এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  পুজো ২০১০

  • টিয়ামন্ত্র

    মাজুল হাসান
    ইস্পেশাল | পুজো ২০১০ | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৫৭৩ বার পঠিত


  • ক.

    সুগোল জাম্বুরা আর বিড়াল-বেলুনের সমার্থক ছিল দূর্গাবিষর্জন। আমার ইচ্ছে ছিল এই বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা বলবার। কিন্তু আমার ছোট বোন, আমার পিঠেপিঠি টুনটুনি বোন এসে হাজির হয়। তাকে নিয়েও গল্প বলা যেতে পারে। কারণ, সে ভেবেছিল, ঈশ্বর হয়তো বাবার মতো মানুষ অথবা বাবাই ঈশ্বর। আশলে সেসময় এক-দুই-তিন করে ডিকবাজি দিচ্ছিল শৈশব। তাই আমি, আমার বন্ধু নুরুজ্জামান, ইউনুস কনটেকাটারের ছোট ছেলে জহুর তখন সবাই মিলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠিরে মার্তিল-মার্তিল। জহুর অথবা কে যেন বলে ওঠে, "চেলেঞ্জ!"
    - অই গুলিটাকে লাগাইতে পারবি? পারবি না।
    - তুই কি হাফিজ চাচার মতো বড় যে পারবি?
    - বলতো দেশের সবচে বড় মানুষ কে?
    আমি বলি "হাফিজ চাচা"। অন্যসময় সবাই সেটাই বলে। কারণ, আমরা সবাই জানি হাফিজ চাচার মতো লম্বা মানুষ পুরো নিউটাউনে আর একটিও নেই। কিন্তু সেদিন নুরুজ্জামান বলেছিল ভিন্ন কথা, বলেছিল-এরশাদ, পেসিডেন্ট।
    তার কথাতে যুক্তি ছিল। আশলে আমি মেনে নেওয়া পক্ষে ছিলাম। তারপর আমার চুই-গুল্লি নিয়ে চম্পট দেয় কেউ। হয়তো আমারই সুহৃদ, বন্ধুজন! তবুও জহুর বলে, নুরুজ্জামান বলে-মাইরি আমি তোর চুই নেই নি।
    মাইরি কেটে মিথ্যে বলা যায় না, সেটা আমাকে শিখিয়েছিল জহুর-নুরুজ্জামান। সেদিন সেই বিশ্বাস ভাঙে। ততোদিনে আমসুপারি টিফিনে আমার আস্তা টাকা বদল হয়ে গেছে জহুরের সাথে। আস্তা টাকার বিনিময়ে আমি পেয়েছিলাম একটা সিকি আর দুইটা দশপাই। তারপর যা হবার তাই, দোকানি আর দশটা সন্দেশ দেয়নি কোনদিন।

    খ.

    হাসুবুড়ার পুকুর, ডুমুরপাড়া ভাটাপুকুর পেরুলেই পরীরাজ্য পুলহাট। চিঠি এসেছে বারবার। পুলহাটের আকাশ দিয়ে চলে যায় চাটায়াল গুড্ডির উড়াল। প্যাক গুড্ডি ধরবে বলে পেছন পেছন বাছুর পালায়। তার সাথে মাঞ্জা কাটা সুতোয় উড়ে-উড়ে উড়ে গেলেও আমার ছিল লক্ষণরেখা। বাবার কড়া শাসনের দুপুর। তারপরেও একটা দিন দুপুরে জলপাই দীঘিতে চোখে-চোখে ভর করে লালপদ্ম। সাতালপাড়ার খেড়-পূজার বান খাওয়া খামালটার চোখ যেন আরো লাল হয়ে ওঠে! জানা হয় না, বাবার চোখ কি করে নিমিশেই খেয়াল বদলায়? তেমনি জানা হয না, লোডশেডিংয়ের সন্ধায়-নাজুপাঞ্চর কালো তিল কেনো যে এতো পিদিমজ্বলা জ্বলে! সেই তিলের কাছে তিশিক্ষেত হয়ে বসে থাকে অবাক-করা ফুল।
    রাস্তায় ডাক দিয়ে যায় ভদু পাগলা
    -পাখি লাগবো পাখি, একখান বনটিয়া? মুনমুনিয়া পাখি?
    আমার একটা বনটিয়া পোষার ইচ্ছে ছিল, দ্বিতীয় শ্রেনী থেকে কড়া রোদ অবধি। পাখিওলা শুধায়, খাওয়া দিতে পারবা নি?
    -কি খায় তোমার টিয়া?
    -খায় তো অনেক কিছু, কিন্তু বেশি লাইক করে, পাকা মরিচ। টকটকা পাকা মরিচ!
    আমি অবাক হই নাজুপাঞ্চ কি করে ঠোটে এমন লাল রং চাপল?
    আমি বলি-ও টিয়া, টিয়া, কোথায় ছিলা এতোদিন? টিয়া কিছু বলে না। বলি না, আমিও। তাই দেখে সেদিনই বাবার কন্ঠে ডেকে ওঠে ঈস্রাফিলের শিঙার ডংকার। বাবা বলে-কৈ গেছিলি? বল জবাব দে। শত মারেও সত্য বলি না। আমি বলি, সাইদের সাথে ৮ নম্বরে খেলতে গেছিলাম। এখানেই তো ছিলাম, বাবু ভাইদেও বাড়ি। এভাবে অনেকদিন পরে খেয়াল হয়, আমিও মিথ্যে বলতে শিখে গেছি। আমারও মনে হয়-সব সময় মিথ্যে বলাটা খারাপ কিছু না। মাঝে মাঝে বলা যেতে পারে। গীতায় যেমনটা বলা হয়েছিল, অপ্রিয় সত্য বলো না, সেই রকম। তাই বাবা শুধালে বলি-ছিলাম ওখানে, ছিলাম সেখানে। আশলে তখনো আমি মিকাইলের জল-মেঘের মতো সরল। জলও একদিন জেনে যায় অবস্থা ভেদে আকার-আকৃতি বদলানোর জরুরী কৌশল।

    গ.

    এমনিভাবে বহুগুলো ভাসানের মেলা, অনেকগুলো ঈদগাহঞ্চর মাঠ এসে চলে যায়। ছোটবেলা হলে ভাবতাম, একটা কানিবুড়ি দিনগুলোকে তার ঝলার মধ্যে পুরে নিয়ে কাহারোলের জঙ্গলে চলে গেছে। কি অবাক রকমের শৈবব! শৈশব হয়তো একই রকম থাকে। এই যে আমার অনাগত মেয়ে তার আগত দাদার সাথে খুঁনসুটি করছে। তার দাঁড়ি ধরে ঝুলছে, জামার পকেটে কেঁচো কিংবা ঘুঘরী-পোকা ঢুকিয়ে রাখছে। বাবা তাই দেখে চমকে যায়। বলবে, কে করছে এই কাজ? তুমি? তুমি?
    আমি জানি না বিষয়গুলো ঠিক কেমন? মেয়ে বলেছিল কি?
    - আমি না, আমি না।
    তারপর সে হাসবে। হিহিহিহি। কাল আজ হবে। আজ কাল হয়। তাই আজ এতোদিন পর অথবা এতোদিন আগেই সান্ধ্য-খিড়কি পথে বাবা আমার মেয়েকে শেখাচ্ছেন টিয়েপাখির পাঠ :
    - মিথ্যে বলো না টুনি...নাইলে আল্লা ঠোট কেটে নেবে।
    মেয়েও আদুরী। মাথা ঝাকাচ্ছে। সত্যি তাই? মেয়ে বারবার অবাক হয়
    - ঠোট কেটে নিবে?
    - হে কুচুৎ করে কেটে নেবে!
    তখন হয়তো মেয়ে বলে-"বাবা, দাদু কি বলতে জানো"? আর আমি দেখি, ছোট ছোট পায়ে কি মমতার টান! বাড়িয়ে দেয়া হাত। আহারে... মেয়ে, কেনো বড় হবি? কেনো বড় হবি? এরকম একবার বাবার কথা শুনে আমি বলেছিলাম-ফালতু কথা। ফালতু কথা। বাবা বলে-না মোটেই না, তুমি এর হাতেনাতে ফল পাবে। আমি তোমাকে তাই দন্ড দিচ্ছি। তখন পাশে আমার বোন তাকিয়ে ছিল বিড়াল-বিড়াল চোখে অথবা সে একদিন তাকিয়ে থাকবে। তার পাশে আমার মেয়ে। ঠিক তখনই, আমি সত্যি সত্যি একটা ঠোটকাটা টিয়ে পাখি হয়ে যাব। ফলে আমি চেচাই—দেখো আমরা একটা ঠোটকাটা টিয়ে পাখি হয়ে গেছি। দেখো... দেখো। কিন্তু আমার কথা কেউ শুনে পাবে না।
    বাবা, মা, আমার বোন, জহুর, নুরুজ্জামান, অথবা তিশিফুল নাজুপা ওরা কি ছল করেনি কখনো? আমি তো জানতাম, তারা আমার চেয়ে কোনো অংশে কম ছল করবে না। কিন্তু আপনারা জেনে নিন, তারা কেউ দন্ডিত হয়নি। কারণ, তাদের সবার ঠোট অক্ষত থাকবে। কেবল আমিই একটা ঠোটকাটা টিয়ে পাখি হয়ে গেছিলাম। হয়তো গতকাল হয়ে যাওয়া আগামীকালে। আজ তাই আমি লেজ নাড়াচ্ছি অথবা আপনারা টের পাবেন না। হয়তো তিন তীথি আগেই তেমনটি হয়ে গেছে, আমি সেঁধিয়ে গেছিলাম ফণিমনষা-সন্ধার আরো দূরতম কোনো অজ্ঞাত কোটরে অথবা আজ থেকে তিন তীথি পরে তেমনটা ঘটবে। তেমনটি ঘটবেই। লেজ নাড়িয়ে আমাকে পালিয়ে যেতেই হবে উঠোনের তারা-ধরা আমলকির ডালে। আমাকে যেতেই হবে। পাছে আমার মেয়ে যদি আমাকেই ঈশ্বর ভেবে বসে!

    ছবি- সায়ন করভৌমিক
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ০১ অক্টোবর ২০১০ | ৫৭৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন