মৌসুমি ব্যবসা এক নিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানিতে জন্মলাভ করে। অথচ ইতিহাসের সব থেকে যন্ত্রণাদায়ক সত্যগুলোর একটি হল, ভবিষ্যৎ সবসময়ই আমাদের বিষ্মিত করবে, সবসময় অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে। বাজার সব থেকে নিষ্ঠুরভাবে তাদেরকেই চমকে দেয়, যারা সব থেকে বেশী নিশ্চিত থাকে যে, তাদের ভবিষ্যৎ অনুমানটি সঠিক হবে। ব্রিটিশ প্রাবন্ধিক জি কে চেস্টারটন একদা বলেছিলেন, "সেই লোকই আশির্বাদপুষ্ট যে কোন কিছুই প্রত্যাশা করে না, কারণ সে তাহলে আর হতাশ হবে না।" ... ...
পুস্তকেই তো বলা হয়েছে কেউ যদি অনাবাদী জমিন আবাদ করে, তার জন্য রয়েছে সওয়াব… এখন একদম মিম্বরের সামনেই রয়েছে সে…স্রষ্টার এত বড় জমিনে জায়গা পাওয়া বুঝি কি সবাইকে দিয়ে হয়? এর জন্য বুদ্ধি, ক্ষীপ্রতা, সজাগ দৃষ্টি দরকার হয় শক্তিমত্তার পাশাপাশি… বেশ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন মুরব্বি… জায়গাটা এত মধুর লাগে তার কাছে! খোশবুর রোশনাই মনে হয় এখান থেকেই ছেটানো হয়! পবিত্র এক শিহরনে তার দুচোখ বয়ে নিদ নেমে আসতে চায়! ... ...
এক সময় ঝটিকা অভিযানটি সম্পন্ন করে প্রদর্শনীতে থাকা বাক্সগুলোর থেকে কম দামী কিছু মিলবে কিনা জানতে মোরসালিন তরুণীটির দিকে প্রথমবারের মত ভাল করে তাকায়- গোলাপী ফাউন্ডেশান উপচে উপচে পড়ছিল তার রক্তে-মাংসে-গাত্রে। বেশ আড়ষ্ট হয়ে পড়ে সে, আর অনেকটা গায়ে পড়ে অকারণে একটা ব্যাখ্যা জুড়ে দেয়ার চেষ্টা করে, ‘ইয়ে…মানে…বাচ্চাদের জন্য …কিছুক্ষণ খেলেটেলে তো নষ্ট করে ফেলবে, তাই বেশী দামিটা…?’ সেলস গার্ল যেন সব বুঝতে পারে, তার ভীষন মায়া পড়ে যায় ক্রেতাটির উপর। বাণিজ্যিক চাকরি নীতিভ্রষ্টা হতে কসুর করে না এক পারিবারিক চাকরির অমোঘ টানে…অতি সস্তা একটি মেকাপ বক্স যেটি খেলতে খেলতে নষ্ট করে ফেলা যাবে, তার একটি বিকল্প উৎসের নাম চুপি চুপি বলে দেয় সে। ... ...
অনতিদূরে দেখতে পেলাম, মিন্টু ভাইয়ের বাইক। গ্রামের একটি স্কুলের একুশ না, বরং ঐ বাইকটি আমায় আগ্রহী করে তুলল। তো সেই ভাঙ্গাচোরা স্কুলে গিয়ে যা ভেবেছিলাম, তা-ই দেখতে পেলাম- কোন শহীদ মিনার নাই। সাজসজ্জা নাই। মঞ্চ নাই। মনে মনে একটু হাসলামও। শহরের সেই বক্র হাসি, যা একান্ত স্বভাবজাত ও চিরাচরিত। ... ...
জিডিপিকে নিয়ে আগ্রহ নতুন কিছু নয়, একে একক মাপকাঠি ধরে দেশের স্কোরশিট বের করার ইতিহাস অনেক পুরনো এবং ব্যাপ্তি সারা বিশ্ব জুড়েই। অথচ যতই দিন যাচ্ছে, ততই শ্রী হারাচ্ছে এই সোনার কাঠি এর অন্তর্গত দুর্বলতার জন্য। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল একবার লিখেছিলঃ ‘’যদি একটি শিল্পকারখানা এর পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দুষন সৃষ্টি করে এবং সরকারকে সেই দুষিত পরিবেশ পরিচ্ছন্ন করার বিল পরিশোধ করতে হয়, তাহলে এই দুইটি কাজই জিডিপিতে যোগ করে।‘’ আমাদের দেশের নির্মাণযজ্ঞে আমরা দুইটি চিত্র দেখতে পাই, একদিকে শূন্য জায়গায় নতুন বাড়ি হচ্ছে, অন্যদিকে পুরনো বাড়ি ভেঙ্গেও নতুন বাড়ি হচ্ছে। জিডিপি পুরনো বাড়ির ক্ষতকে স্পর্শ না করে দুইটি চিত্রকে একই দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করে । আইভরি কোস্ট ১৯৬০ এর দশকে আফ্রিকার জন্য প্রবৃদ্ধির উদাহরণ ছিল, আর্জেন্টিনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বিশ্বের প্রধান শিল্পোন্নত দেশগুলির একটি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল, মেক্সিকো উত্তর আমেরিকার প্রবৃদ্ধি তারকা হিসেবে দুর্দান্ত খেলে যাচ্ছিল ১৯৫০ থেকে টানা তিরিশ বছর। কিন্তু দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি-ঝড় থেমে গিয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাবে। আমলাতন্ত্র, জমির রেকর্ড, সম্পত্তি অধিকার, শিক্ষা, এবং বিচার ব্যবস্থা – রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোতে অব্যবস্থাপনা তাদের প্রবৃদ্ধির বেলুন ফুটো করে দিয়েছিল। অন্যদিকে, কোরিয়া ১৯৬০-৮০ … এই বিশ বছরে তার মাথাপিছু আয় ২০ গুন বাড়িয়ছে, ইতিহাসে যে রেকর্ড আজ পর্যন্ত কেউ ভাংগতে পারেনি। কোরিয়া পড়ে যায়নি কারণ সে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সুদৃঢ়করনে মনোযোগী ছিল শুরু থেকেই। ... ...
তিন-চারদিন পরের কথা। রাস্তার নারকীয় জ্যাম আমার অফিস টাইমের আয়ু আধা ঘন্টা কমিয়ে দিয়ে মেজাজকে সপ্তমে তুলে রেখেছিল। এই সময়টুকুতে কতটুকু এগিয়ে যেতে পারতাম দিনের কাজে, যতবারই ভাবছিলাম, আমার স্নায়ুদেশ ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিল। কোন কাজে মন বসছিল না। নিতান্ত অনিচ্ছায় সেদিনের স্থিতিপত্র হাতে তুলে নিতেই চোখ চলে গেল ঋণের ফিগারে। বেড়েই চলেছে, প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ে, মনে হয়, দুনিয়ার শেষদিন পর্যন্ত বেড়ে চলবে, কারণ যত না ঋণ শোধ হয়, তার থেকে অনেক অনেক বেশী ঋণ অশোধিত থাকে এই পৃথিবীতে। প্রায় মগ্ন হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু একটা ছায়া সংকেত আমায় চোখ তুলতে বাধ্য করল, দেখি দুলাল একটা ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে, সেই আগের মত, কিছুটা বাঁকানো, ঝুঁকে পড়া দেহ, আর চোখ তেমনি আবডালে রাখা। ... ...
মূল্যস্ফীতির স্পিডমিটারটি যদি ঠিকমত ঘুরানো যায়, তাহলে ‘মূল্যস্ফীতির’ দেখা হয়ত মিলবে, কিন্তু ‘অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি’কে শত হাত দূরে থাকবে। দুঃখ হল, অনেক দেশের অসৎ প্রশাসন স্পিড লিমিটকে ছাড়িয়ে এমন রুদ্ধশ্বাসে ছোটে যে, এক সময় মূল্যস্ফীতির চাকা বিষ্ফোরিত হয়ে ধোঁয়া উঠতে থাকে। যারা সরকারকে ঋণ দিয়েছিল, মূল্যস্ফীতির তোড়ে তাদের সুদ আয় উড়ে যায় না শুধু, আসল টাকার বাঁধও দুলে উঠে। আর যারা টাকা ধরে রেখেছিল হাতের মুঠোয় বা ঘরের সিন্দুকে, তারাও ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মাথা চাপড়াতে থাকে। সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের ভবিষ্যত নাগরিকেরা, কারণ দেশটি পরে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ঋণ পায় না। এইসব দেশের সরকার তখন টাকা ছাপিয়ে হলেও তার সামরিক যন্ত্রকে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বড় করতে থাকে আর এভাবে নিজের মসনদকে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালায়; এক্ষেত্রে জনগনের কাছ থেকে কর আদায় করা হচ্ছে না সত্য; তবে তাদের টাকার মূল্য ব্যাপক অবনমন ঘটে, যা অর্থনীতিবিদগনের কাছে মুদ্রাস্ফীতি কর নামে পরিচিত। রুপি করের একটা কবিতায় আছেঃ ‘আমি জল/এত নরম/যে জন্ম দিতে পারি/এত কঠিন/যে ডুবিয়ে দিতে পারি।‘ জলের সাথে অনেক মিল টাকার। আমাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় ব্যাংকে রেখে ভাবি ‘আসল’ টাকাটা নিরাপদ থাকবে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি তাও খেয়ে ফেলে; পুঁজিবাজারে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করে কেউ যদি ১০% মূলধনী মুনাফা অর্জন করে, তাহলে তার পুরোটাই গ্রাস করতে পারে সমহারের একটি মূল্যস্ফীতি। সম্পত্তি পুনর্বন্টনেও খেল দেখায় মূল্যস্ফীতি; আমি যদি ১০০ টাকার ঋণ করি ১০ টাকা সুদে, তাহলে আমার সুদাসল ১১০ টাকা ৫৫ টাকা হয়ে যাবে ১০০% মূল্যস্ফীতিতে। মানে, মূল্যস্ফীতি ব্যাংকের জন্য খারাপ, কিন্তু ঋণগ্রহীতার জন্য স্বর্গ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২১ সালের একটি স্থির সুদের বন্ধকি ঋণের পুরোটাই শোধ করা যেত ১৯২৩ সালের একটি পত্রিকার মূল্য দিয়ে। লাতিন আমেরিকায় ৩০ বছরের মর্টগেজ এখনো প্রায় নিষিদ্ধ। মূল্যস্ফীতির অমোঘ টানেই বাংলাদেশে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের জন্য পাগলপারা হয়ে ছুটতে দেখা যায় অনেককে। ... ...
সজীবকে জানানো হয়েছিল সাপোর্টিং হ্যান্ড আসছে; কিন্তু কে ভাবতে পেরেছিল, সে হবে স্কুল বালিকার মত দেখতে, আর মুখ ফোলাবে কথায় কথায়! তিথী সজীবের সব কাজ নিজেই করে দিতে চাইতো, আর প্রায়ই আটকে যেয়ে ‘ভাইয়া’ ‘ভাইয়া’ স্বরে এমন চেঁচাতো যে সজীবকে গোল্লাছুট লাগাতে হতো। সেদিন কয়েকটা সেলস্ সেন্টার পরিদর্শনে বের হচ্ছিল, তিথী যেন ঘরের মেয়েটির মত বায়না ধরল। রেশমী চুলের ঢেউ তার মুখের বিস্তীর্ণ উপকূলকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল, গোলাপী ঠোঁট দুটো ভিজে সপ্সপ্ করছিল । সজীব কথা না বাড়িয়ে সোঁ সোঁ করে রিকশায় উঠে গেল আর তারপর তিথীর দিকে রোমশ হাতটা বাড়িয়ে দিল; কিন্তু তিথী কি কারণে কি মনে করে ইঞ্চিখানেক পিছিয়ে গেল। এরপর রিকশার বাহু ধরে গদিতে নিজে নিজেই উঠে বসলো, যদিও পুরো পথ জুড়ে একটা ফাঁক রাখল তাদের দুজনের মধ্যে, সেই ইঞ্চিখানেক। ... ...
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি এক আবাসন কারখানায় বসবাস করছি। যেখানে তাকাই সেখানেই আবাসন ব্যবসা, প্রতি মুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে এই ব্যবসা। যাঁরা বাপ-দাদার কাছ থেকে সম্পত্তি পেয়েছেন, তাঁরা তো আছেনই, পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, উকিল, ইমাম, আমলা—সবাই নেমে পড়ছেন এই ব্যবসায়। কিছুদিন আগে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়েছিলাম। কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্লট কিনেছেন দুই বছর আগে, ফ্ল্যাট বানানোর জন্য এখন গৃহঋণ চাই তাঁর, বিস্তারিত শুনে বললাম, ‘স্যার, এসব ক্ষেত্রে তো গৃহঋণ হয় না, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার হলে করে দেওয়া যেত।’ প্রধান শিক্ষক মহোদয় উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘আমি তো ডেভেলপারই, আপনি আমাকে রিয়েল এস্টেট লোনই করে দিন।’ ... ...