এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপর বাংলা

  • রোমানা মঞ্জুর প্রসঙ্গে কিছু ব্যক্তিগত ভাবনা

    আল-বিরুনী প্রমিথ লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ২৭ জুন ২০১১ | ৭১১ বার পঠিত
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষিকা রোমানা মঞ্জুরের সাথে গত ৫ জুন কি বীভৎস এবং ঘৃণ্য কাজ সংঘটিত হয়েছে সে সম্পর্কে কম বেশি আমরা সকলেই অবগত । কাজেই সে সম্পর্কে আমি নিজে আর বিস্তারিত কিছু বলতে চাইনা, কেবল সম্পূর্ণ বিষয়টিতে আমার নিজের কাছে কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়েছে, সেটাই আমি এখানে ব্যক্ত করতে আগ্রহী।

    প্রথমত, তার সাথে যা হয়েছে সেটা নিয়ে লেখালেখি করতে গিয়ে কিংবা বলতে গিয়ে অনেক জায়গাতেই আমি দেখছি যে বলা হচ্ছে 'তার মত মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত একজন নারীর সাথে এরকম ঘৃণ্য কাজ হওয়াটাকে কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায়না' বা এরকম কিছু কথা। এসব কথার অর্থ কী? তিনি যদি 'মেধাবী' কিংবা 'উচ্চশিক্ষিত' না হয়ে থাকতেন তাহলে কি তার বিরুদ্ধে এই আচরণ গ্রহণযোগ্য হতো ? তিনি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা না হতেন তাহলে কি এই ভয়াবহ আচরণকে অনুমোদন করা যেত ? যখন কারো প্রতি সহানুভূতি জানাতে গিয়ে এরকম স্পর্শকাতর বিষয়ে 'মেধাবী', 'উচ্চশিক্ষিত' এইসকল শব্দ ব্যবহৃত হয় তখন খেয়াল রাখাটা জরুরি, যে যারা 'মেধাবী' কিংবা 'উচ্চশিক্ষিত' হিসাবে সমাজে সেভাবে পরিচিত নন তাদের সাথে এরকম কিছু হলে তখন সেই বিষয়টা প্রান্তিক হয়ে যায়। আমাদের মনে রাখবার দরকার যে কেউ 'মেধাবী', 'উচ্চশিক্ষিত' হোক না হোক কারো সাথেই এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য নয় । এখানে ব্যক্তির শ্রেণীগত অবস্থান, সামাজিক অবস্থানের চাইতেও ব্যক্তি স্ব্‌য়ং বেশী গুরুত্বপূর্ণ , রোমানা মঞ্জুরের সাথে যা হয়েছে সেটা নিয়ে আমরা সকলে যেরকম সোচ্চার সেরকম কিছু আমার বা আপনাদের কারো বোনের সাথে হলেও সকলের সোচ্চার হওয়াটাই কাম্য । এক্ষেত্রে মানুষ নিজে যদি তার সামাজিক অবস্থান , শ্রেণীগত অবস্থানের চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় তাহলে প্রতিনিয়তই এরকম ঘটনা ঘটে যাবার সম্ভাবনা আরো বেশি ।

    দ্বিতীয়ত, রোমানা মঞ্জুরের নিজের যেই শ্রেণীগত অবস্থান, তাতে তার ১০ বছর ধরে স্বামীর অত্যাচার সহ্য করাটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে তার নিজের গাফিলতি এবং বস্তাপচা কিছু সংস্কার মেনে চলবার অসমর্থনযোগ্য প্রয়াস হিসাবেই দেখতে পছন্দ করব। তার যেই সামাজিক অবস্থান এবং শ্রেণীগত অবস্থান তাতে স্বামী নামক এক পশুর এরকম যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়াটা তার পক্ষে খুবই সম্ভব ছিল, তার অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যই তাকে সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে পারত স্বামী থেকে আলাদা হয়ে। কিন্তু তারপরেও তিনি স্বামীর অত্যাচার সহ্য করেছেন এবং তার শেষ পরিণতি হয়েছে দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলা । এই ক্ষেত্রে আমাদের যেই ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবেই ভাবা দরকার তা হল কী কী কারণে জোড়াতালি দিয়ে দাম্পত্য সম্পর্ক এভাবে রাখতে গিয়ে পরিণতিতে চোখ হারানো, অনেকক্ষেত্রে জীবন হারানো এবং মানসিকভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে হয়, সেই মনস্তাত্বিক বিষয়টা আমাদের সমাজে অবহেলিত রয়ে গেছে আজও। জোড়াতালি দিয়ে একটা ব্যর্থ সম্পর্ক বজায় রাখলে তাতে চোখ যাক, জীবন যাক, মানসিকভাবে কেউ বিধ্বস্ত হোক আমাদের বিদ্যমান সমাজের, সংসারের নিয়ম কানুন তা নিয়ে কখনোই ভাবিত ছিলনা এবং ভাবিত থাকবেওনা। শাসকগোষ্ঠীর নিজস্ব সুবিধার লক্ষ্যেই এরকম বস্তাপচা সংস্কার আমাদের সকলকেই গেলানো হয়েছে এবং হয়ে আসবে কেননা তাতে তার টিকে থাকবার কাঠামোটা বজায় থাকবে। আমাদের নিজেদের কি এসব নিয়ে প্রশ্ন করাটা বর্তমানে জরুরী নয় ?

    তৃতীয়ত, রোমানা মঞ্জুরের স্বামী হাসান সাইদ আলোচনাকে ঘুরিয়ে দেবার জন্যে রোমানা মঞ্জুর চরিত্রহীন ও তার পরকীয়া আছে এসব গালগল্প ছড়াচ্ছেন। এসবে আমরা কম বেশি সকলেই তাকে গালমন্দ করা থেকে শুরু করে তাকে অনেক কিছুই বলছি। কিন্তু আমরা কয়জন ভেবে দেখেছি যে হাসান সাইদ কেন এই ব্যাপারটিকেই আলোচনা ঘুরিয়ে দেবার জন্যে ব্যবহার করছেন ? যদি সেই প্রশ্নই আসে তাহলে কি এটাই প্রমাণিত হয়না যে উপরিউক্ত বিষয়টি যেকোন আলোচনাকে ঘুরিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট কেননা আমরা সেসবের দ্বারা প্রভাবিত হই ? আমাদের মধ্যবিত্তের একটি বড় অংশ তথাকথিত নৈতিক চরিত্র, সংস্কার এসব নিয়ে খুব বেশীমাত্রায় স্পর্শকাতর বিধায়ই কি এই ইস্যুটা অনেক ক্ষেত্রেই ঢাল হিসাবে ব্যবহৃত হয়না কিংবা আলোচনাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়না ? হাসান সাইদ কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে আমাদের মধ্যবিত্তের বড় একটি অংশের চিন্তাভাবনা, স্বভাব এসবের বড় একটি অসঙ্গতিকেই সামনে এনে ফেলেছেন। তাকে গালিগালাজ করে, তার বিচারের দাবীতে মিছিল-মিটিং সবই ঠিক আছে কিন্তু আমাদের নিজেদের ভেতরে যেসকল অসঙ্গতি রয়েছে সেগুলার ব্যাপারে কি আমরা সচেতন হবনা ? আমাদের নিজেদের ভেতরের যেসকল অসঙ্গতি রোমানা মঞ্জুরের এই দু:খজনক ব্যাপারটিতে অনেকটাই প্রকাশিত হয়েছে সেই ব্যাপারে সচেতন হবার দায়িত্ব আমরা কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারিনা, এড়িয়ে গেলে এরকম অজস্র ঘটনাতে আমাদের ভাবনাকে নানাভাবেই অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে এবং পরিস্থিতি যেমন আছে তেমনই থাকবে, তার গুণগত কোন পরিবর্তন ঘটবেনা ।

    উপরিউক্ত যেসকল অসঙ্গতি আমাদের মাঝে বিদ্যমান, যেসকল চিন্তাভাবনা, অভ্যাসগুলোর জন্য আমরা প্রতিনিয়ত শোষিত হই, বিচ্ছিন্ন হই একে অপরের থেকে, আমাদের জীবনের গতিপথই বদলে যায় সেগুলা দূর করবার দায়িত্ব আমরা নিজেরা কবে নেব ? নিছক সময়ের অনুগত সন্তান হয়ে থাকাটাই কি আমাদের পরিণতি ? সময়কে, পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা আমাদের এই ভঙ্‌গুর মধ্যবিত্ত সমাজ কি কখনো করবে ? যদি করতেই হয় তবে এখন থেকেই কেন নয় ?

    'মঙ্গলধ্বনি'তে পূর্বপ্রকাশিত ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপর বাংলা | ২৭ জুন ২০১১ | ৭১১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন