এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • তিব্বতি রিফিউজি ক্যাম্পে আটচল্লিশ ঘন্টা

    রঞ্জন রায়
    আলোচনা | বিবিধ | ২৩ মার্চ ২০০৮ | ৭৩১ বার পঠিত
  • ছোটনাগপুর মালভূমির পশ্চিমপ্রান্তে যেখানে ছত্তিশগড় আর ঝাড়খন্ড রাজ্য একটা সীমারেখায় মিশেছে, ঠিক সেইখানে পাহাড়-জঙ্গলে ঠাসা একটা চমৎকার অঞ্চল হল আমাদের সরগুজা জেলা। রাজধানী অম্বিকাপুর। এই এলাকা কয়লা ও নানান বনজসম্পদে সমৃদ্ধ। আবার সমুদ্রতল থেকে অনেকখানি উঁচুতে বলে প্রচন্ড গরমেও তেমন জ্বালায়-পোড়ায় না। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও সহজ সরল আদিবাসী জীবনযাত্রা অনেক ভাগ্যান্বেষীকেই হাতছানি দেয়। চিরিমিরির সুখ্যাত লাহিড়ি পরিবারের আদিপুরুষ ও সম্ভবত: এভাবেই কোন বিপুল সুদুরের বাঁশরি শুনে এখানে এসেছিলেন। তারপর তারা প্রবাদপুরুষ হয়ে গেলেন। বিশাল কয়লাখনি আর সুলভ সস্তা মেহনতী শ্রম। সবে মিলে নীট যোগফল বিত্ত ও সম্পদের বিপুল সঞ্চয়। এখানেই শেষ নয়। সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এই বাঙালী পরিবারটির অবদানের খ্যাতি ব্যাপ্তি পেল চিরিমিরি শহর, সরগুজা জেলা ছাড়িয়ে সমগ্র ছত্তিশগড়ে।

    লাহিড়ি ডিগ্রী কলেজ, ক্লাব, লাইব্রেরি, বাংলা-হিন্দি নাট্য আন্দোলন সবেতেই ওঁরা সক্রিয় ভাবে আছেন। ড: লাহিড়ির ইংরেজি সাহিত্য পড়ানো বিশেষ করে শেক্সপীয়র নিয়ে ওনার পাঠ ছাপার অক্ষরে সবার চোখ টানল। আর সত্তরের দশকে পরবর্তী প্রজন্মের পরমভট্টারক লাহিড়ি কলকাতায় গিয়ে খুললেন- "" ব্লু-বেল পাবলিশার্স''। ওঁরা ছাপতে লাগলেন অতি জনপ্রিয় ক্রাইম থিলারের সিরিজ-- জেমস হেডলি চেজ আর মডেস্টি ব্লেজ। বস্তুত: বাঙালী পাঠকের কাছে এদের নাম পৌঁছে দেবার প্রথম কৃতিত্ব ঐ ভদ্রলোকের। ( চেজ এর প্রথম বাংলা অনুবাদ-আমি যদ্দূর জানি "" শকুনের চোখে পলক পড়ে না''। ওরকম মার-কাটারি নামকরণের জোরে সবার চোখ টানলো আর আমার মত হাভাতেরা লাইব্রেরি থেকে এনে গোগ্রাসে পড়তে লাগলো।)

    লাহিড়িপরিবার একটি উদাহরণ মাত্র, কিন্তু ব্যতিক্রম নয়। সরগুজা জেলায় বাঙালীদের ভাগ্যসন্ধানে আসা এবং ছোট-বড়-মাঝারি নানামাপের সাফল্য লাভ করার অনেক ঘটনা চোখে পড়ে। ফলে সরগুজায় বিশেষকরে চিরিমিরি-বৈকুন্ঠপুর এসব কলিয়ারি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো ফুটবল খেলা ও ফুটবল ক্লাব। বন-জঙ্গলের মধ্যে গরীব আদিবাসীবালকদের মিনি-মাগনা হস্টেলে রেখে সভ্যভব্য করনেওয়ালা রোমান ক্যাথলিক মিশনগুলো পর্য্যন্ত ফুটবল-শিক্ষা প্রায় কম্পালসরি করে দিলো। আর বাঙালীত্বের প্রভাব ছড়িয়ে পড়লো প্রাপ্তবয়স্ক সবার নাম ধরে সম্বোধনের সময় --দা' এই সাফিক্স জুড়ে দেয়ায়। তাই অম্বিকাপুর রাজপরিবারের ব্যাংক অফিসার এবং ইউনিয়ন নেতা ত্রিভূবনপ্রতাপ সিং অনায়াসে হয়ে যান ভুবনদা'।

    কিন্তু ভাগ্যান্বেষী সব সমাজের প্রতি ভাগ্যদেবী এত সদয় ন'ন। এই ভেগে আসা দলাই লামার অনুগামী তিব্বতি সমাজের কথাই ধরুন। ধর্মশালা ছাড়াও এই সমাজ ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের কোন কোন কোণায়, ছোট ছোট দলে। তবে বছরে একবার অন্তত: দলাই লামার আশীর্বাদ নিতে ধর্মশালা যাওয়া চাইই-চাই। নয়তো মার্চ মাসে ১৯৫০-৫১এর স্বাধীন তিব্বতের দাবিতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে।

    এমনি এক বিরাট ক্যাম্প গড়ে উঠেছে সরগুজা জেলার পাহাড়ের ওপর মইনপাটে, আজকে যার আধুনিক নাম কমলেশ্বরপুর। সরগুজার জেলা সদর অম্বিকাপুর থেকে মাত্র আশি কিলোমিটার দুরত্বে। ছত্তিশগড়ে এদের অস্তিত্ব নিয়ে আদৌ সচেতন ছিলাম না। ঘুম ভাঙ্‌লো বছর বিশেক আগে, শীতের সময় কোলকাতার ফুটপাতের মত বিলাসপুর শহরে তিব্বতীদের যে গরম কাপড় বিক্রির স্টল তাতে গিয়ে। আমার অনভ্যস্ত চোখে মোঙ্গল ধাঁচের মুখ হলেই নেপালি।

    কেনাকাটির সময় কথাবার্তায় যা জানলাম তা হল--- ওরা দার্জিলিং এর নেপালি নয়, রিফিউজি তিব্বতি। মইনপাটে ঘাঁটি গেড়েছে বছর তিরিশ হল। ওরা পশম বোনে, আলুর চাষ করে আর কেউ কেউ লাসা পেডিগ্রির সাদা রংয়ের চোখের ওপর লোমঝোলা কুকুরের বাচ্চা ভালো দামে সমতলে এনে বিক্রি করে। সিনিয়র তিব্বতি জানালেন যে আগে সরকারি ব্যাংক ওদের লোন দিচ্ছিলো, একবছর আগে বন্ধ করে দিয়েছে। দোরবু বলে সেই ভদ্রপুরুষটি এও জানালেন যে ওরা ব্যাংককে প্রতিটি পাই-পয়সা চুকিয়ে দেন। তবু কেন এই ব্যবহার? ওরা বুঝতে পারেন না।

    আমার ব্যাংক সত্ত্বা জেগে ওঠায় একটি নামজাদা সরকারি ব্যাংকে রিজিওনাল ম্যানেজার স্তরে খোঁজ নিয়ে জানলাম যে সত্যি সত্যিই এমনটি ঘটেছে। আলুর চাষের জন্যে বরাবরই ঐ ব্যাংক তিব্বতি রিফিউজিদের লোন দিয়ে এসেছে, ফেরৎ পেতে কোন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু বছরকয়েক আগে রিজার্ভ ব্যাংকের একটি ফরমান এলো যে বিদেশিদের লোন দেয়া চলবে না। এবং তিব্বতিরা বিদেশি বটেক! খুব হলে "" আশ্রিত- বিদেশি''( তসলিমার মত?)।

    ইচ্ছে হল একবার ঘুরে আসি, ওদের ""জিন্দগি'' কেমন তা' চর্মচক্ষে দেখে আসি। বছরটা ১৯৮৯এর মে মাস। মৌকা পেয়ে আমরা কয় বন্ধু রওনা দিলাম মইনপাট বা কমলেশ্বরপুর । বিলাসপুর থেকে বাসে ২০০ কিলোমিটার অম্বিকাপুর। তারপর এক পুলিশিবন্ধুর জীপে ঘন্টা দুই চলার পর পাহাড়ের ওপর ফিশ্‌ পয়েন্ট, টাইগার পয়েন্ট পেরিয়ে অন্তিম বিন্দু । শেষ ২০ কিলোমিটার দেরাদুন থেকে মুসৌরি যাওয়ার পথের মত,-- একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে খাদ। কিন্তু পৌঁছেই মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠলো। পাহাড়ী উপত্যকা। যেন পাশাপাশি চারটে সবুজবাটি উল্টিয়ে রাখা। আর বটিগুলোর জোড়ের জায়গা দিয়ে বয়ে চলেছে এক ক্ষীণকায়া জলের ধারা।

    প্রত্যেক বাটিগুলোর ওপর আলাদা আলাদা রিফিউজি ক্যাম্প-- এক নম্বর, দু' নম্বর-এমনি করে চারটি। বাড়িগুলোর চারপাশে কাঠের বেড়া বেশ উঁচুকরে দেয়া। আর সেই বেড়ার গায়ে অসংখ্য ভূততাড়ানোর মন্তরলেখা সাদা রেশমি পতাকা পত্‌পত্‌ করে উড়ছে। সবগুলো ঘর প্রায় একই রকম দেখতে। ঘরে ঘরে চলছে তাঁত--পিটলুম, ছত্তিশগড়িতে খট্‌খটা। মাটির ফ্লোরে গর্ত করা। তাতে পা" ঢুকিয়ে বসে ফুট
    মেশিনের মত পা চালিয়ে আর ওপরে দু'হাত চালিয়ে বোনা হচ্ছে গালিচা, সোয়েটার ও অন্যান্য শীতবস্ত্র। শীতের মরসুমে স্টল লাগিয়ে বিক্রী হবে সমতলে।

    বুনছে কিন্তু মেয়েরা, প্রমীলাসংস্কৃতি যে! নাকি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ? কিন্তু আমার পুলিশ অফিসার বন্ধুটি যে একটু বেশি মাত্রায় পুরুষ। বাচ্চা মেয়েটার কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে গালচের নক্‌শা দেখছে না সপ্তদশীর বুকের খাঁজ, তা' সহজেই অনুমেয়। মেয়ের মা প্রটেক্‌শনের জন্যে কাছে এসে দাঁড়ায়, প্রতিবাদ করেনা, কিন্তু আমাদের দিকে বোবা আকুতি নিয়ে তাকায়। আমি পুলিশ বন্ধুটির কাঁধে হাত রাখি, চাপ দিয়ে বলি-- কি হে এখানে দইয়ের মত জমে গেলে চলবে? চল, মনাস্টারিতে যাই। রাস্তায় পড়লো থানা। পুলিশের ওখানে ভেতরে গিয়ে আলাপ-পরিচয়ের পর চা'খেতে বসা গেল। জানলাম গত দশবছরে এই তিব্বতি বস্তিতে কোন লুট-মার্ডার- রেপ হয়নি, মানে রিপোর্ট হয়নি।

    এরা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় জাতি। আমার মন খুঁতখুঁত করে। হয়তো ওরা খুব ক্লোজড্‌ সোসাইটি বানিয়ে আছে। হয়তো এরা নিজেদের সামাজিক গোপন কোর্ট চালায়। কিছু হলেও ভারত সরকারের আইন-আদালতে নালিশ করে না। করলে হয়তো ওদের ভিসা নিয়ে সমস্যা হতে পারে (আজকের তসলিমার মত?)।

    সেখান থেকে আধমাইল পায়ে হেঁটে গেলাম মনাস্টারিতে। ছোট মনাস্টারি। সামনের কামরায় অমিতাভ বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব আর মঞ্জুশ্রী দেবী। একপাশে পদ্মপাণি অবলোকিতেশ্বর। বেরিয়ে এলেন এক বয়স্ক লামা। জানালাম আমি রায়পুরের রবিশংকর ইউনিভার্সিটিতে বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন নিয়ে রিসার্চ করছি( পাশের থেকে একবন্ধু ফুট কাটলো--- এত গুল ধম্মে সইবে?)।

    উৎসাহিত হয়ে সেই লামাটি গিয়ে সিনিয়রমোস্ট লামা-- হলদে আল্‌খাল্লা, নেড়া মাথা আর দু'দিনের না কামানো দাড়িতে বুড়োটে ভাব, কে ডেকে নিয়ে এলো। তিনি আমার গুলতাপ্পি-বক্‌বকানি শুনে আগের লামাটির মাধ্যমে জানালেন- তিনি হিন্দি বা ইংরেজি কিছুই বোঝেন না। আগন্তুক দর্শনের ছাত্র সুস্বাগতম্‌।
    কিন্তু এসব আলোচনার জন্যে উপযুক্ত পাত্র হলেন সেকন্ড সিনিয়র লামা। তিনি ও'দুটো ভাষা জানেন, খবর দেয়া হয়েছে। তিনি এলেন। বয়স পঞ্চাশের ওদিকে।

    ওনাকে বৌদ্ধদর্শনের ক'টা নাম আর ""পতিচ্চ সমুৎপাদ'' অর্থাৎ ল' অফ কজালিটি শুনিয়ে ভারি ইমপ্রেস
    করা গেল। আমি জানতে চাইলাম -- এখানে ভিক্ষু হবার জন্যে বা পিটক গ্রন্থ অধ্যয়নের জন্যে কেউ আসে না? উনি উৎসাহিত হয়ে বল্লেন- আসে, কিন্তু-আজকাল সংখ্য কমে গেছে। তারপর ওনার পেছন পেছন এল মুন্ডিতমস্তক পীতবস্ত্রধারী দুই বালক। উনি আমাকে বল্লেন-- এখানে পড়ানোর স্ট্যান্ডার্ড খুব ভালো না। অধিকাংশ যায় ধর্মশালায়। এরাও পিটকের এবং পালিসাহিত্যের প্রাথমিক পাঠ নিয়ে তারপর যাবে ধর্মশালা। তবু আমি চাই আপনি এদের "" পতিচ্চসমুৎপাদ'' নিয়ে কিছু বলুন।

    এসব চুকলে আমরা গেলাম অভ্যন্তরীন প্রার্থনাকক্ষতে। বিশাল হলঘর। সেখানে একটা সীমার পর নগ্নপদ না হয়ে ভেতরে যাওয়া যায় না। তাই হলাম। চোখে পড়ছে এমনসব ছোট ছোট ব্রোন্‌জের মূর্তি যা ঠিক প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে খাপ খায় না। মনে হল দলাই লামা তো মহাযানী। তবে এই সেক্ট টা মনে হয় আরও একটা ছোট্ট সাবসেক্ট যেটা হয়তো বজ্রযান-ডাকিনীযান বা এমনি কোন তান্ত্রিক ব্যাপার-স্যাপার হবে। নানান বীভৎসদর্শন ও শৃংগাররসের মূর্তি দেখলে আমার মত অদীক্ষিত আনাড়ি লোক এইরকম অনুমান করতেই পারে। এবার আমার পুলিশবন্ধুটি এসব কথাবার্তায় অসহজ হয়ে আরও ভেতরে গেল; ও দোকান থেকে আলু-বেগুন তোলার মত করে টেবিলের ওপর যত্ন করে সাজানো স্বর্ণ এবং ব্রোঞ্জ মূর্তিগুলো হাতেকরে তুলে তুলে আবার এদিকসেদিক রাখতে লাগলো। তারপর আরও খানকয়েক মূর্তি খেলনার মত করে হাতে নিয়ে রগড়ে রগড়ে দেখতে লাগলো- যেন স্যাকরা সোনা যাচাই করছে।

    পাশের কুঠুরি থেকে বেরিয়ে এলেন সিনিয়র লামা। থমকে দাঁড়ালেন, চোখে নীরব তিরস্কার। চোখ আমার দিকে ফিরল, যেন বলছে---আপনি না শাক্যমুনির দর্শনের অনুরাগী। আর আপনার বন্ধুটি এমন কালাপাহাড়! আসলে আপনারা কে? অনুসন্ধিৎসু ছাত্র না লুটেরা?

    অন্য বন্ধুদের ইশারা করে বল্লাম ঐ পুলিশি ভ্যান্ডালটিকে বাইরে নিয়ে যেতে। লজ্জা কাটাতে দ্বিতীয় সিনিয়র লামার সঙ্গে খেজুরে গল্প শুরু করি।
    --- আচ্ছা, আপনিতো "" কাম-চালাউ'' হিন্দি-ইংরেজি জানেন। কোথায় শিখলেন?
    ---- আসলে আমি এখানের কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়াই।
    আমার চোখ কপালে ওঠে,-সেকি, আপনি এই মঠের লামা ন'ন? সন্ন্যাসী ন'ন?
    উনি হাসলেন। আমি ও সবই । আমাকে ধর্মশালা থেকে পাঠানো হয়েছে। আমি সরকারি কর্মচারি নই। এই মইনপাটে ভারত সরকার তিব্বতি রিফিউজিদের জন্যে সেন্টল স্কুল খুলে দিয়েছে, তাতে সব সরকারি কর্মচারি। আমি ধর্মশালার তরফ থেকে আছি। তিব্বতি ধর্মশাস্ত্র ও ইংরেজি পড়াই। মাসোহারা দু'হাজার টাকা পাই।
    আমার বাঙালী খোঁচানো স্বভাব জেগে ওঠে।-- আচ্ছা, আপনি ঐ সান্মানিক রাশি মনাস্টারিতে দান করে দেন, না কি নিজের পকেটেই?
    --- আমি আপনার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারছিনা।
    --- না মানে, ইয়ে আসলে তো প্রাচীন বৌদ্ধধর্মে ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের দান নেবার অধিকার ছিল না। তারা দান গ্রহণ করতেন চতুর্দিশার আগত-অনাগত সমস্ত সংঘের নামে। তাই বলছিলাম, আপনার এহেন আচরণ শাক্যমুনি প্রদত্ত শিক্ষার সংগে ঠিক খাপ খায় কি?
    প্রৌঢ় লামার মুখ শুকিয়ে কালচেটে হয়ে গেল। পাহাড়ের ওপারে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে আনমনে বল্লেন--- আমার বৃদ্ধা মাতা আর বিধবা বোন আমার ওপর আশ্রিত। সব ব্যয়ভার আমাকে বহন করতে হয়। আমি নিরুপায়।
    আমার গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। ইচ্ছে করছে নিজের পাছায় টেনে একটা লাথি কষাই।
    একগ্লাস জল চেয়ে খেলাম। তারপর হেসে বল্লাম--- দেশ ছেড়েছেন কবে? উনি হেসে একটা অনির্দিষ্ট ভাবে হাত দোলালেন। যার মানে অ-য়ে অজগর থেকে চন্দ্রবিন্দু -সবই হতে পারে।
    বল্লাম---দেশে ফিরতে ইচ্ছে করে না?
    --- করে না আবার? কিন্তু আমি চাইলেই কি হয়? তথাগত না চাইলে---।
    --- এবার মনে হয় পারবেন। দেখছেন না? চীনে নতুন হাওয়া বইছে। দেং সিয়াও- পিং অনেক খোলামেলা। উনি লাল-সাদা বেড়াল নিয়ে মাথ ঘামান না। বেরাল ইঁদুর ধরতে পারলেই হল। রেডিও শুনুন, খবরের কাগজ দেখুন,--হাজার-হাজার ছাত্র বেইজিংয়ে ঢুকছে, গান গাইছে, নতুন বসন্ত এসেছে। মনে ভরসা আনুন, অমিতাভ বুদ্ধ আপনার প্রতি সদয়।

    উনি এবার আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।----দেখুন, অমিতাভ বুদ্ধের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা আছে। কিন্তু চীনে-কমিউনিস্টদের আপনি চেনেন না। আমরা হাড়ে হাড়ে জানি। ঐসব নবীন বসন্ত-টন্ত ফক্কিকারি। সারা দুনিয়াকে ওরা বোকা বানাচ্ছে, শীগ্গির কামান গর্জালো বলে।

    নমস্কার করে গেলাম হাট-বাজারের দিকে। চায়ের দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চে বসে তাকিয়ে আছি---সামনে মাটিতে উবু হয়ে বসা দোকানিদের দিকে। মণিপুর-নাগাল্যান্ডের প্রমীলা রাজ্যের মত এখানেও বিক্রেতারা অধিকাংশই মহিলা। একটি মোটরসাইকেলের রিপেয়ারিংয়ের টুলস্‌ নিয়ে বসা একটি ছেলের সঙ্গে গল্প জমাই। আস্তে আস্তে ওর মত উনিশ-কুড়ি বেশ কয়জন এককাট্টা হয়। নানান গল্পের পর জিগ্যেস করি---তোমাদের নিজেদের দেশে ফিরতে ইচ্ছে করে না?
    --- মানে?
    ---কেন? তিব্বতে? ওখানে কোন জেলা থেকে তোমরা এসেছো? কোন গ্রামে তোমার দাদুর বাড়ি ছিল?
    ওরা আমতা আমতা করে। নিজেদের মধ্যে কিছু বলে হেসে ওঠে। তারপর বলে -- দেখুন, আমরা কিছুই জানি না। মানে আমাদের জন্ম এই মইনপাটে। আমরা গেছি বিলাসপুর, অম্বিকাপুর। একবার রায়পুর। আর বাবা-মার সঙ্গে ধর্মশালা মাত্র একবার।

    বাবা-মা প্রতিবছর ধর্মশালায় যায়। আমার মা অনেক ছোটবেলায় দাদুর হাত ধরে এখানে এসেছে। শুনেছি ওখানে পাথর আর বরফ। খুব শীত।খাবার কম, রাস্তাঘাট ভালো নয়। হিন্দিগান নেই। ফুটবল খেলা হয় না। জমিন এত উপজাউ নয়। গিয়ে কি করব? আমাদের জন্যে এই সরগুজা, ছত্তিশগড়ই হল দেশ।

    চুপ করে থাকি। হিসেব মেলাতে পারিনে। মনে পড়লো বিলাসপুরে আমার বন্ধু বিজয়ের আমেরিকাপ্রবাসী ডাক্তারদাদার ক্লাস সেভেনে পড়া ছেলের সঙ্গে আমার আলাপ। আমেরিকায় জন্মানো ছেলেটা ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে জানিয়েছিলো---- বিলাসপুর শহর মাঝে মাঝে বেড়াতে আসার জন্যে ভালো, কিন্তু বরাবর থাকার জন্যে নয়। সত্যিই তো, এদেশে জন্মানো আমার মেয়েরা এভ্‌রিথিং কোলকাতার জন্যে আমার টান কি করে বুঝবে?আমি নিজে দেশভাগের পর এপার বাংলায় জন্মেছি, ওপার বাংলার জন্যে কৌতূহল ছাড়া কিচ্ছু অনুভব করি না তো!

    সন্ধ্যেয় ফেরা গেল সরকারি বাংলোর আরামে। বাজার থেকে কেনা মুরগি চৌকিদার রাঁধছে, একজন ট্রান্‌জিস্টারে খবর শুনছে, বল্লো-- বেইজিংয়ে লিবারেশান আর্মি পৌঁছে গেছে, বাতাবরণ টেন্স। আমরা বলি --সব ঠিক হয়ে যাবে, কোন খুন-খারাবা হবে না।

    সবাই খেয়াল করি---হাওয়ায় হিমেল ভাব। রাত্তিরে চাদর লাগবে। জায়গাটা সমুদ্রতল থেকে কয়েকহাজার ফুট ওপরে। অথচ দ্যাখো, ছত্তিশগড়ে এখন নৌতপা বা"" সব্‌চেয়ে বেশিগর্ম ন'দিন '' এর পালাচলছে। ২৬ মে থেকে ৩জুন, এর পর বৃষ্টি নামবে। আজ ২রা জুন। তিব্বতিরা যে এখানে ঘাঁটি গাড়বে তার আশচর্য কি?

    রান্নাঘর থেকে হাল্কা হাসির আওয়াজ, গা করিনে। চৌকিদারের বৌ হয়তো। হেল্প করছে। কিন্তু খানিকপরে একি! আমাদের কামরায় এক তিব্বতি মহিলা সমভিব্যহারে আমাদের পুলিশবন্ধুটির প্রবেশ। আমি জিগাই --ইনি কে?
    মহিলাটি স্পষ্ট উচ্চারণে বল্লেন---বাবুজি, রাগ করবেন না। দারোগাবাবু আমার পুরোনো বন্ধু। যখনই আসেন আমার বাড়ি যান। উনি বল্লেন-আমার ক'জন বন্ধুএসেছে। তাই আমি সঙ্গে এলাম। আর আমার ঘরে তৈরি পুরোনো তিব্বতিমদ --আমাদের ভাষায় "রুদ্দা' বলে , খেয়ে দেখবেন। এলাকায় নাম আছে।
    আমি মহিলাকে বসতে বলে পাশের কামরায় যাই। সঙ্গে বাকি চারজন। বলি-- এটা কি হচ্ছে?
    পুলিশবন্ধুটি হে-ঁহেঁ করে বলে--- আপনি ওরকম ভাবে দেখছেন কেন? আপনিইতো বল্লেন-- আমরা প্‌ঞ্চপান্ডব, আপনিতো বল্লেন-- তিব্বতে পলিয়ান্ড্রি আছে। তা' আমি ভাবলাম--একজন দ্রৌপদী নিয়ে আসি। আজকের রাত কাটবে ভালো। কাল সকালেই তো আমরা চলে যাবো। আপনি অমন মর‌্যালিস্ট হলে--?
    আমি বল্লাম--মর‌্যালিস্টফর‌্যালিস্ট নই। কিন্তু আমি যাতে কম্ফর্ট ফিল করি না, সেটা আমার ওপর চাপাতে পার না। এখানে আসার আগে এমনিতো কোন কথা হয়নি? তাহলে?
    দারোগা-- ভেবেছিলাম, সারপ্রাইজ দেব। কিন্তু রুদ্দা চাখতে আপত্তি আছে?
    --- ঠিক আছে, একঘন্টা উনি বসুন, আলাপ করা যাক। তারপর ওনাকে যতটা প্রমিজ করে এনেছ ততটা পেমেন্ট করে টা-টা করে দাও ।আর হ্যাঁ। উনি আমাদের সঙ্গে মাংস-ভাত খেয়ে যাবেন।
    তাই হল, রুদ্দা খেয়ে সবাই গান গাইতে লাগলো।মহিলাটি মাধুরী দীক্ষিতের লেটেস্ট ফিল্মের গান বেশ সুরে গাইলেন। আমার প্রশ্ন গুলোর জবাবে প্রচুর হাসলেন। ভাবখানা --- ধান ভানতে শিবের গীত কেন?
    সাড়ে আটটা নাগাদ দারোগা বন্ধুকে বল্লাম---ওনাকে ঘর অব্দি হেড়ে এস।

    রাত্তিরে বন্ধুটি আর ফিরলো না। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে তৈরি হতে লাগলাম। সাড়ে সাতটায় বাস ছাড়বে। সোয়া সাতটায় দারোগাবন্ধু হাজির । আমরা একটু গম্ভীর। বাস সকাল নটায় অম্বিকাপুর পৌঁছ্‌লে আমাদের একজন স্টল থেকে দৈনিক পত্রিকা কিনে আনলো।হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো--- আরে কি কান্ড! আজকের হেড্‌লাইন দেখেছেন? তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে ছাত্রদের পিষে ট্যাংক এগিয়ে গেছে।

    মার্চ ২৩, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৩ মার্চ ২০০৮ | ৭৩১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন