এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • গণতন্ত্র ও আজকের পাকিস্তান

    ওয়াক্কাস মীর লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৩ জুন ২০১০ | ৮৩৪ বার পঠিত
  • সংবিধান, তা সে যে দেশের জন্যেই হোক না কেন, তৈরি হয় সেই দেশের আমজনতার রক্ষার্থে। সংবিধান দেশের, দশের, ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবার যৌথ প্রচেষ্টাকে প্রতিফলিত করে, এক সুশৃঙ্খল অথচ মুক্ত সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার অঙ্গীকার রাখে। সেই সংবিধান যারা মেনে চলে, সেই দেশবাসীকে সে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। সংবিধানকে তাই বলা হয় সমাজের নৈতিক মেরুদণ্ড। আমাদের সংবিধানও তার থেকে বিশেষ আলাদা কিছু নয়, কেবল আমরা নিজেদের আরও নিরাপত্তা দেবার অছিলায়, নিজেদের আরও সংরক্ষিত করে তোলার তাগিদে সেই মেরুদণ্ডে কিছু বড় বড় ছিদ্র খুঁড়েছি, আর "আমরা' বাদে সমস্ত "ওরা'-দের ছুঁড়ে বের করে ফেলে দিয়েছি সেই নিরাপত্তার আচ্ছাদন থেকে। আমাদের সংবিধান, আমাদের সমাজের মেরুদণ্ড, এখনও, যে সমাজের সর্বাঙ্গ দিয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, প্রতিটা ক্ষতমুখে জমে উঠছে পুঁজ আর, সেটাকে সারাবার মহান প্রচেষ্টায় আমরা স্রেফ অন্যদিকে তাকিয়ে সেটাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করছি। সাম্যের মৃত্যু ঘটছে প্রতিদিন, স্বাধীনতা গুমরে গুমরে মরছে সেই সমস্ত ক্ষতচিহ্ন নিয়ে। আমরা গর্বের সঙ্গে আমাদের নিজেদেরই কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলেছি আরও উন্নত, আরও সহনশীল এক পাকিস্তান দেশে বেঁচে-থাকার আশার জনাজা।

    প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে ঘটছে এই খেলা। আমরাই রক্তাক্ত হচ্ছি, আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা ধিক্কার দিচ্ছি স্বাধীনতাহীনতার বিরুদ্ধে, আমরাই ফিরিয়ে নিচ্ছি আমাদের মুখ, পরক্ষণেই। স্বাধীনতার কণ্ঠনালী পাকিস্তানে ছিন্ন হচ্ছে প্রতি দিন, সেই ছুরির জোগান দিচ্ছ তুমি, আমি তাতে শান দিয়ে তাকে আরও ধারালো করে তুলছি পরের দিনের জন্য। আমরা শিখছি ঘৃণা করতে, আমাদেরই শরীর চুঁয়ে বেরোন রক্তে হাত ডুবিয়ে সেই হাতে আমরা আশীর্বাদ করছি আমাদের সন্ততিদের। তারা বেড়ে উঠছে সেই রক্ত, সেই ঘৃণা বুকে নিয়ে, মন্ত্রের মত আওড়াচ্ছে, "হিন্দুস্তান, আমেরিকা, ইজরায়েল আমাদের শত্রু, আমরা ইসলামিক দেশ, আহমদীরা মুসলিম নয়, অতএব তারাও আমাদের শত্রু।' ... সেই ছেলেপুলেরা বড় হয়ে কেউ নতুন তত্ত্বের প্রচলন করছে, যে তত্ত্ব শত্রুদের নামের তালিকায় যুক্ত করছে ডেনমার্কের নাম, তাদেরই কেউ বড় হয়ে তৈরি হচ্ছে আদালতের মহামান্য বিচারপতি, ঐতিহাসিক রায়ে নিষিদ্ধ করছে ফেসবুক, পাকিস্তানের সমস্ত কম্পিউটার থেকে; আরো উচ্চাকাঙ্খী কেউ হয় তো লাভ করছে মন্ত্রীত্বের গদী, উচ্চতার ক্ষমতা আর জঙ্গীদের সাহচর্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাকিস্তানের প্রদেশ থেকে প্রদেশে, নিপুণভাবে সাফ করে দিচ্ছে সমস্ত আহমদী, শিয়া, ক্রিশ্চান, শিখ, হিন্দুদের।

    এই সুমহান অ-সহনশীলতার ধ্বংসযজ্ঞ সমবেতভাবে প্রত্যক্ষ করছি আমরা, আমরা যারা পাকিস্তানের সংবিধানস্বীকৃত মুসলমান সংখ্যাগুরু। আমরা উল্লসিত হচ্ছি, অভিনন্দিত করছি এইসব দেশনেতাদের, পিঠ চাপড়ে দিচ্ছি একে অন্যের; আমরা কবর খুঁড়ছি স্বাধীনতার, সাম্যের, তারপরে ছুরি দিয়ে গলার নলি কেটে তাদের ঠেলে ফেলে দিচ্ছি সেই কবরের গর্তে, অন্তত যতক্ষণ না-পর্যন্ত আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছি, আমরা খুন করেই যাচ্ছি, করেই যাচ্ছি। আমরা তো জানি না নিজেদের পৃথিবীর সামনে প্রতিষ্ঠা করার পদ্ধতি, আমরা শুধু জানি লুঠতে, খুন করতে এবং অস্বীকার করতে।

    এত সব কিছুর মাঝে আমরা হারিয়ে ফেলেছি একটা বিশেষ জিনিস, আত্মোপলব্ধি। আমাদের রক্তমাখা হাত আমরাই দেখতে পাচ্ছি না, শুধু আমাদের সামনে একটা আয়না নেই বলে। সাধারণত, সমাজই সেই আয়নার কাজ করে, বুঝতে সাহায্য করে আমাদের ভুল। অ্যাডাম স্মিথ ব্যক্তির বিকাশে সমাজের গুরুত্ব নিয়ে লিখেছিলেন, " Bring him into society and he is immediately provided with the mirror which he wanted’. ... তা হলে কি সব আয়না ভেঙে গেছে? চারপাশে যদি দ্বিতীয় কেউ না থাকে আমাদের ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য, তা হলে তো ভুল, ভুল বলেই আর মনে হয় না তখন, আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলি আমাদের দৃষ্টিশক্তি। স্মিথ আমাদের সমাজে এই ভুল অস্বীকার করবার প্রবণতা লক্ষ্য করেছিলেন, তিনি লিখেছিলেন, " Unfortunately, the moral looking-glass is not always a very good one. It can be extremely deceitful. There is not in the world such a smoother of wrinkles as is every man’s imagination with regard to the blemishes of his own character’.

    আমাদের দেশের চরমপন্থীরা সংখ্যালঘুদের রক্ত ঝরায়, কিন্তু জীবনীশক্তি কমে আসে, আমাদের, সংখ্যাগুরুদের। মনুষ্যত্ব হারাই, আমরাই। সংখ্যালঘুদের প্রতিটা মৃত্যুর সাথে শেষ নিশ্বাস নেয় আমাদের সংখ্যাগুরুদের ন্যায়, নৈতিকতা। অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ রাখি বলেই আমরা নিজের ধর্মের লোকেদের জন্য অনেক তাড়াতাড়ি আইডি কার্ড বা পাসপোর্ট বানিয়ে দিই। তুমি হয় তো বলবে, আমি না, স্টেটই তো আমাদের বলে এই রকম করতে। আমরা তো হুকুমের চাকর মাত্র। ... কিন্তু শোনো বন্ধু, আমরা কি স্টেটের কেউ নই? বিগত বহু বছর ধরে এই অন্যায় হয়ে চলেছে, আরও বহু বছর ধরে চলবে। আমরা কি মনের ভেতরে সামান্য সাহস নিয়েও কোনওদিন রাস্তায় নেমেছি এই অবিচার এই অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে? যতক্ষণ "আমরা' সুবিধা ভোগ করছি, ততক্ষণ প্রতিবাদের কথা আমাদের মাথাতেও আসে না। আমাদের সাংবাদিকরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য চিৎকার করার বদলে আরাম করাই শ্রেয় মনে করেন, আহমদীদের মসজিদকে তাঁরা প্রতিনিয়ত লিখে চলেন "প্লেস অফ ওয়রশিপ', "মস্ক' লেখেন না। বার অ্যাসোসিয়েশন খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারেন ফেসবুক নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে, এবং এই নিয়ে আইনসভায় নতুন বিল পাশ করে ফেলতে পারেন। প্রতিবাদ তো পরের কথা, সম্প্রতি আহমদী লাহৌরে সম্প্রদায়ের লোকেদের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাদের রক্ষা করার জন্য আইনসভা কোনও বিল পাশ করার কথা ভুলেও ভাবেন নি। ফেসবুক নিষিদ্ধ হবার পরে লাহৌর ক্যান্টনমেন্ট কাছারির রাস্তায় "ওয়াজিব-উল্‌-কাত্‌ল'এর পোস্টার দেখা গেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে, কিছু আরও ইতস্তত খুন। সরকারের তরফে কোনও কড়া পদক্ষেপ? না:। এই দেশের উচ্চতর ন্যায়াধীশ পদসমূহে এর আগেও এবং বর্তমানেও কিছু ব্যক্তি ছিলেন বা আছেন, যাঁরা আহমদী সম্প্রদায়ভুক্ত। লাহৌর গণহত্যার পরে তাঁরা সবাই ছিলেন নিশ্চুপ। এ দেশের মানুষের কাছে, বিচারব্যবস্থার কাছে, সরকারের কাছে, অনেক মানুষের প্রাণের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটা কার্টুন?

    যাঁরা ভাবছেন ফেসবুকের ঘটনাটা আইনজীবিদেরও ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করেছিল, তাঁদের অনুরোধ করব রামাদানের সময়ে একবার লাহৌর হাইকোর্টের বাররুমে ঘুরে আসুন। ফুর্তির ফোয়ারা চলে। এই মোচ্ছব তো ইসলামের শিক্ষা নয়, কিন্তু ইসলামকে কি দোষী করা যায় এর জন্য? আমাদের নীতিই এখানে এসে ঠেকেছে, ধর্মের নামে আমরা রক্তের নদী বইয়ে দিয়ে শান্তভাবে তা প্রত্যক্ষ করি। দেওয়ালে কিংবা সিলিং ফ্যান থেকে লটকে থাকা শিশুর মৃতদেহের থেকেও একটা কাগজে আঁকা কার্টুন আমাদের বেশি উত্তেজিত করে। ছ'বছরের ইব্রাহিমের আতঙ্কিত চোখের সামনে, মডেল টাউন মসজিদে, সমস্ত লোককে খুন করা হয়েছিল একে একে, কী বলবেন আপনি সেই শিশুকে? আমাদের মধ্যে কোনজনের ক্ষমতা আছে ঐটুকু বাচ্চাকে বোঝায় কী ঘটেছে এবং কেন ঘটেছে? কী করে তাকে বোঝাবে যে তাকে মারতে আসা হয়েছে তার ধর্মবিশ্বাসের জন্যে, যা কিনা তার একান্ত নিজস্ব, হৃদয়ের মাঝে লুকনো এক গোপন, পবিত্র অনুভূতি? না, কোনও আতঙ্কবাদীর কাজ তো নয় এটা, এই খুন করেছে কিছু চরমপন্থীর দল, আপনি-আমি যাদের বাড়তে দিয়েছি আমাদেরই চৌহদ্দির মধ্যে! একটা পুরো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তাদের নাম লেখা বুলেটগুলো যখন বন্দুকে লোড করা হচ্ছে, তখন আমরা, সংখ্যাগুরুরা বসে বসে দেখেছি সেই প্রস্তুতি। এই গণহত্যা হঠাৎ ঘটা কোনও ঘটনা নয়। এই ঘৃণা, এই বিদ্বেষ বেড়ে উঠেছে আমাদেরই তৈরি করে দেওয়া চৌহদ্দিতে, বেড়ে উঠতে দিয়েছি আমরা সংখ্যাগুরুরা, বেড়ে উঠতে দিয়েছে রাষ্ট্র।

    কাউকে আস-সালামা-লাইকুম বলে শুভেচ্ছা জানানো কিংবা মসজিদকে মসজিদ বলে জ্ঞাপন করা, অপরাধ! এই কী ইসলাম! এক বিশ্বায়িত ধর্ম? ... আসলে ইসলাম হাইজ্যাক্‌ড হয়ে গেছে। আমরা ইসলামের বিভিন্ন শব্দবন্ধের ব্যাখ্যা তৈরি করেছি, আমাদের সুবিধেমত, কারণ ইসলাম তো আমাদের বাপের সম্পত্তি! আপাতদৃষ্টিতে, আল্লাহ্‌ সকল মানুষের জন্য, কিন্তু "আমরা' ছাড়া আর কেউই সেই "সকল মানুষ'-এর মধ্যে পড়ে না। সেই অর্থে, কোনও খ্রিস্টধর্মাবলম্বী দেশেও যদি কখনো এই রকমেরই নিয়ম চালু হয়, সেখানে তো কোনও মুসলিম "জিসাস ক্রাইস্ট, আমার প্রভু' বললে তাকে পুলিশে ধরবে, কারণ জিসাস ক্রাইস্ট সকলের প্রভু হলেও সে তো সেই দেশে "সকলের' মধ্যে পড়ে না। অথবা, সে-দেশের বাকি মুসলিমরাই হয় তো তাকে মেরে ফেলবে, মুসলিম হয়েও জিসাস ক্রাইস্টের নাম নেবার অপরাধে।

    পঞ্জাব সরকার রাবোয়া ( Rabwah ) শহরের নাম সম্প্রতি পাল্টে চিনাব নগর করতে বাধ্য হয়েছে। রাবোয়া, আহমদী সম্প্রদায়ের রাজধানী, এক শান্ত ছোট্ট শহর। সেই শহরের বাসিন্দাদের হাতে, তাদের জন্যেই গড়ে ওঠা এই শহর, যে বাসিন্দাদের পাকিস্তান সরকার দীর্ঘদিন ধরে নিজের দেশের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করে এসেছে। বছরের পর বছর ধরে। রাবোয়া দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী শহর। দেশের অন্যতম সেরা পাবলিক লাইব্রেরি এবং হাসপাতাল আছে এই শহরে। এই শহরে বাস করেন এমন অনেক যুবক যুবতী যাঁরা শিক্ষা নিয়ে এসেছেন কেমব্রিজের মত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, তারপরে ফিরে এসেছেন এই শহরে শিক্ষকতার কাজে, অথবা বিদেশে আরব্ধ জ্ঞান স্থানীয় ভাষায় অনুবাদের কাজে, যাতে অন্যরাও উপকৃত হন। এটিই পাকিস্তানের একমাত্র শহর, যেখানে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে এমন অনেক অচেনা মুখের দেখা আপনি পাবেন, যারা চেনে না আপনাকে, কিন্তু মৃদু হেসে আপনাকে সালাম জানিয়ে যেতে ভুল করবেন না। সব মিলিয়ে, রাবোয়া শহর জুড়ে এমন এক আতিথেয়তার উষ্ণতা ছড়ানো আছে, যা পাকিস্তানের অন্য কোনও শহরে বিরল। শহরের দু-হাত সবসময়েই বাড়ানো থাকে অতিথিদের জন্য। আমি যখন রাবোয়া গেছিলাম, এই আতিথেয়তা আমাকে এত বিস্মিত করেছিল, বন্ধ দরজার আড়ালে আমি বসে বসে ভেবেছিলাম, যা ঘটছে, তা সত্যি তো? ... আহমদীদের শহর, এই রাবোয়াতে খুব ভালো আইসক্রিমও পাওয়া যায়। এই আহমদীদের জন্য যখন কবর তৈরি করছিল ধর্মীয় উগ্রবাদীরা, সরকার তখন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল। আপনি হয় তো বলবেন, বৈষম্য কোন দেশের সমাজে নেই? প্রায় প্রতি দেশেই কিছু না কিছু সংখ্যক মানুষ অনর্থক রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। ঠিক, কিন্তু রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব থাকে সেই সূক্ষ্ম বিভাজনরেখা মেনে চলার, যেখানে একজন মানুষের, একটা সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত পরিসরে হাত বাড়ানোর আগে রাষ্ট্র দশবার ভাবে। অনৈতিক বৈষম্য, যা চিরকাল সংখ্যাগুরু চাপিয়ে দেয় সংখ্যালঘুর ওপরে, সর্বদাই ঘটে এসেছে সমাজের কোনও না কোনও স্তরে, কম বা বেশি মাত্রায়। সেটাই ভয়ংকর হয়ে ওঠে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে, যখন কেবল সংখ্যাগুরু নয়, রাষ্ট্র স্বয়ং সেই বৈষম্যে মদত দিতে থাকে এবং আইন ও ন্যায়ের বর্ম পরে অসহায় সংখ্যালঘুদের খুন করতে থাকে। এই গণহত্যার পর অনেক সাংবাদিক সরব হয়েছেন, দোষারোপ করেছেন সরকারকে, রাষ্ট্রকে, আইনব্যবস্থাকে, দেশের দুই মহাশক্তিমান ভদ্রলোকও একই সঙ্গে টুইটারে দোষারোপে ব্যস্ত থেকেছেন সেই সময়ে, একে অপরের বিরুদ্ধে।

    তা হলে এর শেষ কোথায়? সমাধানের প্রথম ধাপ অবশ্যই অন্যায় স্বীকার করা। এবং তার পরের ধাপে সেই অন্যায় আর যাতে না-হয়, তা নিশ্চিত করা। আহমদী, হিন্দু, ক্রিশ্চান, শিখ, অন্য সমস্ত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণার চাষ হয়ে চলেছে আমাদের জনতার চৌহদ্দিতে, তাকে বন্ধ করতে হবে। একদিনে এই ঘৃণা নিশ্চিহ্ন হবে না, ঘরে বসে শুধু "নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক!' ভাবলেও তা নিশ্চিহ্ন হবে না। মুখ খুলতে হবে। আলোচনা চালাতে হবে। বিতর্ক হোক। কথার যুক্তিতে কাটা হোক বিপরীত কথাকে। আর্গুমেন্টকে ভয় পেয়ে, তাকে এড়িয়ে চললে, কোনও সমস্যার সমাধান কোনওদিন আসবে না। প্রত্যেকে নিজের চারপাশে যে তথাকথিত নৈতিক আয়না সাজিয়ে রেখেছে, ভেঙে চলতে হবে তাদের। তবেই সমাধানের রাস্তা দেখা যাবে।

    আমার খুব কাছের এক বন্ধু মারা গেছে, আজ প্রায় তিন বছর হল। জীবদ্দশায় সে খুব সযত্নে আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল এই কথাটা, যে, সে একজন আহমদী। একজন পাকিস্তানি হিসেবে এ যে আমার কাছে কী লজ্জার বিষয়, আমি কী বলব! সে একা নয়, অনেক আহমদীই প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চায় না যে সে আহমদী। আমাদের তথাকথিত বন্ধুত্ব হেরে গেছিল রাষ্ট্রের দমনমূলক আইডিওলজির কাছে। সেই আইডিওলজির আমিও একজন অংশ বই কী! আমার বন্ধুর সেই ছ বছরের ভাইপো, যে সেই মডেল টাউন মসজিদের গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেছিল, তার সেই আতঙ্কের মুখোমুখি হতে আমার আজ ইচ্ছে হয়, আমার ঘৃণা করতে ইচ্ছে হয় আমার সেই সহকর্মীকে যে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদযাত্রায় অংশ নিতে অস্বীকার করে। জনৈক "সংবিধান বিশারদ' সুপ্রিম কোর্টে সতেরো জনের সামনে ব্যাখ্যা করেছিলেন, জিয়া-র প্রিয় "অবজেক্ট রেজোলিউশন' তত্ত্বই এই দেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি। ... আমি কী করে শ্রদ্ধা, বিশ্বাস রাখি সেই সংবিধানে, যে সংবিধান মানুষের গণতান্ত্রিক কেড়ে নেবার জন্যেই শুধু ব্যবহৃত হয়? "অবজেক্ট রেজোলিউশন' নিয়ে বিশেষভাবে আমার কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু এই নীতি যে-ভাবে অতীতে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে কিছু সুবিধেবাদী গোঁড়া আইনজ্ঞের দ্বারা, তার পরিণাম হয়েছে ভয়াবহ। আমি বুঝে পাই না, ১৯৮৫ সালে একজন ডিক্টেটরের তৈরি করা কিছু সংযোজন কী করে একটা দেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি হতে পারে। সংবিধানের অষ্টাদশ সংযোজন, আর্টিক্‌ল টু-এ-তে নতুন ভাবে " freely ' শব্দটা জুড়েছে। একটা শব্দে পুরো বাক্যের মানে পাল্টে যায়। পার্লামেন্ট কি এইবার পাকিস্তানের পিনাল কোড থেকে সমস্ত বৈষম্যমূলক নিয়মগুলো মুছে ফেলার সাহস দেখাবে? নিজেদের "রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ' দেখা বন্ধ করে কোনও পার্লামেন্টারিয়ান কি উদ্যোগী হবেন সংবিধান থেকে দ্বিতীয় সংযোজন ( Second Amendment ) মুছে ফেলতে, জনপ্রিয়তা হারানোর তোয়াক্কা না-করে? আমি কি কোনওদিন সেই কোর্টে কেস জিততে পারব, যেখানে আমি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম পাসপোর্ট বা আইডি কার্ডে "ডিক্লারেশন অফ হেট' উল্লেখ করার বিরুদ্ধে? এই দেশে আমার সন্তানকে বেড়ে উঠতে দিতে আমার ভয় করে। গ্রেফতারি এড়াবার জন্য আমি খুব সাবধানে আমার লেখায় সংবিধান থেকে কিছু সরাসরি উদ্ধৃতি দেওয়া থেকে বিরত থেকেছি, সচেতনে। জানি না, কোন ভবিষ্যতের দিকে আমরা চলেছি।

    লাহৌর গণহত্যার বিরুদ্ধে একতি প্রতিবাদসভায় আমি যোগ দিয়েছিলাম। দেখলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতিবাদ তার ভাষা হারিয়ে পর্যবসিত হল আমেরিকা-বিরোধী, ইজরায়েল-বিরোধী প্রতিবাদসভায়। লোকে বলতে উঠে বলল ভারতে, ব্রিটেনে, আমেরিকায় বৈষম্যের কথা। আমার হাসি পেল। ভাবলাম, কোনটা বেশি খারাপ? প্লেনে ওঠার আগে লাইন থেকে আলাদা করে বের করে সারা শরীর খানাতল্লাশি করতে দেওয়া? নাকি ছেলের বিয়ের কার্ডে "বিসমিল্লাহ্‌' লেখার জন্য আইনের চোখে অভিযুক্ত হওয়া? ভারত একজন মুসলিম রাষ্ট্রপতি বা একজন মহিলা মুসলমান বিচারক বানাতে পারে, আমেরিকা, যে দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট একজন মুসলিম অভিবাসীর সন্তান, ব্রিটেন, যেখানে প্রচুর মুসলিম মহিলা সম্প্রতি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। সেই সব দেশের সমাজও নিখুঁত নয়, কিন্তু তাদের আমরা পরিহাস করছি? আমরা? ভুললে তো চলবে না, আমেরিকানরা চক্রান্ত করে প্রতিটা এয়ারপোর্টে আমাদের জুতো মোজার গন্ধ শোঁকার জন্য টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে নি! আসল সমস্যাটা অন্যখানে। এইখানে। আমাদের মধ্যে। তাকে যুঝতে হবে।

    আমার অনেক কথাই হয় তো আপনি বুঝতে পারলেন না। The Role of Islam in the Legal System of Pakistan বইটা পড়ুন, ডক্টর মার্টিন লাউ-এর লেখা। মুনীর রিপোর্ট খুঁজে বের করে পড়ুন, পারলে ১৯৯৩ সালের জহিরুদ্দিন বনাম রাষ্ট্রের মামলার কেসস্টাডি ( SCMR 1718 ) পড়ুন। আহমদীদের ওপর অত্যাচারের বিষয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের জাজমেন্টও পড়ুন। অনেক তথ্য পাবেন।

    শেষকথা : ওয়েবসাইট পাকিস্তান সরকার PTA কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত। এতে এ রকম অনেক ডকুমেন্ট পাবেন, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের। সত্যের মুখোমুখি হবার ভয়?

    - মীর

    **মূল লেখাটি এখানে পাবেন - http://mirsmusings82.wordpress.com/2010/06/01/freedoms-jugular-is-slit-by-knives-that-you-and-i-helped-sharpen/
    বাংলায় অনুবাদ করেছেন শমীক মুখার্জী।

    ১৩ই জুন, ২০১০
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৩ জুন ২০১০ | ৮৩৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • PM | 11.187.183.59 (*) | ১১ এপ্রিল ২০১৭ ১২:২৭89234
  • এদিন ও দেখতে হলো।

    রউফ ক্লাসরা পাকিস্তানের অন্যতম লিবেরল সাংবাদিক। প্রচুর আনপপুলার এস্ট্যাব্লিশ্মেন্ট বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন---আর তার জন্য মুল্য ও দিয়েছেন বুক চিতিয়ে। Kঅদিন আগে পর পর দুটো প্রথম সারির নিউস চ্যানেল বদলাতে বাধ্য হয়েছেন চাপে পড়ে .. কিন্তু অবস্থান বদলান নি।

    এই ক্লিপ টাতেও উনি বলছেন যে কুলভুষন যাদবের ( মৃত্যু দন্ড প্রাপ্ত ভারতীয় "স্পাই") বিচারে অনেক ফাঁক আছে !! প্রশ্নের উর্ধে নয়।

    এহেন লোক বলছেন ভারতের এখনকার বাক স্বাধীনতার অবস্থা খুব খারাপ। পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন অনেক ভালো--- পাকিস্তানে ওনারা সরকার/এস্ট্যাবলিশমেন্ট এর সমালোচনা অনেক ভালোভাবে করতে পারেন ভারতের তুলনায় !!!

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন