এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বিপ্লবের অবৈধ সন্তানেরাঃ স্মৃতির জলছবি 

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩১ অক্টোবর ২০২০ | ১৮৬৭ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • [ আমার মনের ভেতরে কোন সিসিটিভি ক্যামেরা নেই, এমনকি ২৪ কেন ১২ পিক্সেলে তোলা ছবিও নেই। ষাট সত্তরের দশকে ওসবের অস্তিত্ব আমাদের চেতনায় থাকার কথা নয়। আছে কিছু জলছবি, সময়ের ছোঁয়ায় বিবর্ণ, ধুসর। কিছু ডাকটিকিটও আছে, বিশিষ্ট ঘটনার, তেমনই অল্প কিছু ফার্স্ট ডে কভার। তাই গরহাজির কোন পূর্বাপর শৃংখলা। অতএব এর কোন ইতিহাস (ওর‍্যাল বা লেখা) হবার দায় নেই , দিনপঞ্জী বলাও ভুল। বড়জোর স্মৃতির অ্যালবামে গঁদ দিয়ে সাঁটা সেকালের বক্স ক্যামেরায় তোলা সাদা-কালো ছবি এর যথার্থ পরিচয়। হ্যাঁ, নামধাম এবং স্থান-কাল-পাত্র সামান্য বদলে দেওয়া।]

    (১) চিরিমিরির পাহাড়ে, মেঘ জমেছে আহারে!

    চিরিমিরি? কোন জায়গার নামে এমন দাঁত কিড়িমিড়ি ? নামটা কোলকাতায় প্রথম কোথায় শুনেছিলাম?

    ও হ্যাঁ, মনে পড়ছে । বার্ষিক শিশুসাথীতে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি হাসির গল্পে একটি গানের জলসার বর্ণনায় - “এখন তবলা সঙ্গত করবেন চিরিমিরি-খ্যাত তবলচি বোঁচকারাম”।

    তা হিন্দিবলয়ের জায়গার ও লোকজনের নাম যেমন বজরং বা হনুমান সিং, অনেকসময় বঙ্গভুমে হাসির খোরাক জুগিয়েছে। হিন্দিবলয়ে এর বিপরীত – ‘আমি তোমাকে কেতো ভালবাশি!’

    তারপর সত্তরের দশকে চিরিমিরির বিখ্যাত লাহিড়ি পরিবারের পরমভট্টারক লাহিড়ি কোলকাতায় খুললেন — ‘ব্লুবেল পাবলিশার্স’। শুরু হল জেমস হেডলি চেসের থ্রিলারগুলোর বাঙলা অনুবাদ, একের পর এক। দেশ পত্রিকার বিজ্ঞাপনে প্রথম বইটার নামই ধমাকেদার — “শকুনের চোখে পলক পড়ে না”। এর পর এল লীলা মজুমদারের কলমে মডেস্টি ব্লেজের মুচমুচে অনুবাদ।

    হ্যাঁ, দাদু বিভূতিভূষণ লাহিড়ি চিরিমিরিতে কয়লাখনির মালিক হয়ে গড়ে তুলেছিলেন বাঙালী উপনিবেশ। লাহিড়ি ডিগ্রি কলেজ, বাঙলা নাটকের দল, কালীবাড়ি। ওঁর পরিবারের জনৈক অধ্যাপক লাহিড়ির শেক্সপীয়রের নাটকের উপর নোটসগুলোর নাম ছত্তিসগড়ের সমস্ত কলেজের ইংরেজি বিভাগের মুখে মুখে।

    সে না হয় হল, এখন আমি হাঁটছি চিরিমিরির কুরেশিয়া হিল টিলার উপরে কুলিধাওড়ার অলিগলিতে, সন্ধ্যের আলোআঁধারিতে পথ হারিয়ে ফেলেছি।

    ১৯৭১ এর বর্ষাকাল। চারপাশের জঙ্গল সাফ করে বসানো ওই কুলিধাওড়ার চারদিকে শালের বন। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। নীচু নীচু খুপরিমত ঘর, দেয়ালগুলো কাঠের প্ল্যাংক বা পটিয়ার গায়ে পেরেক পুঁতে তৈরি। ছাতে টালির ছোটভাই খাপরা বসানো। মাথা নীচু করে শেকল নামিয়ে ঢুকতে হয় । দশ বাই ছয়ের একচিলতে কামরা। সোজা হয়ে দাঁড়ালে মাথায় ছাত ঠেকে যায়। মেজেটা কাঁচা, মাটির। একটি টেমি বা কুপি জ্বলে।

    মাঝে মাঝে ঝেঁপে বৃষ্টি আসছে। তখন একটা শাল বা মহুয়া গাছের নীচে দাঁড়াই দুজনে। খানিকক্ষণের মধ্যেই ঝুপ্পুস ভিজে হি হি করে কাঁপছি। কিন্তু সব গুলো মহল্লা সব গলি একইরকম দেখতে।ুসব গাছগুলোও তাই। একটু পরে বুঝতে পারি আমরা গোল গোল ঘুরছি। কোন ঘরে গিয়ে দরজা ঠেলে কিছু জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। সিকিউরিটি রিস্ক। সকালে সুদীপ আসবে বাঙালি পাড়া পোনরি হিল থেকে। কিন্তু আমার শ্বাস ফুলছে—হাঁপানির টান? ঘরে কিট ব্যাগের মধ্যে ট্যাবলেট আছে। মাত্র তিন সপ্তাহ এখানে এসেছি। কিছুই চিনি না। ঘরটা খুঁজে পেতে হবে।

    যাই হোক, ছোটভাই দিনের বেলায় বেরোত, ওই খুঁজে পেল। ধড়ে প্রাণ এল। তালা খুলে মাথা নীচু করে ঢুকে টেমি জ্বালালাম।

    এককোণায় কয়লার উনুন, পাশে খবরের কাগজ বিছিয়ে শুকনো আলু, পেঁয়াজ, এক শিশি তেল নুন হলুদ, দুটো কৌটোয় চাল এবং চিনি, চটের ঝোলায় আটার প্যাকেট। এক পাশে চায়ের ছোট প্যাকেট, দুটো সস্প্যান, একটা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি দুটো হাতা ও চামচ, তরকারি কাটার ছুরি। এদেশে বঁটির ব্যবহার নেই বললেই হয়।

    উনুনের সামনে মেজের মাটি খুঁড়ে তিন ইঞ্চি গভীর দু’ইঞ্চি চওড়া নালি, সোজা দরজার ফ্রেমের নীচ দিয়ে গলে বাইরে বেরিয়ে গেছে। এই নালাতেই বাসনকোসন চালডাল বা সবজি ধুয়ে ঢালা হয়, ফ্যান গলানো হয়। রাত্তিরে সাপের ভয়ে ওই ফাঁকফোকর কাগজ দিয়ে ঠেসে বন্ধ করে দিই।

    ভাই উনুন ধরিয়ে গরম চা বানিয়ে তরকারি কেটে সসপ্যানে বসিয়ে চালের কাঁকর বাছতে বসল। তারপর বলল চাল একটু কম পড়বে, ও চারটে হাতরুটি বানাবে, থালার উপর কাঁচের গ্লাস দিয়ে বেলে নেবে।

    পেরেক থেকে এপার ওপার একটা দড়ি, তাতে তিন চারটে হ্যাঙারে ঝুলছে টেরিকটের তিনজোড়া জামাপ্যান্ট, কিন্তু সেগুলোর গায়ে পুরনো খবরের কাগজের জ্যাকেট পরানো বেশ কায়দা করে। জামাকাপড়্ যোগী’দার। যোগেন্দ্রভূষণ রায়। নকশালদের এম-এল নামের বৃহৎ দলটির ছত্তিশগড় অঞ্চলের নেতা । বিলাসপুরের ডঃ পূর্ণেন্দু ঘোষ বা ডাক্তারদা (তেভাগা আন্দোলনের সময় কাকদ্বীপ এলাকার রাঙা ডাক্তার বা লাল ডাক্তার) এবং অন্যরা সব ধরা পড়ে জবলপুরের সেন্ট্রাল জেলে বন্দী, সবার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। যোগীদার পেছনে পুলিশের হুলিয়া। পুলিশের খাতায় যোগীদার অনেক নাম – জে বি রায়, যোগী রায়, যোগেন রায়, জগভূষণ রায়।

    রান্না করতে করতে ওর গল্প শুরু হয়।

    গতবছর ভাটাপাড়ার কাছে গুটুরিয়া গ্রামে এক জোতদারকে মারার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। বিলাসপুর, রায়পুর, ভিলাই। রেকটাম-রাইপ ছোটভাই, তখনও স্কুলের গন্ডি পেরোয়নি, ধরা পড়ল দুর্গ শহরের স্টেশন থেকে একটু দূরে কসারিডি পাড়ায়, আরেক রেকটাম-রাইপ সমবয়সী ছেলের সঙ্গে। সে কবিতা লিখত – দুর্বল অর্জুন, সবল বনো!

    হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা (তখন ক্লাস ইলেভেন) না দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা ওই দুই স্যাঙাৎ সেখানে পেটি কন্ট্রাক্টর পরিচয়ে একটা মাথা গোঁজার কামরা যোগাড় করেছিল। নিজেরা হাত পুড়িয়ে ভাতে ভাত রেঁধে খেত। চারপাশে বস্তিবাড়ির ঘরের মেয়েরা কৌতূহলের চোখে দেখত নতুন গোঁফের রেখা বেরোন ছোকরা পড়শিদের।

    ছত্তিশগড় অঞ্চলের মেয়েরা খেটে খায়, এবং অপেক্ষাকৃত স্বাধীনচেতা। কাছের পুকুর থেকে কলসি ভরে জল আনার পথে কেউ কেউ আলাপ জমানোর চেষ্টা করত। ঘরে উঁকি মেরে দেখত ওরা কীভাবে রাঁধে বাড়ে। দরকার হলে মশলা বেটে দেবে বা কোন একটা পদ রেঁধে পাঠিয়ে দেবে এমন ইচ্ছে। কিন্তু এই দুটো ছোঁড়া একেবারে আনন্দমঠের সন্ন্যাসী। যোগীদার নির্দেশ – এই সব আধাগ্রাম আধা শহর এলাকায় মেয়েদের সঙ্গে আলাপ জমাবে না। ওসব হবে গাঁয়ে যাওয়ার পরে। সেখানে জলের মধ্যে মাছের মত থাকতে হয়, একেবারে মিলেমিশে। এখানে অল্পদিন, তাই সুরক্ষার কারণেই ঘাপটি মেরে থাকা । ফলে পাড়ার মেয়েদের মধ্যে কথা ছড়িয়ে গেল যে এই দুটো ছোকরা একেবারে অন্যরকম—একদম ল্যাঙট কে পাক্কে! হুঁ হুঁ বাবা! এদের ল্যাঙট কষে বাঁধা।

    এইসব খবর ওদের এনে দিয়েছিল বি ডি থাপা। দুর্গ শহরের কাছে একটি আধা মিলিটারি ছাঊনির ল্যান্স নায়েক। ও নাকি ষাটের দশকের কোন এশিয়ান গেমসে – জাকার্তা নাকি টোকিওতে
    — বক্সিঙয়ে ফ্লাই ওয়েট গ্রুপে রূপো জিতেছিল। মাঝবয়েসি থাপা রোজ সকালে চলেও আসত এদের সঙ্গে লাল চা খেতে এবং আড্ডা মারতে। এরা বিড়ি খেত, থাপা মাঝে মাঝে সিগ্রেট খাওয়াত — চারমিনার। বলত ও নাকি কোলকাতা ইউনির গ্র্যাজুয়েট, পাসকোর্সে, হবেও বা। বলত ওর হিন্দি দুর্বল, কিন্তু ইংরেজি দারুণ। ওর ভাষায় – আই ক্যান নট ইস্পীক হিন্দি, পর আংরেজি কা তো টাঙ হি তোড় দেতা হুঁ!

    হিন্দিটা ভাল বলতে পারিনে, কিন্তু ইংরেজির তো একেবারে ঠ্যাঙ ভেঙে দিই। দুই শ্রীমান হাসে। থাপা দিলদরিয়া মানুষ। গোটা ভারত ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে বাচ্চাগুলোকে রঙবেরঙের অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনায়, তার বেশিরভাগই নারীঘটিত।

    আস্তানায় মাঝে মাঝে হাজির হত কমরেড মূর্তি, যোগীদার ভাষায় পাক্কা গেরিলা। অন্ধ্রের শ্রীকাকুলামের পাহাড়ী এলাকায় কবি ও নাট্যকার ডঃ সুব্বারাও পাণিগ্রাহীর ‘জমুমুনিকুল কথা’ লোকনাট্যের দলে ছিল। ১৯৭০ এর প্রথম দিকে এনকাউন্টারে সুব্বারাও এবং নির্মলা ও পঞ্চাদ্রি কৃষ্ণমূর্তি শহীদ হলে মূর্তি পালায় বস্তার হয়ে ছত্তিশগড়ে। বর্ডারে ধরা পড়েছিল, কিন্তু পাগলের অভিনয় করে ছাড়া পেয়ে ও এবং শিউনারায়ণ বলে সতের বছরের ছেলেটি ভিলাই এসে মৈত্রীবাগে মালীর কাজ বাগায়।

    মূর্তি কাকভোরে এদের দু’জনকে ঠেলা মেরে ঘুম থেকে তুলে দিত।

    -- উঠো, কমরেড উঠো! ইতনা সোতে রহোগে তো ক্যায়সে ক্রান্তি করোগে?

    এত ঘুমুলে বিপ্লব করবে কেমন করে?

    একজন ঘুমকাতুরে চোখে বিড়বিড় করে – শালা! বিপ্লব যেন ঘোড়ায় চড়ে এসে গেছে।

    নিমের দাঁতন করে মুখ ধুয়ে মাটির ছোট্ট উনুনে চায়ের জল চড়ায়। ওদিকে মূর্তি কাছের ছোট ডোবা থেকে চানটান সেরে চাড্ডি বানিয়ান ধুয়ে দরজার কপাটের উপর মেলে দিয়েছে। নিজে একটা ধুতি পরে শতরঞ্চিতে আসনপিঁড়ি হয়ে খুলে বসেছে লাল রেক্সিনে মলাট দেয়া একটি ছোট পকেট ডায়েরি মত — মাওয়ের রেডবুক, হিন্দি সংস্করণ। ওদের দুজনেরও রেহাই নেই। তবে ওদের হাতে ইংরেজিতে। একটা চ্যাপটার খোলা হয় – অপোজ লিবারেলিজম! উদারনীতিবাদ কা বিরোধ করেঁ!

    আধঘন্টা পরে সাব্যস্ত হয় মাও যে দশরকমের উদারনীতিবাদের বিরোধিতা করে সাথীদের এর ছোঁয়াচ থেকে সতর্ক করেছিলেন, ওদের মধ্যে তার অন্ততঃ আটটা বিরাজমান। ওরা হতাশ হয়, বিড়ি ধরায়। মূর্তি রান্নাতে হাত লাগায়। একগাদা লাল লঙ্কা দেয় । ওরা আপত্তি করলে ও গর্বের সঙ্গে জানায় — বিপ্লবী হতে গেলে লাল লংকা খাওয়া অভ্যেস করতে হবে।

    কিন্তু এত করেও শেষ রক্ষা হলনা। চারমাস মাত্র পুরো হয়েছে, এবার অন্য জেলার পাহাড়ি এলাকায় বেস এরিয়ায় যেতে হবে। বাড়িওলাকে শেষ ভাড়া দেয়া হয়ে গেছে। এমন সময় সাত সকালে দু’গাড়ি পুলিশ ওদের ঠেক ঘিরে ফেলল।

    সার্চ করার আছেই বা কী! এদের সম্বল লোটাকম্বল আর যৎসামান্য তৈজসপত্র। পুলিশ বোধহয় ভেবেছিল কোন অস্ত্রশস্ত্র বা বোম বানানোর ম্যানুয়াল, নিদেন পক্ষে একটা দুটো হাতিয়ার পাবে। পেল একটা চার ইঞ্চি তরকারি কাটার চাকু — সেটাই বাজেয়াপ্ত করল। ওরা এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। পাকা খবর পেয়েছে যে কোলকাতা থেকে অল্প বয়েসি বাঙালি ছেলে এসেছে — বোম বানানো শেখাবে বলে। দেখল দুটো ছেলে, ক্লাস ইলেভেনের বোর্ড একজামিনেশন দেয় নি। কিন্তু শেষ মুহুর্তে পেল একটা ছোট চিরকুট – যোগীদার লেখা, ব্লাস্ট ফার্নেসের কমরেড রাজরত্নমকে। এরা পড়ে উনুনে ফেলার জন্যে দলা পাকিয়ে বিছানা থেকে উনুনে ছুঁড়ে দিয়েছিল।

    আগুন নিভে এসেছিল, ঠিকমত পোড়ে নি। রাজরত্নমের নাম স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে।

    কী জ্বালা!

    পঞ্চনামা বানানোর সময় সাক্ষী হিসেবে সই করল ওই চালাঘরের মালিক আর পান-সিগ্রেটের ঠেলাওলা। রূপোর পদক পাওয়া বক্সার বিডি থাপা সই করতে বা এদের সম্বন্ধে কোন স্টেটমেন্ট দিতে অস্বীকার করে।

    ছেলে গেছে বনে

    সেইসময় আমি দুই ফুসফুসে টিবি নিয়ে শয্যাশায়ী, বাপের হোটেলে আছি। স্টিল প্ল্যান্টের বাগান ঘেরা কোয়ার্টারে আমার জন্যে আলাদা ঘর, আলাদা বাথরুম। কারণ আমার স্পুটাম পজিটিভ, এই অবস্থায় স্টীল প্ল্যান্টের হাসপাতালে প্রোটোকল অনুযায়ী টিবি ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে কোয়ারান্টাইনে থাকার কথা, মানে যতদিন স্পুটাম নেগেটিভ না হয়।

    কিন্তু ওই ওয়ার্ডে উঁকি দিয়ে পাশাপাশি শুয়ে থাকা একগাদা লোক, লাল কম্বল আর খক খক কাশি এবং মিনিটে মিনিটে এনামেলের পাত্রে সবার থুতু ফেলা দেখে আমি বেঁকে বসলাম।

    -- আমি এখানে থাকব না, বাবা!

    শেষে আমাদের পারিবারিক ডাক্তার শুক্লাজী লিখে দিলেন যে রায়বাবুর কোয়ার্টার স্যানাটোরিয়ামের মত সেফ। আমাকে প্রতি ১৫ দিন অন্তর হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে এবং ওষুধ ও ইঞ্জেকশন যাতে নিয়মিত নিই সেটা উনি নিজে দেখবেন।

    কোলকাতা থেকে এখানে আসার পর প্রথম সন্ধ্যেয় বুকে স্টেথো লাগিয়ে ওনার মুখ গম্ভীর হয়য়ে গেছল। রায়বাবু, এক্সরে করান। আপনার বাড়িতে এই অসুখ কেন হল?

    পরের দিন এক্সরে। দুই ফুসফুসেই নীল আর্মস্ট্রং এর তোলা চাঁদের পাহাড়ের ছবি, মায় সব গর্ত এবং শুকনো খাত সমেত।

    -- রায়বাবু, চিকিৎসা করান,এবং ভগবানকে ডাকুন। কেসটা ভাল নয়।

    আমার কাশ্মীরে যুদ্ধে যাওয়া বাবা কেঁদে ডাক্তারের পা’ জড়িয়ে ধরেন। আমার ছেলেটাকে বাঁচিয়ে দিন, যা বলবেন যেমন বলবেন — সব শুনব।

    তখন টিবির চিকিৎসা বলতে দুটো ট্যাবলেট – পাস ও আইসোনেক্স। সঙ্গে ইঞ্জেকশন স্ট্রেপটোমাইসিন। দুবছর ধরে চিকিৎসায় লেগেছিল ১৪৪টা ইঞ্জেকশন। ঘরে থেকে করানোয় বাবাকে ওগুলো কিনতে হয়েছিল। ট্যাবলেট এবং ভিটামিন ও টনিক হাসপাতাল থেকে ফ্রি।

    দু’মাস আগে ডাক্তার আমাকে সম্পূর্ণ রোগমুক্ত ঘোষণা করলেন, চিকিৎসা শেষ।

    তার দু’মাস পরে যোগাযোগ করে এক দুপুরে মাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে আমরা দুই ভাই আবার পালালাম।

    এদিকে পূর্ববঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ওখানে সামরিক শাসক জেনারেল টিক্কা খান। অল বদর নামের কুখ্যাত ঘাতক বাহিনীর হাতে মারা গেছেন অনেক অধ্যাপক, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। শেখ মুজিব লায়ালপুর জেলে। টাইগার সিদ্দিকি বলে জনৈক মুক্তিবাহিনীর কম্যান্ডারের নাম খুব শোনা যায়। এপার বাঙলা ওপার বাঙলা এই গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র নিয়ে কি যে বলছে বুঝতে পারছি না। কেউ বলছে দুই সামত্রাজ্যবাদী শিবিরের হালুয়া-রুটি ভাগাভাগির লড়াই্‌ মানে ওটা কোন মুক্তিযুদ্ধই নয়! কেউ বলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত দুই বাংলায় লাল গেরিলারা সরকারি ফৌজের বিরুদ্ধে হামলা চালাক।ওপারে খান সেনার বিরুদ্ধে এবং এপারে ইন্দিরা সেনার বিরুদ্ধে। আমরা মুখিয়ে থাকি দু’জনের কথা শোনার জন্যে - বদরুদ্দিন উমর ও মহম্মদ তোহা। কিন্তু ওদের বক্তব্য ছত্তিশগড়ে ঠিকমত পৌঁছোয় না।

    রেডিও পিকিং কিছু তো বলুক!

    বাবার রাশিয়ান কলীগ মিঃ গুলেশা দেশে ফিরে যাবার সময় আমাদের বাড়িতে ডিনার করে বাবাকে হাগ করে একটা ছোট ট্রাঞ্জিস্টর দিয়ে গেলেন । ওদের দেশে তৈরি। শর্ট ওয়েভ আর লং ওয়েভ। আমরা ওটা কব্জা করে এরিয়েল লাগিয়ে টাগিয়ে কলকাতা-এ আর রেডিও পিকিং শোনার চেষ্টা করি। অতিকষ্টে কান লাগিয়ে শুনতে হয়।

    রেডিও পিকিং! রেডিও পিকিং!

    প্রথমে আপনারা শুনবেন একটি গান যার অর্থ হচ্ছে ইস্ট ইজ রেড বা পূর্বদিক লাল!

    এবারে শুনুন খবর। ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসি ---।

    কাম্বোডিয়ার বৈধ শাসক প্রিন্স নরোদম সিহানুকের নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক ফ্রন্ট গত সপ্তাহে মার্কিন হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে ---।

    উফ, পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা নিয়ে কিছু বলুন কমরেড!

    এবারে শুনুন পিপলস ডেইলির একটি প্রবন্ধ। ---

    চীন গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকার পাকিস্তানের উপর সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার ইশারায় ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের হামলার প্রতিবাদ করছে এবং পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে ন্যাশনাল গর্ভনমেন্টকে পূর্ণ সমর্থন করছে। এবারে শুনুন পিকিং অপেরার “লাল লন্ঠন” এর একটি গান।

    ছোটভাই উল্লসিত। দাদা দেখলি! হানাদারদের বিরুদ্ধে ন্যায়যুদ্ধের পক্ষে নিঃশর্ত সমর্থন!

    দূর! কিস্যু বুঝলাম না। এ তো মনে হয় ইয়াহিয়া খানের সামরিক জুন্টাকেই সমর্থন করল। তা কী করে হয়? মাও এবং চৌ এন-লাই এমন ভুল করবেন?

    আমরা চুপসে যাই।

    আমার বাবা রোজ “স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র” শোনে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কুষ্টিয়া না বগুড়া নাকি মীরপুরে খান সেনার প্ল্যাটুন ধ্বংস হয়েছে - এসব মন দিয়ে শোনে এবং লিপটন চা ও ডিমের ওমলেট খেয়ে সেলিব্রেট করে। যদি বলি – ওসব প্রচার। আসলে স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র কোলকাতার সার্কাস এভিনিউয়ে প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান হাইকমিশনের অফিস থেকে ব্রডকাস্ট হচ্ছে বাবা ভীষণ রেগে যায়। দু’দিন কথা বন্ধ।

    বাবা ১৮৪৯ সালে ছুটি ক্যানসেল করিয়ে কাশ্মীরের লড়তে গেছল। ৬২-৬৩ সালে একের পর এক চীনা ফৌজের হাতে ভারতীয় ঘাঁটির পতনের অপমান ভুলতে পারেনা। চুশুল-বমডিলা-তাওয়াং-তেজপুর!

    তখন চীনের সঙ্গে যুদ্ধের দিনে আকাশবাণীর খবরে বলা হত ভারতীয় সেনা পূর্বপরিকল্পনামত আগের ঘাঁটি ছেড়ে পিছিয়ে এসেছে। একদিন মা বলে ফেলল — এরা খালি পিছিয়ে আসে ক্যান? একদিন তো এগিয়ে যাক।

    বাবা গর্জে উঠল – তুমি মেয়েছেলে যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজি ট্যাকটিসের কী বোঝ? ব্যস, দুজনের তিনদিন কথা বন্ধ।

    কোলকাতা থেকে বাবার বন্ধু এসে গল্প করেন – বনগাঁ ও ব্যারাকপুরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ট্রেনিং হচ্ছে। অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ কোলকাতায় আছেন।

    এবার বাবা আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকায় না।

    আমরা দু’ভাই খুশি হই, আড়ালে বলি – বেশ হয়েছে।

    কারণ গতবছর রটে গেছল যে মুক্ত এলাকা থেকে, মানে অন্ধ্রের শ্রীকাকুলাম এজেন্সি এলাকা থেকে নকশালদের রেডিও ব্রডকাস্টিং শুরু হবে। এটা নিশ্চয়ই জনযুদ্ধের একটা গুণগত উন্নয়নের ধাপ।

    বাবা হাসল। এসব ফালতু কথা জঙ্গলে গাছের ডালে বেঁধে একটা ট্রান্সমিটার থেকে পঞ্চাশ মিটার রেডিয়াসের মধ্যে ব্রডকাস্ট করা যায় । ওকে বেতারকেন্দ্র বলা বা স্বাধীন বাঙলা বেতারের সঙ্গে তুলনা করা ছেলেমানুষি।

    শেষে ১৯৭০ সালের সম্ভবতঃ জুলাই মাসে হয়ত হয়েছিল কিছু। দেশব্রতী পত্রিকায় তার ট্রান্সস্ক্রিপ্ট পড়ে আমরা দমে গেলাম।

    মিনিট দশের ব্রডকাস্ট। নিউজ কম, ঘোষণা বেশি। কিন্তু রেডিও পিকিং এর ক্লোন মত।

    রেডিও ইন্ডিয়ান লিবারেশন! রেডিও ইন্ডিয়ান লিবারেশন!

    ন্যাড়া বোধহয় আর বেলতলায় যায়নি।

    (ক্রমশঃ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 162.115.44.104 | ০১ নভেম্বর ২০২০ ০৬:১৭99479
  • ভাল লাগছে, রঞ্জন-দা । পড়ছি 

  • ar | 96.230.106.154 | ০২ নভেম্বর ২০২০ ১৯:১২99569
  • একটা টাইপো রয়ে গেছে, "১৮৪৯"।

  • Ranjan Roy | ০৩ নভেম্বর ২০২০ ০২:৫৮99580
  • ধন্যবাদ, ar !    ।


    ওটা ১৯৪৯ সাল হবে।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন