এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • হস্তিমূর্খের বিমান দর্শন

    হস্তিমূর্খ লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২২ নভেম্বর ২০০৯ | ১৮১৫ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • হস্তিমূর্খের চোখের উপরেই কত কি বদলে গেল! বিমানবন্দরের ভোরের ব্যস্ততাটাও কেমন এখন অন্য রকম লাগে। আগে মধ্যবিত্ত বিমান যাত্রাকে একটা "অভিজাত' মার্কা লাগাতেন। উত্তর-পূর্বে থাকার সুবাদে হস্তিমূর্খকে হাফ প্যান্টুল পরেও বহুবার প্লেনে চরতে হয়েছে। এ জন্যে হস্তিমূর্খের বন্ধু লেভেলে বেশ সমাদর ছিল! বিমান বালিকার থেকে পাওয়া সুগন্ধি ভিজে ভিজে কাগজ, মানে "ফ্রেশনার' কোনো কোনো বন্ধুর হাতে তুলে দিলে সে বর্তে যেত। নাকের কাছে ধরে বা মুখে লাগিয়ে এমন একটা মুখভঙ্গি করত যেন বিলেত পৌঁছে গেছে। ভোম্বল একবার বালিশের তলায় অমন একটা সুগন্ধি ভিজে ভিজে কাগজ মাস কয়েক রেখে দিয়েছিল আর পরে বলেছিল "অনেকদিন গন্ধ ছিল জানিস তো!' অমন করে পরবর্তী জীবনে সে প্রেমিকার চিঠি রাখত কি না সন্দেহ!

    আগে আমাদের দমদম বিমানবন্দর একেবারেই অন্যরকম ছিল। আজকের মত এস আকারের লম্বা কিউ পরতো না। হাল্কা কুয়াশা মাখা ভোরের শহরতলি। বাতাসটা এখনকার চেয়ে বেশ কয়েক গুণ সতেজ আর তরতাজা। একটা লম্বাটে সাদা দুই বা তিনতলা বাড়ির একদিকে আন্তর্জাতিক, অন্যদিকে আন্তর্দেশীয় ব্যবস্থা। বেকন লাইট লাগানো কন্টোল টাওয়ার যা ছিলো পাঁচ ছ তলা উঁচু! আজকের গেমস খেলা বাচ্চাদের কিছুতেই তা আকর্ষণ করত না। কিন্তু ঘাসে ছাওয়া কাঁটাতারের পাশে টিনের চাল ঢাকা উত্তর-পূর্বী বিমানবন্দর থেকে এসে তাই দেখেই তাক লেগে যেতো। এখনকার মতো রংবেরং এর জামা পরা কাঁচা বয়েসের ছেলেমেয়ে বা কাউন্টার ছিলো না। গুটি কয়েক সাদার উপর কমলা অক্ষরে লেখা কাউন্টার, পাশে অ্যাভারির গোল কাঁটাওয়ালা মেক্যানিকাল ব্যালান্স। তার সামনে বাসের নম্বরের মতো বোর্ড ঝুলত "ডিব্রুগড়', "গৌহাটি', "জোড়হাট', বা "আইজল'। নাতিদীর্ঘ লাইনে যারা দাঁড়াতেন তারা একান্তই সাধারণ চেহারার কিছু মুখ। দু-একজন লাইসেন্স রাজের তল্পিবাহক সাফারি পরিহিত সবজান্তা অফিসার। বেচুতে বেচুতে দুনিয়া তখনও ভরে ওঠে নি। কনিষ্ক তখনো মাঝ আকাশে উড়ে যায় নি। অকাশ সন্ত্রাস কথাটা অজানা ছিলো। কালেভদ্রে দু একটা হাইজ্যাক হত বটে কিন্তু অনেকটা জায়গা জুড়ে এক্স-রে স্ক্যানার তখনও বসেনি। কলকাতায় কনভেয়ার বেল্টের দিকে তাকিয়ে আমরা "থ' হয়ে যেতাম। চলন্ত বেল্টে ঘুরে চলেছে দড়িবাঁধা ট্রাঙ্ক, একঝুড়ি আনারস, বা চটা ওঠা কিট ব্যাগ! ঝকঝকে নামের মার্কা দেওয়া ট্রলিব্যাগ বা ফ্যাশন দুরস্ত জিরো ফিগারের কাঁধঝোলা তখনও মাতৃগর্ভেও আসেনি! উত্তর পূর্বে তো একখানা ট্রাক্টর অতি সাধারণ ভাবে দু-একটা ঠেলা চাপিয়ে সুটকেশগুলো একটা বারান্দায় গাদা করে ফেলতো আর হস্তিমূর্খের বাবা-মার মতো কিছু ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা খুঁজে খুঁজে নিতেন।

    তবে আপন গড্‌! চোখ টেরে যেত যদি কাউন্টারে দিল্লী বা বম্বের বোর্ড পড়ত। নিমেষে প্রচুর লোকের লম্বা লাইনে জায়গাটা যেত ভরে আর তাদের চেকনাই ছিলো আলাদা। অধিকাংশই ঘুম ভাঙা বিরক্ত মুখ, লাল চোখ। একা মেয়ে ট্রলি ঠেলে চলেছে। বাঁ হাতে পেপারব্যাক। পরনে জিনস্‌ ও ডোরাকাটা ক্যাসুয়াল গেঞ্জির মত টি-শার্ট। আমাদের মতো উত্তর-পূর্বের গাঁইয়ারা এমন দৃশ্য খুব বেশি দেখে নি। তারা অধিকাংশই একটা দল বা ছুটিতে বাড়ি যাওয়া ছাত্র-ছাত্রী। ক্যাসুয়াল এর কন্সেপ্ট তখনও তাদের মধ্যে আসেনি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্লেনে চড়ার মত কাজ কি করে কারোর কাছে বিরক্তিকর হয়, হস্তিমূর্খ অবাক হয়ে ভাবতো। পরে অবিশ্যি গুরুজন স্থানীয় এক জন উর্ধ্বতনের কাছ থেকে হস্তিমূর্খ শুনেছিল, জে এফ কে থেকে নাকি একটি বিমান সূর্য ওঠার সময়ে অমন সারি সারি লাল চোখো কে নিয়ে ওড়ে, আর সূর্যটাকে প্রায় ঘাড়ে চাপিয়ে লস এঞ্জেলেস নিয়ে যায়! সেখান থেকে সে যখন ফেরৎ আসব আসব করছে তখন ক্যালিফোর্নিয়াতেও সূর্যদেব উঠি উঠি, অর্থাৎ তার গর্ভে তখন আরো একদল লাল চোখো। এ কারণে এই উড়ানের নাম নাকি রেড আই ফ্লাইট!

    তখন ছিলো সরকারি ভারতি হাওয়ার একছত্র রবরবা। কালো প্যান্ট সাদা শার্ট পরা কিছু লোক। তাদের মধ্যে কারো কারো কাঁধে মানে না বোঝা কিছু তারা। ওয়াকি টকি ওয়ালাদের টারম্যাকের আগে দেখা যেত না। বিমান বালিকা মাত্রই শাড়ি, তাদের নামাঙ্কিত লম্বাহাতা ব্লাউজ ও একটা খুদে প্লাস্টিকের বাস্কো। দেখে বেশ ভারতি হাওয়ার ভারতীয় বিমান বালিকা মনে হত। মালপত্র বিমানে তুলে দেওয়ার পর সিকিউরিটি চেক তখনও হত। মেটাল ডিটেক্টার সেই প্রথম দেখল হস্তিমূর্খ। কখনও সখনও একটু লজ্জাও হত। হাতব্যাগ ভর্তি থাকতো মামাবাড়ি থেকে দেওয়া পটল, বিট গাজর বা ক্যাপ্সিকাম যা গন্তব্যে অমিল ছিলো। লাগেজে সেসব দিলে চটকে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। আমার এক বন্ধুর পশুপ্রেমী ভাই নাকি সগর্বে একবার বোতলে ভরা লাল-নীল মাছ, আর একবার একহালি লোটোন পায়রা হাতে বিমানে চেপেছিল।

    উড়ো জাহাজের চেহারাও কত বদলালো হস্তিমূর্খর চোখের উপরে! সুরক্ষা বেড়া পার করে (তখনও তা সুরক্ষা জাল হয়ে ওঠে নি) দেবার পরে যে সাধারণ চেহারার বাসগুলো বেশ খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিত, সেখানে গুটিকয় কমলা ন্যাজওলা ফকার ফ্রেন্ডশিপ দাঁড়িয়ে থাকত। তার পশ্চাদ্দেশে ভিটি ডক বা ভিটি ডম ইত্যাদি দুর্বোধ্য কিছু লেখা থাকত। গোড়াতে বোয়িং বা এয়ারবাস ইত্যাদি ন্যস্ত ছিলো দিল্লী বা বোম্বাই এর জন্য। তাদের চেহারা দেখে তাক লেগে যেত। এদের পোশাকি নাম ছিলো ট্রাংক রুট এর এয়ারক্রাফট। যখন আমাদের উত্তর-পূর্বের নিরুত্তাপ শান্ত মফস্বল রূপ রাজধানী শহরটাতে বোয়িং সাতশো সাঁইত্রিশ চালু হল, তখন লোকজন বোয়িংয়ে টিকিট কাটার জন্য একরকম ক্ষেপে উঠেছিল। বোয়িং এর টিকিট শেষ হয়ে গেলে কিছু মানুষ সদ্য পরাজিতের মতো মুখ করে ফকারের টিকিট নিয়ে বাড়ি ফিরত। সেসব বিমানগুলি আমাদের পাড়ার রিক্সার মতো পোষা ছিল! এখনকার সস্তা উড়ানের মতো শুকনো ছিল না। চেপে বসলে জল-নাস্তা পাওয়া যেত। আনারস বা কমলার জ্যুস ও মিলত। দু-একজন অত্যুৎসাহী যাত্রী কে একাধিকবার বিমান বালিকার কাছ থেকে মুফতি চা ও চাইতে দেখেছি। বিরক্ত মুখে হলেও তাঁরা তা দিতেন ও। এখনকার মতো ট্রলি ঠেলে খাবার বা জিনিস বিক্রি করা হত না। নানা সময় কাগজ-টাগজ এ ভারতি হাওয়ার বিমান বালিকাদের নিয়ে নানারকম লেখাপত্র হলে কী হবে, তাঁরা দিব্যি ভালো লোক ছিলেন। সেই যে হস্তিমূর্খের বোন গোমূর্খ, যে আদ্যিকালের মত তার মামাবাড়িতে মানুষ হচ্ছিল, বহুবার মার জন্য কান্নাকাটি করে একা একা ভারতি হাওয়ার বিমানে, বুকে একটা আন্‌অ্যাকমপ্যানিড চাইল্ড ব্যাজ লাগিয়ে আমাদের শহরের এয়ারপোর্ট পর্যন্ত চলে আসত, তার পুরো দায়িত্ব তো ভারতি হাওয়ার বিমান বালিকারাই নিতেন। বাড়ি থেকে ফিরে যাওয়ার সময় যখন সে কেঁদে ভাসাত তখন তাকে সামলে সুমলে লজেন্স খাইয়ে দম্‌দম্‌ অবধি পৌছনোর কাজটাও তাদেরই ছিল।

    বিমান যাত্রাকে ঘিরে অনেক মজার মজার অলীক গল্প হওয়ায় ভাসত। মানুষজন তো এতটা গ্যাজেট প্রেমী আর বোতাম নির্ভর হয়নি। একটি যুবক নাকি বিমান বালিকাকে ডাকার বোতাম টিপে ভয় পেয়ে জ্বলন্ত বোতামের দিকে তাকিয়ে ছিল। বিমান বালিকা এসে তাকে চোস্ত ইংরেজীতে ডাকার কারণ জিজ্ঞাসা করে। আরো ঘাবড়ে গিয়ে যুবকটি খাস বাংলা অর্থাৎ কি না চোস্ত বাঙাল ভাষায় উত্তর দেয় "কম্বলটা পাইড়া দ্যান, শীত লাগে'। বিমান বালিকাদের প্রথম ভাষা ছিলো ইংরেজী । দ্বিতীয় হিন্দী। বাংলা নৈব নৈব চ বা যৎসামান্য। যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য যে আন্তর্জাতিক উড়ানেও বাংলা ব্যবহৃত হয়, তা হস্তিমূর্খ পরে তার প্রভুদের বৃটিশ এয়ারে দেখেছে। আরো একটা গল্প ছিল আমাদের পাড়ার একটি বাহুবলী দাদা বিমানের শৌচালয়ে ঢুকে বেরোনোর দরজাটি খুলতে পারছিলেন না। ওটা তাঁর দেখা কোন দরজার বিভাগেই পড়ে না। তখন তিনি স্থান-কাল-পাত্র-পাত্রী ভুলে বিমান বালিকাকে নার্স নার্স নার্স বলে চেঁচিয়ে ডেকেছিলেন। এক বৃদ্ধা নাকি উত্তর-পূর্বের প্রবল বর্ষাকালীন উথাল পাথাল আকাশে ভয় পেয়ে "হরে হরে তিনি তিনি' জপ করেছিলেন। হরে র পরে যা বলা হয় তা তো তাঁর স্বামীর নাম। তিনিই বা কি করেন!

    আমাদের এ হেন পোষা ভারতি হাওয়া, আমাদের ভুগিয়েছে কম নয়। বর্ষাকালটায় কবে যে কলকাতায় পৌঁছব ঠিক থাকত না। রাতে ওঠা নামার প্রশ্নই ওঠে না। টানা বেশ কদিন গেল উড়ান বন্ধ। এয়ারপোর্টে পা রাখবার জায়গা নেই। সকালের বিমান বার দশেক বিলম্বিত লয়ে আসবে ঘোষিত হওয়ার পর কলকাতা এসে পৌঁছলাম রাত সাড়ে দশটায়। উড়ানটা কতোক্ষণের? ৪৫ মিনিট! যৎসামান্য কিছু সমস্যা ঘটলেই উড়ান বাতিল। উত্তর-পূর্বে হলে তো ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন মানে বাড়ি। লোকজন কেমন একটা হাসিহাসি মুখ করে তাকাত আর গা জ্বলে যেত। ওটাই কলকাতায় ঘটলে এলাহি ব্যাপার হত। মানে ভারতি হাওয়ার পয়সায় হোটেলে বাস। তাও তিন তারা এয়ারপোর্ট অশোক। হস্তিমূর্খ তো বিয়ে করে তার গিন্নি গণ্ডমূর্খ কে নিয়ে যাবার দিন বিকেলে বিমান গেল বাতিল হয়ে। একদিকে তিনতারার সুখ, অন্যদিকে বর-বৌ হীন বৌভাত উদযাপনের আশঙ্কা! সে এক চিলু বিলু অবস্থা। তাই সে সময় সকালের উড়ানের চাহিদা ছিল বেশি। একটা কনসেপ্ট ছিল আর কোন বিমান উড়ুক না উড়ুক সকালের ফ্লাইট যাবেই। আমাদের সাথে দূর উড়ানের ট্রাঙ্করুটের যাত্রীরা ছিলো একেবারে আলাদা। তারা অধিকাংশি লাইসেন্স রাজের ধ্বজাধারী তোম্বামুখো লোকলস্কর, এল টি সি ওয়ালা বা ব্যস্ত ব্যবসায়ী। এরাই ভারতি হাওয়ার ওরকম হাই প্রাইস বিমানে উড়তেন। আর আমরা ছিলাম ভর্তুকি সেক্টরের হরিদাস গুরুদাস।

    অর্থনীতির পরিবর্তন এর সাথে সাথে কত বদল এল। এখন বিমান যাত্রা তার এলিট ট্যাগ হারিয়েছে। এখন পাড়ার পুজো কমিটির ভূলো বা বাবলাও "ডিল' দিলে পাটায়া ঘুরতে যায়। বিমানবন্দর গুলো যাত্রীর ভারে বিপর্যস্ত। দৈত্যাকার হয়েও তারা দেশসুলভ ভিড়াক্রান্ত। সকালে ফুটবল মাঠের মতো লম্বা কিউ! অসাধারণরা সাধারণের সাথে একই লাইনে। বাইরে মেহেঙ্গা - আম বিমান কম্পানি আলাদা হলেও ভিতরে সকলে সমান রাঙা। শুধু চকচকে স্যুট বা চোস্ত বোলচাল আর গলাবাজি থেকে বোঝা যায় তিনি আসলে হনু। এক ঘন্টার যায়গায় দুই ঘন্টা আগে বিমানবন্দরে পৌঁছানোর আর্জি জানায় ক্যারিয়ারেরা।

    নিরাপত্তার বাড়াবাড়িতে বিরক্ত হয়ে মুক্তি পাবার পরেও দেখা যায় বসার জায়গা নেই। গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে বহু মানুষ। স্কার্ট ব্লাউজ পরা জিরো ফিগারের দিকে পৌঁছতে চাওয়া তরুণীরা আর চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামানো তরুণেরা ওয়াকি টকি হাতে ভিড়ের লাইনে ঘুরঘুর করে। ডাকে "চেন্নাই চেন্নাই' বা "মুম্বাই / আমদাবাদ'। উদ্দেশ্য লাইনের পশ্চাতে দাঁড়ানো তার বিমানের যাত্রীদের বেলাইন করে সামনে নিয়ে যাওয়া। তার সাথে জড়িয়ে আছে তার বিমানের কম সময় গ্রাউন্ডে থাকা। মানে কম পার্কিং খরচ মানে ইয়ে, কম্পানির মুনাফা! আগে এমনটা ছিল না। প্রথমবার প্লেনে চড়া দু-একজন যাত্রী নাকি ইচ্ছে করে দেরী করত যাতে তার নাম অ্যানাউন্স করে বলে "মিস্টার দিলীপ দেবনাথ - দিস ইস দ্য লাস্ট কল ফর বোর্ডিং - ' ইত্যাদি ইত্যাদি। আর ভোলা যায় না সদ্য ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বিমানে বসার খানিক পরেই, সদ্য উড়ে স্টেডি হওয়ার সাথে সাথে, ভারতি হাওয়ার মোড়ক লাগানো লজেন্স, ফ্রেশনার, কানের তুলো, মৌরি হাতে বিমান বালিকার সেই ট্রে খানি।

    ভারতি হাওয়ার সারি সারি কাউন্টার এখন শূন্য পড়ে থাকে। কেমন একটা দীর্ঘশ্বাস ভাসে ঐ অঞ্চলটাতে। নানা রংয়ের চকচকে কম পয়সার উড়ানে এখন লম্বা লাইন। ভারতি হাওয়ার অতগুলো কাউন্টারে এখন একটি বা দুটি কর্মী। কেমন একটা রং চং করা জলসাঘরের কনসেপ্ট। তাহলে কি সবই পাল্টেছে? না তো! রানওয়েতে ওঠার আগে বিমান যখন দু দণ্ড জিরোয়, দেখি পাশের মাঠ সাদা কাশে ছেয়ে গেছে। তারা মৃদু হাওয়ায় মাথা নাড়িয়ে কেমন টা টা বাই বাই করছে। আর রানওয়ের সারি সারি আলোগুলো সোজা মধ্য রাত্রির ছায়াপথের মত চলে গেছে। এ পথ গেছে কোনখানে? সেই আলোগুলো ঠিক ছেলেবেলার মতোই আকর্ষণীয়। আলোকিত আদিগন্ত এক অজানা সরণী।

    আমি বড় হয়ে গেছি। আমার ছোটবেলার উত্তর-পূর্বের নিরুদ্বেগ মফ:স্বল ছেড়ে চলে এসেছি বহুদূর। আর যাওয়া হয় না। তবুও যখন প্রবল গতি শরীরে অণু-পরমাণুতে ছড়িয়ে যায়, মনে হয় এই তো আর একটু পরেই পাতার শিরার মতো চোখে পড়বে বাংলাদেশের নদীগুলো। পরিষ্কার দেখা যাবে পদ্মা আর মেঘনার রাক্ষুসে সঙ্গমস্থল। ছোটবেলা যে জায়গাটাকে চাঁদপুর বলে চিনতাম। যেখানেই যাই না কেন আর একটু পরেই তো সবুজ ত্রিপুরার নিচু পাহাড়গুলো আর ল্যাটেরাইটের রঙের এঁকে বেঁকে যাওয়া লাল রাস্তা। দ্বীপের মতো গাঢ় সবুজ বাঁশঝাড় ঘেরা গ্রাম, আর ছোট্ট ধানক্ষেত ভর্তি টিলা ঘেরা উপত্যকা। তারপর আমার বাড়ি। আমার পাড়া। পুকুরের পাড়ে সজনে গাছের ছায়ায় আমাদের প্রথম আড্ডা মারার জায়গা। কৈশোরের বন্ধুরা। কৌতুহল মাখা প্রশ্ন "কবে আইলা?'

    বিমানে উঠলেই আমার কেমন টাইম মেশিনের কথা মনে পড়ে ...

    ২২শে নভেম্বর, ২০০৯

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২২ নভেম্বর ২০০৯ | ১৮১৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • rabaahuta | 161.191.175.194 (*) | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:৩৪89306
  • এইটা আবার পড়লাম অনেকদিন পর।
  • ranjan roy | 192.68.23.133 (*) | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৫:০৬89307
  • এই প্রথম পড়লাম; বেশ লেগেছে।
  • dd | 116.51.29.68 (*) | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৫:২৯89308
  • ওঃ, এটা কি আগে পড়েছি? মনে পড়ছে না তো।

    বছর পঞ্চাশ + আগে, তখন কুচবিহারে। কলকাতা আসতে হলে প্লেনেই আসতে হত। সাবসিডাইজড রেট ছিলো - নর্থ ইস্টের মতন। তখনো ফারাক্কা ব্রীজ হয় নি। ট্রেনে প্রায় দুই দিন না আরো বেশী লাগতো। দুটো ট্রেন আর একটা স্টীমার করে।

    সেই প্লেন ছিলো ডাকোটা প্লেন। খুবই ছোটো। কুরি বাইশ জন বোধহয় বসতে পারতো। বা আরেকটু বেশী। প্লেনের পিছন দিকেই ছিলো ডাঁই করে রাখা প্যাসেঞ্জারদের লাগেজ আর কিছু কার্গো। ইনক্লুডিং তামাক ।

    সেই প্লেন যেতো খুবই নীচু দিয়ে। নীচের লোকজন গাড়ী ঘোড়া পষ্টোই দেখা যেতো। আর প্লেনের সারাক্ষন কানে তুলো গুঁজেও রেহাই পেতাম না। ভীষণ কানে ব্যাথা হতো এমনই ভয়ানক আওয়াজ হত।

    হায় সেই মায়াঘেরা শৈশব।
  • dd | 116.51.29.68 (*) | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৫:৫২89310
  • আর হ্যাঁ। সে সময়ে দমদম অ্যারপোর্ট যাস্ট একটা একতলা বাড়ী ছিলো। ঠাসাঠাসি ভীড় হতো লাউঞ্জে।

    আপনেরা জানেন না। সে সময়ে বিদেশ যেতো লোকে ওভারকোট হাতে নিয়ে। অন্ততঃ কুরি জন সাশ্রু লোকে আসতো বিদায় জানাতে।
  • kk | 218.54.80.144 (*) | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৬:৫৬89311
  • ভালো লাগলো। হস্তিমূর্খের লেখার শেষ প্যারাগ্রাফ, বিশেষ করে শেষ লাইন আমাকে কেমন একটু উদাস করে দেয়। বরাবরই। এই লেখায় "কনিষ্ক তখনো মাঝ আকাশে উড়ে যায়নি" লাইনটাও বড় ভালো লাগলো। তবে ন্যারেশনে 'হস্তিমূর্খের' অথবা 'আমার' যেকোনো একটা বেছে লিখলে কি আরো লাগতো? কী জানি!
  • Abhyu | 85.137.4.123 (*) | ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১১:৪৯89312
  • এই প্রথম পড়লাম। ঠিক যেমন হয়, মায়ময় লেখনী। কেকে যেমন বলল, লেখার শেষ প্যারাগ্রাফ, বিশেষ করে শেষ লাইন আমাকেও কেমন একটু উদাস করে দেয়। বরাবরই।
  • কুমড়োপটাশ | 198.155.168.109 (*) | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৯:১৫89314
  • ভারতি হাওয়া কী?
  • + | 168.125.51.122 (*) | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৯:২১89315
  • এয়ার ইন্ডিয়া?
  • Atoz | 161.141.85.8 (*) | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১২:০০89313
  • কিন্তু কোন্‌টা হল শেষপর্যন্ত? তিন তারা ? নাকি উড়লো বিমান শেষে? নাকি বরবৌওয়ালা বৌভাত হল পরে?
    ঃ-)
  • রৌহিন | 113.214.138.87 (*) | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৫:৫৬89316
  • ভারতি হাওয়া অবশ্যই এয়ার ইন্ডিয়া। আমাকে সবচেয়ে ছুঁইয়ে গেল ওই চাঁদপুর - পদ্মা মেঘনার সঙ্গম। সামনাসামনি তো দেখিনি - যতবার আগরতলা যেতাম, ওটাই সেরা আকর্ষণ ছিল।
  • r2h | 136.185.162.143 | ০৭ এপ্রিল ২০২১ ২২:৫৩104526
  • .

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন