সত্তরের দশকে কোলকাতার নকশালপন্থী আন্দোলন দমন করে এলিটবর্গের চোখে টাফ অফিসার হিসেবে খ্যাতিপ্রাপ্ত প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার রণ্জিৎ গুপ্ত নিজের মেমোয়ার্সে লিখেছেন যে সেই সময়ে মধ্যবর্গীয় নকশালপন্থী নেতারা ছিলেন রোম্যান্টিক স্বপ্নদর্শী। এঁদের সামরিক ব্যাপারে কোন সংগঠিত চিন্তাভাবনা ছিল না। ফলে দু'তিন বছরের মধ্যেই এদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু উনি খেয়াল করেছিলেন যে আশির দশকে অন্ধ্র প্রদেশে কোন্ডাপল্লী সীতারামৈয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতা বিস্তার করা পি ডব্লিউ জি বা পিপল্স্ ওয়ার গ্রুপ সামরিক ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক হয়ে প্রস্তুত হয়েছে। এরা অন্ধ্র প্রদেশের উপকূল এলাকা ধরে দক্ষিণবঙ্গে ছড়িয়ে পড়লে আগের কায়দায় নিয়ন্ত্রণ করা রাষ্ট্র এর পক্ষে কঠিন হবে। আজকে তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দশকের শেষে দেখা যাচ্ছে এটা অনেকখানি সত্যি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে সীতারমৈয়ার দলত্যাগ, ধরা পড়া ও মৃত্যুর পরে মুপল্লা লক্ষ্মণ রাও বা গণপতির নেতৃত্বে পুরনো সিপিআই (এম-এল) ও পিপলস্ ওয়ার গ্রুপের সমন্বয়ে আজকের সিপিআই(মাওবাদী) প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কথায় সবচেয়ে বড় আভ্যন্তরীণ বিপদ। অন্ধ্র-উড়িষ্যা-ঝাড়খন্ড-বস্তার-বিহার ও রাঢ়বাংলায় এদের দমন করতে তৈরি হয়েছে সংযুক্ত কম্যান্ড। অপারেশনে লাগানো হয়েছে সিআরপি, ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস্, ইন্ডো- টিবেটান বর্ডার ফোর্স ইত্যাদির সঙ্গে লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে ভারতের সামরিক বাহিনী। বস্তারের জঙ্গলে খুলতে হয়েছে জাঙ্গল-ওয়ারফেয়ারের ট্রেনিং কলেজ। আর নকশালপন্থী-থুড়ি আজকের মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ সদস্যের ডাগ আউট হল ছত্তিশগড়ের বস্তার এলাকার অবুঝমাড় । সেখান থেকেই পরিচালিত হচ্ছে আজকের সংলগ্ন রাজ্যগুলিতে ওদের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লড়াই।
কোন সন্দেহ নেই যে সামরিক প্রশিক্ষণ ও আধুনিক হাতিয়ার ব্যবহার করার ব্যাপারে বর্তমান মাওবাদীরা প্রাক্তন নকশালপন্থীদের থেকে একযুগ এগিয়ে আছে। 'তীব্র শ্রেণীঘৃণা থাকলে আদিম হাতিয়ার দিয়েও লড়াই করা যায়' গোছের চারদশক আগের নীতিতে এদের আস্থা নেই। একে ৪৭ স্তরের আধুনিক স্বয়ংক্রিয় হাতিয়ার, ল্যান্ডমাইন ইত্যাদির প্রয়োগে এরা দক্ষতা অর্জন করেছে। অ্যামুনিশনের সাপ্লাই এতটাই যে বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকারের সামরিক শক্তির সঙ্গে এনকাউন্টারে এরা কয়েকঘন্টা ধরে গোলাগুলি চালিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি চোখ টানে এদের রণকৌশল। যেভাবে প্রশিক্ষিত কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশের সার্চপার্টিকে এরা প্রলুব্ধ করে নিজেদের পছন্দমত জায়গায় এনে ঘেরাও করে মোক্ষম হামলা করেছে তা শুধু ছত্তিশগড়ের সরকার ও পুলিশবিভাগকে নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহমন্ত্রালয়কেও চিন্তায় ফেলেছে।
উপদেষ্টা হিসেবে পাঞ্জাবে খালিস্তানি দমনের সামরিক ব্লু-প্রিন্ট বানানোর জন্যে খ্যাতিপ্রাপ্ত কে এস গিলকে আনা হয়েছিল। একবছর পর তিনি ফিরে গেছেন। হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় প্যালেস্তাইনে অ্যান্টি-গেরিলা ওয়ারের অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত ইজরায়েলি অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যে আনা হবে কি না!
কোয়লিবেড়া, কোরাবোড় ও দক্ষিণ বস্তারের বিভিন্ন এলাকায় বুবি ট্র্যাপ দিয়ে সাঁজোয়া গাড়ি উড়িয়ে দেয়া ও তারপর হতভম্ব সরকারি বাহিনীর ওপর সুবিধাজনক অবস্থান থেকে গুলি চালিয়ে শেষ করে দিয়ে হাতিয়ার ও গোলাবারুদ লুঠ করে ফিরে যাওয়া-- মোটামুটি এই হল মাওবাদী আক্রমণের রণকৌশল।একেকটি হামলায় সরকারি বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা দশ-বিশ-পঁচিশ-পঁচাশ থেকে পঁচাত্তর অব্দি দাঁড়িয়েছে। বস্তারের সংলগ্ন ওড়িষ্যার কোরাপুটে কয়েকশ' মাওবাদী গেরিলার শহরে ঢুকে জেল ভেঙে বন্দীদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মত দুঃসাহসিক ঘটনাও ঘটেছে। গত মাসে ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুর থেকে প্রায় দেড়শ' কিলোমিটার দূরে মৈনপুরের কাছে কৃষকদের জমির পাট্টা ও লোন বিতরণের জন্যে আয়োজিত জনসভার থেকে ফেরার সময় মন্ত্রীর কনভয়ের ওপর হামলা হয়। অল্পের জন্যে মন্ত্রী বেঁচে যান, মারা যায় ওনার বডিগার্ড ও কিছু সরকারি কর্মচারি। জানা যায় যে হামলার পর মাওবাদী গেরিলারা যখন কাছে এসে দেখে যে পেছনের কিছু জীপে আরোহীরা সাদাপোষাকের পুলিশ নয়, সাধারণ কৃষক মাত্র, তখন ক্ষমা চেয়ে ওদের প্রাথমিক চিকিৎসা করে স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।
নিঃসন্দেহে এইসব ঘটনার প্রভাব পড়েছে সরকারি বাহিনীর মনোবলের ওপর। রাজ্যপুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব প্রকট হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জোয়ানেরা অভিযোগ করেছেন জঙ্গলে ঠিকমত রসদ, মশারি ও অ্যান্টি মসকুইটো ক্রিম না পাওয়া নিয়ে। সরগুজা জেলায় একটি কিশোরীকে গেরিলা সমর্থক অজুহাতে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে মেরে ফেলার পর গ্রামবাসীরা সরকারি বাহিনীর ক্যাম্প ঘিরে বিক্ষোভ জানায়। তদন্তে পুলিশের গল্পটি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় সরিয়ে দেয়া হয়েছে ছত্তিশগড়ের ডায়রেক্টর জেনারেল অফ পোলিস বিশ্বরঞ্জনকে।
কিন্তু ছবিটি এতটা একরঙা নয়। ভারত সরকারের গৃহমন্ত্রালয়ের তৈরি ব্লু-প্রিন্টে গত দু'বছর ধরে চলছে অপারেশন গ্রীন হান্ট।
দন্ডকারণ্যের অন্তর্গত বস্তারের অধিকাংশ এলাকা আদিম ঘন জঙ্গলে ঢাকা। আর আছে কেশকাল ঘাঁটি ইত্যাদি পাহাড়। প্রতি বর্ষায় ইন্দ্রাবতী নদী প্লাবিত হয়ে বস্তারকে কার্যতঃ দুভাগে ভাগ করে। ইতিহাসবিদ ও পুরাতত্ত্ববিদ প্রয়াত ডঃ সংকালিয়া সত্তরের দশকের শুরুতে রামচন্দ্রের লংকা আসলে দক্ষিণ বস্তার, সমুদ্র মানে বর্ষার ইন্দ্রাবতী নদী, আর রাক্ষস মানে উত্তর ভারতীয়দের চোখে বস্তারের জঙ্গলের আদিবাসী -- এইসব বলে ব্যাপক বিতর্ক শুরু করেছিলেন।
অপারেশন গ্রীন হান্ট মানে এই ঘনসবুজ এলাকাকে মাওবাদীদের হাত থেকে মুক্ত করা।
তার জন্যে স্ট্র্যাটেজি হল এক, গ্রামগুলো যাতে মাওবাদীদের সাপ্লাই বেস না হয় তার জন্যে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে মার্কিন সেনার ব্যবহার করা কায়দায় স্ট্র্যাটেজিক হ্যামলেট বানিয়ে তাতে গ্রামবাসীদের আলাদা করে রেখে স্পেশাল পুলিশ ফোর্স বা স্থানীয় যুবকদের হাতে বন্দুক দিয়ে ওদের দিয়ে নজরদারি করানো। দুই, মাওবাদীদের শহুরে নেটওয়ার্ককে নষ্ট করা; সিমপ্যাথাইজারদের চিহ্নিত করে ব্যাপক জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিষ্ক্রিয় করা। তিন, মাওবাদীদের হিংসা, সন্দেহের বশে আদিবাসীদের নির্বিচারে মেরে ফেলার ঘটনাকে প্রচারের আলোয় এনে মাওবাদীদের 'গরীবের ভগবান' জাতীয় ভাবমূর্তিটিকে মিথ প্রতিপন্ন করা। চার, যে সব ব্যবসায়ীরা বা বড় শিল্পপতিরা মাওবাদী এলাকায় নিজেদের ব্যবসা- বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার জন্যে মাওবাদীদের সমানান্তর প্রশাসনকে প্রোটেকশন মানি বা ট্যাক্স দিচ্ছে তাদের কোণঠাসা করে মাওবাদী আন্দোলনের আর্থিক সাহায্য বন্ধ করিয়ে দেয়া।
অনেক বুদ্ধিজীবি অভিযোগ করেছেন অপারেশন গ্রীন্হান্টের আসল উদ্দেশ্য ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের ও বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনালদের জন্যে বস্তারের খনিজ সম্পদ লুঠের দরজা খুলে দেয়া। ওনাদের কথা অনুযায়ী মাওবাদী আন্দোলন আসলে এই মাল্টিন্যাশনালদের রাক্ষসী আগ্রাসন থেকে বস্তারের বনজ ও খনিজ সম্পদ রক্ষার জন্যে আদিবাসী মারিয়া-মুরিয়া জনজাতির প্রতিরোধ। এই অভিযোগপত্রে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আছেন লেখিকা অরুন্ধতী রায়, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী গৌতম নওলাখা, অর্থনীতিবিদ অমিত ভাদুড়ি, দিল্লির অধ্যাপক ও মানবাধিকার কর্মী নন্দিনী সুন্দর, পরিবেশবাদী মেধা পাটকর ও অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবি। আপাত দৃষ্টিতে কথাটা সত্যি মনে হয়। বস্তারের জঙ্গলে ইস্পাত শিল্পের জন্যে বিশাল জমি অধিগ্রহণ করেছে টাটা ও পাওয়ার-জায়ান্ট এস্সার গ্রুপ। শোনা যায় সলওয়া জুড়ুম , যার স্থানীয় হাল্বী ভাষায় অর্থ 'সার্বজনীন শান্তি', নামের মাওবাদী-প্রতিরোধী আন্দোলনের পেছনে এদের আর্থিক সাহায্য কাজ করছে।
টাকার উল্টোপিঠটি দেখা যাক। সিপিআই(মাওবাদী) দলের রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টো , যা কি না অন্তরজালের পাতায় সহজলভ্য, বলছে ওরা ক্ষমতায় আসলে পরে ভারতকে শত্তিশালী শিল্পোন্নত দেশ বানাবে। এর সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের যেকোন ওয়েলফেয়ার স্টেটের পক্ষে সওয়াল করা যেকোন রাজনৈতিক দলের ম্যানিফেস্টোর কিছু পলিটিক্যাল জার্গন ছাড়া মৌলিক তফাৎ কোথায়! আর প্রাকৃতিক সম্পদকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার না করার কথা কোথাও বলা নেই। তাহলে? আবার এদিকে ঘটেছে একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। এস্সার কোম্পানী থেকে মাওবাদীদের নিয়মিত টাকা পৌঁছানোর এজেন্ট ঠিকাদার বি কে লালাকে পুলিশ মাওবাদী প্রতিনিধির হাতে ১৫লাখ দেয়ার সময় বামাল গ্রেফতার করেছে।তারপর পুলিশ দন্তেওয়াড়া জেলার কিরন্দুলে এস্সার কোম্পানীর হেডকোয়ার্টারে গিয়ে ওদের জেনারেল ম্যানেজার ডি এস সি বি বর্মাকে ইন্টারোগেট করেছে। বিগতস্থানীয় স্টেট ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের লেনদেন পরীক্ষা করে দেখেছে।
বিগত ১৩ সেপ্টেম্বরে মাওবাদী আন্দোলন প্রভাবিত ৬০ জেলার কলেক্টরদের নিয়ে এক ওয়ার্কশপে কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রী চিদাম্বরম জানাচ্ছেন যে মাওবাদী হামলায় মারা গেছে ২৯৭ জন, আর অন্য টেররিস্ট হামলায় ২৭ জন এবং উগ্রবাদী হামলায় ৪৬ জন। তাই একদিকে চিদাম্বরম মাওবাদীদের অস্ত্রসমর্পণ বা রাজনৈতিক বিচারধারা বর্জনের মত পূর্বশর্ত ছাড়াই আলোচনার টেবিলে বসতে আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে রাজধানী রায়পুরের মানা বিমানবন্দরের কাছে ৪০০ একড় জমি নিয়ে তৈরি হবে এয়ারফোর্সের বেস স্টেশন। আরেকটি হবে ভিলাইয়ের কাছে নন্দিনীতে। ইতিমধ্যেই লজিস্টিক সাপোর্টের নামে রায়পুরে স্থাপিত হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১) ছত্তিশগড়-ওড়িষ্যা সাব-এরিয়া হেডকোয়ার্টার,২) টেরিটোরিয়াল আর্মি বেস্, ৩)ইন্ডিয়ান মিলিটারি স্কুল, ৪) জাঙ্গল ওয়ারফেয়ার ট্রেনিং সেন্টর(নারায়ণপুর, বস্তার), ৫) ২১০০ একর জমি নিয়ে কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি ট্রেনিং সেন্টর, সরাইপালী।
বর্ষা চলে যাচ্ছে। নতুন ডিজি নবানীর সঙ্গে প্রথম সমীক্ষা বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী রমণ সিং বলছেন-- জঙ্গল মেঁ ঘুসকর মারো নকসলিয়োঁ কো। রাজ্যের গৃহমন্ত্রী ননকীরাম বলছেন যে সরগুজা জেলায় মাওবাদীদের নিকেশ করার কাজ সম্পূর্ণ। এবার বস্তারের পালা।
এবার মাওবাদীদের ক্ষয়ক্ষতির দিকটা দেখা যাক। কেন্দ্রীয় কমিটির তাত্ত্বিক নেতা কোবাড গান্ধী জেলে, নাগপুরের দলিত বস্তিতে দীর্ঘদিন কাজ করা ওনার স্ত্রী অরুন্ধতী গান্ধী বস্তারের জঙ্গলে অপুষ্টি ও চিকিৎসার অভাবে যক্ষ্মায় মারা গেছেন। ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় রাস্তা তৈরি করতে ভারপ্রাপ্ত চেরকুরি রাজকুমার 'আজাদ'কে কথিত এনকাউন্টারে মেরে ফেলা হয়েছে। কোলকাতার নারায়ণ সান্যাল বা 'বিজয়' সত্তর বছর বয়সে ছত্তিশগড়ের জেলে আজীবন কারাবাসের দণ্ডভোগ করছেন। যদিও সুপ্রীম কোর্ট সলওয়া জুড়ুম আন্দোলন এবং নিয়মকানুনের বাইরে আইন শৃংখলা রক্ষার জন্যে আদিবাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়াকে বে-আইনী ঘোষণা করেছে, কিন্তু ছত্তিশগড় সরকার পুরোনো এসপিও দের নতুন বাহিনীর নামে নিয়োগপত্র দিয়ে বৈধতা দিচ্ছে।
সবচেয়ে লোকসান বোধহয় এই যে ব্যাপক ছত্তিশগড়ের সমতলে জনসাধারণের মধ্যে, বিশেষত: কৃষকদের মধ্যে মাওবাদী আন্দোলনের কোন সমর্থন নেই। বিশ বছর আগে বস্তারের তেন্দুপাতা ঠিকেদারদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের মজুরি বাড়ানোর আন্দোলন, আদিবাসী মহিলাদের ওপর বহিরাগতদের যৌনশোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ ইত্যাদির মাধ্যমে মাওবাদীরা আপামর জনসাধারণের মনে একটি শ্রদ্ধার আসন পেয়েছিল। আজকে নির্বিচারে গাঁয়ের লোকদের সন্দেহের বশে হত্যা, পুলিশের চর অভিযোগে বিরোধী রাজনীতির লোকদের গলাকাটা সমতলের লোকদের কাছে মাওবাদীদের ভয় ও ঘৃণার পাত্র করে তুলেছে।
সমতলের কৃষকদের জন্যে কোন আন্দোলন মাওবাদীরা করছে না, ওদের কোন সংগঠন নেই। তাই এতদিন গরীবের জন্যে কাজ করেও মানবাধিকার কার্যকর্তা ডঃ বিনায়ক সেন সুপ্রীম কোর্টে জামিন পেলেও রায়পুর শহরে থাকতে পারছেন না। রাজদ্রোহের অপরাধী নকশাল নেতা নারায়ণ সান্যালের চিকিৎসার জন্যে ওনার জেলের মধ্যে তিরিশবার দেখা করা সাধারণ লোক মেনে নিতে পারছে না। ব্যাপারটা এখন দুদিক থেকেই 'আমরা-ওরা'য় দাঁড়িয়ে গেছে। মাওবাদীরা বস্তারে ইন্সট্যান্ট জাস্টিস (খানিকটা দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ গোছের) দিয়ে জনতার রক্ষক হয়েছিল। আজ ওদের ক্যাঙ্গারু কোর্ট (অরুন্ধতী রায় যাই বলুন) ছত্তিশগড়ে বিবমিষা তৈরি করেছে। ফলশ্রুতি- সমতলে জন আন্দোলনের স্পেস ভীষণভাবে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এখানে এখন মানবাধিকারের কথা বলা অপরাধ। অধিকাংশ এনজিও সন্দেহের তালিকায়।
আর বস্তারের জনগোষ্ঠি মারিয়া-মুরিয়া-বাইসন মারিয়ারা বিস্তীর্ণ ছত্তিশগড়ের ওরাঁও-গোঁড়-কঁওয়র-বিঁঝওয়ার ইত্যাদি আদিবাসীদের থেকে মূলত: আলাদা। বস্তারের উপভাষাও ছত্তিশগড়ি নয়, হল্বী। ওটা অন্ধ্র এলাকার তেলেগু ভাষার সঙ্গে মেলে। তাই শংকর গুহনিয়োগী ও যোগী রায়েরা সত্তরের দশকে বস্তারে ঘাঁটি বানাতে ব্যর্থ। একই কারণে নব্বইয়ের দশকে অন্ধ্র প্রদেশে গ্রে-হাউন্ডের তাড়ায় পুরনো নকশাল আন্দোলনের ঘাঁটি শ্রীকাকুলাম,খাম্মাম আদি থেকে লং মার্চ করে দক্ষিণ বস্তারে ঘাঁটি গড়ে তুলতে পেরেছেন গণপতি-কিষেণজীরা। আজ ওদের সর্বভারতীয় হেডকোয়ার্টার হল বস্তারের অবুঝমাড়, যেখানে কয়েকদশক আগে আদিবাসীদের ঘোটুল প্রথা বা কিশোর-কিশোরীদের একসঙ্গে একধরণের কমিউনে থেকে সাবালক হয়ে ওঠার প্রথা নিয়ে ফিলিম বানাতে বিবিসির লোকজন এসেছিল।
সব মিলিয়ে ছত্তিশগড়ে বর্তমান মাওবাদী আন্দোলনের ছবিটা কী? কিইবা এর ভবিষ্যত? ব্যাপক ও উচ্চপর্যায়ে নিয়ে গেছে। অন্ধ্র প্রদেশের ভারভারা রাও বা গদ্দারের মত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের লোক এখানে সামিল হন নি। ওদের আন্দোলন বস্তারের দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলের টেরেন ছেড়ে সমতলে ছড়াতে পারছে না। কেমন যেন শ্রীলংকার লিট্টে আন্দোলনের শেষ দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্র দিয়ে ঘেরা জাফনা আর সমতল ও শিল্পাঞ্চলের বিস্তার দিয়ে ঘেরা বস্তারের পরিণতি একই। চিদাম্বরমরা ভেতরে তলোয়ার শানাচ্ছেন আর বারবার নিঃশর্ত আলোচনার কথা বলে যাচ্ছেন। উদ্দেশ্য সরকারের তুলনায় মাওবাদীদের একগুঁয়ে, অমানবিক প্রতিপন্ন করা। যাতে আগামী মিলিটারি অপারেশনের সময় মাওবাদীরা কোথাও কোন সহানুভূতি না পায়। আজকের বস্তারে একদিকে সরকারি বাহিনী ও এসপিও, অন্যদিকে মাওবাদী গেরিলারা। মাঝখানে জাঁতা কলে পিষছে আদিবাসীরা।
স্থানীয় কবি শাকির আলীর ভাষায়ঃ
তুমি কোন দলে -- মাওবাদীদের?
-- না।
তবে কি সরকারের ?
-- তাও নয়।
আমি হচ্ছি সেই আদিবাসী বুড়ো,
যে বসে আছে পুড়ে যাওয়া কুঁড়ে ঘরের সামনে।
যার একছেলে গেছে পুলিশের গুলিতে, আরেকটি মাওবাদীদের।
যে ভুলে গেছে নিজের অতীত,
যার ছানিপড়া চোখে ধরা দেয় না ভবিষ্যৎ।
(পরের পর্বে সমাপ্য)
পূর্বপ্রকাশ ঃ 'আজকের দিন'