এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • অন্য কোথা অন্য কোনখানে

    কল্লোল লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৮ মার্চ ২০১৬ | ২০৭৩ বার পঠিত
  • অন্য কোথা অন্য কোনখানে
    চলছিলো তো অনেক কিছুই। রোহিত ভেমূলা, কানহাইয়া কুমার, উমর খালে্দ, আজাদী, কাশ্মীর, উত্তরপূর্ব, ঋণখেলাপী বিজয় মালিয়া, নারদ স্টিং এ কাহিল তৃণমূল, নানান বাদ-প্রতিবাদ ইত্যাকার বহুকিছু। এসবের মধ্যেই সুযোগ এলো উত্তর কর্ণাটকের আদিবাসী গ্রামে যাবার। এরা অবশ্য আদিবাসী বলে না, বলে বনবাসী। এই ঘুরতে যাবার একটা নামও দিয়েছে এরা বনযাত্রা। এরা হলো অখিল ভারতীয় বনবাসী কল্যান আশ্রম। উইকি বলছে এরা সঙ্ঘ পরিবারের সদস্য। ধর্মান্তর নিয়ে এদের নানান মাথাব্যথা। আমার সাথে এদের যোগাযোগের সেতু হলো রমেশ, রমেশ ভাট। পেশায় কোম্পানি সেক্রেটারী। নিজের ফার্ম আছে। আমাদের নানা কাজে বহু সাহায্য করে। কথাবার্তায় একটু বিজেপি ঘেঁষা। অসম্ভব মৃদুভাষী ও নিপাট ভদ্রলোক।
    ও অনেকদিন থেকেই বলছে, ওরা উত্তর কর্ণাটকের আদিবাসী এলাকায় একটা স্কুল চালায়। সেখানে হোস্টেলে রেখে প্রায় পঞ্চাশজন আদিবাসী ছেলেকে বিনা খরচে পড়ায়, সেটা দেখতে যেতে। কোনবারই যাওয়া হয়ে ওঠে না। এবার তাই মনে হলো ঘুরেই আসি।
    উত্তর কর্ণাটক জেলার মুন্দগোদ তালুকে দুটো গ্রামে যাওয়া হবে চিপাগেরি আর বাইনহাল্লী। সারারাতের বাসযাত্রা। ব্যাঙ্গালোর থেকে সিরসি। সিরসি তালুকের প্রধান শহর সিরসি হলো একটা ছোট্ট শহর। সহযাত্রীরা সকলেই ব্যাঙ্গালোরের, আমি ও আর দু-চারজন ছাড়া সকলেই কোম্পানি সেক্রেটারী বিরাদরির। আমি ও আর একটি দিল্লীর ছেলে বাদে সকলেই কান্নাডিগা। পাঁচজন মহিলা সহ আমরা প্রায় পনেরো-ষোলো জন। বাসটি আমাদের ভাড়া করা।

    সিরসির পিডব্লিউডি বাংলোতে স্নান সেরে একটা ছোট রেস্তরাঁতে ইডলি-বড়ার প্রাতঃরাশ। এখানকার সম্বরের স্বাদ ব্যাঙ্গালোরের চেয়ে আলাদা। নারকেলের চাটনীটি কোন এক অজানা মশলায় সামান্য লালচে ও স্বাদে একটা ঝাল ভাব আছে। প্রচুর তিব্বতী মানুষ খেতে এসেছেন কাছের এক তিব্বতী উদ্বাস্তু কলোনী থেকে।
    সিরসি থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ত্রিপালজী। উনি এখানকার বরিষ্ঠ সঙ্ঘ প্রচারক। খেতে খেতে আলাপ হল। অকৃতাদার, একহারা চেহারা, মৃদুভাষী ও ভীষন বিনয়ী। বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। পরনে সাদা ধুতি-কুর্তা, কাঁধে ঝোলা, কাঁচা-পাকা চুল, পরিষ্কার কামানো মুখমন্ডলে একধরনের শান্ত অথচ প্রত্যয়ীভাব।

    প্রাতঃরাশ সেরে বাস চললো কাছের এক গ্রামের ইস্কুলে। এটি সরকারী ইস্কুল। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করা যায় এখানে। এটি আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা। এখানকার আদিবাসীরা গৌলি। এরা মূলতঃ গোয়া আর মহারাষ্ট্র থেকে আসা। চাষবাস আর গোপালন এদের জীবিকা। তাবে একটা মজার ব্যাপার এরা শুধু দেশী গরু পোষেন। সংকর জাতের গরুতে এদের তীব্র আপত্তি। সেসব গরুর দুধকে এরা দুধ বলে মানেন না। দুপুরের খাওয়ার ঠিক আগে আমরা পৌঁছেছি। একটা শ্রেণীকক্ষে আমাদের বসানো হলো। বাচ্চারা আমাদের গান শোনালো। ভাষা বুঝি না, তাই সঙ্গীদের একজন মোটামুটি অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন। ভারতমাতার গান, দেবতাদের নিয়ে গান। চারটি ছেলে ও দুটি মেয়ে আলাদা করে গাইলো। বেশ সুরে গলা। মেয়েরা আর ছেলেরা নাচও দেখালো। ছেলেদের নাচটি বৈশিষ্টহীন। গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচ, গানের সাথে। মেয়েদের নাচটি বেশ সুন্দর। চারটি মেয়ে উবু হয়ে বসে মাটিতে দুহাতের পাতা বুলাতে বুলাতে হঠাৎ বসা অবস্থাতেই শূণ্যে পা ছুঁড়ে গোল হয়ে ঘুরতে লাগলো। অনেকটা রাশিয়ান ছবিতে দেখা কসাকদের নাচের মতো। এরপর ত্রিপালজীর অনুরোধে তারা গীতার বেশ কিছু শ্লোক শোনালো।
    ত্রিপালজী কিছু বললেন। অনুবাদে বুঝলাম, মূলতঃ নিজেদের ঐতিহ্য ও পরম্পরা বজায় রখাতে অনুরোধ করলেন।
    দুপুরে বাচ্চাদের খেতে দেওয়া হলো, মশলা দেওয়া ভাতের মধ্যে ছোলা সেদ্ধ।
    তিনজন শিক্ষক। একজন পুরুষ, অন্য দুজন মহিলা। মহিলারা খুব সুন্দর করে শাড়ি পরেছেন। বেশ পরিপাটি।
    ইস্কুলের বাইরে কিছু মানুষের সাথে কথা হচ্ছিলো। মূলতঃ ধান চাষ ও গোপালন করেন। দুধ বেচার চেয়েও বেশীটা নিজেরাই খান। চাষের মরশুম শেষ হলে জন খাটতে যান গোয়ায়। ওখানে দিনে তিনশো টাকা মজুরী পাওয়া যায়। খাইখরচ মিটিয়ে হাতে এক/দেড়শো টাকা থাকে।
    এরা মারাঠীভাষী। কানাড়া ভাষাটিও রপ্ত। ইস্কুলে কানাড়া ভাষায় পড়ানো হয়। সে কারনে বাচ্চাদের ইস্কুলে পাঠাতে অভিবাবকদের অনিহা আছে।
    ওদের নিজেদের উৎসব হয় এপ্রিল মাসে। সে উৎসব ওদের আদিবাসী উৎসব। তবে ওরা হোলীও খেলেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে হোলী খেলা হয়।

    ফিরে এলাম সিরসিতে। ওই পিডব্লিউডি বাংলোতেই দুপুরের খাওয়া। উত্তর কর্ণাটকী রান্না। দুটো সব্জী, ভাত আর সম্বর। শেষপাতে দই।

    এবার আমাদের সাথে যোগ দিলেন দুই মহিলা ও একটি কিশোর। এরাও সঙ্ঘ প্রচারক। খাওয়ার পর প্রায় ঘন্টাখানেক কথা হলো। ওরাই বললেন, অন্যেরা শুনলো। ধর্মান্তকরনের সমস্যা নিয়ে বলছিলেন। আদিবাসীদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে এদের খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হচ্ছে – এই রকম সব। ওরা তাদের “re-convert” করছেন বলে দাবী করলেন। আমার জিজ্ঞাস্য ছিলো, ওরা কি এই আদিবাসী খ্রীস্টানদের হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করছেন? জবাবটা বেশ চমকে দেওয়ার মতো – না, আমরা ওদের আদিবাসী ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে বলছি।

    রওনা হলাম বায়ানাল্লী গ্রামের দিকে। এটি মুন্দগোদ তালুকে। আমাদের গোটা যাত্রাটাই বিশাল জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যার মাঝে মাঝে বিন্দুর মতো জেগে রয়েছে এই আদিবাসী গ্রামগুলো। ছোটনাগপুর মালভূমির জঙ্গলের মতোই পর্ণমোচী গাছের বন। এখন বেশীরভাগ গাছেই পাতা নেই। কিছু কিছু গাছে সবে পাতা আসছে। পাতা ছাড়া গাছ দেখে চেনার মতো বৃক্ষবিশারদ নই, তাই আন্দাজে মনে হলো বেশীটাই শালবন। বেশ কিছু বুনো কাজু গাছ দেখেছি গ্রামগুলোর চারপাশে। এখানকার মাটি কালো। কাপাসের চাষ হয়। জিজ্ঞাসা করে জানলাম বীজহীন তুলো এখানে ব্যবহার হয় না।
    পথ অনেকটা। তাই পৌঁছাতে বেলা পড়ে এলো। অবশ্য এখানে এখন সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত কাজ চালানোর মতো আলো থাকে। বায়ানাল্লী গ্রামে পঞ্চাশ/ষাঠ ঘর আদিবাসী থাকেন । বেশ সম্পন্ন গ্রাম। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ও ডিশ টিভি আছে। নেটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ৫৬% মানুষ সাক্ষর এই গ্রামে। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছিলেন এই গ্রামেরই দুই যুবক। তাদের একজনেদের বাসার দাওয়ায় বসা হলো। চা চানাচুর সহযোগে বৈকালিক স্বল্পাহারও হালো। এটি পাকা বাড়ি। সদর দরোজার দুপাশে রীতি মেনে লাল সিমেন্টের রোয়াক। তাতে প্লাস্টিকের মাদুর পেতে বসা। অনেকটা যায়গা নিয়ে বাড়ি। বসতবাড়ি, শষ্যগোলা, গোয়াল, আনাজের বাগান, সব মিলিয়ে বেশ অবস্থাপন্ন ছবি। ত্রিপালজী ও অন্য প্রচারকেরা এখানে, ভালোই পরিচিত। নিয়মিত আসা যাওয়া আছে। বাচ্চারা ত্রিপালজীর কোলে চড়ে চানাচুরে ভাগ বসাচ্ছে।
    আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো গ্রামের ইস্কুলটিতে। আগের ইস্কুলটির তুলনায় খুব ছোট। একটাই ঘর। বিজলী বাতি আছে, তবে হুকিং করে। এটি চালান অখিল ভারতীয় বনবাসী কল্যান আশ্রম। সেখানে বাচ্চারা ভারতমাতার আরতি করতে করতে গান গাইলো। এবং আবারও ত্রিপালজীর অনুরোধে গীতা আর বেদ থেকে পাঠ হলো।
    সন্ধ্যা নামলো বহুক্ষণ ধরে। পাতাহীন বৃক্ষরাজির ফাঁকে অস্তমিত লাল সূর্য অনেকক্ষন বিরাজ করলেন। শুনলাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।
    গ্রামের শেষে বনের গা ঘেঁসে একটি চালাঘর। বেঞ্চিও পাতা আছে তাতে। হয়তো পঞ্চায়েতের সভা হয়। অন্য সময়ে আড্ডাঘর হিসাবে ব্যবহারও হয় হয়তো। সেই চালাঘরের সামনেটাই মঞ্চ হলো দুটো ব্যাটারী আলো দিয়ে। পিছনটা সাজঘর।
    একটা নাচ দিয়ে শুরু হলো, ছেলেদের নাচ। তিনটি ছেলে সাদা পোষাকে। অনেকটা গুজরাটি পোশাকের মতো ছোট কুর্তার সাথে গোড়ালি পর্যন্ত লহঙ্গার মতো। সাথে মাদলের মতো তাল যন্ত্র ও ঝাঝ (বড় করতাল) । এর পর নাটক। বিষয়বস্তু বেশ হাড়হিমকর। অভাবের তাড়নায় সন্তানকে বেচে দেওয়া। অবশ্য শেষটায়, টাকা ফেরৎ দিয়ে সন্তানকে ফিরিয়ে আনা। নাটকের মাঝে মাঝে প্রাচুর হাস্যরসও এসেছে, সেটা সমবেত দর্শকদের হাসির হররা দেখে বোঝা গেল। গ্রামেরই একটি ছেলে লিখেছে, সেই নির্দেশক। মেয়েদের নাচ এলো তারপর। গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে অনেকটা সাঁওতালি মেয়েদের নাচের মতো। বৈশিষ্টটি অন্য বিষয়ে। নাচতে নাচতে মেয়েরা যখন মাথা ঝুঁকিয়ে এক পা থেকে অন্য পায়ে যাচ্ছে, তখন খুব জোরে শ্বাসের আওয়াজই তালের কাজ করছে। লয় ক্রমশঃ বাড়তে বাড়তে দ্রুত হচ্ছে। শেষের দিকে প্রায় – আরডির পিয়া তু অব তো আজা–র পরে যে - আহা আহ আহা আছে অনেকটা তার মতো শোনাচ্ছিলো। দুটি মেয়ের গান দিয়ে শেষ হলো।
    এরপর ত্রিপালজী কিছু বললেন। অনুবাদে যা বুঝলাম, তা বেশ রোমাঞ্চকর। জঙ্গলের অধিকার বনবাসীদের। সেটা তাদের আদায় করতে হবে। বনবাসীদের সম্মতি ছাড়া জঙ্গল কাটা চলবে না।

    ওখান থেকে আসা হলো হোস্টেলে। লেখার শুরুতে যে হোস্টেলের কথা বলেছিলাম, সেই হোস্টেলে। পঞ্চাশজন ছেলে থাকে এখানে। এখান থেকে বেশ দূরে অন্য জায়গায় মেয়েদের হোস্টেলও আছে। সকলেই আদিবাসী। একটি সিদ্দী ছেলেও আছে। সে কথায় পরে আসছি। হোস্টেলের পাশেই ইস্কুল। হোস্টেলে ছেলেদের দেখাশোনা করেন এক যুবক, মঞ্জুনাথ। ইনিও সঙ্ঘের সর্বক্ষণের কর্মী। এছাড়া এক মহিলা আছেন রান্নার জন্য। মঞ্জুনাথ বেশ কড়া গোছের স্বল্পবাক মানুষ। হাফহাতা শার্ট আর খাঁকি হাফ প্যান্ট। খালি পায়ে থাকেন। কখনোই চটি বা জুতো ব্যবহার করেন না। ছেলেদের খাওয়া শেষ হলে আমরা খেলাম। ভাত, সব্জি, সম্বর ও দই। খাবার শুরুতে কষায়া দেওয়া হলো। দুধের সাথে কি সব জড়িবুটি দেওয়া। খেতে খারাপ না।
    খাওয়ার পর হোস্টেলের সামনে উঠোনে জমায়েৎ। ছেলেদের জন্য আনা নানান খেলার সরঞ্জাম, ভলিবল, নেট, ব্যাট-বল-উইকেট, বল ও সাইকেলের চাকা পাম্প করার সরঞ্জাম এমনি নানান জিনিস ওদের হাতে তুলে দেওয়া হলো। সব শেষে আবারও ত্রিপালজী কিছু বললেন। অনুবাদে আবারও রোমাঞ্চকর ঠেকলো। পড়াশোনা, খেলাধূলা, ভারতীয় ঐতিহ্য এসবের সাথে বললেন – তোমাদের বেদ পাঠ করতে হবে। কোন একটা শিক্ষাকেন্দ্র খোলা হয়েছে, সম্ভবতঃ প্রতি রাজ্যে একটি, যেখানে শুধু অব্রাহ্মণদের বেদ পড়ানো হবে। বললেন – বেদে কোথাও লেখা নেই যে অব্রাহ্মণ বেদ পড়তে পারবে না। আরও বললেন – আদিবাসীরা ভারতের জনসংখ্যার দশ শতাংশ। খনি, বাঁধ এসবের কারনে সবচেয়ে বেশী তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। তাই তাদের আত্মিক বলে বলিয়ান হয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

    সকালে চা খেয়ে যাওয়া হলো একটি সিদ্দী বসতিতে। একটি সিদ্দী পরিবার এখানে বসত গড়েছেন প্রায় তিরিশ বছর আগে। এখন সে পরিবার বেড়ে চোদ্দটি ঘর। এরা কলা আর সুপারী চাষের সাথে গোপালন করেন।
    সিদ্দীরা দক্ষিন পূর্ব আফ্রিকা থেকে আসা মানুষ। কেউ বলে মুঘল-পাঠান আমলে এদেরই হাবশী বলা হতো। কারুর মতে সিদ্দীরা বান্টু জাতির মানুষ। হাবশীরা ইথিওপিয়া আবেসিনিয়ার মানুষ। সে তর্কে না গিয়েও এদের চেহারাতে, পুরু ঠোঁট, কোঁকড়ানো চুলে, আফ্রিকার ছাপ স্পষ্ট।
    আলাপ হলো রমণ সিদ্দীর সাথে। উনিই এদের মধ্যে বয়ঃজেষ্ঠ। উনিই ওনার পরিবার নিয়ে এখানে আসেন তিরিশ বছর আগে। তার আগে ওনারা অন্য কোথাও থাকতেন। ওনার বাবা অভাবের তাড়নায় জমি বাড়ি সব বেচে দেওয়ায় ওনারা সে জয়গা ছাড়তে বাধ্য হন। জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে এ জায়গাটি ভালো লাগায় এখানেই ঘর বাঁধেন। বনদপ্তর মৌখিক অনুমতি দিয়েছে মাত্র। ফলে বনদপ্তর এদের দিয়ে বিনিপয়সায় কাজ করায়। কলাটা দুধটা আদায় করে।
    এদের দেবস্থান দেখলাম। সেটা রমণের ঘরের ভিতরেই। একটা ছোট গাছের কান্ডের মতো, মাটি দিয়ে লেপা। এটি কি দেবতা জিজ্ঞাসা করে যে উত্তর এলো তাতে অনুবাদকও বেশ কিন্তু কিন্তু করে বললে – সাপ। সেও নিশ্চিত নয়। ওখানে অদ্ভুত একটা ফল খেলাম। এরা বললে কাজু। আমি তো জানতাম কাজু ফল খাওয়া যায় না। খেলে মুখে প্রচন্ড চুলকানী হয়। এ ফলটি দেখতে জামরুলের মতো, কিন্তু খুব নরম আর রসে ভরা। নুন দিয়ে খেতে হয়। একবারে পুরোটা মুখে পুরে চিবালে মুখ ভরে যায় রসে। মিষ্টি রস।

    ওখান থেকে হোস্টেলে ফিরে ইডলী দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে সিরসি। সেখানে দুপুরের খাওয়া সেরে ত্রিপালজী ও অন্য প্রচারকদের থেকে বিদায় নিয়ে বাস চললো ব্যাঙ্গালোর।

    সারা পথ নানান ভাবনা এলো। বার বার কেন যেন মনে আসছিলো মাওবাদীদের কথা। ওরা যে সব বিষয়কে ধরে আদিবাসীদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, সেই একই বিষয় নিয়ে এরাও আদিবাসীদের মধ্যে প্রভাব তৈরী করছে। সেই জঙ্গলের অধিকার, সেই খনি, বাঁধ বিরোধী অবস্থান, সেই উচ্ছিন্ন না হওয়ার দাবী......। মাওবাদীদের মতোই এরাও এইসব এলাকায় লেগে পড়ে আছে সর্বক্ষণ।
    এরা ইস্কুল চালাচ্ছে, হোস্টেলে রেখে পড়াচ্ছে, সবটাই বিনিপয়সায়। তার সাথে এদের সাংষ্কৃতিক বৈশিষ্টকে রক্ষা করা এবং তারই সাথে গীতা-বেদ শিক্ষা – অব্রাহ্মণদের, আদিবাসীদের। তফাৎ, মাওবাদীদের মতো রাষ্ট্রবিরোধী কর্মসূচী না থাকায়, রাষ্ট্রের তাড়া খাওয়া নেই।

    সামনে হয়তো কঠিনতর দিন আসছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৮ মার্চ ২০১৬ | ২০৭৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • শিবাংশু | 127.201.154.90 (*) | ২২ মার্চ ২০১৬ ০৫:২৩56957
  • কল্লোলদা,

    তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের লামাদের অধ্যাত্ম জ্ঞান নিয়ে আমার বিশেষ ভালো অভিজ্ঞতা নেই। লদাখ ভ্রমণের সময় প্রত্যেকটা বড়ো গোম্ফায় আমি সেখানে উপস্থিত লামাদের সঙ্গে কথা বলেছি। না হলেও গোটা কুড়ি-পঁচিশ। নবীন প্রবীণ দুইই। কিন্তু কেউই বজ্রযানের তিব্বতি সংস্করণের গেলুক পা বা দ্রুক পা'র কিছু আনুষ্ঠানিক লোকাচার বা মিথের বেশি জানেন না। অতিথিদের বলার জন্য বজ্রযানী বৌদ্ধ প্যান্থিয়নের কিছু ( তাও বড়ো জোর চার-পাঁচ জন) দেবদেবীর নাম জানেন । দু'জন ছাড়া লামা তারানাথের নামও বাকিরা জানেন না। দু'টি গোম্ফায় কিছু কিছু আগ্রহী সাহেবমেম শ্রোতার কাছে আমাকে রীতিমতো লেকচার সেশন করতে হলো ( আমার ব্রাহ্মণীর ঘোর কটাক্ষ উপেক্ষা করে)। সেখানে বেশ কিছু লামাও ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ বললেন " এসব কথা আমাদের 'কাজে' লাগবে।" বজ্রযানের বিশদ অ্যাকাডেমিকদের জন্যই থাক। শাক্যমুনির যুক্তি ও করুণার দর্শন, যেটা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য, মনে হয়না ঔপচারিক তিব্বতি লামাদের তা'তে বিশেষ দখল আছে।

    আসলে আমাদের দেশে অল্প কয়েকটা সেরিব্রাল কেন্দ্র ব্যতিরেকে শাক্যমুনি বুদ্ধ বা তাঁর দর্শন সম্পর্কে লোকজন বিশেষ কিছু জানেনা। একজন সাধারণ নব্য বৌদ্ধের শাস্ত্র জ্ঞান দীঘ্ঘ নিকায়, খুদ্দ নিকায়, ধম্মপদের মলাট পর্যন্তই যায়। নিবেদিত হিন্দুত্বপন্থীদের বেদপুরাণ 'জ্ঞানে'র মতো'ই। সত্যি কথা বলতে আজকের ভারতবর্ষের কাছে গৌতমবুদ্ধ এসেছেন তো সাহেবদের হাত ধরেই।
  • de | 69.185.236.51 (*) | ২২ মার্চ ২০১৬ ০৬:১৪56958
  • আরেসেসের সংগঠনের যা মেশিনারি তাতে বহু ভালো কাজ করা যায়! এই যে অনির্বাণ, কল্লোলদা যা করছেন, এমনিভাবেই ধীরে ধীরে ওদের ব্রেনওয়াশ করে ফেলতে হবে! তারপরে কতো ভালো কাজ ওদের দিয়েই করানো যাবে। আগে থেকেই চাড্ডী ইঃ বলে গালি দিয়ে বিরূপ করে তোলা চলবে না!
  • Tim | 108.228.61.183 (*) | ২৫ মার্চ ২০১৬ ০৬:১১56959
  • কল্লোলদার লেখাটা ভালো লাগলো। আমারো বেশ ভালোই লাগলো কর্মসূচী। পার্ফেক্ট না হলেও, সলিউশন তো বটে।
  • রোবু | 213.99.211.81 (*) | ২৫ মার্চ ২০১৬ ০৬:২৫56960
  • আমার একটা জায়গায় প্রবলেম লাগলো। বনবাসীদের নিজেদের ঐতিহ্য ও পরম্পরা বজায় রাখতে উত্সাহ দেওয়া ও বেদ পড়ানোর মধ্যে কোনো কনফ্লিক্ট নেই?
  • saikat | 126.203.136.72 (*) | ২৫ মার্চ ২০১৬ ০৮:০০56961
  • সময় থাকলে এটা পড়ে দেখতে পারেন।
    http://www.hindustantimes.com/india/target-northeast-how-rss-plans-to-make-region-saffron/story-YZGPkOBXb6tS301BvpunpJ.html

    ভারত-বিরোধিতা, পশ্চিমী সভ্যতার প্রভাব, মিশনারীদের কাজ, এসবের বিরুদ্ধে আরএসএস ইত্যাদিদের কাজকর্ম। এবং পড়শোনাকে ব্যবহার করে।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন