এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • উদ্বাস্তু হওয়ার ইতিকথা

    ইন্দুবরণ গাঙ্গুলী লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৯ জানুয়ারি ২০২০ | ২০৯১ বার পঠিত
  • স্বাধীন বাংলা

    খণ্ডিত ভারতের স্বাধীনতার কথা শুনে তৎকালীন বাংলার মুসলিম নেতাদের একাংশের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল, এই ভেবে যে, পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলে বাঙালি মুসলমানদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রশাসকগণ। সুতরাং বাঙালি মুসলমানের পরাধীনতা থেকেই যাবে। তাই তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী সইদ সোরহাবর্দি, বাংলা মুসলিম লিগের সম্পাদক জনাব আবুল হাসিম প্রমুখ নেতা প্রস্তাব করেন, ভারতকে দুই ভাগ নয়, তিন ভাগে ভাগ করা হোক, যথা পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ। মোদ্দা কথা, বঙ্গভঙ্গ বন্ধ করে, বাংলাকে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশে পরিণত করা হোক। এ প্রস্তাব নিয়ে তারা সর্বশ্রী শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশংকর রায় ও সত্য বকসীর সাথে বহু বৈঠক করেন। এমনকি স্বাধীন বাংলার সংবিধান কী হবে, তার জন্য একটি সাব কমিটিও গড়া হয়। শরৎচন্দ্র বসু এ বিষয়ে গান্ধিজির সাথে সংযোগ স্থাপন করেন। গান্ধিজি বঙ্গভঙ্গ বন্ধ করার এ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন বটে, কিন্তু কংগ্রেস সভাপতি আচার্য কৃপালনী ও ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত এ প্রস্তাব ভেস্তে যায়। এ সব ঘটনাই ১৯৪৬ সনের মে মাসের।
    ৩ জুন, ১৯৪৭ সন, লর্ড মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস ও লিগের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে ঘোষণা করলেন, ভারত ও পাকিস্তানের ভিত্তিতেই ভারতকে অবিলম্বে স্বাধীনতা দেওয়া হবে। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের এই ঘোষণা এবং পরে নেহরুজির ঘোষণায় মুসলিম প্রধান এলাকার সংখ্যালঘুদের প্রতি একাত্মতার অনুভূতি জ্ঞাপনের পর বোঝা গেল, কংগ্রেস নেতৃত্ব সরকারি ভাবেই দেশভাগের শর্ত মেনে নিয়েছেন। গান্ধিজি এ বিষয়ে নীরব রইলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দেশবিভাগের এই শর্ত মেনে না নিয়ে তার উপায় নেই। অনেকে ভেবেছিলেন, গান্ধিজি আমরণ অনশন করেও দেশ বিভাগ রুখবেন। কিন্তু তা তিনি করলেন না। হয়তো তিনি বুঝেছিলেন যে, তখন আমরণ অনশনে মরণকেই বরণ করতে হত, শিষ্যদের ক্ষমতার মোহ থেকে মুক্ত করতে পারবেন না। অতঃপর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট খণ্ডিত ভারতদ্বয় স্বাধীন হল। র‍্যাডক্লিফ কমিশন দেশভাগের কারিগর নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি অভিভক্ত ভারতের বুকে নিপুণ হাতে ছুরি চালিয়ে ভারত পাকিস্তানের নতুন মানচিত্র এঁকে দিলেন।

    দুই

    পূর্ববঙ্গের প্রতিক্রিয়া

    স্বাধীনতা, পাকিস্তান ও বঙ্গভঙ্গের সংবাদে পূর্ববঙ্গের সংখ্যা গরিষ্ঠদের মধ্যে যারা একটু সচ্ছল ও কিছু লেখাপড়া করেছিলেন, মোটামুটি দৈনিক কাগজ পড়তে পারতেন অথবা সংবাদ শুনতে জড়ো হতেন, তাদের মধ্যে যেন জাদুদণ্ডের স্পর্শ লাগল। রাতারাতি তাদের মধ্যে একটা রাজকীয় আত্মসচেতনতা স্ফুরিত হল। তাদের দৈনন্দিন জীবন ধারায় একটা স্বতন্ত্রতা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অহমিকার প্রকাশ ঘটল। মসজিদে অর্ধশিক্ষিত মৌলবিসাহেবদের ডাকে ঘন ঘন বৈঠক শুরু হল। মুসলিম লিগ নেতাদের বাড়িতে লাগাতার বৈঠকি আলোচনা এবং নানাধরনের প্রশ্নোত্তর চলল। হাটেবাজারে রাস্তাঘাটে হিন্দুদের সঙ্গে কথাবার্তার ধরন পালটাতে শুরু করল পালটাতে শুরু করল ভব্যতা ও শিষ্টতার ধারা। ধান্দাবাজ যুবক ও বয়স্ক মুসলমানদের হিন্দু বাড়িতে যাতায়াত বৃদ্ধি পেল। বৃদ্ধি পেল, হিন্দুদের কাছে যথেষ্ট মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা। যেখানে তার অভাব ঘটল সেখানেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হতে লাগল যে, জমানা পালটেছে।
    সুতরাং, অপরদিকে, মুসলিমদের ওই ধরনের আচরণে, হিন্দু পরিবারের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই এসব ঘটনা নিয়ে নানাধরণের আলোচনা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে জটলা শুরু হল। বহুক্ষেত্রে গৃহকর্তার সঙ্গে পরিবারের অপর সদস্যদের মতান্তরও ঘটেছে। এতদব্যতীত প্রতিবেশী পরিবারদের মধ্যেও পারস্পরিক আলোচনা ও মতামত আদানপ্রদান শুরু হল। অনেক ক্ষেত্রে নানাধরনের অমানবিক বা অভব্য ঘটনার গুজবও, এক কান থেকে অপর কানে, সঞ্চারিত হতে শুরু করে এবং স্বাভাবিকভাবেই তাতে ভীতির সঞ্চার হত। এমনই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের হিন্দু সরকারই কর্মচারীদের অপশন দিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার ঘটনা এবং তৎস্থলে মুসলিম কর্মচারীর আগমন, হিন্দু সমাজের মানসিকতায় দুশ্চিন্তার ছাপ ফেলতে সহায়তা করল। চুরিডাকাতির ব্যাপারে অথবা কোনো মুসলমান কর্তৃক অপমানিত বা নিপীড়িত হিন্দু থানায় অভিযোগ করতে গিয়ে দারোগাবাবুদের কাছে হাসিতামাশার পাত্রও বিবেচিত হচ্ছিলেন। ফলে, হিন্দু সমাজের মানসিকতায় যথেষ্ট চাঞ্চল্য ও আতঙ্কের সৃষ্টি হল ।
    ইংরেজ আমলেও গ্রামাঞ্চলে প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব লাভে স্বচ্ছল বা প্রতিষ্ঠাবান হিন্দুগণ, অথবা তাদের প্রযত্নে, সাধারণ হিন্দুগণও এতদিন, অধিকতর সুযোগসুবিধা লাভে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রশাসন থেকে হিন্দু কর্মচারীগণের সিংহভাগ সপরিবারে ভারতে চলে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই সামাজিক প্রশাসনের হাল, ক্রমে বিপরীত দিকে ধাবিত হতে শুরু করল। এ অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলল, গ্রামাঞ্চলের হিন্দু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরও ক্রমে অজ্ঞাতসারে ভারতে সরে পড়ার ঘটনা। বলা বাহুল্য, ইংরেজ আমলে সরকারি প্রশাসনের পালটা শক্তি কেন্দ্র হিসেবে গ্রামাঞ্চলের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলসমূহ যথা, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, ফরওয়ার্ড ব্লক ও তাদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সমিতি, ক্লাব ও গ্রন্থাগার প্রভৃতি গণসংঘগুলি গ্রামবাসীদের মস্ত বড়ো সহায়ক শক্তিরূপে বিবেচিত হত। এদের পরিচালকদের ব্রিটিশবিরোধী অকুতোভয় ছিল সাধারণ মানুষের শক্তি ও সামাজিক নৈতিকতার উৎস স্বরূপ। বলা বাহুল্য এদের শতকরা ৯৯.৯ ভাগই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। আপশোশের কথা, এরা দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে তৎকালীন পরিস্থিতিতে মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন। এঁরা ঐসময়, কোনোরূপ সামাজিক দায়িত্ব পালন করলেন না। এমনকি, ভারতে চলে যাওয়ার পূর্বে, অপর হিন্দুদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা বা কোনো পরামর্শ প্রদান করলেন না। নিরপেক্ষভাবে বলতে গেলে, বলতেই হবে যে কমিউনিস্টরাই বরং তুলনামূলক ভাবে কম সংখ্যায় দেশত্যাগ করার মনোভাব ব্যক্ত করতেন। যদিও তৎসত্ত্বেও বহু কমিউনিস্ট, দলের অনুমতি ব্যতিরেকেই দেশত্যাগ করেছিলেন। কারণ, কমিউনিস্টরাও বিষয়টির উপর কোনো সামাজিক প্রচার আন্দোলন সংগঠন করার বিষয় চিন্তা করেননি। এককথায়, ওইসব রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। সাধারণ লোকের মতো এরাও ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অবশ্য আর-একটা কথা এখানে উল্লেখ করা অবশ্যই প্রয়োজন যে, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রতি পাকিস্তান প্রশাসনের সাম্প্রদায়িক মনোভাব শেষপর্যন্ত কী হবে, এদের গ্রেপ্তার করে ফেলবে কি না, তা নিয়েও একটা সন্দেহ ছিল। নেতৃস্থানীয় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকগণের গোপনে ভারতে চলে যাওয়ার পেছনে এধরনের ভীতিও কাজ করেছে নিঃসন্দেহে। আর, নেতৃস্থানীয় অধিকাংশ কংগ্রেসিদের কাছে ছিল, স্বাধীন ভারতে মর্যাদাপূর্ণ চাকুরি বা অর্থকরী সুযোগসুবিধার হিল্লে করার একটা প্রলোভনের ইশারা।
    পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হলেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, ব্যাবসা, বাণিজ্য ও রাজনীতি সর্বত্রই ছিল তাদের অগ্রগণ্য ভূমিকা। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর হিন্দু প্রভৃত্বের কথা অস্বীকর করা যায় না। অধিকাংশ মুসলমানই ছিল অশিক্ষিত ও গরিব। সম্পদশালী হিন্দু ও মুসলিমদের দ্বারা তারা শোষিত হত। নীচের তলায় এই বহুসংখ্যক মুসলিম জনতাকে সম্পদশালী মুসলিমরা মসজিদের অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত মৌলবিদের দ্বারা অনুশাষিত ও নিয়ন্ত্রিত করত প্রায় সর্বক্ষেত্রে। অবশ্য পরবর্তীকালে অর্থাৎ দেশভাগের কিছুকাল পূর্বে কমিউনিস্ট পার্টি মৌলবিদের প্রভাব কাটিয়ে গরিব মুসলিম চাষিদের সামন্তপ্রভু, সে হিন্দুই হোক, বা মুসলমানই হোক, তাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সংগ্রামে শামিল করতে প্রয়াস পেয়েছিল। যদিও সে সংগ্রাম পূর্ববঙ্গের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। কোনো কোনো অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু দেশভাগ তথা পাকিস্তান হওয়ার পর সে সংগ্রামের বিশেষ কিছু আর অবশিষ্ট রইল না।
    অর্থনৈতিক ক্ষমতা নির্বিশেষে পূর্ববঙ্গের সমগ্র মুসলিম সমাজ পাকিস্থান ঘোষণার পর যেন একটা জগদ্দল পাথর চাপা থেকে মুক্তিলাভের আনন্দে উদ্‌বেলিত হয়ে উঠল। পুরুষানুক্রমে মুসলমানগণ হিন্দু বাড়িতে যে সীমাহীন অমর্যাদা, অপমান ও অবহেলা ভোগ করেছে, পাকিস্তান হওয়ায় তাদের সেই অন্ধকারময় যুগের অবসান ঘটল বলেই তারা আনন্দিত বোধ করল। অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মুসলমানদের সেই আনন্দ প্রকাশের রীতি পদ্ধতি ও ভাষায় স্বাভাবিক ভাবেই প্রভুত্বশালী হিন্দু সমাজের মান মর্যাদাকে আঘাত করল এবং ওইসকল ঘটনায় সংশ্লিষ্ট হিন্দুগণ তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্‌বিগ্ন ও শঙ্কিত হয়ে দেশত্যাগ করাই শ্রেয় বিবেচনা করল।
    কলকাতা ও নোয়াখালির সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতা ও দেশবিভাগের সম্ভাবনায় শঙ্কিত সম্পদশালী হিন্দুগণের একাংশ পাকিস্তান প্রশাসন কায়েম হবার পূর্বেই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বিকল্প বাসস্থান নির্মাণ, বিনিময় বা বাড়ি ভাড়া করে দেশত্যাগ করেছিলেন, অথবা স্থানান্তরের জন্য, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি সম্পূর্ণ করে রেখেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রশাসন কায়েম হবার পর প্রথম দিকে স্থানীয় মুসলমানদের আচরণে মানসিকভাবে আহত হিন্দুগণ দেশত্যাগ শুরু করলেও তাদের সংখ্যা ছিল কম। সাধারণ হিন্দুদের বৃহদাংশই পুরুষানুক্রমিক বাস করা ভিটেমাটি ত্যাগ করতে দ্বিধা করেছিলেন। ভাবছিলেন, দেখাই যাক না, কী হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, মুসলমান সমাজের দরিদ্রতর অংশ যারা দিন মজুর, নৌকার মাঝি বা হাটেবাজারে তরিতরকারি বিক্রি করে কোনো রকমে পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতেন, তাঁরা কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার তাৎপর্য অনেক দিন পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারেননি। হিন্দুগণ দেশ ছেড়ে চলে যাবে এরকম প্রচার শুনে তাঁরা হিন্দুদের নানা রকম প্রশ্ন করতেন। তাঁরা ভাবতেন, তাহলে তাঁদের রুজি-রোজগারের কী হবে! হিন্দুগণই তাদের কাজকর্মের প্রধান অবলম্বন। তারা যদি চলে যায়, তাহলে গ্রাম্য শ্রমজীবী মুসলমানদের কাজ জুটবে কোথায়? তাই এরা হিন্দুদের দেশত্যাগ না করতে বহু অনুরোধ উপরোধ করেছেন। বহুক্ষেত্রে এরা হিন্দুদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।

    দেশত্যাগের উসকানি

    সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সরল আন্তরিকতা দিয়ে তো সমাজের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় না। কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন সূচিত হতে শুরু করল । স্থানীয় মুসলিম বুদ্ধিজীবীর, অর্থাৎ গ্রামের মাতব্বর সম্প্রদায়, হিন্দু সম্পত্তির উপর অধিকার কায়েম করার দ্বারা লাভবান হওয়ার প্রলোভনকে আর চেপে রাখতে পারছিলেন না। তাঁরা একদিকে জলের দামে হিন্দুদের জমিজমা ক্রয়ের প্রস্তাব দিতে শুরু করলেন এবং অপরদিকে, হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করার জন্য, অতি উৎসাহী মুসলমান ছেলেদের লাগিয়ে হিন্দু বসতিসমূহের পারিপার্শ্বিকতাকে বিষিয়ে দিতে লাগলেন। হিন্দু মেয়েদের প্রতি অশ্লীল ইঙ্গিত, নানা ধরনের গান ও ছড়া কাটা প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপ চালু করা হতে থাকল। কোথাও কোথাও হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করার প্রস্তাবও দেওয়া হল। এ সম্পর্কে শ্রদ্ধেয় হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘উদ্‌বাস্তু’ গ্রন্থে জনৈক উদ্‌বাস্তুর নিকট জানা একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। “হিন্দু মেয়েরা ঘাটে স্নান করতে গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের লোক পাড়ে এসে দাঁড়ায়। তাদের মধ্যে বয়সে নবীন যুবক যেমন আছে, তেমন বয়সে প্রবীণও আছে। দাঁড়িয়ে নাকি তারা ছড়া কেটে গান ধরে। এক পাড়ের লোক গায়, ‘পাকপাক পাকিস্তান’, অন্য পাড়ের লোক বলে, ‘হিন্দুর ভাতার মুসলমান’।
    “এই অদ্ভুত আচরণে যে মেয়েটি স্নান করতে জলে নেমেছে সে স্বভাবতই আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। নির্যাতনকারীদের মতে, তার সেই আচরণ ভারী কৌতুকবোধ জাগায়। তারা হেসে কুটিকুটি হয়। এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে না। তারপর নাকি ঘাটের দিকে একজন প্রৌঢ় পুরুষ এগিয়ে এসে বলে, “ও বিবি, বেলা যে বেড়ে চলল। আর দেরি কেন? এবার ঘরে চল।”
    সে কথা শুনে মেয়েটি ভয়ে আরও আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। আবার ওদিকে হাসির হুল্লোড় বয়ে যায়। তখন সেই প্রৌঢ় মানুষটি এক নবীন সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ওরে তোর চাচির গায়ে বুঝি খিল ধরেছে। উঠতে কষ্ট হচ্ছে। হাত ধরে তুলে নিয়ে আয়।”
    ভদ্রলোক এখানেই কাহিনি শেষ করলেন। তারপর বললেন, “এরপর আর দেশে যাব কী করে।”
    [ব্রিটিশ আমলে, বিশেষ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে যে জমিদার শ্রেণি গড়ে উঠেছিল, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন উচ্চবর্ণের হিন্দু। বাংলার সাধারণ মানুষের উপর, বিশেষ করে দরিদ্র মুসলমান প্রজাদের উপর যে অমানবিক আচরণ তাঁরা করতেন, পাকিস্তান গড়ে ওঠার সম্ভাবনায় সাধারণ মুসলমানের এ হেন প্রতিক্রিয়া নিঃসন্দেহে নিন্দার্হ, কিন্তু এ হিন্দু জমিদারদেরই পূর্ব কৃতকর্মের ফল। আরও বলার, বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমতায় আসতে চাওয়া দলগুলি তাদের স্বার্থ চরিতার্থে নানা অছিলায় এক সম্প্রদায়কে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়েছে, আজও দিচ্ছে। সম্প্রদায়গুলি এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার মাত্র।—সম্পাদক]

    তিন

    দেশত্যাগ ও উদ্‌বাস্তু আখ্যা লাভ

    এমনিভাবে এবং কোনো কোনো স্থানে সোজাসুজি হুমকি দিয়েও সংখ্যালঘুদের বিতাড়নের কর্মসূচি ওরা হাসিল করতে শুরু করে। ফলে মানমর্যাদা নিয়ে হিন্দুগণ দেশত্যাগ করাই যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করলেন। কিন্তু দেশত্যাগী হতে চেয়েও রেহাই ছিল না। দেশত্যাগের উদ্দেশ্যে ভারতে যাওয়ার পথে মুসলিম ন্যাশন্যাল গার্ড ও সরকারি কর্মচারীদের হাতে লাঞ্ছনার কাহিনিও কম মর্মন্তুদ ছিল না। দেশত্যাগীদের মালপত্র কেড়ে নেওয়া, তল্লাশির নামে মেয়েদের শ্লীলতাহানি ও ঘুষ আদায় প্রভৃতি হরেক রকম অত্যাচার ও নিপীড়ন সয়ে এসে স্বাধীন ভারতভূমির রঙিন স্বপ্নে বিভোর দেশত্যাগীগণ শিয়ালদহ স্টেশনে উদ্‌বাস্তু আখ্যায় বিভূষিত হতে লাগলেন। সকল দেশত্যাগীই যে শিয়ালদহ স্টেশনে এলেন তা নয়। অনেকে ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় প্রভৃতি অঞ্চলেও গেলেন। পশ্চিমবঙ্গে বৃহত্তম সংখ্যক উদ্‌বাস্তু সমাগম হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গেও সকলেই শিয়ালদহ স্টেশনে আসেননি। অনেকে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এবং দক্ষিণবঙ্গের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায়ও দেশত্যাগ করে এসে উঠলেন। তৎসত্ত্বেও শিয়ালদহ স্টেশনে উদ্‌বাস্তু সমাগমই ঘটেছিল সবচাইতে বেশি সংখ্যায়।

    স্বপ্নভঙ্গ

    উদ্‌বাস্তুদের অনেকেরই ভরসা ছিল যে, স্বাধীন ভারত সরকার উদ্‌বাস্তুদের স্বাগত জানাতে শিয়ালদহ স্টেশনে নিশ্চয়ই কোনো ব্যবস্থা রাখবেন। কারণ, দেশবিভাগের পূর্বে প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু, গান্ধিজি, ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রমুখ জাতীয় নেতাই ঘোষণা করেছিলেন যে, দেশবিভাগের জন্য যদি সংখ্যালঘুদের পাকিস্তানে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তাহলে, ভারতই তাদের আশ্রয় ও পুনর্বাসন দেবে। সর্বোপরি মানবতাবাদী মহাত্মা গান্ধির প্রিয় শিষ্য পূর্ববঙ্গেরই ছেলে ড. প্রফুল্ল ঘোষ তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী (তৎকালে বলা হত প্রধানমন্ত্রী)। তিনি অবশ্যই উদ্‌বাস্তুদের অভ্যর্থনা, আশ্রয়দান ও সুষ্ঠু পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! সরকারি কোনো অভ্যর্থনা তো দূরের কথা, কোনো সমাজসেবী সংস্থারও পাত্তা নেই, যাদের সঙ্গে পরামর্শ করা যায়। সমাগত উদ্‌বাস্তুরা তখন কী করবে বা কোথায় যাবে!
    স্বাধীন ভারতে অভ্যর্থনা লাভের রঙিন স্বপ্নের ঘোর কেটে যাবার পর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত উদ্‌বাস্তু, যাদের কলকাতায় আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের আস্তানা ছিল, তারা সেখানে গিয়েও উঠলেন। কিছুসংখ্যক দু-চারদিন স্টেশনে থেকেই ইতস্তত ঘুরে ঘরভাড়া করে চলে গেলেন। কিন্তু যাদের কলকতায় কেউ নেই বা আর্থিক সংগতিও নেই,তাদের স্টেশন চত্বরে থাকা ভিন্ন আর গত্যন্তর রইল না। প্রথম দিকে এদের সংখ্যা অল্প হলেও ক্রমে এদের সংখ্যাই বৃহত্তম আকার ধারণ করল এবং স্টেশন প্ল্যাটফর্ম ছাপিয়ে, ক্রমে স্টেশনের সম্মুখস্থ উন্মুক্ত চত্বরে চটের ছাউনি দিয়ে, শত শত পরিবার ঝড়, জল ও রোদে পুড়ে সরকারি দাক্ষিণ্যের প্রত্যাশায় দিনাতিপাত করতে লাগলেন। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি, ক্ষেত্র বিশেষে, মাসের পর মাসও অতিক্রান্ত হল, সরকারি দাক্ষিণ্যে ক্যাম্পে স্থানান্তরিত হতে।
    স্বাভাবিকভাবেই, তখন তাদের সভ্য-ভব্য জীবন যাপনের নিম্নতম আড়ালটুকুও মুছে গেছে। সমাজবিরোধীরা উদ্‌বাস্তু মেয়েদের উসকাচ্ছে পাপের পথে নিয়ে যেতে। এ সময়, এদের জন্য যথোপযুক্ত আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা না করে, যেসব বে-সরকারি সেবাসমিতি মাঝে মধ্যে উদ্‌বাস্তুদের চিড়া-গুড় ও খিচুড়ি, প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল দিচ্ছিল, তাদেরই একটি সংগঠনের মারফৎ মাথাপ্রতি ২০০ টাকা হারে ক্যাশডোল ও চিড়া-গুড় বিলির ব্যবস্থা করে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ড. প্রফুল্ল ঘোষ চলে গেলেন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের দেশত্যাগ না করতে অনুরোধ করতে। উল্লেখযোগ্য এই যে, ওই ক্যাশডোল ও চিড়া-গুড় বিলির ব্যবস্থাটা করা হয়েছিল সইদ সোরাহবর্দির আমলে কলকাতা ও নোয়াখালি দাঙ্গায় আশ্রয়চ্যুতদের জন্য। ড. ঘোষ সেই ব্যবস্থাটিই সম্প্রসারিত করলেন উদ্‌বাস্তুদের জন্য শিয়ালদহ স্টেশনে। আর যাদের ক্যাম্পে স্থানান্তরিত করা হত, তাদের চিড়া-গুড়ের পরিবর্তে চাল-ডালডোল দেবার ব্যবস্থা হয়েছিল।
    -------------------------------
    বইমেলায় গুরুচণ্ডা৯ থেকে প্রকাশিতব্য কল্লোল সম্পাদিত ‘ উদ্বাস্তু কলোনির কথা – একটি স্মৃতিকথা সংকলন’ন এর অংশবিশেষ
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৯ জানুয়ারি ২০২০ | ২০৯১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 172.68.146.253 | ৩০ জানুয়ারি ২০২০ ১৩:২৩90874
  • এই বইটা কিনবো ভেবে রেখেছি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন