি না।
    - কোন ফোনের রেকর্ড?
    - না আপু। আমাদের তো ফোন নাই।

    আমার ধৈর্য হারাতে লাগল।
    - কেন করল ওসমান এরকম?
    - আমি জানিনা আপু।
    - তুমি বলেছিলে ওকে যে ওর অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকেনি?
    - কইসিলাম আপু।
    - আমি তো তোমাদের বুঝিয়ে বলেছিলাম যে চিন্তার কোন কারণ নেই? বলিনি? আগামী দুই মাসের সব খরচের ব্যবস্থা করে রেখেছি তো! বলিনি তোমাদের? বলেছিলাম তো!
    - হ। কইসিলা। হেয় ও তো খুশিই আসিল। কী জানি! মাথা আউলাইয়া গেসিল মনে হয়।

    আমার মাথাও আউলাইয়া যায়। আমার বিলার কথা মনে হয়।

    তিন দিনের মাথায় ওসমানের গোর দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। ৫০০০ ডলার খরচ। চাঁদা আসে, গ্র্যান্ট আসে, স্থানীয় মসজিদ থেকে সহায়তা আসে, ইমাম আসেন।

    আমার কাউন্সেলর অনেক চেষ্টা করে ওসমানের পরিণতির ব্যাখ্যা দিতে। আমার পোষায় না। বলে ওসমান ডিপ্রসনের শিকার ছিল। আমার রাগ হয়ে যায়, ওকে না দেখে, ওর সঙ্গে কথা না বলে কেমন করে এটা বলতে পারে অ্যাডেলিয়া? আমার পরীর সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে হয় ভীষণ, ভাবি খুঁজে বের করি এতসব ব্যবস্থার পর কেন ওসমান এই পথে গেল? ওর সঙ্গে কি সুশান্ত সিং রাজপুতের দেখা হবে? আমার এত পরিশ্রম নষ্ট করে দিল ওসমান?

    কী হয়েছিল ওসমানের? কে জানে। বাতাসে অনেক কথা ভাসে। অ্যাডেলিয়া বলে ডিপ্রেসন, কেউ বলে স্থানীয় জুয়া/ড্রাগ মাফিয়াদের কাছে টাকা ধার করে ফেলেছিল, কেউ পরীর দিকে গোপনে আঙুল তোলে - এদেশে আসার আগে রিফিউজি ক্যাম্পে কিছু অন্ধকার অতীতের কথা বলে।

    অফিস থেকে আমায় ছুটি দেওয়া হয়। কড়া নির্দেশ। কমিউনিটি যেতে পারব না। আমার অবস্থা খুব খারাপ হতে থাকে।


    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৩ জুলাই ২০২১ | ২৪৮৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | 14.139.196.12 | ০৩ জুলাই ২০২১ ১০:৩৪495555
  • এ এক অসম্ভব দলিল। 

  • | ০৩ জুলাই ২০২১ ১০:৪০495556
  • উফফ মাগো! 

  • ইন্দ্রাণী | ০৩ জুলাই ২০২১ ১১:১১495557
  • নো ফ্রেন্ড বাট দ্য মাউন্টেনস - রাইটিং ফ্রম ম্যানাস প্রিজন মনে পড়ছে-
    "Death is death / Plain and simple / Absurd and sudden / Exactly like birth.”

    দলিল তো বটেই। তার বাইরে আরো বড় কিছু পেতে চলেছি সম্ভবত।
    অপেক্ষায় ...

  • Tim | 2603:6011:6506:4600:f40a:523a:1622:1c85 | ০৩ জুলাই ২০২১ ১১:১৫495558
  • পড়ছি। সামনে বসে প্রথমবার শুনে যেরকম অবিশ্বাস্য লেগেছিল, ছাপার অক্ষরে পড়েও সেরকমই লাগছে। 

  • শক্তি দত্ত রায় | ০৩ জুলাই ২০২১ ১১:৩৫495560
  • অভাবনীয় বাস্তবতার দলিল।যাদের কথা এতদিন বিশেষ জানতামই না তারা ভাবাচ্ছে।এ এক অন‍্যরকম কলম

  • তন্বী হালদার | 110.225.5.192 | ০৩ জুলাই ২০২১ ১৭:১৫495569
  • পুরোটাই দম বন্ধ করে পড়ে ফেললাম

  • স্বাতী রায় | ০৩ জুলাই ২০২১ ১৭:২৬495570
  • আনএমপ্লয়মেন্ট এর টাকা কেন আসে নি তার কোন এনকোয়ারি হল ? 

  • চৈতালি | 2402:3a80:1f0c:8527:1325:c79:9d9c:fc36 | ০৩ জুলাই ২০২১ ১৯:১২495575
  • এমন কর্মীদের কথা জেনে আপ্লুত হই  l পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম l

  • Somenath Guha | ০৩ জুলাই ২০২১ ২০:৫৯495579
  • রোহিঙ্গারা কি তাহলে বেসিকালী বাঙালি? এর সঙ্গে আরাকানের রক্তও আছে? 

  • Ranjan Roy | ০৩ জুলাই ২০২১ ২১:০১495580
  • কী বলব! আমি যে সুকন্যা ও তার বরকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি! একী অভিজ্ঞতা!!

  • Sukanya Kar Bhowmik | ০৩ জুলাই ২০২১ ২২:১৪495583
  • @স্বাতী রায় - এই ঘটনার পর পুরো কেস ফাইল হয়ে পুলিশের হাতে। আমি পুলিশ/ অন্যান্য বিভাগে যা যা জানাবার জানিয়েছি।  এর তদন্ত করার অধিকার আমাদের নেই। আর  ওই পরিবারের রিসেটেলমেন্ট এজেন্সী করবে সব আইনী কাজ। তিন /চারটে অর্গানাইজেশন মিলে ওর স্ত্রী'র ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে। এছাড়া ও কিছু সরকারী সাহায্য পায়। ওদের জন্য সমস্যা হল যে হাতে টাকা আসে না। টাকা চায় সবাই। আর সরকারের কথা হল  যে,কাজ কর। রোজগার যদি না থাকে/ একটা নির্দিষ্ট মাত্রার নীচে হয় তবে তুমি  X Y  Z সুবিধা পাবে। কিন্তু সবই কার্ডের মাধ্যমে। রোজগার নেই/ কম থাকলে তুমি মেডিকেড/ফুড ষ্ট্যাম্প ইত্যাদি পেতে পার কিন্তু হাতে টাকা দেওয়া হয় না। এত সুন্দর ব্যবস্হা। কিন্তু কম্যুনিটি খুশী হয় না। আমাদের মত আরো যত অরিগানাইজেশন আছে - আমরা কেউ টাকা সরাসরি দিই না । খুব ছোট অঙ্কের গিফ্ট কার্ড হয় মাঝে মাঝে। এতেও control থাকে। কোন রকম মাদক দ্রব্য/ জামাকাপড় কেনা যায় না । শুধু খাবার আর পড়াশুনা সংক্রান্ত জিনিসই ঐ কার্ড একসেপ্ট করে।

  • aranya | 2601:84:4600:5410:21aa:e3b9:62ad:37e1 | ০৫ জুলাই ২০২১ ০৩:৩১495615
  • অসাধারণ 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন