এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • মানবিকতা ও বৈধতার অন্ধকার চেহারা : আসামের 'বিদেশি' আটক-শিবিরের ঝাঁকি-দর্শন - প্রথম পর্ব

    হর্ষ মন্দার, অনুবাদ - স্বাতী রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ১৭২১ বার পঠিত
  • প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব

    জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ মনিটর হিসাবে, আক্টিভিস্ট হর্ষ মন্দার জানুয়ারিতে দুটি আটক শিবিরে যান। এই লেখাটি তাঁর অভিজ্ঞতার হাড়-হিম করা বিবরণ। প্রথম প্রকাশঃ ২৬ শে জুন, ২০১৮। লেখক ও স্ক্রোলের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত।


    আসামের মানুষএক ধোঁয়া-উগরানো আগ্নেয়গিরির উপরেবসে আছে - যে কোন সময় সর্বনাশা দুর্দশা আর অবিচারের প্রবল বিস্ফোরণের আশংকা। জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর পরিবর্তনের কাজটা ভয়ানক কষ্টকর ভাবে টেনে টেনে লম্বা করা হচ্ছিল, শনিবার আসামে বাস করা ভারতীয় নাগরিকদের তালিকার একটি ড্রাফট বেরোলে সে কাজটার একটা আপাত-পরিসমাপ্তি হবে। নব্বই লাখ বাঙ্গালী-মুসলমান আর অল্পকিছু কম সংখ্যার বাঙ্গালী-হিন্দু ভয়ে ভয়ে, বুকের ভিতর কাঁপুনি নিয়ে, সেই তালিকার জন্য অপেক্ষা করছেন।

    যারা বিদেশি বলে গণ্য হবেন, তাদের কপালে কি আছে? –অজস্র আবশ্যিক আইনি ও মানবিক সংশয় জাগিয়ে এই প্রশ্নটা ঘাপটি মেরে আছে, ঠিক যেন একটা থমকে থাকা তুমুল ঝড়। ভুক্তভোগীর সংখ্যাটা কয়েক হাজার মহিলা, পুরুষদের এবং শিশু হতে পারে, বা হাজার হাজারও হতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদেশি নাগরিকদের হস্তান্তর করার কোনও আনুষ্ঠানিক চুক্তি নেই, সেক্ষেত্রে এই দেশে যারা বংশ-পরম্পরায় বাস করছেন, তাদের ঠিক কি দশা হবে? এই দেশে তাদের পরিবার, পরিজন থাকেন , তাঁদের সাংস্কৃতিক এবং হার্দিক বন্ধন এদেশের সঙ্গেই, এঁদের কর্মক্ষেত্র আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃষিজমিও এই দেশে । যদি রাতারাতি এ দেশকে বিদেশ বলে ঘোষণা করা হয়, তাহলে এদের কি দশা হবে? এঁদের ভবিষ্যতে বা ভাগ্যে কি আছে!

    সরকার থেকে এর কোন নির্দিষ্ট উত্তর নেই। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশি হিন্দুদের জন্মগত-ভাবে-ভারতীয় নাগরিকদের সমান মর্যাদা দেওয়ার জন্য একটি আইন তৈরি করেন । আসামের বেশিরভাগ মানুষ এই ধরনের কোন ব্যবস্থার খুব বিরোধী।আসামের মন্ত্রী ও ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মা ডিসেম্বর মাসে বলেছিলেন যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর উদ্দেশ্য হল "আসামে বসবাসকারী অবৈধ বাংলাদেশিদের চিহ্নিত করা" যাদের "দেশছাড়া করা" হবে। তিনি যোগ করেন যে বিজেপির মতাদর্শ অনুসারে, "বাংলাভাষী হিন্দুরা" আসামের মানুষদের সঙ্গেই থাকবেন।

    একটি সংবাদ প্রতিবেদনে প্রতীক হাজেলাকে, যিনি জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর মুল আধিকারিক, উদ্ধৃতকরা হয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন যে 4.8 মিলিয়ন লোক সঠিক উত্তরাধিকারের কাগজপত্র দেখাতে পারেন নি। এখান থেকে এরকম একটা কথা শুরু হয়েছে যে যদি প্রায় পাঁচ মিলিয়ন (পঞ্চাশ লাখ) লোকের রাষ্ট্রহারা হওয়ার ভয় থাকে, তাহলে তাঁরা মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের মত একটা বিপজ্জনক অবস্থায় পড়তে যাচ্ছেন - ভারত দাবি করে যে এঁরা অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী অথচ ঢাকা তাদের ফেরত নিতে রাজি নয়। হাজেলা অবশ্য পরে তাঁর বক্তব্য অস্বীকার করেন এবং সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন। এই সপ্তাহের শেষে, দ্য হিন্দুর একটি রিপোর্টে হাজেলাকে উদ্ধৃত করে বলা হয় “যত মানুষ নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়লেন তার সংখ্যা খুব বেশিহলে পঞ্চাশ হাজার হবে"। এইসব কথায় শুধু উদ্বেগ আর ভয় বাড়ছে।

    এই সব মানুষেরা যাঁদের বিদেশি হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হবে, তাঁদের ভবিষ্যতে কী হতে পারে তার খানিকটা আঁচ পাওয়া যায় আসামের বিদেশি ট্রাইব্যুনালের বিদেশি চিহ্নিত করা কয়েক হাজার মানুষের গত এক দশকের অভিজ্ঞতা থেকে। এইসব মানুষদের, পুরুষ ও নারী উভয়পক্ষকেই, কখনো কখনো প্রায় এক দশক ধরে, জেলখানার ভিতরেই খানিকটা অংশ নিয়ে তৈরি করা আটক শিবিরে রাখা হয়েছে - খুবই খারাপ অবস্থায়, মুক্তিরও কোন সম্ভাবনা নেই । এদের কী অবস্থা, কোন কানুনের অধীনে এঁদের আটকে রাখা হয়েছে আর সরকার তাঁদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছে সে বিষয়ে আসামের ভিতরেই খুব কম মানুষ ওয়াকিবহাল, আসামের বাইরে তো আরোই কম খবর আসে।

    মানুষের নিরন্তর দুর্দশা

    এই আটক শিবির গুলি মানবাধিকারও মানবিকতা কর্মীদের জন্য খোলা নয়, তাই তাদের বন্দীদের দশা কখনো প্রকাশ্যে আসেনি।গতবছর, আমি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের আমন্ত্রণে সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ মনিটর হিসাবে যোগ দিই। আমি প্রথমেই যে সব কাজ করতে চাই, তার মধ্যে একটি হল আসামের এই আটক শিবির গুলি পরিদর্শন। অনেকবার বলার পরে, কমিশন অবশেষে আমাকে তাদের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেয়। জানুয়ারীর ২২ থেকে ২৪ তারিখ আমি আসামে যাই আর দুজন গবেষকের সাহায্য নিই – একজন মহসিন আলম ভাট, যিনি হরিয়ানার জিন্দাল গ্লোবালল স্কুলের শিক্ষক, এবং আরেকজন স্বাধীন গবেষক আব্দুল কালাম আজাদ যিনি আগে গুয়াহাটির টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোসাল সায়েন্সেস-এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।আমরা গোয়ালপাড়া ও কোকড়াঝাড়ের আটকশিবির দুটি দেখতে যাই আর বন্দীদের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলি। আটক শিবির তৈরির পর থেকে, দশ বছরে আমরাই সম্ভবত প্রথম বেসরকারি মানবাধিকার কর্মী যারা ওই কারাগারে ঢোকার অনুমতি পেয়েছে। আমরা জেল এবং পুলিশ কর্তৃপক্ষ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং রাজ্যসচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং গোয়ালপাড়া, কোকড়াঝাড় ও গুয়াহাটিতে নাগরিক সমাজের সদস্যদের সঙ্গেও দেখা করেছি। আমরা দেখেছি যে আইন এবংমানবিকতা দু’দিক দিক দিয়েই এই আটক শিবিরের অবস্থান অন্ধকারের সীমানায়।

    আটক শিবিরে আমি যা দেখেছি ও শুনেছি তাতে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি। আমি, আমার গবেষকদের সঙ্গে যৌথভাবে শিবিরের মানুষগুলির ভয়াবহ এবং সীমাহীন দুর্দশার কথা নিয়ে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করেছি– সেখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনগুলিকে কিভাবে অবজ্ঞা করা হচ্ছে তার কথাও বলা হয়েছে এবং সেগুলির জরুরি ভিত্তিতে সংশোধন দাবি করা হয়েছে। যাই হোক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে বারংবার মনে করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও, আমি আজ অবধি আমার রিপোর্টের ভিত্তিতে কমিশন বা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার কোন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে শুনিনি। এবার, জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর সমাপ্তির পর লক্ষ লক্ষ লোকের বিদেশি বলে চিহ্নিতকরণের যে সম্ভাবনা দেখা গেছে, তাতে আমার মনে হয়েছে যে আমার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ মনিটরের পদ থেকে পদত্যাগ করা এবং আমার রিপোর্টটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

    শুনানি ছাড়াই দোষী বিধান

    আমরা প্রথমেই বুঝলাম সেটা এই যে বেশিরভাগ মানুষ যাদের বিদেশি বলে ভাবা হচ্ছে এবং ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে, তাদের অধিকাংশেরই একদম প্রাথমিক পর্যায়ের আইনি প্রতিনিধিত্বের অভাব ছিল এবং ট্রাইব্যুনালে তাদের কথাও কেউ শোনেনি। তারা বেশিরভাগই হয় "এক তরফা" (এক্স-পার্টে) আদেশের ভিত্তিতে আটক অথবা কোন শুনানি ছাড়াই তাদের বিরুদ্ধে আদেশ জারি করা হয় – তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এই যে বারবার আইনি নোটিস পাঠানোর পরেও তাঁরা ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দেন নি। অনেকে দাবি করেছেন যে তাঁরা কখনোই নোটিশ পাননি: আমরা অনেক জনের কাছে সাধারণ নোটিশ দেখেছি, কখনও কখনও কিছু লোককে নাম ধরে বলা হয়েছে আর অন্যদের জন্য তাতে শুধু একটা সংখ্যা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এঁদের অনেকেই পরিযায়ী শ্রমিক, বাড়ীর থেকে অনেক দূরে কাজ করেন – অন্য শহরে বা অন্য রাজ্যে, অথবা তখন বাড়ীতে ছিলেন না অথবা হাজারটা অন্যান্য কারণ নোটিশ পান নি।

    আমরা জানলাম যে যাঁরা নোটিশ পেয়েছেন তাঁরা সাধারণত, খুব ভয় পেয়ে যান এবং অনেকই তাঁদের যেটুকু সামান্য সম্পত্তি ছিল, তাও বিক্রি করে দেন আর অনেক টাকা ধার করে এই পর্বের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার জন্য উকিল লাগান। এই আইনজীবীদের মধ্যে অনেকেই খুব নিম্নমানের অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে মক্কেলদের পথে বসান।

    এমনকি যে ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে আমরা কথা বলেছিলাম, তিনিও বলেন যে প্রতিবার তিনি যখন আটক শিবিরগুলিতে যান, বন্দীরা তাঁর কাছে অভিযোগ করেন যে তাঁদের হয়ে ঠিকভাবে আইনিলড়াই করার কেউ নেই এবং তাঁদের আসলে প্রয়োজনীয় নথিপত্র সব আছে, কিন্তুএমন কেউ নেই যাঁর কাছে তাঁরা আবেদন করতে পারেন। কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে অনেক সময় কাউকে বাড়িতে না পাওয়া গেলে, তার আত্মীয়দের কাছে নোটিস দিয়ে আসা হয়। তাঁরা এও বলেন যে কেউ সাধারণতঃ নোটিস নেওয়াটা এড়িয়ে চলেন না কারণ সবাই জানেন যে সেটা করলে তাঁদের নাগরিকত্ব প্রমাণের সম্ভাবনা আরো সীমিত হয়ে যাবে।

    বন্দীদের কথা শুনলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের মামলাগুলিতে এক তরফা (এক্স-পার্টে) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল অথবা তাদের ভারতীয় জাতীয়তা প্রমাণের যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়নি। একটি মানবিক গণতন্ত্র হিসেবে, আমরা ধর্ষণ বা খুনের মত জঘন্য মামলায় অভিযুক্তদেরও আইনগত সাহায্য দিই, অথচ এক্ষেত্রে কোন অপরাধ না করেই মানুষগুলো আটক-শিবিরে পচছে কারণ আইনি পরিষেবার খরচ তাঁদের সামর্থ্যের বাইরে।

    সামগ্রিকভাবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা একজন ব্যক্তিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক, বহিষ্কার বা বিচ্ছিন্ন করা যেতে পারে, তাই রাজ্য সরকারকে এই বাবদে ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করতেই হবে। একজন অর্ধশিক্ষিত মানুষের, যাঁর পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক সম্বল নেই, তাঁর কাছে এটি কী ধরণের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, সেই বিষয়ে সরকারি স্তরে সমবেদনা এবং বোধের প্রকাশ প্রয়োজন। সরকারি তরফে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে লোকেরা যেন সত্যিই তাদের নোটিশগুলি পান এবং তাঁরা যেন আরও বেশি স্বচ্ছ ভাবে আইনি পরামর্শ এবং সহায়তা পান।

    কয়েদীদের থেকেও অধম
    যে দুটি শিবিরে আমরা গিয়েছিলাম - পুরুষদের জন্য গোয়ালপাড়া এবং কোকড়াঝাড়ে নারী ও শিশুদের জন্য - দুই কেন্দ্রেই গভীর ও ব্যাপ্ত সংকট, যন্ত্রণা আমাদের চোখে পড়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রই কারাগারের একটি ধারে তৈরি করা হয়েছে। এখানে বছরের পর বছর বন্দিদের রাখা হয়, আইনের ধূসর সীমানায় - কোনও কাজকর্ম নেই, বিনোদন নেই, একটি দু’টি বিরল পারিবারিক মোলাকাতের সুযোগ ছাড়া পরিবারের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই - আর নেই মুক্তির কোন সম্ভাবনাও। একটি জেলে, কয়েদিদের অন্ততপক্ষে কাজ করতে, হেঁটেচলে বেড়াতে বা খোলা জায়গায় বিশ্রামের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু আটক শিবিরের মানুষগুলোকে এমনকি দিনের বেলাও তাদের ব্যারাকের বাইরে আসতে দেওয়া হয় না -তাদের নাকি "নাগরিকবন্দীদের" সাথে মেলামেশা করতে দেওয়া যাবে না।

    মেয়েদের জেলখানাগুলো এমনিতেই ছেলেদের জেলের থেকে বেশি চাপাচাপির জায়গা হয় আর কোকড়াঝাড়ের জেলের মধ্যে মেয়েদের যে আটক শিবির, সেটির পরিস্থিতি আরোই দমবন্ধকরা। ভেবে দেখুন একবার, যে এইমহিলারা– অধিকাংশই কোনমতে-সাক্ষর গৃহবধূ, কিছু বযস্ক বিধবা - প্রায়একদশক ধরে তাদের একটা ৫০০ বর্গমিটারের মত ঢাকা জায়গার বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।বিশেষ করে মেয়েদের ক্যাম্পে, মেয়েরা সারাক্ষণই কাঁদেন, যেন তাঁরা একটি স্থায়ী শোকেরমধ্যে বাস করছেন।

    কর্মকর্তারা আমাদের জানিয়েছেন যে এই আটক-হওয়া মানুষদের অধিকার সম্পর্কে কেন্দ্র বা রাজ্যের থেকে কোন নির্দেশিকা বা নির্দেশ নেই। আইনগতভাবে না হলেও, কার্যত এই আটকশিবির গুলি আসাম জেল ম্যানুয়ালের নিয়মে চলে। আমরা এও দেখলাম যে রাজ্য সরকার আটক-শিবির ও কারাগারের মধ্যে বস্তুতঃ কোন তফাত করে না, এবং সেই সঙ্গে আটক-হওয়া-মানুষ আর কোন অপরাধের-দায়ে-অভিযুক্ত বা দোষী-প্রমাণিত-হওয়া কারাবন্দীদের মধ্যেও কোন তফাত নেই। যেহেতু আটক-হওয়া মানুষদের আধিকার এবং প্রাপ্য বিষয়ে কোন পরিস্কার আইনি নির্দেশ নেই, জেল কর্তৃপক্ষ আটক-হওয়া-মানুষ আর কোন অপরাধের-দায়ে-অভিযুক্ত বা দোষী-প্রমাণিত-হওয়া কারাবন্দীদের মধ্যে বেছে বেছে আসাম জেল ম্যানুয়ালের বিধিগুলোর প্রয়োগ করেন। জেল-নিয়মের আওতায় থাকা বন্দীরা প্যারোল বা কাজ-করে-মাইনে পাওয়ার মত যে সব সুবিধাগুলি পান, সেগুলোর থেকে এই আটক-হওয়া মানুষেরা বঞ্চিত। অতএব আটক মানুষেরা সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের মত ব্যবহার পান অথচ বন্দীরা যে অধিকারগুলি পেয়ে থাকেন, সেগুলো পান না।

    আমরা দেখেছি যে পুরুষ, নারী ও ছয় বছরের উপরের ছেলেদের তাদের পরিবার থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে – এতে তাদের কষ্ট আরো বেড়েছে, বলাই বাহুল্য। অনেকেই বহু বছর ধরে তার জীবনসঙ্গীকে দেখেন নি, অনেকেই আটক হওয়ার পর থেকেই প্রিয়জনেদের আর দেখতে পাননি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া একটি আবেগ জর্জর বিবৃতিতে আটক-বন্দী সুভাষ রায় প্রশ্ন তোলেন, "পৃথিবীতে কোন দেশের সংবিধান স্বামীর থেকে স্ত্রী বা পিতা মাতার থেকে তাদের সন্তানদের আলাদা করে দেয়?" আটকে থাকা মানুষেরা আইনত তাঁদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন না। তবে মাঝে সাঝে মানবিকতার খাতিরে জেল কর্তৃপক্ষ মোবাইলে কথা বলিয়ে দেন। বাড়ির লোকের অসুস্থতা বা এমনকি মৃত্যুতেও প্যারোল জোটে না। জেল কর্তৃপক্ষের জ্ঞানমতে, প্যারোল শুধু সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের প্রাপ্য, কারণ তাঁরা ভারতীয়।

    পরিবারের পক্ষে এঁদের সঙ্গে দেখা করার আরও বড় সমস্যা হল যে রাজ্যের মধ্যে মাত্র কয়েকটি জেল-ই আটক-শিবিরে রূপান্তরিত হয়েছে। অনেক পরিবারের লোকেরা যাঁরা নিজেরা বন্দী নন, অথচ যাঁদের প্রিয় মানুষেরা আটক শিবিরে আটকে রয়েছেন তাঁদের আটক শিবিরে যাতায়াত করার মত পয়সা নেই, বিশেষতঃ আটক শিবিরটি যদি অন্য জেলায় হয়। এই মুহূর্তে আসামে বিভিন্ন জেলের লাগোয়া ছ’টি আটক শিবির আছে। ২০১৪ সাল অবধি মাত্র দু’টি ছিল। গোয়ালপাড়ার কেন্দ্রটিতে আটটি জেলার আটক হওয়া মানুষদের রাখা হত। কোকড়াঝাড়ের কেন্দ্রে মেয়ে এবং শিশুদের রাখা হয়, যদিও তেজপুর, জোড়হাটআর শিলচরেও আটক হওয়া মেয়েদের রাখার ছোটখাট ব্যবস্থা আছে।

    গত মাস থেকে সারা বিশ্ব জুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মার্কিন সীমান্তে অবৈধ অভিবাসীদের কাছ থেকে তাদের সন্তানদের পৃথক করে দেওয়ার নীতি নিয়ে নিন্দা চলছে। কিন্তু বৃহত্তর মানবাধিকার সম্প্রদায়ের কোন মন্তব্য বা তিরস্কার ছাড়াই গত এক দশক ধরে আসামে বিদেশি সন্দেহে আটক হওয়া মানুষদের ক্ষেত্রেও এটাই চলে আসছে। আমরা দেখেছি যে পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে, শিশুদের জন্য প্রবল ঝুঁকির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমনও ঘটনা আছে যে শিশুকে ভারতীয় ঘোষণা করা হয়েছে অথচবাবা-মা উভয়েই বিদেশি বলে চিহ্নিত হয়েছেন। এইক্ষেত্রে, রাষ্ট্র শিশুটির কোনও দায়িত্ব নেয়না, সে দূর-সম্পর্কের আত্মীয়দের কাছে বা পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে পড়ে থাকে। ছয় বছরের কম বয়সী শিশুরা তবু মায়ের সঙ্গে আটক শিবিরে থাকতে পারে। কিন্তু ছয় বছরের উপরের শিশুদের, যাদের বিদেশি বলে ধরা হচ্ছে, তাদের আইনানুগ তত্ত্বাবধানের বিষয়টি আরও অস্পষ্টও নড়বড়ে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব
  • আলোচনা | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ১৭২১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Prativa Sarker | 561212.96.895612.151 (*) | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:৩৯83515
  • ট্রাম্প তো দেখছি এই সেদিনের শিশু !
  • pi | 4512.139.122323.129 (*) | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:১২83516
  • এই লেখা পড়ে প্রথমেইএ
  • মেঘ শান্তনু | 2345.110.9004512.129 (*) | ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৫:৫৭83517
  • যত পড়ছি এই বিষয়টা নিয়ে বিভিন্ন জায়াগায় , বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছি
  • Du | 7845.184.4556.246 (*) | ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৩৯83520
  • এখানে দেখি নেপালী হিন্দু কি একটা ক্লজ এ রিফিউজি ভিসা পায়। যদিও ডিটেল জানিনা তবে ঐ মাওবাদী সরকার রিলেটেডই হবে বোধকরি। নইলে নেপালে হিন্দু রিফিউজি হবে কেন মাথায় ঢুকলো না।
  • pi | 2345.110.015612.113 (*) | ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০৮:৪৮83518
  • এরকম একটা অমানবিক ভয়নকর ব্যাপার নিয়ে দেশে এত হেলদোল হইচই কম, ভাবতে আশ্চর্য লাগে!৷ পবতেও তো ঘাড়ের উপর নাচছে। দলগুলিকেও তেমন ইস্যু করতে দেখিনা এসব।

    হর্ষ মন্দার কিন্তু লড়ে যাচ্ছেন।

    এই কেসে কোর্ট যা বলছে, দেখা যাক কিছু হয় কিনা

    https://thewire.in/law/nrc-case-article-21-supreme-court
  • S | 458912.167.34.76 (*) | ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ১১:৩৭83519
  • দিনকাল সেরকম নয় বলে। নইলে এই "বিদেশি"দেরকে কোনো উন্নততর দেশ আশ্রয় দিতে রাজী হলেই বাকিরা হিংসায় জ্বলবে। আমি সেই আশায় আছি। যে অন্তত কয়েকজন সেই সুযোগ পাবেন। দেখবো তখন নেটিভিস্টদের আস্ফালন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন