এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • পায়ের তলায় সর্ষে (গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন)

    bublee
    অন্যান্য | ১৭ নভেম্বর ২০০৮ | ৯৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • bublee | 71.106.244.161 | ১৭ নভেম্বর ২০০৮ ০৬:৩৭405007
  • সারাজীবন ধরে আমার একটা ছোট্টো স্বপ্ন ছিলো যে, ছোট্টো একটা নদীর ধার ধরে ধরে আমি ছুটে যাবো, হাঁটবো, আর নদীটা কখনো আমার সাথে কথা বলবে, কখনো ঝর ঝর করে পাথরে জল ছড়িয়ে, নুড়ি কুড়িয়ে, খল খল করে হাসতে হাসতে আমাকে ছাড়িয়ে যাবে, পাহাড়েরে আড়ালে লুকিয়ে যাবে। আমি বাঁক ঘুরে নদীকে বলবো, "এই যে তোমাকে আবার পেয়েছি"। নদী হয়তো আমাকে সঙ্গ দেবে, বাঁকে বাঁকে নতুন নতুন রূপ দেখাবে, কিম্বা হয়তো আমাকে পাত্তাই দেবে না। আপন মনে কখনো বিস্তীর্ন জায়গা জুড়ে, কখনো বা দুহাত চওড়া হয়ে কত দূরে চলে যাবে আমাকে জানতেই দেবে না। নদী হয়তো মনে মনে বলবে, 'জানো, আমি কতো হাজার বছর ধরে কত দূর দূর বয়ে গেছি? যখন কোনো সভ্যতা তোমরা তৈরী করনি, এই গাছ আর এই বনানী, এই পাথরে ভরা নুড়ি আমার কাছে ছিলনা, আমি ছিলাম। বয়ে গেছে আমার তোমাকে সঙ্গ দিতে'। আমি নদীকে বলবো, 'যাই বলো আর তাই বলো, আমি তোমার সাথে আছি, যখন তুমি আমার কাছে থাকবে না, যখন আমি বুড়ি হয়ে যাবো, তখনো তোমার স্মৃতি আমার সাথে থাকবে। তাই নিয়েই আমি সুখী, তুমি আমাকে মনে রাখবে কিনা তাই নিয়ে আমার একটুও চিন্তা নেই'। নদী বলবে,' ভালো কথা, আমরা তাহলে বন্ধু'। এই রকম ভাবে হাবিজাবি কথা শুনতে শুনতে, আমার কথা নদীকে বলতে বলতে আর নদীর রূপ দেখতে দেখতে আমি পাগল হয়ে যাবো, কথা হারিয়ে যাবে, শরীরে ক্লান্তি আর মনে প্রশান্তি নিয়ে, নদীকে বিদায় জানিয়ে আমি আমার পথ ধরবো। আর নদী? আবার নদীর নতুন বন্ধু হবে, আবহমান্‌কাল ধরে নদী নিজের মনে বয়ে যাবে।

  • bublee | 71.106.244.161 | ১৭ নভেম্বর ২০০৮ ০৭:৩২405018
  • বাপরে! এই একটা ছোট্টো স্বপ্ন সেই ছোট্টোবেলা থেকে পুষে রাখার জন্যে এতো ঝামেলা পোহাতে হবে তা জানা ছিল না!
    আমার নদীর নাম ফ্যানটম ক্রীক। আমি তার নাম দিয়েছি রূপবতী। এই রূপবতী কন্যার দেখা পেতে আমরা গিয়েছিলাম গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন।
    প্রথম দিন আমরা সাউথ কাইবাব ট্রেইল ধরে নেমেছি বেশ কয়েক হাজার ফুট। অসম্ভব ধূলধূসরিত পাহাড়ী পথ, পিঠে অসম্ভব বোঝা, অবিশ্বাস্য রকম কঠিন উৎরাই, আর ছিঁচ্‌কাঁদুনে কন্যা সঙ্গে করে আমরা যখন নিচে নামলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তার আগে যে বিশ্বস্ত সুপার হিরোকে সঙ্গে করে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম, আমার পঁচিশ বছর ধরে সঙ্গে থাকা সেই সুপার হিরো, আমার দেখাদেখি একবার ধুলায় পতিত হয়েছেন।
    নামতে নামতে কলরাডো নদীর সাথে দেখা হয়েছে খানিক আগে। যত আমরা নিচে নামছি, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন তত রূপ বদলে বদলে গ্র্যান্ড-আর ক্যানিয়ন হচ্ছেন। কঠীন পাহাড়ি রূপ বদলে বদলে, নরম মাতৃমুর্তি ধরতে ধরতে, পাহাড়, নদী, সন্ধ্যা তারা পরিবৃত একটা রূপসী মায়ায় পরিণত হয়ে, আবেশে মন ভরিয়ে দিয়েছে।
    অবশেষে আমরা নিচে গিয়ে পৌছুলাম। ডানহাতে নদী (ব্রাইট এঞ্জেল ক্রীক) আর বাঁহাতে ক্যাম্প। একটা জায়গা খুঁজে, তাঁবু টানিয়ে গুছিয়ে বসতে বসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমার সুপার হিরোর হাঁটু আর আমার বাঁ হাত পতনের মূল্য হিসাবে অচল অবস্থা ঘোষনা করেছে অনেকক্ষন। টর্চের আলোয় খাবার খেতে খেতে আমার হিরো অনুযোগ কোরলো যে, কারা যেন সার্চ লাইট জ্বেলে ক্যাম্প করছে, ক্যাম্পে এতো আলো ভালো লাগছে না। বললাম, 'উপরে তাকাও'। অবাক বিস্ময়ে তিনি আবিস্কার করলেন যে, এতো আলোর উৎস হোলো জ্যোস্না! এতো জ্যোস্না আর এতো তারা দেখা শহুরে মানুষের ভাগ্যে বেশী জোটে না। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত শরীরে শুক্লা অষ্টমীর চাঁদকে বিদায় জানিয়ে শুতে চলে গেলাম কিছুক্ষন পরে।

  • d | 117.195.35.126 | ১৭ নভেম্বর ২০০৮ ০৭:৫২405026
  • :গুরুচন্ডা৯'তে স্বাগতম। দারুণ সাবলীল লেখা আপনার। চালিয়ে যান হইহই করে।
  • bublee | 71.106.244.161 | ১৭ নভেম্বর ২০০৮ ১১:৫৯405027
  • ফ্যান্টম র‌্যানচে আমাদের ব্রেক্‌ফাস্ট ছিলো সাড়ে ছ'টায়। ছ'টা বেজে কুড়ি মিনিটে ঘুম ভেঙ্গেছে আমাদের। রাতে মাঝে ঘুম ভেঙ্গেছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু ঠান্ডার ভয়ে মুন্ডু বার করে আকাশ দেখার ইচ্ছাটাকে অবদমিত করতে হয়েছে প্রতিবার।
    দশ মিনিটের মধ্যে প্রাতকৃত্যাদি সেরে পৌঁছে গেছি ফ্যান্টম র‌্যান্‌চ-এ। ঘর ভরা লোকজনের সাথে বসে খাবার খেয়ে ক্যাম্পে ফিরত এসেছি এক ঘন্টার মধ্যে। যাবার আর ফেরার পথে একদল মহিলা হরিণের সাথে দেখা। তারা 'পথীক কেনো অধীর হেনো' মুখ করে আমাদের নিরীক্ষন করে, তারপরে আস্তে আস্তে অবহেলা ভরে পথ ছেড়ে দিয়েছে।
    গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ট্রেক করতে গেলে হাতের লাঠি ছাড়া আইবুপ্রোফেন বন্ধু হয়ে যায়। ফ্যান্টম র‌্যান্‌চ-এ আইবুপ্রোফেন কিনতে পাওয়া যায়। তাই কিনতে গিয়ে আমার পেটুক সুপার হিরো স্টেক ডিনারের বুকিং পেয়ে গেছেন। ডিনারের সময় বিকাল পাঁচটায়। ক্রেডিট কার্ড বার করে তিনি ডিনার বুক করে দিয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে।
    কথা ছিল রিবন ফল্‌স দেখতে যাবো এরপর। হজমিগুলির মতো বেশ কয়েকটি আইবুপ্রোফেন শরিরে ঢুকে গেছে এর মধ্যে। আমার কন্যাকে ক্যাম্পে রেখে, আমাদের আগে থেকে বুক করে রাখা লান্‌চ তুলে নিয়ে আমরা যখন রিবন ফল্‌স-এর পথ ধরলাম ততক্ষনে আমরা প্রায় দু'ঘন্টা সময় নষ্ট করেছি। নষ্ট করেছি বললে ভুল বলা হয়, জায়গাটা এতো সুন্দর যে চোখ ফেরানো যায় না, তাড়া করতে মন করে না।
    রিবন ফল্‌স যেতে গেলে নর্থ কাইবাব ধরতে হয়। ফ্যন্টম র‌্যান্‌চ পিছনে রেখে নর্থ কাইবাব ধরে চলতে শুরু করলাম আমরা।
    প্রকৃতি মা যখন এই পৃথিবীটা তৈরী করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এর উপরটা তৈরী করে বেশ খানিকক্ষন বিশ্রাম নিয়েছেন, তারপর তাঁর শিল্পী মনটাকে জাগিয়ে তুলে কি করি কি করি ভেবেছেন, তখন তিনি সৃষ্টি করেছেন নর্থ কাইবাবের এই অংশটি। বেশীর ভাগ রাস্তা নদীর ধারে সামান্য চড়াই। আমাদের সামনে তারুন্যে ভরপুর দুটি যুবক দুমদুম পায়ে আমাদের ছাড়িয়ে ডানদিকে ঘুরে অন্য একটা ট্রেইল চলে গেছে খানিক আগে। যাবার পথিক এছাড়া আর কারো দেখা পাই নি সারা পথে।

  • bublee | 71.106.244.161 | ১৭ নভেম্বর ২০০৮ ১২:২৫405028
  • নদী চলেছে আমাদের বাঁহাতে। যেতে যেতে রাস্তার উপর হঠাৎ একটা ব্রীজ। ব্রীজ পার হয়ে নদী আমাদের ডানহাতে। কি অদম্য প্রয়াসে, পরিশ্রমে, এই নদীর আর্তনাদকে উপেক্ষা করে মানুষ টেলিফোনের খুঁটি পুঁতেছে, লাইন টেনেছে টেলিগ্রাফের! পাহাড় আমাকে প্রতিবাদের ভাষায় বলেছে,'দেখো, আমার শরীরে কতো যন্ত্রনা দিয়েছো তোমরা! দেখো, এই রূপবতী নদী তোমার, আমার পাথর ক্ষয়ে ক্ষয়ে নেমে এসেছে কতো হাজার, কতো কোটি বছর ধরে; প্রতিবাদ করিনি, কেননা আজকে আমার এই যে সৌন্দর্য্য- সেটা তোমার রূপবতী আর তার সাথীদের দেওয়া, আর তোমরা মানুষেরা সভ্যতার সঙ্গে আমাকে দিয়েছো ক্ষতচিহ্ন'! বললাম, 'ওগো পাহাড়, মাপ চেয়ে নিচ্ছি আমি ওদের হয়ে। আর রাগ কোরো না। মানুষ এখন বুঝতে শিখেছে, তোমাকে রক্ষা করার অদম্য প্রয়াস নিয়েছে, তাতো তুমি জানো'। পাহাড় রইল চুপ করে। আমার উত্তর তার পছন্দ হোলো কিনা বোঝা গেলো না।
  • bublee | 71.106.244.161 | ১৭ নভেম্বর ২০০৮ ২১:৫১405029
  • আমরা চলেছি পাহাড়ের কোলে কোলে। পাহাড় যেভবে ঘুরেছে নদীর পাশে পাশে, আমরা চলেছি তাকে দিশা করে। মাঝে কোথা থেকে অন্য একটা ক্রীক এসে মিশেছে ফ্যান্টম ক্রীকের সাথে। ডানদিকে পাহাড়, বাঁদিকে পাহাড়, পাশে নদী চলেছে ছলছলাৎ ছলছলাৎ করে আর রাস্তা চলেছে ঘুরে ঘুরে।

    গায়ে ব্যথা, আমার বাঁহাতে ব্যথা আর ওষুধের প্রভাবে শরীর তখন আছে ঝিম ধরে কিন্তু মনটা ভরপুর। আগের দিন যেহেতু আমরা সাউথ কাইবাব দিয়ে নেমেছি আর এখন আমরা উঠছি, পায়ের যে পেশীগুলোতে কালকে ব্যথা করছিলো, এখন সেখানে ব্যথা করছে না, কিন্তু সামান্য উৎরাই হলেই সমস্ত পেশী জুড়ে 'মানছি না, মানব না' করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

    এখন নদী আমার ডানদিকে। নদীর পরে পাহাড় আর খাতে খাতে আমরা চলেছি। হঠাৎ পথের উপর একটা পাথরের ফাঁক থেকে ভুরভুর করে জল উঠে রাস্তা ভিজিয়ে দিচ্ছে। নদী তখন ডানদিকে চার পাঁচ ফুট নীচে! এখানে জল আসে কোথা থেকে? বাঁদিকে পাহাড়ের দেয়াল। বোঝা যায় না। ভালো কথা, থাকো তুমি। আমার অনুসন্ধিৎসু মনটাকে তালা দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম।

    নদীর সাথে ততক্ষনে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। রূপবতীর রূপ বদলাচ্ছে প্রতিমুহুর্তে। কখনো সে খরস্রোতা-- না ভুল হলো বলা, বেশীর ভাগ সময়ে সে ভরস্রোতা, তেজস্বীনী কুমারী কন্যা। কোথাও একফোঁটা শেওলা জমতে দেয়নি পাহাড়ের গায়ে, শুধু বারদুয়েক পথ ছেড়ে সামান্য সরে আসার ফলে অল্প গাছ বা ঘাস জন্মেছে সরে আসা জমিতে। আমাদের পথ থেকে কখনো পথের পাশে, কখনো বা দশ ফুট নীচ সে দিয়ে বয়ে গেছে। একবার বাঁকের মুখে রূপবতী প্রায় দশ ফুট চওড়া হয়ে গেছে আর পথ গেছে বাঁকের মুখে হারিয়ে। বেশীর ভাগ সময়ে সে অবশ্য দু তিন ফুটের বেশী চওড়া নয়।

    এরপর আমরা দু নম্বর ব্রীজ পেরিয়েছি, তিন নম্বর ব্রীজ পেরিয়েছি। তারপর একদল তরুন তরুনীর সাথে দেখা। এরা নর্থ কাইবাব ধরে নামতে নামতে কালকে রাতে কটনউড ক্যাম্পে থেকেছে, আজকে আমাদের ব্রাইট এঞ্জেল ক্যাম্পে থাকবে। বেশ বিধ্বস্ত অবস্থা। প্রশ্ন করলাম রিবন ফল্‌স আর কত দুরে, বলে আরও চার মাইল!
  • arjo | 168.26.215.13 | ১৭ নভেম্বর ২০০৮ ২১:৫৮405030
  • বাবলী দি, একঘর হচ্ছে। চালিয়ে যাও।
  • bublee | 71.106.244.161 | ১৭ নভেম্বর ২০০৮ ২২:১২405031
  • মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ
  • bublee | 71.106.244.161 | ১৮ নভেম্বর ২০০৮ ০০:০২405032
  • ট্রেইল-এ দূরত্ব অনেক সময় 'ডালভাঙ্গা ক্রোশ' এর মতো।আমাদের হিসাব মতো আমরা প্রায় চার মাইল পথ এসেছি, হতে পারে না আরো চার মাইল দূর। এখন বাজে সড়ে এগারোটা। অন্তত দুমাইল প্রতি ঘন্টা গতিতে আমরা হাঁটছি। আমি net-এ অনেক চেষ্টা করেছি এই রস্তার বিবরণ পেতে, কিন্তু যেহেতু বেশী লোক এই পথে যায় না, তাই ভালো বিবরণ কিছু পাই নি। গায়ের যন্ত্রনার জন্যে ভরসাও গেছে কিছু কমে। আবার পাঁচটার সময় ডিনারে পৌঁছুতে হবে।

    'কিগো কন্যা, কোথায় তোমার ঝর্না'? নদী হাসে, জল গড়ায়, কথার উত্তর দেয় না। এর মধ্যে রাস্তা কঠীন হতে শুরু করেছে অল্প অল্প। বেশ কয়েকবার পাথরের ধাপ পেরোলাম কষ্ট করে। যন্ত্রনা জানান দিচ্ছে। 'নাম রেখেছি রূপবতী, মহা মায়া হলে কেন? আর কতদূরে তোমার ঝর্না'? নদী বলে, 'আমার লাগে না মনে, তোমরা যা বলো তা বলো'।

    প্রায় সাড়ে বারোট বাজে; এখনো পেলাম না রিবন ফল্‌স-এর দেখা। হয়ত আর মাইল খানেক রাস্তা। একটা পথীক নেই যে সন্ধান দেবে। চার নম্বর ব্রীজ পেরিয়েছি অনেকক্ষন।

    এবারে একটা কঠীন সিদ্ধান্ত নিতে হলো। তাই একটা জায়গায় আমরা বসলাম লাঞ্চ করতে। পাথরের উপর আমাদের লাঠীগুলোকে বিশ্রাম দিয়ে। যদি রিবন ফল্‌স আরো দুমাইল দূরে হয়, তাহলে আমাদের পৌঁছতে পৌঁছতে দেড়টা। এবার যদি আমাদের ফিরৎ আসার সময়টা যাবার সময়ের থেকে বেশী লাগে, তাহলে আমরা ডিনার মিস করে যাব। ক্যাম্পে কন্যাকে একা অন্ধকারে থাকতে হয়, আর আমাদের সাথে টর্চ লাইট নেই। রিবন ফল্‌স না ষ্টেক ডিনার ভাবতে ভাবতে ষ্টেক ডিনার জয়ী হলো, লাঞ্চ খেয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম।

    ফেরার পথে আমার সাথীকে বললাম এই যে আমরা পাঁচ সাড়ে পাঁচ মাইল পথ এই নদীর সাথে সাথে এসেছি, এটা না দেখলে জীবনে কতকিছু না দেখা থেকে যেতো।

    ফেরার পথে নদী আমার রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে বারবার। সূর্যের আলোয় আর পাহাড়ের ছায়ায় লুকোচুরি খেলেছে সে আমার সাথে। পাহাড় এখন পাগলী নদীর আঁচল কুড়িয়ে, নানা রং-এর বর্ণচ্ছটায় নিজেকে আপ্লূত করে, নদীর বকবকানী শুনতে শুনতে উদাস পুরুষের মত নদীর পিছন পিছন পথ চলেছে।

  • bublee | 71.106.244.161 | ১৮ নভেম্বর ২০০৮ ০০:৩৫405008
  • যাবার পথে মাঝে মাঝেই দেখেছি পাথরের দেয়াল প্রায় দু তিন ফুট উঁচু করে নদী আর মানুষ যাবার রাস্তা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। অনেকটা ভিত গাথার মতো করে, বারান্দার মত তার উপরে বেশ বসা যায়। নদীর দিকে মুখ করে, পাহাড়ের দিকে পিছন করে বসে ভাবলাম সারা শরীর আর মন জুড়ে এই প্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে গেলে বসা উচিৎ হবে না। শবাসন ভঙ্গিমায় নিজেকে পুরোপুরি দান করলাম প্রকৃতির হাতে। চোখ বন্ধ করে দেখার চেষ্টা করলাম চারপাশটাকে। প্রকৃতির সাথে আত্মার এই মিলন শুধু অনুভব করা যায়, বর্ণনা করা যায় না।

    কতক্ষন ছিলাম এইভাবে ঠিক জানিনা, আমার হিরো তখন আমাকে ঠেলেঠুলে দেখছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি কিনা! মনে মনে আমার বেরসিক সুপার হিরোর মুন্ডপাত করে, অনেক গালি মনে মনে দিয়ে, আবার চলতে শুরু করলাম ক্যম্পের পথে।
  • debu | 170.213.132.253 | ১৮ নভেম্বর ২০০৮ ০২:২২405009
  • চালাও পান্সি!
    অমি খুব মিস করলাম তোমার সঙ্গে না গিয়ে।
    দেবু
  • bublee | 71.106.244.161 | ১৮ নভেম্বর ২০০৮ ০৩:৩৮405010
  • যাবার পথে যেখানে ভুরভুর করে জল উঠে রাস্তা ভিজিয়ে দিচ্ছিল, সেখানে দেখলাম দুজন প্রৌঢ পুরুষ মানুষ আর একজন প্রৌঢা মহিলা জল বাঁচিয়ে, টেনিস জুতো না ভিজিয়ে এদিকে আসার চেষ্টা করছে। জিঞ্জাসা করলাম কোথায় যাচ্ছ তোমরা? বলে, রিবন ফল্‌স দেখতে। ও! তা, দেখে তো মনে হচ্ছে, আপিস থেকে ফিরে, গা ধুয়ে পাউডার লাগিয়ে পাড়ার ক্লাবে তাস খেলতে চলেছো! আমার মুখের ভাবে বোধহয় কিছু আন্দাজ করে বললো, 'আমরা আসলে hiker নই একেবারে। এমনকি আমরা walker ও নই, কালকে এসেছি খচ্চরের পিঠে করে, আগামী কাল ফিরৎ যাব'। ভয়ে ভয়ে ট্রেইল হাঁটার স্বাভাবিক প্রশ্নটি করলাম, 'জল আছে তোমাদের সঙ্গে'? সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষটি জ্যাকেটের পকেটে হাত দিয়ে বলে,'হ্যাঁ আছে'। ইচ্ছা করছিল 'ওরে যাস নে খোকা ওদিকে' করে টেনে ধরে রাখতে, তবু হায়, 'যেতে দিতে হয়'। ভরসার কথা ওরা walker ও নই বলেছে!

    ফ্যান্টম র‌্যাঞ্চ-এর কাছাকাছি যা কয়েকটা হরিণ দেখেছি, এ ছাড়া আর কোনো প্রানীর দেখা পাই নি এই পুরো রাস্তায়। এই রাস্তায় খচ্চর চলে না বলে তাদের দেখাও পাই নি।

    কি অসম্ভব রাগ হচ্ছিল নিজেদের উপর, যখন দেখলাম বেলা সাড়ে তিনটের মধ্যে আমরা ক্যাম্পে ফিরৎ চলে এসেছি! গতকাল স্নান হয় নি, আজকেও না। অনুমতি পত্রে বলা আছে নদীতে নেমে স্নান করা যায়। নদীকে জিঞ্জাসা করলাম , 'কি গো, নাইবো নাকি'? নদী বলে, আমার দাঁত আছে, কামড়ে দেব জলে নামলে। যাক গে, ঠান্ডার ভয়ে নামলাম না জলে। গরম জল করে তোয়ালে দিয়ে গা ভালো করে মুছে ফিটফাট হয়ে প্রস্তুত হলাম ষ্টেক ডিনারের জন্য।

    আমার কন্যা সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে এসেছেন, সাউথ কাইবাবের ব্ল্যাক ব্রীজ পর্যন্ত চরেছেন। তারপর তার মন্তব্য, 'এই নদীটা পার্টিগার্ল, সারাদিন ধরে চ্যাটার করছে--- কেয়ার পর্যন্ত করছে না, কেউ শুনছে কি না'। মনে মনে ভাবলাম জেনারেশন গ্যাপ, কিন্তু ধরেছে ঠিক। নদী আপন মনে কথা বলে চলেছে, কেউ শুনছে কিনা তা নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই।

    অত:পর ষ্টেক ডিনার। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বিখ্যাত সেই ষ্টেক ডিনার যা কিনা খচ্চরের পিঠে করে ঊপর থেকে আসে। পরিতৃপ্ত মনে ডিনার সেরে ক্যাম্পে ফিরলাম সন্ধ্যার মুখোমুখী।

    মানুষ যখন একটা স্বপ্ন দেখে, তখন তার স্বপ্নটাকে বাস্তব বলে মনে হয়, আর ঘুম ভাঙ্গার পরে বোঝা যায় আরে এটা তো স্বপ্ন ছিল! যে স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে, সে স্বপ্ন পুরোটা বোনা না হলে মনের কাছে পরিস্কার হয় না। ক্যাম্পে ফিরে এসে হঠাৎ আমার উপলদ্ধি হলো --- আমার কত দিনের স্বপ্ন একটা নদীর সাথে, একটা নদীর পাশ ধরে আমি হাঁটবো আর নদী আমার বন্ধু হবে! মনে কোনো প্রশ্ন না রেখে আমার এ স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে--- এমনটা হবে আমি কোনোদিন ভাবি নি। এ প্রকাশের ভাষা নেই আমার।
    ভাবে আপ্লুত মন নিয়ে, এখন ভীষন শীত করছে, আকাশ দেখবো কালকে, ভাবতে ভাবতে টেন্টে ঢুকে গেলাম অন্ধকার নামার পরে পরেই।
  • rimi | 168.26.215.135 | ১৮ নভেম্বর ২০০৮ ১৯:৫৯405011
  • তারপর? বাকিটা কই?
  • Blank | 203.99.212.224 | ১৮ নভেম্বর ২০০৮ ২০:০০405012
  • ডিনারের জন্য মাত্র ১/১২ লাইন :(
  • bublee | 71.106.244.161 | ১৯ নভেম্বর ২০০৮ ১২:০৪405013
  • রাতটা ছিল অসম্ভব কনকনে ঠান্ডা। তাঁবুর ভিতরে তাও খানিকটা গরম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গেছে বেশ ক'য়েকবার। শেষরাতে ক্লান্তিতে সবাই ঘুমিয়েছি বাধ্য হয়ে। ফ্যান্টম র‌্যাঞ্চে ব্রেকফাস্ট ছিল সকাল সাড়ে পাঁচটায়। আগে থেকে একটু চিন্তা ছিলই যে উঠতে পারবো কিনা, অত সকালে খাবার খেতে। ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন বাজে প্রায় ছ'টা। ব্রেকফাষ্ট মিস করেছি নিশ্চয়। এখানে খাবারের জায়গায় বাধা সময়ে টেবিলে প্লেট সাজিয়ে দরজা খুলে দেয়; কে কোন টেবিলে বসবে তা নির্দিষ্ট থাকে। মোটামুটি পঞ্চাশ মিনিট সময় থাকে খাবার খাওয়ার জন্য। দরজা বন্ধ হয়ে যায় আবার। টেবিল পরিষ্কার করে, টেবিল সাজিয়ে পরের ব্যাচের লোকদের খাওয়ান হয় আবার।

    যাইহোক, ঠান্ডায় শরীরটা বাসী রুটির মতো কড়কড়ে হয়ে আছে। তাড়াহুড়ো করতে ইচ্ছাও করছে না আর লাভও নেই গিয়ে হয়তো। সিদ্ধান্ত হল ক্যাম্পেই ব্রেকফাষ্ট করবো শুকনো খাবার দিয়ে। তাহলে আরও অন্তত আধাঘন্টা বাদে উঠা যায়।

    গরমাগরম চা আর শুকনো খাবার দিয়ে ব্রেকফাষ্ট করে, তাঁবু গুটিয়ে, আমরা যখন বেরলাম তখন প্রায় সাড়ে নটা বাজে। তাড়ার কিছু নেই আজ, কেননা আজকে মাত্র পাঁচ মাইল গিয়ে ইন্ডিয়ান গার্ডেন ক্যাম্প করে থাকার কথা, তারপর যদি সময় থাকে তাহলে প্ল্যাটু পয়েন্ট।

    আবার সেই বোঝা পিঠে। কিছুটা হাল্ক হয়েছে এই দুইদিনে খাবার খেয়ে। বেশ কয়েকটা আইবোপ্রোফেন ঢুকে গেছে শরীরে। তারপর আবার পথ চলা শুরু। আজকে থেকে আমাদের উঠা শুরু।

    ব্রাইট এঞ্জেল ট্রেইল ধরে পৌছালাম রূপালী ব্রীজ-এ। পায়ের নীচে নীলচে কলরাডো নদী উথলানো দুধের মত সাদা ফেনা তুলে, নুড়িতে নুড়িতে ঠোকাঠুকি করে, যৌবনবতী গরবিনীর মত, চারপাশের পরিবেশকে উপেক্ষা করে আপনমনে চলেছে। রুপালী ব্রীজ তার উপর দিয়ে চলে গেছে যেন সাদা ফেনার লেস বসানো নীলবসনা নৃত্যরতা কোনো সুন্দরীর রূপালী চুড়ির মতো। ব্রীজ পার হতে হতে নদীর দাপাদাপি দেখা যায়। এই ব্রীজ পার হয়ে আমরা পৌছালাম অন্য একটি পাহাড়ের ধারে। এখান থেকে চড়াই শুরু। বাঁদিকে পাহাড়, ডান হাতে নদী আর পাহাড় বেয়ে আমরা উঠছি অল্প অল্প।

  • bublee | 71.106.244.161 | ১৯ নভেম্বর ২০০৮ ১২:৩২405014
  • গৌরীপট্টের উপর যেমন শিবলিঙ্গ বসানো থাকে আর কালো শিবলিঙ্গের গায়ে যে চন্দনের তিনটি সমান্তরাল তিলক কাটা থাকে, তার সঙ্গে যদি তুলনা করা যায় তবে, গৌরীপট্ট হল আমদের কলরাডো নদী আর শিব লিঙ্গের মত পাহাড়ের গায়ে তিলকের পাকদন্ডী বেয়ে ক্রমশ আমরা উঠছি।

    মুগ্‌ধ বিষ্ময়ে ভাবছি এত রূপ, এত সৌন্দর্য্য দু'চোখ ভরে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। গতকালের সেই কুমারী নদীর রূপ গেছে হারিয়ে। প্রকৃতির এই রূপে তাঁর স্রষ্টার কাছে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। প্রার্থনা করতে হয়, আমায় শুধু দেখার মত চোখ দাও, এ যেন আমি কখন ভুলে না যাই, বেদনা না পাই...

    যে কলরাডো নদী তার প্রানক্ষমতায় গত পয়ত্রিশ কোটি বছর ধরে পাহাড়ের উপর থেকে নামতে নামতে আজ বর্তমানের পথ ধরে চলেছে, সে নদীর ওপাশেও পাহাড়। রাস্তা যেহেতু ঘুরে ঘুরে চলেছে, সেহেতু যত দূর চোখ যায় লালচে আর কালচে পাথরের পাহাড় আর মাঝে সব্জেটে নীল নদী। মাথার উপরে ঝকঝকে নীল নীর্মেঘ আকাশ। আকাশ এত নীল যে মাঝে মাঝে সে নীল জমাট বেঁধে নেভী ব্লু রং এ পরিণত হয়েছে। আমরা যত উপরে উঠছি, নদী তত নীচে নামছে । একজায়গায় কারা যেন একটা হলুদ রং-এ র‌্যাফ্‌ট নোঙর করে নদীর ধারে নেমেছে। একবার মাথার উপর দিয়ে হলদে কালো ডোরাকাটা ভ্রমরের মত একটা হেলিকপ্টার গুঞ্জন করে ওপাশের পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
  • bublee | 71.106.244.161 | ১৯ নভেম্বর ২০০৮ ১৩:৪৩405015
  • খানিকবাদে আমরা নদী ছেড়ে পাহাড়ে ভিতরের অংশে ঢুকে পড়লাম। কবে আবার নদীর সাথে দেখা হবে কে জানে। পথে একটা পাথরে বাধানো রকের উপর বসে জল আর খাবার খেলাম আমরা। পিছনে একটা ছোট্ট ক্রীক বয়ে যাচ্ছে কুলকুলানী শব্দে। একটু পরে আমরা সেই ঝোরাটা পেরিয়ে ওপাশে পৌছলাম। ঝোরাটা দুফুটের বেশী চওড়া নয় আর কোনভাবেই ছয় ইঞ্চির বেশী গভীর নয়, নুড়ির ওপর পা দিয়ে পেরিয়ে গেলাম আরামে। অন্যপাশে একটি যুবক আমাদের পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। জিঞ্জাসা করে জানা গেল, ইনি আসছেন ইন্ডিয়ান গার্ডেন থেকে। রাস্তায় এই রকম ঝোরা আছে ঠিক চারটে, তার মধ্যে এইটাই সবচেয়ে চওড়া। এরপর আমরা দুনম্বর ঝোরা পেরলাম। আরও কিছুক্ষন হেঁটে তারপর লাঞ্চ করেছি পা ছড়িয়ে বসে তিন নম্বর ঝোরার কাছে।

    এরপর কখন আমরা বোঝার আগেই ডেভিল কর্ক ষ্ক্রূ অংশে পৌছে গেছি। কি অসম্ভব খাড়া চড়াই রে বাবা! দুটো করে পাকদন্ডী পরিয়ে দু মিনিট করে বিশ্রাম নিয়েছি নিয়ম করে, হাঁপিয়ে পড়ি বা না পড়ি। উপরের থেকে পাকদন্ডীর রাস্তা দেখে মনে হচ্ছে আমি এই রাস্তা ধরে অবশ্যই উঠিনি। লালচে ধুলার এই রাস্তা কোন এক খনি মালিক বানিয়েছিল তার মালপত্র যাতায়াতের জন্য। এই রাস্তা কেউ শখ করে বানায়! যাইহোক, প্রায় উঠে এসেছি। রাস্তায় সময় নষ্ট করেছি অনেক। খাড়া চড়াই প্রায় শেষ। মাথায় পৌছে গিয়ে বসা হলো দশ মিনিটের মত; বিশ্রাম, জল, আর স্ন্যাস্কসের জন্যে। বাজে তখন প্রায় দেড়টা বা পৌনে দুটো। পাকদন্ডীর নীচ থেকে বেশ একটা ছন্দময় শব্দ উঠে আসছে। উৎসুক হয়ে দেখলাম কারা এত শব্দ ছড়াছে, দেখি, দুটি যুবক তরতর করে পাকদন্ডী বেয়ে উঠে আসছে--- তাদের জুতোর বা হাঁটার শব্দ। আমাদের দেখে দাঁড়ালো। একজন সাদা আর অন্যজন এশিয়ার যে কোন দেশের হতে পারে। দিত্বীয়জন আমাকে হিন্দিতে জিঞ্জাসা করলো কোথায় যাচ্ছ তোমরা। বললাম। তোমরা? বলে কিনা সকালবেলায় রওনা হয়েছে নর্থ রিম থেকে, যাচ্ছে উপরে। হিসাব করলে দেখা যাবে মাত্র চব্বিশ মাইল পথ। শুধাল জল আছে কিনা আমাদের সাথে, বললাম আছে। নৃত্যরত আরবী ঘোড়ার মত টগবগিয়ে বাঁকের মুখে ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল অল্পক্ষনের মধ্যে। হিসাব করে দেখলাম এই অবিশ্বাস্য চড়াইতেও ওরা ঘন্টায় চার মাইল গতিবেগ বজায় রাখছে!

    আমার সুপার হিরো এরা চলে যাবার পর কমপ্লেন করলো যে আমাদের একটু তাড়তাড়ি হাঁটা দরকার প্ল্যাটু পয়েন্ট দেখতে হলে। বেশ কতগুলো অজুহাত ছিল আমার-- সঙ্গে যথেষ্ট পেইন কিলার নেই, ওটা তো ওপর থেকেও দেখতে পাওয়া যায় ইত্যাদি ইত্যাদি-- বলে কিনা ওখান থেকে ভালো সূর্যাস্ত দেখা যায়। সূর্যাস্ত? আগে বলবে তো। শুনে পা চালালাম। এর মধ্যে আমরা চার নম্বর আর পাঁচ নম্বর ঝোরা পেরিয়েছি। ছয় নম্বর ঝোরা ইন্ডিয়ান গার্ডেন এর খুব কাছে। পা না ভিজিয়ে এ পেরোনোর কোন সম্ভাবনা নেই। জল দেখলেই আমার পা ডোবানো অভ্যেস। নেহাৎ এই বোঝা নিয়ে ভিজা জুতো পরে চড়াই উঠতে অসুবিধা হবে বলে কিছু বলি নি। পা তো ভিজেছেই, কিন্তু এ জল যদি আমি না ছুঁয়ে যাই, শান্ত জলের স্নেহাশীষ আমি যদি না নিয়ে যাই, তাহলে এই ঝোরাকে আমার অপমান করা হয়, পাহাড়কে অবহেলা করা হয়, আর আমার অন্তরাত্মাকে উপেক্ষা করা হয়। লাঠীর উপর ভর করে, নীচু হয়ে হাত দিয়ে সে জল স্পর্শ করে তবে আমার শান্তি। আমার সাথীরা আমার নির্বুদ্ধিতায় অবাক হয়ে, বাক্যহারা হয়ে থমকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
  • bublee | 71.106.244.161 | ১৯ নভেম্বর ২০০৮ ১৪:৫৩405016
  • ইন্ডিয়ান গার্ডেনে পৌঁছে গেলাম পৌনে তিনটের মধ্যেই। কটনউড গাছে ঘেরা ইন্ডিয়ান গর্ডেন-এ পৌছে সাত নম্বর ঝোরা। এখানে আমরা মালপত্র নামিয়ে ভাল করে মুখ হাত ঝোরার জলে ধুয়ে ক্যাম্প সাইট কোথায় খুঁজতে চললাম। সূর্যাস্ত দেখার কথায় শরীর উঠেছে চনমনে হয়ে। দুমদাম ক্যাম্প খাটিয়ে, কন্যাকে ক্যাম্পকে রেখে বিশ্রাম নিতে বলে প্ল্যাটু পয়েন্টের দিকে আমরা যখন রওনা হলাম তখন মোটমুটি সাড়ে তিনটে বাজে।

    ছবি দেখে আমার ধারনা ছিল যে ইন্ডিয়ান গার্ডেনটা বেশ বানিজ্যিক ভাবে তৈরী। বাস্তবে দেখা গেল ঠিক তার উল্টো। জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট একটা ঝোরার পাশে লুকানো একটা ক্যাম্প গ্রাউন্ড। কত চোখের জলে এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের ইতিহাস লেখা। এই নদী, এই পাহাড় ইন্ডিয়ানদের গ্রাম ছিল, ঘর ছিল। কত রক্তে ভরা বেদনার সাথে এরা ঘর ছেড়েছে, প্রান দিয়েছে। আজ কটনঊড পাতায় আর হয়ত রক্ত লেগে নেই, কিন্তু দীর্ঘশ্বাস জড়িয়ে আছে নিশ্চয়। পাহাড় সে গল্প করে না, নদী সে কথা বলে না, তাদের কাজ পথীককে আনন্দ দেওয়া। উদসীনতা দিয়ে এরা আমাদের মুগ্‌ধ করে, মন ভরে দেয়। আবহমান কাল ধরে এই চলে আসছে, চলার ইতিহাস রচনা হচ্ছে। আমদের ক্যাম্পসাইটে কালকে অন্য লোক থাকবে, পাহাড় শুধু দেখবে, ভাববে না, বা, ভাবনা জানতে দেবে না। জিঞ্জাসা করলে উত্তর দেবে, 'প্রাইভেসী প্লীজ'।

    ইন্ডিয়ান গার্ডেন ক্যাম্প সাইট থেকে প্ল্যাটু পয়েন্ট দেড় মাইল। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের যে অংশটায় আমরা কালকে ছিলাম তাকে বলে ইনার গর্জ। তারপরে আজকের এই অংশটাকে বলে, টন্টো প্ল্যাট্‌ফর্ম। এই জায়গায় সব্জেটে পাথরের সঙ্গে কোয়ার্টজ মিশাল।

    সমতল রাস্তায় দেড় মাইল পথ যেতে আমাদের আধাঘন্টার বেশী লাগে নি। পশ্চিমের আকাশে পাহাড়ের পিছনে খটখটে রোদ্দুর দেখে আমার সুপার হিরো থিসিস লেখার মত মুখ করে ঘোষনা করলো যে সূর্যাস্ত হয়ে গেছে পাহাড়ের আড়ালে, আর দেখা যাবে না। এ বস্তু নিয়ে কি করা যায়, খাঁড়া আর বলিকাঠ এখানে কোথায় পাই ভাবতে ভাবতে সামনে দেখি একটা রেলিং আর তাতে লোকজন ঝুঁকে কি যেন দেখছে। আমিও দেখ্‌ব! কতগুলো পাথর টপকে রেলিং ধরে সামনে গিয়ে আমরা তো হা! নীচে কলরাডো নদী রুদ্রমূর্তিতে পাথরে মাথা ঠুকতে ঠুকতে , শিবের বুকে পা পড়ার আগের কালীমুর্তি হয়ে সগর্জনে ঘুরপাক খেতে খেতে ছুটে চলেছে। সূর্যাস্ত নয়, নদী দেখার সেরা জায়গা হলো এটা। এরপর নর্থ রিমের পিছনে পশ্চিমের আকাশে সূর্য অস্ত গেলো, পুবের আকাশকে হোলির রং-এ রাঙ্গিয়ে দিয়ে। আমরা ক্যাম্পে ফিরলাম অন্ধকার নামার আগেই।

    রান্না বসিয়ে দেওয়া হলো গরম গরম খিচুড়ি। আহা! কি স্বাদ তার! ঘি ঢালা খিচুড় আদা দিয়ে খাওয়া হলো যতখানি পেটে ধরে তার একটু বেশী। তারপর বাসনপত্র ধোয়াটোয়া করে আস্তে আস্তে তাঁবুর ভিতর ঢুকে পড়া হলো। বাইরে আজ তাপমাত্রা তিরিশ ডেগ্রী ফারেন্‌হাইট হবে। জামা, জ্যাকেট, মোজা আর যা যা পরা যায় সমস্ত জড়িয়ে শোবার ব্যবস্থা করা হল শীতের রাতের প্রস্তুতি হিসাবে। মন ভরে অবশ্য আকাশ দেখেছি তার আগে। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছি বেশ তাড়াতাড়িই।
  • Du | 67.111.229.98 | ২০ নভেম্বর ২০০৮ ০১:৩৪405017
  • বুবলী আপনার লেখায় পাইনের ফাঁকে আসা রোদের ঝিলমিলি আর জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। দারুন ! বেড়াতে নিয়ে গেলেন আমাদেরও পরিশ্রমটুকু ছেঁকে নিয়ে।
  • bublee | 71.106.244.161 | ২২ নভেম্বর ২০০৮ ১২:৫৬405019
  • কতক্ষন ঘুমিয়েছি জানি না, হয়ত ঘন্টা দু'য়েক বা তারও কম। পাশে আমার কন্যার কাঁপুনীর চোটে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঠান্ডার চোটে ব্যাচারা ঠক্‌ঠক করে কাঁপছে! ঘুম ভাঙ্গতে বুঝলাম কি অসম্ভব ঠান্ডা। পরষ্পরের শরীরের যত কাছাকাছি থাকা যায়, ততটা ঘেঁষাঘেষি করে ঠান্ডা একটু কম লগলো ক'য়েক সেকেন্ডের জন্য মাত্র। এই পাহাড়ের মধ্যে তাঁবুর নীচে সারারাত এরকম ঠান্ডা সহ্য করে কি করে থাকবো কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। শুয়ে শুয়ে মনে হলো পীঠের নীচে ঠান্ডা লাগছে, উঠে বসা হলো সবাই মিলে। বসতে গিয়ে দেখি ঘাড় নাড়তে পারছি তো পা নাড়তে পারছি না, পা নাড়াতে পারছি তো হাত শক্ত হয়ে জমে গেছে! প্রকৃতির হাতে নিজেকে এত অসহায় আর কখন মনে হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। আমার হিরোকে বললাম যে, বাইরে থেকে প্রোপেন স্টোভটা নিয়ে এসে ভিতরে জ্বালিয়ে বসব। অত্যন্ত অন্যায় আবদার। কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিং হতে পারে, জামাকাপড়ে আগুন ধরে যেতে পারে, কিন্তু ঠান্ডার কাছে হাতে অন্য কোনো যুক্তি খাটল না। টেন্টের জানালা একটু ফাঁক করে দিয়ে দু হাত আর দু পা দিয়ে শক্ত করে ধরে বসে স্টোভ জ্বালানো হলো উষ্ণতা পাবার জন্য। মিনিট দশেক জ্বালিয়ে রেখে বন্ধ করা হয়েছে। ঠান্ডা সহনীয় হয়েছে তারপর আধা ঘন্টা বা পয়তাল্লিশ মিনিট। তারপরে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আগুন যখন জ্বলছে, ক্লান্তিতে, আরামে ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু বিপদের ভয়ে ঘুমনো যাচ্ছে না। ভয়ে ভয়ে আগুন বন্ধ করে দিয়ে হচ্ছে। ফলে আবার ঠান্ডা! বাইরে অন্যান্য ক্যাম্পে সকলের ঘুম জড়িত, ক্লান্তিমাখানো গলা শোনা যাচ্ছে। সারারাতে সমস্থ ক্যাম্পের কেউ ঘুমায় নি ঠান্ডায়। কখন আলো ফুটবে, তার অপেক্ষা করতে করতে, ভোর হবার প্রতীক্ষায় কখন শুয়ে কখন বসে সারারাতটা কেটেছে। নিজেদেরকে বারবার কষ্ট করে বিশ্বাস করাতে হয়েছে যে, এই রাতটা আমাদের জীবনের শেষ রাত নয়, আগামীকাল রাতে হোটেলের ঘরে আরামে ঘুমাবো।

    ভোরের আলোর ছোঁওয়া লাগার সাথে সাথে অল্প অল্প করে ঠান্ডা কমতে শুরু করল। ঘুমাবার বৃথা চেষ্টা করে, আধা ঘন্টা পরে উঠে পড়লাম সবাই মিলে। তাঁবু থেকে বেরতে গিয়ে উপলদ্ধি করলাম যে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না! গত তিনদিনের গায়ের, পায়ের সমস্ত ব্যথা তাদের বন্ধু-বান্ধব সঙ্গে করে জুড়ে বসেছে, সারারাত ঠান্ডায় তাদের ভারী উপকার হয়েছে।

    বিলাসিতা করে গরম জল বসালাম হাত মুখ ধোবার জন্য। ছোটোবেলায় ব্রংকাইটিসের ধাত ছিল বলে মা ভোর বেলায় গরম জল করে দিত। তার কাছে সেটা তখন করা প্রয়োজনীয় ছিল। আজকে শখ করে এই পাহাড়ি ঠান্ডায় বেড়াতে এসে এত বছর পরে গরমজলে মুখ ধুতে গিয়ে কয়েক নিমেষে সারাজীবনটা ফ্ল্যাশব্যাকের মত চোখের সামনে ঝলসে উঠল। হঠাৎ মফস্বলের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া সেই আমির সাথে আজকের আমি নিজের মুখোমুখি অজান্তে দাঁড়িয়ে গেলাম । 'তোমার মহাবিশ্বে কিছুই হারায় না তো প্রভু'... ভিতরেরে শিকড়টা হঠাৎ রসজল পেয়ে বেশ পুষ্ট হয়ে উঠেছে।

    চা আর ব্রেকফাষ্ট খেয়ে তাঁবু গুটিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারলাম রওনা হলাম, বাকীরা ক্যাম্প থেকে বেরনোর আগেই। অসম্ভব অসুস্থ লাগছে। পা চলছে না। পিঠের বোঝা আজকে অবশ্য অনেক হাল্কা হয়ে এসেছে। শরীরে যে কষ্ট হচ্ছে তাকে আর ব্যথা বা ক্লান্তি বলা চলে না, সম্পুর্ণ অবসাদ। সান্তনার কথা এই যে, আজকেই উপরে উঠে যাব, তারপরে হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম; চিন্তার কথা এই যে, শেষের এই অংশটা সবচেয়ে বেশী কঠীন, গতকালের চেয়েও।
  • bublee | 71.106.244.161 | ২২ নভেম্বর ২০০৮ ১৩:৫৬405020
  • চলতে শুরু করলাম । ইন্ডিয়ান গার্ডেন থেকে বেরিয়েই ব্রাইট এঞ্জেল ট্রেইল-এর জেকব্‌স লেডার অংশটা শুরু। গতকাল আমরা ক্যাম্প করেছি টন্টো প্ল্যাটফর্মের ওপর। এরপরের অংশটাকে বলে সুপাই ফর্মেশন। টন্টো প্ল্যাটফর্ম আর সুপাই ফর্মেশনে ব্রাইট এঞ্জেল সেল দেখত পাওয়া যায়। সবুজ দানা দানা সেল পাহাড়ের গায়ে চুমকির মত আটকে থাকে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গঠনে অনেক কমপ্লিকেশন। আর এ সম্বন্ধে আমার বিদ্যেও বেশী নয়। প্রথমে জায়গাটা একটা সমুদ্র ছিল, তারপরে ভুমিকম্পে পাহাড় ঠেলে উঠেছে। পশ্চিমে একটা অংশে তখনও সমুদ্র, তাতে সামুদ্রিক প্রানীর বাস করত, তাদের ফসিল দেখতে পাওয়া যায় এখনও। এরপর কলরাডো নদীর কেদরানী তো আছেই। পাহাড়ের যে অংশটাতে আমরা প্রথম রাত ছিলাম, সেটা লাল আর কালো। কালোটা গ্র্যানাইট। লাল পাথরের মধ্যে কালো গ্র্যানইটের শিরা দেখেছি অনেক। মার্বেলিং।

    কি নাম রে বাবা! জেকব্‌স লেডার! এই সিঁড়ি করে নাকি স্বর্গের দেবদেবী বা এঞ্জেলরা ওঠানামা করে! আমার মত মানুষদের স্বর্গে বা নরকে নিয়ে যাবার জন্য নিশ্চয়। অথবা, ট্রেইলের এই অংশটা র নাম এই আশায় যে, এ পথে অনেক মানুষকে স্বর্গে পাঠানো যাবে! প্রাণ হাতে করে হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে উঠছি, এরমধ্যে একদল মানুষ খচ্চরের পীঠে করে, যাকে ইংরাজীতে মিঊল বলে, নীচে নামছে। এদের দেখলে পথ ছেড়ে দিয়ে দাড়াতে হয়। আগেও করেছি। এই দলটার শখের প্রান গড়ের মাঠ। অসম্ভব হট্টগোল করতে করতে নামছে। নামতে নামতে একবুড়ি হাসিমুখে জিঞ্জাসা করল, 'ইন্ডিয়ান? নাইস ড্রেস'! ইয়ার্কি হচ্ছে? ভয়ংকর একটা ভায়োলেন্ট চিন্তা মাথায় খেলে গেলো... এই মিউলটা আমার এক হাতের মধ্যে রয়েছে, এটাকে যদি আমি এখন কাতাকুতু দেই, তাহলে এটা হয়ত একটা লাফ মারবে, তার ফলে বুড়ি ছিটকে পড়বে খাতের দিকে। কিন্তু বেচারা খচ্চরটা! আহা! ওটার যদি কিছু হয়! থাকগে, বেচারা কৃষ্ণের জীব! তিনজনে মিলে রক্তচক্ষুতে এমন তাকিয়েছি যে, জেকব্‌স ল্যাডার ধরে যারা উঠছে এমন দেশী জনতার সাথে সে চিটচ্যাট করবে না, অন্তত মিউলের পিঠে বসে তো না।

    খানিকপরে আমার হিরোর মাথায় ঢুকেছে হঠাৎ , আমি যে গতিতে হাঁটছি তাতে তার কষ্ট হচ্ছে, আলো থাকতে থাকতে উপরে উঠা যাবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। সকালবেলা আমার শরীরে জড়তা থাকে বরাবরই। আমার আত্মবিশ্বাসে আমি জানি যে, আমি ঠিক সময়ের আগেই পৌছে যাব। জোরে হাঁটা আমার পক্ষে সম্ভব নয় আর ইচ্ছাও নেই, কেননা তাতে বিপদ বাড়বে। এক কথা, দু কথা, শেষে আমি বললাম, তুমি আগে এগিয়ে যাও, আমি পিছনে আসছি। আজকে দেখলাম আমার কন্যার কোনো অভিযোগ নেই, গতকালও ছিল না। মনে মনে আমি একটা ছোট্ট হলুদ রং-এর মাছ হয়ে গেলাম, বেশ ছড়ানো স্বচ্ছ সোনালী রঙের লেজ আর পাখনা নিয়ে, অনেকটা গোল্ড ফিশের মত মিষ্টি দেখতে, আর আমার হিরো আমার চোখের সামনে চক্‌চকে গোলাপী রঙের ওপর সাদা আর বেগুনী ফুলকাটা, ক্রিং ক্রিং ঘন্টিওলা, হাতলে ঝুলঝুলি লাগানো, সাদা বাস্কেট বসানো বাইসাইকেল হয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
  • bublee | 71.106.244.161 | ২২ নভেম্বর ২০০৮ ১৪:৫০405021
  • সুপাই ফর্মেশনের ওপরের অংশটাকে বলে রেড ওয়াল। লাল রঙের পাথর। পুরানো মন্দিরের চাতালে বসলে মাথার সমান যে অংশটাতে দেবদেবীর, বা কোনো যক্ষমূর্তির প্যানেল থাকে, রেড ওয়ালের নীচের অংশটাতে, মানে সুপাই ফর্মেশনের ঠিক উপরের অংশটাতে সেই রকম টেম্পল ফর্মেশন আছে। তারপরের অংশটা সোজা। রেড ওয়ালের এই পুরোটা উঠে এলে থ্রী মাইল রেষ্ট হাউস। ক্লান্ত শরীর ভরপুর মনে চারপাশটা দেখতে দেখতে উঠছি।

    এরপরে একটা জায়গায় দাঁড়ালাম একটু বিশ্রাম নিতে। নীচের থেকে শক্তপোক্ত শরীরের এক বৃদ্ধ উঠে আসছেন। আমার তো ঘাম হয় নি। এই ঠান্ডার মধ্যে ভদ্রলোকের নাক দিয়ে টপটপ করে ঘাম পড়ছে। মুখ হয়ে উঠেছে লাল। দাঁড়ানোর ইচ্ছে নেই তার। বললাম, হাঁপিয়ে পড়েছ। তোমার একটু ব্রেক দরকার। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্রেক আমার অনেক আগেই দরকার ছিল। বুঝলাম, পথের ব্রেকের কথা বলছেন না, জীবনে কোনো বড় ভুল সিদ্ধান্ত নেবার কথা বলছেন। সম্ভ্রমের সাথে পথ ছেড়ে দিলাম, ভদ্রলোক সামনে এগিয়ে গেলেন।

    খনিকবাদে মনে হলো, বাইসাইকেলটার খোঁজ করা উচিৎ। আমাদের এক মহিলা যখন পিছন থেকে পাশ করে যাচ্ছেন , তাকে বললাম আমার বাইসাইকেলটাকে থ্রী মাইল রেস্ট এরিয়ায় অপেক্ষা করতে বোলো। রাস্তায় বেরিয়ে আলাদা হতে নেই।

    অবশেষে, ধীরে সুস্থে জেকব্‌স ল্যাডার পেরিয়ে ধুলধুসরিত হয়ে যখন রেস্ট এরিয়ায় পৌছুলাম , তখন দেখি আমার বাইসাইকেল লোগো লাগানো সুপার হিরো পাহাড়ের উপর বসে আছে। জনে জনে এই বার্তা পৌঁছে গেছে... ডারউয়িনের বিবর্তনের ফলে মাছ থেকে মানুষে পরিণত হলাম খানিকবাদে।

    এখানে বসে লাঞ্চ খাওয়া হলো। বেলা প্রায় বারোটা বাজে তখন। খাবার খেয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে সুস্থ বোধ করলাম । খাবার পরে আমার সুপার হিরো তার আদরের ক্যামেরাটাকে চাতালের ধুলোর পরে রেখে কোথায় যেন গেল। আমি ধুলো থেকে তুলে একটা পাথরেরে উপর রাখলাম যাতে পড়ে না যায়। প্রায় চল্লিশ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। পরের দেড় মাইল এমন কিছু কঠীন নয়। কোনো জায়গাতেই অবশ্য তের প্রতি শতাংশর কম গ্রেড নেই। জেকব্‌স ল্যাডার পুরটাই ষোলো শতাংশ বা তার বেশী গ্রেড। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে কুড়িও হতে পারে।

    এরপরের অংশটাকে বলে কোকোনিনো স্যান্ড ষ্টোন। সাদা এই খাড়া পাথরের মাঝে মাঝে চলটা ওঠা খোদল। পুরো রাস্তার আর কলরাডো নদী দেখতে পয়েছি বলে মনে পড়ছে না। কলরাডো নদী তার নাম পেয়েছিল এক ইতালীয় পর্যটকের কাছ থেকে। ক-ল-রা-ডো যার মানে হচ্ছে কালার রেড। নদী তার প্রাণ শক্তিতে লাল পাহাড় কেটে ধুয়ে বয়ে নিয়ে চলেছে, তাইতে এই লাল রং। এই লাল রং থেকেই লাল নদী। উনবিংশ শতাব্দীতে বাবারা এই নদীতে বাঁধ দেয়েছেন, তারফলে একটি হ্রদ তৌরী হয়েছে। নদীর ধুয়ে নিয়ে আসা সেই লাল রং এই হ্রদের নীচে এখন জমা হচ্ছে। হ্রদের পরে নদীর রং সব্জেটে নীল যেটা এখান থেকে দেখা যায়।

  • bublee | 71.106.244.161 | ২২ নভেম্বর ২০০৮ ১৬:০১405022
  • ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে পৌছে গেলাম ওয়ান এন্ড হাফ মাইল রেস্ট এরিয়ায়। ধীরে শুস্থে অবশ্যই। এখানে এসে আমার সুপার হিরো জানাল যে তার ক্যামেরার ফ্ল্যাশ কাজ করছে না। মনে হয় ধুলো ঢুকেছে। যেমন আমাদের ফেলে একা একা আসার চেষ্টা! দাপাতে দাপাতে বাইসাইকেল হয়ে যাওয়া! মনে মনে, 'উদার ছন্দে পরমানন্দে বন্দনা করি তারে', মুখে বললাম, ফুঁ দিয়ে দেখলে হতো না? বলে, এখানে না।

    এখনও দেড় মাইল পথ আর সবচেয়ে কষ্টকর বলে শুনেছি। ষোলো প্রতি শতাংশ বা তার বেশী গ্রেড। কোকোনিনো স্যান্ড ষ্টোনের এই পরের অংশটাকে বলে কাইবাব স্যান্ড ষ্টোন।

    প্রথম যখন গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এসেছিলাম উনিশশ পঁচানব্বই সালে, তখন থেকে আমার এই ট্রিপটা করার ইচ্ছে। এত বছর বাদে আমার সেই স্বপ্ন পুরন হতে চলেছে আর দু মাইলের মধ্যে। শরীরে তখন শক্তি ছিল না, এসব করার জ্ঞানও ছিল না, একেবারে আনাড়ী। তার মধ্যে স্বপ্নের সাবসেটে আর একটা ছোট্ট নদীর সঙ্গে হাঁটার স্বপ্নটা ঢুকে গেছে। ভরপুর মনে হাঁটছি। শরীরের ক্লান্তির সাথে মনের প্রশান্তির কোনো মিল নেই। রাস্তার এই অংশটায় দিনে দিনে গিয়ে ফিরে আসার ট্রাফিক অনেক। অনেকেই আমাদেরকে ফেলে এগিয়ে গেছে। আমার একটুও প্রেষ্টিজে লাগছে না, কেননা আমার মত আর কারো এত বছরের স্বপ্ন এভাবে পুরণ হচ্ছে না।

    পৌঁছে গেলাম শেষের খাড়া অংশটাতে। দু'পা হেঁটে দুবার বসতে হয়। যতদুর চোখ যায়, লাইন ধরে পাহাড়ের গায়ে লোকজন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্রাম নেবার জন্য। পিছন থেকে আমার সুপার হিরো বলল, রতন বলেছিল, এই জায়গায় লোকে বাবার নাম ভুলে যায়। কথাটা শুনলাম, তারপরে ভাবলাম। বাবার নাম? হ্যাঁ, বাবার নামটা তো মনে পড়ছে, ভুলি নি। তারপরে আবার ভাবলাম, কিন্তু আমার নামটা কি? এক পা ফেলেছি, মনে পড়ছে না। দু পা! না, মনে পড়ছে না। তিন নম্বর! আরে আমার নামটা কি? চার নম্বর! দুত্তোর! পঞ্চম পদক্ষেপের ঠিক আগে নিজের নামটা মনে পড়ে গেল। যাক বাবা, ভুলি নি! এরপরে আরও গোটা দুয়েক সুইচব্যাক বা পাকদন্ডী। এবার আমার সুপার হিরো একতু এগিয়ে গেলো। অত:পর পৌছে গেলাম পাহাড়েরে প্রায় শেষ মাথায়। আমাকে একটু দাঁড়াতেই হবে, আমি আর পারছি না। একটু বসতে গিয়ে বাসের হর্ণ শুনতে পাচ্ছি। তাকিয়ে দেখি কখন ভিউপয়েন্টের রেলিং এর ধারে পৌঁছে গেছি বুঝিই নি। যে মহিলাকে বলা হয়েছিল আমার বাইসাইকেলটার খোঁজ করতে, সেই মহিলা আমার সুপার হিরোর পাশী দাঁড়িয়ে রয়ছে, তার সাথীদের আশায়। হেসে বলল, হোলো তালে? পেরেছ! ইউ মেড ইট!

    জীবনে আমার যত আনন্দ দিয়েছ জীবননাথ ........

    এই পুরো ট্রিপটা একটা অদ্ভুত স্পিরিচ্যূয়াল অভিঞ্জতায় মনের কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। বারবার মনে হয়েছে উপরে উঠে কোনো মন্দির দেখতে পাব।

    ধ্যানগম্ভীর এই যে ভূধর, নদী জপমালা ধৃত প্রান্তর,
    হেথায় নিত্য হের পবিত্র ধরিত্রীরে
  • rimi | 24.214.28.245 | ২৩ নভেম্বর ২০০৮ ০৭:৫২405023
  • আরে এই লেখাটা যে শেষ হয়েছে আগে খেয়ালই করি নি। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের নীচে নামা হয় নি বলে যে দু:খ ছিল তা অনেকটাই প্রশমিত হল লেখাটা পড়ে। তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ঘুরে এলাম।
  • Arpan | 208.57.131.4 | ২৩ নভেম্বর ২০০৮ ০৯:৪৯405024
  • বেশ ভাল লাগল। সজীব বর্ণনা ও পরিমিত রসবোধ।
  • I | 59.93.255.228 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ০৯:৫৯405025
  • কাজিরাঙ্গায় আসাম ট্যুরিজমের যে লজগুলি আছে, তাতে কলকাতায় আসাম ট্যুরিজমের অফিস থেকে বুক করা যায়? তাদের ভাড়া কিরকম (এখনকার)? আর ITDC-র লজগুলি? (একই জিজ্ঞাসা)
    এছাড়া আর কোনো ঠিকঠাক থাকার জায়গা আছে, preferrably 400-600 /double bed room-(আমাদের তিনটে চাই/অথবা 6-7জন থাকার মত কটেজ)?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন