এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • শীতের গপ্প---পৌষের সেই অন্যরকম দিন গুলো

    shrabani
    অন্যান্য | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০ | ৯৬৭৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • shrabani | 124.124.244.109 | ১০ ডিসেম্বর ২০১০ ১৫:৩৬432575
  • পরদিন স্যুটকেস খুঁজে বার করি তুলতুলি কম্বল, লেপ তৈরীর খোঁজখবর নেওয়া শুরু। আগে খেয়াল করিনি, সেদিনই দেখলাম বেলা বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। সূর্যাস্তের পরেই ঝুপ করে রাত্তির নেমে এল, বিকেলকে প্রায় দেখাই গেল না। আর সে কি রাত্রি! শীতল, থমথমে, বড় বড় গাছের সোঁদা ছায়াঘেরা দেহাতী রাত। বিলিতী হাল্কা কম্বলের ভেতরে ঢুকে মন কেমন করে উঠল রোদে শুকনো ধবধবে সাদা ওয়াড়ের লেপের ওমের সঙ্গে মায়ের স্পর্শ জড়ানো উষ্ণতার জন্য । এই প্রথম মন খারাপ হল, ফিরে তাকিয়ে।

    হয়ত চারিপাশের অবিরাম টুপটাপ পাতাঝরার শব্দ, বাতাসের ধুলোর গন্ধ, মরা বিকেল আর দীর্ঘ রাত্রি মিলে আরও বেশী করে উন্মনা করেছিল। ভালো লাগেনা সেই ধূসর বেলা, কিছুই ভালো লাগেনা। পৌষকে এত ফিকে বেরঙ রুক্ষ মলিন আগে তো কখনো লাগেনি!
    অথচ কতদিন কতভাবে বলেছি ভেবেছি শীতকাল আমার ফেভারিট। জায়গা বদলে আরও কত কিছু এমন করে বদলে যায়, এই উপলব্ধির সেই শীতের শুরুতেই শুরু। আমার ফেভারিট শীত রয়ে গেল আরও অনেক ফেভারিট জিনিসের সাথে ফেভারিট লোকদের মাঝে, আমার ফেলে আসা আকাশে। হরেক রকম খাওয়াদাওয়া, উৎসব পার্বণ সেসব গল্প হয়ে গেল মেসের ডাল তরকারীতে আর কর্মজীবনের দৈনিকতায়!

    বেশ কিছুদিন লেগেছিল পৌষবেলাকে এই নতুন বেশে মানিয়ে নিতে। একটু সয়ে গেলে তখন অতটা খারাপ আর লাগেনা, বিশেষ করে দিনের বেলা। দুই ঘরজোড়া বারান্দায় সকাল থেকে বিকেল অবধি ভরা থাকে রোদ্দুর। বিল্ডিংয়ের পিছন দিক সেটা তাই অযত্নে নানা বড় বড় গাছের ভীড়ে ছোট্ট জঙ্গলের আকার নিয়েছে। সেখানে তখন শাল তমালের পাতা ঝরে যায় অবিরাম।
    ছুটির দিনে দুপুরে বারান্দায় রোদপিঠে গল্পের বই হাতে বসলে কানে ভেসে আসে ঝরাপাতার গান। কখনও আনমনে বইয়ের পাতা থেকে সরে চোখ চলে যায় গাছগাছালি ঘেরা দৃশ্যের দিকে। শুকনো পাতায় মৃদু পায়ের শব্দ ছোট ছোট ডালপালা আর পাতা কুড়নোর দলের। পাঁচিলের ভাঙা দেওয়াল দিয়ে অনধিকার প্রবেশ তাই ভীত সন্ত্রস্ত, ওদিকটায় লোকজন বা সিকিউরিটী গার্ডের তেমন আসাযাওয়া নেই বুঝি,তাই এই ঝুঁকি নেওয়া। দেখেও না দেখার ভান করে থাকি, তবু একটু থমকায়, অপেক্ষা করে প্রতিরোধের। যখন দেখে বাধা আসছেনা তখন চাহনিটা পাল্টে তাচ্ছিল্যের হয়ে যায়-"হবে কোনো ফালতু লোক", উপেক্ষায় আবার জুটে যায় নিজেদের কাজে।

    মাঝে মাঝে শুকনো পাতা পোড়ানোর গন্ধর সাথে বাতাসে ভেসে আসে উষ্ণতা, দিব্যি লাগে সেই গন্ধ জড়ানো গরম হাওয়ার পরশ। এখনো কখনো চোখ বন্ধ করে সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে ঐরকম গন্ধ পাই, বড় আরাম লাগে।
  • shrabani | 124.124.244.109 | ১০ ডিসেম্বর ২০১০ ১৬:২১432576
  • ফোনে কথা হলে সবাই ঈর্ষার গলায় বলে - "এত রোদ তোর ওখানে, কলকাতায় তো শীতে আদ্ধেকদিন তেমন করে রোদ ফোটেই না, কেমন যেন মরা মরা। ধোঁয়া ধূলোয় আকাশটাই পরিস্কার দেখা যায়না। ভালই আছিস।"
    কেমন আছি তা জানিনা তবে শীতের দিন, বেলা ছোট, রোদ ফুরিয়ে গিয়ে অন্ধকার নেমে আসে যখন তখন ঠিক ভালো লাগেনা। একটাই রক্ষে, শীত এখানে দুদিনের মেহমান। সংক্রান্তির পরেই নাকি ঠান্ডা কমে যেতে শুরু করে, মাঘপঞ্চমীতে বসন্তের আগমনেও কোনো নড়চড় নেই!

    শীত একটু জমে উঠতেই পিকনিকের ধুম পড়ে গেল। আসলে এখানে যাকে বলে বিনোদনের আর কিছুই নেই, তাই এসব নিয়েই লোকে থাকে। আশেপাশে একটু গেলেই বন জঙ্গল পাহাড় ছোট ছোট ঝরনা আর ধারা অগুনতি। ছুটির দিনে দলবেঁধে পছন্দমত একটা জায়গায় গিয়ে জড়ো হলেই হল। একটু দুর বাঙ্গো ড্যাম বা কেন্ডাই ফলস অথবা খুঁটাঘাটের মত জায়গা হলে সকালে মেস বা ক্লাব থেকে খাবার বানিয়ে বড় বড় ক্যাসারোল ভর্তি করে নেওয়া। স্পটে গিয়ে শুধু নাস্তার গরম চা পকোড়া করা কিম্বা লুচি ভাজা। কাছাকাছি হলে পুরো রান্নাটাই সেখানে। পিকনিক সীজন তো সেই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ঐ জানুয়ারীর মাঝ অবধি। তারপরে বা তারাঅগে তো এমন চড়চড়ে রোদ যে খোলা জায়গায় বসা যায়না। কটা আর ছুটির দিন পাওয়া যায় ঐ টুকু সময়ে!

    নতুন আর শহুরে হওয়ার সুবাদে চারিপাশে যাই দেখি তাতেই মুগ্‌ধতা, এই খনি এলাকা সত্যিই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের খনি। শীতের সময় বনের রূপ যেন আরো বেশী খোলে!
    পুরনো লোকেরা দেখেশুনে বলে আদিখ্যেতা। তারা বছর বছর অজস্র পিকনিক দলের সঙ্গে একাধিকবার এসব জায়গায় ঘুরে ঘুরে হারিয়েছে প্রথম দেখার আনন্দ।
    প্রথম পিকনিকে গেলাম চুহিয়ানালায় (নদী নালার নালা)। শালবনের মাঝে লালমাটির রাস্তা পেরিয়ে জলের ধারে, কত নাম না জানা গাছ লতাপাতা। দেখে দেখে আশ মেটেনা। বসন্ত এলে নতুন পাতায় আর লাল ফুলে সেজে এই বনের কি রূপ দাঁড়াবে ভেবেই রোমাঞ্চ হয়!

    মুশকিল হল প্রতিটা ছুটির দিনেই পিকনিকের প্রোগ্রাম, কেউ না কেউ আয়োজন করছে এবং কোনো না কোনো সূত্রে ডাক পড়ছে নতুন ছেলেমেয়েগুলোর। সারা সপ্তাহ অফিস করে ছুটির দিনে কাজ কম থাকেনা সেই এক চিলতে এক মানুষের সংসারেও এটা কেউই বিশ্বাস করতে চায়না। ফলে ময়লা চাদর কাপড়ের স্তুপ জমতে থাকে, দরকারী ফোন করা বা চিঠি লেখা এরকম নানা খুচরো কাজ জমে জমে পাহাড় হয়।
    শেষ দিকে ক্লান্তি এল, যেখানেই যাই সেই তো একই ব্যাপার। জায়গা গুলোর নাম আলাদা দৃশ্যপট একই, দলের লোক আলাদা কিন্তু তাদের কথাবার্তা সব একই,অফিসসংক্রান্ত। এমনকী মেনুও প্রায় কমবেশী একই থাকে, মাংস পোলাও পনীর ফুলকপির তরকারী পুরী!
  • shrabani | 124.124.244.109 | ১০ ডিসেম্বর ২০১০ ১৬:৪৫432577
  • মকর সংক্রান্তির দিন, চোদ্দই জানুয়ারী, রবিবার। নতুন ব্যাচের এদিন নিজস্ব পিকনিক, এক্সক্লুসিভ। এতদিন অবধি তাদের দল বেঁধে কোথাও যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। নানা প্রোটোকল মেনে বিভিন্ন দলের সাথে খন্ডে খন্ডে যাওয়া। এমনিতে একসাথে ঢুকলেও নানান ডিউটী সময়ের চক্করে তাদের একসাথে বসা ব্যাপারটাই কম হয় আজকাল। এরকম পিকনিকে যেতে যেতেই এর ওর মনে আসে, ইস, যদি সব বন্ধুরাও থাকত সাথে এরকম একটা জায়গায়। সিনিয়রদের খেয়াল করতে হতনা, নিজেদের মত করে আড্ডা মজা, সে আনন্দই আলাদা হত।

    তবে কোথাও যেতে এদের সবচেয়ে বড় বাধা যাতায়াতের। নিজের গাড়ী ছাড়া এদিকে চলাফেরা সম্ভব নয়, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট যা আছে তাতে চড়ার কথা ভাবা যায়না। আর এইসব ছেলেমেয়েদের কাছে এখনো চারচাকা তো দুরের কথা দু চাকার গাড়ীও সবার নেই। শেষমেশ এদিক ওদিক চেয়ে চিন্তে মোটামুটি কয়েকটি বাইকের ব্যবস্থা হল।

    ঝগড়া চলছিল বিনুর সাথে। কি নিয়ে মনে নেই! ঐ বয়সে ঝগড়ার আবার কারন হয় নাকী, হয়ত তাই, সেরকম কোনো কারণ ছিলনা। বিনু একটু ভাবেভোলা ছিল, গায়ে তখনো কলেজের গন্ধ। ব্যচেলর হোস্টেলের করিডোরে একে তাকে ধরে ক্রিকেট খেলত। রোজ ডায়েরী লিখত, আবার কখনো একটা সাইকেল যোগাড় করে চালাত এমাথা থেকে ওমাথা। আর বিকেলে কফি হাউসের বারান্দায় বসে শীতের মন খারাপ করা বিষন্ন বিকেলের দিকে তাকিয়ে বলত, থাকবেনা কিছুতেই থাকবেনা সে এই বনজঙ্গলে। চলে যাবে কেরালায়, বাড়ীর কাছে ত্রিবান্দমে। সেখানে শীত নেই, সমুদ্রের হাওয়ায় গরমও মোলায়েম। শীত ভালো লাগেনা বলে সোয়েটার কম্বলের ওপরও তার খুব রাগ, বন্ধুরা জোর করে কেনালেও গায়ে চড়াত খুব কম!

    শুক্রবার আমিই প্রথমে ফোন করলাম ইউনিটে, ডিউটী বিনুর না জেনেই। সময় জানার ছিল, মূল ঘড়ির সঙ্গে সময় মেলাতে হবে আমার ইনফর্মেশন সিস্টেমের। গলা শুনেই বুঝলাম বিনু, দরকার তাই কদিনের আড়ি ভেঙে বলতেই হল কথা। সুযোগ পেয়ে সাথে সাথেই প্রস্তাব এল, জানুয়ারী চোদ্দ সবার সুবিধা, আমাদের পিকনিক হয়ে যাক। কিছু বললাম না, হ্যাঁ না কিছুই। সন্ধ্যেবেলায় ওরা দল বেঁধে এল আমার ঘরে। বিনু সবার শেষে হাত দুটোকে এক করে ঝুলিয়ে অদৃশ্য ব্যাটে প্রাকটিস করতে করতে।

    সবার অনুরোধেও আমি হ্যাঁ করলাম না। তখন আমার সংক্রান্তির কথা মনে করে এক বুক মনখারাপ। এতদিন পরে পিঠেপুলি আউনিবাউনী ছোটোবেলা মকর সব মনে ভীড় করে আসছে আর মনে হচ্ছে এই শেষের শুরু। আমি হয়ত চিরকালের মত সব কিছুর থেকে দুরে চলে এসেছি। যতদিন ছিল যে ইচ্ছে করলেই এসব ছুঁতে পারি ততদিন ইচ্ছে করেনি। ভালো লাগছে না এঅবস্থায় হইচই আনন্দে মাততে। ঐ দিনটা একটু একলা হতে চাই তাই ওদের সঙ্গে যেতে রাজী হই না কিছুতেই।

  • shrabani | 124.124.244.109 | ১০ ডিসেম্বর ২০১০ ১৬:৫৩432578
  • চা খেয়ে হইহল্লা করে দলটা যখন বেরোচ্ছে তখন বিনু বোলিং করছে, যেতে যেতে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে গেল আমায়। দরজা বন্ধ করে ঘরে ঢুকেছি, মন খারাপই সব মিলিয়ে, আবার দরজায় ধাক্কা।
    খুলে দেখি বিনু, "তুই সত্যিই যাবিনা আমাদের সাথে? কেন, আমি যাচ্ছি বলে?" সেই চাহনির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলি, ঘরে ডেকে বসাই। কত গল্প হয়, সংক্রান্তি পিঠে মকর খেজুর গুড় আরো কত কি নিয়ে কত কাহিনী। নোট চালাচালি, আমাদের গুড় পিঠের মত ওদের আপম, দোসা তো ওরা সারাবছর খায়, সরুচাকলি কেন শুধু নতুন চালেই হয়। রাত হলে যখন ও উঠছে তখন দুজনেরই মুখ ভরা হাসি। দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় নেবার আগে তবু একবার সংশয়, "আমরা সবাই চলে যাব, ছুটির দিনে তুই একা থাকবি?"

    আসলে তখন আমরা কজন মিলেই পরিবারের মত,সবকিছুতে সবাই সবার পাশে, একসাথে এসেছি তো তাই! আমি ওকে বারবার আশ্বস্ত করতে থাকি আর ও যাবার জন্য জোরাজুরি। একসময় হার মেনে চলে যায়, মনটা একটু খারাপ ওর হাসিটা দেখে। তবে এবারের মত ঝগড়াটা আমাদের শেষ, এই ভেবে বোধহয় দুজনেই খুশী। তার একদিন পরেই পিকনিক, আর কোনোদিন আমি বিনুর সাথে ঝগড়া করিনি।

    রবিবার দেরীতে ওঠা, সব কিছুতেই দেরী। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে বই নিয়ে বারান্দায়। কিন্তু ঠান্ডা কমছে, এদিকের লোকে বলে আজকের দিন থেকেই শীতের বিদায়বেলা শুরু। রোদে মিঠের চেয়ে কড়া ভাবই বেশী, অগত্যা ঘরের ভেতর বিছানায় আশ্রয়। ঘুমটা সবে গাঢ় হয়েছে, এমন সময় জানালা দিয়ে আসা নানা আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। আধোঘুম আধো জাগরণে মনে হয় কোনো কারণে অনেক লোক জড়ো হয়েছে, ঘন ঘন গাড়ীর হর্ণ, নানা লোকের কথাবার্তায় শান্ত কমপ্লেক্সটা কেমন জেগে উঠেছে। অনেক চেষ্টা করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি তখনও বেলা আছে, ঘড়িতে বাজে সাড়ে তিনটে। আমার ঘর থেকে সামনের দিক দেখা যায়না, শুধু জানলা দিয়ে একটু যা চোখে পড়ল তাতেই দেখলাম বেশ কিছু লোক। এটা গেস্ট হাউসের এলাকা, লোকজন আসতেই পারে তবু কেমন স্বাভাবিক লাগলনা। কি করব ভাবতে ভাবতেই দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা, আমার নাম ধরে ডাকছে কারা।

    উঠে দরজা খুলতেই দেখি কতগুলো মুখ, কিছু চেনা কিছু অজানা। "তুমি যাওনি পিকনিকে, তোমাদের সবাই তো গেছে? নীচে কে বলল তুমি নাকী ঘরেই আছ, যাওনি।" আমি একটু থতমত খেলাম, তখনও ঘুমের রেশ কাটেনি বোধহয় তাই ভেবেছিলাম পিকনিকে না গিয়ে কি কোনো অন্যায় করেছি নাকি, কোনো প্রোটোকল ভেঙেছি, কে জানে! সামলে নিয়ে উত্তর দিতেই তারা তড়িঘড়ি করে দৌড়ল সিঁড়ি দিয়ে। কিছু না বুঝে কোনোরকমে দরজার লক টেনে আমিও দৌড়ই পিছুপিছু। নীচে তখন যুদ্ধের প্রস্তুতি। দু তিনটে গাড়ী তৈরী, একটি অফিসের জীপও। বেশ কিছু বড় সিনিয়র অফিসার গোল হয়ে দাঁড়িয়ে,দুজন গেস্ট হাউসের রিসেপশনের ফোনে বসে (তখনও সেলের যুগ শুরু হয় নি)। একজন একটু সিনিয়র অফিসারের চোখ পড়ল আমার দিকে, রাশভারী মানুষটি মুখটা যতসম্ভব নরম করে, চোখদুটিতে স্নেহভরে বললেন, "ঘাবড়াও নহী, ধীরজ রাখো, সব ঠীক হো জায়েগা।"

    আমি হতভম্ব, বেঠিক টা যে কি তাই বুঝলাম না। আর একজন বললেন, "এও ওদের সাথী তো না? একে আমাদের কারোর একটা বাড়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। এখানে একা থাকলে পরেশান হয়ে যাবে।" একজনকে ডেকে সেইমতই বোধহয় নির্দেশ দিলেন।
    একজন আমার কাছে এল কে কে পিকনিকে গেছে জিজ্ঞেস করতে। আমি যন্ত্রের মত নামগুলো বলে গেলাম। গাড়ীগুলো একে একে বেরিয়ে গেল, তবু তখনও রয়ে গেল অনেক লোক। কলকাতা, বম্বে এসব নানা টুকরো কথার মাঝে আমি গিয়ে একটু দুরে একটা বেঞ্চে বসে রইলাম একলা। আমাকে কেন কেউ কিছু বুঝিয়ে বলছিল না। নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করার ক্ষমতা বা উৎসাহ দুটোই কেমন যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম।
    একটু পরে আবার একদলের চোখ পড়ল আমার দিকে, কিসব আলোচনা হল। ফিল্ড হোস্টেলের চেনামুখ একজন এগিয়ে এল। "ওরা বলছেন তোমাকে কারো একটা বাড়ীতে নিয়ে যেতে। তুমি কি তোমার বসের বাড়ী যাবে?" এবার আমি একটু সাহস করে জানালাম আমি এখনো কিছুই জানিনা কি হয়েছে!

  • shrabani | 124.124.244.109 | ১০ ডিসেম্বর ২০১০ ১৬:৫৯432579
  • বাঙ্গো ড্যামের কনট্রোল রুম থেকে সুইচইয়ার্ডে খবর এসেছে। এখান থেকে যে পিকনিকের দল গিয়েছিল ওরা ঠিকমত এলাকাটা চেনেনা। ড্যামের ওদিকে ভীড়ভাট্টা বলে সেখানে না গিয়ে অনেকটা নীচে নেমে গিয়ে নদীর ধারে আসর পেতেছিল। নদীতে জল বেশী ছিলনা, জলে নেমে বল খেলছিল। আসলে যে দিকে গেছিল সেদিকে কেউ যায়না, গ্রামও ওখান থেকে অনেক দুরে। জলে ঘুর্ণী বা চোরাবালি কোনোকিছু ছিল, দলের একজন ডুবে গেছে। কোনো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছেনা, অবশ্য কেউ জলে নেমে খুঁজতেও রাজী নয়। গ্রামের লোকেরা ওটাকে ভুতের জায়গা মনে করে, এর আগেও এরকম দু তিনটে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ওখানে। তাই সচরাচর যায় না ওখানে।

    কলকাতা ও বম্বে অফিসে খবর দেওয়া হয়েছে ডুবুরী পাঠাতে। এখন গাড়ী গেল বাকীদের আনার জন্য ও ড্যামের লোকেদের আর পুলিশের সঙ্গে কথা বলে যা যতটুকু ব্যবস্থা করা যায় তার জন্য।
    অনেক কিছু বলছিল, কে খবর পেয়েছে, পেয়ে কি করেছে। কে কি বলেছে, কি হতে পারে এসব নানা কথা। আমি কিছুই শুনছিলাম না, শুধু চোখের সামনে সিনেমা স্লাইডের মত একের পর এক মুখ ভেসে যাচ্ছিল। কে কে কে?
    একটু পরে বুঝলাম ছেলেটি নিজের কথা শেষ করে আমার উত্তরের অপেক্ষায়। আমি শুধু চোখ তুলে তাকালাম, কি বলব? ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বুঝল তারপর আস্তে আস্তে বলল," ভাগ্যিস তোমাদের রাজেশ সুইচইয়ার্ডে কাজ করেছে, তাই ও ড্যামের কনট্রোল রুম থেকে কিভাবে যোগাযোগ করতে হয় জানত, সেজন্যই আমরা এত তাড়াতাড়ি খবর পেলাম। বিনু ডুবে গেছে। খেলতে খেলতে ও একাই একটু দুরে চলে গেছিল। তখন আশেপাশে কেউ ছিলনা। চিৎকার শুনে বাকীরা পৌঁছবার আগেই মিলিয়ে গেছে। দলে কেউই সাঁতার টাতার জানেনা মনে হয়। খুব বেশী কিছু এখনো জানা যায়নি, রাজেশের গলা শুনেই মনে হয়েছে ও খুব শকড, বেশী কিছু বলতে পারছিলনা। "

    আমার কি হল! খুব কোনো কষ্ট, দু:খ? আমি কি পাথর হয়ে গেলাম না কোনো নাটকীয় চিৎকার করে উঠলাম? কিছুই হলনা। আমি উঠে দাঁড়িয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে বললাম, "আমি যাব"।
    ছেলেটী একটু ঘাবড়ে গেল কি? ওও হয়ত বেশ একটা নাটক বা কান্নার জন্য তৈরী হয়েছিল, একটু হতাশই হল বোধহয়। পরে ভেবে দেখেছিলাম আমি আসলে যারা আমার পরিবারের মত সেই সঙ্গীদের কাছে যেতে চাইছিলাম, এইসব অচেনা লোকেদের থেকে দুরে। কিন্তু বিনুর জন্যে কোনো শোক আমার মধ্যে তখনও দানা বেঁধে ওঠেনি, যেন ইচ্ছে করেই মন সেটাকে পাশে রেখে দিল।

    কেউই অবশ্য আমাকে নিয়ে যাবার কথা কানে তুলল না। জায়গাটা বেশ দুরে, জঙ্গল, অন্ধকার নেমে এসেছে। যত তাড়াতাড়ি বাকীদের নিয়ে ফেরা যায় ততই মঙ্গল। প্রোজেক্টের বড় কর্তা এসে পৌঁছলেন, রিসেপশন তখন এমারজেন্সী কনট্রোল রুমের আকার নিয়েছে। নানা টুকরো কথা কানে ভেসে আসছে। পুলিশী ঝামেলা হতে পারে, পুলিশ মার্ডার সন্দেহ করছে। ওখানে এতজন ছিল কেউ বাঁচাবার চেষ্টা করলনা এ কেমন কথা! আত্মহত্যা নয় তো? ছেলেটার কোনো অ্যাফেয়ার ছিল কিনা - নানান জল্পনা কল্পনা।

  • shrabani | 124.124.244.109 | ১০ ডিসেম্বর ২০১০ ১৭:১৩432580
  • আমি অন্ধকার সিঁড়িতে বসেছিলাম একা। লোকে প্রথমবারের পর আমাকে ভুলে গিয়েছিল। আমি কান্নাকাটি জাতীয় কিছু করলে হয়ত ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতাম। কিন্তু আমি কিছুই করিনি।
    তাড়াতাড়িতে গায়ে গরম কিছু দেওয়া হয়নি। ঠান্ডায় প্রায় জমে গেলেও ওখান থেকে নড়লাম না। কতক্ষণ এভাবে বসেছিলাম জানিনা,দু তিনটে বাইকের আওয়াজ শুনলাম। বাইকগুলোতে আমার বন্ধুরা নেই, তাদের এ অবস্থায় আর বাইক চালিয়ে আসতে দেওয়া হয় নি। এখান থেকে গাড়ীতে যারা গিয়েছিল, তারা বাইকগুলো নিয়ে এসেছে। গাড়ীও এসে যাবে এক্ষুনি। কেউ একজন আমাকে ডাকল, আমি রাস্তার ওপর গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনটে গাড়ী পরপর এসে দাঁড়াল, তার থেকে নামছে সবাই, মাথা নীচু করে অপরাধীর মত। আমার দিকেও তাকায়নি ওরা, আমিও সামনে যেতে পারলাম না। পা দুটো কেমন যেন পাথরের মত ভারী, টেনে টেনে কোনোরকমে নিজের ঘর পর্যন্ত গিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায়! তারপরে সারাবছরের ঘুম ঘুমিয়েছিলাম।

    দুদিন সকাল রাত কিভাবে কেটে গেল। কলকাতার ডুবুরীরা হঁসদেও নদী তোলপাড় করে ফেলল। দুদিন পরে কতদুরে এক গ্রামে নদীর চড়ায় পাওয়া গেল বিনুকে। তারপরে পোস্টমর্টেম, থানা পুলিশ,দাহকাজ! বিনুর আর সমুদ্রের ধারে ফেরা হলনা, এই জঙ্গলের প্রতিটা শীতে সে এখানেই থেকে যাবে!

    সব কাজ শেষ হয়ে গেলে আমরা সবাই বসে আছি ফিল্ড হোস্টেলে, বিনুর ঘরে। রাজেশ ওর ডায়েরীটা বার করেছে, একটু একটু পড়ছে। আমি বারণ করি। যা শুনি একদম বাচ্চাদের মত ডায়েরী লেখা। বন্ধ করার আগে উঁকি মেরে দু পাতা উল্টে নি, আমার সঙ্গে ঝগড়া নিয়ে কোনো কথা নেই!
    ও যে এত হোমসিক হয়ে পড়েছিল মনে মনে, আমরা কেউ বুঝতেই পারিনি।
    কেউ কথা বলতে পারছিনা, চুপ করে আছি। কারুরই সহ্য হচ্ছিলনা এই দমবন্ধ করা নীরবতা, তবু কি বলব কেউই হয়ত ভেবে পাচ্ছিলাম না। আগেশ বিনুর দেশের ছেলে। একসাথে বাড়ী যেত ওরা। ও দুদিন কারোসাথে কোনো কথাই বলেনি। মুখটা দু হাঁটুর মাঝে গুঁজে বসেছিল মাটিতে। হঠাৎ মুখ তুলে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, "বিনু খুব ভালো দিনে গেছে, পৌষ সংক্রান্তি, খুব পুণ্যের দিন"।

    তাই তো, সেদিন সংক্রান্তির দিন ছিল। আমার মকর সংক্রান্তি, আউনি বাউনি, পিঠেপুলি, পার্বণের দিন। আমি একটা সংক্রান্তিতে একা থাকতে চেয়েছিলাম, সংক্রান্তির দু:খে। বিনু আমাদের জীবনের সমস্ত পৌষসংক্রান্তির আনন্দ নিয়ে চলে গেল, সমস্ত চোদ্দই জানুয়ারীর মানে পাল্টে দিয়ে.........
  • Shibanshu | 59.93.70.51 | ১০ ডিসেম্বর ২০১০ ১৮:০১432581
  • স্পর্শ করলো...
  • Nina | 64.56.33.254 | ১০ ডিসেম্বর ২০১০ ২১:০৬432582
  • বড্ড ভাল লেখে এই মেয়েটা---বিষাদমাখা মনটা ককিয়ে তাই বলে উঠল!
  • titir | 128.210.80.42 | ১০ ডিসেম্বর ২০১০ ২১:৩৭432583
  • শ্রাবণী,
    আপনার শীতের গল্পে এতোটাই মুগ্‌ধ হয়েছিলাম যে, আমার মত আনাড়িও লিখতে শুরু করেছিল। এমন কি কালকেও ভেবেছিলাম আর একটু লিখব বলে, কিন্তু টইটা খুঁজে পেলাম না। ভাগ্যিস লিখি নি। আপনার লেখা সত্যি নাড়িয়ে দিয়ে গেল আমার শীতের জড়তাকে।
  • shrabani | 59.161.87.101 | ১১ ডিসেম্বর ২০১০ ২০:৫৪432585
  • তিতির,
    এখানে অনেক পাকা লিখিয়েরা থাকলেও আমরাও আছি, আদত আনাড়ী, কোনো বিশেষ শিক্ষা নেই শুধু মনের কলম, হৃদয়ের ভাষা, তাই তো টই আমাদের জন্যে!
    তুমিও খুব ভালো শুরু করেছো, থেমোনা লিখে যাও।
  • ranjan roy | 122.168.141.177 | ১২ ডিসেম্বর ২০১০ ১৪:২৯432586
  • শ্রাবণী,
    আপনার লেখা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ঐ স্বল্পস্থায়ী শীতের সন্ধ্যের মনখারাপ যে আমার ভীষণ চেনা। কেন্দাই ফল, বাঙ্গো ড্যাম, ফুটকাপাহাড়ের পিকনিক, সব।
    আমি ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৬ অব্দি ওই এলাকায় ছিলাম। আপনাদের জমনীপালী অথবা গোপালপুরের রেসিডেন্সিয়াল এলাকা থেকে কাঠগোড়া যাবার রাস্তার ওপর ছুরি বলে গ্রামে, যেখানে ঘরে ঘরে কোসার শাড়ি বা থান তৈরি হয় সেখানে ( হয়তো কোসা কিনতে আপনি বন্ধুদের সাথে কোন রোববারে ওখানে এসে থাকবেন), আর শেষ তিন বছর NTPC এলাকার পেছনে আগারখার ইত্যাদি গাঁয়ের পেছনে আহিরন নদীর ওপারে গেবরা রোড স্টেশনের ওপারে কুসমুন্ডা কলিয়ারি এলাকায়।
    মনে পড়ছে ওই একদশকে বাঙ্গো ড্যাম( আমার প্রথম বিবাহ বার্ষিকী ওখানেই নৌকোতে সেলিব্রেট করেছিলাম, খাওয়াদাওয়া মাচাডোলিতে), আর রায়গড়ের রাস্তায় বিখ্যাত ঝর্ণায় বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছিল। রতনপুরের কাছে খুঁটাঘাটে অবশ্য কিচু হয়নি।
    ইদানীং একটি এন জি ও'র সঙ্গে কনসালটেন্সি করছি, ফলে মাসে দুবার পালি, রতনপুর আর কোরবা যেতেহচ্ছে।গত মাসেই গেছি কেন্দাই আর বাঙ্গো, অনেক কিছু বদলেছে। কিন্তু কেন্দাই প্রায় সেরকমই আছে। শাল ছাড়াও আপনাদের থাকার সময় সরকার বেশ কিছু সেগুনের বন লাগাচ্ছিল। সেসব এখন সত্যি চমৎকার বন হয়ে গেছে। তবে আগের সেই pristine forest বদলে গেছে। ভেতরে অনেক দূর অব্দি পাকা রাস্তা হয়েছে। হারিয়ে যাবার ভয় নেই।
    আমাকে যেতে হয় কাটঘোরার কাছে তুমান, জটগা, কোরবি এলাকার জঙ্গলে। আর আছে পালি এলাকার আদিবাসী বহুল বনগ্রাম। সভ্যতার ফল রাস্তা, বিজলী, প্রাইমারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, দোকানপাট সবই হচ্ছে, মোবাইল টাওয়ার এসে গেছে।
    কিন্তু সেই হারিয়ে যাওয়া পায়ে হাঁটা বনের রাস্তায় থমকে দাঁড়ানো দলছাড়া হরিণের দেখা, বনের মধ্যে শাল ও মহুয়ার সোঁদাল গন্ধ, উইয়ের ঢিপি, সাপের খোলস, জ্বালানী কাঠের বোঝা মাথায় আদিবাসী মেয়ে- এসব আজও আমাকে irrationally উন্মনা করে।
    এই মন কেমন করা লেখাটির জন্যে ধন্যবাদ।

  • Arpan | 122.252.231.10 | ১৩ ডিসেম্বর ২০১০ ০১:৩৬432587
  • ""... আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর
    আরো এক আলো আছে: দেহে তার বিকেল বেলার ধূসরতা:
    চোখের - দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হয়ে আছে স্থির;
    পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর;''

    ব্যস, আর কিছু লেখার দরকার নেই।
  • shrabani | 124.124.244.109 | ১৩ ডিসেম্বর ২০১০ ১০:১৬432588
  • রঞ্জনদা,
    ছুরি আমরা অনেকদিন গেছি বন্ধুরা মিলে, জামনিপালী থেক হেঁটে হেঁটে। ঘটনাটা ৯৫ এর, অর্থাৎ আপনার সময় থেকে ততদিন পর্যন্তও এসব দুর্ঘটনাকে সিরিয়াসলী নেওয়া হয়নি। ঐ এলাকায় কোনো সতর্কবাণী লিখে বোর্ড থাকলে এরকমটা হতনা।

    আমি ছ বছর মাত্র থেকেছি জামনীপালীতে, ঐ ছ বছর নি:সন্দেহে খুব ভালো কেটেছে, জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, আদিবাসীদের সরল সহজ জীবন সব মিলিয়ে অপূর্ব লাগত। ছুরি তেগিরিধারীর বাড়ী গিয়ে কোসা দেখা, দরীর সাপ্তাহিক বাজার, কাঠঘোরার ধাবায় শীতের রোদ্দুরে বসে ঝাল ঝাল মাছভাজা পেয়ারার স্যালাড সহযোগে, রতন্‌পুরের মন্দির, অচানকমারের দোকানে অমরকন্টকের চড়াই ওঠার আগে পকুড়ি চা.....আরো কত ছোট ছোট আনন্দ মজা ভরিয়ে রাখত জীবন.....
    এই শহরে বসে সেসব এখন স্বপ্নের মত মনে হয়। আমার কর্তা এখনও যান ওদিকে বছরে এক দু বার। কোরবার শুনি অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, চারিদিকে নতুন নতুন পাওয়ার প্ল্যান্ট আসছে!
  • ranjan roy | 122.168.45.75 | ১৩ ডিসেম্বর ২০১০ ১২:৫৫432589
  • শ্রাবণী,
    সত্যি, বাঙ্গো, আহিরণ, মনিয়ারী আর শিবনাথ দিয়ে কত যে জল বয়ে গেছে। আমার সময়ের দুবলা-পাতলা যুবক গিরিধারী আজ ভারিক্কি প্রৌঢ়। কোসা এক্সপোর্ট করে সেদিনের উঠতি ছোকরা জীবরাখন দেবাঙ্গন আজ কোটিপতি। আর সেই সময়ের সবচেয়ে অবস্থাপন্ন পরিবার মেলুরামদের আজ অবস্থা পড়তির দিকে।
    হ্যাঁ, কোরবা ও রায়গড় এলাকায় বেশ ক'টি প্রাইভেট সেক্টরের পাওয়ার প্ল্যান্ট শুরু হচ্ছে।
    আমার কলিগের ছোটভাই অজিত চোপড়ে এখন এন টি পি সি'র চাকরি ছেড়ে রায়গড়ে থাপারের পাওয়ার প্ল্যান্টে জি এম হয়ে যোগ দিয়েছে।
    কিন্তু ছুরিগাঁয়ের মধ্যে দিয়ে রাজওয়াড়া পেরিয়ে একটু হাঁটলেই দেখতে পেতেন কালোপাথরের টিলায় অভ্রের ঝিকিমিকি আর অনেক নীচে পাকদন্ডী পেরিয়ে নামলে বাঙ্গো নদী। ওপারে কোসগাই পাহাড় আর সত্রেঙ্গা গ্রাম। ঝোরাসিরকি গাঁয়ের পাকা ধানের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। জল কোথাও কম হাঁটু অব্দি, কোথাও বেশি। কাঠি পুঁতে নিশান লাগিয়ে সতর্ক করা। ডোঙ্গা দিয়েও পার হওয়া যায়। বালির পাড়ে প্লাস্টিক পেতে চড়ুইভাতি, বালি খুঁড়ে ঠান্ডা জল খাওয়া। ছবি তোলা, পাহাড়ের কোলে বেড়ানো। নীল হাতির মত উঁচু আর দীর্ঘ আকাশছোঁয়া পাহাড়ের শ্রেণী।
    সন্ধ্যের আগে ফিরে আসা।
    হ্যাঁ, ওখানে তখন সেপ্টিক ল্যাট্রিন ও কলের জল ছিল না।
    প্রথম প্রথম রত্নার খুন অসুবিধে হয়েছিল। তবু বয়েস ছিল আমাদের পক্ষে। তাই রত্নার চেষ্টাতেই ঘনঘন পিকনিক হত নদীর পাড়ে।
    ছুরির স্মৃতি সারাজীবন সঞ্চিত থাকবে।
  • de | 59.163.30.4 | ১৩ ডিসেম্বর ২০১০ ১৪:১৮432590
  • অপূর্ব লাগলো -- শ্রাবণীর লেখা আর তার সঙ্গে রঞ্জনদার ধরতাই! এই জায়গাগুলো বোধহয় মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তিসগড়ে --তাই তো!
  • sana | 58.106.4.180 | ১৩ ডিসেম্বর ২০১০ ১৮:৫২432591
  • শ্রাবনী,মনের কলম বলেই বোধ্‌হয় এমনি করে মন ছুঁয়ে গেল!
  • titir | 128.210.80.42 | ১৬ ডিসেম্বর ২০১০ ০২:৪১432592
  • এল যে শীতের বেলা বরষ পরে।
    এবার ফসল কাটো, লও গো ঘরে।।
    -----------------------------
    হিলহিলে সবুজ ধান গাছগুলি শীতের দোলায় দোল খেতে খেতে পরিনত হয়ে গেছে। এখন সে সোনালী রূপসী। সারা মাঠ জুড়ে সে রঙ ছড়িয়ে পড়ে। চাষীর বড় আশার ফসল। বড্ড কষ্টের দিন গেছে তার। আশায় আশায় বসে থাকে। অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া আছে অনেকজনকে। কপাল ভালো হলে সুখের দিন, না হলে--------
    ধানগুলিকে ঘরে তোলার জন্য অনেক লোকের দরকার। একি সময়ে এতো লোকের চাহিদা মেটাতে পরিযায়ী পাখির মতো লোধাসুলি, গোপিবল্লভপুর থেকে অজস্র লোক আসত। এদের নিজেদের ও অল্প কিছু চাষ আবাদ ছিল, সেগুলো শেষ করেই পুবমুখে রওনা হত। এক এক দলে কুড়ি পঁচিশ জন লোক। বড় বড় প্যাঁটরা আর পুঁটলীতে যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি। প্রথম দিন গৃহস্থ বাড়ী থেকে সব খাবার দাবার যোগান দেওয়া হত। আর ওরা লেগে পড়ত আস্তানা তৈরীর কাজে। কোন কোন বাড়িতে একটা বড় ঘর থাকত শুধু মজুরদের থাকার জন্য, না হলে বাইরের লম্বা বারান্দাকে ঘিরে খড় দিয়ে সুন্দর এক ঘর বানিয়ে নিত। বয়স্করা খড় দিয়ে তৈরী করত বসার পিঁড়ি। পরের দিন থেকে ধান কাটার কাজ শুরু। দু একদিন রোদ খাবার পর সেগুলি বাড়ি আসবে, হয় মাথায় করে, না হলে বাঁকে অথবা গোরুর গাড়ি করে। দূরের মাঠগুলি থেকে সব সময় গোরুরগাড়ি করে ধান আসত। ছোটদের খুব মজা হত গোরুরগাড়ি চড়ার। কিন্তু মা রা খুব একটা প্রশ্রয় দিতনা তাতে। কেননা ফেরার সময় গাড়ি ফিরবে ধান বোঝাই করে, আর ছোটোদের ফিরতে হবে হেঁটে হেঁটে। তবে "চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী"র মত লুকিয়ে চলে যেতাম সেই অচিনপুরে।
    গৃহস্থবাড়ি থেকে দুবেলার সিধে আর জলখাবার পেত কাজের লোকেরা। চাল, ডাল, তেল, নুন, সব্জী সবই। ওদেরই কোন এক বৌ সময়ের কিছু আগে এসে রান্না করত। যা কিছু সব্জী দেওয়া হোক না কেন, সেটা বেশ ঝোল ঝোল করে রাঁধত। কাজের শেষে সবাই যখন একথালা উঁচু ভাত আর সেই তরকারি পরিতৃপ্তি করে খেত মনে হত, এদের আর কিছু চাইবার নেই। কতবার যে ওদের সঙ্গে বসে খেতে ইচ্ছে করেছে তা ভগবানই জানেন। এদের ছোটরা আমাদের বন্ধু হয়ে যেত, দুদিন যেতে না যেতেই। আর সকলবেলায় যখন খড় জ্বালিয়ে গা শেঁকতে বসত , আমরাও সামিল হয়ে যেতাম সেই দলে। যদিও সেই ব্যাপারটা বড়মার খুব অপছন্দের ছিল।
    ধান জমা হত বাইরের বড় খামারে। সরু মোটা বিভিন্ন ধানের বিভিন্ন গাদা। কিছু কিছু আবার ঝাড়া শুরু করে দিত হত, না হলে সব ধান ধরবে না। প্রথম যুগে পাটায় করে ধান ঝাড়া, পরে এলো পা দিয়ে চালনো ধান ঝাড়ার মেশিন। সারাদিনে যা ধান ঝাড়ানো হত, সন্ধ্যেবেলায় সেগুলিকে কুলোর বাতাস দিয়ে পরিষ্কার করে (ধান ওড়ানো) ধামায় মেপে হামারে ভরা হত। এই মাপ দিয়ে বোঝা যেত, কত বিঘা জমিতে কত মন ধান ফলেছে। রূপশাল, কবিরাজশাল,ঝিঙ্গেশাল ছিল সরু সরু ধান। আর জংলীজটা, কাইঘ্রা হল মোটাধান। তালমাড় বলে এক মোটা মোটা ধানের চাষ হত শুধু মুড়ির চালের জন্য। মুড়ি হত হাল্কা পল্কা বড় বড়। এছাড়া গন্ধমালতী আর কনকচুঁড় পায়েস আর পিঠের জন্য বরাদ্দ ছিল।
  • Nina | 68.84.239.41 | ১৬ ডিসেম্বর ২০১০ ০৭:০৫432593
  • বাহ! তিতির, ভারি সিন্দর হচ্ছে। কি সুন্দর সব ধানের নাম, জানতামই না----বসে রইলাম আরও পড়ার জন্য
  • Nina | 68.84.239.41 | ১৬ ডিসেম্বর ২০১০ ০৭:০৬432594
  • * সুন্দর
  • ranjan roy | 122.168.166.136 | ১৬ ডিসেম্বর ২০১০ ০৮:৪৫432596
  • তিতির,
    তুমি কি মেদিনীপুরের মেয়ে? সুন্দর করে লিখছ, আমি যেন পশ্চিম মেদিনীপুরের গাঁ দেখতে পাচ্ছি। এই লেখা শেষ হলে আরও লিখবে-- ওদিককার মানুষজনের কথা। শুনতে চাই।
    সত্তরের দশকে রঙিন চশমা দিয়ে কোলকাতার কফি হাউসে বসে গোপীবল্লভপুর-ডেবরা সম্বন্ধে অন্যরকম ভাবতাম, কিন্তু ওখানকার মানুষদের চিনতে চেষ্টা করিনি। একবিঘেতে ধান ফলাতে কী কী করতে হয় জানতাম না।
    আজ তোমার লেখা আমার অনেক প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলএছে।
    এর পর অন্য এক সূতোয় লিখবে তোমার ছেলেবেলার গল্প।
  • Shibanshu | 59.96.97.153 | ১৬ ডিসেম্বর ২০১০ ১০:৪১432597
  • খুব ঝরঝরে লেখা। মনে হয় যেন চিনি পৌষ সন্ধ্যার ঐ নির্জন খড়ের মাঠগুলি। হয়তো গড়বেতা, চন্দ্রকোনা, গোয়ালতোড় কি শিলদা।
  • aishik | 115.248.152.33 | ১৬ ডিসেম্বর ২০১০ ১৪:৪৪432598
  • AmianekchhoTo, kintunAbOlepArchhinA, asaadhArOnlekhA, shrAbOnidiArtitirdi(?)r.
  • kd | 59.93.247.171 | ১৬ ডিসেম্বর ২০১০ ১৭:৫৩432599
  • বা: বা: দিল্লি/পার্ডিউর যুগলবন্দী! আ হা! পড়ে মন ভরে গ্যালো। তোমাদের সোনার কলম হোক।
  • titir | 128.210.80.42 | ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ ০২:৫৭432600
  • রঞ্জনদা,
    আপনি ঠিকই ধরেছেন, জন্মের সময় মেদিনীপুরের ছিলাম, এখন পশ্চিম মেদিনীপুরের হয়ে গেছি। বহুদিন দেশ মানে, সেই গাঁ ছাড়া। গাঁ আমি ছাড়লেও, গাঁ তো আমায় ছাড়েনি। ঘুরে ফিরে চলে আসে সে।
    সত্তরের দশকের ঘটনাগুলোর সময় এত্ত ছোট্ট ছিলাম যে কিচ্ছু মনে নেই। আসলে বোঝার মতো বোধবুদ্ধি তৈরী হয় নি, সে সময়। তবে অনেক জীবিকার অনেক অনেক মানুষ দেখার সৌভাগ্য ঘটেছে আমার। সময় মতো লিখব তাদের কথা।
    অনেক অনেক ধন্যবাদ।

    নীনা,
    আরও অনেক ধান ছিল, এখন সব নাম ভুলে গেছি। আর এগুলো ছিল সব বর্ষার ধান। মানে বর্ষাকালে রোয়া হত আর শীতে বাড়ি আসত। অনেক পরে বিকল্প ধানের (উচ্চ ফলনশীল) চাষ শুরু হয়েছিল, কিন্তু সেই ধানের চালকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে বেশ নীচু দরে দেখা হত। বাড়িতে কেউ খেত না। ঐ ভাত নাকি হজম হবে না। তাই সবটাই বিক্রি করে দেওয়া হত। দাম ও প্রাচীন ধানের তুলনায় বেশ কম হত।

    শিবাশুদা,
    পৌষ সন্ধ্যার মাঠগুলি সত্যি ঐরকম। নির্জন হত কিনা জানি না, মাঝে মাঝে ধান কাটা চোরের উপদ্রবে অতিষ্ট হয়ে গৃহস্থকে রাত জেগে মাঠ পাহারার ব্যবস্থ করতে হত। সেজন্য এক টং ঘর তৈরী হত মাঠের মাঝে। অনেকটা ত্রিভুজ আকৃতির। পুরোটাই বাঁশ আর খড় দিয়ে তৈরী। মেঝেতে খড়ের গদি। তার উপর কাঁথা কম্বল বিছিয়ে বিছানা। চার পাঁচজন মিলে সেই ঘরে রাত জেগে পাহারা দিত।

    ঐশিক,
    ভালো লেগেছে জেনে আমার ও ভালো লাগল।

    কেডিদা,
    সোনার কলমটা খুব বেশী হয়ে গেল আমার জন্য। তার বদলে দেখার চোখ আর লেখার ক্ষমতা পাই, এই বলে আশীর্বাদ করুন।

    দেবযানী,
    চালাও পানসি বেলঘরিয়া, বলে চালিয়ে দিলাম। ঠোক্কর খেয়ে কোথায় ঠেকবে বা ডুববে, কে জানে?

    শ্রাবণী,
    আনাড়িকে সাহস জোগানোর জন্য অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ।
  • titir | 128.210.80.42 | ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ ০৩:০০432601
  • শিবাংশুদা,
    নামটা ভুল লিখে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না।
  • Nina | 68.84.239.41 | ১৭ ডিসেম্বর ২০১০ ০৬:০১432602
  • তিতির, অনেক লেখ। খুব ভাল লেখার হাত তোমার আর দেখার চোখটিও আহে্‌হ----খুব ভাল লাগছে
  • titir | 24.15.212.116 | ২৪ ডিসেম্বর ২০১০ ০৮:৩৬432603
  • ধান ঝাড়ার সময় কিছু খড় আঁটি থেকে খুলে আসত। সেগুলোকে জড়ো করে রাখা হত পতিল মাড়ার (গোরুর পায়ে মাড়ানো) জন্য। সরু ধান, মোটা ধানের আলাদা আলাদা বেশ বড়ো বড়ো স্তুপ হত পতিলের জন্য। আর আমাদের ছোটদের যত খেলা ছিল সেই স্তুপের উপরে। ডিগবাজী, গড়াগড়ি , লুকোচুরি সব খেলা হত তাতে। হাল্কা গদির মতো খড়ের গাদায় খেলতে যত মত মজা, পরিনাম ছিল সেই পরিমান ভয়ঙ্কর। সন্ধেবেলা বাড়ি ঢুকে হাত পা ধোয়ার পর জ্বলুনি শুরু হতে যেত সারা গা জুড়ে। সেই যে নরম খড় ভেবে গড়াগড়ি খাওয়া, সে যে কখন অজান্তে হাত পায়ে সারা গায়ে দাগ কেটে গেছে নিষ্পাপ বালক বালিকার দল বুঝবে কি করে? জল লাগলেই জ্বলুনি। বড়রা কেউ কেউ আবার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে বলত, আর খেলবি খড়ের গাদায়। মায়েরা ভালো করে সর্ষের তেল মাখিয়ে আরাম দিত বাছাদের। পরের দিন সব ভুলে আবার সেই ডিগবাজী----------
    পতিল মাড়ানোর জন্য খামারের মাঝখানে একটা বড় বাঁশের খুটি পোঁতা হত। সেই বাঁশের খুঁটি ঘিরে বলদগোরু চক্রকারে ঘুরবে আর তাদের পায়ের চাপে খড় থেকে ধান বেরিয়ে আসবে। অনেক গুলি বলদগোরুর দরকার হত, এই কাজের জন্য। প্রতিবেশীরা সবই সবাইকে গোরু দিয়ে সাহায্য করত। সে জন্য আগে পিছে করে পতিল মাড়ানো দিন ঠিক হত। সবচয়ে বয়স্ক বলদটি পালের গোদা, মানে তারই সঙ্গে খুঁটির যোগ প্রথমে। তার পর জুড়ে যেত অন্য গোরুগুলি। এবার কলুর বলদের মত শুধুই ঘুরে চলা। যে গোরুগুলিকে হেট হেট করে চালানা করত, সেই উখুন ডাঙ (খড় ওলট পালাট করার লাঠি) দিয়ে দেখে নিত ধান ঠিক মত মাড়াই হচ্ছে কিনা। মাঝেমাঝে লোকটি বিশ্রাম করতে বা বিড়ি খেতে গেলে, আমরা মহা উৎসাহে স্বেচ্ছায় গোচালকের ভুমিকা নেমে যেতাম।

    পতিল মাড়ার পর যে সব ধান বেরত, সেগুলো সরু মোটা ধানের মিশ্রণ। তাই ভালো কোন কাজে লাগত না। হাবিজাবি কাজে সেগুলোকে লাগান হত। মকর সংক্রান্তি বা পৌষ সংক্রান্তির আগেই ধান ঝাড়াই, বাছাই, পতিল মাড়ান সব শেষ করতে হত। কেন না,সেই যে বড় বাঁশের খুঁটি সেখানেই হবে পৌষলক্ষ্মীর পুজো সংক্রান্তির দিনে। লক্ষ্মী হয়ে মাঠের প্রথম ধানের গুচ্ছটি বাড়ি এসে গেছে সবার আগে। তোলা আছে গৃহস্থের বাড়ির চালে। জমি থেকে ধান তোলা শেষ হয়ে গেলে কোন একটা কোনায় (এখন আর মনে নেই) গিয়ে লক্ষ্মী দেবীকে স্মরণ করে প্রনাম জানিয়ে আসত চাষী আর প্রার্থনা করত পরের বছর যেন আরো বেশী ফলন হয় মাগো।

  • Titir | 24.15.212.116 | ০২ জানুয়ারি ২০১১ ০৪:৫৮432604
  • শীতের আরেক উপকরণ হল খেজুর রস। বাড়িতে দু তিনটে খেজুর গাছ ছিল, সেগুলোতে কোনো দিন খেজুরকুল হত না। তাই সেগুলোকে চেঁছে ছুঁলে খেজুর রস বের করতে আসত কালিদা। একাজ তাদের জাত ব্যবসা ছিল না, কিন্তু করতে পারত বলে করত। রস ভাগাভাগী হত মালিক আর তার মধ্যে। দুদিন গৃহস্থের আর একদিন তার। মাঝে একদিন গাছ বিশ্রাম পেত। এইনিয়ে অভিযোগ ও হত। যেদিন তার পালা, সেদিন নাকি ভালো করে চেঁছে দিত, যাতে অনেক বেশী রস পড়ে। খেজুর রস নিয়ে যত কাব্য, সিনেমা বা গল্প হোক না কেন, ঐ রস কোনোদিন খেয়ে দেখতে ইচ্ছে করে নি। মানে ঐ খ্যাদা নাকে একটু উঁচু নাকি ছিলাম বলে। আর বেলা বাড়লে ঐ রস গেঁজে তাড়ি হয়ে হত, তাই তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করতে হত রসের। এই রস দিয়ে অনেক অনেক পিঠে হত। গুড় বানানোর জন্য মোতিবিবির মতো হাত কারুর ছিল না বলে, বাল্যকালে খুব একটা আসক্তি জন্মায় নি।

    তবে অনেক বেশী কদর ছিল আখের গুড়ের। এই আখ চাষ ও বাড়িতে হত। যেদিন আখ গাছ কাটা হত, বাগানের চারপাশে ছেলেপুলের ভীড় জমে যেত। বড় বড় লম্বা একটা করে আখ জুটত তাদের। আখের গোড়া থেকে কেটে নেওয়া হত। মাথার দিকের পাতা আর গায়ের গাঁটগুলো ভালো করে পরিষ্কার করে গাড়ি ভর্তি করে আখশালে নিয়ে যাওয়া হত। সেখানে আখ পেসাই করে রস বের করা আর তার থেকে গুড় তৈরি, সব একদিনে হত। তাই আখশালে আগে থেকে বলে রাখতে হত। এই আখশাল ছিল সেনাদের। আমরা বলতাম'সানাবাড়ি"। বড় বড় চুল্লিতে গরম রস পাক দিয়ে তরল সোনা তৈরি হত সেই আখশালে। সেখানে বটের পাতার ঠোঙা করে গরম গুড় খেত বাচ্চারা। বড় বড় মাটির কলসী (আমরা বলতাম গুড়ের কুঁদা) ভরতি হয়ে গুড় আসত বাড়িতে। সেই গুড় সারা বছরের খরচের জন্য।

    নানারকম ডাল হত এই শীতকালে। মুগ, বিউলি (আমাদের ভাষায় বিরি কলাই), খেসারি আর আঁটকি। সবগুলোকেই আমরা কলাই বলতাম। খেসারি ডালের গাছ আবার সব্জি মানে শাক হিসাবে খাওয়া হত। একদম ডগার দিকের অংশটা তুলে ভাজা খাওয়া হত। তবে গাছে ফুল আসার আগে আগে করতে হত। কি সুস্বাদু ছিল সেই শাকভাজা। এই গাছের ফুলগুলি ছিল অপুর্ব সুন্দর, বেগুনী বা নীল রঙের। ছোট্ট অপরাজিতা ফুলের মতো। গাছগুলি পেকে গেলেই ফসল আসত ঘরে । আমাদের কাজছিল গাছ থেকে বেছে বেছে শুঁটিগুলি আলাদা করার। মায়েরা বলত, কচি হাতে এই কাজ ভালো হয়। আমরাও পারি বা না পারি লেগে পড়তাম কাজে। এর পরে হত বড়ি দেওয়ার পালা।
  • Nina | 68.84.239.41 | ০২ জানুয়ারি ২০১১ ০৫:২১432605
  • তিতির, তোমার লেখায় একটা অদ্ভুত আমেজ ছড়ায়, মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলাকার কত কথা---এক কাপ গরম চা নিয়ে তোমার লেখাটা পড়তে পড়তে কখন যেন হারিয়ে ই গিয়েছিলাম --সেই খেঁসারির দানা ছাড়িয়ে , শীতের মীঠে রোদে বসে খাওয়া, আর খেজুড়ের ঝোলা গুড়! ঠান্ডা আখের রস! সত্যি আমাদের বাড়ীতে ভাল রান্না যে করতে পারত তাকে আমরা মোতিবিবি আর যে বাজে রাঁড়ত তাকে ফুলবানু বলতুম :-))
    আরও লেখ---খুব সুন্দর লিখছ!
  • titir | 24.12.5.31 | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১ ০৭:৩৪432607
  • সারা শীতকাল জুড়ে বড়ি দেওয়া হত বাড়িতে। তবে এটা সাধারনত ছুটির দিন বা রবিবারে করতে হত। অন্য দিনগুলিতে স্কুলের ভাত আর নানা কাজে মায়েদের ফুসরত মিলত না। বড়ি দেবার আগের দিন সকাল বেলায় ডাল ভেজানো হত বড় বড় গামলায়। বিকাল বেলায় ফুলে ফেঁ পে সেগুলি ঢোল। খুব যত্ন করে সেগুলিকে ধোয়া হত পুকুরের জলে। ডালের গা থেকে খোসা গুলি আলগা করে, বসে যেত বাটার পালা। বাটা হবে শিল নোড়াতে। পাড়ার খুব দক্ষ কিছু কাকি, জ্যেঠি ছিল এই বাটার জন্য। পিচ্ছিল বিউলি ডাল, শক্ত হাতে না জব্দ করলে, একদম চিত্তির। আমরাও চেষ্টা করে দেখেছি, কিন্তু কোন দিন ও এই ডালকে বাগে আনতে পারি নি। ডাল বাটা হত বেশ মসৃণ করে দু বার। পরে সারারত সেই ডালবাটা শীতের হীম খেয়ে জমা থাকত বড় বড় গামলাতে। সক্কাল সক্কাল শুরু হবে বড়ি দেওয়ার পালা।

    বড়ি হবে বিভিন্ন ধরনের। কেউ ঝোলের, কেউ ঝালের আর কেউ টকের। এ ছাড়া ভাজা খাওয়ার ও বড়ি ছিল। বড়ির সঙ্গে মিশত বিভিন্ন মসলা। থেঁতো করা আদা, জিরে, শুকনো লংকা দেওয়া হত ঝাল বড়িতে। মাঝে মাঝে কুমড়োর আঁতি( কুমড়োর ভেতোরের সাদা অংশ কুরিয়ে,রোদে শুকনো করে ডাল বাটাতে মেশানো হত) যোগ হত তাতে। এই বড়িতে নুন দেওয়া হত না। তাহোলে বড়ির নাক থ্যাবড়া হয়ে যাবে। সকালবেলা ফাইনাল টাচ দিতে আর একবার ডাল বাটা হত শিলে। সেই ডাল ভাল করে ফেটিয়ে কাসার বড় বড় কানা উঁচু বাটিতে করে সুন্দর তেকোনা বড়ি বসে যেত তেল মাখানো মসৃণ পাটাতে। এই পাটা হল বাঁশের কাঁঠি দিয়ে তৈরী। এই বড়ির নাম ছিল গুটি বড়ি। নুন দিয়ে যে থ্যাবড়া থ্যাবড়া বড়ি হত তার নাম ছিল বাতাসা বড়ি। দেখতে অনেকটা মিষ্টি বাতাসার মতো। এগুলো বেশ ভঙ্গুর। ভাজা খেতে খুব মজা। এগুলিতে আবার যোগ হত খোসা ছাড়ানো কুমড়োর বীজ।

    সবচেয়ে রাজকীয় যে বড়ি, তার নাম হল নকশা বড়ি বা গয়না বড়ি। সেই বড়ির ডাল খুব ভালো করে ধুয়ে আবার এক এক করে বেছে নিতে হত, কোন খোসা লেগে আছে কিনা। খোসা একদম থাকা চলবে না। বাছার পরে আবার সেই বাটার পালা আগের রাত্তিরে। পরের দিন সকাল বেলার নরম রোদে তাকে দিতে হবে। বেলা বাড়লে তিনি আবার গেঁজে যাবেন। তাই সাত তাড়াতাড়ি বড়ি দেবার যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে যেত সবাই। বড়ি বসবে পোস্তের আবরনের উপর। তাই বাড়ির যত বড় বড় থালা, কুলো সুন্দর করে পোস্তের লেয়ার দিরে সাজিয়ে রাখতে হত। বড়ি বের হবে মোটা কাপড়ের পুঁটলি দিয়ে, যার মাঝখানে একটা সুন্দর ছিদ্র করা আছে। সেই ছিদ্র দিয়ে ফেঁটানো ডাল বাটা সুন্দর নকশা হয়ে নেমে আসবে থালার উপরে। একটা হয়ে গেলে তার শেষ প্রান্তকে ছোট্ট কাঁঠি দিয়ে কেটে দিত হত। খুব সাবধানে এই বড়ি দিতে হত। কি সুন্দর সব নকশা। কেউ কানের মাকড়ি, কেউ ঝরোখা, কেউ জামাই বড়ি। কি অপুর্ব তাদের রূপ! আমরা অপটু হাতে শিখে যেতাম সেই সব নকশা। বেশী রোদ লাগলে এই বড়ি ফেটে যাবে, তাই মাঝে মাঝে কিছু আচ্ছাদন দিয়ে হালকা করে ঢেকে দেওয়া হত। একদিক ভালো করে শুকিয়ে গেলে অন্য পিঠ উল্টে দিতে হত। নতুন জামাই বাড়িতে এই বড়ি যাবে শীতের উপহার হিসাবে। তাই শাশুড়িদের বড্ডো গরজ ছিল এই বড়ি বানানোর। এই বড়ি জমা থাকত বড় বড় মাটির সরায়, আর সেই সরা ঝুলত শিকেতে। বাসি গায়ে কেউ ছোঁবে না তাকে। তাহোলে তিনি নাকি নষ্ট হয়ে যাবেন।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন