এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • যমুনায় সিম আনতে যাচ্ছি

    Yashodhara Ray Chaudhuri লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০২ মে ২০১৪ | ১৫৫২ বার পঠিত
  • কৃষ,
    তোকে এস এম এস না করে কেন খামোখা চিঠি লিখতে যাব, বলতো? লিখতাম না। কিন্তু তোর ফোন সুইচ অফ আছে, কতদিন কতবার চেষ্টা করেছি। তোর মোবাইলে এখন বোধ হয় শুধু গান শুধু গান। তোর মোবাইলে এখন বোধ হয় সিম নেই। তুই কেন সিম ফেলে দিলি কেষ্টা, আমাকে অ্যাভয়েড করবি বলে, নাকি পুলিশ তোকে খুঁজছে বলে?
    আমি কিছুতেই মানতে পারিনা, এবারও আমার ভুল সম্পর্ক করা হয়ে গেছে! না, আমি বিশ্বাস করিনা... গোয়ালাপাড়ায় লোকজন বলছে, কয়েকটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে ছেড়ছাড় করেছিলি। তারপর থেকে পুলিশ তোকে খুঁজছে। আমার কেষ্টা, আমার কৃষ, যাকে আমি আপন করে নিয়েছি, ভালবাসার ধন বলে সবটা সাপটে খেয়ে নিতে চেয়েছি, এমনভাবে রেখেছি নিজের অন্দরে অন্তরে যাতে আর কিছুতেই বিচ্ছিন্ন না হই, সে বলে অন্য মেয়ের সঙ্গে লটঘট করে! আমি বিশ্বাস করিনা। ওরা বলে, সব রকমের বদমাইশির প্রুফ যাতে না পাওয়া যায়, তাই প্রমাণ লোপাটের জন্যই তুই তোর সিমটা যমুনায় ফেলে দিয়েছিস। আমি বিশ্বাস করিনা। ছি ছি, তুই যে সমাজবিরোধী নোস, তুই যে মেয়েদের সঙ্গে কিছু করলেও, সেটা আলতো ফষ্টিনষ্টি শুধু, কাউকে বে ইজ্জত করিসনি, রেপও করতে যাসনি, সেকথা বুক চিতিয়ে বলতে পারলি না? এত ভয় তোর?
    আমার সঙ্গে তোর সম্পর্কটা কি, যে তোকে চিঠি লিখব? বড় গলা করে বলার মত আছেই বা কী আমাদের সম্পর্কে। পুরুষ তো আমি আগেও দেখেছি। ভুল সম্পর্ক তো আমি আগেও করেছি। সেবার একটা আধবুড়ো লোক মোবাইলে একের পর এক এস এম এস করে কত রসের কথা লিখত। প্রথম প্রথম ভাল লাগত, পরে বুঝলাম মাকড়শার জাল। মনে হত শানবাঁধানো যমুনার ঘাটে আছড়ে ফেলে ফোনটা ভেঙেই ফেলি। মরে যেতে ইচ্ছে হত, এমন পাকে পাকে জড়িয়েছিল সে আমায়, একের পর এক এস এম এসে। উত্তর দিয়েই কাল হয়েছিল। প্রথমে লিখত, মাঝরাত্তিরে পুঁক পুঁক করে বেজে উঠে ফোন জানান দিত যে লিখেছে, তোমাকে আদর করতে ইচ্ছে করছে। উত্তর দিলেও বিপদ, না দিলেও বিপদ। উত্তর দেওয়া মানে তো ওর কথাটাকে স্বীকার যাওয়া। আর না দিলে, আবার লিখত, জানি, তোমার ইচ্ছেটা এতই প্রবল, তাই আমার মেসেজের উত্তর দিতে পারলে না। আমি তোমার নিরুত্তর থেকেই জেনে নিলাম, সম্মতিটা আছে। এখন মনে মনে তোমায় আদর করছি।
    আমি হানড্রেড পারসেন্ট জানি, সেই লোকটার সঙ্গে তোর কত যোজন যোজন তফাত। সেই লোকটা তুই ছিলিস না, কৃষ, তুই না। সেই লোকটার কথা পড়লে আমার গা গুলতো শেষের দিকে। ওটাকে আমি প্রেম বলিনা, ওটা শুধু শরীর, শুধু শরীর। এত কামনা, মানুষ জানি কামনার দাস, কিন্তু তবু, সবার সব জিনিশের রং –ঢং ভাল না। সবাইকে সব জিনিস মানায় না। ওই লোকটাকে জেলে পোরা উচিত, তোকে নয়। তোর সঙ্গে আমি কিছুই করিনি হয়ত বা, অথবা সবকিছুই করেছি। কিন্তু তোকে যেভাবে নিয়েছি, নিজের অভ্যন্তরীণ করে নিয়েছি, সেভাবে তো নিতে দেয়না, দেয়নি কেউ। উল্টে আমাকেই নিয়ে, ঘেঁটে, বেছে, কাঁটা ছাড়িয়ে , নষ্ট করে যায়।
    তোর সম্বন্ধে আমার এত উদারতা কেন? ভয়ানক অভিমান, দোষারোপ কেন নয়? কেননা তুই শ্যামল কিশোর? কেননা তুই বড় বেশি সুন্দর। পুরুষ হলেও সুন্দর, তোর দিকে তাকিয়েও আমার সুখ? না কি তোর মেয়ে পটানোর রীতিনীতি অনেক বেশি পাকাপোক্ত? তুই আসলে জানিস, কোথায় থামতে হয়?
    প্রথম যেদিন মিট করেছিলাম, তুইও জানতিস, আমি তোর দূর সম্পর্কের মামি হই। তোর বয়স আমার থেকে অনেক কম। কিন্তু তোর চোখে কী একটা ছিল। সস্তার রেস্তোরাঁয় তোর সঙ্গে বসেছি, আবার ভাল দোকানেও। সেদিন তুই আমাকে সিটি সেন্টার দেখাতে নিয়ে গেলি। মফস্বলের মেয়ে বলে সাজতে জানিনা তা তো নয়, আগে তো দেখেছি মানুষ আমাকে দেখলে উতলা হয়। নিজের ওপর তখন কনফিডেন্স ছিল। এখন পয়ঁত্রিশের ভুল দিক, তাছাড়া অত বড়লোক, অত ভিড়, অত রং চং মাখা মেয়ে আর বিশাল বিশাল ছাত ওলা উঁচু উঁচু শপিং প্লাজা, তার থেকে ঝুলন্ত রঙ্গিন পতাকা পতপত ওড়ে, দেখে আমার পা জড়িয়ে আসছিল। চারপাশে প্যান্টস পরা, সালোয়ার পরা মেয়ের দল। আমার সেদিনের জরিপাড় শাড়ি আর নটকান দেওয়া গোলগলা ব্রোকেডের ব্লাউজে আমাকে কেমন দেখাচ্ছিল ভাবছিলাম। তাছাড়া আমার তো আর কুড়ি বাইশের চেহারাটা নেই। গালে গলায় মেদ, কোমরে মেদ। এসব সংশয় ছিল। কিন্তু তুই এলি, দূর থেকে এমন একটা হাসলি, তোর চোখদুটো দেখে সব ভাবতে ভুলে গেলাম। খালি ভাবলাম, ওঃ হো, ওই কালোর মধ্যে থেকে এমন আলো বেরোয় কী করে গো! ভগবান!
    আমাকে ছোটবেলা থেকে কম পুরুষ বাজে ছোঁওয়া দিয়ে যায়নি কৃষ। একেবারে ছোট বয়সে , যখন বারো কি তেরো, বাবা মা কেমন যেন পুলিশি সতর্কতায় ঘিরে রেখে দিত, অথচ তারই মাঝখান থেকে কতবার কত পুরুষমানুষ এসে ছোঁবার চেষ্টা করেছে। যখন একটু বড়, ভাবতে ভালই লাগত যে ঘনঘন ল্যান্ডফোনে ভূতুড়ে ফোন আসে কাদের যেন, তা আমারই জন্যে। অথবা, উড়ো চিঠি আসত।
    আমাকে ছাতে যেতে মানা করে দিয়েছিল বাবা। আমি ছাতে উঠতাম স্নান করে, চুল ঝাড়তাম। তখন ঢিলে বেঁধে রগরগে প্রেম পত্তর পড়ত। বাবা অনেক সময় ফোন ধরত, ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ফেলে কারা যেন চুপ করে ফোন কেটে দিত। আমি প্রথম দিকে এক দুবার ধরেছিলাম, বলত, তোমার প্রেমে আমি পাগল রাইকিশোরী। কাল স্কুল যাবার পথে কদমতলায় মিট করবে? দাঁড়াব।
    সেও তুই ছিলি না কৃষ। তুই আমার তোলা শাড়ি, তুই আমার গরিব মানুষের ইলেকশান আই কার্ড। খুব কষ্ট হলে তোকে নামিয়ে বুকে ধরি। যখন অপমানে চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে চায়, তখন তোর মুখ ভেবে শান্তি পাই। তোর ওপর আমাকে বিশ্বাস রাখতেই হবে।
    আমি বিশ্বাস করিনা, ওরা যা বলে, তুইও কদমতলায় দাঁড়াস, তুইও পারলেই আনটু শানটু করিস, যে কোন একটা মেয়েকে পেলেই তার সঙ্গে খানিক ফুরুদুরু করে নিস।
    আমার সঙ্গে যারা ফুড়ুত করে উড়তে চেয়েছিল , আমি তাদের সঙ্গে উড়িনি। তনয় সাহার দলের ছেলেরাও ছিল হয়ত তার মধ্যে। কিন্তু তাতে কী? আমাকে শত বেড়ি দিয়েও বাঁচাতে পারল আমার বাবা মা? শেষমেশ দোলের দিন, একটা দোলের দিনই ভুল সম্পর্কের আগুন লকলক করে ছুঁল আমায়। তনয় সাহার দলবলের হাতে পড়তেই হল আমাকে। বন্ধুদের থেকে আলাদা হতেই রং মাখিয়ে তনয় সাহার ছেলেরা আমাকে গ্যারেজে টেনেও নিয়ে গেল। যা খুশি করল। জোর করে মাল খাওয়াল। তবে, একটুর জন্য, মরলাম না আমি। মা বলেছিল, প্রথম কথাই, মরলি না কেন হতভাগী! কিন্তু মরতে যাব কেন শুনি? আমার ১৭ বছরের সুন্দর শরীরের ক্ষমতা ছিল দাগ মুছে ফেলার। হয়ত আমার সৌভাগ্য, সেবারের সে দাগ বেশিদিন ছিল না। হয়ত আমি পেরেছিলাম, আমার না বোঝা দিয়ে সব দাগ লুকোতে, আর বাবা মা পেরেছিল, তনয়ের কাছে আর্জি জানিয়ে, টাকা নিয়ে মুখ বুজতে।
    বাবা ভয় পেয়েছিল। তনয় সাহার লোকেরা সর্বত্র। পাড়ায় থাকবে কী করে যদি পুলিশে যায়। মিটমাট করে নিল। তনয় সাহার হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে টাকা নিয়ে বেপাড়ায় বাসা ভাড়া করল। আর আমার লুটে যাওয়া ইজ্জত ফেরত দিতে চেষ্টা করল বিয়ে দিতে। বাবার মধ্যে থেকে একটা স্ট্রোক হয়ে, মন ভেঙে গিয়ে, শরীর ভেঙে গিয়ে একেবারে শেষ হয়ে যাবার অবস্থা । তাই খুব তাড়াহুড়ো করে, প্রায় সামনে যাকে পায় তার সঙ্গেই বিয়ে দিতে বাবা উঠে পড়ে লাগল।
    অয়ন ঘোষের সঙ্গে আমার বিয়ে হল সাতদিনের নোটিসে। অয়ন ঘোষ দুবাইতে চাকরি করে। মজুর সাপ্লাই দেয়। মিডিলম্যান। বাবাকে কেউ একটা খবর দিল, বাবাও হুটোপাটি করে দিন সাতেকের মধ্যে আমার বিয়ে ঠিক করল। টাকা নিল অয়ন, কিন্তু সে টাকা তো মিটমাট করার জন্য তনয়ের পার্টির লোক দিয়েছিল বাবাকে। বাবার যা সঞ্চয় ছিল তাও গেল। আমি বিয়ে হয়ে মরুভূমির দেশে চলে গেলাম।
    আবার একটা ভুল সম্পর্ক? নাঃ হয়ত ভুল ঠিক বলে আসলে কিছু নেই। কিছু মনেই পড়েনা আজকাল আর। শুধু একটা ঠান্ডা, ম্যাদামারা,নিষ্কলুশ দিনগত পাপক্ষয় ছাড়া। আমার রাগ, আমার অনুরাগ সব জল হয়ে যাওয়ার গল্প। শরীরহীন, অক্ষম দাম্পত্যের মধ্যে ঢুকে পড়লাম আমি। কিন্তু সবাই তো জানে, শরীরই কোন বিয়েকে ধরে রাখে। নাঃ সবাই জানে কি তা? অয়ন জানত না। সে জানত বিকৃতি। সে জানত সে ঠান্ডা, কিন্তু চাইত আমি তাকে জাগাই। বলত, এবার তুমি আমাকে ঠিক করে দাও। ঠিক করে দে আমাকে, জাগা আমাকে, ওঠা আমাকে ধরে, পারবি না?
    অনেক চেষ্টা করে না পারলে সে আমাকে মারত। বেল্ট খুলে। কিন্তু শেষ মেশ বুঝে গেল, ওর কম্মো নয় জেগে ওঠা। আমার কম্মো নয় ওকে জাগানো। তবু, অনেকদিন একসঙ্গে ছিলাম আমরা। তেতো, কষাটে, অদ্ভুত এক সম্পর্ক ছিল আমাদের। আমি যন্ত্রের মত রান্না করতাম, ঘর পরিষ্কার করতাম, রাশি রাশি কাপড় কাচতাম। দুবাইয়ের রুখাশুখা আবহাওয়ায় সেসব কাপড় নিমেষে শুকিয়ে যেত। আমি বারান্দায় দাঁড়াতাম, হু হু হাওয়ায় বালি উড়ত। আমি ভাবতাম , কবে আবার আকাশ জোড়া মেঘ দেখতে পাব, কবে আবার বৃষ্টি দেখতে পাব। কোনদিন আদৌ দেখতে পাব তো?
    আমি আমার মত করে অয়নকে ভাল বেসেছি, ওও ওর মত করে আমায়। ঐটুকু সময় তো আমি আর কারো কথা ভাবিনি। শুধু জানতাম, জীবনে কতরকমের অদ্ভুত রসিকতা আছে। যে মেয়েশরীরের জন্য পাগল হত পাড়ার ছেলেরা, সেই মেয়েশরীরের সব রহস্য ভাঙল আমার তনয় সাহার মত একটা দাগি লোকের হাতে, আর যার কাছে খুব শিহরন খুব আনন্দ খুব আশ্বাস পাবার কথা, সেই অয়ন পারলই না আমাকে তেমনভাবে ছুঁতে।
    পরের বার যেই দেশে আসলাম আমরা, ছোট ছুটিতে, আমি বেঁকে বসলাম। মা বাবার কাছে ফিরে গেলাম। অয়নের সঙ্গে আর ফেরত গেলাম না। পিঠে বেল্টের দাগগুলো ছিল। ফোর নাইনটি এইট এ ছিল। ফিরতে হল না। কষ্ট হল আমার , অয়ন তো পরের দিকে আর আমাকে মারত না, কিন্তু আমি তো ওর দেওয়া ওই দাগগুলোকে ব্যবহার করে নিলাম ওর থেকে মুক্তি পেতে।
    বাবা মারা গেল, মায়ের সঙ্গে লড়াই ঝগড়া করে করেও এই বাড়িটাতেই থেকে গেলাম। মা কেবল বলে, এই এক মেয়ে আমার । সারাজীবন কষ্ট দিল এটা। বড্ড কষ্ট ।
    আমি যে কষ্ট পেয়েছি, সেটা কেউ দেখবে না কৃষ?
    কষ্ট পেতে আমার কোন আপত্তি নেই কৃষ। কিন্তু আমার মনের বল ভেঙে দিচ্ছিল ওরা সবাই । তনয় সাহা থেকে শুরু করে আমার মা অব্দি সবাই। আমাকে বলছিল, তুমি সুন্দর ছিলে , এখন আর নেই। তাছাড়া তোমার সৌন্দর্যই তোমার শত্রু। তুমি সব্বাইকে কষ্ট দিয়েছ , তোমার রূপের জন্য বাবা মা কষ্ট পেয়েছে। তুমি তাদের পেটের শত্তুর। তুমি তোমার স্বামীকে সুখ দিতে পারোনি। তাহলে আখেরে তোমার রূপ কোন কাজটায় এল শুনি? তুমি মানুষ হিসেবেও যোগ্য নও। কিচ্ছু পারো না তুমি , শুধু লোকের মাথা খেতে পার। আর এখন, এতদিন পর, তোমার সৌন্দর্যও ভাঁটায়, চাঁদেও তো কৃষ্ণপক্ষ আসে... তোমারও রূপ ধীরে ধীরে চলে যাবে।
    আশ্চর্য ভাবে আমিও বিশ্বাস করে নিয়েছি ওদের কথা। আমিও ভেবে বসেছি রূপই আমার একমাত্র মাপ। আমি ভুলে গেছি সারাজীবনে কত খেটেছি, কত কাজ করেছি। বাপ মায়ের সংসারেও ঘর ঝেড়েছি, মুছেছি, রেঁধেছি। অয়নের সংসারেও, রাশি রাশি রুটি বানিয়েছি, আমার জীবনের দাম কি তিনশো পয়ঁষট্টি ইনটু পনেরোটা গরম গরম ফুলকো ফুলকো রুটির সমানও নয়? দু বালতি করে কাচা কাপড়েরও কি দাম নেই? প্রতিদিন বিছানা ঝেড়ে রাখা, ঘর পুঁছে রাখারও কি দাম নেই?
    চল্লিশ পেরিয়ে, যখন আর পারছি না, সমস্ত জীবনটাই ধূসর ছাই ছাই, পলক ফেললেই মনে হয় নেই , কিছু নেই...তখন তুই এলি, কৃষ।
    এখন আমি আবার সুন্দর হয়ে উঠেছি। আমি এখন সৌন্দর্যের মানে জানি। বিকেলে এখনো এই মফস্বলের ছোট বাড়িটিতে মাধবীলতা দিয়ে ঢাকা ছাতে ঘুরি, মনে হয় সারাজীবনের অদ্ভুত দুঃখ কষ্টগুলো ছায়া হয়ে মিলিয়ে গেছে। নিজেকে আবার ভালবাসতে ইচ্ছে করে। নিজের জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে।
    তোর সঙ্গে প্রথম যেদিন মিট করি, তুই আমার হাঁটু ছুঁয়ে বলেছিলি, তুমি খুব ভাল, তোমার মন খুব সুন্দর। নিজে জানোতো তুমি কত সুন্দর? আর তোমার অনেক যত্ন চাই, আদর চাই। মুখ ফুটে বলবে না সেটা?
    আমি যে কেঁপে গেছি কৃষ, তোর কথা শুনে। আমার মনে যে সংশয়, যে কষ্ট, যে আত্মপ্রত্যয়ের অভাব জমা হয়েছিল, সব যে উবে গেছে তোর ওই কথায়। তুই যে আবার আমাকে বুকে বল দিলি, আবার ভেতরটা ভরিয়ে তুললি আত্মপ্রেমে। আসলে নিজের জন্য প্রেম সেটাই হারিয়ে গেছিল, একটা মেয়ের তো সেটাই সবকিছু। কেউ কখনো সেই কথাটা বোঝায়নি কেন আমাকে? তুই বোঝালি।
    যখন কেউ চায়না আমাকে, তখন তুই আমাকে চেয়ে, এটাই বুঝিয়েছিস , কৃষ, আমি এখনো ফুরিয়ে যাইনি। আমাকে কেউ এখনো চায়, আমার দিকে তাকায়, যেন মরুভূমির আকাশে থরে থরে শ্রাবণের মেঘ, যেন মৌসুমী বায়ুর ঢেউ চলে এসেছে আমার শুকনো আঙিনায়।
    এই পোড়া মাটির দেশে তুই আমার কালোকাজল আষাঢ়, তুই আমার অকাল বসন্ত। আমি চিরদিনের রাই, তুই আমার চিরদিনের কেষ্ট।
    আর একটা জিনিস আমি তোর সঙ্গে সম্পর্ক করে শিখেছি কেষ্ট। সেটা হল, একটা মেয়ে শুধু নিজেকেই সুন্দর ভাববে কেন? শুধু নিজের শরীরকেই পুরুষের কাছে সুন্দর বলে ধরে দেবে কেন? সে তো পুরুষকেও সুন্দর দেখবে। তুই যে এত সুন্দর, তুই যে এত নরম কোমল আবার এত তুখোড়, এত সজল শ্যামল আবার এত ধরাছোঁয়ার বাইরে , অনেকটা কালো লেপার্ডের মত ! বিদ্যুতগতিতে সাইকেল নিয়ে ছুটে যাস যখন রাস্তা দিয়ে, তোর টিরিং বেলের আওয়াজে সেই শ্যামের বাঁশি শোনার মতই আমি হাঁক পাঁক করে এসে দাঁড়াই আমার বারান্দায়, আশ্চর্য হয়ে দেখি তোর ছিপছিপে দেহটা। এই মুগ্ধতা তো আমি আগে পাইনি।
    তখনই বুঝতে পারি, জীবনে এই প্রথম পেলাম মেয়ে হয়ে একটা ছেলের প্রতি এই মুগ্ধতার অবসর! কেবল একটা ছেলেই একটা মেয়েকে শুধু চাইতে পারবে নাকি, এ সমাজ এমন বিধান দিয়েছে বলেই মেনে নিতে হবে? শুধু পুরুষগুলোই টেরিয়ে দেখবে মেয়েদের, গিলে খাবে? আমি যে তোকে চোখ দিয়ে গিলে খাই, আমি যে তোর দিকে তাকিয়ে সবকিছু ভুলে যাই, আমার অতীত, আমার অপমানভরা দিনগুলো, আমার ক্ষতবিক্ষত শরীর, আমার মায়ের সঙ্গে আমার রোজকার খিটিমিটি, আমার বুকভরা কাশি, আমার গঞ্জনাভরা পাড়াপড়শি।
    আমি তোর দিকে তাকাই আর ডুবে যাই তোর সৌন্দর্যে। বড় বড় পন্ডিতগুলো পন্ডিতি করুক গিয়ে, পুলিশগুলো তোকে তাড়া করে বেড়াক গিয়ে, তুই কিন্তু কেবল একলা একলা একটা নারীকে ভোগ করে পালাসনি, তুই তোর কাছাকাছি যে সব মেয়েরা এসেছে তাদেরও মুক্তির আকাশ দিয়েছিস, অন্তত আমাকে তো দিয়েইছিস, আমার বাঁকাশ্যাম! আমি তোর জন্যই বেঁচে গেছি।
    আজ, যমুনায় ডুবে মরার কথাটা ভাবতামও না, যদি তোর সিম ফেলে না দিতিস। এই সুইসাইড নোটে, আমার আর তোর ভেতরে ঘটে যাওয়া সব কথা লেখা থাকল না। ওরা চাইলেও খুঁজে পাবে না কোন ট্রেস, কোন ক্লু। যদি দায়ী কেউ হয়ে থাকে , সে আমার বাবা মা, ওই তনয় সাহা, ওই অয়ন ঘোষ, সক্কলে মিলিয়ে যেটা , সেইটা, এই সমাজ। সবকটা ভুল সম্পর্ক। তুইনা, কৃষ, তুই না। আমি শেষ মুহুর্ত অব্দি বিশ্বাস করতে চাই তোর সঙ্গে এটা আমার ভুল সম্পর্ক ছিল না।
    ইতি, তোর রাধা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০২ মে ২০১৪ | ১৫৫২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ঐশিক | 133.252.160.213 (*) | ০২ মে ২০১৪ ০২:০২73012
  • খুবই ভালো লাগলো দিদি
  • | 24.97.123.186 (*) | ০২ মে ২০১৪ ০৯:৪২73010
  • এটা অবশ্য ফেবুতে পড়েছিলাম।
  • কল্লোল | 125.242.140.76 (*) | ০২ মে ২০১৪ ১১:৩৪73011
  • পরজনমে হইয়ো রাধা....................
  • Biplob Rahman | 127.18.231.62 (*) | ০৪ মে ২০১৪ ০৫:৩৮73013
  • হা প্রেম! :/
  • ঝর্না | 52.104.2.220 (*) | ০৮ মে ২০১৪ ০৪:৫২73014
  • খুব ভালো একটি লেখা পড়লাম...
  • AP | 24.139.222.45 (*) | ০৮ মে ২০১৪ ০৭:৫৩73015
  • খুব ভলো লেখা, তবে রাধা সুইসাইডটা না করলেই পারতো !
  • Avik Mukherjee | 125.253.246.133 (*) | ১০ মে ২০১৪ ০৯:৫০73016
  • শিলাদিত্য পত্রিকায় দোল - এর সময় পড়েছি। বেশ লেগেছিল।
  • yashodhara ray chaudhuri | 24.99.42.81 (*) | ১১ মে ২০১৪ ০১:৫২73017
  • thanks...sobbaike... porer part e lekha hobe, jamunay jete jetei or shyam er songe dekha hoye gelo... ar hindi cinemar moto ekta kono happy ending... !!!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন