এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • পনেরই জুন-ওয়ার্ল্ড এল্ডার অ্যাবিউজ ডে

    শ্রাবণী
    আলোচনা | বিবিধ | ১৫ জুন ২০০৮ | ৫৪৪ বার পঠিত
  • (যা দিয়ে লেখা শুরু করেছি তা হয়ত ঠিক প্রচলিত নিয়মকানুনের সঙ্গে যায় না। আসলে উল্লিখিত বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবতে গেলেই আমার সবচেয়ে প্রথমে যা মনে পড়ে বা যে মুখ মনে পড়ে, তা দিয়েই শুরু করেছি। হয়ত এ ঘটনা অত্যন্ত মামুলী, লেখার মত নয়, তবু আমার কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ট্র্যাডিশনাল যৌথ পরিবারের ঘেরাটোপে বড় হয়েছি, সম্পর্কের নানান কঠোর দিক সম্বন্ধে বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিলনা। ভাবতাম বাকী যা যেরকমই হোক, বাবা মা আর সন্তানদের মধ্যেকার সম্পর্কের মত নিখাদ অমলিন আর কিছুই হয়না। এর আগে গল্পকথায় হয়ত পড়ে থাকব তবে তা গল্প বলেই ভুলে যেতাম, মনে দাগ কাটত না। বাস্তবেও এরকম হয় বা হতে পারে আমারই আশে পাশে, সেই উপলব্ধি সেই তখন থেকেই শুরু।)

    কেন চেয়ে আছ গো মা .........

    ----ওমা, বুড়ি, এসেছিস এতদিন পরে। তোরা সব যে দেখি দেশটাকে ভুলেই গেলি ।
    কোমরটাকে সোজা করে দাঁড়াতে পারছেনা, হামাগুড়ি দিয়ে ছোট্টখাটো কোঁকড়ানো শরীরটাকে কোনোরকমে টানতে টানতে দুর্গামন্দিরের সামনে আমার দিকে এগিয়ে আসা মানুষটাকে চেনা আমার পক্ষে সম্ভবই ছিলনা যদি না পাশে দাঁড়ানো মুখরা বধূটি বলে উঠত,
    ----হ্যাঁ গো মনিপিসী তুমি এবারেও এসেছ ওই অত দুর থেকে, এইভাবে। দ্যাখতো লাল মোরামের রাস্তায় হাঁটু দুটোর কি অবস্থা হয়েছে? তোমার ছেলে, নাতি নাতনী রা কি সব মরেছে? বচ্ছরকার দিনে আর একটা রিকশায় চাপিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারেনি তোমায়?
    এই আমাদের মনিপিসী, একি চেহারা হয়েছে! হতভম্ব অবস্থাটা তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে হাত ধরে সিঁড়িতে বসাই। ঠাকুরদালানে রাখা বেলপাতা ধোয়ার জলে হাতের রুমালটা ভিজিয়ে, ছড়ে যাওয়া হাঁটু দুটোকে পরিস্কার করতে করতে বলি,
    ----সত্যি পিসী, একা একা এভাবে এসেছ কেন, এই শরীরে?
    ঘোলাটে চোখদুটো জলে ভরে গেছে, ডুকরে উঠে বলে,
    ----ওরে আসছে বছর হয়তো আর মাকে দেখার জন্য থাকবনি রে। তাই শেষ দেখাটা দেখতে এলাম। বলে যাই মাকে যেন এবছরই নিয়ে যায়। তোদের সক্কলকেও যে বড় দেখতে ইচ্ছে করে রে।
    চোখে বোধহয় ভালো দেখতেও পায়না যদিও একটা ভাঙা চশমা পরে আছে, কথার ফাঁকে ফাঁকে আমার মুখে হাত বোলাতে থাকে নিজের শুকনো খড়ি ওঠা হাত দিয়ে।

    মনিপিসী আমাদের পরিবারেরই মেয়ের মেয়ে। ওর মা ছিলেন আমার এক জ্ঞাতি দাদুর বোন। তিনি খুব অল্প বয়সে বিধবা হন, মনিপিসী তখন কয়েক মাসের শিশু। শ্বশুরবাড়িতে থাকতে দেয়নি। আমাদের এখানে নিয়ে এসে তাকে একটু জমি দিয়ে ছোট্ট একটা ঘর বানিয়ে দেয় বাড়ীর তখন কার কর্তারা। সকলে মিলে সাহায্য করে এদের সংসার চলত।
    মনিপিসী বড় হয়ে বিবাহযোগ্যা হল যখন, সবাই মিলে পরামর্শ করে একটি গরীব ছেলেকে ঘরজামাই আনল। মেয়েদের সংসারে পুরুষ অভিভাবক হল, সবদিক থেকে সুখী সংসার। অবশ্য বেশীদিন সে সুখ স্থায়ী হলনা। মনিপিসীর ছেলে অজুদা যখন দুবছরের, তখন পিসেমশাই মারা যান।
    এর ওর বাড়ীতে উদয়াস্ত কাজ করে, চেয়েচিন্তে, ছেলেকে বড় করল পিসী। ম্যাট্রিক পাশও করল সে। পাশের গ্রামে তখন সদ্য এক প্রাইমারী স্কুল খোলা হয়েছে,সরকারী। সেখানে লোক নেওয়া হবে। সকলের চেষ্টায় দাদার চাকরী হয়ে গেল ঐ স্কুলে, মাইনে সামান্য হলেও ঘরের খেয়ে চাকরী। এতকাল পরে দু:খের সংসারে সুখ শান্তি এল।
    আমরা ছুটিছাটায় যখন বাড়ী যেতাম অজুদার মেয়ে ছিল আমার অন্যতম খেলার সাথী। ঠাকুমা তখন মারা গেছেন। মনিপিসী পুরো সংসার বৌদিকে দিয়ে দিয়েছে। বৌদির কথাতেই সংসারের ঘড়ি চলে। অবশ্য কায়িক পরিশ্রম সব পিসীর, সাধারণ পরিবারে কাজের লোক আর কে রাখে! একটু জমি হয়েছে, গরুও কেনা হয়েছে। সেসব দেখাশোনা পিসী করে। পিসী বউমা বলতে অজ্ঞান।
    নিজের নাতি নাতনীদের সঙ্গে সঙ্গে পাড়ার সমস্ত বাচ্চাদের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল পিসী। তার চারপাশে সবসময় খানকয়েক কচি কাঁচার দল। যেখানেই যাক সঙ্গে করে তিন চার জনকে নিয়ে না গেলে তার যাওয়াই হতনা। ছোটোদের যে কোনো হইচইএ বড় একজনই, মনিপিসী। চেহারাও ছিল ছোটোখাটো, তাই ছোটোদের পাশে বেশ মানিয়ে যেত।
    আমার ছেলেবেলার গ্রামের বাড়ীর আনন্দের যা স্মৃতি সবেতেই জ্বলজ্বল করে পিসীর উপস্থিতি।
    আস্তে আস্তে অনেক পরিবর্তন আসে গ্রামের জীবনধারায়। সেইসব মানুষ যারা সবাইকে একসূতোয় বেঁধে রেখেছিল এক এক করে বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে। স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা এইসব শহুরে বৃত্তি গ্রাস করতে থাকে গ্রামের সহজ সরল মানুষদেরও। আমাদেরও বাড়ী যাওয়া অনেক কমে আসে পড়াশোনার চাপে। শুনতে পেতাম অজুদারা আর আমাদের পাড়ায় থাকতে চাইছে না। ওরা আরও ভালো বাড়ী করতে চাইছে, যার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ওদের বর্তমান ভিটেতে নেই, অতিরিক্ত জায়গা দিতে হালের কর্তারা কেউ রাজী নয়। আসলে ওদের এই বড়মানুষীটা কেউ মানতে পারছেনা। ছোটোখাটো ব্যাপারে ওদের সঙ্গে অন্যান্য বাসিন্দাদের ঝগড়া অশান্তি। পিসী আগের মত সবাইকে নিয়ে মিলে মিশে থাকতে চায়, তা ওদের পছন্দ নয়। সময়বিশেষে পিসীর গায়ে হাতও তোলে নাতি নাতনীরা।
    যখন দেখি পাড়ার বাচ্চারা খেলছে, হইহই করছে মনে হয় কি যেন তফাত ওদের আর আমাদের ছেলেবেলার মধ্যে! তফাত তখন ঘাড় গুঁজে মলিন শাড়ীতে মলিনতর হয়ে গরু খাওয়াচ্ছে বা রকে বসে কুটনো কাটছে, কয়লার গুল দিচ্ছে অথবা এমনিই বসে আছে আকাশের পানে তাকিয়ে, যেন প্রাণহীন পুতুল এক।
    সেবার বাড়ী গিয়ে দেখলাম মাইল খানেক দুরে ওদের এক খামার বাড়ী কেনা ছিল,সেখানে পাকাবাড়ী উঠছে। দাদা তখন হেডমাস্টার। নিন্দুকেরা বলল, স্কুলবাড়ী পাকা হচ্ছে সরকারী টাকায় আর সেই ইঁট বালি সিমেন্ট দিয়ে ওদেরো বাড়ী হচ্ছে।
    পিসীর কান্না শুনে বাবা খুব উত্তেজিত হল, পিসীকে বলল
    ----তুই চল আমার সাথে, আমি না থাকলেও তোর ভাইপো ভাইঝিরা তোকে দেখবে।
    মনিপিসী কাঁদতে কাঁদতে জানাল যে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। অনেক জোর করার পরে কারনটা ও জানা গেল। তার ভয় ছেড়ে চলে গেলে ছেলে যদি তার মুখে আগুন না দেয়, তখন কি হবে? সে যে অনন্ত নরকবাস! শত কষ্ট হলেও ঐ আগুনটুকুর জন্য তাকে ছেলের সংসারেই থাকতে হবে!
    এর পর অনেক দিন গ্রামে যাওয়া হয়নি, পিসীরা এর মধ্যে পাড়া ছেড়ে চলে গেছে।

    হঠাৎ করে বাবা চলে গেলেন, মা খুব ভেঙে পড়েছিল তাই পুজোতে সবাই মিলে মাকে নিয়ে গ্রামে এসেছি। মনিপিসীকে এই অবস্থায় দেখে আর একবার বাবার কথা মনে পড়ল। বাবা ওকে খুব ভালোবাসত।
    ----হ্যাঁরে তোরা দাদাকে রাখতে পারলিনি? সেখানে শুনি এত ডাক্তার বদ্যি, তবু দাদা চলে গেল আর আমি এখানে বিনা ওষুধ বিষুধে এখনও যমের অরুচি, পড়ে রয়েছি।
    বাবার শোক আর একবার ঘিরে এল। ছোড়দা আটচালায় দাঁড়িয়ে ছিল, ডাকলাম। তাকে জড়িয়ে পিসীর আর এক প্রস্থ কান্না। মা বাড়ীতেই আছে, তার কাছে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সোজা দাঁড়াতে পারেনা যে, হামাগুড়ি দিয়ে চলে। ছোড়দা বলল "কোনো ব্যাপারই না, এইটুকু তো একটা মানুষ"। কোলে তুলে নিল। প্রথমে আপত্তি করল, নোংরা শাড়ী। পুজোর দিনেও একটা অনেকবার ঘরে কাচা লাল হয়ে যাওয়া থান পরনে। যখন দাদা তুলে নিল ফোকলা দাঁতে সে কি হাসি!
    আমি একজন কে পাঠালাম একটা রিকশা ঠিক করে আসতে, বিকেলে পিসীকে বাড়ী নিয়ে যাওয়ার জন্য। সারাদিন আমাদের বাড়ী থাকল,মায়ের সাথে পুরোনো দিনের গল্প করল, খুশী চোখে মুখে উপচে পড়ছে। অনেক তৃপ্তি করে ভাত খেল, মনে হল অনেককাল ঠিক মত খায়ও না। এক কাকীমা বললেন বাড়ীতে নাকি খেতেও দেয়না ঠিকমত। বলে, আর কেন বেঁচেথাকা? পাড়ার দু একজন প্রবীণেরা এ নিয়ে বলতে গিয়ে অপমানিত হয়েছে।
    বিকেলে বাড়ী যাওয়ার আগে হঠাৎ বলে উঠল,
    ----হ্যাঁরে বুড়ি, তুই বিয়ে করবি না? তোর মা বলল তুই নাকি বড় চাকরী করছিস?
    আমি হেসে বললাম,
    ----কি হবে বিয়ে করে, সেই তো ছেলে মানুষ করব, তারপর তোমার দশা হবে।
    ভালো করে বোধহয় শুনলনা আমার কথাটা। ডুকরে উঠে বলল,
    ----তাহলে তোর কাছে নিয়ে যেতিস আমাকে। আমাকে কেউ দুচোক্ষে দেখতে পারেনা, বউমা, গোপাল, ছেলেমেয়েগুলো, সবার চক্ষুশূল আমি। মারধোর করে সবসময়, শুধু আমার মৃত্যু কামনা করে, আমি যে আর কোনো কাজে লাগিনা ওদের।
    আমি স্তম্ভিত। কত যন্ত্রনায়, কষ্টে, এক নিরক্ষর ধর্মভীরু হিন্দু বিধবা একমাত্র ছেলের হাতের মুখাগ্নির পুণ্যের লোভ ত্যাগ করে, আমার মত দুরের আত্মীয়র সাথে অজানায় পাড়ি দিতে চায়!
    সন্ধ্যা আরতির সময় অজুদার সঙ্গে দেখা হল। দাঁত বার করে এক গাল হাসি।
    ----মা এসেছিল তোমাদের বাড়ীতে? আমাদের না বলে একাই বেরিয়ে এসেছিল, নাহলে তোমার বৌদির জন্য তো রিকশা বলা হয়েছিল। আসলে আজকাল আর মাথার ঠিক নেই। সবসময় চোখে চোখে রাখতে হয়। কত ডাক্তার দেখালাম মাকে, কিছুই হলনা।
    পাশে বৌদি দাঁড়িয়ে মুখটাকে করুণ করুণ করে। ইচ্ছে হল বলি, ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে এই ডাহা মিথ্যে গুলো আর না বলতে, কষ্ট করে চুপ থাকলাম।

    মাসখানেক পরেই মা জানাল মাদুর্গা পিসীর কথা শুনেছেন, তার সব কষ্টের অবসান হয়েছে। কারো চলে যাওয়ার খবরে এতটা স্বস্তি আর কখোনো পাই নি। পরের বারে বাড়ী গিয়ে দাদা বৌদি ও তাদের ছানাদের কুমীরকান্না শুনলাম দাঁতে দাঁত চেপে আর আশা করলাম যে মনিপিসী স্বর্গ থেকে সব দেখে শুনেও তার নাড়ী ছেঁড়া ধনকে ক্ষমা করে দেবে! হাজারহোক মা তো!

    এরা চাহে না চাহে না চাহে না তোমারে .......

    সকালের কাগজে একটা প্রতিবেদন, সাথে JNU র ক্যাম্পাসে গাছের তলায় বসে থাকা একটি মানুষের ছবি। দুর্বল শরীর বয়সের ভারে কোঁকড়ানো,ঘোলাটে প্রায়ান্ধ অসহায় দৃষ্টি, মুখে অজস্র বলিরেখা, হাতে একটা নোংরা প্লাস্টিকের থলি। আলোকিত সকালে ঝাপসা আমার চোখ, কোন সুদুর অতীতে র আর একটা মুখের সঙ্গে এই ছবির মুখ যেন একাকার হয়ে গেছে। কার্মা দেবী না মনিপিসী কাকে দেখছি আমি?

    প্রায় একশ বছর বয়স, নাতনী,এক ছেলের বাড়ি যাবার নাম করে বার করে নিয়ে এসে রাস্তায় গাছতলায় বসিয়ে দিয়ে গেছে। চোখে দেখেনা,স্মৃতিও প্রায় লুপ্ত। অনেক জিজ্ঞাসা করে শুধু ছেলের, নাতনীর নাম আর মহীপালপুরের নাম বলে। মহীপালপুরে কোন জায়গায় থাকে সে সম্পর্কে কিছু না বলতে পারায় খোঁজ করেও ওর ছেলেকে পায়না পুলিশ। অবশেষে তাকে পাঠান হয় গৌতমপুরীর ""বিশ্রাম বৃদ্ধ আশ্রম কর্ম""এর আশ্রয়ে। কোথায় আছে তাও ভালমত বোঝেনা, তবে বাড়িতে ফিরতে চায়না আর। খেতে দিতনা, বড় মারধোর করত যে ওরা। ক্ষীণদৃষ্টি, দুচোখ থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে কোঁচকানো দুই গাল বেয়ে, এই কাহিল শরীরে আর সহ্য হয়না ওদের আঘাত।

    সেই একই কাহিনী, শুধু স্থান,কাল আর পাত্রপাত্রী বদলে গেছে। আশ্রমের আরও তিরিশ জন সদস্যের গল্পেও খুব বেশী ফারাক নেই। সারা দেশ বিদেশ থেকে এই প্রতিবেদনের ওপর প্রতিক্রিয়া আসে। কেউ বলছে কঠিন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক তাদের, যারা পরিবারের অসহায় বৃদ্ধ সদস্যদের সঙ্গে এহেন আচরণ করছে। আমাদের দেশে বৃদ্ধদের জন্য কোনো সুব্যবস্থা নেই বিদেশের মত, সরকারের উচিৎ বৃদ্ধদের জন্যে সোশ্যাল সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা। আবার কারুর মতে আজকের এই যুগে যৌথ পরিবার ব্যবস্থা চলেনা, যুব সমাজের ওপর অনেক চাপ। তাই বৃদ্ধ পিতামাতার নিজেদেরই উচিৎ সংসার ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাওয়া , ভারতে তো পুরাকালে বাণপ্রস্থের ব্যবস্থা ছিলই!

    পরিসংখ্যান বলছে যে এদেশে প্রায় চল্লিশ শতাংশ বৃদ্ধবৃদ্ধারা পরিবারের কাছে নানাভাবে দুর্ব্যবহারের স্বীকার হয়ে থাকেন, যদিও প্রতি ছটির মধ্যে একটিই কেস সামনে আসে। এককথায় সমাধান হওয়ার মত সাধারণ সমস্যা এটি নয়। কিন্তু এ যে শুধু আজকের যুগের বা ওয়েস্টার্ণ কালচারের প্রভাবজনিত সমস্যা নয় তা আমাদের থেকে বেশী আর কে জানে! কাশী আর বৃন্দাবনের অলিতে গলিতে বাঙালী বিধবাদের করুণ কাহিনী সে তো সেকাল থেকেই চলে আসছে! যাদের কেউ কোথাও নেই তাদের একরকম সমস্যা, আবার যারা পরিবারের মধ্যে আছে তাদের আরএকরকম। অনেকসময় আর্থিক সঙ্গতি থাকলেও এর কোনো সুরাহা হয়না ( সমস্ত টাকাপয়সা আত্মসাৎ করে বৃদ্ধবৃদ্ধাদের বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে আত্মীয়স্বজন এরকম ঘটনা আকছার শোনা যায়)। পরিবারের মধ্যে থেকে অনেক সময় এরা মানসিক তো, বটেই শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হন।

    হেল্পেজ ইন্ডিয়ার হিসেব বলছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এল্ডার অ্যাবিউজ কেসে দায়ী তাদের নিজের ছেলেমেয়েরা। কোনো এক লেখায় দেখেছিলাম যে শিশুরা বা মেয়েরা বৃদ্ধদের থেকে অনেক বেশী ফোটোজেনিক, তাই বোধহয় সংবাদ মাধ্যম তাদের সংক্রান্ত খবর নিয়ে যতটা মাতামাতি করে, ততটা অশক্ত, অসহায় বয়স্কদের নির্যাতন নিয়ে করেনা। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স ও ডাউরি ডেথ, ইত্যাদি নানা "ক্রাইম এগেনস্ট উইমেন"এর জন্য খোলা হয়েছে বিশেষ সেল। যারা বয়স্কদের সমস্যা নিয়ে কাজ করেন, তাদের কথা অনুযায়ী অনেক পুত্রবধুই এই সেলের ও এর বিশেষ আইনের অপব্যবহার করে থাকে বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ীদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে।

    বলে রাখা ভালো বয়স্কদের প্রসঙ্গে অ্যাবিউজ বলতে শুধু ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ বোঝায় না। অযত্ন অবহেলা দ্বারা যে সাইকোলজিক্যাল অ্যাবিউজ করা হয় তা এই বয়সে শারীরিক পীড়নের চেয়ে কম ক্ষতিকারক নয়। সমাজের অন্যান্য সমস্যার মত বয়স্কদের বা এল্ডার অ্যাবিউজের সমস্যাকে ঠিক এক ছাঁচে ফেলা ঠিক হবে না কারন এক্ষেত্রে এফেক্ট প্রায় একই ধরনের হলেও কজ ভিন্ন ভিন্ন। সমাজের যেকোনো স্তরের মানুষই এই সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। বয়স্কদের সমস্যার দুটি প্রধান কারন হল অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা ও শারীরিক অক্ষমতা। একজন ধনী বৃদ্ধ তার টাকা থাকার জন্য আর একজন সহায়সম্বলহীন টাকাপয়সা না থাকার জন্য, ঠিক একই ভাবে তাদের নিজ নিজ সন্তানদের হাতে যন্ত্রণা ভোগ করতে পারে। এছাড়া যৌথ পরিবার ব্যবস্থার ভাঙনও একটি অন্যতম কারন। সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামে ও শহরে, সমাজের ইকনমিক্যালি লোয়ার স্ট্রাটার বৃদ্ধা বিধবা মহিলারা দুর্ব্যবহারের শিকার হন সবথেকে বেশী।
    WHO র স্টাডি অনুসারে পরিবারের বাইরে এল্ডার অ্যাবিউজের অন্যান্য জায়গা হল বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, নার্সিং হোম ইত্যাদি।

    যেসময়ে মানুষের সবচেয়ে বেশী দরকার হয় যত্নের, সাহায্যের, ভালোবাসার, ঠিক সেসময়েই তাদের সবচেয়ে দূরে ঠেলে দেয় সমাজ, সংসার আর তাদের আপনজনেরা, রক্তের সম্বন্ধরা। আর সেইসব সন্তানেরা, যারা নিজেদের অস্তিত্বের ঋ্‌ণ এত সহজে অস্বীকার করে যায়, কি বলা উচিৎ তাদের! সব দেখে শুনে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে সিনিয়র সিটিজেনদের নিজেদেরই উচিৎ সন্তানদের ওপর নির্ভরশীলতা কম করা। দরকার হলে সন্তানদের দুর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনী সাহায্য নিতে হবে, আরও ভোক্যাল হতে হবে। শক্ত, সমর্থ এবং আর্থিক ভাবে স্বনিয়ন্ত্রিত বয়স্ক মানুষেরা তা পারেন, কিন্তু যারা তা নয়? কার্মা দেবীর মত অশীতিপর অসুস্থ গরীব বিধবারা, তারা কি করবে?

    ভারতে বয়স্ক জনসংখ্যা আনুমানিক সাড়ে আট কোটিরও বেশী, মোট জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ। ইউনাইটেড নেশনের হিসেবে ২০৫০ সাল অবধি এ দেশে জনসংখ্যার প্রায় কুড়ি শতাংশ মানুষের বয়স হবে ষাটের ঊর্ধে। তাই এনিয়ে ভাবনা চিন্তা করার সময় এসেছে। সর্বাগ্রে সরকারের দায়িত্ব এদের প্রপার সোশ্যাল সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা। যারা এই সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন তাদের সচেষ্ট হতে হবে জনসচেতনতা বাড়াতে। বয়স্ক ও তরুন দুই প্রজন্মের মধ্যে একে অপরের প্রতি সহনশীলতার আবহাওয়া তৈরী করতে। আমাদের দেশে এই সমস্যা সহজে সামনে আসেনা, পারিবারিক সম্মানের বাহানায়। এজন্য আরো বেশী করে কাউন্সিলিংএর দরকার।

    পনেরই জুন, ""ওয়ার্ল্ড এল্ডার অ্যাবিউজ অ্যাওয়ারনেস ডে'। এদেশের বিভিন্ন অর্গ্যানাইজেশন,যারা এই বিষয়ে কাজ করছে তারা এই জুন মাসকে "এল্ডার অ্যাবিউজ অ্যাওয়ারনেস মান্থ" হিসেবে চিহ্নিত করে বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়েছে। এদের মূল উদ্দেশ্য হল,

    To create awareness in elderly people themselves regarding what comes under elder abuse.
    To sensitize young people regarding elder abuse and enabling them to reflect on their own attitudes towards the elderly.
    To bridge the intergenerational gap between elderly and young people.
    To create awareness in media and society at large regarding elder abuse.

    এই জটিল সমস্যার সমাধান খুঁজতে সামাজিক চেত্ননা ও সরকারী আইন দুইই দরকার । নতুন একটি বিল আসছে, যাতে সিনিয়র সিটিজেনেদের "রাইট টু মেন্টেনান্স ফ্রম চিলড্রেন" থাকবে। এছাড়াও তাদের ক্ষমতা প্রদান করা হবে যাতে দরকার মনে হলে এরা সন্তানদের সম্পত্তির ভাগ থেকে বাদ দিতে পারেন। একটি স্পেশাল ট্রাইবুন্যাল শুনবে বয়স্ক মানুষের অভিযোগ। ইউনিয়ন ক্যাবিনেট ইতিমধ্যেই বিলটি পাস করেছে। সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশনে বিলটি আনা হবে। ধীরে হলেও আজ বয়স্কদের সমস্যা নিয়ে চারিপাশে এই যে চিন্তা, উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে, এ অত্যন্ত আশাজনক।

    তথ্যসূত্র
    "Elder abuse in India - A country report for WHO by Shubha Soneja"

    জুন ১৫, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৫ জুন ২০০৮ | ৫৪৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন