আমি শিক্ষাবিশেষজ্ঞ নই। এবং আমার দৌড় কলকাতা থেকে সিঙ্গুর অবধি। সেটাও নেহাৎই মধ্যবিত্ত বৃত্তে। সেই বৃত্তে আমি কী দেখছি? আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধবরা প্রায় কেউ তাঁদের ছেলেমেয়েদের রাজ্য বোর্ডের ইশকুলে পড়াননা। যাঁরা রাজ্য বোর্ডের শিক্ষক, তাঁরাও না। তার নিশ্চয়ই অনেক কারণ আছে। কিন্তু মোদ্দা কথা হল, কলকাতা থেকে সিঙ্গুর অবধি, এই যে তিরিশ কিলোমিটার এলাকা, স্যাম্পল সার্ভে না করেই বলতে পারি, যে, রাজ্য বোর্ডের ইশকুল গুলো মধ্যবিত্তের প্রথম পছন্দ তো নয়ই, বরং অগতির-গতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। আমরা যে ইশকুলগুলোয় পড়েছি, যেগুলো নামী ইশকুল বলে জেনেছি, সেগুলো সমেত। দুর্নীতি, ইশকুল-বন্ধ করে দেওয়া, এই ব্যাপারগুলো দিয়ে এই দুচ্ছাইকরণ প্রক্রিয়াটাকে ক্রমশ ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। ... ...
এইটুকু খালি জানা আছে, যে, শুদ্ধস্বরের সঙ্গে এবার লাগছিল কোমল ধা এবং নি। বেহালা এবং সেতার বাজছিল পরপর। বোঝা যাচ্ছিল, শুরুর স্বর স্রেফ চোখে-ধুলো-দেওয়া উদ্যোগপর্ব ছিল। আসলে সেই শুদ্ধস্বর ছিল প্রস্তুতি, আসলে যা হয়ে উঠবে চারুকেশী। বদলে যাচ্ছিল দৃশ্যায়ন। অনির্বাণ মাঝে-মাঝেই একটু-একটু সুজন হয়ে যাচ্ছিলেন, আর সুজন একটু-আধটু অনির্বাণ। আর নাটকের ঠিক মাঝখানে এসে, দেখা গেল, দুজন শারীরিক ভাবে জুড়ে গেলেন। পিছনে, যদ্দূর মনে করতে পারছি, সেই মুহূর্তেই বেহালা সিম্ফনী হয়ে গেল। সেও ভেঙে দেওয়া চারুকেশীতেই। পাশ্চাত্যে এই স্কেলটার নাম মেলডিক মাইনর। ঝপাঝপ মিলে গেল তারাও। ... ...
এই ফুটবলের বাজারে আমি লোভে পড়ে একটা সিনেমা দেখে ফেললাম। কলকাতার সিনেমাজগতের পুরাযুগ নিয়ে সিনেমা, জিনিসটায় আমার আগ্রহ আছে, সেই লোভে। সিনেমার নাম কলা। ইংরিজিতে QALA। তাই থেকেই বোঝা উচিত ছিল কেসটা। কিন্তু আমি আবার ঠেকে শিখি। খুলে দেখি একেবারে কাঁচQALA । যেমন মিস্টিসিজম, তেমনই ডার্ক, কিন্তু সিনেমাটা কীসের প্রেক্ষাপটে, সুইজারল্যান্ড না কলকাতা, বোঝার উপায় নেই (ভাষা হিন্দি, তাতে অসুবিধে নেই, কারণ,হিন্দি সিনেমার প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রায়ই সুইজারল্যান্ডে দেখা যায়।) কলকাতার সিনেমা নিয়ে ছবি, কিন্তু সারাক্ষণ দেখে গেলাম সিমলারও উত্তরে কোন এক জায়গায় ধাঁইধপাধপ বরফ পড়ছে। কেদার-বদ্রীতেও সারাবছর বরফ পড়েনা, আলাস্কাতেও না, কিন্তু এখানে পড়ে, হয়তো উত্তরমেরুর কাছাকাছি, কে জানে। সেখানে এক সঙ্গীতশিল্পী মহিলা তাঁর মেয়ের উপর হেবি অত্যাচার করেন, আর বেপাড়ার একটা পাঞ্জাবি ছেলেকে ধরে এনে গান শেখান। সেই জাল ভেদ করে মেয়ে একদিন কলকাতায় গানের জগতে সুপারস্টার হয়, এই হল গপ্পের একটা অংশ। শুরুর পাঁচ মিনিটেই এটা বুঝতে পারবেন, কাজেই স্পয়লার নয়। ... ...
এ বছরের গোড়ার দিকে মোদী এবং সুভাষ বসুকে নিয়ে আনন্দ পট্টবর্ধন যা লিখেছিলেন, বঙ্গানুবাদে তা এরকমঃ "মোদী এবং আরএসএস কেন সুভাষ বসুকে ভালোবাসে, ভালো করে বুঝে নিন! সুভাষ যখন হিটলারের সঙ্গে নীতিগত বোঝাপড়ায়, তখন আরএসএস আর হিন্দু মহাসভা তার সঙ্গে আদর্শগত বোঝাপড়া করে ফেলেছে। হিটলারের আশীর্বাদ নিয়ে সুভাষ আজাদ-হিন্দ-ফৌজে যাদের নিয়োগ করেন, তাদের বেশিরভাগটাই সেইসমস্ত ভারতীয় সেনাদের থেকে, যারা জার্মান, ইতালিয়ান, এবং জাপানিদের হাতে ধরা পড়েছিল। হ্যাঁ, তাদের অনেকেই নাৎসিদের পক্ষে যুদ্ধ করে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু আরও, আরও অনেক বেশি ভারতীয় সৈন্য মারা যায় নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।" এতে তথ্য এবং বোঝাপড়াগত কিছু ভুল আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল, এই লাইনে বললে, তার ফলাফল কী হবে। আজাদ-হিন্দ-ফৌজ নাৎসিদের জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছিল, সুভাষ-আরেসেসের একরকম করে বোঝাপড়া ছিল, এ কথা বললে, বঙ্গে ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতা নিঃসন্দেহে লাটে উঠবে। ... ...
এটা, ওই এলাকায় চালু পদ্ধতি। অর্থাৎ টাকা ধার নিয়ে শোধ দিতে না পারলে সেক্ষেত্রে মেয়েদের নিলামে চড়ানো হয়। তাতে যা দাম উঠবে উঠবে। অন্তত আধডজন জেলায়, এএনআই এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জিনিসটা চালু। রীতিমতো স্ট্যাম্প পেপার দিয়ে সইসাবুদ করে কর্মটা সমাধা করা হয়, স্থানীয় পঞ্চায়েতের সহযোগিতায়। এটাই একমাত্র পদ্ধতি তা নয়। ঋণ পরিশোধের যেমন নানা উপায় থাকে, এক্ষেত্রেও তাই। কেউ যদি নিজের মেয়েকে বেচতে রাজি না হন, সেক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের নির্দেশে মেয়ের মাকে ধর্ষণ করা হয়। কতজন করে, সেটা খবরের কাগজের প্রতিবেদনে লেখা নেই। কন্যাসন্তান না থাকলে কি কিস্তি পরিশোধের একমাত্র উপায় ধর্ষণ? সেটাও লেখা নেই। তবে, আন্দাজ করা যায়, তাইই হবে। ... ...
নতুন কেন্দ্রীয় সরকার আসার পর আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল বিষয়টা। এখন শিল্প মুনাফা তো নয়ই, বরং ওইটাই দেশপ্রেম। আর কোনো প্রতিযোগিতার লেশমাত্রই নেই। ঠেকনা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছেছে। ব্যবসার নতুন মডেল হল, শিল্পপতি ব্যাংক থেকে ধার নেবেন। সেই টাকায় শিল্প বানাবেন। তারপর সেই ধারের টাকা ব্যাংক মকুব করে দেব। অর্থাৎ দেশবাসীর টাকায় শিল্প হবে, মুনাফা করবেন শিল্পপতি। কিন্তু সে তো মুনাফা নয়, সেটাই হল দেশপ্রেম। এই নতুন মতাদর্শ এখন বছর দশেক চলছে। ওইটাই এখন ইনথিং। এখন চুপচাপ আস্ত বন্দর আদানির হাতে চলে যায়। কোথাও একটিও বিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা যায়না। এখন টাটাকে কে তাড়িয়ে মহা অপরাধ করেছিল, এই নিয়ে তর্জা হয়। কারণ, শিল্পপতিরা মুনাফা নয়, তৈরি করেন কর্মসংস্থান, সমাজসেবার ঠিকাদারি তাঁদের। তাঁরা আমাদের স্বজন। তাই আমাদের কোনো মুক্ত অর্থনীতি নেই, আছে স্বজনপোষিত অর্থনীতি। ক্রোনি ক্যাপিটালিজম। পোষিত পুঁজিবাদ। ঠেকনা দেওয়া পুঁজিবাদ। স্বাধীন, স্বাবলম্বী মুক্তবাজার অর্থনীতি বলে কিছু নেই। স্বাধীন ভারতের উৎপত্তির আগে থেকেই। ভারতবর্ষের পুঁজির ইতিহাস মূলত স্বজনপোষণের ইতিহাস। ... ...
হাল আমলের দুজন বাঙালি ডাক্তার, এই গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই, এই কলকাতা শহরেই থাকতেন তাঁরা, এমন কিছু কান্ড ঘটিয়েছিলেন, যা, অকল্পনীয়। একজন দিলীপ মহালনবিশ, যিনি ওআরএস এর আবিষ্কারক। খবরে দেখলাম, মারা গেছেন। মৃত্যুর খবরে নড়েচড়ে বসলাম। কারণ, বেঁচে যে ছিলেন, সেটা জানতামনা। নোবেল-টোবেল তো পাননি। যদিও পাওয়া উচিত ছিল। আর আমরা এমনই জাত, যে, বাইরে থেকে পুরষ্কার নিয়ে না এলে, কাউকে জাতে তুলিনা। ... ...
ব্যাপারটা কী ভীষণ বিপজ্জনক, আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের হাত ধরে মেটা, সম্ভবত ৯০% ভারতীয়ের কাছে পৌঁছে গেছে। এবং নিজেদের এরা বাকস্বাধীনতা, এবং সামাজিক ন্যায়ের ধর্মযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে, যে মতাদর্শে বিশ্বজুড়ে বহু মানুষকে প্রভাবিত করতেও সক্ষম হয়েছে। যেমন, ন্যায়বিচারের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সরিয়ে দিয়েছে সামাজিক মাধ্যম থেকে। কিন্তু এখন, এতদিনের সন্দেহের পর, যদি, সত্যিই দেখা যায়, কিছু লোক, স্রেফ রাজনৈতিক কারণে, গোটা সামাজিক মাধ্যম জুড়েই অতিরিক্ত এবং অপার ক্ষমতা পেয়ে চলেছেন, তাহলে প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, সামাজিক মাধ্যম ন্যায়বিচারের পরাকাষ্ঠা নয়, বরং নির্দিষ্ট মতাদর্শের প্রচার ও প্রসারে, এবং বাকিদের কণ্ঠরোধ করতেই ব্যস্ত, আর সমস্ত একনায়কের মতো। ইতিপূর্বের সব একনায়কদের সঙ্গে এদের একটাই তফাত, তা হল, এদের হাতে আছে বিপুল ক্ষমতা, যা রোম থেকে চিলে পর্যন্ত, আজ পর্যন্ত কোনো একনায়ক অর্জন করতে পারেননি। ... ...
সব ব্যাপারে আদালতই শেষ কথা বলবে, এ অতি বিপজ্জনক ব্যাপার। আদালত যখন সমকামিতার পক্ষে রায় দেয়, তখন আমরা নাচি, যখন অযোধ্যা-বিবাদে একরকম করে বিজেপির পক্ষে রায় দেয়, তখন আমরা গেল-গেল রব তুলি, কিন্তু কথা হল, এগুলো আদৌ আদালতের বিচার্য কেন? আইন প্রণয়ন করা, সমাজকে সঠিক (অথবা বেঠিক) পথে চালনা করা, মানুষের বোরখা পরে ঘোরার অধিকার আছে, নাকি ন্যাংটো হয়ে, খুনে মৃত্যুদন্ড থাকবে না নয়, এগুলো দেখা আদৌ আদালতের কাজ নয়। ... ...
পরিস্থিতি অবশ্য এরকমই হবার কথা। নিজের ভাষা, নিজের জাতীয়তাকে রক্ষা করা একটা রাজনৈতিক কাজ, সেটাকে দশকের পর দশক ধরে উপেক্ষা এবং দুচ্ছাই করে যাওয়া হয়েছে। কংগ্রেস দিল্লির ধামা ধরেছে, সিপিএম বামফ্রন্ট সরকারকে চোখের মনির মতো রক্ষা করতে গিয়ে ৭৭এর স্মারকলিপি গিলে ফেলেছে, অশোক মিত্র সরকার ছেড়েছেন, আর তৃণমূল ঠিক কী চায় নিজেই জানে কিনা সন্দেহ। সবার উপরে অবশ্যই বিজেপি, যাদের অ্যাজেন্ডা, বস্তুত, বাংলাভাষী ধর আর বাংলাদেশে পাঠাও। বাংলাদেশী হটাও আর গরু-পাচার বন্ধ কর। অস্যার্থ, গরুরাই এপারে থাকবে, বাংলাভাষীরা সীমানার ওপারে। ... ...